শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

আমাদের কথা।। মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০




 

আমাদের কথা

আজ 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর জন্মদিন। সবাইকে প্রথমেই 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। ৭ বছর আগে শুধুমাত্র কলকাতা নয়, বাংলা ভাষাভাষী বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে আজকের দিনে, এই ১৫ আগষ্ট, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবসের দিনে আত্মপ্রকাশ করে 'মাসিক কবিতাপত্র'। বাংলা ভাষার নানা প্রান্তের কবিরা ছিলেন এই কবিতাপত্রটির সম্পাদক ও প্রকাশক।পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, ভারতের অন্যান্য রাজ্য, এমনকী বাংলাদেশের কবিরাও ছিলেন 'মাসিক কবিতাপত্র'-র সম্পাদক ও প্রকাশক।প্রতিটি সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায় এই সম্পাদক ও প্রকাশকদের নাম ঠিকানা ও মেল আইডি সহ প্রকাশিত হতো এবং সম্পাদকমণ্ডলীর যে কাউকে লেখা পাঠানোর আহ্বান থাকতো। আমাদের জানা নেই পৃথিবীর ছোটোপত্রিকার ইতিহাসে ইতিপূর্বে এরকম ঘটনা ঘটেছে কি না! কোনও একটি পত্রিকার সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে, উপদেষ্টা হয়ে অনেকেই যুক্ত থাকেন, বিনিময়-প্রথার মতো, নিজের অঞ্চলে পত্রিকাটি নিয়মিত বিতরণ ও প্রচার করলে সেই পত্রিকায় নিয়মিত লেখার সুযোগ পাওয়া যাবে, এমনকী পত্রিকাটি প্রকাশনা শুরু করলে সেখান থেকে কম খরচে নিজের বইপ্রকাশ ও নিজের অঞ্চলে তার শাখা-প্রতিনিধি হয়ে জেলা বইমেলা বা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় ওই পত্রিকাটির স্টল আগলানো ও নিজের বইবিক্রির অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া যায়। দীর্ঘকাল ধরে এই ব্যবস্থা চলে আসছে। লেখককবিরাও এই সূবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। 'মাসিক কবিতাপত্র' এই শাখা-প্রশাখা মূলক বিনিময়-প্রথায় প্রথম দিন থেকেই বিশ্বাস করেনি, আজও করে না। বিশ্বাস করে না গুরুবাদ-এ। তরুণতম কবির মস্তিষ্ক-প্রক্ষালনে।পুরনো সংখ্যাগুলি, 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর, দেখলেই পাঠক এ-কথার সারবত্তা অনুধাবন করতে পারবেন। সম্পাদকমণ্ডলীর বিভিন্ন জন আক্ষরিক অর্থেই বিভিন্ন সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন, স্বাধীনভাবেই, মেল-এ প্রুফ চালাচালি করে। কোনও বিশেষ তত্ত্ব বা গুরুবাদের ইজমকে পাত্তা না দিয়ে।কারণ, 'মাসিক কবিতাপত্র' শুধুমাত্র কবিতার কাছেই দায়বদ্ধ।  

'মাসিক কবিতাপত্র'-এর জন্মলগ্ন থেকেই কোচবিহার থেকে কলকাতা মালদা থেকে মুম্বই পুরুলিয়া থেকে বহরমপুর বাঁকুড়া থেকে বাংলাদেশ শিলিগুড়ি থেকে শান্তিনিকেতন বর্ধমান থেকে আগরতলা বাংলা ভাষাভাষী নানা অঞ্চল থেকে মোট ৩০ জন কবি যুক্ত থেকেছেন, আবার নানা কারণে সরে দাঁড়িয়েছেন সম্পাদনা থেকে, কেউ-বা প্রয়াত।আজ 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর জন্মদিনে সেইসব কবিবন্ধুদের আরেকবার নামোল্লেখ রইলো এখানে-- অনীক রুদ্রসিদ্ধার্থরঞ্জন চৌধুরিপ্রবীর দাসবিকাশ সরকারমোঃ নুরুল ইসলামশঙ্খশুভ্র দেববর্মণমাসুদার রহমানউমাশংকর বড়ুয়াবিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়সোমনাথ রায়অয়ন গোস্বামীগৌতম গুহরায়তাপস দততো, অসীম শর্মা, রাজকুমার রায়চৌধুরী, সুবীর সরকার, কৃত্তিবাস ঘোষনাসিম-এ-আলম, নিলয় রায়, মধুছন্দা মিত্র ঘোষ, অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়, রিমি দেঅনিন্দ্য রায়দীপঙ্কর বাগচীসূরজ দাশরাজন গঙ্গোপাধ্যায়,পার্থপ্রতিম আচার্যঅনুপম মুখোপাধ্যায়মণিশঙ্কর সান্যালশান্তনু বিশ্বাসপ্রণব চক্রবর্তীগোবিন্দ ধরইন্দ্রজি রায়দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিতাভ ঘোষাল, রতন পাল, উৎপল ফকির, দেবাশিস সাহা, রাজীব সিংহ। 

বলাবাহুল্য ছাপার হরফে এক থেকে দুই ফর্মা ছিল এই মাসিক কবিতাপত্রটির আয়তন। বিশেষ সংখ্যা অবশ্য আয়তনে বড়ো হয়েছে। অন্যান্য পত্রিকার যা হয়, স্বাভাবিক কারণেই 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সংঘ ভেঙে আবার সংঘ গড়ে ওঠা ছোটোপত্রিকার অন্যতম ধর্ম। যখন 'মাসিক কবিতাপত্র' কয়েকমাস বন্ধ, ১৮-তম সংখ্যা বিশেষ 'শক্তি চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা' হিসেবে বেরনোর পর, তখন এগিয়ে এলেন কবি সিদ্ধার্থরঞ্জন চৌধুরী, তাঁর প্রকাশনা সংস্থা 'উবুদশ' থেকে বেরোতে শুরু করলো আবার নিয়মিত 'মাসিক কবিতাপত্র'।যুক্ত হলেন আরও একঝাঁক কবি।২০২০-এর বইমেলায় ফেব্রুয়ারি-মার্চ যুগ্ম সংখ্যা বেরনোর পর সারা পৃথিবীর সঙ্গে ভারত তথা আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও 'লকডাউন' ঘোষণার পর এই নতুন 'সাপ্তাহিক অনলাইন'-এর আয়োজন। যদিও এপ্রিল ২০২০-তে 'মহামারী করোনার সময়ে' একটি বিশেষ সংখ্যা পিডিএফ আকারে আন্তর্জাল সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে সময়ের জীবন্ত দলিল হয়ে। আমাদের ওয়েবসাইটে সংখ্যাটি আছে। আগ্রহী পাঠক পড়তে পারেন সংখ্যাটি। অনুরোধ রইলো উপরের ভিডিওটি দেখবার, 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর নানাবিধ কর্মকাণ্ড সেখানে সংক্ষেপে ধরা রইলো।

যতদিন না ঠিকঠাক কলেজস্ট্রিট খুলছে, উবুদশ খুলছে, মাসিক কবিতাপত্র এভাবেই অনলাইনে। ততক্ষণ সাবধানে থাকুন। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও লেখক আমাদের সকলের শ্রদ্ধার জন হিরণ মিত্র, আমাদের প্রিয় হিরণদার আঁকা এতোগুলি ছবি আমাদের এই বিশেষ জন্মদিন সংখ্যার সম্পদ।হিরণদাকে আমাদের শ্রদ্ধা। তাঁর ভাষায় আমরা বলতে পারি, 'স্টে হোম, ক্রিয়েট আর্ট'।

তিনটি কবিতা ।। সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০




সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় ।। তিনটি কবিতা


লকডাউনের ডায়রী থেকে ১


আতঙ্কে কেঁপে উঠছি থেকে থেকে। 

ভয় হয় রাস্তার শূন্যতায়।

কতদিন আর কতদিন জানা নেই?

সে এক অদৃশ্য ঘাতক 

জানা নেই কোনদিক থেকে ছুটে আসবে মরণাস্ত্র 


নেই বিশল্যকরণী

চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়


কেমন আছে বৃদ্ধ মা বাবা?

ভোরের আলো?


নিজেকে এক খোলসের ভেতর জমাতে জমাতে

ঠিকরে আসে চোখ

মন ভোলাতে বেছে নিই বাহারী প্রসাধন।

নির্মল এক আকাশের কাছে

উগড়ে দিই ব্যর্থ যন্ত্রণা। 


চাল ডাল তেল নুন।

প্রয়োজন ব্যাস এটুকুই।

ঘরের ভেতর তিনটে গলার স্বর। জড়িয়ে ধরছে

ক্রমশ একে অপরকে...

আসলে বিষণ্ন মানুষ বড়ো দুর্বল। 

অনিদ্রার দুঃস্বপ্ন দেখে খোলা চোখে। যদি আর 

না পারি দিতে অন্ন জল? 



লকডাউনের ডায়রী থেকে ২



শূন্যতায় গায়ে আছরে পড়ছে হাওয়া

ত্রস্ত মানুষ ছুটে চলেছে ক্রমশ অন্ধ কোটরে।

দৃশ্য থেকে বহুদূরে, আলোহীন কূপের ভেতর

বাড়ছে দেহের উত্তাপ।

খাদ্য নেই, নিথর বাতাস…

মুখোশের আড়ালে লাল হয়ে ওঠা চোখ

ভয়াবহতায় হাহুতাশ করছে ঈশ্বরের দরবারে।


এ মৃত্যুভয় আমাকে নিয়ে যায় অদৃশ্য কবরে।

ভাতের গন্ধ নেই। স্পর্শ নেই।

আমরা ছিনিয়ে নিই আমাদের ভাগ

যারা অভুক্ত তারা আমাদের কেউ না!


বুকে পাথর রেখে চওড়া করছি পথ

নিষ্ঠুর জীবন।

ভেসে আসা পরিযায়ী চিৎকার 

চোখে জল,

ঢেকে দিই তুলোর বালিশের নীচে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে 

ঘর্মাক্ত মৃতদেহগুলোর ওপর!



লকডাউনের ডায়রী থেকে ৩



অসহায় আকাশ

কাতারে কাতারে নিঃশ্বাস ফেলছে তারা

একে অন্যের ঘাড়ে, 

দুমড়ানো মুচরানো শরীর

পায়ে হাঁটা বিস্তর পথ

ঘরে ফেরার কি কঠিন আকুতি!


তবু অসহায়। আমরা বড়ো অসহায়

পারছি না বাড়িয়ে দিতে হাত

এখন আর স্পর্শের ঋণ নেই

নেই মানবতার।

দুহাতে জড়িয়ে আছি শুধু নিজেদের

আগামী রাত্রির আতঙ্ক নিয়ে

হুঁশ নেই আর, 

কি রাষ্ট্র কি মানুষ কি প্রতিশ্রুতি

শুধু সত্য জীবন

নিজেকে আটক করে, পেরিয়ে যাওয়া 

আরো একটা দুর্বোধ্য পাহাড়!   


স্মরণঃ সুমিত চট্টোপাধ্যায় ব্রততী ঘোষরায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০



স্মরণঃ সুমিত চট্টোপাধ্যায়  ব্রততী ঘোষরায়


সুমিত চট্টোপাধ্যায় ।। আতঙ্ক

ঘরে ফিরে দরজায় তালা-- রাত-- বাইরে আতঙ্ক !
রাত-খাবারের শেষে ঘুম-- স্বপ্ন-- ওপারে আতঙ্ক !
মতামত-তর্কে জমে ওঠে-- আড্ডা-- বিতর্কে আতঙ্ক !

এমন একটা দেশ আমাদের-- মহীরুহের মতো আপনি
সামনে কুঠার এক প্রশ্নচিহ্ন যেন
অনবরত জানান দেয়-- আপনি কে ?

দীর্ঘ বাস-- মেলামেশা-- পড়শির চোখে অসীম সন্দেহ হঠাতই।
অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, এই কী তবে আতঙ্ক--
অজানা গোপন কোনও কারখানায় বানানো চতুর উদ্দেশ্যে ?



ব্রততী ঘোষরায়।।শব্দের ঘুঙুর

সোনালি উঠোনে শব্দের ঘুঙুর
মায়াদোলকে রোদ্দুরের ওঠানামা
সময়কে মুঠো করে প্রহর জানাচ্ছে এক দুই
এক প্রহর দুই প্রহর মায়াবৃত্ত ঘুরে যাচ্ছে

এখন অপেক্ষার সময়-- নীল ডানায় পাখি ভাসছে
হলুদ বেগুনি রঙে হাত ডুবিয়ে চরাচরও ভেসে যাচ্ছে
কচুরিপানার পাতলা পাপড়ি ভরা একটু বুনো জল
তারও ভালোলাগার মতো প্রহর আছে
সে ডুবজলে যত্নে রেখেছে অনেককিছু
ওপাশে কাঁটার মতো শিউরে ওঠা ঝোপ
সেখানে আলো মাখানো দুপুর
সোনালি উঠোন শব্দঘুঙুর বাজিয়ে সময়কে ডাকছে
রোদ্দুরের মায়াদোলকে কাছে আসছে দূরে যাচ্ছে
প্রহরের দল, গেঁথে রাখছে এক, দুই।



ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট/রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০




রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে



(গত সংখ্যার পর)

৫. ঝিমলিদি, মনা, মনার ঠাকুমা আর মুণ্ডমালিনী

এই শ্যাওলা-ধরা বারান্দার অনেকটা জুড়ে রান্নাঘর৷ দেওয়ালের এক ধারে ইট দিয়ে বাঁধানো দুটো পেল্লাই উনুন৷ হাত দিয়ে কয়লা ভাঙার দিন শেষ৷ উঠোনের কোনে কয়লা ভাঙার ঘরে এখন বস্তা ভর্তি কোক কয়লা আর ঘুঁটের জঙ্গল৷ কালো কালো ডিমের মতো কয়লা৷ জলে ভিজে গেলে বড়ি শুকনোর মতো মনার ঠাকুমা আঙিনায় চটের রোদে মেলে দিত সেইসব ডিম৷ কালো কালো ডিম৷ মনা আর তার ভাই নামতার সুরে ঠাকুমাকে রাগাতো---আঙিনায় কানাই বলাই/রাশি করে সরিষা কলাই৷ বালক-বালিকার সদ্যশেখা সহজ পাঠ মনার ঠাকুমাকে খেপিয়ে তুলতো৷ কাক খেদানোর ভঙ্গিতে ঠাকুমা গাছের ডাল হাতে ছুটে যেত ওদের তাড়া করে৷ বোধিকল্পদ্রুমের উঁচু ডাল থেকে যুবতী কাক চেঁচিয়ে উঠতো, কা---কা! বালক তখন চক দিয়ে খড়িওঠা মেঝেতে ছবি আঁকে খড়্গহস্তী মুণ্ডমালিনীর৷
জেলা স্কুলে যাবার সময় প্রতিদিন পায়ে পায়ে নেতাজী মোড়৷  ওই যে ঘটকবাড়ি, মজুমদার প্রেস, সারিসারি সার, কীটনাশক আর কাগজের দোকান, সাধনা ঔষধালয় ঢাকা, আশুবাবুর সরাফা, বোমকাকু-রামকাকুদের কুমোরটুলি, এইচ আহমেদের লটারি সেণ্টার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারি, নগদ এক লক্ষ টাকা প্রথম পুরস্কার, ফোয়ারা মোড়৷
জেলা স্কুলে যাবার সময় প্রতিদিন পায়ে পায়ে নেতাজী মোড়৷ বুক ডিপো, বুক হাউস, পেপার সিন্ডিকেট, নিউ কাগজ কালি...৷ অসময়ের ফলাহারী কালিকামূর্তির গায়ে মাটির প্রলেপ বোমকাকুর, খাকি স্কুলব্যাগ কাঁধে বালক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে--- চারহাতে চারটি অভিব্যক্তি করালবদনী মাতৃকার! বাড়ি ফিরে সেই খড়্গহস্তী মুণ্ডমালিনীর ছবি আঁকে কৃষ্ণেন্দু৷ প্রতিদিন নিয়ম করে৷ একদিন সেরকমই জেলা স্কুলে যাবার সময় পায়ে পায়ে নেতাজী মোড়৷ বন্ধুর সঙ্গে কৃষ্ণেন্দু৷ লোহার রেলিঙে ঘেরা নেতাজী মূর্তির সামনে কী ভিড় কী ভিড়! দুই জোড়া বালক পা সহসা থমকে দাঁড়ায় একে অন্যের হাত ধরে বালক দু-জন ভিড়ের ফাঁকে তাকায়, শ্বেতশুভ্র আবক্ষ নেতাজি মূর্তিটির কর্তিত মাথা দেখে সমস্ত শরীর জুড়ে একটা ঠান্ডা ভয় বয়ে যায়--- বালকের চোখের সামনে দুলতে থাকে করালবদনীর রক্তপিপাসু সেই ভয়ঙ্কর খড়্গ! সেই ভিড় থেকে হিসহিস স্বরে অনুচ্চকিত দুটি শব্দ শোনা যায়, নকশাল! নকশাল!

মায়ের কাছে জানতে চাইলে, প্রশ্ন করলে, মা ভীত চোখে বালকের মুখ চাপা দেয়৷ কয়েকদিনের জন্য কৃষ্ণেন্দুর একা একা বাড়ির বাইরে বেরনো বন্ধ৷ এমনকী বন্ধুর সঙ্গে স্কুলেও নয়৷ তার কানের ভেতর অনবরত বাজতে থাকে সেই ভিড়ের গুঞ্জন৷ এর আগে দিদির ইতিহাস বইয়ে কনিষ্কের ছবি সে দেখেছে, মুণ্ডবিহীন কনিষ্কের সেই ছবি৷ অথচ আজ প্রতিদিনের চেনা এই নেতাজী মূর্তি কর্তিত মাথায় কী ভয়ঙ্কর! এক অচেনা ভয় এসে গ্রাস করে তাকে৷ সে কোনও কাজে মন বসাতে পারে না৷  কৃষ্ণেন্দুর কানের ভেতর অনবরত বাজতে থাকে সেদিনের সেই ভিড়ের সেই গুঞ্জন৷ হিসহিস স্বরে অনুচ্চকিত দুটি শব্দ শুধু শোনা যায়, নকশাল! নকশাল!


মনাদের বাড়ি আর বালকের বাড়ি পাশাপাশি হলেও মধ্যিখানে এক প্রলম্বিত উদ্যান৷ মনাদের৷ কাঁটাঝোপ, গুল্মলতা, কচুবন, চোরকাঁটা পেরিয়ে৷ খিড়কি দিয়ে আরেক বাড়ির খিড়কি জোড়া৷ সেপথে সচরাচর কেউ যায় না৷ কিছু ধসে যাওয়া পতিত ঘর মনাদের৷ সেখানে সাপ-গিরগিটি-তক্ষক৷ যেন সোরা ও গন্ধকে মোড়া এক হিমযুগ৷ এক তীব্র মনখারাপ৷ কিছু ঘুঘু আর হাঁড়িচাচা৷ অচেনা অর্কিড৷
প্রায় হিংসুটে দৈত্যের বাগান বলা যায় এই মনাদের বাগানকে৷ অথবা বলা যায় মহাকাব্যিক আলোছায়াময় তপোবন৷ মহাকালদ্রুমের মতো মস্তো এক নিমগাছ মাঝখানে৷ গাছের উপরে তাকালে তার ডালে ডালে অনেক পাখির বাসা আর যত্নের খড়কুটো৷ আর এই প্রকান্ড গাছটির ঠিক নিচেই মনাদের রান্নাবাটি৷ ধুলো পাথরকুচি আর ঘাসের বাতায়ন৷ ন্যাকড়ার পুতুলের ঘরসংসার৷ 
দূরে দূরে সুপুরি, বেল, কাঁঠাল, পেয়ারা, আতাগাছ, কচু, সবেদা, সন্ধ্যামণি...৷ দক্ষিণ কোণের ঘরে টাইপরাইটার, সাইক্লোস্টাইল৷ পিটিআই রিপোর্টার সুধীর জ্যেঠু আর তাঁর একান্ত ডার্করুম৷ ছোটো একফালি বারান্দা-ঘেরা একখানি ঘর৷ ঘরের জানালার বাইরে নানা ধরনের ডাকটিকিট আর ফেলে দেওয়া কাগজের রাশি৷ ডাকটিকিটের লোভে একটি বালক, কৃষ্ণেন্দু, মনার ভাইয়ের হাত ধরে ভয়ে ভয়ে খাম থেকে ডাকটিকিট ছিঁড়ে নিজের খাতায় সাঁটে৷ ওদিকে অনেকগুলি বাথরুম৷ লম্বা লম্বা কলাবতী গাছ৷ ফলসা আর করমচা৷ মনাদের খরগোশের পিছু নিয়ে একদিন বালকটি গুটি গুটি পায়ে ভর সন্ধ্যায় সেইদিকে৷ বাড়িতে বাড়িতে তখন সন্ধ্যাকালীন শাঁখ বাজছে৷
---‘এই তুই শিব হবি? আমি মা কালী...!’ 
মনার সেই সম্পর্কিত দিদি, ঝিমলিদি সন্ধ্যার গোধূলি আলোয় খুলে ফেলেছে তার ফ্রক৷ নগ্ন ফরসাবুকে দুটি গোলাপি গম্বুজ৷ অনতিউচ্চ, ঘামে ভেজা৷ 
---‘কিরে? ভয় কিসের? এদিকে আয়---৷ মা কালীকে কি শিববাবা ভয় পায়? দেখিসনি!’ ঝিমলিদির চোখমুখ আরও ভয়ঙ্কর৷ কেমন যেন নিশিতে পাওয়া৷
ভয়ে বালক একছুটে সেখান থেকে পালিয়ে যায়৷ পাগলের মতো দৌড়তে শুরু করে৷ ঘাস, চোরকাঁটা, পাথরকুচি পেরিয়ে দৌড় দৌড়৷ সেদিন রাতে প্রবল জ্বরের মধ্যে বালক স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল মুণ্ডমালিনীর সেই ভয়ঙ্কর মুখ৷ শুনতে পেয়েছিল রক্ত জল করে দেওয়া সেই কাতর আবেদন, ‘কি রে, তুই শিব হবি? আমি মা কালী!’


বিয়ের রাতে ঝিমলিদি খুব সুন্দর সেজেছিল৷ মায়ের কোলে কৃষ্ণেন্দু জেগে বসেছিল বরকে দেখবে বলে৷ অথচ গভীর রাতে আসরে যখন বর এল তখন ও ঘুমে কাদা৷

এরপর থেকে মনাদের বাগান কেমন যেন শুকিয়ে যেতে লাগল৷ ঝিমলিদির বিয়ের পর পাখিরাও এখন আর সুর করে ডাকে না৷ বোধিকল্পদ্রুমের উঁচু ডাল থেকে যুবতী কাক আর ‘কা---কা!’ করে চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে না৷ মনার ঠাকুমাও আগের মতো আর কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকে না৷ মনাদের পুতুলের বিয়ে, রান্নাবাটির সংসার, এক্কা-দোক্কা আগের মতোই নিয়মিত চললেও কাউকেই, এমনকী মা-কেও বালকের কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি, 
---ঝিমলিদির বরকে দেখতে কেমন? শিববাবা? 


কাকিমা, মানে মনার মা একদিন বিকেলে হসপিটালের ডিউটি থেকে আর ফিরলো না৷ মনা আর তার ভাই কেঁদে কেঁদে সারা৷ পাড়ার মাতব্বরদের মিটিং৷ গোলটেবিল৷ বালকও শুনলো অমিতাভ বচ্চনের মতো কানঢাকা চুলের পাড়ার বাবলুকাকুর কথা৷ মনার মায়ের পাশাপাশি বাবলুকাকুকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ মনার বাবা বিকেল থেকে চুপ৷ কোনও কথাই যেন কোথাও নেই৷ ছিল না৷ হঠাৎই, মাতব্বরদের সেই উচ্চকিত মিটিং-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনার ঠাকুমা সবাইকে চলে যেতে বললো৷ অনেকদিন পর বালক স্পষ্টতই ঠাকুমার হাতে সেই কাক খেদানো গাছের ডাল যেন দেখতে পেল৷ যুবতী কাক, শশব্যস্ত, ডেকে উঠলো, কা---কা!


৬. একটা ল্যাম্পোস্ট, তীব্র আলো ঝরানো হ্যালোজেন আর একটা রোগা গলি 

সারারাত বৃষ্টি৷  শনশন্ হাওয়া আর ঝিপঝিপ্ ঝমঝম্৷ এই রোগাগলির দুই ধার ধরে জলের ধারা৷ খলবল খলবল৷ দ্রুতগতিতে উল্টোদিকে ছুটছে৷ ছোটো ছোটো ঢেউ৷
অথচ সমস্ত সকাল জুড়ে কেমন মনখারাপ৷ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নরম এক আলো আর ভেজা ভেজা আঁশটে গন্ধ৷ সকালে বৃষ্টি নেই কোনো৷ পাখির ভাঙা ডিম, ভাঙা বাসা আর ইতঃস্তত গাছের ভাঙা ডাল ছড়িয়ে রাস্তায়৷ ভেজা, বিপর্যস্ত কাক জানলার কার্নিশে চঞ্চু ঘষে নিজেকে প্রস্তুত করছে৷
দূরে কলতলায় মেয়েদের ভিড়৷ বুক পর্যন্ত বাঁধা সায়া৷ ভেজা, বিপর্যস্ত৷ একে অন্যের পিঠে সাবান ঘষে দিচ্ছে৷ অলৌকিক বুদ্বুদের মতো সেই ফেনা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে৷ আঁশটে গন্ধের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সাবানের সুগন্ধি৷
গলিপথে ধীরে ধীরে রোদ ঢোকে৷ পুরনো বাড়িগুলোর স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা তক্ষক সহসা বাইরে আসে৷ শ্যাওলামাখা দরজার পাশে বসে একটি বালক রাস্তার ধারের খলবলে জলের ধারায় অভ্যাসবশত কাগজে তৈরি নৌকো ভাসায়৷ একটার পর একটা৷ তরতরিয়ে ভাসতে থাকে দুলতে দুলতে৷ কোনওটা আবার জল ভরে ডুবে যায়৷
কিন্তু যাদের রান্নাঘর নেই কিন্তু বিছানা আছে, সেই শীলামাসি রত্নামাসিরা প্রতিদিন সকালে জুবলি রোড মোচ-ফরাক্কার চা-দোকান থেকে স্টিলের গ্লাসে চা আর কাগজে জড়ানো বিস্কুট নিয়ে এই গলিপথ দিয়ে ফিরে যায়৷ ফিরে যায় কলতলা৷ মেয়েলোকেদের গায়ে-পড়া ঢলাঢলি, কলকাকলি, সারারাতের ক্লান্তিনিবারণী স্নান আর অলৌকিক সাবান-বুদ্বুদের রহস্যময় আলো-আঁধারিতে৷
আকাশের অনেক উঁচুতে বাবলুকাকু লাটাই থেকে নির্দ্বিধায় তার ঘুড়িকে উড়ে যেতে দিত৷ অনেক শীতের দুপুরে বালক দেখেছে তার পাশে দাঁড়িয়ে৷ আকাশের নরম রোদ পেরিয়ে, অসীম নীল পেরিয়ে টানটান সূতোয় ঘুড়িটা কোন্ উঁচুতে গিয়ে স্থিতপ্রজ্ঞের মতো পতপত করে উড়তো৷
---‘নে-নে, ঢিল দিবি৷ লাটাই থেকে সুতো ছেড়ে যাবি যতক্ষণ উড়তে চায়’৷ 
বালকের হাতে লাটাই ধরিয়ে বাবলুকাকু রেলিঙের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে সিগারেট জ্বালায়৷ অমিতাভ বচ্চনের মতো কানঢাকা চুলের বাবলুকাকু৷ সেদিকের গলিপথ দিয়ে তখন ঘরে ফেরে শ্বেতশুভ্র অ্যাপ্রন, সিস্টার, আমার কাকিমা৷ মনাদের মা৷


৭. কুয়াশাভ্রমণ

ফ্রাঞ্জ কাফকার মতো বন্ধুভাগ্য কৃষ্ণেন্দুর নেই৷ অন্তত থাকলেও কৃষ্ণেন্দুর  তা জানা নেই৷  কাফকাও জানতো না যে সে চলে গেলে ম্যাক্স এতো সব কাণ্ড ঘটাবে! কাফকার পক্ষে জানা সম্ভবও ছিল না৷ গ্রিগর যেভাবে মা-বোন সকলের কাছে শেষপর্যন্ত পোকামাত্র হয়ে গেল তা গ্রিগরেরও জানা ছিল না৷ তার অফিসের বস, কলিগ, বন্ধু কেউই তাকে কখনও মানুষ পদবাচ্য মনেই করেনি৷ বালক যুবক হলে একদিন তারও একটা কর্মক্ষেত্র হয়৷ কলিগ, বস, বন্ধু, প্রেমিকা--- দূর থেকে হাততালি দিয়ে সম্মতি জানাতে ইচ্ছে করে তার গ্রিগরকে৷ তার কিছু কিছু বন্ধুকে এখন টিভিতে, শর্টফিল্মে দেখা যায়৷ কেউ টক শো-তে তর্ক করে৷ কেউ গান গায়৷ কেউ সিনেমা বানায়৷ কেউ আবার অভিনেতার ভূমিকায়৷ ম্যাক্স ব্রডের মতো কৃষ্ণেন্দুর কোনও বন্ধু নেই৷ কাফকারও ছিল না৷ জীবনানন্দের তো তবু সঞ্জয়বাবু ছিলেন, ম্যাক্স ব্রড ছিল না!

দেখিনি কী আলোজ্বলা খোপ খোপ ঘর, পাশাপাশি পেতে রাখা বেড, বুকসেল্ফ, ভাঙা আলনা-ওয়ার্ড্রোবের মুখোমুখি দড়িতে টাঙানো পরিত্যক্ত জিন্স্, ছেঁড়া শার্ট বা বার্মুডার ভিড়!  চটা-ওঠা দেয়ালে চারকোল ও পোস্টার কালারে আঁকা হিজিবিজি শ্লোগান ও ছবির কোলাজ! বেডের তলায় গড়াগড়ি ঠাণ্ডা ও গরম পানীয়ের ঝুলমাখা বোতল৷ রাত জেগে কাটানো স্টাডি-লিভ এবং শীতরাতে উষ্ণ চায়ের সন্ধানে হস্টেল থেকে পঞ্চাননতলা পর্যন্ত কুয়াশাভ্রমণ! তবু তো নির্বিকার জেলাগুলো বছর বছর মেধাবীদের ঠেলে দিচ্ছে ভিড়ে ঠাসা মহানগর আর হঠাৎই জল হয়ে ঝরে যাওয়া গ্লেসিয়ারের মুখে৷ চিরন্তনের কেরিয়ারগ্রাফে৷
 
প্রত্যেক প্রজন্মেরই এমন একটা সময় থাকে যখনও পর্যন্ত যূথবদ্ধতার জন্য জীবনকে বাজি রেখে লড়ে যেতে পারে তারা৷ বন্ধু, বন্ধুতা, প্রেম তখন আর শব্দমাত্র নয়, জীবনের সঙ্গে যুঝতে থাকার অনিবার্য অবলম্বণ হয়ে তাকে প্রতিনিয়ত পোড়াতে থাকে৷ আর এই দহনবেলায় পুড়তে পুড়তে সে হঠাৎ একদিন নিজেকে আবিষ্কার করে মধ্যরাত্রির নিয়ন আলোয় ভেজা জনমানবহীন এক অচেনা দীর্ঘ হাইওয়ের উপর৷ একা৷ সঙ্গীহীন৷ তার চারপাশ দিয়ে সাঁ-সাঁ শব্দে ছুটে যাচ্ছে নানা ধরনের চতুশ্চক্রযান৷ বিষাদ মাখানো সেই রাতে নিজেকে ঠেলতে ঠেলতে কোনও মতে চৌমাথার অচেনা আইল্যান্ডের রেলিঙে দাঁড় করানো৷ নিয়নের সোনালি আলোয় হাইওয়েটা তখন দীর্ঘদেহী অ্যানাকোন্ডার মতো হিসহিস করছে৷ পা পিছলে যেতে পারে বলে কোনও মতে আইল্যান্ডের রেলিঙ ধরে আগ্রাসী ট্যুরিস্টের মতো মোবাইল তাগ করে তুমি সেলফি তুলছো৷ ঠিক যেরকম যাবতীয় যূথবদ্ধতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত লেখার টেবিলে তুমি শেষমেশ একা৷ একা আসলে সমগ্র প্রজন্মটাই৷ নিজেদের লিখনভঙ্গি ঠিক করবে নিজেরাই নাকি টোপ ফেলে রাখা প্রাতিষ্ঠানিক অন্নজলে নিজেকে নধর করবে রাত্রিদিন! এইসব দ্বিধাদীর্ণ সময়ে ক্রমাগত অচেনা হতে থাকে রাস্তারা৷ ঝিলপাড়৷ বন্ধুমুখ৷
 
একটার পর একটা ঠিকানা বদল হয়৷ তুমি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকো স্বর৷ নতুন কণ্ঠস্বর৷ সময় পেরিয়ে যায়৷ ফুটপাথ বদল হয়ে জেগে ওঠে হিমশীতল আইনক্স, সারি সারি গদি-আঁটা চেয়ার, হাতলের গর্তে ঠাণ্ডা পানীয়, সুরভিত উষ্ণ পপকর্ন, এসকালেটর পেরিয়ে সারি সারি ঝুলে থাকা নারী, পুরুষ ও শিশুপোষাক, বাহারি মল, তাহাদের কসমিক প্রেম৷ তবু তুমি খুঁজতে থাকো৷ এই অবসরে কেউ টুক করে প্রতিষ্ঠা পেল৷ চাকরি৷ বাড়ি-গাড়ি-রাজকন্যা৷ কারো কারো বই বের হল৷ বুকস্টলের নরম আলোয় সেইসব বইয়ের উদ্ধত স্পাইন অচেনা ঠেকে খুব৷ চায়ের দোকানে, আড্ডার লবিতে, কফিহাউসে, পানশালার টেবিলে একই কলকাকলি একঘেয়ে করাতকলের শব্দের মতো মাথার ভেতরে ঘুসঘুস করতে থাকে৷ মেলা, আড্ডা, মফসসল সর্বত্রই সেই একঘেয়ে ঘষঘষ-ঘুসঘুস৷ আসলে একটা নতুন কোনও কিছু৷ মগ্নতা বা তারও বাইরে আরও অন্য কোনও কিছু৷ বাউল তার সমস্ত প্যাশন তখন ঢেলে দিচ্ছে ফুরিয়ে আসা রাত্রির শেষযামে নানান বিভঙ্গে, মগ্নচৈতন্যে৷ অথচ আখড়ায় সকলের মাঝে বসে তখনও তুমি বান্ধবীর গলার রবীন্দ্রগানকে অতিক্রম করতে পারছো না৷ কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছো না সেই আনত গ্রীবার অনির্বাণ ঔজ্জ্বল্য৷ ভিড়ের ভিতর থেকেই উঠে এসেছিল সেই অমোঘ সত্য৷ আসলে কিছুই কিছু না৷ নিজস্ব স্বর অর্জন করাটাই শেষ পর্যন্ত শেষ কথা৷
 
এই পথে নোটবন্দি সময়ে গ্রিগরের বন্ধুরা বালকের সঙ্গে পেটাই পরোটা খেত রোজ৷ তারপর চা৷ সিগারেট৷ কলোনি বাজারে লকাই পেটিএম ছাড়াই কাতলা মাছের পেটি রোজ ওজন করতো৷ মিহিরের দোকানে কোনও খাতা ছাড়াই গ্রিগর ডিম, পাউরুটি আর মাখন কিনতো৷ এটিএমের সামনে মানুষদের লম্বা সর্পিল লাইন তখন রোজ৷ কোনও কোনও পোকা সেই লাইনে হঠাৎ দাঁড়ালে মানুষরা তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিত৷  ফ্রাঞ্জ কাফকার মতো বন্ধুভাগ্য ওই পোকাদের একদমই নেই৷ বিউটিফিকেশনের কাজ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত ওই পোকাদের কারও কারও সঙ্গে লালকা পুকুরের ধারে আমোদী, কই অথবা ট্যাংরা মাছ কিনতে গিয়ে কৃষ্ণেন্দুর দেখা হত৷ কৃষ্ণেন্দু এখন বাস নয়, অটো নয়, রিক্সোয় যাতায়াত করে৷ এক রিক্সো থেকে আরেক রিক্সো, আরেক রিক্সো থেকে...

ফ্রাঞ্জ কাফকার মতো বন্ধুভাগ্য কৃষ্ণেন্দুর কখনও ছিল না৷



৮. সাঁওতাল পরগনায়

পাহাড়ি টিলা আর শালবনের ঘন জঙ্গলে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে চাঁদ৷ জ্যোৎস্নার নিবিড় বিস্তার৷ শেষ-ট্রেন চলে গেছে৷ কুপি-জ্বলা হাটের গভীরে ফুলুরি জিলিপি আর মহুয়ার গন্ধ৷ ইতঃস্তত ছড়িয়ে থাকা শালপাতায়, পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ দিয়ে গড়িয়ে যায় হ্যান্ডেলে ব্যাটারির হেডলাইট লাগানো সাইকেল৷ এখানে তীব্র এখন হ্যাজাকের আলো৷ বাদামি৷ ইঙ্গিতপ্রবণ৷ ফুলকপি, রাঙালু, বরবটি, শাকালুদের ঝুড়িতে উড়ে বেড়াচ্ছে জোনাকির আলো৷ শীতের তীব্রতা হাটুরেদের ফিরতি পথে তীব্রতর আরও৷ 

মিস্রাজীর সঙ্গে সাউজীর তুমুল আড্ডা৷ দড়ির খাটিয়ায় প্রতি সন্ধ্যায় খঞ্জনি বাজিয়ে তুলসিদাসী ভজন৷ ধূপ ও কর্পূরের আরতি৷ আর রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে রেডিওয়৷ দূর থেকে শোনা যায়৷ বিনাকা গীতমালায় ঝুমরিতালাইয়ার অনুরোধে গান বাজছে, মোহে আঈ না জগসে লাজ...৷ নিলাজ সেই নারীর মতোই এখন পাহাড়ের এ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খাটো ডুরেকাটা শাড়ি পাথরে খোদাই সেই নারীমূর্তির রক্তে-মাংসে কামোন্মাদ এক পশুকে ডুবে যেতে দেখছে কৃষ্ণেন্দু৷ সমস্ত ‘জগ’ তখন দিশাহারা৷ পাহাড়ের মতো সেই পাথুরে শরীরে তখন জ্যোৎস্নার নগ্ন আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে৷ মাঘের অপ্রতিরোধ্য শীত তখন মহাশূণ্যে ইশারাপ্রবণ৷ ছোট্টো রেলস্টেশনের পাশে কনভেয়র বেল্ট জড়ানো দানবীয় যন্ত্রদুটি প্রবল শব্দে তখনও কুচি কুচি করে দিচ্ছিল কালো পাথরের রক্ত, মাংস৷
 
কৃষ্ণেন্দুরা একই সঙ্গে বড়ো হচ্ছিল৷ গায়ে গা৷ ডিসেম্বরের লম্বা ছুটিতে রঙবেরঙের উলের সোয়েটার৷ টবের চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, গাঁদা বা দোপাটির রাশি কৃষ্ণেন্দুদের ছাদ থেকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিল৷ থানাপাড়া পেরিয়ে ছোটো রাজবাড়ি, বড়ো রাজবাড়ি৷ কৃষ্ণেন্দুদের হাতে দহনপর্বকালীন পোড়াগন্ধ, ছাইয়ের কালো দাগ লেগে আছে৷ 
ওরা একটু একটু বড়ো হচ্ছিল৷ এক সঙ্গে৷ ছুট ছুট অবিশ্রান্ত ছুট৷ ছুটতে ছুটতে যে কোনও ট্রেন কলকাতা অভিমুখী৷ শীতের দুপুরে ছাদের ওপর বিস্ফারিত চোখ চন্দ্রমল্লিকা সুর্যমুখী আর গাঁদার ছানাপোনারা৷ ডাঁই করে রাখা খড়ের গাদায় বয়ঃসন্ধি৷ ঠোঁট ছড়ে গেলে বোরোলীন, আহা বোরোলীন! তুমি কী আহত শার্দুল, বালক, সেইদিন অচেনা স্টেশনে! সঙ্গী কাজিন, তোমার অনুজ কী বুঝেছিল মাঘদুপুরের অভিশপ্ত ইশারা! পাঞ্জাবী ধাবায় রুটি-তড়কা, নিরুপায়ের গ্রাসাচ্ছাদন! বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে এতো এতো এক্সপেরিমেণ্ট শেষে ঋতুপর্ণ ঘোষ মান্যতা দিল উৎসব সিনেমায়৷ তাও প্রায় দেড়-দু দশক পরে৷ 

অবশেষে রাত্রি গড়ায় এসে নির্জন অচেনা স্টেশনে৷ নকশাল আন্দোলন নিয়ে যারা বই লিখেছিল কৃষ্ণেন্দু তাদের লেখা কিছু কিছু পড়েছে৷ কিছু কিছু কৃষ্ণেন্দুর অনুমান ও অভিজ্ঞতা৷ শ্রেণীশত্রুরা এসে লুকোয় তোমার আড়ালে৷ রাঙামা৷ তুমি তাদের মাশরুম কারি রান্না করে ভাত খাওয়াও৷ কলকাতা থেকে অনেক দূরে সাঁওতাল পরগনায়৷ লিন পিয়াও লিন পিয়াও৷ রামপুরহাট থেকে সাঁইথিয়া হয়ে একটি স্টিম-এঞ্জিন কৃষ্ণেন্দুদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল শিয়ালদায়৷ তোমরা দুই কাজিন, বালক, দুই ভাই, বয়ঃসন্ধি থেকে পরস্পরবিরোধী৷ সাহিত্যচর্চার আড়ালে একে অন্যকে বুঝতে দাওনি৷ রাঙামা বুঝতো৷ তোমাকে জন্ম না দিলেও, হে বালক, তোমার প্রতি যে স্নেহপরবশ অধিকারবোধ, রাঙামা অনেক উন্মার্গগামীতায় তোমাকে সময় দিয়েছে৷ সেই সঙ্গ, যা তোমার আজন্মলালিত৷ অথচ সাঁওতাল পরগণার সেই অচলিত গ্রাম থেকে, ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে তোমাকে অনুভব করতে চেয়েছিল একজন৷ বাড়িতে, আত্মীয়স্বজনদের কুচকাওয়াজ থেকে যখন তুমি পিছিয়ে যাচ্ছিলে সমস্তদিন৷ শুধু তোমার বদলে বদলে যাওয়া গৃহকোণে কৃষ্ণেন্দু কোনওদিন একটি ধূপ অথবা মোমবাতি জ্বালাতে পারোনি তুমি রাঙামার স্মৃতিতে৷ বাঘাযতীন থেকে তোমাদের ছোটোমেসো পালিয়ে গিয়েছিল সেই সাঁওতাল পরগণায়, রাঙামার কাছে৷ তুমি শুধু তুকতাক আর মাদারির খেলা দেখছিলে সেদিনের কলকাতায়৷ 

(এরপর আগামী সংখ্যায়)

ফিরে দেখাঃ জন্মদিনে সুকান্ত ভট্টাচার্য

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০


ফিরে দেখাঃ জন্মদিনে সুকান্ত ভট্টাচার্য



সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর কবিতা

মধ্যবিত্ত '৪২ 
পৃথিবীময় যে সংক্রামক রোগে,
আজকে সকলে ভুগছে একযোগে,
এখানে খানিক তারই পূর্বাভাস
পাচ্ছিএখন বইছে পুব-বাতাস।
উপায় নেই যে সামলে ধরব হাল,
হিংস্র বাতাসে ছিঁড়ল আজকে পাল,
গোপনে আগুন বাড়ছে ধানক্ষেতে,
বিদেশী খবরে রেখেছি কান পেতে।
সভয়ে এদেশে কাটছে রাত্রিদিন,
লুব্ধ বাজারে রুগ্ন স্বপ্নহীন।
সহসা নেতারা রুদ্ধদেশ জুড়ে
'দেশপ্রেমিকউদিত ভুঁই ফুঁড়ে।
প্রথমে তাদের অন্ধ বীর মদে
মেতেছি এবং ঠকেছি প্রতিপদে;
দেখেছি সুবিধা নেই এ কাজ করায়
একক চেষ্টা কেবলই ভুল ধরায়।
এদিকে দেশের পূর্ব প্রান্তরে
আবার বোমারু রক্ত পান করে,
ক্ষুব্ধ জনতা আসামেচাটগাঁয়ে,
শাণিত-দ্বৈত-নগ্ন অন্যায়ে;
তাদের স্বার্থ আমার স্বার্থকে,
দেখছে চেতনা আজকে এক চোখে।।


হে মহাজীবন 
হে-মহাজীবনআর এ কাব্য নয়
এবার কঠিনকঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেইকবিতার স্নিগ্ধতা—
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি॥


ছাড়পত্র
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিতউদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসেকেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশুতাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থমৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক'রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।।




কনভয় 
হঠাৎ ধূলো উড়িয়ে ছুটে গেল
যুদ্ধফেরত এক কনভয়ঃ
ক্ষেপে-ওঠা পঙ্গপালের মতো
রাজপথ সচকিত ক'রে
আগে আগে কামান উঁচিয়ে,
পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার।
ইতিহাসের ছাত্র আমি.
জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম
ইতিহাসের দিকে।
সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয়
ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে।
সামনে ধূম-উদ্গীরণরত কামান,
পেছনে খাদ্যশস্য আঁকড়ে-ধরা জনতা-
কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়ালে দেখলাম,
মানুষ।
আর দেখলাম ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক
মমতা।
অনেক যুগঅনেক অরণ্য,পাহাড়সমুদ্র পেরিয়ে
তারা এগিয়ে আসছেঝল্‌সানো কঠোর মুখে।।


সিগারেট 
আমরা সিগারেট।
তোমরা আমাদের বাঁচতে দাও না কেন?
আমাদের কেন নিঃশেষ করো পুড়িয়ে?
কেন এত স্বল্প-স্থায়ী আমাদের আয়ু?
মানবতার কোন্ দোহাই তোমরা পাড়বে?
আমাদের দাম বড় কম এই পৃথিবীতে।
তাই কি তোমরা আমাদের শোষণ করো?
বিলাসের সামগ্রী হিসাবে ফেলো পুড়িয়ে?
তোমাদের শোষণের টানে আমরা ছাই হই:
তোমরা নিবিড় হও আরামের উত্তাপে।
তোমাদের আরামঃ আমাদের মৃত্যু।
এমনি ক'রে চলবে আর কত কাল?
আর কতকাল আমরা এমনি নিঃশব্দে ডাকব
আয়ু-হরণকারী তিল তিল অপঘাতকে?
দিন আর রাত্রি রাত্রি আর দিন;
তোমরা আমাদের শোষণ করছ সর্বক্ষণ
আমাদের বিশ্রাম নেইমজুরি নেই
নেই কোনো অল্প-মাত্রার ছুটি।
তাইআর নয়;
আর আমরা বন্দী থাকব না
কৌটোয় আর প্যাকেটে;
আঙুলে আর পকেটে
সোনা-বাঁধানো 'কেসেআমাদের নিঃশ্বাস হবে না রুদ্ধ।
আমরা বেরিয়ে পড়ব,
সবাই একজোটেএকত্রে-
তারপর তোমাদের অসতর্ক মুহূর্তে
জ্বলন্ত আমরা ছিট্‌কে পড়ব তোমাদের হাত থেকে
বিছানায় অথবা কাপড়ে;
নিঃশব্দে হঠাৎ জ্বলে উঠে
বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে মারব তোমাদের
যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল।


দেশলাই কাঠি 

আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্যহয়তো চোখেও পড়ি না :
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ-
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস ;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি ।

মনে আছে সেদিন হুলুস্থূল বেধেছিল ?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন-
আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুড়ে ফেলায় !
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ
আমি একাই-ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি ।

এমনি বহু নগরবহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে
তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের ?
মনে নেই এই সেদিন-
আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে ;
চমকে উঠেছিলে-
আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ ।

আমাদের কী অসীম শক্তি
তা তো অনুভব করছে বারংবার ;
তবু কেন বোঝো না,
আমরা বন্দী থাকব না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়বআমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরেগঞ্জেগ্রামে-দিগন্ত থেকে দিগন্তে ।

আমরা বারবার জ্বলিনিতান্ত অবহেলায়-
তা তো তোমরা জানোই !
কিন্তু তোমরা তো জানো না :
কবে আমরা জ্বলে উঠব-
সবাই-শেষবারের মতো ॥


নিবৃত্তির পূর্বে
দুর্বল পৃথিবী কাঁদে জটিল বিকারে,
মৃত্যুহীন ধমনীর জ্বলন্ত প্রলাপ;
অবরুদ্ধ বে তার উন্মাদ তড়িৎ;
নিত্য দেখে বিভীষিকা পূর্ব অভিশাপ।

ভয়ার্ত শোণিত-চক্ষে নামে কালোছায়া,
রক্তাক্ত ঝটিকা আনে মূর্ত শিহরণ
দিক্প্রান্তে শোকাতুরা হাসে ক্রূর হাসি,
রোগগ্রস্ত সন্তানের অদ্ভুত মরণ।

দৃষ্টিহীন আকাশের নিষ্ঠুর সান্ত্বনাঃ
ধূ-ধূ করে চেরাপুঞ্জি- সহিষ্ণু হৃদয়।
ক্লান্তিহারা পথিকের অরণ্য ক্রন্দনঃ
নিশীথে প্রেতের বুকে জাগে মৃত্যুভয়।।


ঐতিহাসিক 
আজ এসেছি তোমাদের ঘরে ঘরে
পৃথিবীর আদালতের পরোয়ানা নিয়ে
তোমরা কি দেবে আমার প্রশ্নের কৈফিয়ৎঃ
কেন মৃত্যুকীর্ণ শবে ভরলো পঞ্চাশ সাল?
আজ বাহান্ন সালের সূচনায় কি তার উত্তর দেবে?
জানিস্তব্ধ হয়ে গেছে তোমাদের অগ্রগতির স্রোত,
তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছ ভবিষ্যৎ
আর অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উৎসাহের কয়লা।
কিন্তু ভেবে দেখেছ কি?
দেরি হয়ে গেছে অনেকঅনেক দেরি!
লাইনে দাঁড়ানো অভ্যেস কর নি কোনোদিন,
একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
মারামারি করেছ পরস্পর,
তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে
বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ।
কেবল বঞ্চিত বিহ্বল বিমূঢ় জিজ্ঞাসাভরা চোখে
প্রত্যেকে চেয়েছ প্রত্যেকের দিকেঃ
-কেন এমন হল?

একদা দুর্ভিক্ষ এল
ক্ষুদার মাহীন তাড়নায়
পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে
ইতর-ভদ্রহিন্দু আর মুসলমান
একই বাতাসে নিলে নিঃশ্বাস।
চালচিনিকয়লাকেরোসিন?
এ সব দুষ্প্রাপ্য জিনিসের জন্য চাই লাইন।
কিন্তু বুঝলে না মুক্তিও দুর্লভ আর দুর্মূল্য,
তারো জন্যে চাই চল্লিশ কোটির দীর্ঘঅবিচ্ছিন্ন এক লাইন।

মূর্খ তোমরা
লাইন দিলেঃ কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু,
রক্তয়ের বদলে পেলে প্রবঞ্চনা।
ইতিমধ্যে তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খল ভিড়ে
মুক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার।
লাইনে দাঁড়ানো আয়ত্ত করেছে যারা,
সোভিয়েটপোল্যান্ডফ্রান্স
রক্তমূল্যে তারা কিনে নিয়ে গেল তাদের মুক্তি
সর্ব প্রথম এই পৃথিবীর দোকান থেকে।
এখনো এই লাইনে অনেকে প্রতীক্ষমান,
প্রার্থী অনেককিন্তু পরিমিত মুক্তি।
হয়তো এই বিশ্বব্যাপী লাইনের শেষে
এখনো তোমাদের স্থান হতে পারে-
এ কথা ঘোষণা ক'রে দাও তোমাদের দেশময়
প্রতিবেশীর কাছে।
তারপর নিঃশব্দে দাঁড়াও এ লাইনে প্রতিজ্ঞা
আর প্রতীক্ষা নিয়ে
হাতের মুঠোয় তৈরী রেখে প্রত্যেকের প্রাণ।
আমি ইতিহাসআমার কথাটা একবার ভেবে দেখো,
মনে রেখোদেরি হয়ে গেছেঅনেক অনেক দেরি।
আর মনে ক'রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র,
নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ,
অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা,
আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন।।


মীমাংসা 

আজকে হঠাৎ সাত-সমুদ্র তের-নদী
পার হতে সাধ জাগে মনেহায় তবু যদি
পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ
প্রস্রবণের মতো এসে যেত হঠাৎ আজ-
তাহলে না হয় আকাশ বিহার হত সফল,
টুকরো মেঘেরা যেতে যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল।

আর আমি বুঝি দৈত্যদলনে সাগর পার
হতামযেখানে দানবের দায়ে সব আঁধার।
মত্ত যেখানে দৈত্যে দৈত্যে বিবাদ ভারি;
হানাহানি নিয়ে সুন্দরী এক রাজকুমারী।
(রাজকন্যার লোভ নেই, -লোভ অলঙ্কারে,
দৈত্যেরা শুধু বিবস্ত্রা ক'রে চায় তাহারে।)

আমি একজন লুপ্তগর্ব রাজার তনয়
এত অন্যায় সহ্য করব কোনোমতে নয়-
তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন,
যেখানে ঝল্‌সে উঠবে আমার অসির কিরণ।
ভাঙাচোরা এক তলোয়ার আছে, (নয় দু'ধারী)
তাও হ'ত তবে পক্ষীরাজেরই অভাব ভারি।
তাই ভাবি আজতবে আমি খুঁজে নেব কৌপীন
নেব কয়েকটা বেছে জানা জানা বুলি সৌখিন।



ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ।। ইন্দ্রজিৎ রায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০




ইন্দ্রজিৎ রায়।। ফালতু ডায়রি, বৈশাখ, বিশেবিষ


হঁসদেও নদী পেরিয়ে আকাশখাওয়া চিমনিগুলো , ডোরাকাটা চিমনি ,এখানে নদী আটকে সেই জল কারখানার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে ,তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে । দিদা বলতো ছাগলের লড়াই ,আনুষ্ঠানিক বাতি ,চোং লাগিয়ে,লোক ডেকে শেষে এই ! নদী পেরিয়ে বিদেশের পোস্টকার্ডের মত ঝকঝকে নগরপ্রতিমা , যা ঠিক এখানকার নয়,এগুলো সরকারের আমদানি ।এই সরকার লোকটা কে বুঝতে সত্তর বছর লাগলো আমাদের ।আজ ও সত্যি জানিনা । জানানার মত। মর্দানা আর জানানা ।দুরকম দেশ,কাল । কারখানা সংলগ্ন বাড়িঘর গুলোতে আমার বাবা মা থাকতেন, কোন পাশাখেলার চালে আমার দিদাও গিয়ে পৌঁছেছিলেন । সেটা প্রথমে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও , পরে বোঝা যায় এর আধিভৌতিক দিকগুলো । নড়াইল সাবডিভিশন কি খুলনা ? দিদার বাবার নাম ছিলো পুলিনবিহারি । রাজরোগ ।বাবা চলে যান ।ঘুরতে ঘুরতে , থিতু কাকে বলে ? কেউ কি হয় । এই যশোর খুলনা ঝিনাইদহ আমি গেছি ।কিন্তু ফিরে এসে বলার কাউকে পাইনি ,কারণ , ততদিনে ...কেন দিদার কথা বলতে হবে । হনুমানজীর কথা ছেড়ে ,কেন বলতে এলাম সেটা হয়ত ঐ বাল্যকালের গাধা পেটাপিটি ।টালিভাঙ্গা টুকরোর একটা স্তুপ বানিয়ে যেন দূর থেকে রবারের বল ছুঁড়ে তা ভেঙ্গে ফেলা ,একটা চিৎকার ওঠে ,হো ও ও ও ও , থেমে যায় আবার । পুনরায় ঝিঁঝি ও পাহাড়ি গুবরে পোকা দখল নেয় নীরবতার । নিশুত রাতে পাহাড়ি গুবরে দিক হারিয়ে ঠং করে ল্যাম্পপোস্টে লাগে এসে । আবার এই চাট্টান ছত্তিসগড় ঝিমোতে থাকে ।
খুব ভোরে উঠে আশপাশের অনেক রাস্তাঘাট বুঝে নেয় দিদা , প্রবল পাঠাভ্যাস ছিলো , শেষ বয়সেও ছানি চোখে , বইয়ের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখেছি ,একেকসময়ে ভাবতাম কোনও বইয়ের মধ্যেই ঢুকে পাতার মত জালজাল ,অশ্বত্থের মত হয়ে আছে কোনও মানুষ ,বই খুললে হয়ত বেরিয়ে আসতে পারে , এসব ভাবতাম । অত বড় কারখানাতে যা হয় , তা কিন্তু আদতে মাছের তেলে মাছ ভাজা ,শিল্প মানে কল কারখানা অথবা লেখাছবি শিল্প , সবই কিন্তু কঁ কাঁচামাল এখানেই পাওয়া । দুনিয়াতে ।কাঁচামাল বানানোর খেমতা নেই কারো । দিদা বলতো , গোলকের পেটের ভেতরেই তেল , সেই তেলে গাড়ি প্লেন চালিয়ে কত ফুটানি দেখ ।এক ফোঁটা পেট্রল বানাতে পারবি ? না ।কেন? এত নপর চপর কথা ,পেট্রল বানা কেনে ! বানাতে সময় লাগবে ।কাল । মহাকাল ঢুকে সব পচিয়ে তবে তো তেল , অত সোজা ।এই যে হঁসদেও নদীর ওপরে বাঁধ , মালগাড়ি ভরতি কয়লা বাষ্প হচ্ছে , সেই ক্ষিপ্ত বাষ্প ঠেলে ঘোরাচ্ছে টারবাইন , আর এখানকার স্থানীয় সফল মানুষ ,তাদের মজদুর ভাই বলে ডেকে,তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে কিছু শহুরে শিল্পী দিব্যি বেঁচে আছে, এও এক বুকভাঙ্গা আখ্যান । এখানে দাঁড়িয়ে দিদা ছাড়াও আরেকজন কে ভাবি ।না তিনি আপনাদের ভাষায় সেলেব্ নন ,তবে ঐ মজদুর ভাইদের কাছে , নিশ্চই । শঙ্কর গুহনিয়োগি । ব্যাস । নামটাই যথেষ্ট ।বাকিটা সংস্থাপক , অধ্যাপক ,ব্যবস্থাপক এঁরা বলবেন ।আমাদের কাজ তো বলা না ,হাতিঘাসের এপার ওপার , টকটকে লাল বৃষ্টিধোয়া একটি টালির দিকে তাকিয়ে আনমনা হতে পারেন বন্ধুরা আজও , হাতিঘাসের ভেতরে টালি ।কী রূপ ! মনে পড়ে দশ বিশটা বছর , দিদার হাসপাতাল বাস । গভীর কোমা । দেয়ালা ।কাউকে চিনতে পারছে না । পেচ্ছাপ বন্ধ ।আমি দৌড়ে এসেছি ।দিদা আ , স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলো দিদা ।তিনদিন পর ।ডাক্তার অবাক ।আসলে ডাক্তারি শাস্ত্রে কি বাৎসল্য পড়ায় ? পঞ্চরসের ভিয়ান ।পড়ায় ? জানি না । পরের দিনও তাই ।অবস্থা খারাপের দিকে ।সাড়া নেই । আমাকে ডাক্তার বললেন , আপনি ডাকুন । সাড়া দিলো দিদা ।যেন পুরুলিয়ার মামাবাড়ির অতলান্ত পাতকুয়ো থেকে গলাটা উঠে এলো , সোনাই ই ই , হাতটা এগোতে আঙুলটা চেপে ধরলো দিদা , আহা বাৎসল্য মহারস কেন ! কী খাবে দিদা ? বলো ,বলো কী খাবে ....এক মুহুর্তের নীরবতা , দহী ভাত খাবো ...আমি দৌড়ে বেরোলাম বাবার স্কুটারটা নিয়ে ,এতক্ষণে ভাত হয়ে গেছে , কিন্তু ,কিন্তু যখন ফিরলাম , দিদা , ওই আর কি । দইভাত টা থেকেই গেলো । আমার প্রিয় একটি পাঞ্জাবি গান , " বিনা হুকম্ দে অন্দর না ,যায়ে রোটি.." , হুকুম ছিলো না ,দই ভাত ,কিন্তু কোমার ভেতরেও শুধু বাৎসল্যের জোরে ,নাতির ডাকে , মৃত্যুর হাত ছাড়িয়ে , সাড়া দেওয়া ।মনে থাকে ।
এরপরেও থাকে আমার ডোমজন্ম । ডোমরাজা । ওখানে শ্মশাণ ছিলোনা, নতুন বসতি তো , বিলাসপুর যেতো সবাই ।আমি রাজি হইনি । বললাম যা হবার ,এখানেই হবে । মানুষজন জুটে গেলেন । কিন্তু হাসপাতাল থেকে দিদা ,মানে দিদার শরীর চলে এলো সন্ধেবেলা ।সারারাত , ড্রয়িং রুমে শুয়ে থাকলেন ।পরদিন , হঁসদেও নদীর ধারে ,কাঠ যোগাড় করে,চিতা বানিয়ে যখন কাজ হচ্ছে , আমার , আশ্চর্যভাবে মনে পড়ছে , অক্ষয় মালবেরি র কথা , দিদা মিশে যাচ্ছে ,হঁসদেও নদীতে ,ছত্তিসগড়ের আকাশে , অক্ষয় মালবেরির দাদুর মত , আমি কিরকম শিক্ষানবিশ ডোমের মত ,হাতে একটা নদীর পাথর নিয়ে , চিতার অনতিদূরে , ঠিক যকৃতের মত দেখতে ,নদীর পালিশ করা পাথর , যা আমাকে ভুলতে দেয় না কিভাবে কোমার গভীর থেকে অত স্পষ্ট সাড়া দিতে পারে জান ।
প্রাণ কি পাখি ? সত্যিই ? ডোমরাজা । গা শিরশির করে । হঠাৎ হঠাৎ । ব্রয়লার হিন্দি ভাষা জানে ,অথবা মৈথিলী ,অবধী ...এটা অনেক আগে একটা লেখার শিরোনাম ছিলো ,মাংসের ভেতরে যেমন কুচকুচে হাড় খুঁজে পাওয়ার একটা এলানো ইচ্ছে থাকে ,সকাল থেকে সাইকেলে গড়াতে গড়াতে যে ব্রয়লারের চিৎকার গুলো শুনি ,ওটা বাংলা হতে পারে না । হিন্দি নাকি ? তাই হবে , ছত্তিসগড়ের ঠেট হিন্দি ,গা শিরশির করে ওঠে .....
(ক্রমশ )