বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০

সাপ্তাহিক সংখ্যা ১ ।। ৭ আগষ্ট,২০২০ ।। সম্পাদকীয়

আ মা দে র ক থা

অনলাইন সাপ্তাহিক কবিতাপত্র হিসেবে 'মাসিক কবিতাপত্র'-র পথচলা শুরু হলো এ বছর বাইশে শ্রাবণেকবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসেআজকের এই মহামারী সময়ে। কলেজ স্ট্রিট বন্ধ। বইপাড়া বন্ধ। আমাদের প্রকাশনা দপ্তর 'উবুদশবন্ধ। প্রেস বন্ধ।অগত্যা আমরা নতুন রূপে ফিরে এলাম নতুন নতুন কবিতা নিয়ে। এ সময়ের তরুণ প্রজন্ম থেকে চিরকালীন বাংলা কবিতার প্রতি 'মাসিক কবিতাপত্র'-র আসক্তি। এই অনলাইন সংখ্যাতেও সেই প্রবণতা জারি রইলো। আপনাদের মতামত পেলে আমাদের ভালো লাগবে।

এইরকম একটি মননহীন আবহেমাসিক কবিতাপত্রের আন্তর্জাল সংখ্যা৷ মহামারীর ভেতর মারামারি৷ ঠিক ভুলের৷ লেখা অলেখার৷ মানুষের জন্য কাজ করা বনাম ঘোলাজলে রাজনীতির সস্তা ডিঙ্গা ভাসানোর৷ নীরব দর্শক আমরা৷ তবু সামান্য কিছু বলার চেষ্টা করলামএই সংকটে৷  ভালো থাকুন৷ পাশের বাড়ির মানুষদের সাবধান হতে বলুন৷

এই আন্তর্জাল সংস্করণ চারদিকের অজ্ঞানতারউদাসীনতার বিরুদ্ধে একটি শাণিত ডায়রি৷ অন্ধকারের নৌকা৷ কিছু পুনর্মুদ্রণ ও কবিতাগদ্য এই অন্তরীণকালের ডায়েরির মতো আমাদের এই সংগ্রহে প্রকাশিত হলো৷ আসলে আমরা প্রত্যেকেই একই লড়াইয়ের সেনানী৷ এই বোধ থেকেই আমাদের এই সামান্য আয়োজন৷ মহামারীর বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গে থাকি৷ সচেতনতা বাড়ুক আমাদের৷ সকলে সুস্থ থাকুন৷ সঙ্গে থাকুন৷ অন্তরীণে থাকুন৷ জয় মানুষের হবেই৷৷


ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট/রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে



ছবিঃ দেবাশিস সাহা

রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে


১. ভ্রমণবৃত্তান্ত

যাকে কৃষ্ণেন্দু বিরহ বলে ভুল ভেবেছিলো সেই অনির্বাণ দিন ও রাত দূরাগত মাটির আঘ্রাণ খোঁজে একটানা ছুটে চলা ট্রেনের এই অন্ধকার বার্থে৷ সমগ্র এখন সময়ের বেদনাময় শব্দ শোনে৷ নীরব, প্রত্যাশাবিহীন৷ অনেক নদীর ঢেউ, অনেক সমতল, বালির পাহাড়, উঁচুনিচু টিলা অতিক্রান্ত এই পথ৷ এই ঘুমন্ত রেলকামরা এই অনন্ত শূন্যতা এই বার্থে বার্থে ভেসে থাকা গাঢ় অন্ধকারে মিলনের অবুঝ ইশারা এক অচেনা মত্ততার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ মধ্যরাতের নিঝুম দেহাতী স্টেশন দেখে আবারও সেই তুমি, ঝিমলিদি, তোমাকে মনে পড়ে গেল কৃষ্ণেন্দুর৷ সিটি জংশন থেকে শীতের ভোর ছুটে যেত রোজ পাটনাসাহিব৷ ভাঁড়ে ভাঁড়ে ধোঁয়া-ওঠা চা, চুল এলোমেলো করে দেওয়া ঠাণ্ডা বাতাস আর স্টিম-এঞ্জিন থেকে দমকা বাতাসের সঙ্গে উড়ে আসা কয়লার কুচি৷ গায়ে গা লেপটে বসে থাকা৷ প্রায় একই চাদরে পরস্পর জড়িয়ে৷ ইচ্ছাকৃত অর্ধেক ঘুমের ভেতর কুণ্ডলীপাকানো আকাঙ্ক্ষার সাপ৷ টোটাল কুহক৷ অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণে তখন ফ্রয়েডসাহেব আর সেইসব কামনারা৷ নিজেরই প্রতিভাময় এই হাত আর আঙুলের সঙ্গে যত বোঝাপড়া৷ প্রতিদিনের চেনা স্টেশন কখন অচেনা হয়ে যায়৷
পেটে গামছা দিয়ে কলসি বাঁধা৷ কলাবেণী চুল টানটান করে বাঁধা৷ প্রখর রোদ চেটে খায় বাকি শরীরের আর্দ্র পেলবতা৷ এই চারিদিকে ছড়ানো-ছেটানো পুকুর আর জংলা-ঝোপের ভিড়৷ স্নানশেষে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফেরার এটাই পথ৷ আচমকাই পুকুরের শ্যাওলাসবুজ কাঠের পিছল সিঁড়ি হড়কে ভারি অন্ধকার জলের অনেক নিচে তখন তলিয়ে যাচ্ছে দুপুর৷ ডুবতে ডুবতে ঝাঁঝি-মাছ আর ব্যাঙাচিদের ভিড়ে যেন এক হিলহিলে লাউডগা সাপ তার চুলের মুঠি ধরে অন্ধকার অতল থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তরল আলোর দিকে৷ সেই ভারিজল নাকে চোখে মুখে ঢুকে বালকের অন্ধকার দিন৷ ভেজাফ্রক ঝিমলিদির আঁটোসাঁটো বুক জল ঠেলে ঠেলে পাড়ে থামে৷ ওর দুইঠোঁট ফাঁক করে ঝিমলিদি নামিয়ে আনে ঠোঁট ৷ স্ট্র দিয়ে কোল্ডড্রিঙ্কস খাওয়ার মতো আশ্লেষে কৃষ্ণেন্দুর পেট থেকে টেনে বার করে সেই ভারি নোনাজল৷ ডুবন্ত খেয়ার মতো কৃষ্ণেন্দু চার হাতপায়ে জড়িয়ে ধরে ঝিমলিদিকে৷ সেই প্রখর রোদে তলিয়ে যায় বালক ও প্রকৃতি৷
দরমার ঘরের ভেতর মাঝরাতে চাঁদ আসে৷ ঘুমন্ত কৃষ্ণেন্দুর পাশের শূন্যতা সহসা পূর্ণ হয়ে ওঠে, হালকা অন্ধকারে৷ দূরে দক্ষিণের ঘরে তখন ঝটাপটি৷ ঘনঘন শ্বাস ফেলার হিসহিসে শব্দ শোনা যায়৷ প্রাপ্তবয়স্ক দুটি ছায়া মিথুন-মুহূর্তে৷ শঙ্খ লেগেছে৷ কৃষ্ণেন্দুর শরীরের পাশে তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে সুপ্ত অথচ উষ হলকার স্রোত৷ জ্যোৎস্নারাত্রির মতো অপার্থিব ঝিমলিদির ত্বকের পৌর্ণমাসী সৌন্দর্যে এই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ এখন মৃগয়া-কাতর৷ বালকের ডানহাত অনিবার্য চাঁদের কলঙ্কে খেলে বেড়াচ্ছে৷ নিস্তব্ধ ভ্রমণে নীল আর্মস্ট্রং তখন নমুনা-সন্ধানী৷ এভাবেই চাঁদ বালক আর ঝিমলিদি সারাটা রাত অনন্ত শূন্যতায়৷ শুধু দরমার বাড়িটুকু অজানা উড়ন্ত বস্তুর মতো কেন যে পাড়ি দিতে চায় মহাশূন্যে কৃষেন্দু বুঝতে পারে না৷ অনন্ত লাভাস্রোত আর লতাগুল্মজালে সময় তখন প্লাবিতপ্রায়৷ বালক তার ফ্রকের একটা কোণ শক্ত করে ধরে থাকে৷ সমস্ত মনখারাপ শেষ পর্যন্ত নিউইয়ার গ্রিটিংসের মতো উজ্জ্বল হলেও তাহাদের অসংযম ক্ষুন্নিবৃত্তি আসলে ভোরবেলার যুদ্ধবিরতি৷ দরমার ফাঁক দিয়ে সূর্যালোক ওই এসেছে বিছানায়৷
বাতাস-নিয়ন্ত্রিত এই পথ৷ এই অভিযাত্রা৷ মাথার উপরের আকাশে উড়ে যায় অলৌকিক শ্বেত উত্তরীয়৷ আজ কবেকার রক্তসমুদ্র শুকিয়ে আসা এই পথে দাঁড়িয়ে তুমি, ঝিমলিদি, ইতিহাসের মগ্ন ছাত্রী৷ ধাপে ধাপে উঠে গেছে কারুকার্যময় বিজয়-তোরণ৷ বুলন্দ্ দরওয়াজা৷ নগ্ণ পায়ে রৌদ্রতপ্ত লাল পাথরের মেঝেতে তুমি দাঁড়িয়ে৷ পা রাখা যাচ্ছে না৷ পাশে সানগ্লাস আর টুপিতে ঢাকা তোমার ক্লান্ত পরিবার৷
ফতেপুর গ্রামের সেই নবীন গাইড, ক্লাশ সেভেনের ইব্রাহিম, বাদশা আকবরের গল্প বলছিল ইতিহাসের ছাত্রী, তোমাকে৷ সেইদিন৷ ইদের উজ্জ্বল সকালে৷ তুমি অন্যমনস্ক৷ নিজের ভেতরে নিজে৷ তোমাকে আকুল করে সেই নেশা৷ সেই অশ্রুতপূর্ব গানের সুর৷ অতীতের স্তব্ধ ধুলো, বিষাদময় দুর্গ, তোরণ আর প্রাসাদের হাতছানি৷ তখন কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকে না৷ আলোককুচিময় এই উজ্জ্বল সকাল সেলিম চিস্তির দরগায় চাদর চড়িয়ে গবাক্ষের রঙিন সুতোয় মনোকামনার গিঁট বাঁধতে তোমাকে যতটা উৎসাহী করেছিল, তুমি খররৌদ্রে রুমালে মাথা ঢেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ ছুটে গিয়েছিলে সেই উৎসাহেই৷ ইব্রাহিম, ক্লাশ সেভেনের স্কুল-পালানো সেই ইব্রাহিম, সকালের নমাজের পর তোমার ক্যামেরায় বন্দি করতে চাইছে তোমাদেরই,
‘দিদি রেডি? ভাইসাব আপ জারা সিধা হোকে রহেনা৷ মুন্না, য়েক মিনিট, টোপি লগা লো...’
কয়েক পা দূরের সিক্রি তখন পঞ্চমহলের খা খা শূন্যতায় রৌদ্রে পুড়ে যাচ্ছিল৷ একা৷ অনন্তকাল৷



২. জোছনা করেছে আড়ি


স্নায়ুর অশান্ত চাপ এড়ানোর জন্য যারা গান শোনে তাদের ভালো লাগে কৃষ্ণেন্দুর৷ টানা সাতদিন গান শুনে থম্ মেরে যাওয়া ঝিমলিদিকে ও যেদিন একটা ডেয়ারিমিল্ক দিয়েছিলো, সেইদিন আগ্রার রাস্তায় ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়েছিলো গোলাপায়রার দল৷ সেই অচিন দেশে, হয়ত সেই নির্জনে রূপের সৌরভে খুঁজতে খুঁজতে সেই ঠিকানা আকার আর সাকার হারিয়ে গেল নিরাকার সেই জ্যোতিরূপে৷ তবু ঘাট-আঘাটায় তরল জ্যোৎস্নায় তরী ঠিক রেখে এগিয়ে যাও তুমি৷ অপারের কান্ডারী৷ পাথরের ঠাণ্ডায় মাটির উষ্ণতার সন্ধান৷ তোমাদের প্রেমও কী বহুগামী! সৌন্দর্যসন্ধানী! ইতমদ্-উদ্-দৌলার ব্যাপ্ত করিডোর আর সূক্ষ্ম কারুকাজের সামনে উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে তুমি৷ তার খিলানে, আকাশে উঠে যাওয়া নম্র গম্বুজে, বরফি কাটা অসংখ্য নকশার আড়ম্বরে রঙ পালটে পালটে সূর্যরশ্মির আনাগোনা৷ কে যেন ডাকে, গলা ছেড়ে ডাক দেয় কাউকে৷ সেই চিৎকৃত আগুন ছুটে যায় দোজখে৷ আকুল৷ ধবংসময়৷ তুমি তার সকল অর্থময় ইঙ্গিত কী বুঝেছো কখনও! প্রত্যেকবার নিজেরই খোলা শরীর ঢাকতে চেয়েছো আলোয়, ছায়ায়, অন্ধকারে৷ বৃক্ষহীন সেই বিরাট প্রান্তরে, দয়াল, সঙ্গীতের সুর হয়ে জেগে থাকে সেই ডাক৷ বেহেশ্তের অপার সৌন্দর্য৷ আকুল৷ ধ্বংসময়৷
বাড়ির পেছনের তেজপাতা গাছের ঝিরিঝিরি ছায়ার ফাঁক দিয়ে যে-রোদ্দুর এসে পড়েছিলো ‘সোয়ান’-লেখা ওর ড্রয়িং খাতায়, সেই রোদ্দুরের রঙটা ইদানিং ঠিকঠাক মনে পড়ে না কৃষ্ণেন্দুর৷ প্রতিবেশীবাড়িতে রোজ সন্ধেবেলা তবলার বোলে কথা বলে উঠতো ঝিমলিদির যে-ঘুঙুর, মনে মনে একবার সেই ঘুঙুরের ছবি এঁকেছিলো ও৷ অ্যান্টেনায় বিঁধে থাকা ঘুড়ির দল স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠেছিলো তখন৷ পিচঢাকা কালো রাস্তায় ঝিপঝিপ বৃষ্টির মধ্যে ছুট দিয়েছিলো ও৷ 
স্বপ্নের গভীর থেকে ঘুমের গভীরে সেই শালবন... ঝিরিঝিরি ছায়া... হলুদ বালিতট...৷ মাটির মেঝে ফুঁড়ে তমালের গাছ, বৃক্ষ,সঙ্গীতের অভিষেক সভা... বৃক্ষের গোড়াতেই রসিকজন...৷ উঁচু করে বাঁধানো চত্বর, চত্বরে খ্যাপার দল৷ দো্তারা আড়বাঁশি আর খমকের জগঝম্প৷ আসর জুড়ে ভেঙে পড়েছে মেলা...৷ রাত বাড়ছে, বৃষ্টিবিন্দুর মতো গলে গলে পড়ছে কুয়াশা৷ খ্যাপা তার শীর্ণদেহে ঝলকা কাটা আট কুঠুরি নয় দরোজার সদর কোঠায়৷ গমকের প্রাবল্য ঠিকরে দেয় মেধাবী চোখদুটো৷ ঘাড়ের দুইপাশে ঝামরে এসে পাক খায় খ্যাপার সর্পিল কেশরাশি৷
একটি দুটি মানুষ, নাগরিক, পিঠে রুকস্যাক৷ কুয়াশার মতো অবচেতনের অস্পষ্টতায় নদীর পাড় বরাবর হেঁটে চলেছে সোজা৷ অজয়ের নিস্তরঙ্গ জলে আটকে আছে মধ্যরাত্রির বিষণ্ণ্ চাঁদ৷ রাস্তার পাশে নিভে এসেছে নিজেদের সেঁকে নেবার গণতান্ত্রিক চুল্লি৷ ধোঁয়া উড়ছে, উড়ছে ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক, উড়ছে কাগজপোড়া গন্ধ৷ ধুলোর উপরেই রাতজাগা ক্লান্ত মানুষ আর শ্বাপদেরা কুণ্ডলী পাকিয়ে জিরোচ্ছে৷ 
আলেয়ার আলোয় দূরবর্তী আর দূরের থাকে না৷ ঘুমের গভীরে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই বাঁকা নদী আর তার পিছল ঘাট৷ ক্ষণিকের জন্য গন্ধকালীর গান বধির করে রাখে চরাচর৷ স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে কিছু আশ্চর্য সম্ভাবনা এবং আলোর মুহূর্তরা তৈরি হয়, তৈরি হয় স্রোতের মতো অজস্র উদ্ধত ভয়৷ তমালতলায় গৌরখ্যাপা তখন নানান বিভঙ্গে, নানান মুদ্রায় ঘুরে ঘুরে নাচছে, ডুবকিতে পাঁচ আঙুলের ঝড়, মুখোমুখি তিনকড়ি চক্রবর্তী, খ্যাপার যুগলে বন্দী৷ আকাশ ছাপিয়ে স্বপ্ন ছাপিয়ে অবচেতন জুড়ে জেগে উঠছে সেদিনের সেই গান, ‘...পাড়ে যাবি কী করে?’


হস্টেল ডাইনিঙে লেটস্লিপ দেওয়া রাতের খাবার হিম পড়ে থাকে৷ অকাতরে ঘুমনো রুমমেটের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হাই ওঠে ওর৷ দুপায়ে চটি গলিয়ে ধীরে ধীরে ছাদে যায় কৃষ্ণেন্দু৷ চারদিক রেলিঙতোলা নিয়ন-আলোয় ভেজা এই পাঁচতলার ওপর থেকে ছাদটাকে এখন একটা বিচ্ছিন্ন আইল্যান্ডের মতো মনে হয় ওর৷ ছাদের এককোণে ডাঁই পড়ে আছে ক্যানবিয়রের খোল, মদের নিঃশেষিত ভাঙা বোতল৷ দূরে দূরে অন্ধকার৷ অন্ধকারের ফাঁকে-ফোকরে বিচ্ছিন্ন মাথা উঁচু দাঁড়িয়ে আছে স্টাফ কোয়ার্টার, ওল্ড পিজি, কৃষ্ণেন্দুদের নিউ পিজি, লেডিজ হোস্টেল৷ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বুক ভ’রে ধোঁয়া নেয় কৃষ্ণেন্দু৷ হাঁটতে হাঁটতে ছাদের পেছন দিকটাতে এসে দাঁড়ায়৷ তখনি পাশের রেলপথ দিয়ে একদল ফাঁকা শূন্য কামরা নিয়ে দূর সমুদ্রবন্দরের দিকে শব্দ করে জোরে ছুটে চলে যায় শেষ কোনও ট্রেন৷ অন্ধকার আকাশের বিস্তৃত সিনেমাস্কোপে তখন ইচ্ছের সীমাহীন বিরুদ্ধতা৷
ওদিকে কাহিনিকাব্যের উল্টোপৃষ্ঠায় তখন থিকথিক অন্ধকারে ভাসছে চাঁদ৷ চাঁদের শরীর৷ ধাবমান অশ্বের দ্রুততায় কেউ পেরিয়ে যেতে চাইছে স্বপ্ন, স্বপ্নের ওপার৷ সিগারেট-ঝরানো তামাককুচিতে ছেয়ে আছে বিছানা-চাদর৷ অ্যাকোরিয়ামের নিস্তরঙ্গ জলে মৃতমাংস ছঁুড়ে দেয় মাছ৷ মেঘের শরীরে বাড়ে ক্ষয়৷ কবরের ঝুরঝুর মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে ইবলিশ অথবা মেফিস্টো৷ তাদের বর্ণহীন পোশাক যে-কোনও স্বেচ্ছাচারীর ঈপ্সিত আশ্রয়৷ 
আবার গড়িয়ে নামছে সেই পাথর, সত্যগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে৷ অন্ধকারের ভয়াবহতা আর পঙ্গু ঘোড়ার অসহায় যন্ত্রণা নিয়ে নিচুপথে হ্যাণ্ডক্যাপে-বন্দি মানুষের স্মৃতি আর অস্তিত্ব ছুঁয়ে৷ চার যুগ ধরে সেই গড়িয়ে নামা ধ্বংসকারী চিৎকার ভাষার দুর্বোধ্যতাকে উপেক্ষা করতে চায়, উপেক্ষা করতে চায় মৃত্যুশোক আর পুড়ে যাওয়া কৈশোরকাল৷ কে ফিরিয়ে দেবে তোমার ঘরের চাবি? কে ভুলিয়ে দেবে সেই অশ্রুময় সৎকারদিন? গড়িয়ে নামছে পাথর প্রেতিনীর অগ্নিদগ্ধ প্রেমে৷
উঠোনে শুয়ে আছে সেই মৃতার শরীর আর রহস্যময় সেই স্মৃতিরা দুর্বিনীত সত্তাটিকে টেনে হিঁচড়ে ঠেলে নিয়ে যায় সেই পতনশীল পাথরটার সামনে৷ চার যুগ ধরে সে ঠেলে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে পতনশীল পাথরটাকে আকাঙ্ক্ষার শীর্ষবিন্দুর দিকে৷ নগ্নরাত্রির শরীরে তখন বিন্দু বিন্দু জেগে উঠছে ঘাম৷ লুকনো সিঁড়ির খোঁজে কৃষ্ণেন্দু প্রথমবার লেজ সোজা করে টেরোড্যাকটিলের ভঙ্গিতে মেলে দ্যায় দুই ডানা৷



৩. তোমাকে চাই


আবারও সেই আয়নায় ভুল করে পিঠের জড়ুল দেখে ফেলবার মতো ভয়৷ ক্ষণিকের শিহরণ৷ উত্তেজনা৷ ঢেউয়ের উপরের বুদবুদের মতো নিমেষে মিলিয়ে যাওয়া মুহূর্তরা৷ পরস্পর আদর আর স্বীকৃতি পাওয়ার লাগামহীন প্রতিযোগিতা৷ ডেস্কটপে স্টার্টবার মেনুর এক কোণে ডিজিটাল সময় তখন মধ্যরাত পেরোচ্ছে৷ কবিতা উৎসবের দূরাগত আমন্ত্রণের চমক নীরবে উপেক্ষা করে এই রাত৷ ছোটো ছোটো খোলা জানলার কোণে সবুজ আলোর বিন্দুরা জ্বলতে থাকে৷ শব্দ করে কথারা এসে ভিড় করে৷ ভিড় করে সমূহ কবিতারা৷ একটু একটু করে শীতের কুয়াশা হালকা হয়ে আসে৷ স্বচ্ছ ডানার ফড়িঙেরা দূর থেকে উড়ে আসে পরাগকুচি মাখা প্রত্যঙ্গ নিয়ে৷ 
এই ওষ্ঠে বিষাক্ত রঙ৷ এই ওষ্ঠে কামনারা অধিকার সচেতন৷ এই ন্যাড়া প্রান্তরে এখন চাঁদ ঢলে এসেছে৷ চলকে উঠেছে সেই পিছল-ঘাট৷ বাঁকা নদীর তীরে শ্রান্ত হাটুরের এই অবিরাম পথচলা৷ গৃহস্থের রাত্রিব্যাপী আত্মকণ্ডূয়ণ, জ্যোৎস্নার গভীরে বিপজ্জনক চলাফেরা, গান, স্মৃতির রোমন্থন৷ এ সবই নিয়মতান্ত্রিকতারও আরও অধিক কিছু৷ এই অনিবার্য ফাল্গুনের রাতে, আলেক, যাবতীয় প্রতীক আর চিত্রকল্পের ইশারাকে অগ্রাহ্য করে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে অনিবার্য সেই গান৷ আর এই অন্ধকারে আবার বাতিল পোড়াকাঠগুলি জ্বলে উঠল স্বপ্ণে৷ বিষণ্ণ্, জরাগ্রস্ত৷
কবেকার হারিয়ে যাওয়া একটা স্বপ্ন বিষণ্ণ্ গমক্ষেতে ধূসর কাকেদের ওড়াউড়ি দেখছিল, দেখছিল কী ভাবে ভ্যান গখ মোটা মোটা ব্রাশের আঁচড়ে আদিগন্ত ছড়ানো ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলছিলেন তাঁর ভয়৷ যে ভয় গ্রহ-উপগ্রহ ব্রহ্মাণ্ডমণ্ডল ছাড়িয়ে নিতান্তই একটি শিশুর বুকে বাসা বেঁধেছিল৷ ঘুণপোকার মতো যাপনের মৃদু কর্কশ শব্দ একঘেয়ে শ্লোগান অথবা টেলিভিশনের টক-শোয়ের মতো ক্রমশ ক্লান্তিকর হয়ে উঠছিল৷ বাতিল পোড়াকাঠগুলি নিজেদের পাঁজর জ্বালিয়ে ওই প্রপাতের যাবতীয় গ্রাস থেকে ভয়ার্ত শিশুটিকে আগলে রাখছিল৷ আগলে রাখছিল বন্দুকবাজদের যাবতীয় অসহিষ্ণুতা থেকে৷


তারপর মন্দির-চাতাল৷ আঙুল ঠিকরে বেরোয় লুকনো বাঘনখ৷ বাসি রক্তরসে ভ’রে ওঠে অস্কারপ্রাপ্ত দামি সেলুলয়েড৷ তুমুল আক্রোশে স্বপ্নের তলপেট ফাঁসিয়ে দ্যায় খ্যাপা৷ ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে হারিয়ে যায় বিয়রের বোতল, পাখির ছিন্ন পালক৷ ঝাউয়ের আড়াল থেকে চোখ মেলে তাকায় মরা চাঁদ৷ 
---‘তোর জন্য এক বাক্স ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি৷ ফিরে গিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেবো মন’--- লেডিজ হোস্টেল থেকে উড়ে যায় এইসব এলোমেলো স্মৃতি দূরবর্তী অন্য কোনও বালিকার কাছে৷ 
অপেক্ষার দুপুর গড়িয়ে ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে ওঠে তার ছুটির বিকেল৷ জানালার বাইরে থেকে নুয়ে আসা রোদ এসে পড়ে লেখার টেবিলে৷ উড়ে যায় পরিত্যক্ত চিঠি, না-পাঠানো এসেমেস৷ হাত ধরাধরি করে হেঁটে যায় নিরালা-সফর৷ ম্যানগ্রোভগাছের ভিড়ে জমে ওঠা নোনাজলে হারিয়ে যায় বন্ধুমুখ৷ ঝাউয়ের ছায়ায় ছায়ায় খেলা করে আলো আর অনির্বাণ বর্ণালী৷ উপমহাদেশে তখন ভীষণ লু৷ বিকেল ফুরিয়ে আসে৷ মেয়েরা গা ধোয় বিজ্ঞাপিত দুগ্ধফেননিভ নির্দিষ্ট সাবানে৷ স্নানশেষে ছোটো ছোটো-জামা পরে৷ বিছানার গভীর নরম থেকে মুখ তুলে ঠোঁট মেলে ধরে৷ বালিশের ফোকরে ফোকরে বাসা বেঁধে থাকা পতঙ্গেরা দুলে ওঠে হর্ষে৷ সমকাল গেয়ে ওঠে মহুয়াসুন্দরী৷ 
--- কী হল! চুপচাপ, কী ভাবছো বলো? ভয় কীসের?... মাত্র দুদিনের এই ট্যুর আমাদের৷ মোবাইলও সুইচ অফ্ আছে৷ কৃষ্ণেন্দু শুনছো? শুনতে পাচ্ছো? ... কৌমার্যের অহেতুক অহংকারে কীভাবে এতো দাম্ভিক হও তুমি! আমাকে এভাবে উপেক্ষা করো, করতে পারো! ... উফ্, এই অবহেলা আর টলারেট করা যাচ্ছে না৷
--- অনেক রাত্রি হয়েছে এখন, চুপ করো৷ ভাল্লাগছে না আর৷ কালই ফিরতে চাই কলকাতায়৷ যদি তুমি সঙ্গে থাকো--- ভালো, নয়তো কলকাতায় একা ফিরে যাব৷ এই প্রথমবার বি.আর.বি.-র টিউটোরিয়াল সেইসব মেটাফিজিক্যাল পোয়েটদের নিয়ে৷ দেবে না তুমি সোমদত্তা?
---কাল তো অনেকের আসার কথা এখানে৷ হঠাৎ ফিরবো কেন বলো? মোহর জানবে দেখো এসে ঠিক সকালবেলা৷ আর ওর সঙ্গে আসবে ওই ফিল্মি-ঋত্বিক, সিনেমা বানায় যে...
---তা অবশ্য ঠিক৷ তুমি তবে ফিরবে কেন সোমদত্তা! কিন্তু আমাকে যেতেই হবে যে৷ তুমি তো জানোই ওই টিউটোরিয়াল তুমি না দিলেও তোমার কোনও প্রবলেম নেই৷ কিন্তু, আমি, উফ্, প্লিজ, বুক থেকে নামো---
--- কী বলছ এইসব? ছিঃ৷ চুপ করো৷ থামো৷ আমাকে তুমি যে বোঝো না তা আমি জানি কৃষ্ণেন্দু৷ কিন্তু এখনও এভাবে আমাকে বারবার আঘাত করে কী পাও তুমি? বলোনি আমায় কখনও৷ 
---প্লিজ...
---কীসের প্লিজ! 
---প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও...
---মানে? কি বলছো তুমি জানো? যেভাবে জাগতিক আলো ঢেউ বাতাসেরা দিক চিনে রাখে, সেভাবে তোমার বুকে মুখ গুঁজে পড়ে আছি আমি৷ পাবো না একটু আশ্রয়, ভালোবাসাবাসি?
---আমি তো জানি সেই প্রথম দিন৷ তুমি কলেজের করিডোরে একা৷ একলা দাঁড়িয়ে৷
---সমস্ত আকাশ গুমোটভার, রিনঝিন শব্দে বৃষ্টি...
---তোমার পাশে দোতলার ফাঁকা করিডোরে আমি৷ দুজনের করতল বরষাধারায় ভিজে যাচ্ছে---
---অনেকটা যেন ওই কালিদাস... ক্লেদমুক্ত বিরহী যক্ষ চক্ষু মেলি চায়!
---সোমদত্তাও কবিতা লেখে জানতাম না তো৷ এইরে--- স্যরি...
---এই তো সোনা, সোনামাণিক আমার... উম্ম্ম... উঃ উফ্... আ---আ---আহ্ উঁ... উম্ম্ম...
--- এই প্লিজ কী হচ্---ছে... উম্ম্ম... উফ্... প্লিজ.... আঃ---আহ্হ--- আঃ...শো-ও-নো... অনেক রাত... উফফফ্...



৪. এবং অন্ধকার


এখন রোদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না কৃষ্ণেন্দু৷ যতোটা সবুজ ওর ভালো লাগে, ততোটা আর কারো লাগতেই পারে বলে বিশ্বাস নেই ওর৷ কারখানা শ্রমিকদের অনশন-লিফলেট নিয়ে ছুটে আসে পার্টিবাজ বন্ধুরা৷ টেবিলে রঙ আর তুলি দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে বন্ধুদের পার্টির পোস্টারে প্রিয় কবিতার লাইন লিখে ফেলে ও৷ অথচ সকলেই অসম্ভব কোপারেটিভ৷ সহযোগিতামূলক৷ কৃষ্ণেন্দুও তো মানুষকে ভালোবাসতে চেয়েছিলো, মেলাতে চেয়েছিলো সচেতন ব্যান্ডগান ও এলোমেলো ফকিরি-যাপন! মঞ্চের ঝিকিমিকি আলোর নীচে বাংলা গান ও কবিতার সেই আশ্চর্য যুগলবন্দি যোগেন চৌধুরীর পেপার অন ইঙ্ক-এর মতোই ভীষণরকম স্ট্রোক-প্রবণ৷ 
রাসবিহারীর মোড়ে ওভারহেড তারে তখন ধূসর কাকেদের মহাসম্মেলন৷ তাদের স্থির অথচ অস্থির ছায়া এই কুয়াশায় নতুন অর্থনীতির অনিবার্য দহনপর্বে আরও আরেকবার পোড়ায় ঔপন্যাসিককে৷ একটি টংকার খোঁজে ঔপন্যাসিক ছুটে যান একটার পর একটা বাণিজ্যকেন্দ্রে! অথচ ঘরোয়া আসরে যথারীতি ডুবকি দোতারা খমক ও গিটার প্রস্তুত৷ প্রস্তুতিপর্বের এই শীতে তিনশো কিলোমিটার দূর থেকে ফিরে আসেন শিশুর জননী! বাংলা গান ও বাংলা কবিতার এই নির্বিকার উৎসব শুধু উপভোগ করেন একজন ঔপন্যাসিক৷ তিনিও মানুষেরই মতো৷ রাত্রি বেড়ে গেলে তাঁর রক্তচাপও যায় বেড়ে৷ তিনিও মোবাইলে খুঁজে বেড়ান হারানো সঙ্গীকে৷ অথচ ছুটতে ছুটতে রাস্তা যেখান থেকে দ্বিখণ্ডিত তার প্রান্তেই বন্ধুদের বাড়ি৷ যোজন যোজন অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা শীতার্ত রাত৷ অনেক হিসেব শেষে অনেক অকপট সত্যের পর এই ফিরে আসা৷ এই নির্বিঘ্ন অথচ শঙ্কাপ্রবণ ভ্রমণ৷ কখন মৃত্যুর নিরাপদ শূন্যতার মতো তোমাকে ছুঁয়ে দেখা৷ মত্তনীল অন্ধকারে আকাশ তখন প্রিয় শরীরের মতো সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরেছে৷ তার অন্ধকার খাঁজে খাঁজে নিশ্চুপ দিঘির মতো হারিয়ে গেছেন ঔপন্যাসিক৷ 
কেউ নিষেধ করেনি বলেই সূর্যমন্দিরের ক্ষয়িষ্ণু টিলার পাশে খণ্ডগিরির নিচু গুহায় উবু হয়ে এই অনন্ত বসে থাকা আর তার অসবর্ণ ইঙ্গিতময়তা থেকে গর্ভবতী মেঘ দ্রুত গর্ভমোচনের উৎসাহ পায়৷ ঊরুসন্ধিতে রয়ে যাওয়া আশ্চর্য কমনীয়তা হিট বাংলাব্যান্ডের সুরে রিহার্সাল দ্যায় রোজ৷ বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের ঘুমন্ত প্রেরণা ইথার তরঙ্গে পৌঁছে যায় হোয়াইটহাউস রাইটার্স নবান্ন থেকে ভয়ার্ত মফসসলের আলোকোজ্জ্বল গলির তেতলার কোণের কামশীতল বাথরুমে৷ জলভর্তি প্লাস্টিকের বালতি ও মগ৷ দুটো ইট৷ এবং খাটের পেছনে কী ভীষণ জান্তব একফালি ড্রেন৷

একটা ট্রাম অনেকক্ষণ আটকে আছে রাস্তায়৷ রোদে ঝলসে ওঠা ওভারহেড তারে ঘষে ঘষে ঠোঁটের নোংরা পরিস্কার করছে একটা কাক৷ জনপ্রিয় উপন্যাস-লেখক অনুপুঙ্খ জেনে নিতে চান কৃষ্ণেন্দুদের যাপনের আলো ও অন্ধকার৷ কলেজের দেয়ালে দেয়ালে ইচ্ছে আর মৃত্যুর খবর চক দিয়ে লিখে রাখে কেউ৷ কারা যেন অপেক্ষা করে৷ কারা যেন উত্তর দ্যায়৷ কামুক রাক্ষসীর চোখে চেয়ে থাকে ওদের আকাশ৷
---তাহলে তো তোমরা সবাই মিথ্যে হয়ে যাও৷
ভয়ঙ্কর ভিড়-বাসে হঠাৎই আর্তনাদ করে ওঠেন ঔপন্যাসিক৷
---তোমাদের প্যাশন, প্রেম, তোমাদের ইচ্ছে-স্বপ্ন সব তবে মিথ্যাচারে ঢেকে যায়৷
যেন কোন্ অতল জলের মগ্নতা থেকে চিৎকার করে ওঠেন ঔপন্যাসিক৷ কৃষ্ণেন্দু কোনও উত্তর দিতে পারে না৷
আগ্রার রাস্তায় রাস্তায় সাদা-কালো গোলাপায়রার দল উড়াল দিয়েছিল তখন৷ ফটফটে শুভ্র বেসিনে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত বন্ধুর অনর্গল বমি করে যাওয়া মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর৷ আলো আর অন্ধকারের ত্রিমাত্রিক ত্রিভুজের একদিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ উদ্বায়ী হয়ে উঠেছিলো কৃষ্ণেন্দুর মন৷ 
                                                                                    
(এরপর আগামী সংখ্যায়)

তিনটি কবিতা/রামকিশোর ভট্টাচার্য

রামকিশোর ভট্টাচার্য।। তিনটি কবিতা

এক.
রাতের দিকে তাকিয়ে কত টিপ্পনি হল
স্বপ্ন দেখার আশায় নামা হল সাবেক গভীরে !
ছিটে ফোঁটা কষ্ট না থাকলেও
বিজ্ঞাপিত কষ্টের আলোয়
উল্টে পাল্টে গেল কষ্টের সংজ্ঞাটিও...
এবার একদিন জানলাটি দেখিয়ে দেবে-
কত শ্যাওলা জমেছে শরীরে ..
আবছা গোঙানি রিংটোন হয়ে বেজে যাবে এ মিথ্যে থেকে ও মিথ্যের সংসারে ৷
সে জীবনে তুমি শুধু ধারাবাহিকতা ছাড়া কিছু নয়।

দুই.
মশল্লার গন্ধ বাজছে দৃশ্যের আড়ালে
মরশুমি প্রস্তাবেরা টলটল করছে অন্যের জীবনে ..
নীলছকে হেঁটে যেতে যেতে বোঝাই গেল না
কত গভীরে সামান্য সোহাগার ছোঁয়ায়
গলে যাচ্ছে সুবর্ণগোলক...
বাঁকাচোরা স্মৃতিচোখ পড়েই চলেছে -
আরোগ্যরাতে চুঁয়ে নামা কাব্যনাটক...


তিন.
রঞ্জন থেকে গাছ ৷ গাছ থেকে রঙবাজি ..
তারপর আঁকাবাঁকা মেঘপল্লীর চড়াই -উৎরাই,
সামনের কয়েকটা আলোয় মরচে ধরেছে
কু ঝিক ঝিক গাইতে গাইতে এগিয়ে চলা রাত
বদলে দিচ্ছে মরচের রঙ,
এতদিন চক্রব্যূহ ...ভেল্কি ভেবে আদল বদল ...তবু
ঠিকানা পরিবর্তনের রাতে
গল্পের শিরোনাম বলাই হলনা...

কবিতা/প্রবীর দাস


প্রবীর দাস।।কিছুটা প্রেম


প্রতিটি দিনের ছোটোখাটো ভ্রমণের শেষে

পিছনের পথে খোদিত চিহ্ন যত ফিরে ফিরে দেখা

কানে বাজে কালজয়ী বাউলের সুর

যে পথে কিছুতেই পুনর্বার ফিরে আসা নয়

ভেসে ভেসে ক্ষয়ে যাওয়া মেঘের মতন

সেই পথে ডালপালা ফুল ও পাতা

পুড়ে পুড়ে ছাই, উড়ে যায় স্মৃতিমগ্ন সন্ধ্যার নির্জনে

এঁকে রাখা জলের বৈভবে

হলুদ পাখির ডানার অমূল্য কারুকাজ ---



চারিদিকে আলো ম্লান, ঘিরে ধরে অন্ধকার

পৃথিবীতে আর কোনো নতুনের জিজ্ঞাসা না থাকায়

বলার মতো একটিও কথা না থাকায়

নিরর্থক দিনের উৎকীর্ণ কথায় কিছুটা আত্মমগ্ন ...

বোধ হয় এও সেই গনগনে অভিমান, কিছুটা প্রেম!

কবিতা/রাণা রায়চৌধুরী


রাণা রায়চৌধুরী।। ইনবক্স


একটা ফালতু বাতাস, একটা বাতিল বাতাস ইনবক্সে ঢুকে পড়েছে


কোন দিকে দাঁড়াবো বুঝতে পারছি না


সিনিয়র সিটিজেন-এ ইন্টারেস্ট বেশি দেবে কোপাই নদী --- একথা বলল, এক

ঋতুমতী দোয়েল পাখি।


ল্যাপটপে সুন্দরীর বিজ্ঞাপন বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি জোরে ছুটছে।


আমি কার পক্ষ নেব বুঝতে পারি না।

ঐদিকে সরলা অবলা, এইদিকে কাকের সবুজ ঘাসময় ইশারা।


একটা কিছু ঘটছে চারিদিকে।

কেউ হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে, কেউ নক্ষত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হতে চাইছে, কেউ কেউ আবার শীর্ষে যেতে চাইছে,

কাঠঠোকরা কাঠে মগ্ন, মাছরাঙা মাছে।


আমি পাখির পক্ষ নিই।

তুমি ন্যায়ের ব্যাখ্যা দিচ্ছ সন্ন্যাসীকে।

কবিতা/সুমিতাভ ঘোষাল



সুমিতাভ ঘোষাল।। আত্মজ ৮


পুনর্জন্মগুলি উড়ে যায়

আঁকাবাঁকা দুরূহ প্রপাতে

শুধু এইটুকু জেনে

পরাগরেণুর কোনও ব্যর্থতা নেই

ওরা সব নিজস্ব ক্ষত চুলকে

দালানেতে দোতারা বাজায়

মাধুকরী করে

একটা পায়ের ছাপ

দূরে চলে যায়

ক্রমবিলীয়মান

পরে আর দেখাও যায়না

তারপর পুনর্জন্মরা

হাত ধরাধরি করে নাচে

তখন কি চাঁদ এসে বলে ?

এভাবেও মরা যায় ?

এভাবেও মরে যাওয়া যায় ?

স্মরণ/প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় শম্ভু রক্ষিত বিজয়া মুখোপাধ্যায়


স্মরণ
প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় শম্ভু রক্ষিত বিজয়া মুখোপাধ্যায়





প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়৷৷ এই আমি

নিজেকে দেখি না আর ঘুরেফিরে আগের মতন,
তাকাই না সোজাসুজি আর
নিজের মুখের দিকে,নিজের চোখের দিকে, যেন
ফিরে তাকাবার
ফুরিয়েছে সব প্রয়োজন!
ওদিকে এখন
বেশ টের পাই যে শরীরে
অব্যর্থ গতিতে ধীরেধীরে
অস্তাচল ফেলছে তার আরক্ত মেঘের ছায়াখানি৷
ফেলুক৷ তা স্বাভাবিক৷ তাতে কি আয়নার হাতছানি
এভাবে অগ্রাহ্য করা যায়?
নাকি তা মনের দিক থেকে সুস্থ মানুষকে মানায়?
তবে কেন! কেন?
ভাবতে গিয়ে ঘিরে ফেলল একরাশ ভয়ংকর ভয়!
যে-আমি আমার সামনে, সেই আমি সম্পূর্ণ অচেনা৷
আমি কেন,কেউই তাকে দ্যাখেনি, জানে না!
সত্যি বলতে, সেই আমি এই আমি নয়!





শম্ভু রক্ষিত।। প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না

২৭.
হৃদরোগের সন্ধান নিয়ে ঢুকে পড়ো। সরবরাহকারী নির্মাণযন্ত্র
পৃথিবীর মেঘময় আতঙ্ক শেষপর্যন্ত আধার হিসেবে।
ঊর্ধ্বময় সর্বনাশ ভেবে স্নায়ুতন্ত্রের কাজ। সুরক্ষিত জল
দহনক্রিয়া মাথার ধ্মনী ছিঁড়ে যাও, বোতল, বায়ুর কাঠিন্য অনুশীলন শরীর
অরণ্যসমগ্র, পাখিদের শ্রবণশক্তি, আঙুরসমস্যা শজ নয়
উজ্জ্বল মাথার পর্যবেক্ষণ ভেঙ্গে অবসাদ্গ্রস্ত উচ্চগ্রামের অংশে
প্রমানিত হি, অন্ধ দৈবজ্ঞ, সৌরশক্তি,প্রশান্তি যেন আওয়াজ বিক্রি
টিন-ভর্তি কুয়াশা নিয়ে মানুষ-জীবজন্তুর মাথা হয়ে হাতজোড় করি
বসো গৌরবসূর্য, অদ্ভুত ভূত-প্রেত বিশ্বাস সে-বিষয়ে সচেতন
পৃথিবীর মেঘ, শিষ,দৃষ্টিনির্ভর আস্বাদনের ফসল রহস্যের মিশ্রণ চেওনা
অতুল ঘনরাশি ও উরসুলা কিয়দংশের লাল রং লেগে আছে দুর্যোগমথিত
এলাকায়; তোমার কোনো অলৌকিক পরিক্রমা নেই। শুধু ফুলবাগিচার
ও জল বায়ু কুয়াশার অংশ লক্ষনীয়, সাড়া দাও । রূপকের মত বিবরণ, দৈববানী
সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমানিত হয়েযায়; শরীরের ভিতর বেশী, নিশ্চিত প্রমাণ এই
গবেষণা শক্তি, কেন-না, এখানে এই উক্ত সত্যি স্বর্ণময় হয়-আবিস্কার
রং তুলি বিপদের হূঁশিয়ারী রূপকর্ম হয় ও যেন আদানপ্রদান
তোমার সহানুভূতিশীল হৃদয়টি আমার চাই...





বিজয়া মুখোপাধ্যায়।।একই স্বপ্ন রোজ

এখন আমি একই স্বপ্ন দেখি রোজ
আশৈশব সম্পর্ক নেই যার সংগে সেই বাড়ির।
দেখতে পাই
নাটমন্দিরের দুপাশে জুঁই ফুটেছে---
এখন বর্ষা।
দেখি, দিঘির ঘাট থেকে উঠে আসছে কেউ
আমার মায়ের মত।
দেখি আসগর আলির
সুপুরি গাছে উঠে-যাওয়া লম্বা লম্বা পা,
আর দিগন্ত জোড়া পাটখেত।
ওরা এখন শরণার্থী, ষাট লক্ষ।
ওরা সারাদিন সদরে ঘন্টা বাজায়
আমি অসাড়,
শুধু রাত্রে স্বপ্ন আসে নাটমন্দির,
পাটখেতে ঢেউ, আসগর আলির পা।


দুটি কবিতা/অনুপ মণ্ডল


অনুপ মণ্ডল।।দুটি কবিতা

উষ্ণতা

বিষন্ন বারুদের ভিজে যাওয়া বিছানা থেকে
অভিমান গোপন করার কৌশল শিখে নিচ্ছি
মনের যাবতীয় রহস‍্য
মৃত সাপের ছায়া হয়ে শুয়ে আছে
পথে ফণা তুলে আছে যে সাপ
তার সামনে আমার কাটা হাত মেলে ধরি
দ‍্যাখো,এখানে কোনও মৃত‍্যু লেখা নেই


সম্মিলিত সদ্ভাবনা থেকে
সাদারঙ পৃথিবীর দিকে আমি গড়িয়ে যাই
পাকা বিম্বের লাল রঙ,পুড়ে যাচ্ছি একা
অস্থির অস্থির;উষ্ণতা আমার পাশেই আছে
যে পাশে কাঠগুলো সাজাতে পারেনি রাখাল




অলিন্দসুখ


করাতকলের বৈধতায় প্রোরোচনামূলক অভিধান
আমার সামনেই মেলে ধরা আছে
উঁচু উঁচু গাছগুলো ঝুঁকে পড়ে দেখছে
আমার সঙ্গে গাছ,গাছের সঙ্গে আকাশ
পাখির শরীরে পালকের অভিসন্ধিমূলক অলিন্দ
তোমার নজরে আসেনি
তুমি তাই দেখেছ
খসে যাওয়া পালকের দ্বিতীয় উড়ান
পুনরায় পাখি হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছে একাকী


সন্দেহের উর্ধে নয়,বারুদবিভ্রাটে তোমার গতি
আমরা তোমার পেছন পেছন দু'ভাগ হয়ে
কেউ চলে গেছি শব্দে কেউ কেউ আলোয়


দুটি কবিতা/সুকুমার চৌধুরী


সুকুমার চৌধুরী।। দুটি কবিতা



শিস্


ইচ্ছেটুকুই সর্বস্ব নয় জেনো



মরার পর বাঁচার কথা



আমাকে বলো না



মরে গেলে অচিন পাখি হয়ে



এসে বসবো তোমার দোরে



তুমি দুর দুর করে তাড়িয়ে দেবে



কখনো খুদকুড়ো দেবে




ও সব কি ভালো



তাচ্চেয়ে দুর দুর, খুদকুড়ো, যা পাওয়ার



সব এই জীবনেই ভালো




আর আসার কথা বলো না আমাকে



মরার পর বাঁচার কথা



আমার ভালো লাগে না



যাপন

অসুবিধে হয় জানি । ব্যপ্ত চরাচরে শুধু

ফনিমনসার উলু ।

কতকাঁটা, সমাজ, সংস্কার, ভয়

ক্ষোভ, মুল্যবোধ ।



আমার ভালো লাগা মুখোশখানা তুমি নাও

আমাকে দাও তোমারটা ।আর এভাবেই

এসো ভুলে যাই পারিপার্শ ।



হয়তো বা ফাঁকি,

তবু এও এক অন্যরকম অভিনয় ।আপাতসুন্দর ।

এসো শিখে নিই আর

প্রতিবেশীদের মতো রক্তমাংসময় বেঁচে বর্তে থাকি

কবিতা/অমিত কাশ‍্যপ


অমিত কাশ‍্যপ।।রামরাজত্ব

শ্রাবণ ভাবলে বৃষ্টি এল, না ভাবলে
এখন সেই চেনা শহর নেই, সিগারেট, পানের দোকান
বন্ধ, সাহসী সারমেয়কুল
আড়াল নেয়, অনায়াস ছন্দে রাস্তা হাঁটি


এত শান্তির শহর আগে দেখিনি, পুলিশ নেই, প্রশাসন নেই
ফুটপাতবাসীও নেই, ম‍্যাজিক নাকি
মাঝে মাঝে পেছন ফিরি, কোনো ছায়া, কোনো নিশিডাক


রাত নয়, তবুও পাশে এসে দাঁড়ায়
বন্ধু ভাবলে বন্ধু, না ভাবলে
কারুর কিছু করার নেই, পেটোবাজ, প্রোমোটার সিঁধিয়ে গেল, রামরাজত্ব

তিনটি কবিতা/ইন্দ্রজিৎ রায়


ইন্দ্রজিৎ রায়।।তিনটি কবিতা


কলেজ বিড়ি -১

একটা দুটো চাদর থাকে , কিছুতেই

পুরোনো হয়না ,একজীবন চলে

যায় , গদাইয়ের দোকানের মত ,

রোজই গরম রসের জন্য

সমাগম । কি জানো , শুধু কিছু

চকিত বাতাস এসে , রান্নাঘরটা

ভেঙ্গে দিয়ে যায় । এক ঝুড়ি

বাসনকোসন , বালতি ঘুঙুর , ভাঙ্গা

একতারা , ছত্রাখান । কালো জমজমি চাদর , তারা বসানো , তারায় তারায় , দিদার যশোর খুলনা , আমার ছোট্ট মা খাবার

টেবিলে , চড়ে বসে আছে , বাহাদুর

ভাত লাও , হরে কৃষ্ণ বলছে

শাহী কাকাতুয়া ।



রান্নাঘর ভেঙ্গে দেয় কাল । বাকিটা

আমরা দেখে নেবো । চাদর , চুমকি

বসানো , তারার শহরে মাতামহিদের ছানিকাটা চশমা ,

ভাঙ্গা উনুনে , শেয়ালনির ঘরবাড়ি ।।



কলেজ বিড়ি ২

বিকেল শেষে হাত পা ঢুকেপড়তে চায় মুখের ভেতর । তৃতীয়বিশ্বের হাত চিবাতে থাকি,সজিনাডাঁটার অভ্যাসে । সরকারি চাকরি করা , আপোষহীন বাজনদার , তাদের কোলাহল শুনি । সম্প্রতি ,কটা ঝিঁঝিপোকা এবাড়িতে ,শেল্টার্ নিয়েছে । গভীর রাতে ,নিদ্রিত পাড়ার কাঁধে বসে,দিনের শেষ বিড়িটা ধরায় ঝিঁঝি । নাকি ওটা অন্য কেউ ,বারান্দার অন্ধকারে?


ঝিঁঝিপোকা কি বিড়িও টানে আজকাল


নেশার পরে

হাত ধরে টানে অন্ধকারের গলিগুলো পৌষে । মেলার ঠাকুর দেখি বাইরে , চাতালে বসে । ছিলাম আছে । লালচে সাফি , ছেদক যন্তর । যা ছেদন করে দেবে এ দোকানপাট , আয়নার গলি । এদিকটা কেমন যেন মারোয়াড়ি গন্ধ , ঘী আর চাট মশলা । মেলার ঠাকুর হ্যাংওভার মুক্ত । ওসব পেঁচো মাতালদের হয় । ঠাকুরের সব তখন তখন । গরম । রিহ্যাব্ সেন্টারের গলি থেকে , ঝকঝকে সাইকেল নিয়ে আপুয়া বেরিয়ে কোথায় যেন যায় । প্রায়ই দেখি ,আইসক্রীম গলছে , লালশালু মোড়া কুলফি গাড়ি থেকে ,গাঢ় সবুজ বল হাতে দিচ্ছে রামপুকার । কোথা বাড়ি ? মুঙ্গের জিলা । পৌষের গলি টানে , মা'কে বলা যত নেশাজনিত মিথ্যে , হাতে খইনির মত ডলছি আজ । চিট আঠা এত , মা নেই , মিথ্যেগুলো ,রয়ে গেছে , মেলার ঠাকুরের কাছে আসি , কান্না পায় হঠাৎ ,সারদা মা'র একটা ছবি হাতে দিয়ে বলেন , লে জা বেটা ।



পেঁচো দের সঙ্গে আর কথা হয়না তেমন । খর্বকায় মন্দির থেকে গডজিলার মত হরিনাম , পথ হারানো মথের মত , ধাক্কা লাগে দেয়াল থেকে দেয়ালে ।।


কয়েকটি কবিতা/অরুণ কুমার চক্রবর্তী



অরুণ কুমার চক্রবর্তী।। কয়েকটি কবিতা


ঢেউ
অশান্ত ঢেউরা আজ দুদ্দার ডাঙায় উঠে এসেছে
কেউ আজ স্থির নেই ,
অশান্ত ঢেউয়ের চাবুকে সবাই অস্থির ,
পাড়ায় পাড়ায় ঢেউ , গ্রামেগঞ্জে শহরে , বিশ্বাস ভাঙনে
আলোঅন্ধকারে , শিবিরে শিবিরে , পাড়ার টেবিলে , রান্নাঘরে ,
ধর্ষণে সঙ্গমে , ঢেউ , কী ভাবে সামলানো যাবে
আয় ঢেউ , তোর মাথায় নাচি ,বাঁশি হাতে , অস্ত্র হাতে সস্ত্র হাতে ,
আয় ঢেউ তোর মাথায় নাচি
চায়না থেকে ওই করাচী
চিনেই গেছি চিনেই গেছি
আয় ঢেউ তোর মাথায় নাচি
ছোবল দেয়া চির শমন
কলীয় দমন সার করেছি
তোর মারনে আমরা বাঁচি
আয় আয় তোর মাথায় নাচি
তোর মাথাটা চিবিয়ে বাঁচি


অশ্লীল এক
পথের পাঁচালির সেই করুণ দৃশ্যপট .....
হরিহর অনেকদিন পর বাড়ি ফিরেছেন ,
সংসারের টুকিটাকি জিনিসপত্তর...এটা ...সেটা
শেষে একটি আটপৌরে শাড়ি স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, এটা দুগ্গা মার্ জন্যে,
হরিহর তখনও জানেন না
দুগ্গামা নেই ....
করুণাময়ী সর্বজায়া শাড়িখানি দুহাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরে নীরবে হুহু কেঁদে উঠলেন .....

ব্রেক
কনডম আর সুগন্ধি ফ্রেমে ঢাকা যৌন উত্তেজনার ঝকঝকে এডভার্টাইসমেন্ট উদ্ভিন্ন যৌনবতী যৌনবানের মাখামাখি কামজ বিলাস বিলাস... মিউজিক...

আমার আর নতুন করে বাকিটা দেখার মন থাকে না
বুকের মধ্যে একটা কষ্ট গুমরে ওঠে ....

অশ্লীল দুই
দুর্বিনীত টিভির রাক্ষুসে খিদের এবার চোখ পড়েছে
কচিকাঁচাদের ওপর ,
ঝলমলে ঝকঝকে ফ্লোর, চারদিকে উজ্জ্বল আলোর ঝলমলিয়া কারিকুরি,আহা মোহময় আলোর আলোকপুরী, উজ্জ্বল বিখ্যাত বিচারকদের বাহাবাহা চিৎকারে উজ্জীবিত শিশুদের দঙ্গল , উল্লাসে ফেটে পড়ছে দর্শক , ওখানে শিশুদের বাবামায়েরাও আছেন, উদগ্র মিউসিক মিউজিক গান .....
হায় বেবী সেক্সি সেক্সি .....
চুমা দেদে চুমা....
আজ রাতে মন্দ হোলে ক্ষতিকি ....

স্তনহীন বুকে দুলেদুলে উঠছে অদৃশ্য স্তনভার , কচি কোমরে পাছায় বয়স্ক ছন্দ
কচিকচি শিশুদের মুখে উদ্দাম যৌনবান যৌনাবতীদের উল্লাস , তীব্র উল্লাস শিশ , জব্বর হাততালি
ওপরথেকে ঝুলে আছে লক্ষলক্ষ টাকার গাজরের লোভ , আর গ্ল্যামারে গ্ল্যামারের রের বিমূর্ত থাবা


বিজয়ীদের সুতীব্র উল্লাস....
পরাজিতের চোখে টপটপ নোনা জল গড়াতে গড়াতে পৌছে সুকুমার মনের গভীরে ...
ব্রেক
অনেকদিন পর , ওই সব পরাজিত বিজয়ী কচিকাঁচাদের মুখগুলি খুঁজতে গিয়ে দেখি, ওদের ঠিকানা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না.....


দুটি কবিতা/বৌধায়ন মুখোপাধ্যায়



বৌধায়ন মুখোপাধ্যায়।।দুটি কবিতা

শোকগাথা ১

কে আমার আদি পিতা, কে সেই প্রাচীনতম মাইক্রোব



আমার বাদামি শরীরে দিলে

এতো অভিশাপ অন্ধত্ব



আমি তো আজন্ম আত্মসর্বনাশ বিভেদি কুঠার



হাতে নেমেছি নীলঘাস ঠেলে

উন্মাদ সমযুদ্ধে



আমি সর্বস্ব উজাড় করে

ঢেলেছি তপ্তবিষ গোলাপ শরীরে



খুব শীত ,খুব শীতাক্ত নয় কি

গোলাপ শরীর ?



এর নাম অকাল বিধ্বস্ত খেত

সর্বগ্রাসী সাইক্লোন

এর নাম অসময় , সুরজাল



ভাসমান অন্ধকার ,কয়েকটি ভাঙা এলিমুনিয়াম থালা



ফুটপাথে পড়ে আছে অলীক প্রত্যয়ে

আর মাথায় সোনালী চাঁদ , ওহে ফুলটুসি ন্যাকামির চাঁদ



তুমি কেন মুচকি হাসো, আমার স্বপ্নে যদি শুয়ে থাকে

মরা কাক



আরো দূরে যাও আরো দূরে

আরো দূর গ্রামে

আমি সামান্য কাঁথার নিচে শুয়ে ছিলাম রাতভোর



পাশে মৃত্যুযন্ত্রণায় বাউল কৃষ্ণদাশ, সকালে তার গাবগুব , কাঠের মতো নিস্পন্দ শরীর

রেখেছিলাম নাবাল জমিতে



কোনো আকাশ ছিল না মাথায়

এবার পানির দেখা নাই খরিপ চাষের সময় l



সারাক্ষন বমনেচ্ছা হয় , কতমাস ছুঁইনি রংতুলি

গলায় টের পাই ক্রমাগত

দীর্ঘ হয় গলগণ্ডল মরামাস



বিছানা থেকে খড় উড়ে যায়

উপে যায় অস্তিত্ব আমার ۔۔۔۔


প্রলেপগাথা

অতঃপর কোনো বৃদ্ধি নেই , বিস্তার নেই

আমি তাই আরো একা হতে চাই l হে শামুক , তোমার খোলের ভেতর

আমায় সামান্য জায়গা করে দাও

আমার চলতি শরীর যেন স্থির

হয়ে যায় লীন হয় তোমান্তরে

নিস্পন্দ পাথর হয়ে পড়ে থাকে পথের কিনারে ,অচেনায় ,অন্ধকারে l



কোনো শিশুর কোঁচড়ে মাথা পেতে শুতে চাই

শিশুর স্পন্দিত হাত ধূমল মাথায় নিশিন্দা পাতার মতো

সুস্থ প্রলেপ -----

গেইটের মতো উন্মাদ হওয়ার আগে একবার শান্ত হোক চিন্তার জ্বালামুখ

হে শিশু তুমি আরো আদরের হয়ে ওঠো প্রতিটি শিশুবর্ষে

আমার কপাল থেকে সরিয়ে নাও তেজষ্ক্রিয় চুল



আমি এক প্রাগৈতিহাসিক ডোডো কে এগিয়ে আসতে দেখি সারাক্ষন

যুদ্ধবাজ মানুষের মতো আধপোড়া বাহুমূল

কোনো পৈশাচিক শয়তান সংক্রামক ভাইরাসের মতো

আমার জন্য বয়ে আনে অনিবার্য ক্ষয়ের সংবাদ

এক বোধহীন রিক্ততায় বেলা কেটে যায়



চারপাশে পাতা ঝরে দগ্ধ দুপুরে

চৈতন্যের শেষ বিন্দু মুছে যায়

দুটি কবিতা/রাজন গঙ্গোপাধ্যায়




রাজন গঙ্গোপাধ্যায়।।দুটি কবিতা

ঘাটের কথা

নদীর জলের কাছে ঘুমনো গাছের ডাল

আমাদের পায়রা-বাড়ি, স্রোতের টান

ভাবছি আলসেমি ছন্ন- দিনের শেষে

এমনও গল্পগাথা জমানো টিপ্পি আছে



এসবই ফেলে আসা বাতাবি খেলার মাঠ

কিশোরীপিঠের কাছে আঙুরগাছ



আমাকে নাও তুমি ঘাটের রূপকথা

পায়ের তলা থেকে উধাও দেশ

পরীর চোখের জল জাহাজভেঁপুর সুর

বিনয় মজুমদার আসবে না।



তাই যে তাকিয়ে আছে ফেরার চাকার ধুলো

আঙুলে লেগে তার হারমোনিয়াম...


শরৎ - এর রোদে

যেসব রোদ থেকে পালাতে চাই

যেসব হিমেল রৌদ্রে মাথাটা ঝিম মেরে আসে

তেমনই রোদ্দুর আজ সকালে

বাড়ির দাওয়াই থেকে দেখছি দূরে ঐ স্কুলবাড়ি

ভেসে আসা সহজ পাঠ - - এসেছে শরৎ হিমের

পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে...

দীন- দুঃখিনী মাতৃভাষা যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে যেন সে কাশফুল যেন সে লাজুক দুগ্গা- মা,

ভাই-এর হাত ধরে ছুট, হুশ করে ট্রেন চলে যায়



কোথায় যায় তারা?

বিগত দিনের ভাইবোন, কাশফুল ছেয়ে থাকা মাঠ,আলকাপের গান

আমাকে এমনই রোদ এসব ভাবায়, আমি ভাবনার সাথে কথা বলি একা

কবিতা/বিপ্লব চক্রবর্তী




বিপ্লব চক্রবর্তী।। মৃত্যু শুধু মেঘ হয়ে ঝরে পড়া


মেঘেরাও পরস্পরে কথা বলে হুটোপাটা করে ছোটে

ওদের তেপান্তর আছে আকাশের বিস্তীর্ণ রেখায়

অসহিষ্ণু মেঘেরা আজ ,খেলা নেই শুধু ভয়ঙ্কর সংঘাত

তুমুল হিংস্রতা দিয়ে চেপে ধরে নিজেদের টুঁটি

আগুনগোলক হয়ে ছিঁটকে পড়ে যায়

অবশেষে নরম নিরীহ কিছু মেঘ সংঘাত এড়িয়ে বৃষ্টি হয়ে নামে

পরম খুশিতে আমাদের সংসার সাজায়।



ফাঁকা হয় আকাশ উঠোন বেঁচে থাকে ছন্নছাড়া কিছু কিছু মেঘ

ছুটে যায় সমুদ্রের কাছে,' বলে তারা আমাদের ভাইবোন প্রতিবেশী দাও
ডেকে দাও ডেকে দাও হে প্রপিতামহী নিরত জলধি



তুমিও তো মেঘ হয়ে খেলেছিলে একদিন,লালিমায় রাঙা ছিলে

সংঘাতে কঠিন ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাতে শান্ত হয়ে বৃষ্টি হয়েছিলে

দিয়েছিলে ব্যাসার্ধ্যের সুখ দুঃখ কিংবা হাহাকার



এইতো পেয়েছি বেশ, আমাদের যেটুকু প্রাপ্য বৈরিতার অহংকার

চলো মেঘেদের কাছে যাই,শুরু করি আমাদের পুরনো শৈশব

মৃত্যু বলে কিছু নেই শুধু মেঘ হয়ে ঝরে পড়া।

দুটি কবিতা/সমরেশ মন্ডল



সমরেশ মন্ডল।।দুটি কবিতা


দেওয়ালের ঠিকানা

আমাকে তুই বলেছিলি প্রায় দেওয়ালকে
শোনানোর মতো, 'আমি তো ওকে বলেছি;
আমার জন্য একজন আছে!আই আই টি-আন।'


তবু সে তোর জন্য কল্যাণী থেকে বর্ধমান স্টেশনে
এসে বসেছে। একসাথে বাড়ি যাবে বলে, অপেক্ষা
করেও, দেখা না পেয়ে ;মধ্যরাতের গোমো
প্যাসেঞ্জার ধরে ;বাড়ি ফিরে গিয়ে; রাত জাগা
সরলা মাকে গুনে গুনে মিথ্যা বলেছিল হতভাগা
অথবা ঈর্ষণীয় বন্ধু হে আমার!


তুই আমাকে বলেছিলি প্রায় দেওয়ালকে
শোনানোর মতো, আমি বাড়ি না থাকলেও ও
আমাদের বাড়ি এসে মা-বাবার সঙ্গে গল্প করে ,
আমি বাড়ি ফিরে যাবার পর ও বাড়ি ফেরে।আমার চাপ পড়ে।'
আজকাল কথায় কথায় যখন সবাই বলে," চাপে আছি " ; 

আমার ,তোর কথা খুব মনে পড়ে ; জানি তোর চাপ ঠিক আজকের 'চাপের' মতো ছিল না।


তুই আমাকে বলেছিলি প্রায় দেওয়াল কে শোনানোর মতো ;

দু'জনকেই ভালোবাসি, বিশ্বাস কর ,মন থেকে; কিন্তু শরীর তো একটাই!
তোর নাম বলছি না নিশ্চিত নাতির ঠাকুমা এখন,
এখনো সুন্দরী নিশ্চয়ই ;এখনো কি চাপে আছিস?


দেওয়াল কে শোনানোর মতো এখন যদি 'ওয়ালে'
শোনাতে পারিস! আমি অপেক্ষায় আছি। আমার
ঠিকানা জানা এখন খুব সোজা । তাহলে আবার একবার তোদের, চল জুড়ে দিয়ে আসি।।


যখন তিনি রবীন্দ্রনাথ
আমাকে টপকে প্রযোজকের সামনের চেয়ারে বসে যে মেয়েটি বলেছিল সময় পেলাম না, তাড়াতাড়ি লিখতে হলো রেডিও টক্ টা । দেখবেন একটু ?
প্রযোজক লেখার পাতাগুলো সামনে ঠেলে দিয়ে বললেন:কালান্তরের মত একটি লেখা লিখে নিয়ে এসো
এক মাস সময় দিলাম।
বেলুনের মতো চুপসে যাওয়া মুখ, সমস্ত স্মার্ট হাসি
শরীরী ভঙ্গিমা ডুবে গেল মূহুর্তের হৃদ্গঙ্গায়।
গমগমে গলায় কলেজের প্রাক্তন ছাত্র অজিতেশ
বলছিলেন ,রক্তকরবীর রাজা কে চেনো?
কার এন্ড টেগর
কোম্পানির 'দ্বারকানাথ ঠাকুর' পুরো কয়লা খনির গল্প
তারপর যতবার ঈশানী পাড়ার নন্দিন এর গলা শুনেছি তৃপ্তির মিত্রের কন্ঠে, 

ততবার কোলিয়ারির ধাওরায় ধাওরায়

ভেসে আসা অজস্র গলার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছি।
অনেক পুরনো লং প্লেয়িং ডিস্কে চড়িয়ে, উদয়ন ঘোষ
গীতবিতান হাতে ধরিয়ে , বলেছিলেন ;
প্রতিটি কমা পূর্ণচ্ছেদ সহ গানটি শোনো।
আকুল আবেদন মর্মে পৌঁছে গেলে বলেছিলাম," কি জিনিস শেখালেন স্যার!
বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব দাবি না করে বললেন , এসব গুরু পরম্পরা বিদ্যা, 

আমাকেও শিখিয়েছিলেন আচার্য সুকুমার সেন।



সাহিত্যের ছাত্রী তাই যাদবপুর জিজ্ঞেস করেছিলাম অনুগত
শিক্ষার্থীর মত উত্তরাধুনিকতা একটু সরল করে বোঝাবে ?
হাসিমুখে বলে গেছিল,দয়া দিয়ে চরণ ধোয়া যায়!
আলোক ঋণে ঋণী করবেন কিভাবে ?
আর বোঝার চেষ্টা করিনি ।সে যে আমার প্রাত্যহিক রবীন্দ্রনাথ।


এক গভীর রাতে শান্তিনিকেতনে বহু উপন্যাসের জনক কে ক্লান্ত আঙ্গুলগুলোকে মুঠো করে মুঠো
খুলতে খুলতে বলতে শুনেছিলাম :শাপভ্রষ্ট দেবতা নাহলে এত লেখা আর কি কেউ
লিখতে পারে ?
অথচ যৌবনে তিনি বলেছিলেন "তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্ররচনাবলী লুটোয় পাপোশে।


তারপরও অনেকক্ষণ থেমে জ্যোৎস্নাঢালা শান্তিনিকেতনে গেয়েউঠেছিলেন


"রবি যায় অস্তাচলে আঁধারে ঢাকে ধরণী
করো কৃপা অনাথে হে বিশ্বজনজননী...


কথোপকথন : সুধীর দত্ত

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ১।। ০৬ আগষ্ট, ২০২০

কথোপকথন : সুধীর দত্ত 


জন্ম : ১২ এপ্রিল ১৯৫১ 
প্রথম কবিতা প্রকাশ : প্রথম কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল কবি শরৎসুনীল নন্দী সম্পাদিত সংবেদ পত্রিকায়৷ কবিতাটির নাম মনে নেই৷ ওটি হারিয়ে গেছে৷ যতদূর মনে পড়ে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা হয়েছিল৷ 
প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ : ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া৷ প্রকাশকাল--- ১৯৮৭৷ 
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা : কবিতাসংগ্রহ ও মহাবিহঙ্গের পাখসাট সহ মোট কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা--- ১৪ এবং গদ্যগ্রন্থ--- ৫টি৷ শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ--- ১.অথ লীলাবতী কথা (সিগনেট প্রেস),২... জীব্রাইল কী বলেছিলেন (আদম)। প্রকাশিত হয়েছে 'নির্বাচিত কবিতাসংগ্রহ' ও আরেকটি গদ্যগ্রন্থ 'গীতা এক আশ্চর্য বর্ম ও আয়ুধ'। রাজীব সিংহ-র লিখিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সুধীর দত্ত।


প্রশ্ন: গত শতাব্দীর ৫-এর দশকের শেষ থেকে বলা ভালো ৬-এর দশক জুড়ে সারা বিশ্বে পুরোনো মূল্যবোধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, আধিপত্যবাদ, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবসমাজ৷ এই সময়ে এসে আপনার কবিতার লেখার শুরু৷ এই ঝড়ো সময় আপনাকে, আপনার কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? 

আমি চিরকাল অন্তর্মুখী৷ বাইরের দিক থেকে ভিতরের দিক, আমার নিজের ভিতরটাকে তন্নতন্ন করে খুঁড়ে দেখা, নিজের প্রাণ প্রবৃত্তিকে লক্ষ করা--- এসবই আমার চিরকালের বিষয়৷ সেই সময়ে চারিদিকে যে এত টালমাটাল, সারা বিশ্বে যে এত অস্থিরতা আমাকে তেমনভাবে স্পর্শ করত না, আজ এই মুহূর্তে যেভাবে করে চলেছে৷ বাইরের দরজাটা যেন-বা তখন আমার জন্য বন্ধ ছিল৷ আসলে আমি চৈতন্যের স্থির কেন্দ্রে, মণিপদ্মে ভ্রমরের মতো বসে থাকতে চাইতাম৷ বুঁদ হয়ে৷ সময়ের বাইরে, কিংবা সময়ের সুড়ঙ্গ পথে অতিক্রম করতে চাইতাম সময়কে৷ 
অথচ এই আমিই যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, যখন আমার বয়স ১৬/১৭, তখন সমাজ-বাস্তবতা, চারপাশের যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন আমাকে কী ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিত৷ আর কবিতায় আমি ধরতে চাইতাম তাদের কথা, সেই সময়ের কথা৷ সেই সময়ের কবিতা প্রায় হারিয়ে গেছে৷ অকবিতা-জ্ঞানে আবেগের অনিয়ন্ত্রিত প্রকাশ বলে আমি তাদের কোথাও গ্রহণ করিনি৷ কোনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি সেসব লেখা৷ তা ছাড়া সেইসব কবিতার ভাষায় নিজস্বতা ছিল না বলে সেগুলোকে আমি বর্জন করেছি৷ তবে সেই সময়ে কোথাও একটা উদাসীনতাও কাজ করত, যার বিরুদ্ধে আমার আর একটা সত্তা বিদ্রোহী হয়ে উঠত৷ একটা কবিতার কিছু পংক্তি স্মৃতিতে আছে৷ অল্প বয়সের লেখা৷ তার একটি পংক্তি : ‘‘তবু তুমি রবে উদাসীন?’’ 

প্রশ্ন: একদিকে ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ, অন্যদিকে ভাঙনমুখী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবির--- এক দিকের স্বপ্ণভঙ্গের হতাশা--- এই পরস্পর বিরোধিতা সেইসময় আমাদের দেশেও আছড়ে পড়েছিল৷ আপনার নিজের কবিতায়, আপনাদের সময়ের অন্যদের কবিতায় এই ঝড়ো দিনগুলির কোনো ক্ষত কি আদৌ লক্ষ করা যায়? 

কমিউনিজমের প্রতি এককালে আমার গভীর অনুরক্তি ছিল৷ ভেবেছিলাম এই এক তত্ত্ব যা মানুষকে মুক্তি দেবে৷ কিন্তু সেই স্বপ্ন আমার অচিরেই ভেঙে যায়৷ বোধ হয়--- এ এক অবাস্তব এবং অসম্পূর্ণ দর্শন৷ এর কোন ভবিষ্যৎ নেই৷ কারণ খুব কাছ থেকে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ও এই তত্ত্বের রূপকৃতদের আমি লক্ষ করেছি৷ আমার বোধ হয়েছিল যতক্ষণ না মানুষ মানুষ না হয়ে উঠছে, বৃহৎ চৈতন্যের দিকে নিজের ক্ষুদ্র অহংকে উন্মুখ করছে, ভাবতে শিখছে রূপে বহু হলেও, আত্মায় আমরা সবাই এক, ততদিন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷ যারা অসাম্যকে টিকিয়ে রাখতে চায় প্রয়োজন হলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে হবে৷ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আর্থ-সামাজিক দিকটিকে যেমন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, তেমনি মানুষের ভিতরের পাশবিক এবং আধিপত্যকামী অহং-সর্বস্ব সত্তাকে রূপান্তরিত করতে হবে৷ তাকে নিয়ে যেতে সমষ্টি-চৈতন্যের দিকে, যাতে করে অন্তত বুদ্ধি দিয়েও সে বোঝে যে সে ব্যষ্টি হিসেবে যতখানি সত্য, সমষ্টি চৈতন্যের অংশ রূপে সে ঠিক ততখানি সত্য৷ 
এ তো গেল আমরা তাত্ত্বিক অবস্থানের কথা৷ কিন্তু সময় যে তার প্রহার নিয়ে আমার উপর আছড়ে পড়ছে আমি তা এড়াব কী করে? ভিয়েতনাম তখন আমারও পিতৃভূমি৷ ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ কবিতাটিতে তা অন্যভাবে ধরা আছে৷ ‘অবলোকিতেশ্বর’ কবিতাতে তার আভাস আছে৷ 
অন্যরা তাঁদের অবস্থান থেকে আশা ও আশাভঙ্গের কথা লিখেছেন৷ আমি কখনোও কবিতায় সংবাদ লিখতে চাই নি৷ যখন আমি ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ কবিতায় একটি শিশুর শৈশব গলে যাওয়ার কথা বলছি, তখন সেই সময়ের প্রহারের কথা বলছি৷ বলছি অন্যভাবে৷ 

প্রশ্ন:  তখন আদর্শ হিসেবে কাকে মেনে নিচ্ছেন? আপনার প্রিয় কবি কে? 

হো চাচা তখন আমার প্রিয় মানুষ৷ 
শঙ্খ ঘোষ আমার প্রিয় কবি৷ 

প্রশ্ন:  কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ কি আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? কবিতার শরীর অর্থাৎ ফর্ম আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? 

ক. আমি সেই সময় প্রাউট (PROUT) সমাজ-দর্শনে বিশ্বাসী ছিলাম, যা বহিরঙ্গে মার্কসীয়, অন্তরঙ্গে আধ্যাত্মিক৷ এই দর্শনে তথাকথিত নন্-ভায়োলেন্স মান্যতা পায়নি৷ এই- দর্শন মনে করে, ভিতরে বাইরে সবসময় যুদ্ধ চলছে৷ ব্যক্তি ও সমষ্টি মানুষের অর্থাৎ সমাজের ঊর্ধায়নের জন্য যুদ্ধ আবশ্যিক শর্ত৷ তবে এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ঘৃণা নেই, আছে এক করুণাপর অনিবার্যতা৷ গীতা এর কথাই বলছে৷ লোভী মানুষ বা মানুষ-সমষ্টি যেহেতু তার স্বার্থের জায়গা ছাড়বে না তাই তথাকথিত অহিংসাকে এই দর্শন বলে মৃতের দর্শন৷ এই দর্শনে সম্পদের র‍্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশান মান্যতা পেয়েছে৷ মান্যতা পেয়েছে প্রকৃতি-সৃষ্ট বৈচিত্র্য৷ সবাই কখনো একইসময়ে একই স্তরে পৌঁছোতে পারবে না৷ এক্সপ্লোয়টেশন তো শুধু অর্থনৈতিক স্তরে নয়, বৌদ্ধিক স্তরেও হয়৷ অতএব স্টেটলেশনেস কখনোই সম্ভব নয়৷ তাই এই তত্ত্বের মূল কথাই ছিল বাইরের নিয়ন্ত্রণ এবং আভ্যন্তরীণ রূপান্তরণ একইসঙ্গে চলবে৷ এই দর্শনের লক্ষ্য ছিল মানুষকে শেষ পর্যন্ত এক অহংশূন্য আনন্দের স্তরে নিয়ে যাওয়া, তার ভৌতিক অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করা এবং মানসিক বিকাশের সমস্ত অন্তরায়কে দূর করা৷ এর জন্য চাই রাষ্ট্র-ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ৷ অস্তি-ভাতি-আনন্দ৷ আমার মনে হয়েছিল মার্ক্সবাদের অসম্পূর্ণতা এই দর্শন রূপায়িত হতে পারলে পূর্ণ হবে৷ 

খ. কবিতার ফর্ম আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ফর্ম হল সৌন্দর্য, বিষয় হল সত্য৷ সত্যই সৌন্দর্য আর সৌন্দর্যই সত্য৷ এরা অনন্যাশ্রিত৷ আঙ্গিক প্রকরণ কোনো পোশাক নয়৷ আত্মার সঙ্গে দেহের যে সম্পর্ক প্রসঙ্গের সঙ্গে প্রকরণের একই সম্পর্ক৷ দেহ হল চেতনার বহিরাশ্রয়, কাঠামো৷ কবিতা বিষয় ও আঙ্গিকের রসায়ন৷ তৃতীয় বস্তু৷ অনেকটা বহুব্রীহি সমাসের মতো৷ সমস্তপদকে অতিক্রম করে তা বিষবীয় ইঙ্গিত দেয়৷ ফর্ম হল ভাবের শরীর৷ যেমন ভাব তেমন ফর্ম৷ ফর্ম এবং কনটেন্ট শেষ পর্যন্ত কবিতার উপাদান৷ কবিতা এক অনির্বাচ্য বোধ, শব্দোত্তর বিশুদ্ধ ধবনি৷ এই ধবনিই সঞ্চারিত হয়, এবং তথাকথিত ব্যবহারিক অর্থ ছাপিয়ে এক বোধভূমিতে পাঠককে উন্নীত করে৷ কবিতা শেষ পর্যন্ত এক অনিয়ন্ত্রিত নিয়ন্ত্রণ৷ রূপায়ণই কবিতার রূপ৷ কবির স্ব-রূপের রূপ৷ যেকোনো মহৎ কবিতা এই জন্য বুঝবার বিষয় নয়, বোধের৷ অর্থ সেখানে গৌণ৷ সে প্রমাণ-সিদ্ধ নয়, স্বয়ং সিদ্ধ৷ অর্থ আছে, কিন্তু কবিতা শুধু অর্থ নয়৷ 
তাই আমার অভিজ্ঞতা ও অনুভবে ফর্ম এবং কনটেন্ট শেষ পর্যন্ত একটা মিথুন৷ অর্ধনারীশ্বরের মতো অবিভাজ্য এবং অভেদ৷ 

প্রশ্ন:  আপনার কবিতায় চিরায়ত রোমান্টিকতার বদলে অত্যন্ত উদাসীন মেধাবী এক সত্তা লক্ষ করা যায়৷ যা অত্যন্ত অনুভূতিসম্পন্ন ও সারাক্ষণ ক্রিয়াশীল৷ দেশি-বিদেশি নানা তত্ত্ব, পুরাণ ও সমাজচিন্তা আপনার কবিতার উপাদান৷ প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গির বিপ্রতীপে আপনার সামগ্রিক উচ্চারণ কেন? 

‘রোম্যান্টিক’ শব্দটি তোমরা কী অর্থে ব্যবহার করছ জানি না৷ আনখশির আমি রোমান্টিক৷ আমি কোনো প্রথার ব্যাকরণ মানি না৷ যে কোনো সীমা ভাঙতেই আনন্দ৷ আমার অভিযান অনন্তের দিকে৷ তাই ভাব-জগৎ আমার প্রিয়৷ ওখানে কোনো বেড়া নেই৷ অবাধ৷ মূলত, আমি একজন আধ্যাত্মিক মানুষ৷ চেয়েছিলাম যোগী হতে৷ হয়ে গেলাম কবি৷ বুদ্ধের চেয়ে বড়ো রোমান্টিক কে আছে? স্বামীজীর চেয়ে ভিতরের দুঃসহ পীড়ন ও দুঃখ সইতে পারে আর কোন কবি? পৃথিবীর সমস্ত ধবনিকে নিজের ভিতর ধারণ করবার যে বৃহদেষণা তা-ই কবির লক্ষ্য৷ রোমান্টিকতার শিখরদেশ৷ সেই অর্থে আমি জন্ম-রোমান্টিক৷ 
দ্যাখো, ভেবে-চিন্তে আমি কিছু করি না৷ কেউই বোধ হয় করে না৷ প্রত্যেকের একটা নিজস্ব অক্ষপথ আছে৷ মনন আমার প্রিয়৷ মন ও মননের ভিতর দিয়ে সকলের মতো আমিও নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁজতে খুঁজতে হাঁটছি৷ এই দেখাতে আত্ম-পরিসর বৃদ্ধি পায়৷ ভিতরের ঘের প্রসারিত হয়৷ এই খোঁজ থেকেই পিছন ফিরি অতীতের দিকে৷ যুক্ত হই পরস্পরের সঙ্গে৷ ‘স্মৃতির সমবেত উত্তরাধিকারের সঙ্গে৷’ স্মৃতি প্রবেশ করে সত্তায়৷ পুরাণ, ইতিহাস, বেদ-উপনিষদ, মহাকাব্যকে দেখি আমারই পূর্বজগণের চলা-পথের অভিজ্ঞানরূপে৷ দেখি সত্তা ও চৈতন্যে আমি বহন করছি এক সম্পন্ন উত্তরাধিকার৷ প্রণত হই বুদ্ধদেবের সামনে৷ আমার মধ্যে দেখি তাঁর অহৎও অবলোকিতেশ্বর রূপ৷ আমি ছড়িয়ে পড়ি কেন্দ্র থেকে পরিধিতে, আবার পরিধি থেকে দেখতে থাকি আত্মকেন্দ্র৷ এক অদ্ভুত টানা ও পোড়েন৷ আমার চেতনার মধ্যে দেখি চতুর্দশ ভুবন৷ অনুভব করি, নরকের আগুন না মাড়িয়ে কেউ স্বর্গের দোর গোড়ায় পৌঁছোতে পারে না৷ দেখি আমার মধ্যে কথা বলেন আমার পূর্বপুরুষেরা, দেখি শুধু এই ভারতবর্ষে নয় তারা বাস করেন সমগ্র বিশ্বে৷ দেখি বিশ্বরূপ৷ দেশের সীমা আর দেশের মধ্যে থাকে না৷ আমি বিস্ফারিত হই, দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে৷ বুঝি আমি এই সাড়ে তিনহাত দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ নই৷ আমি এক অক্ষর পুরুষ৷ দেহের সীমা ছাড়িয়ে আমি ভ্রমণ করি এক মহাজাগতিক শূন্যে৷ সেখান থেকেই অবলোকন করি সব কিছুকে৷ আবার এই মৃত্যুলোক থেকে দেখি অ-মৃতকে৷ অনুভব করি চেতনার সেই মর্হলোক যার উপরে আদিত্য লোক, নীচে প্রাণলোক, সাত-পাতাল৷ আমি শ্রী অরবিন্দ ও হযরত মহম্মদের ভাববিশ্বে প্রবেশ করি৷ আশ্চর্য হই৷ মানবিক আলোয় দেখবার চেষ্টা করি তাঁদের অবস্থান-ভূমি৷ আবার নেমে আসি সেই ভূমির আলো-অন্ধকার নিয়ে৷ অনুভব করি হযরতের যন্ত্রণা৷ তিনি কি এসব চেয়েছিলেন! কখনো না৷ তবে? তবুও ঘটে চলেছে৷ 
এসবকে যদি পৃথিবী-উদাসীন মেধাবী সত্তা বল, আমি তা-ই৷ 
আমি কোনোদিন জনপ্রিয়তা চাই নি৷ আমাকে কে বুঝল না বুঝল সে দিকে লক্ষই করি নি৷ শুধু চেয়েছি আমার অনুভবের কথা বলতে হবে এমন এক ভাষায় যা হবে তার সমমাপক৷ সেই ভাষাপথ আপনিই খুলে গেছে৷ আমি শুধু অপেক্ষা করেছি নির্জনে নিরবচ্ছিন্ন তপস্যায়, কীভাবে হয়ে উঠতে পারি শ্রীঅরবিন্দের ভাষায় ‘a cup fit for the nector wine’৷ আমার ভাষা সেই সোমপাত্র৷ এটাই আমার উচ্চারণ৷ পরধর্মে আমি আস্থাবান নেই৷ 
প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গিক বিপ্রতীপে যদি আমার উচ্চারণের কথা বল, তবে তা এই যে আমি কবিতাকে অমসৃণ রামকিঙ্করীয় ভাস্কর্যের আদলে গড়তে চেয়েছি৷ এটাই আমার ভাব-বিশ্বের সঙ্গে খাপ খায়৷ এই ভাববিশ্বে উচ্চাবচতা আছে৷ এর গতি বঙ্কিম৷ বহুস্তরীয়৷ আলো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে গড়িয়ে চলেছে৷ এক দুরবিগম্যতার দিকে৷ প্রথমে এটা আমার মনে কীভাবে যেন প্রোথিত হয়ে যায়৷ পরে তা সহজ হয়ে যায়৷ চেয়েছি কবিতা মন্ত্রধ্বনির মতো বাজুক৷ গীতলতা পরিহার করুক৷ সে বাজুক ভিতরে, তাঁর লাবণ্য খুলুক অন্তরে৷ এই যে প্রবণতা ও প্রযত্ন শেষ পর্যন্ত আঙ্গিকের মধ্যে নিয়ে এসেছে প্রযত্ন-শৈথিল্য, এক অন্তঃস্পন্দ, হয়তো বা গদ্য শরীরে এক কান্তিমান বিপ্রতীপতা৷ 

প্রশ্ন:  কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? অনুজ কবি হিসেবে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? 

না কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন আমাকে আকৃষ্ট করেনি৷ আমাকে আকৃষ্ট করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, বিষ্ণু দে ও টি.এস. এলিয়ট৷ কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার কোনোদিন সখ্যতা ছিল না৷ 
শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়তে ভালো লাগত৷ এক বড়ো মাপের স্বভাবকবি৷ একজন স্বভাবকবি যতদূর যেতে পারেন তাঁর কবিতা তত দূর গেছে৷ তাঁর কবিতা একটা ঘোর, আচ্ছন্নতা তৈরি করত৷ আমার এই দশকের অন্যতম প্রিয় কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত৷ যদিও এঁদের ঠিক কৃত্তিবাস-গোষ্ঠী বলা যায় না৷ 

প্রশ্ন:  লিট্ল ম্যাগাজিন, বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান--- প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সম্পর্কে আপনার মত কী? 

বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা এসব আমাকে কখনো ভাবায়নি৷ দেশ-পত্রিকায় লিখিনি মানে এই নয় যে দেশ-এ লিখতে চাইনি৷ খুবই চাইতাম৷ কিন্তু ছাপাবে কে? সব মিলিয়ে দু-তিনটা কবিতা বেরিয়েছে৷ সে তো ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে৷ ওখানে মুখ চেনাটা বড়ো কথা ছিল৷ বহুকাল পর্যন্ত এটা ছিল৷ শেষে একটা বিশেষ অভিজ্ঞতায় ঘেন্না ধরে গেল৷ মুখ-চেনা কবি মানে এই নয় যে তাঁরা খারাপ কবি বা অকবি৷ তবে ব্যক্তিগত পরিচয়টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ যাঁরা নির্বাচক ছিলেন অন্তত তাঁদের কবিতার প্রতি আপনার যে শ্রদ্ধা আছে এটা আপনাকে কথাবার্তায় হাবে-ভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে৷ আমার একটি বিশেষ অভিজ্ঞতার পর আমি আর কবিতা পাঠাইনি৷ তার মানে এই নয় যে আমি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হয়ে গেলাম৷ আর যদি এরপর হই, তাহলে তো ‘আঙুর ফল টক’--- এই-ই কারণ৷ 
তবে লিট্ল ম্যাগাজিনই হচ্ছে কবিদের আঁতুড়ঘর৷ এরাই জন্ম দেয়, লালন করে, পুষ্ট করে, সম্মান দেয়৷ এরাই একজন কবির যথার্থ আপনজন৷ সংবেদ পত্রিকা না থাকলে আমার লেখা হত কী করে৷ আমি সেই সময় আর কোনো পত্রিকায় লিখি নি৷ সংবেদ-এর মৃত্যুর পর ডায়মণ্ডহারবার থেকে বেরোত গৌতম ব্রহ্মর্ষি সম্পাদিত নির্যাস৷ আমি তো মাঝে মাঝেই ২-৪ বছর শীতঘুমে চলে যেতাম৷ শেষে তো ১০ বছর কিছু লিখিইনি৷ দশ বছর পর আদম থেকে আমার ‘কবিতাসংগ্রহ’ ও ‘গদ্যসংগ্রহ’ বেরোবার পর আবার ফিরে এলাম লেখায়৷ লেখা হল ‘তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ’৷ অকুণ্ঠ ভালোবাসা জানাল তরুণ কবি ও লিট্ল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা৷ মাঝখানে যখন দু-চার বছর লিখিনি সেই সময় তিরপূর্ণি-র সম্পাদক কবি সুদেব বক্সীর তাড়াতে আমি আবার শুরু করি৷ আমরা কেউ কাউকে চিনি না৷ তিনি কয়েকখানা পরপর চিঠি দিয়ে বললেন, আপনি আমাদের প্রিয় কবি৷ একটা গুচ্ছ দিতেই হবে৷ লিখেও ফেললাম৷ দেখুন কীভাবে একটি লিট্ল ম্যাগাজিন ঘুমিয়ে থাকা একজন মানুষকে জাগিয়ে দিল ভালোবাসা দিয়ে৷ ঠিক অনুরূপভাবে বন্ধু প্রতিবিম্ব-সম্পাদকও আমার কাছ থেকে বের করে নিলেন একগুচ্ছ কবিতা৷ পড়ে পুরী-সিরিজের আমার আর এক প্রিয় কবি উৎপল কুমার বসু জানালেন, এই সংখ্যার সবচেয়ে ভালো কবিতা সুধীরের কবিতা৷ এইভাবেই বাঁচিয়ে রাখে লিট্ল ম্যাগাজিনগুলি৷ আমি লিট্ল ম্যাগাজিনের কবি৷ 
আর যে-প্রতিষ্ঠানের কথা উঠছে সেই রকম এক প্রতিষ্ঠান দৈনিক পত্রিকা এই সময়৷ সম্পাদকীয় পাতার সম্পাদক শোভন তরফদার ভীষণ সম্মান দিয়ে আমাকে কবিতা লিখিয়েছেন ‘রবিবারোয়ারি’তে৷ দীর্ঘ কবিতা৷ এই প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে আমাকে মর্যাদা দিয়েছে তা অকল্পনীয়৷ পুজোর সংখ্যায় লেখা ছাপিয়েছে৷ এটা সম্ভব হয়েছে প্রতিষ্ঠানের অপ্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতার অধিকারী শ্রীশোভন তরফদারের জন্য৷ আমার মনে হয় প্রতিষ্ঠান যতটা নয়, তার চেয়ে প্রতিষ্ঠানে আমাদের মতো এককালের সাধারণ মানুষজন যারা পরে কর্ণধার হয়ে ওঠেন তাঁরাই নিজেদের ভরণপোষণের জন্য প্রতিষ্ঠানকে একটা ঘৃণ্য চেহারা দেন৷ স্তাবক-দল চান৷ আমি কবি মনীন্দ্র রায়কে দেখেছি, কী স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে তখনকার দিনে অমৃত-এ আমাদের কবিতা ছাপিয়েছেন৷ 

প্রশ্ণ: আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের প্রেক্ষিতটি কি? 

আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া৷ দীর্ঘকাল ধরে লেখা কবিতার সংকলন৷ লেখার সময়কাল ১৯৭২ থেকে ১৯৮৭৷ ১৫ বছর একটানা লিখিনি৷ মাঝে মাঝেই বন্ধ৷ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৭ সালে৷ তখন চাকরিসূত্রে আমি বাঁকুড়ায়৷ থাকি ডায়মণ্ডহারবারে৷ কবিতা লেখার রুদ্ধস্রোত তখন খুলে গেছে৷ সবাই বলল, আপনার একটা বই বার করা দরকার৷ উৎসাহ দিলেন সংবেদ-এর সম্পাদক কবি শরৎসুনীল নন্দী৷ বই বেরোল৷ 

প্রশ্ন:  ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার--- আপনি স্বীকার করেন? 

প্রশ্নটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার অর্থ যে ডালে বসে আছি, সেই ডাল কাটা৷ এই ছেদনের মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে বটে, সত্যজ্ঞান নেই৷ আমরা তো ঐতিহ্যের সম্প্রসারণ৷ জেনে না জেনে রক্তে বহন করে চলেছি পূর্বপুরুষদের৷ তবে যিনি তার ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন তিনি ঋদ্ধ৷ ঐতিহ্যের জ্ঞান আমাদের জানিয়ে দেয় আমাদের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা৷ শক্তিকে আত্মস্থ করে সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করাই নবীন সৃষ্টি৷ এখানে গ্রহণ-বজন-আত্মীকরণ আছে৷ সচেতন না হলে এসব প্রশ্ণই ওঠে না৷ এই সচেতনতা আমার মধ্যে একটা বৃহতের ভাব জাগায়৷ অতীত ও বর্তমানের ভেদ রেখা শিথিল হয়ে যায়৷ সচেতনতাই বিবর্তনের গতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়৷ এটাই বিপ্লব৷ অতীতকে বহুসময় সে বাহ্যত অস্বীকার করে তাকে প্রসারিত করে৷ অস্বীকার মানে তখন দৃষ্টির নতুনত্ব৷ সেই আলোয় সব কিছুকে দেখা৷ সত্যি কথা বলতে কী, নবীনের মধ্যে মৃতরা পুনর্জাত হন৷ ব্যক্তি কবি তার পূর্বসুরীদের নতুনভাবে বহু সময় আবিষ্কার করেন৷ এ তাঁর নিজের আবিষ্কারও বটে৷ তিনি তাঁর নিজের মধ্যে শুনতে পান পূর্বপুরুষদের বহু স্বর৷ তাঁর অভিজ্ঞতার প্রসারণ ঘটে, নিজের পুনর্নবীকরণ ঘটে৷ এটা হল উত্তরাধিকার৷ পিতা-পিতামহরা চান বর্তমান প্রজন্ম তাঁদের অতিক্রম করুক৷ এই-ই পরম্পরা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা৷ এইভাবে সত্তার মধ্যে পুনর্জাগ্রত হয় স্মৃতি, এবং খুলে যায় ভবিষ্যতের উৎসমুখ৷ 
উত্তরাধিকার হল নবীন ভূখণ্ডের আবিষ্কার ও আত্মবিস্তার৷ এই বিস্তার যদিও দৃশ্যত নিজের, এটি আসলে ঐতিহ্যের জায়মানতা ও সম্প্রসারণ৷ যার শিকড় যত গভীরে সে তত আড়ে বাড়ে ও উচ্চতায় আকাশের দিকে ডালপালায় ডানা মেলতে পারে৷ 

প্রশ্ন:  সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি পুরস্কার নিয়ে একই বিতর্ক আছে৷ এই নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগও সর্বজনবিদিত৷ এ বিষয়ে আপনার মত কী? 

বিতর্কটা মূলত তাঁরাই তোলেন যারা রাষ্ট্রীয় বা অ-রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পান নি৷ একজন স্রষ্টার আত্মসম্মান-বোধই তাঁর আভিজাত্য৷ পেলে তো ভালোই৷ না পেলে কী করা যাবে৷ যিনি বিতর্ক তুলছেন, তাঁকে সম্মান জানালেই তিনি চুপ করে যাবেন৷ তবে মনে রাখতে হবে কবি-সাহিত্যিকরা তো রক্ত-মাংসের মানুষ৷ উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশাও মানবিক৷ তবে দীনতা বড়ো চোখে লাগে, বুকে বাজে৷ এই দীনতা থেকে জন্ম নেয় অসূয়া ও হীনমন্যতা যা বাইরে একটা বিপ্লবী বিপ্লবী ভাবের মতো দেখতে লাগে৷ 
আর যেহেতু আমি কখনো তত ভিতরে তলিয়ে ভাবিনি, রাজনীতির ব্যাপারটা তত বুঝি না৷ তবে হাস্যকর ব্যাপার হল এই, যখন কাউকে আর পাওয়া যাচ্ছে না তখন নির্বাচকরা খুঁজে দেখেন কারা পায়নি৷ কারণ ততদিনে নিজেদের গোষ্ঠীর লোকেদের দেওয়া হয়ে গেছে৷ সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি মনীন্দ্র গুপ্ত দীর্ঘজীবী না হলে তাঁর কপালে কিছুই জুটত না ৷ কবি উৎপল কুমার বসুর কথা ভাবুন৷ তাঁকে কবে অ্যাকাদেমি দেওয়া হল৷ এগুলোকে যদি রাজনীতি বলা হয় এ নোংরামি তো কম-বেশি সব জায়গায় আছে৷ সে তো সেই তথাকথিত সত্য যুগ থেকেই চলে আসছে৷ যাঁরা অভিজাত এবং যথার্থ বড়ো মাপের মানুষ তাঁরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান না৷ 

প্রশ্ন:  বাংলা কবিতায় কলকাতা-কেন্দ্রিকতার অভিযোগ নিয়ে আপনার অভিমত কী? 

এখন অবস্থাটা অনেকটা বদলেছে৷ গ্রাম ঘিরে ফেলছে শহরকে৷ অনেক প্রতিভাবান তরুণ কবি গ্রামে লিখছেন৷ ওখান থেকেই পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে৷ শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগও এখন অনেকটা নিবিড়৷ আরও বদলাবে৷ সুদূর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন দক্ষিণবঙ্গের কবিরা৷ তবে এখনও শহর কলকাতায় না পৌঁছোলে, মান্যতা পাওয়া যাচ্ছে না৷ কবিতা পাক্ষিক দিয়ে বহুকাল আগে শুরু হয়েছিল যে উদ্যোগ তাকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট আদম-পত্রিকা৷ এঁরা জেলা-শহরগুলিতে কবিতার অনুষ্ঠান করেছেন৷ শহরের কবিরা যাচ্ছেন ব্লকে মহকুমা শহরে৷ একটা সুপবন বইছে, মনে হচ্ছে৷ 

প্রশ্ন:  অনেকেই দাবি করেন গত শতাব্দীর সাতের দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায় মৌলিক চিন্তার অভাব৷ আপনি কী বলেন? 

আমি সেভাবে ভাবিনি৷ তবে মৌলিক চিন্তা বলতে কী বলতে চাইছ বুঝতে পারছি৷ এটা ঠিক, সত্তরে এক ঝাঁক শক্তিশালী কবির আবির্ভাব ঘটেছিল৷ তাঁদের মধ্যে বহু কবি বাংলা কবিতায় একটা বিশিষ্ট ছাপ রেখে গেছেন৷ কিন্তু এখনও তো বহু প্রতিভাবান তরুণরা উঠে আসছেন৷ কে বলবে, কী হবে! 

প্রশ্ন:  এতটা পথ পেরিয়ে অনুজ কবিদের প্রতি কোনো বিশেষ পরামর্শ? 

বিশেষ কোনো পরামর্শ নেই৷ তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলব, হুল্লোড়ে লাভ নেই৷ লেখা একটা তপস্যা৷ নিজেকে গড়ে তোলাই তপস্যা৷ প্রথাকে জানতে হবে৷ তারপর মনে হলে আঘাত করো৷ তরুণদের পূর্বজদের সুগভীরভাবে পাঠ করতে হবে৷ তাঁদের অতিক্রম করতে হবে৷ এই-ই শ্রদ্ধা৷ আর এই শ্রদ্ধাই তাদের এগিয়ে দেবে৷ যা লিখব তাই কবিতা হবে, এটা নয়৷ মনন চাই, চাই অভিনিবেশ৷ চাই একটু দূরে সরে থাকা৷ আত্মনিরীক্ষণ করা৷ 

প্রশ্ন:  কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা না গদ্য আজকের তরুণতমদের কবিতায় কীসের প্রভাব স্পষ্ট বলে আপনি মনে করেন? 

কোনো প্রভাবই চিরস্থায়ী নয়৷ আর তা কাম্যও নয়৷ জীবনানন্দ তাঁর কাজ করে গেছেন৷ তাঁর অব্যবহিত অনুজরা তাঁকে ব্যবহার করেছেন৷ পূর্বজদের ঋণশোধ করার অর্থ, তাঁদের থেকে যে গ্রহণ, তাকে আত্মস্থ করে স্বতন্ত্র ভূখণ্ডের নির্মাণ৷ এই মুহূর্তে তাঁর চিন্তাভাবনার দলিলরূপে কবিতা বিষয়ক যে নিবন্ধগুলি আছে তা আমাদের কাছে যথেষ্ট মূল্যবান৷ 

প্রশ্ন:  পরবর্তী-প্রজন্মের কবিদের কাছে কী আশা করেন? 

আশা এই, তারা আমাদের মতো অগ্রজদের নতুনভাবে ভাবাবে৷ তাদের দেখে নিজেকে ভাঙব এবং পুনর্নির্মাণ করব৷

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা ২০১৮ সংখ্যা থেকে 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'-এ সাক্ষাতকারটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।)