সুবোধ সরকার।।তিনি মাথার ওপর আছেন
তাঁর অনুবাদে নিকানোর পাররা বেরুল। চমকে উঠলাম। তাঁর অনুবাদে ভাস্কো পপা বেরুল , কী আশ্চর্য । তাঁর অনুবাদে মিউস বেরুল, তাঁর অনুবাদে তাদেউস রুজেভিজ বেরুল। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে যে রাস্তাটা পূর্ব ইউরোপে এসে ভাস্কো পপার বাড়িতে ঢুকে গেছে সে রাস্তাটা আসলে আধুনিক পৃথিবীর মনন ও মেধার সিল্করুট। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সেই রেশমরাস্তাকে নিকানোর পাররার বাড়ি থেকে যাদবপুরে নিয়ে এসেছিলেন।
ভারতভবনে বিশ্বকবিতা উৎসব চলছে। আমার তখন বয়েস তিরিশ। আমি নিকানোর পাররার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পাররা সারাদিন কবিতা লিখছেন। হাতে খাতা। আমাকে শোনাচ্ছেন। আমি কে?
কবিরা যেমন গাছকে কবিতা শোনায়,
পাখিকে কবিতা শোনায়
, সেরকম আমাকেও শোনাচ্ছিলেন সেদিন ভোপালের বড়ে তালাওয়ের সিঁড়িতে বসে। হঠাৎ মানবদা এসে দাঁড়ালেন , আমি উঠে দাঁড়িয়ে মানদার হাত ধরে বললাম,
'উনি অপাত্রে দান করছেন
, আপনি বসুন।' মানবদা নিকানোর পাররার সঙ্গে স্প্যানিশে দুটো কথা বলে বিদায় নিলেন, অদূরেই তাঁর আর এক বন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন।
এবার নিকানোর পাররা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন
, 'হু ইজ দিস গাই'?
আমি চোখ বড় বড় করে বলতে যাচ্ছি,
আরে উনিই তো ল্যাটিন আমেরিকাকে ভারতবর্ষে নিয়ে এলেন। আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে পাররা বললেন,
' আ ভেরি স্ট্রেন্জ পারসন,
কাল রাতে দেখা হয়েছিল পার্টিতে,
হি
নোজ এভরিথিঙ আবাউট মি'। একটু থেমে যোগ করলেন
, 'পসিবলি হি নোজ মোর আবাউট মি দ্যান এনি ল্যাটিন আমেরিকান ডাজ।'
আমি মানবদাকে সেদিন রাতেই জানালাম কথাটা,
মানবদা খুশি হয়েও জরুরী কথা বললেন
, উনি কলকাতায় আসছেন তো?
আমি বললাম অশোক বাজপেয়ীকে বলেছি,
উনি দেখছেন।
নিকানোর পাররা এসেছিলেন কলকাতায় । সঙ্গে আরও তিনজন বিদেশি কবি। আমি জয়দেব বসু মল্লিকা সেনগুপ্ত এবং আরও অনেকে মিলে রাত জেগে অনুবাদ করেছিলাম । যাদবপুরে হাউসফুল অডিটোরিয়ামে পড়া হয়েছিল সে সব কবিতা। এখানেই নিকানোর পাররা মানবদাকে পাশে নিয়ে বলেছিলেন
, হোয়াট ইজ অ্যান্টি পোয়েট্রি?
ইভেন হোমার রোট অ্যান্টি পোয়েট্রি'। সেদিনের বিদ্বান সমাজ ফেটে পড়েছিল হাততলিতে। এই সব কিছুর মাথার ওপর ছিলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ।
আজও তিনি মাথার ওপর আছেন। তাঁর প্রয়াণ অনুবাদ-ইতিহাসের
দরজা এই সন্ধিক্ষণে কবিদেরকে ডাকছে,
এসো।
(প্রয়াণলেখটি লেখকের
অনুমতিক্রমে তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে এখানে গৃহীত হলো।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন