বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০

কথোপকথন : সুধীর দত্ত

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ১।। ০৬ আগষ্ট, ২০২০

কথোপকথন : সুধীর দত্ত 


জন্ম : ১২ এপ্রিল ১৯৫১ 
প্রথম কবিতা প্রকাশ : প্রথম কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল কবি শরৎসুনীল নন্দী সম্পাদিত সংবেদ পত্রিকায়৷ কবিতাটির নাম মনে নেই৷ ওটি হারিয়ে গেছে৷ যতদূর মনে পড়ে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা হয়েছিল৷ 
প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ : ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া৷ প্রকাশকাল--- ১৯৮৭৷ 
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা : কবিতাসংগ্রহ ও মহাবিহঙ্গের পাখসাট সহ মোট কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা--- ১৪ এবং গদ্যগ্রন্থ--- ৫টি৷ শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ--- ১.অথ লীলাবতী কথা (সিগনেট প্রেস),২... জীব্রাইল কী বলেছিলেন (আদম)। প্রকাশিত হয়েছে 'নির্বাচিত কবিতাসংগ্রহ' ও আরেকটি গদ্যগ্রন্থ 'গীতা এক আশ্চর্য বর্ম ও আয়ুধ'। রাজীব সিংহ-র লিখিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সুধীর দত্ত।


প্রশ্ন: গত শতাব্দীর ৫-এর দশকের শেষ থেকে বলা ভালো ৬-এর দশক জুড়ে সারা বিশ্বে পুরোনো মূল্যবোধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, আধিপত্যবাদ, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবসমাজ৷ এই সময়ে এসে আপনার কবিতার লেখার শুরু৷ এই ঝড়ো সময় আপনাকে, আপনার কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? 

আমি চিরকাল অন্তর্মুখী৷ বাইরের দিক থেকে ভিতরের দিক, আমার নিজের ভিতরটাকে তন্নতন্ন করে খুঁড়ে দেখা, নিজের প্রাণ প্রবৃত্তিকে লক্ষ করা--- এসবই আমার চিরকালের বিষয়৷ সেই সময়ে চারিদিকে যে এত টালমাটাল, সারা বিশ্বে যে এত অস্থিরতা আমাকে তেমনভাবে স্পর্শ করত না, আজ এই মুহূর্তে যেভাবে করে চলেছে৷ বাইরের দরজাটা যেন-বা তখন আমার জন্য বন্ধ ছিল৷ আসলে আমি চৈতন্যের স্থির কেন্দ্রে, মণিপদ্মে ভ্রমরের মতো বসে থাকতে চাইতাম৷ বুঁদ হয়ে৷ সময়ের বাইরে, কিংবা সময়ের সুড়ঙ্গ পথে অতিক্রম করতে চাইতাম সময়কে৷ 
অথচ এই আমিই যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, যখন আমার বয়স ১৬/১৭, তখন সমাজ-বাস্তবতা, চারপাশের যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন আমাকে কী ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিত৷ আর কবিতায় আমি ধরতে চাইতাম তাদের কথা, সেই সময়ের কথা৷ সেই সময়ের কবিতা প্রায় হারিয়ে গেছে৷ অকবিতা-জ্ঞানে আবেগের অনিয়ন্ত্রিত প্রকাশ বলে আমি তাদের কোথাও গ্রহণ করিনি৷ কোনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি সেসব লেখা৷ তা ছাড়া সেইসব কবিতার ভাষায় নিজস্বতা ছিল না বলে সেগুলোকে আমি বর্জন করেছি৷ তবে সেই সময়ে কোথাও একটা উদাসীনতাও কাজ করত, যার বিরুদ্ধে আমার আর একটা সত্তা বিদ্রোহী হয়ে উঠত৷ একটা কবিতার কিছু পংক্তি স্মৃতিতে আছে৷ অল্প বয়সের লেখা৷ তার একটি পংক্তি : ‘‘তবু তুমি রবে উদাসীন?’’ 

প্রশ্ন: একদিকে ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ, অন্যদিকে ভাঙনমুখী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবির--- এক দিকের স্বপ্ণভঙ্গের হতাশা--- এই পরস্পর বিরোধিতা সেইসময় আমাদের দেশেও আছড়ে পড়েছিল৷ আপনার নিজের কবিতায়, আপনাদের সময়ের অন্যদের কবিতায় এই ঝড়ো দিনগুলির কোনো ক্ষত কি আদৌ লক্ষ করা যায়? 

কমিউনিজমের প্রতি এককালে আমার গভীর অনুরক্তি ছিল৷ ভেবেছিলাম এই এক তত্ত্ব যা মানুষকে মুক্তি দেবে৷ কিন্তু সেই স্বপ্ন আমার অচিরেই ভেঙে যায়৷ বোধ হয়--- এ এক অবাস্তব এবং অসম্পূর্ণ দর্শন৷ এর কোন ভবিষ্যৎ নেই৷ কারণ খুব কাছ থেকে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ও এই তত্ত্বের রূপকৃতদের আমি লক্ষ করেছি৷ আমার বোধ হয়েছিল যতক্ষণ না মানুষ মানুষ না হয়ে উঠছে, বৃহৎ চৈতন্যের দিকে নিজের ক্ষুদ্র অহংকে উন্মুখ করছে, ভাবতে শিখছে রূপে বহু হলেও, আত্মায় আমরা সবাই এক, ততদিন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷ যারা অসাম্যকে টিকিয়ে রাখতে চায় প্রয়োজন হলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে হবে৷ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আর্থ-সামাজিক দিকটিকে যেমন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, তেমনি মানুষের ভিতরের পাশবিক এবং আধিপত্যকামী অহং-সর্বস্ব সত্তাকে রূপান্তরিত করতে হবে৷ তাকে নিয়ে যেতে সমষ্টি-চৈতন্যের দিকে, যাতে করে অন্তত বুদ্ধি দিয়েও সে বোঝে যে সে ব্যষ্টি হিসেবে যতখানি সত্য, সমষ্টি চৈতন্যের অংশ রূপে সে ঠিক ততখানি সত্য৷ 
এ তো গেল আমরা তাত্ত্বিক অবস্থানের কথা৷ কিন্তু সময় যে তার প্রহার নিয়ে আমার উপর আছড়ে পড়ছে আমি তা এড়াব কী করে? ভিয়েতনাম তখন আমারও পিতৃভূমি৷ ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ কবিতাটিতে তা অন্যভাবে ধরা আছে৷ ‘অবলোকিতেশ্বর’ কবিতাতে তার আভাস আছে৷ 
অন্যরা তাঁদের অবস্থান থেকে আশা ও আশাভঙ্গের কথা লিখেছেন৷ আমি কখনোও কবিতায় সংবাদ লিখতে চাই নি৷ যখন আমি ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ কবিতায় একটি শিশুর শৈশব গলে যাওয়ার কথা বলছি, তখন সেই সময়ের প্রহারের কথা বলছি৷ বলছি অন্যভাবে৷ 

প্রশ্ন:  তখন আদর্শ হিসেবে কাকে মেনে নিচ্ছেন? আপনার প্রিয় কবি কে? 

হো চাচা তখন আমার প্রিয় মানুষ৷ 
শঙ্খ ঘোষ আমার প্রিয় কবি৷ 

প্রশ্ন:  কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ কি আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? কবিতার শরীর অর্থাৎ ফর্ম আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? 

ক. আমি সেই সময় প্রাউট (PROUT) সমাজ-দর্শনে বিশ্বাসী ছিলাম, যা বহিরঙ্গে মার্কসীয়, অন্তরঙ্গে আধ্যাত্মিক৷ এই দর্শনে তথাকথিত নন্-ভায়োলেন্স মান্যতা পায়নি৷ এই- দর্শন মনে করে, ভিতরে বাইরে সবসময় যুদ্ধ চলছে৷ ব্যক্তি ও সমষ্টি মানুষের অর্থাৎ সমাজের ঊর্ধায়নের জন্য যুদ্ধ আবশ্যিক শর্ত৷ তবে এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ঘৃণা নেই, আছে এক করুণাপর অনিবার্যতা৷ গীতা এর কথাই বলছে৷ লোভী মানুষ বা মানুষ-সমষ্টি যেহেতু তার স্বার্থের জায়গা ছাড়বে না তাই তথাকথিত অহিংসাকে এই দর্শন বলে মৃতের দর্শন৷ এই দর্শনে সম্পদের র‍্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশান মান্যতা পেয়েছে৷ মান্যতা পেয়েছে প্রকৃতি-সৃষ্ট বৈচিত্র্য৷ সবাই কখনো একইসময়ে একই স্তরে পৌঁছোতে পারবে না৷ এক্সপ্লোয়টেশন তো শুধু অর্থনৈতিক স্তরে নয়, বৌদ্ধিক স্তরেও হয়৷ অতএব স্টেটলেশনেস কখনোই সম্ভব নয়৷ তাই এই তত্ত্বের মূল কথাই ছিল বাইরের নিয়ন্ত্রণ এবং আভ্যন্তরীণ রূপান্তরণ একইসঙ্গে চলবে৷ এই দর্শনের লক্ষ্য ছিল মানুষকে শেষ পর্যন্ত এক অহংশূন্য আনন্দের স্তরে নিয়ে যাওয়া, তার ভৌতিক অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করা এবং মানসিক বিকাশের সমস্ত অন্তরায়কে দূর করা৷ এর জন্য চাই রাষ্ট্র-ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ৷ অস্তি-ভাতি-আনন্দ৷ আমার মনে হয়েছিল মার্ক্সবাদের অসম্পূর্ণতা এই দর্শন রূপায়িত হতে পারলে পূর্ণ হবে৷ 

খ. কবিতার ফর্ম আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ফর্ম হল সৌন্দর্য, বিষয় হল সত্য৷ সত্যই সৌন্দর্য আর সৌন্দর্যই সত্য৷ এরা অনন্যাশ্রিত৷ আঙ্গিক প্রকরণ কোনো পোশাক নয়৷ আত্মার সঙ্গে দেহের যে সম্পর্ক প্রসঙ্গের সঙ্গে প্রকরণের একই সম্পর্ক৷ দেহ হল চেতনার বহিরাশ্রয়, কাঠামো৷ কবিতা বিষয় ও আঙ্গিকের রসায়ন৷ তৃতীয় বস্তু৷ অনেকটা বহুব্রীহি সমাসের মতো৷ সমস্তপদকে অতিক্রম করে তা বিষবীয় ইঙ্গিত দেয়৷ ফর্ম হল ভাবের শরীর৷ যেমন ভাব তেমন ফর্ম৷ ফর্ম এবং কনটেন্ট শেষ পর্যন্ত কবিতার উপাদান৷ কবিতা এক অনির্বাচ্য বোধ, শব্দোত্তর বিশুদ্ধ ধবনি৷ এই ধবনিই সঞ্চারিত হয়, এবং তথাকথিত ব্যবহারিক অর্থ ছাপিয়ে এক বোধভূমিতে পাঠককে উন্নীত করে৷ কবিতা শেষ পর্যন্ত এক অনিয়ন্ত্রিত নিয়ন্ত্রণ৷ রূপায়ণই কবিতার রূপ৷ কবির স্ব-রূপের রূপ৷ যেকোনো মহৎ কবিতা এই জন্য বুঝবার বিষয় নয়, বোধের৷ অর্থ সেখানে গৌণ৷ সে প্রমাণ-সিদ্ধ নয়, স্বয়ং সিদ্ধ৷ অর্থ আছে, কিন্তু কবিতা শুধু অর্থ নয়৷ 
তাই আমার অভিজ্ঞতা ও অনুভবে ফর্ম এবং কনটেন্ট শেষ পর্যন্ত একটা মিথুন৷ অর্ধনারীশ্বরের মতো অবিভাজ্য এবং অভেদ৷ 

প্রশ্ন:  আপনার কবিতায় চিরায়ত রোমান্টিকতার বদলে অত্যন্ত উদাসীন মেধাবী এক সত্তা লক্ষ করা যায়৷ যা অত্যন্ত অনুভূতিসম্পন্ন ও সারাক্ষণ ক্রিয়াশীল৷ দেশি-বিদেশি নানা তত্ত্ব, পুরাণ ও সমাজচিন্তা আপনার কবিতার উপাদান৷ প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গির বিপ্রতীপে আপনার সামগ্রিক উচ্চারণ কেন? 

‘রোম্যান্টিক’ শব্দটি তোমরা কী অর্থে ব্যবহার করছ জানি না৷ আনখশির আমি রোমান্টিক৷ আমি কোনো প্রথার ব্যাকরণ মানি না৷ যে কোনো সীমা ভাঙতেই আনন্দ৷ আমার অভিযান অনন্তের দিকে৷ তাই ভাব-জগৎ আমার প্রিয়৷ ওখানে কোনো বেড়া নেই৷ অবাধ৷ মূলত, আমি একজন আধ্যাত্মিক মানুষ৷ চেয়েছিলাম যোগী হতে৷ হয়ে গেলাম কবি৷ বুদ্ধের চেয়ে বড়ো রোমান্টিক কে আছে? স্বামীজীর চেয়ে ভিতরের দুঃসহ পীড়ন ও দুঃখ সইতে পারে আর কোন কবি? পৃথিবীর সমস্ত ধবনিকে নিজের ভিতর ধারণ করবার যে বৃহদেষণা তা-ই কবির লক্ষ্য৷ রোমান্টিকতার শিখরদেশ৷ সেই অর্থে আমি জন্ম-রোমান্টিক৷ 
দ্যাখো, ভেবে-চিন্তে আমি কিছু করি না৷ কেউই বোধ হয় করে না৷ প্রত্যেকের একটা নিজস্ব অক্ষপথ আছে৷ মনন আমার প্রিয়৷ মন ও মননের ভিতর দিয়ে সকলের মতো আমিও নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁজতে খুঁজতে হাঁটছি৷ এই দেখাতে আত্ম-পরিসর বৃদ্ধি পায়৷ ভিতরের ঘের প্রসারিত হয়৷ এই খোঁজ থেকেই পিছন ফিরি অতীতের দিকে৷ যুক্ত হই পরস্পরের সঙ্গে৷ ‘স্মৃতির সমবেত উত্তরাধিকারের সঙ্গে৷’ স্মৃতি প্রবেশ করে সত্তায়৷ পুরাণ, ইতিহাস, বেদ-উপনিষদ, মহাকাব্যকে দেখি আমারই পূর্বজগণের চলা-পথের অভিজ্ঞানরূপে৷ দেখি সত্তা ও চৈতন্যে আমি বহন করছি এক সম্পন্ন উত্তরাধিকার৷ প্রণত হই বুদ্ধদেবের সামনে৷ আমার মধ্যে দেখি তাঁর অহৎও অবলোকিতেশ্বর রূপ৷ আমি ছড়িয়ে পড়ি কেন্দ্র থেকে পরিধিতে, আবার পরিধি থেকে দেখতে থাকি আত্মকেন্দ্র৷ এক অদ্ভুত টানা ও পোড়েন৷ আমার চেতনার মধ্যে দেখি চতুর্দশ ভুবন৷ অনুভব করি, নরকের আগুন না মাড়িয়ে কেউ স্বর্গের দোর গোড়ায় পৌঁছোতে পারে না৷ দেখি আমার মধ্যে কথা বলেন আমার পূর্বপুরুষেরা, দেখি শুধু এই ভারতবর্ষে নয় তারা বাস করেন সমগ্র বিশ্বে৷ দেখি বিশ্বরূপ৷ দেশের সীমা আর দেশের মধ্যে থাকে না৷ আমি বিস্ফারিত হই, দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে৷ বুঝি আমি এই সাড়ে তিনহাত দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ নই৷ আমি এক অক্ষর পুরুষ৷ দেহের সীমা ছাড়িয়ে আমি ভ্রমণ করি এক মহাজাগতিক শূন্যে৷ সেখান থেকেই অবলোকন করি সব কিছুকে৷ আবার এই মৃত্যুলোক থেকে দেখি অ-মৃতকে৷ অনুভব করি চেতনার সেই মর্হলোক যার উপরে আদিত্য লোক, নীচে প্রাণলোক, সাত-পাতাল৷ আমি শ্রী অরবিন্দ ও হযরত মহম্মদের ভাববিশ্বে প্রবেশ করি৷ আশ্চর্য হই৷ মানবিক আলোয় দেখবার চেষ্টা করি তাঁদের অবস্থান-ভূমি৷ আবার নেমে আসি সেই ভূমির আলো-অন্ধকার নিয়ে৷ অনুভব করি হযরতের যন্ত্রণা৷ তিনি কি এসব চেয়েছিলেন! কখনো না৷ তবে? তবুও ঘটে চলেছে৷ 
এসবকে যদি পৃথিবী-উদাসীন মেধাবী সত্তা বল, আমি তা-ই৷ 
আমি কোনোদিন জনপ্রিয়তা চাই নি৷ আমাকে কে বুঝল না বুঝল সে দিকে লক্ষই করি নি৷ শুধু চেয়েছি আমার অনুভবের কথা বলতে হবে এমন এক ভাষায় যা হবে তার সমমাপক৷ সেই ভাষাপথ আপনিই খুলে গেছে৷ আমি শুধু অপেক্ষা করেছি নির্জনে নিরবচ্ছিন্ন তপস্যায়, কীভাবে হয়ে উঠতে পারি শ্রীঅরবিন্দের ভাষায় ‘a cup fit for the nector wine’৷ আমার ভাষা সেই সোমপাত্র৷ এটাই আমার উচ্চারণ৷ পরধর্মে আমি আস্থাবান নেই৷ 
প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গিক বিপ্রতীপে যদি আমার উচ্চারণের কথা বল, তবে তা এই যে আমি কবিতাকে অমসৃণ রামকিঙ্করীয় ভাস্কর্যের আদলে গড়তে চেয়েছি৷ এটাই আমার ভাব-বিশ্বের সঙ্গে খাপ খায়৷ এই ভাববিশ্বে উচ্চাবচতা আছে৷ এর গতি বঙ্কিম৷ বহুস্তরীয়৷ আলো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে গড়িয়ে চলেছে৷ এক দুরবিগম্যতার দিকে৷ প্রথমে এটা আমার মনে কীভাবে যেন প্রোথিত হয়ে যায়৷ পরে তা সহজ হয়ে যায়৷ চেয়েছি কবিতা মন্ত্রধ্বনির মতো বাজুক৷ গীতলতা পরিহার করুক৷ সে বাজুক ভিতরে, তাঁর লাবণ্য খুলুক অন্তরে৷ এই যে প্রবণতা ও প্রযত্ন শেষ পর্যন্ত আঙ্গিকের মধ্যে নিয়ে এসেছে প্রযত্ন-শৈথিল্য, এক অন্তঃস্পন্দ, হয়তো বা গদ্য শরীরে এক কান্তিমান বিপ্রতীপতা৷ 

প্রশ্ন:  কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? অনুজ কবি হিসেবে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? 

না কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন আমাকে আকৃষ্ট করেনি৷ আমাকে আকৃষ্ট করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, বিষ্ণু দে ও টি.এস. এলিয়ট৷ কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার কোনোদিন সখ্যতা ছিল না৷ 
শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়তে ভালো লাগত৷ এক বড়ো মাপের স্বভাবকবি৷ একজন স্বভাবকবি যতদূর যেতে পারেন তাঁর কবিতা তত দূর গেছে৷ তাঁর কবিতা একটা ঘোর, আচ্ছন্নতা তৈরি করত৷ আমার এই দশকের অন্যতম প্রিয় কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত৷ যদিও এঁদের ঠিক কৃত্তিবাস-গোষ্ঠী বলা যায় না৷ 

প্রশ্ন:  লিট্ল ম্যাগাজিন, বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান--- প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সম্পর্কে আপনার মত কী? 

বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা এসব আমাকে কখনো ভাবায়নি৷ দেশ-পত্রিকায় লিখিনি মানে এই নয় যে দেশ-এ লিখতে চাইনি৷ খুবই চাইতাম৷ কিন্তু ছাপাবে কে? সব মিলিয়ে দু-তিনটা কবিতা বেরিয়েছে৷ সে তো ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে৷ ওখানে মুখ চেনাটা বড়ো কথা ছিল৷ বহুকাল পর্যন্ত এটা ছিল৷ শেষে একটা বিশেষ অভিজ্ঞতায় ঘেন্না ধরে গেল৷ মুখ-চেনা কবি মানে এই নয় যে তাঁরা খারাপ কবি বা অকবি৷ তবে ব্যক্তিগত পরিচয়টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ যাঁরা নির্বাচক ছিলেন অন্তত তাঁদের কবিতার প্রতি আপনার যে শ্রদ্ধা আছে এটা আপনাকে কথাবার্তায় হাবে-ভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে৷ আমার একটি বিশেষ অভিজ্ঞতার পর আমি আর কবিতা পাঠাইনি৷ তার মানে এই নয় যে আমি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হয়ে গেলাম৷ আর যদি এরপর হই, তাহলে তো ‘আঙুর ফল টক’--- এই-ই কারণ৷ 
তবে লিট্ল ম্যাগাজিনই হচ্ছে কবিদের আঁতুড়ঘর৷ এরাই জন্ম দেয়, লালন করে, পুষ্ট করে, সম্মান দেয়৷ এরাই একজন কবির যথার্থ আপনজন৷ সংবেদ পত্রিকা না থাকলে আমার লেখা হত কী করে৷ আমি সেই সময় আর কোনো পত্রিকায় লিখি নি৷ সংবেদ-এর মৃত্যুর পর ডায়মণ্ডহারবার থেকে বেরোত গৌতম ব্রহ্মর্ষি সম্পাদিত নির্যাস৷ আমি তো মাঝে মাঝেই ২-৪ বছর শীতঘুমে চলে যেতাম৷ শেষে তো ১০ বছর কিছু লিখিইনি৷ দশ বছর পর আদম থেকে আমার ‘কবিতাসংগ্রহ’ ও ‘গদ্যসংগ্রহ’ বেরোবার পর আবার ফিরে এলাম লেখায়৷ লেখা হল ‘তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ’৷ অকুণ্ঠ ভালোবাসা জানাল তরুণ কবি ও লিট্ল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা৷ মাঝখানে যখন দু-চার বছর লিখিনি সেই সময় তিরপূর্ণি-র সম্পাদক কবি সুদেব বক্সীর তাড়াতে আমি আবার শুরু করি৷ আমরা কেউ কাউকে চিনি না৷ তিনি কয়েকখানা পরপর চিঠি দিয়ে বললেন, আপনি আমাদের প্রিয় কবি৷ একটা গুচ্ছ দিতেই হবে৷ লিখেও ফেললাম৷ দেখুন কীভাবে একটি লিট্ল ম্যাগাজিন ঘুমিয়ে থাকা একজন মানুষকে জাগিয়ে দিল ভালোবাসা দিয়ে৷ ঠিক অনুরূপভাবে বন্ধু প্রতিবিম্ব-সম্পাদকও আমার কাছ থেকে বের করে নিলেন একগুচ্ছ কবিতা৷ পড়ে পুরী-সিরিজের আমার আর এক প্রিয় কবি উৎপল কুমার বসু জানালেন, এই সংখ্যার সবচেয়ে ভালো কবিতা সুধীরের কবিতা৷ এইভাবেই বাঁচিয়ে রাখে লিট্ল ম্যাগাজিনগুলি৷ আমি লিট্ল ম্যাগাজিনের কবি৷ 
আর যে-প্রতিষ্ঠানের কথা উঠছে সেই রকম এক প্রতিষ্ঠান দৈনিক পত্রিকা এই সময়৷ সম্পাদকীয় পাতার সম্পাদক শোভন তরফদার ভীষণ সম্মান দিয়ে আমাকে কবিতা লিখিয়েছেন ‘রবিবারোয়ারি’তে৷ দীর্ঘ কবিতা৷ এই প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে আমাকে মর্যাদা দিয়েছে তা অকল্পনীয়৷ পুজোর সংখ্যায় লেখা ছাপিয়েছে৷ এটা সম্ভব হয়েছে প্রতিষ্ঠানের অপ্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতার অধিকারী শ্রীশোভন তরফদারের জন্য৷ আমার মনে হয় প্রতিষ্ঠান যতটা নয়, তার চেয়ে প্রতিষ্ঠানে আমাদের মতো এককালের সাধারণ মানুষজন যারা পরে কর্ণধার হয়ে ওঠেন তাঁরাই নিজেদের ভরণপোষণের জন্য প্রতিষ্ঠানকে একটা ঘৃণ্য চেহারা দেন৷ স্তাবক-দল চান৷ আমি কবি মনীন্দ্র রায়কে দেখেছি, কী স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে তখনকার দিনে অমৃত-এ আমাদের কবিতা ছাপিয়েছেন৷ 

প্রশ্ণ: আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের প্রেক্ষিতটি কি? 

আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া৷ দীর্ঘকাল ধরে লেখা কবিতার সংকলন৷ লেখার সময়কাল ১৯৭২ থেকে ১৯৮৭৷ ১৫ বছর একটানা লিখিনি৷ মাঝে মাঝেই বন্ধ৷ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৭ সালে৷ তখন চাকরিসূত্রে আমি বাঁকুড়ায়৷ থাকি ডায়মণ্ডহারবারে৷ কবিতা লেখার রুদ্ধস্রোত তখন খুলে গেছে৷ সবাই বলল, আপনার একটা বই বার করা দরকার৷ উৎসাহ দিলেন সংবেদ-এর সম্পাদক কবি শরৎসুনীল নন্দী৷ বই বেরোল৷ 

প্রশ্ন:  ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার--- আপনি স্বীকার করেন? 

প্রশ্নটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার অর্থ যে ডালে বসে আছি, সেই ডাল কাটা৷ এই ছেদনের মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে বটে, সত্যজ্ঞান নেই৷ আমরা তো ঐতিহ্যের সম্প্রসারণ৷ জেনে না জেনে রক্তে বহন করে চলেছি পূর্বপুরুষদের৷ তবে যিনি তার ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন তিনি ঋদ্ধ৷ ঐতিহ্যের জ্ঞান আমাদের জানিয়ে দেয় আমাদের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা৷ শক্তিকে আত্মস্থ করে সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করাই নবীন সৃষ্টি৷ এখানে গ্রহণ-বজন-আত্মীকরণ আছে৷ সচেতন না হলে এসব প্রশ্ণই ওঠে না৷ এই সচেতনতা আমার মধ্যে একটা বৃহতের ভাব জাগায়৷ অতীত ও বর্তমানের ভেদ রেখা শিথিল হয়ে যায়৷ সচেতনতাই বিবর্তনের গতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়৷ এটাই বিপ্লব৷ অতীতকে বহুসময় সে বাহ্যত অস্বীকার করে তাকে প্রসারিত করে৷ অস্বীকার মানে তখন দৃষ্টির নতুনত্ব৷ সেই আলোয় সব কিছুকে দেখা৷ সত্যি কথা বলতে কী, নবীনের মধ্যে মৃতরা পুনর্জাত হন৷ ব্যক্তি কবি তার পূর্বসুরীদের নতুনভাবে বহু সময় আবিষ্কার করেন৷ এ তাঁর নিজের আবিষ্কারও বটে৷ তিনি তাঁর নিজের মধ্যে শুনতে পান পূর্বপুরুষদের বহু স্বর৷ তাঁর অভিজ্ঞতার প্রসারণ ঘটে, নিজের পুনর্নবীকরণ ঘটে৷ এটা হল উত্তরাধিকার৷ পিতা-পিতামহরা চান বর্তমান প্রজন্ম তাঁদের অতিক্রম করুক৷ এই-ই পরম্পরা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা৷ এইভাবে সত্তার মধ্যে পুনর্জাগ্রত হয় স্মৃতি, এবং খুলে যায় ভবিষ্যতের উৎসমুখ৷ 
উত্তরাধিকার হল নবীন ভূখণ্ডের আবিষ্কার ও আত্মবিস্তার৷ এই বিস্তার যদিও দৃশ্যত নিজের, এটি আসলে ঐতিহ্যের জায়মানতা ও সম্প্রসারণ৷ যার শিকড় যত গভীরে সে তত আড়ে বাড়ে ও উচ্চতায় আকাশের দিকে ডালপালায় ডানা মেলতে পারে৷ 

প্রশ্ন:  সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি পুরস্কার নিয়ে একই বিতর্ক আছে৷ এই নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগও সর্বজনবিদিত৷ এ বিষয়ে আপনার মত কী? 

বিতর্কটা মূলত তাঁরাই তোলেন যারা রাষ্ট্রীয় বা অ-রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পান নি৷ একজন স্রষ্টার আত্মসম্মান-বোধই তাঁর আভিজাত্য৷ পেলে তো ভালোই৷ না পেলে কী করা যাবে৷ যিনি বিতর্ক তুলছেন, তাঁকে সম্মান জানালেই তিনি চুপ করে যাবেন৷ তবে মনে রাখতে হবে কবি-সাহিত্যিকরা তো রক্ত-মাংসের মানুষ৷ উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশাও মানবিক৷ তবে দীনতা বড়ো চোখে লাগে, বুকে বাজে৷ এই দীনতা থেকে জন্ম নেয় অসূয়া ও হীনমন্যতা যা বাইরে একটা বিপ্লবী বিপ্লবী ভাবের মতো দেখতে লাগে৷ 
আর যেহেতু আমি কখনো তত ভিতরে তলিয়ে ভাবিনি, রাজনীতির ব্যাপারটা তত বুঝি না৷ তবে হাস্যকর ব্যাপার হল এই, যখন কাউকে আর পাওয়া যাচ্ছে না তখন নির্বাচকরা খুঁজে দেখেন কারা পায়নি৷ কারণ ততদিনে নিজেদের গোষ্ঠীর লোকেদের দেওয়া হয়ে গেছে৷ সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি মনীন্দ্র গুপ্ত দীর্ঘজীবী না হলে তাঁর কপালে কিছুই জুটত না ৷ কবি উৎপল কুমার বসুর কথা ভাবুন৷ তাঁকে কবে অ্যাকাদেমি দেওয়া হল৷ এগুলোকে যদি রাজনীতি বলা হয় এ নোংরামি তো কম-বেশি সব জায়গায় আছে৷ সে তো সেই তথাকথিত সত্য যুগ থেকেই চলে আসছে৷ যাঁরা অভিজাত এবং যথার্থ বড়ো মাপের মানুষ তাঁরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান না৷ 

প্রশ্ন:  বাংলা কবিতায় কলকাতা-কেন্দ্রিকতার অভিযোগ নিয়ে আপনার অভিমত কী? 

এখন অবস্থাটা অনেকটা বদলেছে৷ গ্রাম ঘিরে ফেলছে শহরকে৷ অনেক প্রতিভাবান তরুণ কবি গ্রামে লিখছেন৷ ওখান থেকেই পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে৷ শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগও এখন অনেকটা নিবিড়৷ আরও বদলাবে৷ সুদূর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন দক্ষিণবঙ্গের কবিরা৷ তবে এখনও শহর কলকাতায় না পৌঁছোলে, মান্যতা পাওয়া যাচ্ছে না৷ কবিতা পাক্ষিক দিয়ে বহুকাল আগে শুরু হয়েছিল যে উদ্যোগ তাকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট আদম-পত্রিকা৷ এঁরা জেলা-শহরগুলিতে কবিতার অনুষ্ঠান করেছেন৷ শহরের কবিরা যাচ্ছেন ব্লকে মহকুমা শহরে৷ একটা সুপবন বইছে, মনে হচ্ছে৷ 

প্রশ্ন:  অনেকেই দাবি করেন গত শতাব্দীর সাতের দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায় মৌলিক চিন্তার অভাব৷ আপনি কী বলেন? 

আমি সেভাবে ভাবিনি৷ তবে মৌলিক চিন্তা বলতে কী বলতে চাইছ বুঝতে পারছি৷ এটা ঠিক, সত্তরে এক ঝাঁক শক্তিশালী কবির আবির্ভাব ঘটেছিল৷ তাঁদের মধ্যে বহু কবি বাংলা কবিতায় একটা বিশিষ্ট ছাপ রেখে গেছেন৷ কিন্তু এখনও তো বহু প্রতিভাবান তরুণরা উঠে আসছেন৷ কে বলবে, কী হবে! 

প্রশ্ন:  এতটা পথ পেরিয়ে অনুজ কবিদের প্রতি কোনো বিশেষ পরামর্শ? 

বিশেষ কোনো পরামর্শ নেই৷ তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলব, হুল্লোড়ে লাভ নেই৷ লেখা একটা তপস্যা৷ নিজেকে গড়ে তোলাই তপস্যা৷ প্রথাকে জানতে হবে৷ তারপর মনে হলে আঘাত করো৷ তরুণদের পূর্বজদের সুগভীরভাবে পাঠ করতে হবে৷ তাঁদের অতিক্রম করতে হবে৷ এই-ই শ্রদ্ধা৷ আর এই শ্রদ্ধাই তাদের এগিয়ে দেবে৷ যা লিখব তাই কবিতা হবে, এটা নয়৷ মনন চাই, চাই অভিনিবেশ৷ চাই একটু দূরে সরে থাকা৷ আত্মনিরীক্ষণ করা৷ 

প্রশ্ন:  কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা না গদ্য আজকের তরুণতমদের কবিতায় কীসের প্রভাব স্পষ্ট বলে আপনি মনে করেন? 

কোনো প্রভাবই চিরস্থায়ী নয়৷ আর তা কাম্যও নয়৷ জীবনানন্দ তাঁর কাজ করে গেছেন৷ তাঁর অব্যবহিত অনুজরা তাঁকে ব্যবহার করেছেন৷ পূর্বজদের ঋণশোধ করার অর্থ, তাঁদের থেকে যে গ্রহণ, তাকে আত্মস্থ করে স্বতন্ত্র ভূখণ্ডের নির্মাণ৷ এই মুহূর্তে তাঁর চিন্তাভাবনার দলিলরূপে কবিতা বিষয়ক যে নিবন্ধগুলি আছে তা আমাদের কাছে যথেষ্ট মূল্যবান৷ 

প্রশ্ন:  পরবর্তী-প্রজন্মের কবিদের কাছে কী আশা করেন? 

আশা এই, তারা আমাদের মতো অগ্রজদের নতুনভাবে ভাবাবে৷ তাদের দেখে নিজেকে ভাঙব এবং পুনর্নির্মাণ করব৷

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা ২০১৮ সংখ্যা থেকে 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'-এ সাক্ষাতকারটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।) 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন