বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০

ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট/রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে



ছবিঃ দেবাশিস সাহা

রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে


১. ভ্রমণবৃত্তান্ত

যাকে কৃষ্ণেন্দু বিরহ বলে ভুল ভেবেছিলো সেই অনির্বাণ দিন ও রাত দূরাগত মাটির আঘ্রাণ খোঁজে একটানা ছুটে চলা ট্রেনের এই অন্ধকার বার্থে৷ সমগ্র এখন সময়ের বেদনাময় শব্দ শোনে৷ নীরব, প্রত্যাশাবিহীন৷ অনেক নদীর ঢেউ, অনেক সমতল, বালির পাহাড়, উঁচুনিচু টিলা অতিক্রান্ত এই পথ৷ এই ঘুমন্ত রেলকামরা এই অনন্ত শূন্যতা এই বার্থে বার্থে ভেসে থাকা গাঢ় অন্ধকারে মিলনের অবুঝ ইশারা এক অচেনা মত্ততার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ মধ্যরাতের নিঝুম দেহাতী স্টেশন দেখে আবারও সেই তুমি, ঝিমলিদি, তোমাকে মনে পড়ে গেল কৃষ্ণেন্দুর৷ সিটি জংশন থেকে শীতের ভোর ছুটে যেত রোজ পাটনাসাহিব৷ ভাঁড়ে ভাঁড়ে ধোঁয়া-ওঠা চা, চুল এলোমেলো করে দেওয়া ঠাণ্ডা বাতাস আর স্টিম-এঞ্জিন থেকে দমকা বাতাসের সঙ্গে উড়ে আসা কয়লার কুচি৷ গায়ে গা লেপটে বসে থাকা৷ প্রায় একই চাদরে পরস্পর জড়িয়ে৷ ইচ্ছাকৃত অর্ধেক ঘুমের ভেতর কুণ্ডলীপাকানো আকাঙ্ক্ষার সাপ৷ টোটাল কুহক৷ অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণে তখন ফ্রয়েডসাহেব আর সেইসব কামনারা৷ নিজেরই প্রতিভাময় এই হাত আর আঙুলের সঙ্গে যত বোঝাপড়া৷ প্রতিদিনের চেনা স্টেশন কখন অচেনা হয়ে যায়৷
পেটে গামছা দিয়ে কলসি বাঁধা৷ কলাবেণী চুল টানটান করে বাঁধা৷ প্রখর রোদ চেটে খায় বাকি শরীরের আর্দ্র পেলবতা৷ এই চারিদিকে ছড়ানো-ছেটানো পুকুর আর জংলা-ঝোপের ভিড়৷ স্নানশেষে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফেরার এটাই পথ৷ আচমকাই পুকুরের শ্যাওলাসবুজ কাঠের পিছল সিঁড়ি হড়কে ভারি অন্ধকার জলের অনেক নিচে তখন তলিয়ে যাচ্ছে দুপুর৷ ডুবতে ডুবতে ঝাঁঝি-মাছ আর ব্যাঙাচিদের ভিড়ে যেন এক হিলহিলে লাউডগা সাপ তার চুলের মুঠি ধরে অন্ধকার অতল থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তরল আলোর দিকে৷ সেই ভারিজল নাকে চোখে মুখে ঢুকে বালকের অন্ধকার দিন৷ ভেজাফ্রক ঝিমলিদির আঁটোসাঁটো বুক জল ঠেলে ঠেলে পাড়ে থামে৷ ওর দুইঠোঁট ফাঁক করে ঝিমলিদি নামিয়ে আনে ঠোঁট ৷ স্ট্র দিয়ে কোল্ডড্রিঙ্কস খাওয়ার মতো আশ্লেষে কৃষ্ণেন্দুর পেট থেকে টেনে বার করে সেই ভারি নোনাজল৷ ডুবন্ত খেয়ার মতো কৃষ্ণেন্দু চার হাতপায়ে জড়িয়ে ধরে ঝিমলিদিকে৷ সেই প্রখর রোদে তলিয়ে যায় বালক ও প্রকৃতি৷
দরমার ঘরের ভেতর মাঝরাতে চাঁদ আসে৷ ঘুমন্ত কৃষ্ণেন্দুর পাশের শূন্যতা সহসা পূর্ণ হয়ে ওঠে, হালকা অন্ধকারে৷ দূরে দক্ষিণের ঘরে তখন ঝটাপটি৷ ঘনঘন শ্বাস ফেলার হিসহিসে শব্দ শোনা যায়৷ প্রাপ্তবয়স্ক দুটি ছায়া মিথুন-মুহূর্তে৷ শঙ্খ লেগেছে৷ কৃষ্ণেন্দুর শরীরের পাশে তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে সুপ্ত অথচ উষ হলকার স্রোত৷ জ্যোৎস্নারাত্রির মতো অপার্থিব ঝিমলিদির ত্বকের পৌর্ণমাসী সৌন্দর্যে এই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ এখন মৃগয়া-কাতর৷ বালকের ডানহাত অনিবার্য চাঁদের কলঙ্কে খেলে বেড়াচ্ছে৷ নিস্তব্ধ ভ্রমণে নীল আর্মস্ট্রং তখন নমুনা-সন্ধানী৷ এভাবেই চাঁদ বালক আর ঝিমলিদি সারাটা রাত অনন্ত শূন্যতায়৷ শুধু দরমার বাড়িটুকু অজানা উড়ন্ত বস্তুর মতো কেন যে পাড়ি দিতে চায় মহাশূন্যে কৃষেন্দু বুঝতে পারে না৷ অনন্ত লাভাস্রোত আর লতাগুল্মজালে সময় তখন প্লাবিতপ্রায়৷ বালক তার ফ্রকের একটা কোণ শক্ত করে ধরে থাকে৷ সমস্ত মনখারাপ শেষ পর্যন্ত নিউইয়ার গ্রিটিংসের মতো উজ্জ্বল হলেও তাহাদের অসংযম ক্ষুন্নিবৃত্তি আসলে ভোরবেলার যুদ্ধবিরতি৷ দরমার ফাঁক দিয়ে সূর্যালোক ওই এসেছে বিছানায়৷
বাতাস-নিয়ন্ত্রিত এই পথ৷ এই অভিযাত্রা৷ মাথার উপরের আকাশে উড়ে যায় অলৌকিক শ্বেত উত্তরীয়৷ আজ কবেকার রক্তসমুদ্র শুকিয়ে আসা এই পথে দাঁড়িয়ে তুমি, ঝিমলিদি, ইতিহাসের মগ্ন ছাত্রী৷ ধাপে ধাপে উঠে গেছে কারুকার্যময় বিজয়-তোরণ৷ বুলন্দ্ দরওয়াজা৷ নগ্ণ পায়ে রৌদ্রতপ্ত লাল পাথরের মেঝেতে তুমি দাঁড়িয়ে৷ পা রাখা যাচ্ছে না৷ পাশে সানগ্লাস আর টুপিতে ঢাকা তোমার ক্লান্ত পরিবার৷
ফতেপুর গ্রামের সেই নবীন গাইড, ক্লাশ সেভেনের ইব্রাহিম, বাদশা আকবরের গল্প বলছিল ইতিহাসের ছাত্রী, তোমাকে৷ সেইদিন৷ ইদের উজ্জ্বল সকালে৷ তুমি অন্যমনস্ক৷ নিজের ভেতরে নিজে৷ তোমাকে আকুল করে সেই নেশা৷ সেই অশ্রুতপূর্ব গানের সুর৷ অতীতের স্তব্ধ ধুলো, বিষাদময় দুর্গ, তোরণ আর প্রাসাদের হাতছানি৷ তখন কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকে না৷ আলোককুচিময় এই উজ্জ্বল সকাল সেলিম চিস্তির দরগায় চাদর চড়িয়ে গবাক্ষের রঙিন সুতোয় মনোকামনার গিঁট বাঁধতে তোমাকে যতটা উৎসাহী করেছিল, তুমি খররৌদ্রে রুমালে মাথা ঢেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ ছুটে গিয়েছিলে সেই উৎসাহেই৷ ইব্রাহিম, ক্লাশ সেভেনের স্কুল-পালানো সেই ইব্রাহিম, সকালের নমাজের পর তোমার ক্যামেরায় বন্দি করতে চাইছে তোমাদেরই,
‘দিদি রেডি? ভাইসাব আপ জারা সিধা হোকে রহেনা৷ মুন্না, য়েক মিনিট, টোপি লগা লো...’
কয়েক পা দূরের সিক্রি তখন পঞ্চমহলের খা খা শূন্যতায় রৌদ্রে পুড়ে যাচ্ছিল৷ একা৷ অনন্তকাল৷



২. জোছনা করেছে আড়ি


স্নায়ুর অশান্ত চাপ এড়ানোর জন্য যারা গান শোনে তাদের ভালো লাগে কৃষ্ণেন্দুর৷ টানা সাতদিন গান শুনে থম্ মেরে যাওয়া ঝিমলিদিকে ও যেদিন একটা ডেয়ারিমিল্ক দিয়েছিলো, সেইদিন আগ্রার রাস্তায় ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়েছিলো গোলাপায়রার দল৷ সেই অচিন দেশে, হয়ত সেই নির্জনে রূপের সৌরভে খুঁজতে খুঁজতে সেই ঠিকানা আকার আর সাকার হারিয়ে গেল নিরাকার সেই জ্যোতিরূপে৷ তবু ঘাট-আঘাটায় তরল জ্যোৎস্নায় তরী ঠিক রেখে এগিয়ে যাও তুমি৷ অপারের কান্ডারী৷ পাথরের ঠাণ্ডায় মাটির উষ্ণতার সন্ধান৷ তোমাদের প্রেমও কী বহুগামী! সৌন্দর্যসন্ধানী! ইতমদ্-উদ্-দৌলার ব্যাপ্ত করিডোর আর সূক্ষ্ম কারুকাজের সামনে উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে তুমি৷ তার খিলানে, আকাশে উঠে যাওয়া নম্র গম্বুজে, বরফি কাটা অসংখ্য নকশার আড়ম্বরে রঙ পালটে পালটে সূর্যরশ্মির আনাগোনা৷ কে যেন ডাকে, গলা ছেড়ে ডাক দেয় কাউকে৷ সেই চিৎকৃত আগুন ছুটে যায় দোজখে৷ আকুল৷ ধবংসময়৷ তুমি তার সকল অর্থময় ইঙ্গিত কী বুঝেছো কখনও! প্রত্যেকবার নিজেরই খোলা শরীর ঢাকতে চেয়েছো আলোয়, ছায়ায়, অন্ধকারে৷ বৃক্ষহীন সেই বিরাট প্রান্তরে, দয়াল, সঙ্গীতের সুর হয়ে জেগে থাকে সেই ডাক৷ বেহেশ্তের অপার সৌন্দর্য৷ আকুল৷ ধ্বংসময়৷
বাড়ির পেছনের তেজপাতা গাছের ঝিরিঝিরি ছায়ার ফাঁক দিয়ে যে-রোদ্দুর এসে পড়েছিলো ‘সোয়ান’-লেখা ওর ড্রয়িং খাতায়, সেই রোদ্দুরের রঙটা ইদানিং ঠিকঠাক মনে পড়ে না কৃষ্ণেন্দুর৷ প্রতিবেশীবাড়িতে রোজ সন্ধেবেলা তবলার বোলে কথা বলে উঠতো ঝিমলিদির যে-ঘুঙুর, মনে মনে একবার সেই ঘুঙুরের ছবি এঁকেছিলো ও৷ অ্যান্টেনায় বিঁধে থাকা ঘুড়ির দল স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠেছিলো তখন৷ পিচঢাকা কালো রাস্তায় ঝিপঝিপ বৃষ্টির মধ্যে ছুট দিয়েছিলো ও৷ 
স্বপ্নের গভীর থেকে ঘুমের গভীরে সেই শালবন... ঝিরিঝিরি ছায়া... হলুদ বালিতট...৷ মাটির মেঝে ফুঁড়ে তমালের গাছ, বৃক্ষ,সঙ্গীতের অভিষেক সভা... বৃক্ষের গোড়াতেই রসিকজন...৷ উঁচু করে বাঁধানো চত্বর, চত্বরে খ্যাপার দল৷ দো্তারা আড়বাঁশি আর খমকের জগঝম্প৷ আসর জুড়ে ভেঙে পড়েছে মেলা...৷ রাত বাড়ছে, বৃষ্টিবিন্দুর মতো গলে গলে পড়ছে কুয়াশা৷ খ্যাপা তার শীর্ণদেহে ঝলকা কাটা আট কুঠুরি নয় দরোজার সদর কোঠায়৷ গমকের প্রাবল্য ঠিকরে দেয় মেধাবী চোখদুটো৷ ঘাড়ের দুইপাশে ঝামরে এসে পাক খায় খ্যাপার সর্পিল কেশরাশি৷
একটি দুটি মানুষ, নাগরিক, পিঠে রুকস্যাক৷ কুয়াশার মতো অবচেতনের অস্পষ্টতায় নদীর পাড় বরাবর হেঁটে চলেছে সোজা৷ অজয়ের নিস্তরঙ্গ জলে আটকে আছে মধ্যরাত্রির বিষণ্ণ্ চাঁদ৷ রাস্তার পাশে নিভে এসেছে নিজেদের সেঁকে নেবার গণতান্ত্রিক চুল্লি৷ ধোঁয়া উড়ছে, উড়ছে ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক, উড়ছে কাগজপোড়া গন্ধ৷ ধুলোর উপরেই রাতজাগা ক্লান্ত মানুষ আর শ্বাপদেরা কুণ্ডলী পাকিয়ে জিরোচ্ছে৷ 
আলেয়ার আলোয় দূরবর্তী আর দূরের থাকে না৷ ঘুমের গভীরে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই বাঁকা নদী আর তার পিছল ঘাট৷ ক্ষণিকের জন্য গন্ধকালীর গান বধির করে রাখে চরাচর৷ স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে কিছু আশ্চর্য সম্ভাবনা এবং আলোর মুহূর্তরা তৈরি হয়, তৈরি হয় স্রোতের মতো অজস্র উদ্ধত ভয়৷ তমালতলায় গৌরখ্যাপা তখন নানান বিভঙ্গে, নানান মুদ্রায় ঘুরে ঘুরে নাচছে, ডুবকিতে পাঁচ আঙুলের ঝড়, মুখোমুখি তিনকড়ি চক্রবর্তী, খ্যাপার যুগলে বন্দী৷ আকাশ ছাপিয়ে স্বপ্ন ছাপিয়ে অবচেতন জুড়ে জেগে উঠছে সেদিনের সেই গান, ‘...পাড়ে যাবি কী করে?’


হস্টেল ডাইনিঙে লেটস্লিপ দেওয়া রাতের খাবার হিম পড়ে থাকে৷ অকাতরে ঘুমনো রুমমেটের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হাই ওঠে ওর৷ দুপায়ে চটি গলিয়ে ধীরে ধীরে ছাদে যায় কৃষ্ণেন্দু৷ চারদিক রেলিঙতোলা নিয়ন-আলোয় ভেজা এই পাঁচতলার ওপর থেকে ছাদটাকে এখন একটা বিচ্ছিন্ন আইল্যান্ডের মতো মনে হয় ওর৷ ছাদের এককোণে ডাঁই পড়ে আছে ক্যানবিয়রের খোল, মদের নিঃশেষিত ভাঙা বোতল৷ দূরে দূরে অন্ধকার৷ অন্ধকারের ফাঁকে-ফোকরে বিচ্ছিন্ন মাথা উঁচু দাঁড়িয়ে আছে স্টাফ কোয়ার্টার, ওল্ড পিজি, কৃষ্ণেন্দুদের নিউ পিজি, লেডিজ হোস্টেল৷ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বুক ভ’রে ধোঁয়া নেয় কৃষ্ণেন্দু৷ হাঁটতে হাঁটতে ছাদের পেছন দিকটাতে এসে দাঁড়ায়৷ তখনি পাশের রেলপথ দিয়ে একদল ফাঁকা শূন্য কামরা নিয়ে দূর সমুদ্রবন্দরের দিকে শব্দ করে জোরে ছুটে চলে যায় শেষ কোনও ট্রেন৷ অন্ধকার আকাশের বিস্তৃত সিনেমাস্কোপে তখন ইচ্ছের সীমাহীন বিরুদ্ধতা৷
ওদিকে কাহিনিকাব্যের উল্টোপৃষ্ঠায় তখন থিকথিক অন্ধকারে ভাসছে চাঁদ৷ চাঁদের শরীর৷ ধাবমান অশ্বের দ্রুততায় কেউ পেরিয়ে যেতে চাইছে স্বপ্ন, স্বপ্নের ওপার৷ সিগারেট-ঝরানো তামাককুচিতে ছেয়ে আছে বিছানা-চাদর৷ অ্যাকোরিয়ামের নিস্তরঙ্গ জলে মৃতমাংস ছঁুড়ে দেয় মাছ৷ মেঘের শরীরে বাড়ে ক্ষয়৷ কবরের ঝুরঝুর মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে ইবলিশ অথবা মেফিস্টো৷ তাদের বর্ণহীন পোশাক যে-কোনও স্বেচ্ছাচারীর ঈপ্সিত আশ্রয়৷ 
আবার গড়িয়ে নামছে সেই পাথর, সত্যগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে৷ অন্ধকারের ভয়াবহতা আর পঙ্গু ঘোড়ার অসহায় যন্ত্রণা নিয়ে নিচুপথে হ্যাণ্ডক্যাপে-বন্দি মানুষের স্মৃতি আর অস্তিত্ব ছুঁয়ে৷ চার যুগ ধরে সেই গড়িয়ে নামা ধ্বংসকারী চিৎকার ভাষার দুর্বোধ্যতাকে উপেক্ষা করতে চায়, উপেক্ষা করতে চায় মৃত্যুশোক আর পুড়ে যাওয়া কৈশোরকাল৷ কে ফিরিয়ে দেবে তোমার ঘরের চাবি? কে ভুলিয়ে দেবে সেই অশ্রুময় সৎকারদিন? গড়িয়ে নামছে পাথর প্রেতিনীর অগ্নিদগ্ধ প্রেমে৷
উঠোনে শুয়ে আছে সেই মৃতার শরীর আর রহস্যময় সেই স্মৃতিরা দুর্বিনীত সত্তাটিকে টেনে হিঁচড়ে ঠেলে নিয়ে যায় সেই পতনশীল পাথরটার সামনে৷ চার যুগ ধরে সে ঠেলে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে পতনশীল পাথরটাকে আকাঙ্ক্ষার শীর্ষবিন্দুর দিকে৷ নগ্নরাত্রির শরীরে তখন বিন্দু বিন্দু জেগে উঠছে ঘাম৷ লুকনো সিঁড়ির খোঁজে কৃষ্ণেন্দু প্রথমবার লেজ সোজা করে টেরোড্যাকটিলের ভঙ্গিতে মেলে দ্যায় দুই ডানা৷



৩. তোমাকে চাই


আবারও সেই আয়নায় ভুল করে পিঠের জড়ুল দেখে ফেলবার মতো ভয়৷ ক্ষণিকের শিহরণ৷ উত্তেজনা৷ ঢেউয়ের উপরের বুদবুদের মতো নিমেষে মিলিয়ে যাওয়া মুহূর্তরা৷ পরস্পর আদর আর স্বীকৃতি পাওয়ার লাগামহীন প্রতিযোগিতা৷ ডেস্কটপে স্টার্টবার মেনুর এক কোণে ডিজিটাল সময় তখন মধ্যরাত পেরোচ্ছে৷ কবিতা উৎসবের দূরাগত আমন্ত্রণের চমক নীরবে উপেক্ষা করে এই রাত৷ ছোটো ছোটো খোলা জানলার কোণে সবুজ আলোর বিন্দুরা জ্বলতে থাকে৷ শব্দ করে কথারা এসে ভিড় করে৷ ভিড় করে সমূহ কবিতারা৷ একটু একটু করে শীতের কুয়াশা হালকা হয়ে আসে৷ স্বচ্ছ ডানার ফড়িঙেরা দূর থেকে উড়ে আসে পরাগকুচি মাখা প্রত্যঙ্গ নিয়ে৷ 
এই ওষ্ঠে বিষাক্ত রঙ৷ এই ওষ্ঠে কামনারা অধিকার সচেতন৷ এই ন্যাড়া প্রান্তরে এখন চাঁদ ঢলে এসেছে৷ চলকে উঠেছে সেই পিছল-ঘাট৷ বাঁকা নদীর তীরে শ্রান্ত হাটুরের এই অবিরাম পথচলা৷ গৃহস্থের রাত্রিব্যাপী আত্মকণ্ডূয়ণ, জ্যোৎস্নার গভীরে বিপজ্জনক চলাফেরা, গান, স্মৃতির রোমন্থন৷ এ সবই নিয়মতান্ত্রিকতারও আরও অধিক কিছু৷ এই অনিবার্য ফাল্গুনের রাতে, আলেক, যাবতীয় প্রতীক আর চিত্রকল্পের ইশারাকে অগ্রাহ্য করে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে অনিবার্য সেই গান৷ আর এই অন্ধকারে আবার বাতিল পোড়াকাঠগুলি জ্বলে উঠল স্বপ্ণে৷ বিষণ্ণ্, জরাগ্রস্ত৷
কবেকার হারিয়ে যাওয়া একটা স্বপ্ন বিষণ্ণ্ গমক্ষেতে ধূসর কাকেদের ওড়াউড়ি দেখছিল, দেখছিল কী ভাবে ভ্যান গখ মোটা মোটা ব্রাশের আঁচড়ে আদিগন্ত ছড়ানো ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলছিলেন তাঁর ভয়৷ যে ভয় গ্রহ-উপগ্রহ ব্রহ্মাণ্ডমণ্ডল ছাড়িয়ে নিতান্তই একটি শিশুর বুকে বাসা বেঁধেছিল৷ ঘুণপোকার মতো যাপনের মৃদু কর্কশ শব্দ একঘেয়ে শ্লোগান অথবা টেলিভিশনের টক-শোয়ের মতো ক্রমশ ক্লান্তিকর হয়ে উঠছিল৷ বাতিল পোড়াকাঠগুলি নিজেদের পাঁজর জ্বালিয়ে ওই প্রপাতের যাবতীয় গ্রাস থেকে ভয়ার্ত শিশুটিকে আগলে রাখছিল৷ আগলে রাখছিল বন্দুকবাজদের যাবতীয় অসহিষ্ণুতা থেকে৷


তারপর মন্দির-চাতাল৷ আঙুল ঠিকরে বেরোয় লুকনো বাঘনখ৷ বাসি রক্তরসে ভ’রে ওঠে অস্কারপ্রাপ্ত দামি সেলুলয়েড৷ তুমুল আক্রোশে স্বপ্নের তলপেট ফাঁসিয়ে দ্যায় খ্যাপা৷ ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে হারিয়ে যায় বিয়রের বোতল, পাখির ছিন্ন পালক৷ ঝাউয়ের আড়াল থেকে চোখ মেলে তাকায় মরা চাঁদ৷ 
---‘তোর জন্য এক বাক্স ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি৷ ফিরে গিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেবো মন’--- লেডিজ হোস্টেল থেকে উড়ে যায় এইসব এলোমেলো স্মৃতি দূরবর্তী অন্য কোনও বালিকার কাছে৷ 
অপেক্ষার দুপুর গড়িয়ে ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে ওঠে তার ছুটির বিকেল৷ জানালার বাইরে থেকে নুয়ে আসা রোদ এসে পড়ে লেখার টেবিলে৷ উড়ে যায় পরিত্যক্ত চিঠি, না-পাঠানো এসেমেস৷ হাত ধরাধরি করে হেঁটে যায় নিরালা-সফর৷ ম্যানগ্রোভগাছের ভিড়ে জমে ওঠা নোনাজলে হারিয়ে যায় বন্ধুমুখ৷ ঝাউয়ের ছায়ায় ছায়ায় খেলা করে আলো আর অনির্বাণ বর্ণালী৷ উপমহাদেশে তখন ভীষণ লু৷ বিকেল ফুরিয়ে আসে৷ মেয়েরা গা ধোয় বিজ্ঞাপিত দুগ্ধফেননিভ নির্দিষ্ট সাবানে৷ স্নানশেষে ছোটো ছোটো-জামা পরে৷ বিছানার গভীর নরম থেকে মুখ তুলে ঠোঁট মেলে ধরে৷ বালিশের ফোকরে ফোকরে বাসা বেঁধে থাকা পতঙ্গেরা দুলে ওঠে হর্ষে৷ সমকাল গেয়ে ওঠে মহুয়াসুন্দরী৷ 
--- কী হল! চুপচাপ, কী ভাবছো বলো? ভয় কীসের?... মাত্র দুদিনের এই ট্যুর আমাদের৷ মোবাইলও সুইচ অফ্ আছে৷ কৃষ্ণেন্দু শুনছো? শুনতে পাচ্ছো? ... কৌমার্যের অহেতুক অহংকারে কীভাবে এতো দাম্ভিক হও তুমি! আমাকে এভাবে উপেক্ষা করো, করতে পারো! ... উফ্, এই অবহেলা আর টলারেট করা যাচ্ছে না৷
--- অনেক রাত্রি হয়েছে এখন, চুপ করো৷ ভাল্লাগছে না আর৷ কালই ফিরতে চাই কলকাতায়৷ যদি তুমি সঙ্গে থাকো--- ভালো, নয়তো কলকাতায় একা ফিরে যাব৷ এই প্রথমবার বি.আর.বি.-র টিউটোরিয়াল সেইসব মেটাফিজিক্যাল পোয়েটদের নিয়ে৷ দেবে না তুমি সোমদত্তা?
---কাল তো অনেকের আসার কথা এখানে৷ হঠাৎ ফিরবো কেন বলো? মোহর জানবে দেখো এসে ঠিক সকালবেলা৷ আর ওর সঙ্গে আসবে ওই ফিল্মি-ঋত্বিক, সিনেমা বানায় যে...
---তা অবশ্য ঠিক৷ তুমি তবে ফিরবে কেন সোমদত্তা! কিন্তু আমাকে যেতেই হবে যে৷ তুমি তো জানোই ওই টিউটোরিয়াল তুমি না দিলেও তোমার কোনও প্রবলেম নেই৷ কিন্তু, আমি, উফ্, প্লিজ, বুক থেকে নামো---
--- কী বলছ এইসব? ছিঃ৷ চুপ করো৷ থামো৷ আমাকে তুমি যে বোঝো না তা আমি জানি কৃষ্ণেন্দু৷ কিন্তু এখনও এভাবে আমাকে বারবার আঘাত করে কী পাও তুমি? বলোনি আমায় কখনও৷ 
---প্লিজ...
---কীসের প্লিজ! 
---প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও...
---মানে? কি বলছো তুমি জানো? যেভাবে জাগতিক আলো ঢেউ বাতাসেরা দিক চিনে রাখে, সেভাবে তোমার বুকে মুখ গুঁজে পড়ে আছি আমি৷ পাবো না একটু আশ্রয়, ভালোবাসাবাসি?
---আমি তো জানি সেই প্রথম দিন৷ তুমি কলেজের করিডোরে একা৷ একলা দাঁড়িয়ে৷
---সমস্ত আকাশ গুমোটভার, রিনঝিন শব্দে বৃষ্টি...
---তোমার পাশে দোতলার ফাঁকা করিডোরে আমি৷ দুজনের করতল বরষাধারায় ভিজে যাচ্ছে---
---অনেকটা যেন ওই কালিদাস... ক্লেদমুক্ত বিরহী যক্ষ চক্ষু মেলি চায়!
---সোমদত্তাও কবিতা লেখে জানতাম না তো৷ এইরে--- স্যরি...
---এই তো সোনা, সোনামাণিক আমার... উম্ম্ম... উঃ উফ্... আ---আ---আহ্ উঁ... উম্ম্ম...
--- এই প্লিজ কী হচ্---ছে... উম্ম্ম... উফ্... প্লিজ.... আঃ---আহ্হ--- আঃ...শো-ও-নো... অনেক রাত... উফফফ্...



৪. এবং অন্ধকার


এখন রোদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না কৃষ্ণেন্দু৷ যতোটা সবুজ ওর ভালো লাগে, ততোটা আর কারো লাগতেই পারে বলে বিশ্বাস নেই ওর৷ কারখানা শ্রমিকদের অনশন-লিফলেট নিয়ে ছুটে আসে পার্টিবাজ বন্ধুরা৷ টেবিলে রঙ আর তুলি দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে বন্ধুদের পার্টির পোস্টারে প্রিয় কবিতার লাইন লিখে ফেলে ও৷ অথচ সকলেই অসম্ভব কোপারেটিভ৷ সহযোগিতামূলক৷ কৃষ্ণেন্দুও তো মানুষকে ভালোবাসতে চেয়েছিলো, মেলাতে চেয়েছিলো সচেতন ব্যান্ডগান ও এলোমেলো ফকিরি-যাপন! মঞ্চের ঝিকিমিকি আলোর নীচে বাংলা গান ও কবিতার সেই আশ্চর্য যুগলবন্দি যোগেন চৌধুরীর পেপার অন ইঙ্ক-এর মতোই ভীষণরকম স্ট্রোক-প্রবণ৷ 
রাসবিহারীর মোড়ে ওভারহেড তারে তখন ধূসর কাকেদের মহাসম্মেলন৷ তাদের স্থির অথচ অস্থির ছায়া এই কুয়াশায় নতুন অর্থনীতির অনিবার্য দহনপর্বে আরও আরেকবার পোড়ায় ঔপন্যাসিককে৷ একটি টংকার খোঁজে ঔপন্যাসিক ছুটে যান একটার পর একটা বাণিজ্যকেন্দ্রে! অথচ ঘরোয়া আসরে যথারীতি ডুবকি দোতারা খমক ও গিটার প্রস্তুত৷ প্রস্তুতিপর্বের এই শীতে তিনশো কিলোমিটার দূর থেকে ফিরে আসেন শিশুর জননী! বাংলা গান ও বাংলা কবিতার এই নির্বিকার উৎসব শুধু উপভোগ করেন একজন ঔপন্যাসিক৷ তিনিও মানুষেরই মতো৷ রাত্রি বেড়ে গেলে তাঁর রক্তচাপও যায় বেড়ে৷ তিনিও মোবাইলে খুঁজে বেড়ান হারানো সঙ্গীকে৷ অথচ ছুটতে ছুটতে রাস্তা যেখান থেকে দ্বিখণ্ডিত তার প্রান্তেই বন্ধুদের বাড়ি৷ যোজন যোজন অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা শীতার্ত রাত৷ অনেক হিসেব শেষে অনেক অকপট সত্যের পর এই ফিরে আসা৷ এই নির্বিঘ্ন অথচ শঙ্কাপ্রবণ ভ্রমণ৷ কখন মৃত্যুর নিরাপদ শূন্যতার মতো তোমাকে ছুঁয়ে দেখা৷ মত্তনীল অন্ধকারে আকাশ তখন প্রিয় শরীরের মতো সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরেছে৷ তার অন্ধকার খাঁজে খাঁজে নিশ্চুপ দিঘির মতো হারিয়ে গেছেন ঔপন্যাসিক৷ 
কেউ নিষেধ করেনি বলেই সূর্যমন্দিরের ক্ষয়িষ্ণু টিলার পাশে খণ্ডগিরির নিচু গুহায় উবু হয়ে এই অনন্ত বসে থাকা আর তার অসবর্ণ ইঙ্গিতময়তা থেকে গর্ভবতী মেঘ দ্রুত গর্ভমোচনের উৎসাহ পায়৷ ঊরুসন্ধিতে রয়ে যাওয়া আশ্চর্য কমনীয়তা হিট বাংলাব্যান্ডের সুরে রিহার্সাল দ্যায় রোজ৷ বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের ঘুমন্ত প্রেরণা ইথার তরঙ্গে পৌঁছে যায় হোয়াইটহাউস রাইটার্স নবান্ন থেকে ভয়ার্ত মফসসলের আলোকোজ্জ্বল গলির তেতলার কোণের কামশীতল বাথরুমে৷ জলভর্তি প্লাস্টিকের বালতি ও মগ৷ দুটো ইট৷ এবং খাটের পেছনে কী ভীষণ জান্তব একফালি ড্রেন৷

একটা ট্রাম অনেকক্ষণ আটকে আছে রাস্তায়৷ রোদে ঝলসে ওঠা ওভারহেড তারে ঘষে ঘষে ঠোঁটের নোংরা পরিস্কার করছে একটা কাক৷ জনপ্রিয় উপন্যাস-লেখক অনুপুঙ্খ জেনে নিতে চান কৃষ্ণেন্দুদের যাপনের আলো ও অন্ধকার৷ কলেজের দেয়ালে দেয়ালে ইচ্ছে আর মৃত্যুর খবর চক দিয়ে লিখে রাখে কেউ৷ কারা যেন অপেক্ষা করে৷ কারা যেন উত্তর দ্যায়৷ কামুক রাক্ষসীর চোখে চেয়ে থাকে ওদের আকাশ৷
---তাহলে তো তোমরা সবাই মিথ্যে হয়ে যাও৷
ভয়ঙ্কর ভিড়-বাসে হঠাৎই আর্তনাদ করে ওঠেন ঔপন্যাসিক৷
---তোমাদের প্যাশন, প্রেম, তোমাদের ইচ্ছে-স্বপ্ন সব তবে মিথ্যাচারে ঢেকে যায়৷
যেন কোন্ অতল জলের মগ্নতা থেকে চিৎকার করে ওঠেন ঔপন্যাসিক৷ কৃষ্ণেন্দু কোনও উত্তর দিতে পারে না৷
আগ্রার রাস্তায় রাস্তায় সাদা-কালো গোলাপায়রার দল উড়াল দিয়েছিল তখন৷ ফটফটে শুভ্র বেসিনে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত বন্ধুর অনর্গল বমি করে যাওয়া মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর৷ আলো আর অন্ধকারের ত্রিমাত্রিক ত্রিভুজের একদিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ উদ্বায়ী হয়ে উঠেছিলো কৃষ্ণেন্দুর মন৷ 
                                                                                    
(এরপর আগামী সংখ্যায়)

1 টি মন্তব্য: