শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

সম্পূর্ণ উপন্যাসঃ অ্যালবের কামু ।। ‘দ্য আউটসাইডার’

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০



সম্পূর্ণ উপন্যাস
‘দ্য আউটসাইডার’ : অ্যালবের কামু
অনুবাদক : শ্রী প্রেমেন্দ্র মিত্র




‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ (দ্য আউটসাইডার) উপন্যাসটি ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয় । এটি কামুর প্রথম উপন্যাস এবং সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ এবং বিংশ শতাব্দীর দার্শনিকতার অন্যতম দলিল। অস্তিত্বের সংকট, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য,  জীবনের বাস্তবতা ও অবাস্তবতার দ্বন্দ্ব উপন্যাসটির মূল উপজীব্য বিষয়।  ‘দ্য আউটসাইডার’  উপন্যাসটি ১৯৫৭ সালে নোবেল পুরস্কার পায়।ব্রিটিশ লেখক স্টুয়ার্ট গিলবার্ট প্রথম ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে অ্যালবের কামুর ‘দ্য আউটসাইডার’  ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। ১৯৮২ সালে হ্যামিস হ্যামিলটন দ্বিতীয় অনুবাদটি করেন এবং তৃতীয় অনুবাদটি ১৯৮৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই তৃতীয় অনুবাদটি করেছিলেন ম্যাথিউ ওয়ার্ড। ১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত কামুর অন্যতম দুটি কাজ ‘‘এ হ্যাপি ডেথ’’ ও ‘‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’’ রচনাদুটিতে ম্যুরসো  নামের একটি চরিত্রকে পাওয়া যাচ্ছে। এই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়াটা বিতর্কের বিষয় হলেও বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না । কেননা কাহিনী দুটিতে ম্যুরসো চরিত্রটি যেন প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে প্রতীকী এবং চরিত্রটির মধ্যে জীবন সম্পর্কে যে উদাসীন  নির্লিপ্ত ভঙ্গী ও বিচ্ছিন্নতাবোধ আমরা লক্ষ্য করি তা কিন্তু একুশ শতকে আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। কারণ এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও অস্তিত্বের সংকট মানুষকে ক্রমশঃ একা করে দিচ্ছে। সুতরাং মৃত্যুর আগে তাঁর সেই অসমাপ্ত উপন্যাস ‘‘দ্য ফার্স্ট ম্যান’’-এ এক আত্মজৈবনিক কামুকে পাওয়া যায় যা আলজেরিয়ায় কাটানো শৈশবকেই বেশী করে এঁকেছে।এখানে ‘দ্য আউটসাইডার’  উপন্যাসটির প্রেমেন্দ্র মিত্র-কৃত অনুবাদটি (‘‘অচেনা’’) পুনর্মুদ্রিত হলো। মনস্কপাঠক, গবেষক ও নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য অ্যালবের কামুর উপন্যাসের এই অসাধারণ বঙ্গানুবাদটি সম্পূর্ণ অব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পুনঃপ্রকাশিত হলো। ‘‘নোবেল সাহিত্য সম্ভার’’ সংকলন থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনুবাদটি এখানে গৃহীত হলো । 


অচেনা


মা আজ মারা গেছেন। কিংবা গতকালও হতে পারে, আমি ঠিক জানি না। টেলিগ্রাম যা পেয়েছি তা এই ,‘তোমার মা গত হয়েছেন। কাল  অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। গভীর সহানুভূতি’। ব্যাপারটা তাই ঠিক বোঝা যচ্ছে না, এমনও হতে পারে যে মা গতকালই মারা গেছেন। 
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আতুর আশ্রমটা মারোঙ্গো-তে অ্যালজিয়ার্স থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে। দুটোর বাস ধরলে রাত হবার বেশ আগেই সেখানে পৌঁছে যাব। তাহলে রাতটা সেখানে কাটিয়ে যথারীতি শবদেহ নিয়ে জাগার কর্তব্যটা সারতে পারি আর তারপর আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে এখানে ফিরে আসাও সম্ভব। মনিবের কাছ থেকে দুদিনের ছুটির বন্দোবস্ত করেছি। এ অবস্থায় ছুটি দিতে আপত্তি তিনি করতে পারেন নি, কিন্তু একটু  বিরক্ত হয়েছেন বলেই মনে হল। কিছু না ভেবেই আমি তখন বলেছিলাম , ‘দেখুন, আমি অত্যন্ত দু:খিত। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন এতে আমার কোনো হাত নেই’।
পরে আমার মনে হয়েছে কথাটা ওভাবে না বললেই পারতাম। আমার তো কৈফিয়ত দেবার কোন দরকার ছিল না, তাঁরই সহানুভূতি ইত্যাদি জানাবার কথা। হয়ত গতকালের পর আমার শোকের কালো পোশাক দেখে তিনি তা জানবেন। আপাতত মা যেন ঠিক এখনো মারাই যান নি বলা যায়। শেষকৃত্য হলে ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝতে পারব। ঘটনাটায় যাকে বলে সরকারী ছাপ পড়বে। ...
দুটোর বাসে উঠলাম। বিকেলের অসহ্য রোদের তাপ। রোজকার মত সেলেস্তির রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়া সেরে এসেছি। সবাই খুব ভালো ব্যবহার করেছে। সেলেস্তি আমায় বললে, ‘পৃথিবীতে মার মত কেউ হয় না।’ আসবার সময় সবাই দরজা পর্যন্ত আমায় এগিয়ে দিলে। শেষ সময়টা বেশ তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে।, কারণ শেষ মূহূর্তে ইমানুয়েল-এর বাড়িতে তার কালো টাই আর কালো ফিতে ধার করবার জন্যে যেতে হয়েছিল। ক-মাস আগেই তার খুড়ো মারা গেছেন।
 বাস ধরতে বেশ খানিকটা ছুটতে হল! বোধহয় ওই রকম তাড়াহুড়ো করায় আর সেই সঙ্গে রোদের হলকা , পেট্রোলের গন্ধ আর রাস্তার ঝাঁকুনির দরুন কেমন ঘুম-ঘুম পাচ্ছিল। বেশির ভাগ রাস্তাটা ঘুমিয়েই পার হলাম। জেগে দেখি একজন সৈনিকের গায়ে ভর দিয়ে আছি। সে দাঁত বার করে হেসে জিজ্ঞেস করলে আমি খুব দূর থেকে আসছি কি-না। কথা না বাড়াবার জন্যে শুধু মাথাটা নাড়ালাম।
 আতুর আশ্রমটা গ্রাম থেকে মাইল খানেকের কিছু বেশি ।পায়ে হেঁটেই সেখানে গেলাম। মাকে তক্ষুনি দেখবার অনুমতি চাওয়াতে দরোয়ান জানালে, ‘ওয়ার্ডেন -এর সঙ্গে আগে দেখা করতে হবে’। ওয়ার্ডেন তখন ব্যস্ত, তাই খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। দরোয়ান আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে অফিসে নিয়ে গেল। ওয়ার্ডেন দেখলাম ছোট্ট খাটো মানুষটি , মাথায় পাকা চুল, কোটের বোতামের ঘরে ‘লিজন অফ্ অনার’ -এর সম্মানচিহ্ন লাগানো। ফিকে-নীল চোখে আমার দিকে অনেকক্ষণ সে তাকিয়ে রইল। তারপর আমরা করমর্দন করলাম। আমার হাতটা সে আর ছাড়তেই চায় না। তাই বেশ একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। এবার টেবিলের একটা রেজিস্টারের পাতা উলটে সে বললে, ‘মাদাম ম্যুরসো তিন বছর আগে এ আশ্রমে ভর্তি হন। তাঁর নিজের কেউ আর ছিল না, সম্পূর্ণ আপনার ওপরই নির্ভর ছিল।
মনে হল যেন কোনো -কিছুর জন্যে ওয়ার্ডেন আমাকে দোষী করতে চাইছে। আমি বোঝাবার চেষ্টা করতেই সে বাধা দিয়ে বলে ,‘না-না আপনাকে কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি সব কাগজপত্র দেখেছি। ভালোভাবে তাঁর যতœ নেওয়া ব্যবস্থা করার মত সঙ্গতি আপনার ছিল না । তিনি চাইতেন সারাক্ষণ কেউ না কেউ তাঁর কাছে থাকুক। অথচ যে কাজ আপনি করেন তাতে আপনার মত তরুণদের মাইনে যথেষ্ট নয় যাই হক, এ আশ্রমে তিনি সুখেই ছিলেন’।
বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’
 তিনি আবার বললেন, ‘এখানে কয়েকজন ভালো বন্ধুবান্ধব পেয়েছিলেন, জানেন বোধ হয় তাঁরই মত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। নিজের বয়সী লোকের সঙ্গেই ভালো বনে। আপনি নেহাত ছেলেমানুষ। তাঁর ঠিক সঙ্গী হবার উপযুক্ত নন।’
কথাটা ঠিক। এক সঙ্গে যখন থাকতাম মা সারাক্ষণই আমার ওপর নজর রাখতেন। কিন্তু কথাবার্তা আমাদের খুব কম হত। প্রথম আশ্রমে আসবার পর কয়েক হপ্তা তিনি খুব কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু সে শুধু তখনো সুস্থির হয়ে বসতে পারেন নি বলে। দু-এক মাস পরে কিন্তু আশ্রম ছেড়ে যাওয়ার কথাতেই বোধহয় কাঁদতেন। কারণ সেটাও একরকম বন্ধন ছেঁড়া।
গত বছর আমি তাই খুব বেশি মার কাছে যাই নি। যাওয়া মানে রবিবারটা মাটি হওয়া তো বটেই, তার ওপর বাসে ওঠা, টিকিট করা আর আসতে যেতে দু-ঘন্টা করে সময় নষ্ট।
ওয়ার্ডেন বকে যেতে লাগল। তার কথায় বিশেষ কান দিচ্ছিলাম না। শেষে সে বললে, ‘এবার বোধহয় মাকে দেখতে চান, কেমন’?
উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পথ দেখিয়ে আমার নিয়ে যেতে যেতে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় সে বললে, ‘আশ্রমে শব রাখবার একটা ছোট ঘর আছে। আপনার মার কফিনটা সেখানে রেখেছি, - অন্য বাসিন্দারা যাতে বিচলিত না হয়। বুঝতেই তো পারছেন। কেউ একজন এখানে মারা গেলে দু-তিন-দিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সবাই কেমন একটু অস্থির হয়ে পড়েন। তাতে আমাদের লোকজনেরই শুধু কাজ আর দুর্ভাবনা বাড়ে’।
একটা উঠান পার হয়ে যেতে যেতে দেখলাম কয়েকজন বৃদ্ধ ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন। আমরা কাছে যেতেই তাঁরা চুপ করে গেলেন। তারপর আমরা এগিয়ে যেতেই পেছনে তাঁদের গুঞ্জন শুরু হল। তাদের গলা শুনলে খাঁচার ভেতর একঝাঁক টিয়াপাখির কিচির মিচির মনে পড়ে যায়। আওয়াজটা অত তীক্ষè নয় - এই যা।
ছোট নিচুগোছের একটা ঘরের দরজায় সামনে থেমে ওয়ার্ডেন বললে ‘এইখানেই আপানাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে ম্যঁসিয় ম্যুরসো। কিছু দরকার হলে আমাকে অফিসেই পাবেন। কাল সকালেই           অন্ত্যেষ্টি-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়েছে। রাতটা তাহলে মায়ের কফিন -এর পাশে কাটাতে পারবেন। আপনারও নিশ্চয় তাই ইচ্ছে। হ্যাঁ, আর-একটা কথা। আপনার মার বন্ধুবান্ধবের কাছে জানলাম গির্জার নিয়মকানুন অনুযায়ী তাঁকে কবর দেওয়া হক এই তিনি চেয়েছিলেন । সেইরকম ব্যবস্থাই আমি করেছি। তবু কথাটা আপনাকে জানান দরকার বলে মনে হল।
ওয়ার্ডেনকে ধন্যবাদ দিলাম! যতদূর জানি স্পৃষ্ট নাস্তিক না হলেও মা জীবনে ধর্ম-টর্মর কোনো ধার ধারতেন না।
শব রাখবার ঘরে ঢুকলাম। ঝকঝকে নিখুঁতভবে পরিষ্কার ঘর। দেয়ালগুলি চুনকাম-করা ধবধবে। ওপরে প্রকান্ড একটা স্কাইলাইট।
আসবাবপত্রের মধ্যে ক-টা চেয়ার আর বেঞ্চি। ঘরের মাঝখানে দুটো বেঞ্চির ওপর কফিনটা রাখা। ঢাকনিটা ওপরে দেওয়া হয়েছে কিন্তু স্ক্রুগুলো সম্পূর্ণ আঁটা হয় নি। তাদের চকচকে মাথাগুলো গাঢ় বাদামী কফিন -এর কাঠের ওপরে উঁচু হয়ে আছে। একটি আরব মেয়ে -নার্সই হবে বোধহয় কফিন -এর পাশে বসে আছে। নীল রঙের আবা (আলখাল্লা) তার গায়ে, মাথার চুলের ওপর বেশ একটু উগ্র রঙের একটা রুমাল বাঁধা।
ঘরটা যার জিম্মায় সেই দরোয়ান এখন এসে পৌঁছল। যেরকম হাঁপাচ্ছে তাতে মনে হয় দৌড়তে দৌড়তে এসেছে। 
বললে,‘ঢাকনিটা আমরা চাপা দিয়েছি, কিন্তু আপনি এলেই আমার ওপর খুলে দেওয়ার হুকুম আছে, আপনি যাতে মাকে দেখতে পান।’ 
লোকটা কফিনের দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু আমি তাকে বাধা দিয়ে জানালাম তার ব্যস্ত হবার দরকার নেই।
‘আজ্ঞে ? কী বললেন ?’ সেবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘আপনি চান না যে আমি ...?’
বললাম , ‘না।
স্ক্রু-ড্রাইভার পকেটে পুরে রেখে সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তখনি বুঝতে পারলাম ‘না’ বলাটা আমার উচিত হয় নি। বেশ একটু অস্বস্তিবোধ করলাম। আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে লোকটি জিজ্ঞেস করলে, ‘না কেন বলুন তো‘ ? তার কন্ঠস্বরে কোনো ভর্ৎসনা নেই ব্যাপারটা সে শুধু জানতে চায়।
‘কেন তা ঠিক বলতে পরব না’, জবাব         দিলাম ।
খানিকক্ষণ সে তার পাকা গোঁফের ডগাগুলোতে একটু পাক দিলে তারপর আমার দিকে না চেয়েই মৃদুস্বরে বললে, ‘বুঝেছি’।
লোকটির চেহারায় একটা প্রসন্নতা আছে। নীল চোখ লালচে গাল। আমার জন্যে কফিনের কাছে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে আমার পেছনেই বসল । নার্স -মেয়েটি এবার উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যাবার সময় লোকটি চুপিচুপি আমার কানে কানে বললে,‘বেচারার একটা আব্ আছে।  ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম মাথার চারিধার ঘিরে ঠিক চোখের নীচে একটা সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। তার নাকটা সেই ব্যান্ডেজেই ঢাকা পড়েছে। এই সাদা ব্যান্ডেজটুকু ছাড়া তার মুখের আর -কিছু প্রায় দেখাই যায় না।
মেয়েটি চলে যেতেই লোকটি দাঁড়িয়ে উঠল।
‘এবার আপনাকে একলা থাকতে দিয়ে যাচ্ছি’।
ভাবভঙ্গিতে কিছ প্রকাশ করে ফেলেছিলাম কিনা জানি না, কিন্তু চলে না গিয়ে লোকটা আমার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছনে কেউ অমন করে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন যেন বিশ্রী লাগে। আমারও লাগছিল। বেলা বেশ পড়ে আসছে , সমস্ত ঘরময় একটা মধুর কোমল আলো ছড়ানো। মাথার ওপর স্কাইলাইটের গায়ে দুটো বোলতা ভনভন করছে। চোখ এমন ঘুমে ঢুলে আসছিল যে খুলে রাখতেই পারছিলাম না । মুখ না ফিরিয়েই কতদিন সে এখানে আছে জিজ্ঞেস করলাম। 
‘পাঁচ বছর’।
উত্তরটা এমন চটপট এল যে মনে হল আমি যে এই প্রশ্ন করব সে জানত।
লোকটির মুখ কিন্তু এইতেই খুলে গেল। খুশি মনেই নিজের গল্প জুড়ে দিলে।
 মারেঙ্গোর এক আতুর আশ্রমের দরোয়ানি করে তার শেষ জীবনটা কাটবে দশ বছর আগে কেউ বললে সে বিশ্বাসই করত না। বয়েস তার চৌষট্টি, সে জানালে! সে পারীর লোক।
একথা শুনে বললাম, ‘ও এখানে তাহলে তোমার বাড়ি নয় ?’
মনে পড়ল ওয়ার্ডেন -এর কাছে আমাকে দিয়ে যাবার আগে মার সম্বন্ধে সে কি যেন সব বলেছিল। বলেছিল, এ অঞ্চলের, বিশেষ করে এই সমতলের গরমের দরুন মার কবর খুব তাড়াতাড়ি দেওয়া দরকার। পারীতে তিন দিন এমন কি চার দিন পর্যন্ত শব রেখে দেওয়া যায়। জীবনের বেশির ভাগ সে যে পারীতে কাটিয়েছে আর সেখানাকর কথা যে সে ভুলতে পারে না সেকথা পরে জানিয়েছিল। বলেছিল, ‘এখানে সবই যেন কেমন তাড়াহুড়ো করে সারতে হয়। কারুর মারা যাওয়ার ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে না বুঝতেই শেষ কাজ সারতে ডাক পড়ে যায়।’
‘খুব হয়েছে।’ তার স্ত্রী বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘ভদ্রলোক ছেলে মানুষ। ও বেচারার কাছে এসব কথা বলা তোমার উচিত হয় নি।
দারোয়ান অপ্রস্তুত হয়ে আমার কাছে মাপ চাইবার চেষ্টা করায় বলেছিলাম ‘ঠিক আছে।’ সত্যি কথা বলতে কি সে যা বলছিল তা শুনতে আমার আগ্রহই একটু হচ্ছিল। এসব কথা আমি আগে ভাবি নি। এখন লোকটা বলতে আরম্ভ করলে যে আতুর আশ্রমের একজন বাসিন্দা হয়েই সে এখানে ঢুকেছিল। কিন্তু এখন সে সুস্থ সবল। তাই দারোয়নের কাজটা খালি হতেই সে সেটা নিজে থেকে নিয়েছে।
আমি তাকে বোঝাতে চাইলাম যে এ কাজটা নিলেও আর সকলের মতই আশ্রমের একজন বাসিন্দা মাত্র। কিন্তু সে তা মানতে রাজী হল না। সে নাকি অফিসার গোছের লোক। এর আগে লক্ষ্য করেছি যে, আশ্রমে তার বয়সী বাসিন্দাদেরও সে ‘ওরা’ , কি মাঝে মাঝে ‘বুড়োবুড়ি’ এইভাবে উল্লেখ করে। তবু তার কথাটা আমি বুঝলাম। দারোয়ান হিসেবে তার একটু মর্যাদা আছে, আর সবাইয়ের ওপর একটু কতৃত্বও খাটে।
নার্স-মেয়েটি সেই মুহূর্তে ফিরে এল। দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেছে, স্কাইলাইটের ওপরের আকাশ যেন হঠাৎ কালো হয়ে এল। দরোয়ান সুইচ টিপে আলোগুলো জা¡লিয়ে দিলে। আচমকা সেই উজ্জ্বলতায় চোখ যেন আমার ধাঁধিয়ে গেল । দারোয়ান খাবার ঘরে গিয়ে রাতের খাবারটা সেরে আসতে বলল। কিন্তু খিদে তখন পায় নি। সে আমার জন্যে একবাটি গরম দুধ-দেওয়া কফি আনতে চাইলে। এই জিনিসটা আমার খুব প্রিয়। তাই ধন্যবাদ দিয়ে সম্মতি জানালাম। কয়েক মিনিট বাদে ট্রে-তে করে সে কফি নিয়ে এল, কফিটা খেয়ে ফেলবার পর একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু বর্তমান পরিবেশে কাজটা সঙ্গত হবে কি-না বুঝতে পারলাম না। খানিক ভাবলাম। তারপর মনে হল এতে এমন কিছু আসে যায় না। দারোয়ানকে একটা সিগারেট দিয়ে দুজনে সিগারেট খেতে শুরু করলাম। খানিক বাদে সে আবার আলাপ শুরু করলে।
‘জানেন, আপনার মার বন্ধুবান্ধবেরা শিগগিরই আপনার সঙ্গে কফিন পাহারা দিয়ে রাতে জাগবার জন্যে এখানে আসবেন। কেউ মারা গেলে এখানে এরকম ‘রাত-পাহারা ’ দেওয়া নিয়ম। আমি বরং গোটাকতক চেয়ার আর একপট কালো কফি নিয়ে আসি। 
সাদা দেওয়ালগুলো থেকে ঠিকরোনো কড়া আলোটা বড্ড চোখে লাগছিল । একট্য আলো নিবিয়ে দিতে পারবে কি-না দারোয়ানকে জিজ্ঞস করছিলাম।
‘তা সম্ভব নয়।’ সে বললে। আলোগুলোর নাকি এমন ব্যবস্থা যে সবগুলো হয় একসঙ্গে জ্বলবে বা নিববে। এর পর তার সঙ্গে আলাপ করবার আর বিশেষ উৎসাহ রইল না। বেরিয়ে গিয়ে সে কয়েকটা চেয়ার এনে কফিনের চারপাশে সাজিয়ে রাখল। গোটা বারো কাপ আর একটা কফির পট রাখল তারই মধ্যে একটা চেয়ারের ওপর। তারপর কফিনের অন্য দিকে আমার দিকে মুখ করে সে বসল। নার্স মেয়েটি ....  ঘরের অন্য প্রান্তে আমার দিকে পিছু ফিরে বসে আছে। কি সে করছে দেখা যায় না , তবে পেছন থেকে তার হাত নাড়ার ধরন দেখে মনে হয় সে কিছ বুনছে।
আমার বেশ আরাম লাগছিল। কফিতে শরীরটা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বাইরের খোলা দরজা দিয়ে রাত্রের ঠান্ডা হাওয়ায় ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। বোধহয় খানিকক্ষণ ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। 
কি-রকম একটা খসখসানি শব্দে জেগে উঠলাম। চোখের পাতা এতক্ষণ বন্ধ ছিল বলেই বোধহয় মনে হল যে আলোটা যেন আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কোনখানে এতটুকু ছায়ার বাষ্প নেই। প্রত্যেকটি জিনিসের সমস্ত কোণ, সমস্ত বাঁক যেন চোখের ওপর দাগ কেটে যচ্ছে। মায়ের বন্ধু সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ভেতরে ঢুকেছে। গুনে দেখলাম দশ জন। সেই উগ্র সাদা আলোর ঝলকানির মধ্যে তারা যেন প্রায় নি:শব্দে ভেসে এল। বসবার সময় একটা চেয়ারের একটু আওয়াজ পযন্ত হল না। যেভাবে এদের দেখলাম তেমন স্পষ্ট করে জীবনে আর কাউকে বোধহয় দেখি নি। তাদের চেহারার, পোশাকের কোনো খুঁটিনাটি আমার চোখ এড়াল না। তবু কানে তাদের কোন আওয়াজই পেলাম না। তারা সত্যিই জীবন্ত কি-না বিশ্বাস করা শক্ত।
বৃদ্ধাদের প্রায় সকলেরই গায়ে একটা করে অ্যাপ্রন। অ্যাপ্রনের দড়িগুলো কোমরে আঁট করে বাঁধায় প্রকান্ড তলপেটগলো যেন আরও ঠেলে বেরিয়েছে। বুড়িদের যে এতবড় ভুঁড়ি হয় তা আগে কখনো লক্ষ্য করিনি। পুরুষদের প্রায় সবাই ক্ষয়রোগীর মতো রোগা। তাদের সবাইকার হাতে লাঠি। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল এই যে তাদের মুখের দিকে চাইলে চোখ দেখা যায় না। কুঁকড়ে -যাওয়া চামড়ার জটের মধ্যে শুধু যেন একটা মিটমিটে নিভু-নিভু আঁচের আভাস।
বসবার পর তারা সবাই আমার দিকে তাকাল। ফোকলা মুখের মধ্যে ঠোঁটগুলো যেন ঢুকে গেছে। মাথাগুলো নড়ছে কেমন বেয়াড়া বিশ্রীভাবে। ঠিক বুঝতে পারলাম না এসব বার্ধক্যেরই কোন লক্ষণ , না তারা আমার কিছু বলতে চাইছে। মনে হল তাদের নিজেদের ধরনে তারা আমায় আপ্যায়ন করতে চাইছে। কিন্তু দরোয়ানের চারদিকে ঘিরে বসে বুড়োবুড়িরা মাথা কাঁপাতে কাঁপাতে আমায় গম্ভীরভাবে লক্ষ্য করছে কি- রকম একটা অদ্ভুত অনুভুতি তাতে আমার হচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্যে একাটা আজগুবি ধারণাও আমার হল -এরা সবাই যেন আমার বিচার করতে এসেছে।  কয়েক মিনিট বাদে বৃদ্ধাদের একজন ফোঁপাতে শুরু করলে। বৃদ্ধা দ্বিতীয় সারিতে বসেছে। সামনে আর একটি বৃদ্ধা থাকার দরুন তাকে দ্বিতীয় সারিতে বসেছে। সামনে আর-একটি বৃদ্ধা থাকার দরুন তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু নিয়মিতভাবে থেকে থেকে তার চাপা ফোঁপানি শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে বুঝি আর থামবেই না। অন্যদের কিন্তু তাতে যেন ভ্রƒক্ষেপই নেই। নি:শব্দে চেয়ারগুলোর ওপর থুবড়ে বসে তারা হয় কফিনটা নয় তাদের হাতের লাঠিটা বা সামনের যে কোনো জিনিসের ওপর একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সেই বৃদ্ধা ফুঁপিয়েই চলেছে। একটু অবাকই লাগছিল কারণ তাকে আমি চিনি না। ভাবছিলাম কান্না থামাতে বলি, কিন্তু কথা বলতে সাহস হল না। কিছুক্ষণবাদে দারোয়ান তার কানের কাছে নীচু হয়ে চুপিচপি কি যেন বলল। তাতে শুধু মাথা নেড়ে জড়ানো গলায় কি যে সে গুজগুজ করে বলল বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কান্না তার সমানেই চলতে লাগল।
দারোয়ান এবার উঠে পড়ে তার চেয়ারটা আমার কাছে সরিয়ে নিয়ে এসে বসল। খানিক চুপ করে থেকে আমার দিকে না চেয়েই সে বোঝাতে চেষ্টা করলে, ‘ও আপনার মার খুব অনুগত ছিল। বলছে যে আপনার মা-ই পৃথিবীতে তার একমাত্র বন্ধু ছিলেন। এখন তাই ও একেবারে একা।
এর জবাবে কিছুই বলতে পারলাম না। অনেকক্ষণ ধরে ঘরটা নিস্তব্ধ। বৃদ্ধার ফোঁপানি ও দীর্ঘশ্বাস ক্রমে থেমে এল। আর কয়েক মিনিট একটু আধটু ফুঁপিয়ে সেও শেষে চুপ করে গেল।
ঘুমের ঘোর আমার কেটে গেছে। কিন্তু ভয়ানক ক্লান্ত বোধ করছিলাম। পা-গুলো বড় টনটন করছিল। এইবার বুঝতে পারলাম যে এদের নিস্তব্ধতাও আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে। শুধু একটা অদ্ভুত শব্দই মাঝে পাঝে পাচ্ছিলাম। বুঝতে না পেরে প্রথমটা বেশ গোলমালই লাগছিল। ভালো করে কান পেতে শুনে ব্যাপারটা কি তার পরে বুঝতে পরলাম। বুড়োরা তাদের কুঁকড়ে-যাওয়া গালগুলোর ভেতরটা চুষছে। বিদঘুটে হুম্-হুম শব্দটা থেকেই হচ্ছে। নিজেদের ভাবনায় এমন তারা মগ্ন যে আর কিছুর হুঁশই তাদের নেই। এমনকি কফিনের ভেতরকার মৃতদেহটির সম্বন্ধেও তাদের মন অসাড় বলে আমার একবার মনে হয়েছিল। সেটা আমার ভুল বলেই এখন অবশ্য সন্দেহ হয়। দারোয়ান কফি ঢেলে দিতে সবাই আমরা তাই পান করলাম। তারপর বিশেষ কিছু আর আমার মনে নেই। কোনরকমে রাত কেটে গেল। শুধু একটা মুহূর্তে স্মরণ করতে পারি। হঠাৎ চোখ খুলে দেখি একজন বাদে আর সব বুড়োবুড়ি চেয়ারের ওপর বসে বসেই ঘুমোচ্ছে। দু-হাতে লাঠিটা ধরে তার ওপর চিবুকের ভর দিয়ে সেই বুড়ো আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।  যেন সে আমার জেগে ওঠার অপেক্ষাই করছিল। তখনই অবশ্য আবার আমি ঘুমিয়ে পড়লাম । কিছুক্ষণ বাদেই পায়ের যন্ত্রণায় আবার জেগে উঠতে হল পা-টা ঝিঁ ঝিঁ ধরে কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে।
স্কাইলাইটের ওপর ভোরের একটু আভাস দেখা যাচ্ছে। মিনিটদুয়েক বাদে একজন বুড়ো জেগে উঠে খকখক করে কাশতে লাগল। কেশে সে তার বড় নকশা -কাটা রুমালটায় থুথু ফেলছিল। প্রত্যেক বার থুথু ফেলার সময় মনে হচ্ছিল সে যেন বমিই করছে। অন্য সবাই এ আওয়াজে জেগে উঠল। দরোয়ান জানালে যে এবার তাদের যাবার সময় হয়েছে। সবাই তা শুনে একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘ রাত অস্বস্তির মধ্যে পাহারায় কাটিয়ে তাদের মুখগুলো সব ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে। একটা ব্যাপারে বড় আশ্চর্য লাগল। সবাই তারা আমার সঙ্গে করমর্দন করলে। সারা রাত পরস্পরের সঙ্গে একটা কথাও বলি নি। কিন্তু একসঙ্গে রাতকাটানোর দরুনই বুঝি একটা অন্তরঙ্গতা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠছে।
 আমি তখন একেবারে শেষ হয়ে গেছি। দরোয়ান আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। একটুখানি পরিচ্ছন্ন হয়ে নিলাম। সে আমাকে কিছু দুধ দেওয়া কফি দিল। তাতে একটু যেন উপকার হল। বাইরে যখন বেরুলাম তখন রোদ উঠে গেছে। মারেঙ্গো আর সমুদ্রের মাঝখানের পাহাড়গুলোর ওপরকার আকাশে লালচে মেঘের ছোপ। সকালের  সমুদ্রের হাওয়া বইছে, তাতে বেশ একটা মধুর নোনা স্বাদ। দিনটা ভালোই হবে মনে হচ্ছে। কতকাল শহরের বাইরে কোথাও যাই নি । মার এই ব্যাপারটা না ঘটলে সকালের এই বেড়ানোটা কি সুন্দরই লাগত- নিজের অজান্তে এরকম ভাবছি দেখে নিজেই চমকে উঠলাম।
বাইরে উঠোনে  গিয়ে একটা বড় গাছের তলায় দাঁড়ালাম । ঠান্ডা মাটির গন্ধ নাকে আসছে। ঘুমের ঘোরটা দেখলাম একদম কেটে গেছে। অফিসের  অন্য লোকজনের কথা মনে পড়ল। এখন তারা ঘুম থেকে উঠে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সারাদিনের মধ্যে এই সময়টা আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে। মিনিট দশেক এইরকম অনেক কিছু ভাবলাম। তারপর বাড়িটার ভেতর থেকে একটা শব্দ কানে এল। জানালার ওধারে লোকজনের নড়াচড়া দেখতে পেলাম। তারপর আবার সব    শান্ত। সূর্য আর- একটু ওপরে উঠেছে, রোদে পা-টা গরম হতে শুরু করেছে । দরোয়ান উঠোন পার হয়ে এসে আমাকে জানালে যে আশ্রমের ওয়ার্ডেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। ওয়ার্ডেনের অফিস যাওয়ার পর তিনি আমাকে দিয়ে কিছুূ কাগজপত্র সই করিয়ে নিলেন। তিনিও শোকের পোশাক পরেছেন লক্ষ্য করলাম।
টেলিফোনটা তুলে নিয়ে তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন , ‘কবর দেওয়ার লেকেরা এসে   গেছে । তারা এইবার গিয়ে কফিনের ডালা এঁটে দেবে। আপনি কি মাকে এবার শেষ দেখা দেখতে চান? তাহলে তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলি।’
বললাম,‘না, তার দরকার নেই।’
তিনি নীচু গলায় ফোনে বললেন, ‘ঠিক আছে ফিজিয়াক। ওদের কফিন আঁটতে যেতে বল।’
কবর দেওয়ার অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও উপস্থিত থাকবেন জানালেন। আমি তাঁকে ধন্যাবাদ দিলাম। এবার ডেস্কের ওধারে পায়ের ওপর পা  রেখে তিনি পেছনে হেলান দিয়ে বসলেন। বললেন যে , মৃতদেহ যে পাহারা দিচ্ছে সে ছাড়া তিনি আর আমি শুধু শবযাত্রায় যাব। এ আশ্রমের একটা নিয়ম এই যে বাসিন্দারা কবর দেওয়ার সব অনুষ্ঠানে যেতে পারে না। যদিও আগের রাত্রে কফিন পাহারা দিয়ে রাত জাগতে তাদের মানা নেই।
‘ওদের খাতিরেই এরকম নিয়ম করা’ , তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, ‘ওদের যাতে মনে আঘাত না লাগে। তবে আজকের ব্যাপারে আপনার মার এক পুরনো বন্ধুকে আমি সঙ্গে যাবার অনুমতি দিয়েছি। তার নাম টমাস পেরেজ।’
ওয়ার্ডেন একটু হেসে আবার বললেন ‘এক হিসাবে ব্যাপারটা করুণ গল্পের মত। পেরেজ ও আপনার মা প্রায় হরিহর আত্মা হয়ে উঠেছিলেন হয়ে উঠেছিলেন। অন্য সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পেরেজকে এই নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে জ্বালাতন করত। বলত, ‘কবে বিয়ে করছে হে ?’ পেরেজ হেসে উড়িয়ে দিত। এটা একটা ওদের মধ্যে চলতি হাসি-ঠাট্টার ব্যাপার ছিল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আপনার মার মৃত্যুতে পেরেজ অত্যন্ত আঘাত পেয়েছে। তাকে শবযাত্রায় যেতে বারণ করতে তাই আর মন সরল না। আমাদের ডাক্তারের পরামর্শে তাকে কিন্তু আগের রাত্রে কফিনের পাশে জাগতে অনুমতি দিই নি।
কিছুক্ষণ তারপর নীরবে দুজনে বসে রইলাম। ওয়ার্ডেন একবার উঠে জানালার ধারে গেলেন। খানিক বাদে বললেন, ‘মারেঙ্গো থেকে ওই তো পাদ্রীসাহেব এসে গেছেন। উনি একটু আগেই এসেছেন দেখছি।’
গির্জাটা পাশের গ্রামে। সেখানে যেতে প্রায় পৌনে একঘন্টা লাগাবে এ কথাও ওয়ার্ডেন আমাকে জানিয়ে দিলেন। আমরা এবার নীচে নেমে গেলাম।
কফিন যেখানে রাখা হয়েছে সে ঘরের বাইরেই পাদ্রী অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর সঙ্গে দু জন শিষ্য। তাদের একজনের কাছে একটা ধুনুচি। ধুনুচিটা একটা রূপোর চেন দিয়ে ঝোলানো। পাদ্রী তার ওপর ঝুঁকে পড়ে চেনটা কতখানি লম্বা রাখা হবে তাই ঠিক করছিলেন। আমাদের দেখে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আমাকে সস্নেহে দু-একটি কথা বলে আমাদের দিয়ে কফিনের ঘরের দিকে এগোলেন।
ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলাম চার জন কালো পোশাক -পরা লোক কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কফিনের  ডালা আঁটা হয়ে গেছে’। সে মুহূর্তেই ওয়ার্ডেন জানালেন যে কফিন বইবার গাড়ি এসে গেছে। পাদ্রীও তাঁর প্রার্থনা শুরু করলেন। এইবার আমার সবাই যাবার জন্যে এগোলাম। এক টুকরো কালো কাপড় নিয়ে বাহক চারজন কফিনের দিকে গেল। বাকি আমারা সবাই বাইরে বেরুলাম। দরজার কাছে একজন অচেনা মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
‘ইনি ম্যসি’য় ম্যুরসো’ বলে ওয়ার্ডেন তাঁকে আমার পরিচয় দিলেন। মহিলার নামটা ঠিক শুনতে পেলাম না , শুধু বুঝলাম তিনি আশ্রমের একজন নার্স। পরিচয়ের সময় তিনি মাথা নোয়ালেন। কিন্তু লম্বাটে হাড় বেরুনো মুখে এতটুকু প্রসন্নতার আভাস দেখা গেল না।
পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমরা কফিনটা যাবার পথ করে দিলাম। তারপর বাহকদের পিছু-পিছু সামনে দরজা পর্যন্ত গেলাম। কফিন বইবার গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আগাগোড়া কালো চকচকে জিনিসটা দেখলে অফিসের কলম রাখবার জায়গাটার কথা        পড়ে ।
কফিনের গাড়ির পাশে অদ্ভুত পোশাক -পরা ছোট্ট খাটো একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। শেকৃতোর তদারক করাই তার কাজ বুঝলাম। এসব অনুষ্ঠানের একরকম পরিচালক বলা যায়। তার কাছেই মার বিশেষ বন্ধু ম্যসি‘য় পেরেজকে দেখলাম। বৃদ্ধকে কেমন সংকুচিত, প্রায় লজ্জিত মনে হছিল। মাথায় অত্যন্ত চওড়া কানা -দেওয়া সেকেলে নরম ফেল্টেড হ্যাট একটু বেশিরকম ঝোলা প্যান্ট পরনে উঁচু কলারের তুলনায় কালো টাইটা অত্যন্ত বেমানানভাবে  ছোট। দরজা থেকে কফিন বার করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মাথার টুপিটা খুলে ফেললেন। লক্ষ্য করলাম ব্রণতে ভরতি মোটা নাকটার তলায় তাঁর ঠোঁট দুটি কাঁপছে। তাঁর কানদুটোই আমার সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ল। বড় বড় কোনা লালচে  কানদুটোকে তাঁর ফ্যাকাশে গালের পাশে যেন শীলমোহরের গালার মত লাগাছে। কানের রেশমী সাদা চুলগুলিও চোখে পড়ল।
কফিনের সঙ্গে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আমরা যে যার জায়গায় দাঁড়ালাম। গাড়ির সামনে পাদ্রী, কালো পোশাক -পরা চার জন বাহক তার দুই পাশে , তাদের পেছনে আমি ও ওয়ার্ডেন আর সবশেষে বৃদ্ধ পেরেজ ও সেই নার্স।
ইতিমধ্যেই রোদ চড়া হয়ে উঠেছে, বাতাসও গরম হয়ে গেছে। পিঠে রোদের তাপ লাগছে অনুভব করলাম। কালো পোশাকটার দরুন কষ্টটা আরও বেশি হচ্ছিল। রওয়ানা হবার জন্যে কেন যে আমাদের এত দেরি হল আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। পেরেজ টুপিটা আবার মাথায় দিয়েছিলেন, সেটা খুলে ফেললেন। আমি তাঁর দিকে সামান্য একটু ফিরেছিলাম। ওয়ার্ডেন ঠিক সেই সময়ই পেরেজের কথা আমায় বলতে শুরু করলেন। বিকেলের দিকে একটু ঠান্ডা পড়লে আমার মা ও পেরেজ নাকি প্রায়ই অনেক দুর একসঙ্গে বেড়িয়ে আসতেন। কখনো কখনো দুরের গ্রাম পর্যন্তও যেতেন। নার্স অবশ্য সঙ্গে থাকত।
জায়গাটা দেখছিলাম। আকাশের দিকে লম্বা সাইপ্রাস গাছের সব সারি উঠে গেছে। দুরের পাহাড় আর উজ্জ্বল সবুজের ছোপ- লাগানো তপ্ত লাল মাটি দেখা যাচ্ছে। আর তারই মাঝে এখানে -সেখানে একটা-দুটো নির্জন বাড়ি পেছনের উজ্জ্বল আকাশের আলোয় আরও তীক্ষè হয়ে ফুটে উঠেছে। মার মনের অবস্থাটা খানিকটা আমি বুঝতে পারলাম। এসব অঞ্চলে সন্ধ্যার সময়টায় একটা যেন করুণ        সান্ত্বনা পাওয়া যায়। এখন সকালের সূর্যের প্রখর আলোয় রোদের তাপে সবকিছু যেন কাঁপছে। সমস্ত দৃশ্যটা মনকে দমিয়ে দেয়। 
এবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম পেরেজ একটু খুঁড়িয়ে চলেন। পিছিয়ে পড়তে লাগলেন তিনি। কালো পোশাক পরা বাহকদেরও একজন পিছিয়ে পড়ে আমার সঙ্গে চলতে লাগল। কত তাড়াতাড়ি সূর্য আকাশে উঠে গেছে দেখে অবাক হলাম। হঠাৎ খেয়াল হল যে অনেকক্ষণ ধরেই তেতে-ওঠা ঘাসের উপর পোকাদের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার মুখে ঘাম গড়িয়ে পড়েছে। টুপি আনি নি বলে রুমাল দিয়ে হাওয়া খাবার চেষ্ঠা করলাম।
যে-লোকটি পিছিয়ে পড়েছিল সে আমায় কী যেন বলল পরিস্কার শুনতে পলোম না। ডান হতে টুপিটা একটু উঠিয়ে সে বাঁ হাতের রুমাল দিয়ে মাথার তালুটা মুছল। কি সে বলছে জিজ্ঞেস করায় ওপরে আঙুল দেখিয়ে বললে, রোদটা আজ বড় কড়া, না ?’
বললাম হ্যাঁ। 
খানিক বাদে সে জিজ্ঞেস করলে, যাঁকে কবর দিতে যাচ্ছি তিনি কি আপনার মা ’?
বললাম হ্যাঁ। 
‘বয়েস কত হয়েছিল’ ?
‘তা বেশ হয়েছিল। সত্যি- কথা কি আমি নিজেই মায়ের ঠিক বয়েস জানি না।
লোকটা তারপর চুপ করে রইল। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম পেরেজ অনেক দূরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে। তাড়াতাড়ি আসবার জন্যেই এক হাতে ফেল্ট হ্যাটটা ধরে সে দোলাচ্ছে। ওয়ার্ডেনের দিকেও চোখ গেল অত্যন্ত সাবধানে যেন মাপা- মাপা পা ফেলে তিনি চলছেন তার কপালেও ঘামের ফোঁটা চিকচিক করছে। কিন্তু মুছে ফেলাবার কোন চেষ্টা তার নেই।
মনে হল আমরা সবাই যেন আগের চেয়ে একটু তাড়াতাড়ি অগ্রসর হচ্ছি। যেদিকেই তাকাই শুধু রোদে -পোড়া প্রান্তর। আকাশ  এমন চোখ- ঝলসানো যে আমি চোখই তুলতে সাহস করছিলাম না। এবার নতুন পিচ ঢালা খানিকটা রাস্তা পেলাম । তার ওপর দিয়ে রোদের হল্কা যেন কেঁপে কেঁপে বয়ে যাচ্ছে। পা ফেলতে গেলে প্যাচ-প্যাচ করে জুতো বসে যায়। চকচকে কালো ঘায়ের মত দাগ পেছনে পড়ে থাকে।
সামনে গাড়োয়ানের চকচকে কালো টুপিটার যেন ওই চটচটে জিনিস দিয়ে তৈরি মনে হচ্ছিস। মাথার ওপরে আকাশের চোখ-ঝলসানো তাত আর চার ধরে এইসব কালো রঙের বৈচিত্র্যে সবকিছু কেমন অদ্ভুত একটা স্বপ্নের মত লাগছিল। তার ওপর নানা রকম সব গন্ধ, তেতে ওঠা চামড়ার, ঘোড়ার বিষ্ঠার আর তারই সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে মেশানো ধুপের ধোঁয়ার।    একেই  তো  আগের রাত্রে ভালো ঘুম হয় নি, তার ওপর এইসব মিলে আমার দৃষ্টি ও মন ঝাপসা করে দিচ্ছিল।
ফিরে তাকিয়ে দেখি পেরেজ অনেক দূরে পিছিয়ে পড়েছেন। রোদের হলকায় তাঁকে প্রায়  দেখাই যাচ্ছে না। এর পর হঠাৎ তিনি একেবারে অদৃশ্যই হয়ে গেলেন।
প্রথমটা অবাক হয়েই গিয়েছিলাম। তারপরে  বুঝলাম রাস্তা ছেড়ে তিনি মাঠের পথ ধরেছেন। রাস্তাটা সামনে খানিক দূরে একটা বাঁক নিয়েছে দেখতে পেলাম। এ অঞ্চল পেরেজের নিশ্চয়ই ভালোরকম  চেনা। আমাদের নাগাল ধরবার জন্যে তাই সহজ রাস্তা ধরেছেন। আমরা বাঁকটা ঘোরবার পরেই তিনি আমাদের সঙ্গ ধরে ফেললেন।  কিন্তু তারপর আবার পিছিয়ে পড়তে লাগলেন। আরও খানিকটা গিয়ে তিনি আবার আর একটা সংক্ষিপ্ত পথ ধরলেন; এভাবে পথ সংক্ষেপ করবার চেষ্টা এর পরে তাঁকে অনেক বারই করতে দেখলাম। কিন্তু তখন আমার মাথা দপদপ করতে শুরু করেছে। তিনি কোথা দিয়ে যাচ্ছেন আসছেন সে বিষয়ে আর আমার কোন কৌতূহলই নেই। নিজের পা-দুটো টেনে  নিয়ে যাওয়াই তখন আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে     দাঁড়িয়েছে ।
এর পর সবকিছু যেন হুড়হুড় করে হয়ে গেল। হল এমন শুষ্ক শৃঙ্খলার সঙ্গে যে তার খুঁটিনাটি কিছু আমার মনেই নেই। শুধু মনে আছে গ্রামের বাইরে গিয়ে পৌঁছবার পর সেই নার্স আমাকে যা বলেছিল। তার বলার সঙ্গে আমি চমকে উঠেছিলাম। মুখের চেহারায় সঙ্গে তার গলার স্বর একেবারে  মেলেই না। গলার স্বর বেশ সুরেলা আর একটু  কাঁপা-কাঁপা। নার্স বলেছিল, ‘এখানে  আস্তে হাঁটলে সর্দিগর্মির ভয়, আবার বেশি তাড়াতাড়ি হেঁটে ঘামলে গির্জার ভেতরকার হাওয়ায় ঠান্ডা লাগতে পারে।’ তার বক্তব্যটা বুঝেছিলাম, কোনদিকেই নিস্তার নেই।
সেদিনকার আরও কয়েকটি স্মৃতি আমার মনে দাগ কেটে আছে। যেমন, গ্রামের বাইরে পেরেজ শেষবার যখন আমাদের নাগাল ধরে ফেলেন তখন তাঁর মুখের চেহারাটা। তাঁর দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। হয়তা ক্লান্তিতে বা দুঃখে, হয়ত বা দুয়ে মিলেই। কিন্তু মুখের বলিরেখাগুলোর জন্যে চোখের জল বেশি দূর গড়াতে পারছে না। শুকনো কোঁচকানো কোঁচকানো মুখের খাঁজে ছড়িয়ে গিয়ে যেমন সমস্ত মুখটায়  ওপর একটা মসৃণ পালিশ বুলিয়ে দিয়েছে।
গির্জার চেহারাটাও আমার মনে আছে, রাস্তায় গ্রামের লোকগুলোর কথা, কবরগুলো ওপর সেই লাল ফুলগুলো পেরেজের অজ্ঞান হয়ে  যাওয়া, ন্যাকড়ায় পুতুলের মত তিনি যেন কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। মনে আছে মার কফিনের ওপর গেরুয়া রঙের মাটি ঝরঝর করে পড়ছে। তার সঙ্গে ছোট ছোট সাদা শেকড়ের টুকরো মেশানো। সেই লোকের ভিড়, কোলাহল, একটা বাইরে দাঁড়িয়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করা, ইঞ্জিনের ঘর্ঘর আর আলজিয়ার্সের প্রথম আলোয় ঝলমল রাস্তায় ঢোকবার পর আমার সেই খুশির শিহরণটুকু সোজা বিছানায় গিয়ে উঠে একনাগাড়ে বারো ঘন্টা ঘুমোবার ছবিটা আমি তখন দেখতে পাচ্ছি।


দুই
ঘুম ভাঙাবার পর বুঝতে পারলাম দু দিন ছুটি চাইবার সময় আমার মনিবের মুখ কেন ব্যাজার হয়ে উঠেছিল। আজ শনিবার। তখন একথাটা আমার মনে ছিল না। বিছানা থেকে ওঠবার পর এখন ব্যাপারটা বুঝলাম। মনিব নিশ্চয়ই তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে আমার দু দিনের ছুটি আসলে চার দিনের হয়ে দাঁড়াবে। এটা তাঁর পছন্দ হবার কথা নয়। কিন্তু আজ না হয়ে মার যে গতকাল কবর হয়েছে সেটা তো আর আমার দোষ নয়। শনি-রবিবারের ছুটি আমি পেতামই। তবু মনিবের দিকটাও বুঝতে আমার কষ্ট হল না।
বিছানা থেকে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য। আগের দিনের সব ঘটনায় বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছি। দাড়ি কামাতে কামাতে সকালটা কীভাবে কাটাব ভাবলাম। স্থির করলাম সাঁতার কাটতে যাওয়াই ভালো। বন্দরে যাবার ট্রামটায় উঠে বসলাম।
সব সেই আগেকার দিনের মত লাগছিল। সাঁতারের জায়গায় অনেক ছেলেমেয়ে এসেছে। মারী কার্ডোনাকেও তার মধ্যে দেখলাম। আমাদের অফিসে আগে টাইপিস্টের কাজ করত। তখন তার ওপর বেশ একটু দুর্বলতা হয়েছিল। তারও আমাকে ভালো লাগত বলে মনে হয়। কিন্তু আমাদের অফিসে খুব কম দিনই সে ছিল তাই ব্যাপারটা আর বেশি এগোয়নি।
মারীকে একটা ভেলায় উঠতে সাহায্য করবার সময় হাতটা তার বুকের ওপর যেন, নিজের অজান্তে চলে যেতে দিলাম। সে তারপর ভেলার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি তখন পাশে দাঁড়-সাঁতার কাটছি। একটু পরেই সে ফিরে আমার দিকে তাকাল। চুলগুলো চোখের ওপর এসে পড়েছে, মুখে হাসি। আমি ভেলায় উঠে তার পাশে বসলাম। হাওয়া বেশ একটা মধুর উষ্ণতা। একটু যেন মজা করেই আমি মাথাটা তার কোলের ওপর রাখলাম। মনে হল তার আপত্তি নেই, সুতরাং সেইভাবেই শুয়ে রইলাম। আমার চোখের ওপর শুধু অনন্ত আকাশ - সোনালী নীল। মাথার নীচে নিশ্বাসের সঙ্গে মারীর দেহের ওঠা-নামা অনুভব করছিলাম।
ভেলাটার ওপর আধ-তন্দ্রায় প্রায় আধ-ঘন্টাটাক কাটালাম। রোদ বেশি চড়া হয়ে ওঠায় সে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল, আমিও তার পিছু নিলাম। সাঁতরে তাকে ধরে ফেলে তার কোমরটা হাত দিয়ে জড়িয়ে পাশাপাশি এবার সাঁতার কাটতে লাগলাম। ওর মুখে তখনো সেই আগেকার হাসি।
জল থেকে উঠে পাড়ে দাঁড়িয়ে গা মোছবার সময় সে আমায় বললে, ‘তোমার চেয়ে আমার রঙে রোদের তামাটে ছোপ বেশি।’
আমার সঙ্গে বিকেলে সিনেমাতে যাবে কি-না জিজ্ঞেস করলাম।
সে আবার হেসে বললে, ‘যাব। সবাই একটা মজার ছবির কথা বলছে। ওই যেটাতে ফার্নান্ডেল আছে। সেটাতেই যদি নিয়ে যাও তো যাব।’
আমাদের পোশাক পরা শেষ হবার পর আমার কালো টাইটা ওর নজরে পড়ল। কেউ মারা গেছেন কি-না সে জিজ্ঞেস করল।
মার মৃত্যুর কথা তাকে জানালাম। 
‘কবে?’ সে জিজ্ঞেস করলে।
বললাম, ‘গতকাল’।
সে আর কিছু বলল না। তবু কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করছে বুঝতে পারলাম।
ব্যাপারটায় আমার হাত নেই তাকে বোঝাতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম। মনে পড়ল মনিবকেও ওই কথাই বলেছি। কথাটা নিজের কানেই কেমন বোকার মত শুনিয়েছিল। বোকার মত হোক বা না হোক নিজেকে একটু অপরাধীও না মনে করে বুঝি পারা যায় না।
যাই হোক, বিকেলে মারীর আর সে সব কথা কিছু মনে নেই দেখলাম। ছবিটা জায়গায় জায়গায় বেশ মজার কিন্তু বাজে জিনিসও যথেষ্ট। ছবি দেখবার সময় সে তার পা-টা দিয়ে আমার পায়ে চাপ দিচ্ছিল, আমিও তার বুকে হাত দিয়ে আদর করছিলাম। ছবিটা শেষ হবার সময় তাকে একবার চুমু খেলাম - একটু আড়ষ্টভাবেই।
ছবি দেখার পর সে আমার ওখানেই এল।


জেগে উঠে দেখি মারী চলে গেছে। সকালে তার মাসির সামনে হাজির না থাকলেই নয় সে আমায় আগেই জানিয়েছিল।
মনে পড়ল যে দিনটা রবিবার। তাইতে একটু দমে গেলাম। রবিবারটা আমার কোনো কালে ভালো লাগে না। মাথাটা ফিরিয়ে মারীর বালিশ থেকে আলস্যভরে একটু ঘ্রাণ নিলাম। মারীর মাথা থেকে সমুদ্রের নোনা গন্ধ সেখানে লেগে আছে।
দশটা পর্যন্ত ঘুমোলাম। তারপর সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে দুপুর পর্যন্ত বিছানাতেই কাটিয়ে দিলাম। সিলেস্তের রেস্তোরাঁয় রোজকার মত আজ আর খাব না ঠিক করলাম। সেখানে গেলেই সবাই নিশ্চয়ই নানা কথা জিজ্ঞেস করে জ্বালিয়ে  মারবে। জিজ্ঞাসাবাদ আমার ভালো লাগে না। তাই কয়েকটা ডিম ভেজে প্যান থেকেই সেগুলো খেলাম। রুটি ছাড়াই খেলাম, কারণ বাড়িতে রুটি ছিল না। নীচে গিয়ে রুটি কিনে আনা বড় ঝামেলা।
খাওয়া দাওয়ার পর কি করব ভেবে না পেয়ে ছোট ফ্ল্যাটটায় কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। মা যখন সঙ্গে থাকতেন তখন ফ্ল্যাটটা আমার পক্ষে সুবিধেরই ছিল। এখন আমার একলা থাকার পক্ষে সেটা একটু বেশি বড়। খাবার টেবিলটা তাই শোবার ঘরে এনে রেখেছি। এই ঘরটাই এখন ব্যবহার করি। আসবাবপত্র যা কিছু দরকার এই ঘরেই আছে, ---- একটা পেতলের খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, ক-টা বেতের চেয়ার ---- বসবার জায়গাগুলো তাদের অল্পবিস্তর ঝুলে গেছে। এছাড়া ময়লা দাগী আয়না - লাগানো কাপড়চোপড় রাখবার ক-টা আলমারি। ফ্ল্যাটের বাকি ঘরগুলো কাজে লাগে না। সেগুলো ঝাড়পোছ করবার প্রয়োজনও তাই বোধ করি না।
কিছুক্ষণ বাদে করবার আর কিছু না পেয়ে মেঝেয় ছড়ানো একটা খবরের কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম। তা থেকে জোলাপের একটা বিজ্ঞাপন কেটে আমার অ্যালবামে সেঁটে রাখলাম। খবরের কাগজে মজার কিছু পেলে আমি ওইভাবে রেখে দিই। এর পর হাত ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আর কিছুই করবার নেই।
আমার শোবার ঘর থেকে এ অঞ্চলের         বড়রাস্তাটা দেখা যায়। বিকেলের আবহাওয়া পরিষ্কার হলেও রাস্তা-বাঁধানো পাথরগুলো কালো ও চকচকে দেখাচ্ছে। সামান্য যে কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে তাদের সবারই যেন কিসের তাড়া। প্রথমেই একটি পরিবারকে দেখা গেল, রবিবারেই সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছেন। নাবিকের পোশাকপরা দুটি ছোট ছেলে - প্যান্টগুলো হাঁটুর কাছেও পৌঁছয় নি ---- ভালো সাজপোশাকে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। তারপরে একটি ছোট মেয়ে ---- পায়ে চকচকে কালো চামড়ার জুতো, মাথায় ফিকে সোনালী ফিতে বাঁধা। তাদের পেছনে বাদামী সিল্কের পোশাক - পরা বিপুলকায়া মা চলেছেন, আর তার সঙ্গে ছোট্ট খাটো ফিটফাট বাপটি। লোকটি আমার চেনা। মাথায় স্ট্র হ্যাট, হাতে ছড়ি, গলায় প্রজাপতি ---- টাই। লোকে বলে বড় ঘরের ছেলে হয়ে সে নীচু ঘরে বিয়ে করেছে। কথাটা যে সত্যি, স্ত্রীর পাশে তাকে দেখলেই বোঝা যায়।
এর পর দেখা গেল পাড়ার চালিয়াৎ সব ছোকরাদের - তেলা পাট - করা চুল, লাল টাই, কোমরের কাছটা অত্যন্ত সরু করে কাটা কোট, তাতে সূচের কাজ করা পকেট, পায়ে চওড়ামাথা জুতো। শহরের মাঝখানে বড় কোনও থিয়েটারে যাচ্ছে বুঝলাম। সেইজন্যেই এত আগে বেরিয়ে চড়া গলায় হাসতে হাসতে ও গল্প করতে করতে ট্রাম ধরতে চলছে।
তারা চলে যাবার পর রাস্তাটা ক্রমশঃ খালি হয়ে গেল। এতক্ষণে সব জায়গার ম্যাটিনী  শুরু হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। শুধু কয়েজন জন দোকানী আর ক’টা বেড়াল ছাড়া রাস্তায় কেউ নেই। রাস্তার ধারের বড় বড় গাছগুলোর ওপরে নির্মেঘ আকাশ দেখা যাচ্ছে, তার আলো কোমল। রাস্তার ও-পারের তামাকের দোকানী সামনে ফুটপাতে একটা চেয়ার বার করে এনে তার ওপর আরাম করে বসল। খানিক আগেই ট্রামগুলোয় লোক ধরছিল না, সেগুলো এখন প্রায় ফাঁকা। তামাকের দোকানের পাশে ‘সেজ পিয়ের’ নামে ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ওয়েটার ফাঁকা ঘরের মেঝের কাঠের গুঁড়ো ঝাঁট দিচ্ছে।
মামুলী মার্কা-মারা রবিবারের বিকেল।
চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমি তামাকের দোকানীর মত ঘোড়ায় চড়া ধরনে তার ওপর বসলাম। এতে আরাম বেশি। গোটা - দুই সিগারেট খেয়ে ঘর থেকে একটা চকোলেট নিয়ে এসে খাবার জন্যে জানালার ধারে বসলাম। খানিক বাদেই আকাশ মেঘলা হয়ে এল। গ্রীষ্মের ঝড় হবে বোধ হয়। মেঘের দল কিন্তু বৃষ্টির একটা হুমকি দিয়েই ধীরে ধীরে ওপরে উঠে গেল। রাস্তাটা আর ---- একটু অন্ধকার হয়েছে। আকাশের দিকে চেয়েই অনেকক্ষণ কাটালাম।
পাঁচটার সময় ট্রামের শব্দ অনেক বেড়ে গেল। শহরের বাইরের দিকে ফুটবল ম্যাচ ছিল সেখান থেকে সবাই ফিরছে। ট্রামগুলো মানুষে ঠাসা। পা-দানীর ওপর পর্যন্ত লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আর একটা ট্রামে খেলোয়াড়েরাই ফিরল। তারাই যে খেলোয়াড় তা তাদের প্রত্যেকের হাতে সুটকেস দেখেই বুঝলাম। তারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে দলের গান গাইছিল, ‘বল যেন না থামে ভাই।’ একজন ওপরে তাকিয়ে আমাকে দেখে চীৎকার করে বললে, ‘দিয়েছি ওদের হারিয়ে।’ আমি হাত নেড়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘সাবাস’। এবার সারে সারে প্রাইভেট গাড়ি দেখা দিতে লাগল।
আকাশের চেহারা আবার বদলেছে। বাড়িগুলোর ওপর একটা লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার ভিড় ক্রমশঃ আরও বাড়তে লাগল। লোকেরা বেড়িয়ে ফিরছে। তাদের মধ্যে সেই ফিটফাট ভদ্রলোক ও তার মোটা স্ত্রীকেও দেখলাম। ছোট ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়েদের পিছু পিছু ক্লান্তভাবে নাকে কাঁদতে কাঁদতে আসছে। কয়েক মিনিট বাদে এখানকার ছবিঘরগুলো থেকে কাতারে কাতারে লোক বেরিয়ে এল। ছবি শেষ হয়ে গেছে। লক্ষ্য করলাম ছোকরারা যেন একটা বেশী বড় বড় পা ফেলে খুব জোরে জোরে হাত-পা নাড়তে নাড়তে চলেছে। ছবিটা নিশ্চয়ই ‘বাহাদুরের খেল’ গোছের ছিল। শহরের মাঝখানের ছবিঘরে যারা গিয়েছিল তারা ফিরল আর খানিকটা বাদে। তারা আর একটু ধীর স্থির। যদিও কেউ কেউ তাদের এখনো হাসছিল। সবসুদ্ধ জড়িয়ে কিন্তু তাদেরও কেমন ক্লান্ত আলস্যজড়িত ভাব। তাদের কয়েক জন আমার জানালার নীচের রাস্তায় আড্ডা দেবার জন্য থেকে গেল। হাতে হাত ধরে একদল মেয়ে আসছে। জানালার নীচে যারা দাঁড়িয়েছিল, সেই ছোকরারা তাদের গায়ে গা লাগাবার জন্যে একটু ঘুরে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে কি সব ঠাট্টাও করল। মেয়েরা মুখ ঘুরিয়ে  খিল খিল করে হেসে উঠল। ওরা আমাদের পাড়ারই বলে চিনলাম, তাদের মধ্যে দু-তিন জন আমায় দেখে হাত নাড়ল।
রাস্তার আলোগুলো এইবার জ্বলে উঠল এক সঙ্গে। আকাশে যে তারাগুলোর আভাস দেখা যাচ্ছিল সেগুলো আরো মিটমিটে হয়ে গেল। রাস্তার দিকে চেয়ে চেয়ে চোখদুটো আমার ক্লান্ত হয়ে এসেছে। বাতিগুলোর নীচে নীচে যেন খানিকটা করে তরল উজ্জ্বলতা জমে আছে। মাঝে মাঝে চলতি ট্রামগুলোর আলোয় কোনও একটি মেয়ের চুল, কি হাসি, কি রূপোর বালা ঝিকমিকিয়ে উঠছে।
এর কিছুক্ষণ বাদে ট্রাম চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে এল। রাস্তার ধারের বাতি আর গাছগুলোর ওপরে আকাশটা কালো মখমলের মত দেখাচ্ছে। একটু একটু করে রাস্তা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। একটা মানুষকেও আর দেখা যাচ্ছে না। একটা বেড়াল কোনরকম ব্যস্ত না হয়ে ধীরে ধীরে নির্জন রাস্তাটা পার হয়ে গেল।
রাত্রের খাবার ব্যবস্থাটা এবার তো করতে হয়। নীচের রাস্তা দেখবার জন্যে চেয়ারে বসে এতক্ষণ মাথা নুইয়ে রাখার দরুন উঠে দাঁড়াবার সময় ঘাড়টা কেমন টনটন করতে লাগল। নীচে গিয়ে কিছু রুটি আর স্পাগেটি কিনে নিয়ে এসে নিজেই রেঁধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলাম। জানালায় দাঁড়িয়ে আর একটা সিগারেট খাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হঠাৎ বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে তাই সে চেষ্টা আর করলাম না। জানালা বন্ধ করে ফিরে আসতে আসতে আয়নাটার দিকে একবার চোখ পড়ল। আমার স্পিরিট---ল্যাম্প আর তার পাশের রুটির কয়েকটা টুকরো সমেত টেবিলটার একটা কোণ সেখানে দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল যেমন করে হোক আর একটা রবিবার কাটিয়ে দিয়েছি। মনে হল মার কবর হয়ে গেছে আর কালই আবার রোজকার মতো চাকরি করতে যেতে হবে। সত্যি, জীবনের কিছুই আমার বদলায় নি।


তিন
অফিসে সকালে খুব কাজের চাপ ছিল। মনিবের মেজাজ আজ ভালো। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে কিনা তাও একবার খোঁজ নিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘মার বয়স কত হয়েছিল।’ একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘প্রায় ষাট হবে’। ভাবতে হল পাছে ভুল করি সেই ভয়ে।
আমার জবাব শুনে মনিবের কেন জানিনা একটু যেন        দুশ্চিন্তা গেল মনে হল। আলাপটা ওই কথাতেই যেন শেষ। টেবিলে এক গাদা বিল জমে আছে। সেগুলো সবই দেখতে হল। দুপুরের খাবারের জন্যে বাইরে যাবার আগে হাত ধুয়ে নিলাম। দুপুরে এই হাত ধোয়া সেরে নিতে আমার ভালো লাগে। বিকেলে অনেক ব্যবহার করার দরুন লাটিম জড়ানো তোয়ালেটা ভিজে সপসপে হয়ে থাকে ---- তখন কেমন ছুঁতে খারাপ লাগে।
একবার মনিবকে কথাটা জানিয়েছিলাম। অসুবিধে যে হয় তা স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কাছে এটা সামান্য ব্যাপার বই তো নয়।
অন্য দিনের চেয়ে একটু দেরিতে ---- সাড়ে বারোটা নাগাদ অফিস থেকে ইমানুয়েলের সঙ্গে বার হলাম। ইমানুয়েল আমাদেরই অফিসে ‘ফরোয়ার্ডিং’ বিভাগে কাজ করে।
সমুদ্রের ধারেই আমাদের অফিস। বাইরের     রাস্তায় নামবার সিঁড়িতে একটু দাঁড়িয়ে বন্দরের জাহাজগুলোর দিকে একবার তাকালাম। চড়া চোখ ঝলসানো রোদ। ঠিক সেই সময়ে ইঞ্জিনের ফটফট আর চেন-এর ঝনঝন শব্দের রোল তুলে একটা বড় লরি চলে গেল। ইমানুয়েল লরিটায় লাফিয়ে ওঠার কথা বললে। দৌড়তে শুরু করলাম। লরিটা তখন অনেক এগিয়ে গেছে। বেশ খানিকটা তার পেছনে আমাদের ছুটতে হল। একে ওই গরম, তার উপর লরিটার বিদঘুটে আওয়াজে মনে হল যেন মাথা ঝিমঝিম করছে। বন্দরের ধার দিয়ে পাগলের মতো ছুটছি ---- এইটুকুই শুধু তখন খেয়াল আছে ---- বড় বড় ক্রেন আর জাহাজের জটলা অস্পষ্টভাবে চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে ---- দূরে মাস্তুলগুলো নড়ছে।
আমিই প্রথম লরিটা ধরে ফেলে এক লাফে উঠে বসলাম, তারপর ইমানুয়েলকে ধরে ওঠালাম। দুজনেই তখন হাঁপাচ্ছি। এব্ড়ো খেব্ড়ো নুড়ি ফেলা রাস্তার ওপর দিয়ে যেতে যেতে লরিটার ঝাঁকানিতে অবস্থা  আরো কাহিল। ইমানুয়েল খুশিতে হেসে উঠে আমার কানে কানে হাঁফাতে হাঁফাতে বললে, ‘ধরেছি ঠিক।’
সিলেস্তের রেস্তোরাঁয় যখন পৌঁছালাম তখন  ঘেমে নেয়ে গেছি। দরজার কাছেই সিলেস্তে তার নিজের মার্কা-মারা জায়গাটিতে বসে আছে। ভুঁড়ির ওপর জামাটা ঠেলে উঠে আছে। সাদা গোঁফজোড়া  পাকানো।
আমায় দেখে একটু সমবেদনা জানাল, ‘আশা করি খুব বেশি অস্থির হয়ে পড়নি’? 
বললাম, ‘না’।
দারুণ ক্ষিদে পেয়েছে তখন। খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া সারলাম। শেষ কালে এক কাপ কফি নিলাম। খাওয়া শেষ করে আমার নিজের জাগাটিতে গিয়ে শুলাম একটু কাকতন্দ্রার জন্যে। মদটা একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে।
জেগে উঠে বিছানা ছাড়বার আগে একটা সিগারেট খেলাম। দেরী হয়ে গিয়েছিল একটু, তাই ট্রাম ধরবার জন্যে দৌড়তে হল।
অফিসে অসহ্য দমবন্ধ করা গরম। সারা বিকেলটা কাজেও একটু ফাঁক পেলাম না। অফিস বন্ধ হবার পর জেটিগুলোর ভেতর দিয়ে ঠান্ডায় একটু ঘুরতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আকাশের রঙ কেমন সবুজ দেখাচ্ছে। গুমোট অফিস ঘর থেকে বেরুতে পারাটাই একটা আরাম। বেশিক্ষণ কিন্তু বাইরে থাকা হল না। কয়েকটা আলু সেদ্ধ চড়াতে হবে, সোজা তাই বাড়ি ফিরলাম।
হল-ঘরটা অন্ধকার। সিড়ি দিয়ে ওঠবার সময় সালামানার সঙ্গে প্রায় ধাক্কাই লাগছিল আর একটু হলে। আমি যে তলায় থাকি সালামানার ঘরও সেই তলায়।
রোজকার মতো সে তার কুকুর নিয়ে বেরুচ্ছে। আট বছর ধরে তাদের ছাড়াছাড়ি কখনো হয় নি। স্পানিয়েল জাতের, বিশ্রী লোম ওঠা ঘেয়ো চেহারা। একটা ছোট ঘরে এক সঙ্গে নিত্য থাকার দরুন সালামানের চেহারাটাও যেন কুকুরটার মতো হয়ে গেছে। মাথার চুল পাতলা, মুখে লালচে কি সব দাগ। কুকুরটাও যেন মনিবের মতো কুঁজো হয়ে হাঁটে। হাঁটবার সময় নাকটা মাটিতে ঠেকানই থাকে। কিন্তু এত মিল থাকলে কি হয়, মনিব আর কুকুর পরস্পরের দু চক্ষের বিষ।  দিনে দুবার, সকালে এগারটায় আর সন্ধ্যা ছটায় সালামানো কুকুরটাকে বেড়াতে নিয়ে বেরোয়। আট বছর ধরে এ নিয়মের বদল হয় নি।
রু দ লিয়ঁ-তে দু জনকে যথাসময়ে রোজ দেখা যাবে। চেন - বাঁধা কুকুরটা মনিবকে প্রাণপণে টানতে টানতে চলেছে। সিঁড়িতে পা হড়কে সালামানো প্রায় পড়ে আর কি। সামলে নিয়ে সালামানো গাল দিতে দিতে কুকুরটাকে ঠেঙায়। কুকুরটা ভয়ে কুঁকড়ে এবার পিছিয়ে পড়ে থাকে। মনিবকেই এবার খানিক্ষণ তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সে খানিকক্ষণ মাত্র। খানিকবাদেই আবার সব ভুলে গিয়ে কুকুরটা আবার আগে আগে টানতে টানতে চলে। আবার ঘুরে ঘুরে সেই একই মার বকুনি খাওয়ার পালা।
তারপর ফুটপাতের ধারে তারা দাঁড়ায় দুজনে দুজনার দিকে তাকিয়ে। কুকুরটার চোখে ভয় আর মনিবের ঘৃণা।
রোজ রোজ সেই একই ব্যাপার। কুকুরটা ল্যাম্প-পোষ্ট দেখে দাঁড়াতে চাইলেও সালামানো তাকে টানতে টানতে দিয়ে চলে। ফোঁটা ফোঁটা জলের একটা রেখা তাই তার পেছনে পেছনে আঁকা হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে গিয়ে কিছু করার শাস্তিও সেই ঠেঙানি।
 আট বছর ধরে এইরকম চলে আসছে। সিলেস্তে প্রায়ই বিরক্তি জানায়, কি বিশ্রী ব্যাপার! একটা কিছু বিহিত করতে হয়! কিন্তু সে বিষয়েও ঠিক কিছু যায় না।
হলে যখন দেখা হল সালামানো তখন কুকুরটাকে গাল দিয়ে ভূত ভাগাচ্ছে ---- বেজন্মা ঘেয়ো লেড়ি কুত্তা, এমনি আরো কত কি। কুকুরটা থেকে কেঁউ কেঁউ করে উঠছে।
আমি সম্ভাষণ জানালাম কিন্তু সালামানোর ভ্রƒক্ষেপ নেই। সে তখন থেকে কুকুরটাকে গালাগাল করতে ব্যস্ত।
কুকুরটার অপরাধটা কি জানতে চাইলাম এবার। তাতেও কোনও উত্তর নেই। পাজি নচ্ছার কুকুর ----ইত্যাদি গালাগালই চলল।
 অন্ধকারে ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হল কুকুরটার গলার  কলারে কি যেন একটা সে লাগাচ্ছে।
গলা একটু চড়িয়ে সেই একই প্রশ্ন করলাম। আমার দিকে না ফিরে চাপা রাগে সে কিড়বিড় করে বললে, ‘জাহান্নামে যাক অমন কুকুর। সারাক্ষণ জ্বালাচ্ছে!’
সিঁড়ি দিয়ে এবার সে উঠতে শুরু করল। কিন্তু কুকুরটা কিছুতেই যাবে না। মেঝের ওপর চ্যাপ্টা হয়ে গিয়ে সে প্রাণপণে বাধা দিতে লাগল। সালামানোর তখন চেন ধরে তাকে প্রতিটি ধাপ হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে না গিয়ে উপায় কি! 
ঠিক সেই সময় আর -একটি লোক নীচের     রাস্তা থেকে এসে ঢুকল। লোকটি আমাদের দো- তলাতেই থাকে। অনেকেরই এখানে ধারণা লোকটা দেহোপজীবিনীদের দালাল। জিজ্ঞেস করলে সে অবশ্য জেটির গুদামেই কাজ করে বলে। এ কথাটা অবশ্য ঠিক যে আমাদের পাড়ায় তাকে পছন্দ বড় কেউ করে না। 
আমার সঙ্গে কিন্তু মাঝে মাঝে সে দু- চারটে কথা বলে। কখনো -সখনো আমার ঘরেও এসে বসে একটু আধটু আলাপ করতে, কারণ আমি তার কথা শুনি। সত্যি কথা বলতে কি , তার কথাবার্তা শুনতে আমার ভালোই লাগে। সুতরাং তার ওপর নাক সিঁটকে থাকার কোনো কারণই আমার নেই।
লোকটার নাম সিন্তে—স, রেমন্ড সিন্তে—স। বেঁটে গাঁট্টা গোট্টা চেহারা, নাকটা ঘুঁসোঘুঁসি যাদের পেশা তাদের মতো থ্যাবড়ান। পোশাকে আশাকে কিন্তু খুব ফিটফাট । সেও একবার সালামানো সম্বন্ধে মন্তব্য করে বলেছিল, কি ঘেন্নার ব্যাপার! কুকুরটার সঙ্গে বুড়ো যে রকম ব্যবহার করে তাতে আমি বিরক্ত হই কি-না তাও জিজ্ঞেস করেছিল। বিরক্ত হই না, বলেছিলাম।
দু জনে একসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। আবার ঘরের দরজায় ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় সিন্তে—স বললে ,‘শুনুন! আমার সঙ্গেই এ-বেলা খান না । কালো পুডিং আর মদ আছে।’
 ভাবলাম, মন্দ কি। আমার এ-বেলা তাহলে আর রাঁধতে হয় না।
‘ধন্যবাদ’ বলে সম্মতি জানালাম।
তারও একটিমাত্র ঘর আর সেই সঙ্গে একটা রান্নাঘর ---- তার আবার জানালার বালাই নেই। ওর বিছানার মাথায় সাদা গোলাপী প্লাস্টারের একটি দেবদুতের মূর্তি। অন্যদিকের দেয়ালে কয়েকটা সেরা সেরা খোলোয়াড়  আর উলঙ্গ মেয়ের ছবি আঁটা। বিছানাটা পাতা হয় নি, ঘরটাও নোংরা। 
সে একটা কেরোসিনের বাতি জ্বালল, তারপর একটা ময়লা ব্যান্ডেজ পকেট থেকে বার করে ডান হতে জড়াল।
 জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি ? সে জানালে কার সঙ্গে যেন মারামরি করেছে। লোকটা নাকি তাকে চটিয়েছে।
সিন্তেস আরো বিশদ করে বললে ,‘আমি শখ করে ঝামেলা খুঁিজ না। তবে আমি একটু রগচটা। লোকটা আমায় রোক দেখিয়ে বললে,‘‘মরদ হলে নেমে আসুন ট্রাম থেকে’’। বললাম, ‘মাথা ঠান্ডা করুন, আপনার কি করেছি আমি।’ তাতে বলে কিনা আমার সাহস নেই। ব্যস তাইতেই মেজাজ গেল বিগড়ে। ট্রাম থেকে নেমে বললাম, ‘কথাটি আর বলো না, নইলে একটি ঘুঁসিতে মুখ বন্ধ করে দেব’। তাতে বললে,‘দেখি-ই না কত মুরোদ।’ এবার একটি ঘুঁসি মুখে ঝাড়লাম। তাতেই জমি নিলে। একটু দেখে তাকে তুলতে গেলাম তাতে শুয়ে শুয়েই লাথি ছুঁড়লে। হাঁটুর একটা গুঁতো দিয়ে আরো দু-ঘা কষালাম । তখন রক্তে ভাসছে কাটা শুয়োরের মতো। শুধোলাম , যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে কি-না। বলে, ‘হাঁ, হয়েছে।’ 
বিছানায় বসে সিন্তে—সের কথা শুনছিলাম । সে ব্যান্ডেজটা হাতে বাঁধতে বাঁধতে বর্ণনা দিচ্ছিল মারামারির।
‘বুঝলেন তো!’ সে বললে,‘আমার কোন দোষ নেই, সে-ই সাধ করে হাঙ্গামা ডেকেছে, কেমন তাই না ?’
মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিলাম।
সে বললে,‘আপনাকে তাহলে আসল কথাটা বলি,- একটা বিষয়ে আপনার একটু পরামর্শ চাই। এই ব্যাপারটার সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। আপনি তো অনেক কিছু দেখেছেন শুনেছেন, আপনি নিশ্চয় আমার একটা উপায় বাতলাতে পারেন। তাহলে আমি আপনার সারা জীবনের দোস্ত হব। আমার ভালো কিছু যে করে আমি তাকে জীবনে ভুলি না’।
আমি কিছু না বলাতে সে জিজ্ঞেস করলে, আমি তার সঙ্গে দোস্তী করতে চাই কিনা! বললাম, আমার কোনো আপত্তি নেই। এ জবাবেই সে সন্তুষ্ট হল বলে মনে হল।
কালো পুডিং-এর থালাটা বার করে সে ফ্রাইং প্যানে সেটা রেঁধে নিলে। তারপর টেবিল সাজিয়ে দু বোতল মদ সেখানে রাখল। এসব কাজ সে নীরবে সারল।
খেতে বসার পর একটু ইতস্তত করে সে তার সমস্ত গল্পাটাই বলতে শুরু করলে।
‘ব্যাপারটা নারী ঘটিত- যেমন হয়। তাকে নিয়ে অনেক রাতই কাটিয়েছি। আমারই রক্ষিতা। সত্যি কথা বলতে কি আমার বেশ দু পয়সা খসৃত তার জন্যে। যাকে আজ মেরেছি সে তারই ভাই’।
আমি চুপ করে আছি দেখে সিন্তেস আবার বললে, পাড়াপড়শীরা তার সম্বন্ধে কি বলে সে জানে। কিন্তু কথাটা ডাহা মিথ্যে। ন্যায় অন্যায় সেও মানে আর সবাইকার মতো, জেটির গুদামে সে কাজও করে।
‘হ্যাঁ, তারপর যা বলছিলাম,’ সে বলে চলল,‘একদিন টের পেলাম যে মেয়েটা আমার চোখে ধুলো দিচ্ছে ...’
সিন্তেস তাকে বাজে খরচ না করে চালাবার মতো যথেষ্ট টাকাই দিত বললে। তার ঘর-ভাড়া আর খাই খরচা দিনে কুড়ি ফ্রাঙ্ক।
‘ভেবে দেখুন ঘর-ভাড়া আর খাই-খরচা মাসে ছ’শ ফ্রাঙ্ক’। তার ওপর তখন এটা সেটা উপহার, যেমন একজোড়া মোজা কিংবা আর -কিছু। দাঁড়াল গিয়ে তাহলে প্রায় হাজার ফ্রাঙ্ক। কিন্তু তাতেও বিবি সাহেবের চলে না। রাতদিনই ঘ্যানঘ্যান করত যে আমি যা দিই তাতে নাকি তার কিছুতেই কুলোয় না।’
‘একদিন তাই বললাম - ঘন্টা দু -একের একটা কাজ জুটিয়ে নাও না কেন? তাতে আমারও সাশ্রয় হয়। এই মাসেই একটা নতুন পোশাক কিনে দিয়েছি। তোমার ঘর-ভাড়া আমিই দিই আর তোমার খাবার খরচা। কিন্তু তুমি কাফে তে এক পাল মেয়ে নিয়ে গিয়ে পয়সা ওড়াও। চিনি দেওয়া কফি খাওয়াও তাদের! তার পয়সাটা অবশ্য আমার পকেট থেকেই যায়। আমি তোমার জন্যে যা করি একই তার প্রতিদান!’ কিন্তু সে কাজ নেওয়ার ধার দিয়েও যায় না। আমি যা দিই তাতে চলে না এই শুধু নালিশ। তারপর একদিন টের পেলাম কি ঠকান আমায় ঠকাচ্ছে ।’
সিন্তেস এবার বলতে থাকে কি করে একদিন মেয়েটির ব্যাগে একটা লটারির টিকিট দেখে কেনাবার টাকা কোথায় পেয়েছে - সে জিজ্ঞেস করে। মেয়েটা কিছতেই নাকি বলতে চায়নি। তারপর আরেক দিন দুটো ব্রেসলেট বন্ধক দেওয়ার রসিদ তার কাছে পায়। সে ব্রেসলেট সিন্তেস কিন্তু চোখেও কখনো দেখেনি।

 তলে তলে যে শয়তানী চলেছে, আমি তখনই বুঝলাম আর তাকে বলেও দিলাম যে তার সঙ্গে সব সম্পর্ক আমার শেষ। প্রথমে অবশ্য তাকে বেশ কয়েক ঘা দিলাম, শুনিয়েও দিলাম সাফ্ সাফ্ কয়েকটা কথা । বললাম যে সুবিধে পেলেই যে কোনো পুরুষের সঙ্গে রাত্রিবাস করা ছাড়া আর কিছুতে তার মন নেই। তাকে স্পষ্ট বুঝিয়েও দিলাম, ‘একদিন তোমায় আফশোস করতে হবে, বুঝেছ সুন্দরী,  তখন সাধ হবে আবার আমায় ফিরে পেতে। আমার মতো লোকের হাতে আছ বলে তোমায় রাস্তার সব মেয়ে হিংসে করে তা জানো !
রেমন্ডের কথায় জানা গেল রক্তপাত না হওয়া পর্যন্ত সেদিন সে মেয়েটাকে মেরেছে। আগে কখনো তাকে নাকি মারে নি।
‘অন্তত এমন রাগের মার নয়, আদরের মতো দু-এক ঘা দিয়েছি মাত্র। সে তাতে একটু-আধটু কান্নকাটি চেঁচামেচি করেছে, আমি জানালা বন্ধ করে দিয়েছি। তারপর সে সব ঝগড়া যথারীতি মিটে গেছে।  কিন্তু এবারে আর তা হচ্ছে না। কোনো সর্ম্পক আর আমি ওর সঙ্গে রাখব না। শুধু মনে হচ্ছে ঠিক মতো সাজা ওকে দিতে পরি নি। আমার কথাটা বুঝতে পারছেন?’
এবার কথাটা সে বুঝিয়ে বললে। এই জন্যেই সে আমার পরামর্শ চায়।
লন্ঠনটায় ধোঁয়া উঠছে। সে পায়চারী থামিয়ে পলতেটা একটু নামিয়ে দিলে। কোনো জবাব না দিয়ে আমি তার কথা শুনে যাচ্ছিলাম। গোটা একটা বোতল মদ আমার পেটে গেছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। নিজের সিগারেট ফুরিয়ে গেছে বলে আমি রেমন্ডের সিগারেটই খাচ্ছিলাম। শেষ দিকের কটা ট্রাম চলে যাওয়ার পর রাস্তা নিস্তব্ধ হয়ে এল। রেমন্ড তখনো তার কথা বলে চলেছে। তার জ্বালাটা এই যে মেয়েটার ওপর তার কেমন টান পড়ে গেছে । তবু সে তাকে সায়েস্তা করবে-ই।
প্রথমে সে ভেবেছে, মেয়েটাকে একদিন কোন হোটেলে নিয়ে গিয়ে পুলিশ ডাকিয়ে আনাবে। পুলিশকে বলবে সাধারণ বেশ্যা বলে তার নাম রেজেষ্ট্রীতে তুলে নিতে। সেই তাইতেই তাহলে ক্ষেপে যাবে।
এরপর সে গুন্ডা বদমাসদের দলের দু-চারজন আলাপীর কাছে পরামর্শ চেয়েছে। নিজেদের কাজ বাগাতে ও-ধরনের মেয়ে তারা হাতে রাখে। তারাও কোনো মতলব বাতলাতে পারে নি। কিন্তু তাদেরই এসব জানা উচিত। নেমকহারামী যে করেছে এমন মেয়েকে সিধে করবার উপায়ই যদি না জানে তাহলে গুন্ডা বদমাস হওয়া কেন? এ কথা তাদের বলায় তারা পরামর্শ দিলে মেয়েটাকে ছ্যাঁকা দিয়ে দাগী করে দেবার। কিন্তূু সেটাও তার পছন্দ নয়। ব্যাপারাটা আরো ভাবতে হবে .......তবে প্রথমে সে আমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চায়, আর তা জিজ্ঞেস করবার আগে সমস্ত গল্পটা শুনে আমার কি মনে হল তা তার জানা দরকার।
বললাম, ‘মনে আমার তেমন কিছু হয়নি তবে শুনতে আগ্রহ হয়েছে।’ 
মেয়েটা তার সঙ্গে সত্যি শয়তানী করেছে বলে আমি মনে করি কিনা?
স্বীকার করলাম যে ব্যাপারটা সেই রকমই মনে হয়।
তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া উচিত কি না, আর তার জায়গায় আমি হলে কি করতাম।
বললাম যে এরকম অবস্থায় কি করা উচিত ঠিক করা শক্ত। তবে তাকে শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছেটা বুঝতে পারি।
আরো খানিকটা মদ খেলাম। রেমন্ড তখন আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে কি সে করতে চায় আমাকে বোঝাচ্ছে।র্
সে তাকে একটা কড়া চিঠি লিখতে চায়,এমন চিঠি যাতে মেয়েটি বিছুটির জ্বালায় জ্বলবে আবার নিজের ভুল বুঝে আফসোসও করবে।
তারপর সে আবার রেমন্ডের কাছে ফিরে এলে রেমন্ড তাকে নিজের বিছানাতেই জায়গা দেবে। তারপর সে যখন আদরে বেশ গলে উঠেছে তখন মুখে থুতু দিয়ে তাকে ঘর থেকে বার করে দেবে।
মতলবটা মন্দ নয় স্বীকার করলাম। শাস্তি এতে তার বেশ হবে। রেমন্ড বললে যে ঠিক এই ধরনের চিঠি লেখা তার আসে না। এই ব্যাপারেই সে আমার সাহায্য চায়।
আমি চুপ করে থাকায় সে জিজ্ঞেস করলে তখুনি একটা চিঠি লিখে দিতে আমি রাজী কি না।
বললাম - চেষ্টা করে দেখতে পারি।
এক গ্লাস মদ শেষ করে সে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর প্লেট আর পুডিং-এর টুকরোগুলো সরিয়ে টেবিলটা পরিষ্কার করলে। অয়েল ক্লথটা ভালো করে মুছে সে তার বিছানায় ধারের টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা  চৌকো কাগজ নিয়ে এল। তারপর আনলে একটা খাম, একটা লাল কলম আর বেগুনি কালিভরা একটা দোয়াত।
এবার মেয়েটার নাম বলামাত্র আমি বুঝলাম যে সে মূর।
চিঠিটা লিখে ফেললাম। তেমন কিছু ভেবে চিন্তে লিখলাম না।
শুধু রেমন্ডকে সন্তুষ্ট করবার জন্যেই লেখা। সন্তুষ্ট করব নাই  বা কেন।
লিখে চিঠিটা পড়লাম। সিগারেটটা টানতে টানতে রেমন্ড সবটা শুনল। মাঝে মাঝে মাথাও নাড়ল তারিফ করতে।
‘আরেকবার পড়ো তো?’ সে অনুরোধ করলে। মনে হল বেশ খুশি হয়েছে।
‘আরে এই তো চাই।’ চিঠিটা আবার শোনার পর তার গলায় ! খুশি ছলকে উঠল, ‘দেখেই আমি ধরেছি তোমার মাথায় ঘিলু আছে, দোস্ত!’ সব একেবারে সাফ্-সাফ্ বোঝ।’
‘দোস্ত’ বলার  অন্তরঙ্গতা প্রথমটা তেমন লক্ষ্য করিনি। লক্ষ্য করলাম, হঠাৎ আমার কাঁধ চাপড়ে যখন সে বললে, - ‘তাহলে এখন থেকে আমরা দোস্ত, কি বলো?’
আমি চুপ করে রইলাম। সে আবার সেই কথাই বললে।
দোস্ত হই বা না হই আমার কাছে সবই এক। কিন্তু তার পেড়াপীড়ি দেখে সায় দিয়ে বললাম - ‘হ্যাঁ’।
চিঠিটা সে খামে ভরল। বাকি মদটা আমরা শেষ করলাম। তারপর কোন কথা না বলে খানিকক্ষণ সিগারেট খেতে লাগলাম দুজনে।
রাস্তাটা এখন প্রায় নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শুধু একটা গাড়ি যাওয়ার আওয়াজ।
খানিক বাদে আমি জানালাম যে বেশ রাত হয়ে গেছে। 
রেমন্ড সায় দিয়ে বললে, ‘আজ যে সময়টা দেখতে দেখতে কেটে গেল’। কথাটা সত্যি।
বিছানায় গিয়ে শুতে পারলে আমি তখন বাঁচি, কিন্তূু উঠে ঘরে যাওয়াটাও যেন কষ্টকর। আমাকে নিশ্চয় ক্লান্ত দেখাচ্ছিল কারণ রেমন্ড বললে, ‘কোন কিছুতেই ভেঙে পড়ো না।’ 
প্রথমে তার কথার মানেটা বুঝতে পারিনি। তারপর সে বুঝিয়ে বললে যে আমার মার মৃত্যুর কথা সে শুনেছে। তবে এ শোক তো একদিন না একদিন পেতে-ই হয়।
তার কথাটা ভালো লাগল। তাকে তা জানালামও।
আমি যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াতে রেমন্ড আমার সঙ্গে সাদরে করমর্দন করে বললে যে পুরুষরা পরস্পরকে বোঝে।
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে ওপরের সিঁড়িতে খানিক দাঁড়ালাম।
সমস্ত বাড়িটা কবরখানার মতো নিস্তব্ধ। সিঁড়ির ফাঁকের গর্ত থেকে একটা ভাপসা গন্ধ উঠছে।
নিজের কানের রক্ত চলাচলের দপদপানি ছাড়া আর কিছু আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে তাই শুনলাম।
তারপর সালামানোর ঘরে কুকুরটা গোঙাতে শুরু করল। ঘুমজড়ানো বাড়িটার ভেতর দিয়ে সেই ক্ষীণ কাতরানি ধীরে ধীরে উঠতে লাগল - যেন নিঃশব্দ অন্ধকারের একটা ফুল।

চার
সারা হপ্তা অফিসের কাজের চাপ খুব বেশী ছিল। তারি মধ্যে রেমন্ড একদিন এসে জানালে চিঠিটা সে পাঠিয়ে দিয়েছে। দু-বার ইমানুয়েলের সঙ্গে ছবি দেখতে গেছলাম। ছবির গল্প সে সব সময়ে বুঝতে পারে না, আমায় বুঝিয়ে দিতে বলে।
কাল ছিল শনিবার। আগেকার কথা মত মারী এসেছিল। লাল সাদা ডোরাকাটা তার পোশাকটা ভারী সুন্দর। পায়ে চামড়ার স্যান্ডাল। আমি তো চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। পোশাকের ভেতর দিয়ে তার বুকের চমৎকার গড়নটা বেশ বোঝা যায়। রোদে তামাটে মুখখানা যেন মখমলের মত কোমল বাদামী একটা ফুল।
বাস-এ চড়ে আমার জানা একটা জায়গায় গেলাম। আলজিেের্য়স থেকে কয়েক মাইল দুরে সমুদ্রতীরে। দু দিকের দুটো পাহাড়ী ঢিবির মাঝখানে খানকিটা বালির চড়া। জোয়ারের ঢেউ যেখান পর্যন্ত পৌঁছোয় সেখানে বুনো ঘাসের সার। বেলা চারটের সময় রোড তেমন চড়া নয়, কিন্তু জলের মৃদু তাপটুকু মধুর। অলস মন্থর ছোট ছোট ঢেউগুলো বালির ওপর গড়িয়ে আসছে।
মারী আমায় নতুন একটা খেলা শেখালো। কায়দাটা হল  সাঁতার কাটবার সময় ঢেউ এর ফেনাগুলো শুষে নিয়ে মুখ ভরে উঠবার পর চিৎ দিতে দিতে সেগুলো আকাশের দিকে পিচকিরির মতো ছিটিয়ে দেওয়া। একটা যেন ফেনার কুয়াশা তাতে তৈরী হয়। হাওয়ায় মিলিয়ে না গেলে তা নিজের গালে মুখে ঈষৎ গরম জলের ধারার মত পড়ে।
আমার কিন্তু খানিক বাদেই নোনা জলে মুখ জ্বালা করতে লাগল। মারী তখন এসে জলের মধ্যেই জড়িয়ে ধরে আমার মুখে তার মুখটা চেপে ধরলে। তার জিভের ছোঁয়ায় আমার ঠোঁটদুটোর জ্বালা একটু জুড়োল। মিনিট দুয়েক ঢেউ-এর দোলায় গা ভাসিয়ে আমরা আবার সাঁতরে তীরে উঠলাম।
পোশাক পরবার পর মারী খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল। চোখদুটো তার জ্বলজ্বল করছে। আমি তাকে চুমু খেলাম। দুজনেই চুপ করে রইলাম। পাড়ে ওঠবার সময় আমি তাকে পাশে জড়িয়ে ধরে উঠলাম। তারপর দুজনেরই বাস ধরবার তাড়া। ঘরে ফিরে বিছানায় গিয়ে গড়াবার জন্যে ছটফট করছি।
জানালাটা খুলে রেখে এসেছিলাম। রোদে পোড়া শরীরে রাত্রের ঠান্ডা হাওয়াটা মধুর লাগল দুজনের।
মারী বললে কাল সকালে তার ছুটি। তাই দুপুরে তাকে আমার সঙ্গে খেতে বললাম। সে রাজী হল। আমি নিচে খাবার জন্য কিছু মাংস কিনতে গেলাম। ফিরে আসবার সময় রেমন্ডের ঘরে একটি মেয়ের গলা শোনা গেল। খানিক বাদে শুনতে পেলাম বুড়ো সালামানো তার কুকুটাকে বকছে। তারপরই কাঠের সিঁড়িতে  জুতোর আর কুকুরের পায়ের আঁচড়ানির শব্দ শোনা গেল।
‘চল হতভাগা পাজি চল!’ - কুকুর আর মনিব দু জনে বার হয়ে গেল রাস্তায়। মারীকে বুড়োর গল্প করলাম। সে হেসে উঠল।
মারী আমার রাত্রে - শোবার জামা পা-জামা পরেছে। হাতদুটো গুটিয়ে নিয়েছে। তাকে হাসতে দেখে আবার মনটা অধীর হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ বাদেই সে জিজ্ঞেস করলে তাকে ভালোবাসি কিনা। বললাম, এ ধরনের প্রশ্নের সত্যি কোন মানেই হয় না। কিন্তু বোধহয় ভালো - টালো আমি বাসি না।’
কিছুক্ষণ সে একটু মনমরা হয়ে রইল। কিন্তু দুপুরের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা যখন করছি তখন আবার তার স্ফূর্তি ফিরে এল। সে হাসতে লাগল । হাসলেই তাকে আমার চুমু খেতে ইচ্ছে করে।
ঠিক সেই মুহূর্তে  রেমন্ডের ঘরে গোলমালটা উঠল।
প্রথমে একটি মেয়ের তীক্ষè গলা শোনা গেল। চেঁচিয়ে সে কি বলছে। আর তারপর রেমন্ডের চড়া গলার গালাগাল, ‘আমার সঙ্গে নেমকহারামী ! কুত্তী কোথাকার! নেমকহারামীর মজা আমি তোমায় বোঝাচ্ছি।’
কয়েকটা দুমদাম মারের শব্দ তারপর আকাশ ফাটানো এক চীৎকার - একেবারে যেন শরীর হিম হয়ে যায় সে তীক্ষè চীৎকারে।
ওপরের সিঁড়ির ধারে তখখুনি লোক জমে গেল। মারী আর আমিও দেখতে গেলাম।
মেয়েটা তখনও চেঁচাচ্ছে, আর রেমন্ড তাকে ঠেঙিয়ে চলেছে।
‘কি বিশ্রী কান্ড’ - বললে মারী।
আমি কিছু বললাম না।
মারী আমার পুলিশ ডেকে আনতে বললে। আমি বললাম, ‘পুলিশ-টুলিশ আমার ভালো লাগে না।’
একজন পুলিশ অফিসার অবশ্য তখনই এলেন। তার সঙ্গে তে-তলার একজন ভাড়াটেও উঠে এল।
পুলিশ অফিসার দরজায় ধাক্কা দিতেই ভেতরের গোলমাল থেমে গেল।
অফিসার আবার ঘা দিলেন দরজায়। তারপরই মেয়েটার কান্না শোনা গেল। রেমন্ডও দরজা খুললে।
তার নিচের ঠোঁটে একটা সিগারেট আটকে ঝুলছে, মুখে তার কি রকম বিশ্রী ফ্যাকাশে একটু হাসি।
‘নাম?’
রেমন্ড তার নাম বললে।
‘আমার সঙ্গে সিগারেটটা মুখ থেকে নামিয়ে কথা বলো’ - পুলিশ অফিসার কড়া গলায় বললেন।
একটু ইতস্তত করে আমার দিকে একবার চেয়ে রেমন্ড সিগারেটটা আর নামাল না।
পুলিশ অফিসার তৎক্ষণাৎ বেশ জোরে তার বাঁ গালে একটি চড় কষালেন। সিগারেটটা মুখ থেকে দু-হাত দূরে ছিটকে পড়ল।
রেমন্ডের মুখটা কেমন হয়ে গেল। কিন্তু তখুনি সে কিছু বলতে পারলে না। একটু বাদে সে সিগারেটটা কুড়িয়ে নেবার অনুমতি চাইলে বেশ নিচু হয়ে।
অনুমতি দিয়ে অফিসার বললেন, ‘কিন্তু আর কখনো এরকম বেয়াদবী যেন না দেখি। তোমার মত লোকের এসব বরদাস্ত করতে আমরা রাজী নই।’
মেয়েটা সেই থেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে চলেছে, ‘ছুঁচোটা আমায় মেরেছে, ওটা দালাল - কুটনি!’
‘মাপ করবেন অফিসার’ - রেমন্ড নালিশ জানালে, ‘আপানারা সব সাক্ষী আছেন আমায় দালাল কুটনি বলেছে। এটা অন্যায় নয়?’
অফিসার তাকে ধমকে চুপ করতে বললেন।
রেমন্ড এবার মেয়েটার দিকে ফিরে বললে ‘আচ্ছা সোনামণি, দেখা আবার তোমার সঙ্গে হবে।’
‘ব্যস, খতম’ - বলে অফিসার মেয়েটাকে চলে যেতে বললেন। থানা থেকে ডাক না পড়া পর্যন্ত রেমন্ডকে ঘরেই থাকতে হুকুম দিয়ে বললেন, ‘লজ্জা করে না তোমার, এমন নেশা করেছ যে দাঁড়াতে পারছ না। তোমার হাত পা তো সব কাঁপছে।’
‘নেশা তো আমি করিনি।’ রেমন্ড সাফাই গাইলে, ‘শুধু আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছেন বলে ভেতর থেকে আমার কাঁপুনি আসছে।’
রেমন্ড তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিলে। আমরাও চলে এলাম। মারী আর আমি খাবার টাবার সাজিয়ে নিয়ে খেতে বসলাম। মারীর খিদে তখন চলে গেছে। আমিই একা প্রায় সব খেলাম। একটার সময় মারী চলে গেলে আমি একটা ঘুম দিলাম।
তিনটের সময় দরজায় টোকা পড়ল। রেমন্ড ঘরে ঢুকল। মিনিট দু-এক আমার বিছানার ধারে সে চুপ করে বসে রইল।
জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা কেমন হল। সে বললে গোড়ায় সব যেমন ঠিক করা ছিল তাই হয়েছে। তারপর কিন্তু মেয়েটা তার গালে চড় মারে। তাইতে তার একবারে খুন চেপে যায়। তখন সে মেয়েটাকে ঠ্যাঙাতে শুরু করে। তারপর কি হয়েছে সে তো আমি দেখেছি। সুতরাং বলবার দরকার নেই।
বললাম, ‘যাক্, ওকে শিক্ষা তো দেওয়া হয়েছে আর তাই তো তুমি চেয়েছিলে, তাই না?’
সে স্বীকার করলে তাই শুধু চেয়েছিল বটে! সেই সঙ্গে বুঝালে যে পুলিশ যাই করুক মেয়েটার শাস্তি পাওয়া ত আর বদলাবে না।
আর পুলিশকে কি করে সামলাতে হয় সে জানে। তবে পুলিশকে সে উল্টে মারবে এইটিই আমি আশা করেছিলাম কি-না সে জানতে চায়।
বললাম, ‘কিছুই আমি আশা করি নি,  আর তাছাড়া, পুলিশের ব্যাপারে আমি নেই।’
রেমন্ড যেন খুশি হয়েছে মনে হল। জিজ্ঞেস করলে তার সঙ্গে বেড়াতে যাব কি-না।
বিছানা থেকে উঠে চুল আঁচড়ে নিলাম। রেমন্ড বললে, সে  আসলে কিন্তু চায় যে আমি তার সাক্ষী হই। জানালাম যে আমার তাতে আপত্তি নেই। শুধু আমায় দিয়ে কি সে বলাতে চায় আমি জানি না।
‘খুব সোজা কথা বলতে হবে’ - সে জানালে - শুধু বলবে যে মেয়েটা নেমকহারামী করেছে।’
আমি তার সাক্ষী হতে রাজী হলাম।
দু জনে আমরা বেরুলাম। রেমন্ড একটা কাফে -তে আমায় ব্রান্ডি খাওয়ালে। তারপর দুজনে বিলিয়ার্ডস খেললাম। খেলাটা খুব হাড্ডাহাড্ডি হল। সামান্য কয়েক পয়েন্ট মাত্র হারলাম। তারপর সে এক বিশেষ পল্লীর দিকে যাবার কথা বললে। কিন্তু আমি রাজী হলাম না।
আস্তো আস্তে হেঁটে বাড়ি ফেরবার সময় সে মেয়েটাকে উচিত শিক্ষা দিতে পেরে কি খুশি হয়েছে তা জানালে। আমাকে তোয়াজ করতে তার খুব আগ্রহ দেখলাম। বেড়িয়ে ফেরাটা আমার বেশ ভালো লাগল।
প্রায় বাড়ির কাছে এসে বুড়ো সালামানোকে দরজায় দেখতে পেলাম। তাকে খুব উত্তেজিত মনে হল। দেখলাম তার সঙ্গে কুকুরটা নেই। সে চরকির মত ঘুরে চারিদিকে লক্ষ্য করছে, মাঝে মাঝে জবার মত লাল চোখে হলের অন্ধকারে উঁকি দিচ্ছে। একবার ভেতরে উঁকি দেয় আবার রাস্তার এধারে ওধারে চায়।

‘কি হয়েছে কি?’ - রেমন্ড জিজ্ঞেস করলে কিন্তু সালামানো তখুনি জবাব দিলে না। নিজের মনে তাকে গজগজ করতে শুনলাম - বেটা বেজন্মা! হতচ্ছাড়া লেড়ি।
কুকুরটা কোথায় আমি জিজ্ঞেস করবার পর বললে - ‘পালিয়েছে।’
পরের মুহূর্তে হঠাৎ বৃত্তান্ত শুরু করে দিলে, ‘প্যারেডের মাঠে বেটাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কি একটা মেলা হচ্ছে বলে এমন ভীড় যে হাঁটা যায় না। একটা জায়গায় হাতকড়ি খেলার সেরা ওস্তাদকে দেখবার জন্যে আমি একটু দাঁড়িয়েছি। যাবার জন্যে ফিরেই দেখি কুকুরটা পালিয়েছে। আর একটা ছোট ‘কলার’ কিনবা ক দিন ধরেই ভাবছিলাম। হতভাগা যে ও ‘কলার’ থেকে মাথা গলিয়ে পালাতে পারে ভাবতেই পারি নি।’
রেমন্ড সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলে। ও কুকুর নিশ্চয় পথ চিনে বাড়ি ফিরে আসবে। ওরকম কত কুকরের বহুদূর থেকে মনিবরে কাছে ফিরে আসার কথা বললে। কিন্তু বুড়ো যেন তাতে আরো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।
‘আপনারা জানেন না। ওকে ওরা মেরে ফেলবে। ওরা মানে পুলিশের কথা বলছি। ওকে কেউ নিয়ে ত পুষবে না। ওর ওই ঘেয়ো চেহারা দেখলেই সকলের ঘেন্না হয়।’
থানার কুকুরে খোঁয়াড়ের কথা বুড়োকে জানালাম। বললাম কুকুরটাকে নিশ্চয় সেখানে নিয়ে গেছে। কিন্তু জরিমানা দিয়েই তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।
জরিমানা কত লাগবে বুড়ো জিজ্ঞেস করলে। ঠিক বলতে পারলাম না।
বুড়ো আবার রেগে উঠল, ‘ওই পাজিটার জন্যে আমি জরিমানার পয়সা গুনব। মারুক বেটাকে, আমার কি!’
বুড়ো আবার কুকুরটাকে গালমন্দ দিতে শুরু করলে।
রেমন্ড হেসে হলে ঢুকে পড়ল। আমিও তার পিছ পিছু ওপরে উঠলাম।
সিঁড়ির ওপরে আমাদের ছাড়াছাড়ি হল। খানিক বাদেই সালামানোর পায়ের শব্দ পেলাম। সেই সঙ্গে আমার দরজায় ধাক্কা।
‘মাপ করবেন। আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?’
আমি তাকে ভেতরে আসতে বললাম, কিন্তু সে মাথা নাড়ল। নিজের জুতোর দিকে একবার সে চাইল। তার দড়ি পাকানো কোঁচকানো হাতগুলো কাঁপছে।
আমার দিকে না চেয়েই সে বলতে শুরু করলে, ‘ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে কেউ নেবে না, কি বলেন? কখখনো তা নিতে পারে না। নিলে - কিন্তু কি যে আমার হবে জানি না’।
জানালাম যে যতদূর আমি জানি রাস্তার উটকো কুকুর তিন দিন ওরা রাখে মালিকদের ফেরত নিয়ে যাবার সময় দেবার জন্যে। তারপর যেমন তারা ভালো বোঝে করে।
আমার দিকে একদৃষ্টে খানিক চেয়ে থেকে, ‘গুড নাইট’ বলে বুড়ো চলে গেল।
অনেকক্ষণ নিজের ঘরে তার পায়চারির শব্দ পেলাম। খাট-টা কাঁচক্যাঁচ করে উঠলে তারপর। দেওয়ালের ভেতর দিয়ে কেমন একটা ফোঁপানির শব্দ পেলাম। বুঝলাম বুড়ো কাঁদছে। কেন জানি না মার কথা হঠাৎ মনে পড়ল।
কিন্তু কাল ভোরে আমায় উঠতে হবে। খিদে নেই বলে, বিছানায় তখনই শুয়ে পড়লাম।
পাঁচ
রেমন্ড অফিসে আমায় ফোন করলে। বললে এক বন্ধুর কাছে সে আমার কথা বলেছে। সেই বন্ধু আমায় আলজিয়ের্স শহরের বাইরে তার সমুদ্রের ধারের বাংলোতে পরের রবিবারটা কাটাতে নেমন্তন্ন করেছে।
বললাম যে যেতে পারলে আমি খুশিই হতাম, তবে রবিবারটা একজন মেয়ে বন্ধু সঙ্গে কাটাবার বলে আগেই কথা দিয়েছি।
সে তৎক্ষণাৎ জানালে যে মেয়েটিকেও আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। তার বন্ধুর স্ত্রী তাতে খুব খুশিই হবে কারণ তা না হলে দলের মধ্যে সে ছাড়া আর কোন মেয়ে থাকবে না।
আমি তখুনি ফোন নামিয়ে রাখতাম। কারণ আমার মনিব অফিসের ফোন নিজেদের কাজে ব্যবহার করা পছন্দ করেন না। কিন্তু রেমন্ড আমাকে ফোন ছাড়তে বারণ করলে। আমাকে আর একটা কথা তার বলবার আছে। সেইজেন্যই সে ফোন করেছে। নইলে নিমন্ত্রণের কথাটা বিকেলেও বলা যেত।
‘ব্যাপারটা হল এই’, সে জানালে, ‘সারা সকাল কজন আরব আমার পিছু নিয়েছে। যার সঙ্গে মারামারি হয়েছিল মেয়েটার সেই ভাইটাও তাদের মধ্যে আছে। ফেরবার সময় যদি তাকে বাড়ির কাছে ঘুরতে দেখো তো আমায় জানিয়ো।’ জনাব বললে।
ঠিক সেইসময়ে মনিব ডেকে পাঠালেন। একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। হয়তো মনিব কাজের সময় ফোনে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগাছা না করে নিজের চরকায় তেল দিতে বলবেন।
ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম কিছু নয়। 
তিনি একটা পরিকল্পনার বিষয় আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান। এখনো অবশ্য কিছু ঠিক করেন নি। প্যারিসে তিনি অফিসের একটি শাখা খুলতে চান, বড় বড় কোম্পানীর সঙ্গে কারবারে দিকে চিঠি-পত্রের দেরীটা যাতে এড়ানো যায়। আমি সেখানে কাজ নিয়ে যেতে রাজী কি না তিনি জানতে চান।
‘আপনার বয়স কম’। তিনি বললেন, ‘প্যারিসে থাকতে আপনার ভালোই লাগবে আমার বিশ্বাস। বছরে কয়েক মাস ফ্রান্সে ঘুরে বেড়াতেও পারবেন।’
যেতে আমি প্রস্তুত, তাঁকে জানালাম। কিন্তু সত্যি সত্যি যাওয়া না যাওয়া আমার কাছে সমান।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন - জীবনের যাকে একটু অদলবদল বলে তা আমার ভালো লাগে কি-না।
বললাম যে জীবনের সত্যি অদলবদল হয় না। এক জীবনের সঙ্গে আরে  জীবনের ভালোমন্দের তফাত নেই। আমার এখানকার জীবনেই আমি যে সন্তুষ্ট তাও জানালাম।
মনে হল মনিব একটু ক্ষুন্ন হলেন। বললেন ‘আমার সব কিছুতেই এলাকড়ি, কিছুতেই যেন গা নেই। বড় হওয়ার এরকম ইচ্ছে না থাকাটা একটা মহৎ দোষ - বিশেষ করে ব্যবসার কাজ যখন করি।’
নিজের কাজে ফিরে গেলাম। ওঁকে চটাতে চাই নি, কিন্তু আমার জীবনের ধারা পাল্টাবার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। সব দিক দিয়ে দেখলে মোটামুটি এমন কিছু খারাপ ত নেই। পড়াশোনা যখন করতাম তখন উনি যা বললেন সে রকম যথেষ্ট উচ্চাশা আমার ছিল। কিন্তু পড়াশোনা যখন ছাড়তে হল তখন ক দিন যেতেই বুঝলাম ও সব ভুয়ো।
মারী সেদিন বিকেলে এল। জিজ্ঞেস করলে, - আমি তাকে বিয়ে করব কি না। বললাম, আমার আপত্তি নেই। তার যদি আগ্রহ থাকে বিয়ে সেরে ফেলবে।
মারী আবার তারপর জানতে চাইলে আমি তাকে ভালবাসি কিনা।
প্রায় আগের মতোই জবাব দিয়ে বললাম যে ও প্রশ্নের কিছু মানে নাই বললেই হয়। তবে ভালো বোধ হয় আমি বাসি না।
‘তোমার তাই যদি মনে হয়, তাহলে বিয়ে করবে কেন?’ সে জিজ্ঞেস করলে।
তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, ‘ও ব্যাপারটার কোনো মূল্যই নেই। তবে সে যদি খুশি হয় তাহলে এখুনি আমাদের বিয়ে হতে পারে। কথাটা যে তার দিক থেকেই এসেছে তাও তাকে মনে করিয়ে দিলাম। আমার দিক থেকে বলতে পারি যে আমি শুধু সায় দিয়েছি।’
সে এবার মন্তব্য করল যে বিয়েটা গুরুতর ব্যাপাার।
বললাম - ‘না’।
আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে সে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর জিজ্ঞেস করলে -‘ধরো আর কোনো মেয়ে যদি তোমায় বিয়ে করতে চাইত - মানে আমার মতো তোমার পছন্দসই কোনো মেয়ে - তাহলে তুমি রাজী হতে?’
‘তা হতাম বই কী!’
এবার সে জানালে যে আমায় সত্যি ভালোবাসে কি-না সে বুঝতে পারছে না। এ বিষয়ে অবশ্য তাকে কিছু সাহায্য করতে পারলাম না। খানিক চুপ করে থেকে সে কতকটা নিজের মনেই আমি একটা অদ্ভুত মানুষ এই গোছের কি বললে। স্পষ্ট করেই তারপর জানালে, আর সেইজন্যেই বোধহয় তোমায় ভালোবাসি। তবে একদিন ঠিক ওই জন্যেই  হয়তো তোমায় ঘেন্নাও করব।’
এতে আমার বলবার কিছু নেই, তাই চুপ করেই রইলাম।
কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে সে হাসতে শুরু করলে। তারপর আমার হাত ধরে আবার জানালে যে এটা তার খেয়াল নয়, সে সত্যিই আমায়, বিয়ে করতে চায়।
‘ঠিক আছে!’ বললাম, ‘তুমি যখন বলবে তখনই বিয়ে করব।’
মনিব কিছুক্ষণ আগে যে প্রস্তাবটা করেছেন তাও তাকে জানালাম।
প্যারিসে যেতে পারলে সে খুব খুশি হবে বললে।
প্যারিসে আমি কিছুদিন ছিলাম শুনে জায়গাটা কি রকম সে জানতে চাইলে।
‘আমার ত ঘিঞ্জি গোছের লাগে। ঝাঁক ঝাঁক পায়রা আর অন্ধকার সব চবুতর। মানুষগুলোর কেমন নির্জীব ফ্যাকাশে মুখ।’
বেড়াতে বেরিয়ে বড় রাস্তাগুলো দিয়ে একবার শহরটা পার হয়ে গেলাম। রাস্তায় মেয়েদের বেশ সুশ্রী লাগছিল। তারও তাই মনে হয়েছে কি-না মারীকে কিজ্ঞেস করলাম। ‘হ্যাঁ’ বলে সায় দিয়ে সে আমার কথাটা বুঝেছে বললে। কয়েক মিনিট তারপর আর কোনো কথা হল না। তাকে ছাড়তে চাই না বলে রাত্রে ‘সিলেস্তের’ ওখানে দু জনে একসঙ্গে খাবার কথা বললাম। তাতে খুশিই হত জানিয়ে সে তার অসুবিধার কথাটা বললে। সন্ধ্যায় তার একটা কাজ আছে।
রেঁস্তোরার কাছাকাছি তখন সে পড়েছি। বললাম, ‘তাহলে চ’ল, আবার দেখা হবে।’
সে আমার চোখের দিকে চাইলে।
‘সন্ধ্যায় কি আমার কাজ জানতে চাও না?
‘জানবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু জিজ্ঞেস করার কথা ভাবি নি।’ বুঝলাম এটা একটা ক্ষোভের কারণ করে সে তুলতে চায়। আমাকে বোধ হয় একটু অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল। কারণ হঠাৎ সে হাসতে শুরু করলে। তারপর যেন অভিমানে ঠোঁট উল্টে মুখটা বাড়িয়ে দিলে চুমোর জন্যে।
একা একাই ‘সেলেস্তে’-তে গেলাম। 
সব খাওয়া শুরু করেছি এমন সময় একটু অদ্ভুত চেহারার খাটো গোছের একটি মেয়ে এসে আমার টেবিলে বসবার অনুমতি চাইলে।
‘বসতে পারি এখানে একটু ’।
‘বাঃ নিশ্চয়ই পারেন।’
মেয়েটির গোলগাল মুখটা যেন পাকা আপেলের মতো। চোখদুটো উজ্জ্বল। নড়াচড়া যেন তারের ওপর-চড়ানো কলের পুতুলের মতো থেকে থেকে হেঁচকা টানে।
ওপরের আঁট জামাটা খুলে রেখে সে এক মনে খাবারের তালিকাটা খানিক্ষণ পড়লে। তারপর ‘সিলেস্তে’-কে ডেকে অর্ডার দিলে খাবারের। তাড়াতাড়ি বললেও কথাগুলো স্পষ্ট। সব কথাই বোঝা যায়। ‘ওরদুভর’ আনবার আগে সে ব্যাগ খুলে এক টুকরো কাগজ আর পেনসিল বার করে প্রথমেই খাবারের দামগুলো লিখে যোগ দিয়ে ফেললে। আবার ব্যাগ থেকে ঠিক দামটুকর সঙ্গে কিছু বকশিসের পয়সা বার করে সে টেবিলের ওপর তার সামনে রাখলে।
ওয়েটার ‘ওরদুভ্’র নিয়ে আসতেই সে প্রায় গোগ্রাসে খেতে শুরু করলে। পরের খাবারটা তখনও আসে নি। সে এবার ব্যাগ খুলে একটা নীল পেনসিল আর রেডিওর কাগজ বার করে প্রায় সব প্রোগ্রাম-গুলোতেই দাগ দিতে লাগল। কাগজটা বারো পাতার। খাবার সময় সারাক্ষণই সে সেটায় ডুবে রইল।
আমার খাওয়া যখন শেষ তখনো সে অখন্ড মনোযোগ দিয়ে কাগজটায় দাগ কেটে যাচ্ছে।
তারপর উঠে পড়ে ওপরের জ্যাকেট - জামাটা আবার ঠিক সেই কলের পুতুলের মতো পরে নিয়ে সে দ্রুতপায়ে        রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছুই তেমন করবার নেই। তাই খানিক দূর পর্যন্ত তার পিছু পিছু গেলাম। ফুটপাতের ওপর দিয়ে সে সোজা হেঁটে যাচ্ছে। একবার ফিরে তাকাবার নাম নেই। ওইটুকু মানুষ হিসাবে হাঁটাটা খুবই তাড়াতাড়ি বলতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি আমার পক্ষে বেগটা বড় বেশী। খানিকবাদেই তাকে আর দেখতে পেলাম না। বাড়ির দিকেই ফিরলাম। কিছুক্ষণের জন্যে ওই ‘কলের পুতুল’ (আমার কাছে তাই) আমার বেশ একটু মনে ধরেছিল। ভুলে যেতে অবশ্য দেরী হল না।
বাড়িতে ঢোকবার মুখে বুড়ো সালামানোর সঙ্গে দেখা। তাকে আমার ঘরে আসতে বললাম। কুকুরটা সত্যিই হারিয়ে গেছে সে জানালে। থানার খোঁয়াড়ে সে খোঁজ করতে গেছল। কিন্তু সেখানে তাকে পায় নি। সেখানকার পুলিশে লোক বলেছে যে কুকুরটা হয়তো রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়েছে। চাপা পড়ার খবর থানায় পাওয়া যায় কি-না জিজ্ঞাসা করায় তারা বলেছে সে রাস্তার বাজে কুকুর কোথায় চাপা পড়েছে সে খবর রাখার চেয়ে দরকারী কাজ পুলিশের আছে।
সালামানোকে আরেকটা কুকুর পুষতে বললাম। তাতে সে জানালে যে এই কুকুরটা নিয়েই এতদিন সে কাটিয়েছে। এখন অন্য কুকুর আর সে রকম লাগবে না। কথাটা ঠিকই।
আমি বিছানায় পা তুলে বসেছি। সালামানো টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে আমার দিকে মুখ করে হাতদুটো হাঁটুর ওপর রেখে বসে আছে। মাথার ছেঁড়া ফেল্টেড টুপিটা সে নামায় নি। খোঁচা খোঁচা হলদে গোঁফটার আড়ালে বিড় বিড় করে বকে চলেছে।
একটু বিরক্ত করছিলাম, কিন্তু আর কিছূ করবার নেই। ঘুমও পাচ্ছে না। তাই শুধু আলাপটা চালাবার জন্যে কুকুরটার সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জানতে চাইলাম। কত দিন ধরে কুকুরটা পুষছে ইত্যাদি।
সালামানো বললে, তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই কুকুরটা পুষেছে। বিয়ে সে একটু বেশী বয়সেই করেছিল। বয়সকালে তার থিয়েটারের অভিনেতা হবার শখ ছিল। সৈনিক হিসাবে কাজ করবার সময় মাঝে মাঝে তাদের রেজিমেন্টের নাটক - টাটকের অভিনয়ে সে নেমেছে। ভালোই অভিনয় করত শুনেছে। শেষে অবশ্য সে একটা রেলের কাজ নেয়। ঠিকই করেছিল তার ধারণা কারণ এখন সামান্য একটু ‘পেনসন’ পায়।
বৌ-এর সঙ্গে তার খুব ভালো কখনো বনে নি। তবে পরস্পরকে সয়ে গেছিল। স্ত্রী মারা যাবার পর তাই তার নিজেকে বড্ড একা মনে হয়েছে। রেলের তার একজন সহকর্মী একটা কুকুরীর কটা বাচ্চা হয়েছিল। একটা বাচ্চা সে সালামানোকে দেয়। সঙ্গী হিসেবে সালামানো সেটা নিয়েছিল। প্রথমে বাচ্চাটাকে বোতলে দুধ খাওয়াতে হত। কুকুরের পরমায়ু তো কম। তাই তারা এখন দুজনেই একসঙ্গে বুড়ো হয়েছে বলা যায়।
‘বড় বদমেজাজী কুকুর ছিল।’ সালামানো বললে, ‘মাঝে মাঝে বেশ ঝগড়া লাগত আমাদের। তবে যাই বলি হতভাগার গুণও ছিল কিছু।’
বললাম, ‘কুকুরটা ভালো জাতের মনে হত।’ বুড়ো তাতে খুশি হল।

‘তবু তো অসুখের আগে তাকে দেখেন নি। কি সুন্দর লোমই ছিল গায়ে - সেইটেয় ছিল ওর আসল বাহার। সারাবার অনেক চেষ্টা আমি করেছি। ঘাগুলো হবার পর যতদিন বেঁচে ছিল রোজ রাতে গায়ে মলম ঘসতাম। কিন্তু আসলে বুড়ো হয়েছিল তো। সেটা আর সারাব কি করে।’
আমি একবার হাই তুললাম। বুড়ো উঠতে চাইল। বললাম, ইচ্ছে করলে থাকতে পারে। কুকুরটার জন্যেও দুঃখও জানালাম।
বুড়ো আমায় ধন্যবাদ দিয়ে জানালে যে আমার মাও তার কুকুরটা পছন্দ করতেন। বুড়ো যেভাবে মার নামটা করলে তাতে মনে হল মার শোকে আমি খুব অধীর হয়ে আছি। সে কথা মুখেও বললে। ব্যাপারটা তা নয় জানাতে কেমন যেন অপ্রস্তুুত ভাবে তাড়াতাড়ি বললে যে রাস্তার কেউ কেউ মাকে আতুরাশ্রমে পাঠাবার জন্যে আমার নিন্দে করে। তার নিজের অবশ্য তা ধারণা নয়। আমি যে মাকে কি ভালোবাসতাম তা সে জানে।
বললাম, - কেন যে বললাম এখনো ভেবে পাই না - যে আমার সম্বন্ধে লোকের এত খারাপ ধারণা হয়েছে জেনে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। মা-কে এখানে রাখবার সঙ্গতি না থাকলে আতুরাশ্রমে পাঠান ছাড়া আর কি করা যেতে পারে। তা ছাড়া বছরের পর বছর তিনি এখানে মুখ বুজে কাটিয়েছেন। বুঝতে পারছিলাম যে তাঁর উপযুক্ত কথা বলবার লোক না পেয়ে তাঁর কিছু ভালো লাগছে না।
‘‘তা বটে।’’ সালামানো বললে, - ‘‘আতুরাশ্রমে আর যাই হোক আলাপী জোটে।’’
শোবার সময় হয়েছে বলে সালামানো উঠে পড়ল। বললে, এখন থেকে দিন কাটানো তার পক্ষে একটু ভার হবে।
অনেকদিন তার সঙ্গে আলাপ। কিন্তু এই প্রথম সে একটু সলজ্জভাবে হাতটা বাড়িয়ে দিলে। তার কোঁকড়ানো হাতটার খোসাগুলোও যেন হাতের মধ্যে নিয়ে অনুভব করতে পারলাম।
ঠিক বেরিয়ে যাবার আগে দরজা থেকে ফিরে সে একটু করুণভাবে হেসে বললে, - ‘কুকুরগুলো আজ রাত্রে যদি আর না ডাকে। কেবলই মনে হয়, আমার কুকুরটাই বুঝি ডাকছে...’


ছয়
সে রবিবার সকালে ঘুম ভেঙে উঠতে বেশ কষ্ট হল। মারীকে তার আগে দুবার আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে নাম ধরে ডাকতে হয়েছে । সকাল সকাল জলে নামতে হবে বলে খাওয়ার হাঙ্গামা আর করলামই না। মাথাটা একটু টিপটিপ করছিল। প্রথম সিগারেট খাবার সময় মুখটা কেমন তেতো লাগল। মারী বললে, আমায় ঠিক শ্মশানযাত্রীর মত দেখাচ্ছে। শরীরটা অবশ লাগছিল সত্যিই। মারী একটা সাদা পোশাক পরেছে।  মাথার চুল খেলা। বললাম, তার মুনির মন ভোলনো চেহারা হয়েছে। খুশি হয়ে সে হেসে উঠল।
বেরুবার পথে রেমন্ডের দরজায় আমরা ধাক্কা দিলাম। সে চেঁচিয়ে জানালে এখুনি আসছে।
আমরা রাস্তায় নামলাম। শরীরটা একটু খারাপ থাকায় আর ঘরের জানলায় পর্দা নামানো ছিল বলে সকালের চড়া রোদ্দুরের ঝাঁঝটা চোখে যেন ঘুসি মারল।
মারী কিন্তু খুশিতে যেন তখন নৃত্য করছে। বারবার বলতে লাগল, - ‘কি চমৎকার দিনটা’।
খানিকক্ষণ বাদে আমারও ভালো লাগতে লাগল। মারীকে সে কথা বললাম। সে যেন কানই দিল না। অয়েল ক্লথের একটা ব্যাগ সে সঙ্গে নিয়েছে, তার ভেতর আমাদের স্নানের পোশাক আর একটা তোয়ালে পোরা।
এবার রেমন্ড তার ঘরের দরজা বন্ধ করছে শুনতে পেলাম। তারপরেই সে বেরিয়ে এল। একটা নীল ট্রাউজারের ওপর সে ছোট হাতা -সাদা শার্ট পরেছে। মাথায় স্ট্র হ্যাট। লক্ষ্য করলাম যে কনুই পর্যন্ত তার হাতে লোম বড় বেশী। তবে তার ভেতর দিয়ে গায়ের রঙ যা দেখা যাচ্ছে তা খুব ফরসা। স্ট্র হ্যাটটা দেখে মারী খিলখিল করে হেসে উঠল। আমার নিজের কিন্তু কেমন খারাপই লাগল তার এই পোশাকের বাহার। রেমন্ডের মেজাজ খুব খোশ মনে হল। সিঁড়ি দিয়ে সে শিস দিতে দিতে নেমে এসেছে। আমায় ‘‘কি দোস্ত’’ বলে সম্বোধন জানিয়ে মারীকে সে একেবারে ‘মাদামোয়াজেল’ বলে সম্মান দিলে।
আগের দিন থানায় গিয়ে আমি রেমন্ডের হয়ে সাক্ষী দিয়ে এসেছি। সেখানে বলেছি যে মেয়েটা রেমন্ডের সঙ্গে নেমকহারামি করেছে। পুলিশ তাতেই একটু ধমক দিয়ে রেমন্ডকে ছেড়ে দিয়েছে। আমার কথা আর যাচাই করে নি।
দরজায় দাঁড়িয়ে  একটু আলোচনা করে নিয়ে আমরা বাসে যাওয়াই ঠিক করলাম। যেখানে আমরা যাচ্ছি সেই সমুদ্রের তীরে হেঁটেই যাওয়া যায়। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি ততই ভালো।
বাস স্টপের দিকে রওনা হচ্ছি এমন সময় আমার জামার হাতা ধরে টেনে রেমন্ড  রাস্তার ওপারে দেখতে বললে। দেখলাম কজন আরব ছোকরা ওধারের তামাকের দোকানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের একদৃষ্টে দেখছে। দেখার ধরনটা বিশেষভাবে তাদেরই  নিজস্ব। আমরা যেন পাথরের চাঁই কি মরা গাছ।

রেমন্ড চুপি চুপি জানালে যে বাঁ দিক থেকে ধরলে দ্বিতীয় আরব ছোকরা হল তার সেই দুশমন। আমার মনে হল রেমন্ড একটু যেন ঘাবড়ে গেছে। আমাকে কিন্তু সে আশ্বাস দিলে যে ব্যাপারটা আগেই চুকে টুকে গেছে। মারী তার আগের কথাগুলো শোনেনি। ‘‘কি হয়েছে?’’ সে জিজ্ঞাসা করলে।
তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে রাস্তার ওপারের আরবগুলোর রেমন্ডের ওপর আক্রোশ আছে।
মারী তখনই আমাদের সকলকে পা চালাতে বললে। রেমন্ড এবার একটু হেসে বুকটা একটু চিতিয়ে নিলে।
মারী ঠিকই বলছে। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
বাসস্টপে যেতে অর্ধেক রাস্তায় থেমে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সে বললে যে আরবগুলো আমাদের পিছু নেয়নি। আমিও পিছন ফিরে তাকালাম। না, তারা ঠিক আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে - আমরা যেখানটায় ছিলাম সেদিকে বিনা কারণেই তাকিয়ে।
বাসে ওঠবার পর রেমন্ড মারীকে হাসাবার জন্যে নানারকম মজার কথা বলতে লাগল। তার ভয় - টয় এখন একেবারে কেটে গেছে। বুঝতে পারছিলাম যে মারীকে তার মনে ধরেছে। কিন্তু মারী তার একটা কথারও জবাব দিচ্ছিল না। মাঝে মাঝে আমার চোখে চোখ ফেলে হাসছিল শুধু।
আলর্জিয়েস শহরের ঠিক বাইরে গিয়ে নামলাম। সমুদ্রতীর বেশী দূরে নয়। শুধু একটা পাহাড়ী ঢিবি পার হতে হয়। ঢিবিটা ধাপে ধাপে সমুদ্রে বালি পর্যন্ত খাড়া নেমে গিয়েছে। এখানে জমির ওপর হলদে গোছের সব নুড়ি ছড়ানো। তার মাঝে মাঝে বুনো লিলির তুষারের মতো সাদা ফুলগুলো ফুটে আছে। পেছনে নীল আকাশের দরুন তাদের দেখাচ্ছে চমৎকার। নীল গরমের দিনে সাধারণতঃ যেমন হয় তেমনি ধাতু দিয়ে গড়া পাতের মতো একটা কঠিন দীপ্তিতে ঝলমল করছে। মারী মনের খুশিতে হাতের ব্যাগটা ফুলগুলোর গায়ে দুলিয়ে পাপড়িগুলো চারিধারে ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
এবার আমরা দুসারি কাঠের ছোট  ছোট বাড়ির মাঝখান দিয়ে চললাম। বাড়িগুলোর কাঠের বারান্দা আর সবুজ বা সাদা রঙ করা বেড়া। কোন কোন বাড়ি ট্যামারিস্ক গাছের ঝোপে প্রায় ঢাকা পড়েছে। কোন কোনটা পাথুরে জমি থেকে সোজা অনাবৃতভাবে উঠেছে। বাড়িগুলো পার হতে না হতেই সমুদ্র দেখা গেল। আয়নার মতো স্থির মসৃণ। দূরে যেন নিজেরই কালো ছায়ার ওপর তীরের একটা অংশ অন্তরীপের মতো প্রসারিত হয়ে গেছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা মোটরবোটের ক্ষীণ গুঞ্জন কানে এল। অনেক দূরে একটা জেলে নৌকো বোঝা যায় না এমন ধীরে ধীরে ঝলমলে মসৃণতার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।
মারী কয়েকটা পাহাড়ী বুনো ফুল তুলল। খাড়াই দিয়ে নামতে নামতে দেখলাম কজন এর মধ্যেই ¯নান করতে বালির ওপর জমায়েত হয়েছে।
রেমন্ডের বন্ধুর একটা ছোট কাঠের বাংলো আছে বালির চড়ার এক প্রান্তের কাছাকাছি। বাড়িটা যেন পিছনের পাহাড়ী ঢিবিতে হেলান দিয়ে আছে। সামনের দিকটা কাঠের পিলপের ওপর বসানো। সমুদ্রের জল এখনই সেখানে চাপড়াতে শুরু করেছে।
রেমন্ড তার বন্ধুর সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিলে। তার নাম মাসঁ। বেশ লম্বা চওড়া কুঁদো গোছের চেহারা। তার স্ত্রী বেশ মোটাসোটা হাসিখুশি     মহিলা । কথায় খাস প্যারিসের টান।
মাস বাংলোটা নিজের বাড়ি মনে করে আমাদের স্বচ্ছন্দ হতে বললে। সকালে সে মাছ ধরতে গিয়েছিল। দুপুরে সুতরাং মাছ ভাজার ব্যবস্থা হচ্ছে।
বাংলোটার প্রশংসা করলাম। মাস বললে ছুটির দিন আর শনি-রবিবার সে এখানে কাটায়। ‘‘অবশ্য সঙ্গে সহধর্মিনী থাকেন বলাই বাহুল্য!’’ বসে মাসঁ হাসল।
দেখলাম মাসেঁর স্ত্রী আর মারীর মধ্যে ইতিমধ্যেই বেশ ভাবসাব হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে বেশ গল্পগুজব চলেছে। এই বোধ হয় প্রথম মারীকে বিয়ে করার ব্যাপারটায় সত্যিকার একটু আগ্রহ হল।
মাসঁ তখনই সাঁতার কাটতে যেতে চাইলে। কিন্তু তার স্ত্রী ও রেমন্ডের তা ইচ্ছে নয়। তাই আমি মাঁস ও মারী এই তিনজনে মিলেই বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রে গেলাম। মারী গিয়েই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি ও মাস একটু দাঁড়িয়ে রইলাম। মাঁস কথা বলায় একটু আড়ষ্ট। কথার মাঝে মাঝে ‘আর তা ছাড়া’ - বলা তার একটা মুদ্রাদোষ দেখলাম। তাতে মানে হোক বা না হোক।
মারী সম্বন্ধে সে বললে, ‘‘ভারী সুন্দর মেয়েটি। আর তা ছাড়া সুশ্রী!’’
খানিক বাদে তার এ  মুদ্রাদোষও আর লক্ষ্য করবার মতো রইল না।
পরমানন্দে তখন রৌদ্র¯নান করছি। দেখলাম তাতে শরীরটা অনেক ভালো মনে হচ্ছে। পায়ের নীচে বালি জমে যাচ্ছে। জলে ডুব দিতে ইচ্ছে হলেও ইচ্ছেটা দু-এক মিনিট চেপে রইলাম। তারপর মাঁসকে বললাম, ‘চলুন এবার যাই’। সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিলাম।
মাস সাবধানে নামতে লাগল, তারপর ডুবজল পেরিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলে। সে ডান-হাত বাঁ হাত পর পর চালিয়ে সাঁতার কাটছিল।
আমি তাকে শিগগিরই ছাড়িয়ে মারীকে ধরে ফেললাম।
জলটা ঠান্ডা। আমার তাতে আরো ভালো লাগলো।
অনেক দূর পর্যন্ত আমরা সাঁতরে গেলাম, ---- দুজনে পাশাপাশি এক তালে যেতে বেশ লাগছিল। দুজনেরই একরকম স্ফূর্তির মেজাজ!
একেবারে দূর সমুদ্রে গিয়ে চিত হয়ে ভাসতে লাগলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুর্য যেন ঠোঁট মুখ গাল থেকে নোনা জল শুষে নিচ্ছে বুঝতে পারছিলাম। মাসকে চড়ায় ফিরে গিয়ে বালির ওপর রোদের মধ্যে থুবড়ে বসে পড়তে দেখলাম। দূর থেকে তাকে প্রকান্ড দেখাচ্ছিল ---- যেন একটা ডাঙ্গায় আটকেপড়া তিমি।
এবার মারী দুজনে মিলে জোড়া সাঁতার কাটবার কথা বললে। সে আগে আমি তার কোমর জড়িয়ে ধরে তার পেছনে। যে হাত দিয়ে জল কাটছে আর আমি পা ছুড়ে ঠেলছি।
জলের একেঘেয়ে ছল ছল শব্দ শুনতে শুনতে এক সময়ে যেন আর ভালো লাগল না। মারীকে ছেড়ে দিয়ে আমি ধীরেসুস্থে বুক ভরে দম  নিতে নিতে তীরে ফিরে গেলাম।
বালির ওপর এবার উপুড় হয়ে মাসের পাশে শুয়ে পড়লাম। বললাম, ‘‘জায়গাটা চমৎকার।’‘ মাস সায় দিল।
মারী এতক্ষণে এসে পৌঁছল। মাথা তুলে দেখলাম। তার সারা গায়ে নোনা জল চিক চিক করছে। চুলগুলো পেছনে সে ধরে আছে।
সে এসে আমার পাশেই শুয়ে পড়ল। রোদ্দুর আর দুজনের মিলিত উত্তাপে আমার যেন ঘুম ধরে এল।
খানিক বাদে আমার হাত ধরে নাড়া দিয়ে মারী বললে যে মাস বাংলোয় ফিরে গেছে। খাবার সময় হয়েছে নিশ্চয়।
বেশ খিদে পেয়েছে তাই তৎক্ষণাৎ উঠে পড়লাম। কিন্তু মারী অনুযোগ করলে যে সকাল থেকে একবারও আমি তাকে চুমু খাইনি।
কথাটা ঠিকই, যদিও অনেকবার আমার চুমু খেতে ইচ্ছে হয়েছে। 
‘‘চলো আবার জলে নামি!’ ---- বললে মারী।
দুজনে আবার দৌড়ে গিয়ে ঢেউগুলোর ওপর একটু গা ভাসিয়ে রইলাম।
তারপর একটু সাঁতরে প্রায় ডুবজলে যেতেই মারী দু হাতে আমার গলা জড়িয়ে জাপটে ধরল। তার পা-গুলো আমার পায়ের সঙ্গে জড়াচ্ছে টের পেলাম। আমার সমস্ত শরীরে কি রকম একটা শিহরণ হচ্ছে তখন।
যখন ফিরলাম, মাস তখন তার বাংলোর দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের চেঁচিয়ে ডাকছে। বললাম যে খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। সে তার স্ত্রীর দিকে ফিরে খুশি মুখে জানাল যে আমায় নাকি তার ভারি পছন্দ হয়েছে।
রুটিটা চমৎকার। মাছও যথেষ্ট খেলাম। তারপর এল মাংসের স্টেক আর আলু ভাজা। খাবার সময় আমাদের কারুর মুখেই কথা নেই। মাস মদ খেল প্রচুর, আমাকেও গেলাস খালি হতে না হতে ভরে দিতে লাগল।
কফি যখন দেওয়া হচ্ছে তখন আমার একটু নেশা নেশা লাগছিল। আমি একটার পর একটা সিগারেট খেতে লাগলাম।
মাস, আমি ও রেমন্ড তিনজনে সারা আগষ্ট মাসটা যে যার খরচা দিয়ে এইখানে কাটাব বলেও খানিক জল্পনা করলাম।
হঠাৎ মারী  বলে উঠল, ‘‘আরে! কটা বেজেছে জানো? মোটে সাড়ে এগারটা?’’
আমরা সবাই বেশ অবাক। দুপুরের খাওয়াটা একটু আগে আগেই সারা হয়েছে মাস স্বীকার করলে। তবে লাঞ্চ - ব্যাপারটার কোন সময় অসময় নেই বললেই হয়। ইচ্ছে হলেই খেতে বসা চলে।
শুনে মারী হাসতে লাগল। হাসির কি পেল এতে বুঝতে পারলাম না। বোধ হয় মারীও একটু বেশি নেশা করে ফেলেছে।
মাস জিজ্ঞাসা করলে, আমি তার সঙ্গে সমুদ্রতরীরে একটু বেড়াতে যেতে রাজী কিনা!
‘আমার স্ত্রী খাবার পরই একটু ঘুম দেন,’ সে বললে, ‘আমি দেখছি তাতে আমার শরীর খারাপই হয়। একটুখানি হেঁটে আসা আমার দরকার। ওকে বলি স্বাস্থ্যের পক্ষে সেটা ভালো। তবে যার যেমন নিজের মর্জি।’
মারী বাড়িতে থেকে বাসনপত্র ধোয়াধুয়িতে সাহায্য করবে বললে।
মিসেস মাস তাতে হেসে বললেন যে তা হলে পুরুষদের আগে তাড়ানো দরকার।
আমরা তিনজনই তাই বেরিয়ে পড়লাম।
সূর্য এখন প্রায় মাথার ওপর। জল থেকে রোদের ঝিলিকে যেন চোখ জ্বলে যায়।
বালির চড়ায় এখন কেউ নেই বললেই হয়। পেছনেই বাংলোর গুলোর ভেতর থেকে ক্ষীণভাবে ছুরি-কাঁটার ঠুনঠুন যেন শোনা যাচ্ছে। পাহাড়ের পাথরগুলো তেতে উঠেছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
রেমন্ড আর মাস যাদের কথা নিয়ে আলোচনা করছিল তাদের আমি চিনি না। বুঝলাম এদের দুজনের আলাপ অল্প দিনের নয়। দুজনে একসঙ্গেও কিছুদিন থেকেছে।
জলের ধারে গিয়ে সেইখান দিয়েই আমরা হাঁটতে লাগলাম। মাঝে মাঝে এক-একটা বড়ো ঢেউ এসে আমাদের ক্যাম্বিসের জুতো ভিজিয়ে দিতে লাগল। বিশেষ কিছুই আমি ভাবছিলাম না। খালি মাথায় ওই চড়া রোদ লেগে আমার কেমন তন্দ্রা আসছিল।
ঠিক সেই সময়ে রেমন্ড মাসকে কি যেন বললে বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ চোখে পড়ল, দুরে নীল আলখাল্লা - পরা দুজন আরব আমাদের দিকে আসছে।
রেমন্ডের দিকে চাইতেই সে মাথা নেড়ে বললে, ‘‘ঐ যে সেই।’’
আমরা সোজা এগিয়ে চললাম। কেমন করে তারা এখানে আমাদের সন্ধান পেয়েছে মাস বুঝতে পারছিল না। আমার মনে হল তারা আমাদের বাসে ওঠা আর মারীর হাতের ¯নানের ব্যাগ দেখেই বুঝেছে। মুখে কিন্তু কিছু বললাম না।
আরব দুজন ধীরে ধীরেই হাঁটছিল, কিন্তু খানিকক্ষণের মধ্যেই আমরা বেশ কাছাকাছি এসে পড়লাম।
আমরা আস্তে যাবার চেষ্টা করলাম না, তবে রেমন্ড বললে, ‘শোন, মাস, গোলমাল যদি বাধায় তাহলে তুমি ওই দু নম্বরের লোকটাকে সামলিও। আমি আমার দুশমনকেই নিয়ে পড়ব। আর তুমি ম্যুরলো প্রথমে কিছু কোরো না। বাকি লোকটা যদি এসে লাগে তা হলে হাত লাগিয়ো।
বললাম, ‘ঠিক আছে।’ মাস হাত দুটো পকেটে ভরল।
বালি তেতে যেন আগুন। যেন লাল হলকা বেরুচ্ছে মনে হচ্ছিল।
ক্রমশঃই আমরা কাছাকাছি এসে পড়ছি। কয়েক পা যখন আর আছে, তখন আরব দু’জন থামল।
মাস আর আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। শুধু রেমন্ড সোজা তার সেই দুশমনের কাছে এগিয়ে গেল। কি যেন বললে তা বুঝতে পারলাম না, কিন্তু লোকটা যেন রেমন্ডকে গুঁতোবার জন্যেই মাথাটা নুইয়েছে দেখলাম।
রেমন্ড তখুনি হাত চালিয়ে মাসকে ডাকল।
যার ওপর তার নজর ছিল মাস এগিয়ে গিয়ে তাকে সজোরে দু ঘা দিতেই সে জলের ওপর ঝাপ্টে পড়ল। তার মাথার চারিদিক থেকে তখন বুদবুদ উঠেছে।
রেমন্ড ততক্ষণ তার দুশমনকে বেদম মার দিচ্ছে। লোকটার নাকমুখ রক্তে লাল। 
রেমন্ড ফিরে তাকিয়ে বললে, ‘শুধু দেখে যাও। বেটাকে এখনো পুরো শিক্ষা দিই নি।’
‘সাবধান!’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ওর হাতে ছুরি।’
সাত
কিন্তু আর বলে লাভ নেই। লোকটা তখন রেমন্ডের হাতে ও মুখে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।
মাস লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল। জলের মধ্যে যে বসেছিল সেই আরবটা উঠে পড়ে ছুরি যার হাতে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।
আমরা আর এগুতে তখন সাহস পাচ্ছি না। লোক দুটো ছুরি দেখিয়ে শাসিয়ে একটু একটু করে আমাদের দিকে লক্ষ্য রেখে পেছুতে লাগল। এই ভাবে বেশ কিছুদূর গিয়ে পেছনে ফিরে দৌড়। আমরা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথার ওপর আমাদের কড়া রোদ।
রেমন্ডের হাত থেকে রক্ত পড়ছে। কনুই-এর ওপরটা সে সজোরে চেপে ধরে আছে।
মাস বললে কাছাকাছি একজন ডাক্তারকে হয়ত পাওয়া যেতে পারে।
প্রতি রবিবার তিনি নাকি এই খানেই কাটান।
বেশ তাঁর কাছেই চল এখুনি ---- বললে রেমন্ড। ভালো করে সে কথাই বলতে পারছিল না। মুখের কাটাটা থেকে রক্তের বুদ্বুদ বার হচ্ছিল।
দুজনে দুদিক থেকে ধরে তাকে বাংলোতে নিয়ে গেলাম। সেখানে পৌঁছোবার পর তেমন বেশী কিছু কাটে নি জানিয়ে সে নিজে হেঁটেই ডাক্তারের কাছে যেতে পারবে বললে। মারীর মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে আর মাসের স্ত্রী তো কাঁদতে শুরু করেছে।
মাস আর রেমন্ড ডাক্তারের কাছে চলে গেল। ব্যাপারটা মেয়েদের কাছে বুঝিয়ে বলবার জন্য থাকতে হল। কাজটা আমার পক্ষে রুচিকর নয়। খানিক বাদেই চুপ করে গিয়ে আমি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেতে শুরু করলাম।
প্রায় দেড়টা নাগাদ রেমন্ড মাস’র সঙ্গে ফিরে এলে। তার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ঠোঁটের কাটার ওপর একটা পটি। ডাক্তার তাকে জানিয়েছে যে ব্যাপারটা ভয়ের কিছু নয়, কিন্তু মুখখানা তার তবু বেশ ভার ভার। মাস তাকে হাসাবার চেষ্টা করলে কবার, কিন্তু তাতে ফল কিছূ হল না।’
খানিকবাদে রেমন্ড সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যেতে চাইলে। জিজ্ঞাসা করলাম ---- কোথায় যেতে চায়।
‘হাওয়া খেতে চাই’ গোছের কি যেন সে বিড় বিড় করে বললে।
মাস আর আমি তার সঙ্গে যেতে চাইলাম, কিন্তু সে রেগে উঠে আমাদের নিজের চরকায় তেল দিতে বললে।
তার মেজাজ বুঝে মাস আর পেড়াপিড়ি করা উচিত মনে করলে না। রেমন্ড বেরিয়ে যাবার পর আমি তার পিছু পিছু গেলাম। বাইরে যেন আগুনের হলকা উঠছে। বালি আর সমুদ্রের জলে প্রচন্ড রোদ যেন আগুনের কুচি হয়ে ফেটে পড়ছে।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাঁটলাম। রেমন্ড কোথায় যাবে ঠিক করেই বেরিয়েছে আমার মনে হল। হয়তো আমার অনুমান ভুল।
বালির চড়া যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা ছোট নালা বেশ বড় গোছের একটা পাথুরে ঢিবির আড়াল থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে পড়েছে। নীল আলখাল্লা পরা দুজন আরবকে সেইখানেই দেখতে পেলাম। তাদের নেহাৎ নিরীহ মনে হল। যেন মনে কোনো হিংসাই নেই। আমাদের আসতে দেখে দুজনের কাউকেই নড়তে চড়তে দেখা গেল না।
রেমন্ডের ওপর যে ছুরি চালিয়েছিল সে লোকটা কোনো কথা না বলে রেমন্ডের দিকে শুধু এক দৃষ্টে চেয়ে রইল। অন্য লোকটা আমাদের ওপর নজর রেখে একটা সরু শরের নলে ফুঁ দিয়ে ফিরে ফিরে তিনটে বাজাতে লাগল।
খানিকক্ষণ সবাই আমরা নিস্পন্দ। শুধু সেই খাঁ খাঁ রোদ আর নিস্তব্ধতার মাঝখানে জলের মৃদু কুলকুলুর সঙ্গে শরের বাঁশির তিনটে একঘেয়ে সুরের শব্দ।
রেমন্ড তারপর তার রিভলবারের পকেটে হাত দিলে। আরব দুজন তখনো চুপচাপ। যে লোকটা বাঁশি বাজাচ্ছিল তার পায়ের বুড়ো আঙুল দুটো যে অদ্ভুত রকম বাঁকানো তাও আমার নজরে পড়ল।
তার দুশমনের দিকে চোখ রেখে রেমন্ড জিজ্ঞাসা করলে, ‘দেব নাকি একটা গুলি চালিয়ে?’
তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ভেবে নিলাম। রেমন্ডের এখন যা মেজাজ তাতে বারণ করলে হয়তো আরো রেগে গিয়ে গুলি ছুঁড়েই বসবে।
তাই প্রথম যা মাথায় এল সেই কথাই তাকে বললাম।
বললাম, ‘এখনো লোকটা তোমায় কিছু বলে নি। এ অবস্থায় বিনা উত্তেজনায় গুলি মারাটা ছোটলোকের মত কাজ হবে।’
‘বেশ’ একটু চুপ করে থেকে রেমন্ড বললে, ‘তাই যদি তোমার মনে হয়, তাহলে বেটাকে একটু গালাগালি করে দেখি। জবাব কিছু দিলেই গুলি করব।’
বললাম, ‘ঠিক আছে। তবে ও ছুরি না বার করলে তোমায় গুলি করা সাজে না।’
রেমন্ড উসখুস করতে লাগল। শরের বাঁশি যার হাতে সে সমানে তখনও সেটা বাজিয়ে চলেছে। দুজনেরই নজর কিন্তু আমাদের দিকে। 
রেমন্ডকে বললাম, ‘শোনো, ডাইনের লোকটার তুমি মওড়া নাও আর রিভলভারটা আমায় দাও। অন্য লোকটা যদি গোলমাল কিছু বা ছুরি খোলে তাহলে আমি গুলি করব।’
রেমন্ড রিভলভারটা আমার হাতে দেবার সময় রোদে সেটা ঝিকমিক করে উঠল।
কারুর এখনও কোনো নড়বার চড়বার লক্ষণ নেই। যেন চারিদিক থেকে সব কিছু আমাদের চেপে ধরে নিষ্পন্দ করে দিয়েছে। আমরা শুধু নীরবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছি। রোদের আলো আর সমুদ্র, জলের কুলুকুলু আর বাঁশির আওয়াজের দুই নিস্তব্ধতার মাঝখানে এই বালির চড়াটুকুর ওপর সমস্ত সৃষ্টি যেন স্থির হয়ে গেছে।
ঠিক তখনই আমার মনে হল যে ইচ্ছে হলে গুলি করাও যায় আবার নাও করা যায়, আর করা বা না করা দুই একেবারে সমান।
তারপর হঠাৎ এক মিনিটে আরব দুজন একেবারে উধাও। গিরগিটির মত তারা কখন চক্ষের নিমেষে পাথরগুলোর আড়ালে সরে পড়েছে।
রেমন্ড আর আমি এবার ফিরে চললাম। রেমন্ডকে আগের চেয়ে অনেক খুশি মনে হল। সে তখন ফেরবার বাস ধরবার কথা বলছে।
বাংলোতে পৌঁছে রেমন্ড তৎক্ষণাৎ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভেতরে  চলে গেল। আমি কিন্তু নিচের ধাপেই থেমে দাঁড়ালাম। রোদের কড়া আলো যেন মাথার ভেতর মুগুর পিটছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে মেয়েদের আপ্যায়িত করবার মত আলাপ জমাবার তখন আমার উৎসাহ নেই।
কিন্তু রোদের তাত এতো বেশী যে ওখানে ওই চোখ-ধাঁধানো আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর। দাঁড়ান কিংবা চলে যাওয়া, দুই-ই প্রায় সমান। খানিকক্ষণ বাদে বালির চড়াতেই ফিরে গিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করলাম।
যতদূর চোখ যায় সেই এক গনগনে রোদের ঝাঁঝ। ছোট ছোট ঢেউগুলো যেন ছটফটিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তপ্ত বালিতে জিভ বুলোচ্ছে। বালির চড়ার প্রান্তে পাথুরে ঢিবিটার দিকে আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। মনে হচ্ছিল রোদে আমার রগ দুটো যেন ফুলে উঠেছে। দুদিক থেকে চাপ দিয়ে আমায় যেন আর এগুতে দেবে না। এক একবার রোদের হলকা আমার মুখে লাগে আর দাঁতে দাঁত চেপে প্যান্টের পকেটে হাত দুটো মুঠো করে আমি প্রাণপণে রোদে ঝিমঝিম করা মাথাটা ঠিক রাখবার চেষ্টা করি। বালির ওপর কোথাও কোনো ঝিনুকের কুচি কি কাঁচের টুকরো থেকে রোদের তীক্ষè ঝিলিক চোখে লাগলে জেদ আমার আরো যেন বেড়ে যায়। হার আমি কিছুতেই মানব না। সামনে আমি হেঁটে চলি।
খানিক বাদে বালির চড়ার প্রান্তে কালো পাথুরে ঢিবিটা দেখা গেল। ঢেউয়ের ছিটে আর ঝকঝকে আলোর পাত দিয়ে যেন সেটা ঘেরা। আমি কিন্তু তার পেছনের সেই ঠান্ডা স্বচ্ছ জলের ধারার কথাই ভাবছিলাম, চাইছিলাম তার স্রোতের কলুকুলু আওয়াজটুকু আবার শুনতে। এই রোদের ঝাঁঝ আর মেয়েদের পানসে চোখ, সব কিছু থেকে রেহাই চাই সেই পাথুরে ঢিবিটুকুর ছায়ায়, সেখানকার শীতল স্তব্ধতায়।
কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম রেমন্ডের দুশমন সেই আরব আবার ফিরে এসেছে। এবার সে একাই মাথার পিছনে হাত রেখে চিত হয়ে শুয়ে আছে। মাথাটা তার ঢিবির ছায়ায়, বাকি শরীরটা রোদে। গরমে তার আলখাল্লা থেকে ভাপ উঠছে দেখলাম।
তাকে দেখে একটু চমকেই গেলাম। আমার কেমন ধারণা হয়েছিল ব্যাপারটা চুকে গেছে। আসবার পথে তাই এ বিষয়ে কিছুই ভাবি নি।
আমায় দেখে লোকটা একটু মাথা তুলে তাকিয়ে পকেটে হাত দিলে। আমিও অবশ্য কোটের পকেটে রেমন্ডের রিভলভারটা চেপে ধরলাম। লোকটা তারপর আবার শুয়ে পড়ল। হাতটা কিন্তু‘ তখনও তার পকেটে।
আমি অন্তত দশ গজ দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। ঝাঁ ঝাঁ রোদের হলকায় লোকটা আমার চোখে যেন ঝাপসা একটা কালো ছায়ার মত কাঁপছিল। আধ-বোজা চোখের পাতার ভেতর থেকে তার জ্বলন্ত দৃষ্টি কিন্তু মাঝে মাঝে টের পাচ্ছিলাম। ঢেউয়ের শব্দ তখন দুপুরের চেয়ে আরো অলস ও মৃদু হয়ে এসেছে। কিন্তু রোদের ঝাঁজ কমে নি। পাথুরে ঢিবি পর্যন্ত বিছানো লম্বা বালির চড়ার ওপর সে রোদ যেন হিংস্রভাবে ঘা দিচ্ছে। দু ঘন্টার ভেতর সূর্য একটু নড়েছে বলে মনে হয় না। গলানো লোহার সমুদ্রে তা যেন স্থির হয়ে আছে। অনেক দূরে সাগর -দিগন্তে একটা জাহাজ যাচ্ছে। লোকটার-দিকে কড়া নজর রেখেও চোখের কোণ দিয়ে চলন্ত জাহাজের সেই ছোট্ট কালো রেখাটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম।
মনে হল ফিরে দাঁড়িয়ে এখান থেকে চলে গিয়ে ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেলেই তো হয়।
কিন্তু রোদের উত্তাপে স্পন্দমন সমস্ত বালির চড়াটা যেন পেছন থেকে আমার ঠেলছে।
জলের ধারাটার দিকে আমি কয়েক পা এগিয়ে গেলাম, আরবটা নড়ল না। আমাদের দুজনের মধ্যে এখনো বেশ খানিকটা তফাৎ। মুখের ওপর ছায়া পড়ার জন্যেই বোধ হয় মনে হল যে যেন আমার দিকে চেয়ে মুখ বেঁকিয়ে হাসছে।
আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম। রোদের তাতে আমার মুখ ঝলসে যাচ্ছে। চোখের ভুরুতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মা-র শেষ কাজের সময় যে রকম গরম পেয়েছিলাম, এও ঠিক সেই রকম। সেই রকম বিশ্রীই আমার লাগছিল - বিশেষ করে মনে হচ্ছিল কপালের শিরাগুলো চামড়ার ভেতর থেকে কেটে বেরিয়ে আসবে।
আর সহ্য করতে না পেরে এক পা এগিয়ে দাঁড়ালাম। এক পা এগিয়ে দাঁড়াবার অবশ্য কোনো মানেই হয় না। দু এক গজ গিয়ে তো আর রোদ এড়ানো যাবে না তবু সেই এক পা, সেই একটি মাত্র পা এগিয়ে গেলাম, আর আরবটা তার ছোরা বার করে রোদের আলোয় আমার দিকে তুলে ধরলে।
ইস্পাতের ছোরা থেকে আলোর একটা ঝিলিক উঠে মনে হল আমার কপালে একটা লম্বা সরু ফলা বিঁধে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ভুরুর ওপর ঘাম যা বসেছিল সব দুচোখের পাতার ওপর ঝরে পড়ে একটা তপ্ত পাতলা পর্দায় তাদের ঢেকে দিলে। সেই নোনা ঘাম আর চোখের জলের আবরণে দৃষ্টি তখন আমার অন্ধ। শুধু মাথার মধ্যে সূর্যের প্রচন্ড করতাল বাজছে টের পাচ্ছি, আর তার চেয়ে অস্পষ্টভাবে মনে হচ্ছে যেন ছোরা থেকে ঝলকে-ওঠা আলোর তীক্ষè ফলা আমার চোখের পাতাগুলো চিরে চোখের তারার মধ্যে বিঁধে যাচ্ছে।
তারপর আমার চোখের ওপর সব কিছু দুলতে লাগল। সমুদ্র থেকে একটা জ্বলন্ত দমকা হাওয়া ছুটে এল আর আকাশটা এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত চিঁড় খিয়ে দু ফাঁক হয়ে গেল আর সেই ফাটলের ভেতর দিয়ে বিরাট একটা আগুনের স্রোত নেমে এল। আমার শরীরের সমস্ত স্নায়ু যেন ইস্পাতের স্প্রিং হয়ে গেছে। পিস্তলটা তখন শক্ত মুঠোয় চেপে ধরেছি। পিস্তলের ঘোড়াটা ছুঁটে গেল। হাতের তেলোতে বাঁটের মসৃণ তলার দিকটার ধাক্কা টের পেলাম। আর সেই চাবুকের মত ক্ষিপ্ত আওয়াজের সঙ্গে সব কিছু শুরু হয়ে গেল। ঘাস আর আলোর জড়ানো আবরণ আমি নাড়া দিয়ে ঝেড়ে ফেললাম। এই দিনটিতেই এই বালির চড়ার যে বিশাল শান্তি আমায় অমন তৃপ্তি দিয়েছে তা যে ভেঙে আমি চুরমার করে দিয়েছি আমি জানি। কিন্তু তবু আরো চারবার, সেই অনড় দেহটায় আমি গুলি করলাম। গুলিগুলো চোখে দেখার মত কোনো চিহ্ন যেন রেখে গেল না। 
পর পর প্রত্যেকটি গুলি বুঝি আমার সর্বনাশা নিয়তির দরজায় করাঘাত করছে।


আট
গ্রেফতার হবার পরই কয়েকবার আমায় জেরা করা হয়। কিন্তু সেসব শুধু মামুলি প্রশ্ন, আমার পরিচয় ইত্যাদি জানবার জন্যে।
প্রথমবার যখন থানায় আমার জবানবন্দী নেওয়া হয় তখন মনে হয়েছিল এ মামলায় কারুর যেন কোন আগ্রহ-ই নেই। এক হপ্তা বাদে দ্বিতীয়বার ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে যখন আমায় নিয়ে যাওয়া হল তখন কিন্তু তিনি যেন বিশেষ একটা আগ্রহ নিয়ে আমায় লক্ষ্য করছেন মনে হল।
অন্যদের মত-ই তিনি প্রথমে আমার নাম ধাম কি কাজ করি কোথায় কখন জন্মেছি এই সব জিজ্ঞেস করলেন। তারপর জানতে চাইলেন আমি কোন উকিল দিয়েছি কিনা। বললাম, - না তা দিই নি। এ সম্বন্ধে কিছু আমি ভাবিও নি। উকিল দেওয়া দরকার কিনা জিজ্ঞেস করলাম।
‘এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছ? ম্যাজিস্ট্রেট বললেন।’
উত্তরে বললাম যে আমার মামলা খুব সোজা বলেই আমার ধারণা। তিনি তাতে হাসলেন। বললেন, ‘তোমার কাছে সহজ মনে হতে মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের আইন মাফিক বিচার করতে হবে। তুমি যদি কোন উকিলকে না লাগাও, আদালত থেকেই তোমার জন্যে একজন উকিলের ব্যবস্থা করতে হবে।’
সরকার যে এ সব দিকেও দৃষ্টি দেন এ ব্যবস্থা আমার ভালো লাগল। ম্যাজিস্ট্রেটকে সে কথা জানালাম। ম্যাজিস্ট্রেট সায় দিয়ে বললেন - বিচারের আইন-কানুনে খুঁত ধরবার কিছু নেই।’’
গোড়ায় ব্যাপারটা আমার কাছে তেমন গুরুতর বলে মনেই হয় নি। যেখানে আমার জবানবন্দী নেওয়া হচ্ছিল সেটা সাধারণ একটা বসবার ঘরের মত। জানালায় পর্দা দেওয়া। ডেস্কের ওপর একটি মাত্র ল্যাম্প। যে কেদারায় আমায় বসান হয়েছিল আলোটা তার ওপরই পড়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের নিজের মুখটা ছিল অন্ধকারে।
এ ধরনের দৃশ্যের বর্ণনা আমি বইয়ে পড়েছি। প্রথমে ব্যাপারটা ছেলেমানুষী বলে মনে হচ্ছিল। কথাবার্তা শেষ হবার পর আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। বেশ লম্বা মানুষ। সুপুরুষ বলা যায়। বসা নীল চোখ, পাকা লম্বা গোঁফ আর মাথায় একেবারের তুষারের মত সাদা এক রাশ পাকা চুল। তাঁকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলেই মনে হল। সবসুদ্ধ লোকটিকে ভালোই লাগে। শুধু একটা ব্যাপারে একটা ধাক্কা খেতে হয়। তাঁর মুখটা থেকে থেকে কেমন বিশ্রীভাবে বেঁকে যায়। কোনরকম স্নায়বিক কাঁপুনি বোধ হয়। তিনি যখন যাবার জন্যে উঠলেন আমি প্রায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে ফেলেছিলাম। ঠিক মুহূর্তে মনে পড়ল যে আমি একজনকে খুন করেছি।
পরের দিন আমার জেলের কুঠুরিতে একজন উকিল এলেন। ছোট্টা খাট গোলগাল কমবয়েসী মানুষটি। মাথার কালো চুল সযতেœ পাট করা। এই গরমেও তিনি আট-সাঁট করা কলার -এর সঙ্গে কালো পোষাক পরে এসেছেন। শাদা কালো ডোরা কাটা গলার টাইটা বেশ বাহারে। আমার গােেয় শুধু হাতাগুটোন সার্ট।
খাটের ওপর ব্রীফ কেসটা রেখে তিনি নিজেই নিজের পরিচয় নিয়ে জানালেন যে আমার মামলার সমস্ত বিবরণ তিনি খুব মন দিয়ে পড়েছেন। ব্যাপারটা তাঁর মতে সাবধানে সামলান দরকার। তবে তাঁর পরামর্শ মত চলালে আমার ছাড়া পাওয়া শক্ত হবে না। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম।
‘ভালো! এবার তাহলে আসল কাজে নামা যাক’, বলে তিনি বিছানার ওপর বসলেন। তারপর জানালেন যে আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়া চলছে। আমার মা যে সম্প্রতি আতুরাশ্রমে মারা গেছেন তা ওরা জানে। মারেঙ্গোতে তদন্ত করা হয়েছে আর পুলিশ শুনেছে যে মার শেষকৃত্যের  সময় আমি নাকি অত্যন্ত অগ্রাহ্যের ভাব দেখিয়েছি।
‘বুঝতেই পারছেন’, উকিল বললেন, ‘যে এরকম একটা ব্যাপার নিয়ে আপনাকে জেরা করা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ গুরুতর আর ওই নির্বিকার অগ্রাহ্যের ভাব বলতে যা ওরা বোঝাচ্ছে তা যদি আমি কাটিয়ে দিতে না পারি তাহলে আপনার হয়ে ওকালতি করতে বেগ পেতে হবে। এই বিষয়ে আপনি, শুধু আপনিই আমায় সাহায্য করতে পারেন।’
আমি সেই বিশেষ দিনটিতে দুঃখ পেয়েছিলাম কিনা তিনি একবার জানতে চাইলেন। প্রশ্নটা আমার কাছে সত্যি অদ্ভূত লাগল। এরকম কথা কাউকে জিজ্ঞেস করতে আমার তো খুবই অস্বস্তি লাগত।
বললাম যে ইদানিং কখন কি মনে হয় বা না হয় তা লক্ষ্য বড় একটা করি না। তাই কি উত্তর দেব ঠিক ভেবে পাচ্ছি না। মাকে যে বেশ ভালবাসতাম একথা সত্যি, কিন্তু এ কথার তেমন কিছু তাৎপর্য বোধ হয় নেই। একটু ভেবে বললাম যে সাধারণ সব মানুষই বোধ হয় কোনো না কোনো সময়ে যাদের ভালবাসে, কমবেশী তাদের মৃত্যু কামনা করে।
উকিল বেশ একটু বিচলিতভাবে আমায় বাধা দিয়ে বললেন ‘মামলার সময় বা এখন যিনি পরীক্ষা করছেন সেই ম্যাজিেেস্ট্রটের কাছে খবরদার যেন এরকম কোনো কিছু বলবেন না। আমায় কথা দিন।’
তাঁকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে সেই কথাই দিলাম। কিন্তু সেই সঙ্গে বুঝিয়ে বললাম যে আমার মন মেজাজ আমার শরীর কি রকম থাকে না থাকে তার ওপর সব নির্ভর করে। যেমন মা-র শেষকৃত্যের দিন ক্লান্তিতে আমার কেমন একটা আচ্ছন্ন অবস্থা হয়েছিল। কি হচ্ছে না হচ্ছে, ভালো করে টেরই যেন পাই নি। তবে এটুকু তাঁকে জানাতে পারি যে মা না মারা গেলেই ভালো হত বলে আমার মনে হয়।
উকিলকে তবু যেন অসন্তুষ্ট মনে হল। সংক্ষেপে বললেন, ওইটুকু যথেষ্ট নয়।’
খানিক কি ভেবে নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে সেদিন আমার মনের ভাব আমি চেপে রেখেছিলাম একথা তিনি বলতে পারেন কি না।
‘না’, জবাব দিলাম, ‘সেটা ঠিক সত্য হবে না।’
তিনি কেমন অদ্ভূত ভাবে আমার দিকে তাকালেন, আমি যেন ঘৃণ্য গোছের কিছু। তারপর প্রায় বিরূপ স্বরেই বললেন যে আতুরাশ্রমের পরিচালক ও কয়েকজন কর্মীকে সাক্ষী হিসাবে ডাকাতেই হবে।
- তাতে আপনার বেশ ক্ষতি হতে পারে, বলে তিনি বক্তব্য শেষ করলেন।
আমি বলতে গেলাম যে আমার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ তার সঙ্গে মার মৃত্যুর কোন সম্পর্কই নেই। তিনি তাতে শুধু বললেন, যে আমার এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে আইন আদালতের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় কখনো হয় নি।
খানিক বাদে বেশ বিরক্ত মুখেই তিনি চলে গেলেন। মনে হচ্ছিল তিনি আর একটু থাকলে ভালো হত। তাহলে হয়তো তাঁকে বোঝাতে পারতাম যে আমার হয়ে আরো ভালো ওকালতি করবার জন্যে নয়, বরং বলা যায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাঁর সহানুভূতি আমি চাইছিলাম। বুঝতে পারছিলাম যে তাঁর মেজাজ আমি খিচড়ে দিয়েছি। আমাকে তিনি ঠিক বুঝতে পারেন নি আর তাইতেই তিনি বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। দু একবার ইচ্ছে হয়েছিল বলি যে আমি আর সকলের মতই নেহাৎ সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হত না বোধ হয়। তাই কতকটা উৎসাহের অভাবেই কিছু আর বলি নি।
সেই দিনই পরে আবার আমায় ম্যাজিস্টেটের কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। বেলা তখন দুটো। ঘরটা তখন আলোয় আলো। জানলায় মাত্র পাতলা একটা পর্দা ঝোলান - অসহ্য গরম।
আমায় বসতে বলে ম্যাজিস্ট্রেট অত্যন্ত ভদ্রভাবে জানালেন যে, ‘অপ্রত্যাশিত কারণে’ আমার উকিল উপস্থিত থাকতে পারছেন না সুতরাং তাঁর প্রশ্নের জবাব আমার উকিল না আসা পর্যন্ত আমি ইচ্ছে করলে না দিতে পারি।
বললাম যে আমার জবাব আমি নিজেই দিতে পারব।
ম্যাজিস্ট্রেট একটা টেপা ঘন্টা বাজালেন। একজন কেরানী এসে ঠিক আমার পিছনে বসল। তারপর আমি ও ম্যাজিস্ট্রেট নিজেদের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসবার পর পরীক্ষা শুরু হল।
ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমেই মন্তব্য করলেন যে আমি অত্যন্ত চাপা ও আত্মসর্বস্ব লোক বলে অনেকের ধারণা। এ-বিষয়ে আমার কিছু বলবার থাকলে তিনি শুনতে চান।
বললাম, ‘দেখুন আমার বলবার কথা কিছু একটা বড় থাকে না, তার জন্যেই সাধারণত চুপ করে থাকি। আগের বারের মত তিনি একটু হেসে স্বীকার করলেন যে কারণটা সঙ্গত বটে। - যাই হোক ওতে কিছু আসে যায় না বলে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি হঠাৎ সামনে ঝুঁকে পড়ে আমার চোখে দিকে চেয়ে একটু গলা চড়িয়ে আবার বললেন, আপনার সত্যিকার কৌতুহল আপনার নিজের সম্বন্ধে।’
তিনি কি বলতে চাইছেন ঠিক বুঝতে না পেরে কোনো জবাব দিলাম না।
তিনি আবার বললেন, ‘ আপনার এই অপরাধের ব্যাপারে কয়েকটা জিনিস আমার কাছে দুর্বোধ্য। আশাকরি সেগুলো আমায় বুঝতে দিতে সাহায্য করবেন।’
ব্যাপারটার মধ্যে জটিল কিছু নেই বলায় তিনি সেদিন যা যা আমি করেছি তার বিবরণ চাইলেন। আমি অবশ্য প্রথম পরীক্ষার সময়েই সংক্ষেপে তাঁকে সব কথাই বলেছি - রেমন্ড, বালির চড়া আমাদের সাঁতার কাটা, মারামারি , তারপর আবার চড়ায় আসা আর পাঁচবার গুলি করার কথা।
তবু আবার সব কিছুই তাঁকে বললাম। থেকে থেকে ‘ঠিক! ঠিক!’ বলে তিনি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেলেন। বালির ওপর এলিয়ে পড়া লাশটার কথা বলতে তিনি আরো জোরে মাথা নেড়ে বললেন ‘আচ্ছ! আচ্ছা!’
একই গল্প দুবার বলে আমি তখন থেকে হাঁপিয়ে গেছি। মনে হচ্ছিল জীবনে কখনো এত কথা বলি নি।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন যে আমাকে তিনি সাহায্য করতে চান কারণ আমার সম্বন্ধে তাঁর কৌতুহল । ভগবানের দয়ায় আমার এই বিপদে কিছু উপকার তিনি করতে পারবেন আশা করেন। তবে আরো কয়েকটা কথা তিনি আমায় জিজ্ঞেস করতে চান।
সরাসরি তিনি এবার জানতে চাইলেন, আমি মাকে ভালবাসতাম কিনা।
বললাম, ‘হ্যাঁ বাসতাম। যেমন সবাই বাসে।’
আমার পেছনে বসে যে কেরানী একভাবে টাইপ করে যাচ্ছি সে হঠাৎ থেমে গিয়ে টাইপ মেশিনের রোলারটা টেনে পিছয়ে দিয়ে কি যেন কাটাকাটি করলে। হয়ত ভুল কোনো চাবিতে তার হাত পড়ে গিয়েছিল।
এর পর প্রায় অসংলগ্ন ভাবেই ম্যাজিস্ট্রেট আরেকটা প্রশ্ন করলেন ‘পর পর পাঁচবার গুলি করেছিলেন কেন?’
একটু ভেবে নিয়ে বললাম যে, ঠিক পর পর গুলি করি নি। প্রথম গুলির পর একটু থেকে আর চারবার গুলি করি।
- প্রথম গুলির পর থেমেছিলেন কেন?
আবার যেন চোখের সামনে সব কিছু ভেসে উঠল। বালির চড়ার সেই গনগনে তাত, চোখ মুখ ঝলসানো সেই হলকা। এবার কোন জবাব দিলাম না।
নিস্তব্ধ মুহূর্তে ম্যাজিস্ট্রেটকে যেন অস্থির মনে হল। একবার চুলের ভেতর দিয়ে আঙ্গুল চালালেন, একবার বসলেন, একটু উঠে আবার বসে পড়লেন। শেস পর্যন্ত টেবিলের ওপর দুই কনুইয়ের ভর দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে অদ্ভুতভাবে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু কেন? যে লোকটা পড়ে গেছে তার ওপর পর পর গুলি চালিয়ে গেলেন কেন?’
এবারও কোন উত্তর দিতে পারলাম না।
ম্যাজিস্ট্রেট কপালের ওপর ডান হাতটা একবার বুলিয়ে নিয়ে ভিন্ন স্বরে এবার বললেন,‘আমি জানতে চাইছি কেন আপনি ওরকম করেছিলেন? আপনাকে বলতেই হবে।’
তবু চুপ করে রইলাম।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে পেছনের দেওয়ালে দাঁড় করানো ফাইল রাখবার দেরাজটার কাছে তিনি এগিয়ে গেলেন। একটা ডালা টেনে তা থেকে রূপোর একটা ক্রুশ বার করে তিনি সেটা দোলাতে দোলাতে আবার টেবিলে ফিরে এলেন।
‘এটা কি আপনি জানেন?’ তাঁর গলা তখন একেবারে বদলে গেছে।, আবেগে তা কম্পমান।
বললাম, ‘নিশ্চয় জানি।’
তাঁর কথা এই থেকেই শুরু হয়ে গেল। এক নিঃশ্বাসে যেন তিনি বলে যেতে লাগলেন তাঁর যা বলবার। বললেন যে, ঈশ্বরে তিনি বিশ্বাস করেন। অতি বড় পাপীও ঈশ্বরের ক্ষমা পেতে পারে বলে তাঁর ধারণা। কিন্তু তার জন্যে অনুতাপ করা চাই। শিশুর মত সরল বিশ্বাস ও নির্ভরতা চাই। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে তিনি ক্রুশটি আমার চোখের সামনে নাড়ছিলেন।
সত্যি কথা বলতে কি তাঁর সব কথা ঠিক মত বুঝতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। প্রথমতঃ কামরাটা এত গরম যে দম বন্ধ হয়ে যায়। বড় বড় মাছি তার ওপর চারদিকে ভনভন করতে করতে মাঝে মাঝে আমার মুখে গালে এসে বসছিল। তা ছাড়া তাঁকে দেখে কেমন যেন ভয় করছিল এখন।
অপরাধী যখন আমি নিজে তখন অবশ্য এ রকম মনের ভাব হওয়াটা যে অন্যায় তা বুঝতে পারছিলাম।
ম্যাজিস্ট্রেটের কথা তাই যথাসাধ্য বোঝবার চেষ্টা করলাম। তাঁর কথায় যা বুঝলাম তা এই প্রথমবার গুলি করার পর দ্বিতীয় গুলি চালাবার আগে কেন আমি থেমেছিলাম আমার স্বীকারোক্তিতে এইটুকুর মানে পাওয়া একান্ত দরকার। অন্য সবকিছুর কথা বলতে গেলে এক রকম অর্থ পাওয়া যায়, শুধু এই ব্যাপারটিই তাঁর কাছে পরিষ্কার নয়।
এই সামান্য ব্যাপারটার ওপর অত জোর দেওয়া উচিত নয় এইটিই তাঁকে এবার বোঝাতে গেলাম কিন্তু আমার কথা শেষ হবার আগেই তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কিনা।
না, বলে জবাব দিতেই তিনি অপ্রসন্নভাবে চেয়ারে বসে পড়লেন।
‘তা হতেই পারে না।’ তিনি এবার আমায় বোঝাতে চেষ্টা করলেন। বললেন যে যারা ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করে তারাও তাঁকে মানে। এ-বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহই নেই। সন্দেহ কখনো হলে তাঁর জীবনেরই কোনো মানে থাকবে না।
‘আপনি কি চান যে আমার জীবনের কোনো অর্থ না থাকে?’  ম্যাজিস্ট্রেট বিক্ষুব্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
আমার চাওয়া না চাওয়ার কি সম্পর্ক এ - বিষয়ের সঙ্গে থাকতে পারে বুঝতে পারলাম না। তাঁকেও তাই বললাম।
আমার কথার মধ্যেই ত্র“শটা আমার মুখের কাছে বাড়িয়ে ধরে তিনি চীৎকার করে উঠলেন, আমি     অন্ততঃ খ্রীষ্টান আর তোমার পাপের জন্য যেন তিনি তোমায় ক্ষমা করেন এই প্রার্থনাই আমি করব।’
বেচারা ছোকরা বলে আমায় সম্বোধন করে তিনি তারপর বললেন, ‘যীশু যে তোমার জন্যেই যন্ত্রণা সয়েছেন এ তুমি বিশ্বাস না করে পারো ?’
‘বেচারা ছোকরা’ বলবার সময় তাঁর গলার সত্যিকার আকুলতটা লক্ষ্য করলাম, কিন্তু তখন আর আমার কিছু ভালো লাগছে না। ঘরটা ক্রমশই আরো গরম হয়ে উঠেছিল।
কারুর আলাপের দিক ধরে গেলে যা সাধারণত আমি করি এখনও তাই করলাম। তাঁর কথায় সায় দিয়ে ফেললাম। অবাক হয়ে দেখলাম তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘দেখলে! দেখলে! এখনও কি মানো না যে তাঁর ওপর তোমার বিশ্বাস ও নির্ভরতা আছে।’
বোধ হয় মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়েছিলাম, কারণ তিনি যেন হতাশভাবে চেয়ারে এগিয়ে বসে পড়লেন।
কিছুক্ষণ টাইপরাইটারের শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো আওয়াজ নেই। আমাদের মৌনতার ফাঁকটুকুতে টাইপরাইটার যেন শেষ মন্তব্যের নাগাল ধরে নিলে।
ম্যাজিস্ট্রেট এবার কেমন করুণ অথচ একাগ্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।
‘সারা জীবনে তোমার মত এমন পাথরের মত অসাড়-হয়ে যাওয়া কাউকে আমি দেখিনি। চাপা গলায় তিনি বললেন, য়ে সব অপরাধী আমার কাছে এসেছে, সবাই তারা যীশুর যন্ত্রণার এই প্রতীক দেখে কেঁদেছে।
বলতে যাচ্ছিলাম যে তারা অপরাধী বলেই কেঁদেছে। কিন্তু তখনই মনে পড়ল যে আমি নিজেও তাই। কি জানি কেন নিজের সম্বন্ধে ওই ধারণাটা মনকে মানাতে পারি নি।
আমাদের সাক্ষাৎকার শেষ হয়ে গেছে বোঝাবার জন্যে ম্যাজিস্ট্রেট এবার উঠে দাঁড়লেন। আগেকার মতই ক্লান্ত স্বরে আমাকে শেষবার প্রশ্ন করলেন, যা করেছি তার জন্যে আমি অনুতপ্ত কিনা।
একটু ভেবে নিয়ে বললাম যে আমার মনের অনুভূতিতে অনুতাপের চেয়ে কি রকম একটা বিরক্তির ভাবই যেন বেশী। এর চেয়ে আর কোনো ভালো শব্দ পেলাম না। কিন্তু তিনি যেন ঠিক বুঝতে পারলেন না। 
সে দিনের পরীক্ষা ওইখানেই শেষ হল।
তারপর আরেকবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত হতে হয়েছে। তবে আমার উকিল প্রত্যেকবারই সঙ্গে ছিলেন। এসব পরীক্ষায় আমায় আগের বিবরণ বিশদ করতেই শুধু ডাকা হয়েছে। কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট ও উকিল আইনের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সে সময় আমাকে যেন কেউ লক্ষ্যই করতেন না।
যাই হোক পরীক্ষার ধরণ ক্রমশ বদলেই যাচ্ছে দেখলাম। আমার সম্বন্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের সে কৌতূহল আর নেই। মামলা সম্বন্ধে তিনি যেন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন। ঈশ্বরের কথা আর তিনি বলেন নি তারপর, প্রথম সাক্ষাতের সময় যাতে অত অস্বস্তিবোধ করেছিলাম সেই ধর্মের উচ্ছাসও দেখান নি। ফলে আমাদের সম্পর্কটা যেন আরো প্রীতির হয়ে উঠেছে। কিছু জিজ্ঞাসাপত্রের পর উকিলের সঙ্গে একটু আলাপ করে ম্যাজিস্ট্রেট পরীক্ষা শেষ করে দেন। মামলা যথারীতি এগুচ্ছে এই হল তাঁর বক্তব্য। কখনো কখনো সাধারণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ও আমার উকিল আমাকেও তাতে যোগ দিতে উৎসাহ দেন। আমি আগের চেয়ে অনেক সহজ হতে পারছি। এসব আলোচনার সময় ওঁদের দুজনের কাউকেই আমার প্রতি বিন্দুমাত্র বিরূপ মনে হয় না। সব কিছু এমন মসৃণ সৌজন্যের সঙ্গে সারা হয় যে ধারণাটা বিসদৃশ হলেও আমার মনে হয়, আমি যেন ওঁদের পরিবারেরই একজন।
অকপট ভাবেই বলছি যে এগারো মাস ধরে ওই পরীক্ষার সময় ওঁদের সঙ্গ পাওয়ায় এমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষাৎকার শেষ হবার পর আমায় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যে ক’টিবার পিঠ চাপড়ে ‘নাস্তিক হে, আজ তাহলে এই পর্যন্ত!’ বলেছেন সেই বিরল মুহূর্তগুলির চেয়ে আর কিছু কখনো বেশী ভাল লেগেছে যেন ভাবতেই পারি না।
পরীক্ষার পর আবার জেলের লোকের হাতেই আমায় দেওয়া হত। 
কয়েকটি বিষয়ে কথা বলার প্রবৃত্তি কোনো কালেই আমার হয় নি। জেলে আসবার কয়েকদিন পরে মনে হয়েছিল যে আমার জীবনের এই অধ্যায়টাও সেইরকম একটা বিতৃষ্ণাজনক ব্যাপার।
কিন্তু কিছুদিন কাটবার পর মনে হল এই বিতৃষ্ণার কোনো সত্যিকার হেতু নেই। সত্যি কথা বলতে গেলে প্রথম দিকে জেলে যে আছি তাই ভালো করে উপলব্ধি করতে পারি নি। কি রকম অস্পষ্ট একটা আশা তখন ছিল যে কিছু একটা শীগগিরই হবে - খুশি ও অবাক-করা কিছু।
মারী দেখা করতে আসার পরই পরিবর্তন ঘটল। মারী ওই একবারই দেখা করতে এসেছিল। যেদিন তার চিঠিতে জানলাম যে আমার বিবাহিত স্ত্রী নয় বলে তাকে আর আমার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে না, সেইদিনই আমি বুঝলাম জেলের এই কুঠুরিই আমার শেষ আশ্রয় - কানাগলির মত যা থেকে সামনের পথ রুদ্ধ বলা যায়।
যেদিন গ্রেফতার হই সেদিন আমায় আরো কয়েকজন কয়েদীর সঙ্গে বড় গোছের একটা ঘরে রাখা হয়। কয়েদীদের বেশীর ভাগই আরব।
আমাকে ঢুকতে দেখে তারা মুচকি হেসেছিল তারপর জিজ্ঞেস করেছিল আমি কি করেছি। একজন আরবকে খুন করেছি বলায় তারা কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাত হলে তাদেরই একজন কি করে শোবার তোষক পাততে হয় আমায় শিখিয়ে দিলে।
এক দিন মুড়ে গোল করে পাকিয়ে বালিশের মত করে তোলাই নিয়ম। সারা রাত মুখের ওপর পোকা চরে বেড়াচ্ছে টের পেলাম।
কিছুদিন বাদে আমাকে একটি কুঠুরিতে একলা রাখা হল। দেয়ালে কব্জা দিয়ে লাগান একটা তক্তার ওপর আমি শুতাম। কুঠুরিটায় আর দুটি মাত্র আসবাব। একটা পায়খানা ইত্যাদি প্রয়োজনের বালতি আর একটা গামলা।
একটা ঢালু জমির ওপরে জেলখানাটা। কুঠুরির ছোট্ট জানলা দিয়ে আমি সমুদ্রের আভাস পেতাম।
একদিন জানলার গরাদ ধরে ঝোলা অবস্থায় সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর আলোর খেলা দেখবার চেষ্টা করছি এমন সময়ে একজন পাহারাদার এসে জানালে কে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
ভাবলাম, নিশ্চয়ই মারী। ঠিকই ধরেছিলাম।
বাইরের লোকেদের সঙ্গে যে ঘরে কয়েদীদের দেখা করতে দেওয়া হয় সেখানে প্রথমে একটা ঘেরা বারান্দা দিয়ে গিয়ে কয়েক ধাপ উঠে আবার একটা করিডর দিয়ে যেতে হয়।
ঘরটা বেশ বড়। এঅকদিকে একটা বড় জানলা দিয়ে প্রচুর আলো আসে। উঁচু লোহার গরাদের সারি দিয়ে ঘরটা তিন ভাগে ভাগ করা। এক লোহার গরাদের সারি থেকে আর এক সারির তফাৎ প্রায় কুড়ি হাত। মাঝখানের জায়গাটা কয়েদী আর তাদের বন্ধু দর্শকদের মধ্যে যেন একটা বেওয়াািশ এলাকা।
আমায় মারীর ঠিক সামনাসামনি এক জায়গায় গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। মারী তার সেই ডোরাকাটা পোশাকটা পরে এসেছে।
গরাদের ধারে আমাদের দিকে আমরা প্রায় বারোজন কয়েদি বেশীরভাগই আরব। মারীর দিকে বেশীর ভাগই মূর স্ত্রীলোক। মারীর একধারে ছোট্টখাট্ট এক বুড়ি, ঠোঁট দুটো তার চাপা, আরেক ধারে মোটাসোটা এক ভারিক্কী স্ত্রীলোক। হাত পা নেড়ে কাঁসার মত খনখনে গলায় সে অনবরত চেঁচাচ্ছে। মারী এ দুজনের মাঝখানে যেন চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে আছে। দুদিকের তফাৎটা অনেকখানি হওয়ায় আমাকেও দেখলাম গলা চড়াতে হচ্ছে।
ঘরে প্রথম ঢুকে চারদিকের হট্টগোল আর জানলা দিয়ে আসা চোখ ঝলসানো আলোয় মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। আমার কুঠুরিটা নিস্তব্ধ আর অন্ধকার। এখানকার অবস্থাটা সইয়ে নিতে তাই কয়েক মুহূর্ত লাগল, কিছুক্ষণ বাদেই সকলের মুখ কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম - যেন থিয়েটারের আলো তাদের ওপর ফেলা হয়েছে।
মাঝখানের বেওয়ারিশ এলাকার দুধারে দুজন জেলের কর্মচারী বসে আছে এবার চোখে পড়ল। এদেশী কয়েদী আর তাদের আত্মীয় বন্ধুরা পরস্পরের মুখোমুখী মেঝেয় বসে। তাদের কারুর গলা চড়া নয়। এই গোলমালের ভেতরও তারা প্রায় চাপা গলাতেই কথাবার্তা চালাচ্ছে দেখলাম। নিচের গুঞ্জন ওপরের কথাবার্তার সঙ্গে যেন তাল রেখে চলেছে মনে হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু দেখে নিয়ে আমি গরাদের কাছে এগিয়ে দাঁড়ালাম। মারী রোদ লাগানো ঈষৎ তামাটে মুখটা গরাদের ওপর চেপে ধরে প্রাণপণে হাসবার চেষ্টা করছে। মনে হল ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। কিন্তু সে কথা তাকে বলতে পারলাম না।

‘তারপর?’ গলা চড়িয়ে মারী জিজ্ঞেস করলে, ‘ব্যাপার কি রকম? ভালো আছ তো? যা দরকার সব পাচ্ছ?
‘হ্যাঁ , যা চাই সবই পাচ্ছি’।
কয়েক মুহূর্ত দুজনেই তারপর চুপ। মারী তখনও হাসছে। ওদিকের মোটা স্ত্রীলোকটি আমার পাশের কয়েদীকে উদ্দেশ্য করে চেঁচাচ্ছে। কয়েদী তার স্বামীই হবে বোধ হয়। লম্বা ফর্সা সুদর্শন চেহারা ।
মোটা স্ত্রীলোকটি ওধার থেকে চেঁচিয়ে বললে, ‘জিনী ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না।’
‘তাহলে তো মুস্কিল দেখছি!’ আমার পাশের কয়েদী বললে।
‘হ্যাঁ, আমি তবু জিনীকে বললাম যে তুমি ছাড়া পেয়েই ওকে আবার কাজে নেবে। কিন্তু জিনী সে কথায় কানই দিলে না।’
মারী চীৎকার করে জানালে যে রেমন্ড আমার শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বললাম, ‘ধন্যবাদ দিও।’ কিন্তু আমার কথা আমার পাশের কয়েদীর চীৎকারে চাপা পড়ে গেল। সে তখন বলছে, হ্যাঁ নেব যদি বহাল তবিয়তে থাকে।’
মোটা স্ত্রীলোকটি  হেসে উঠল, ‘বহাল তবিয়ৎ’! তাই বটে। একেবারে তাজা জোয়ান।’
আমার বাঁ পাশের কয়েদী এখনও পর্যন্ত একবারে চুপ। অল্পবয়সী ছোকরা। সরু সরু হাতগুলো মেয়েদের মত। দেখলাম ওধারের বৃদ্ধার দিকে একদৃষ্টে সে চেয়ে আছে। বৃদ্ধার চোখের ক্ষুধাতুর স্নেহের দৃষ্টি। তাদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মারীর কথা এবার শুনতে হল। মারী চেঁচিয়ে আমায় সাহস দিচ্ছে, - আশা যেন আমরা না ছাড়ি।
‘না কিছুতেই ছাড়ব না’ বললাম। তার কাঁধ দুটোর দিকে চোখ পড়ল। হঠাৎ অদম্য একটা ইচ্ছা হল, পাৎলা পোশাকের তলায় কাঁধ দুটোকে চেপে ধরে আদর করতে। পোশাকের মোলায়েম রেশমী জেল্লা আমার চোখ টেনে নিচ্ছে। কেমন যেন মনে হল, যে আশার কথা সে বলছে তার সঙ্গে এই অনুভূতিটা জড়িত। বোধ হয় মারীর মনেও ওই রকম কিছু ভাব জেগে থাকবে, কারণ একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে সে হাসতে লাগল।
‘দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর আমরা বিয়ে করব।’
এখন শুধু তার সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো আর চোখের ধারের কুঞ্চনটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম।
‘সত্যি  তাই ভাবছ? জিজ্ঞেস করলাম।’ প্রশ্ন করবার জন্যে ঠিক নয় শুধু জবাবে কিছু বলতে হয় বলে।
আগেকার মত চড়া গলায় সে তাড়াতাড়ি বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি নিশ্চয়ই ছাড়া পাবে। আর আবার আমরা সমুদ্রে স্নান করতে যাব। প্রতি রবিবার’।
মোটা স্ত্রীলোকটি তখনও চেঁচাচ্ছে। স্বামীকে সে জানাচ্ছে যে জেলখানার অফিসে স্বামীর জন্যে একটা ঝুড়ি সে রেখে এসেছে। ঝ–ড়িতে কি কি আছে তার ফিরিস্তি দিয়ে স্বামীকে সে সাবধানে সেগুলো মিলিয়ে নিতে উপদেশ দিলে। জানালে যে জিনিসগুলোতে বেশ খরচ পড়ছে।
আমার বাঁ ধারের ছোকরা আর তার মা তখনও নীরবে করুণভাবে পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে। নিচে দেশী লোকেদের গুঞ্জন সমানে চলেছে। জানলা দিয়ে বাইরের রৌদ্রের আলো যেন জোয়ারের মত বয়ে আসছে, সকলের মুখে হলদে তেলের পোঁচ বুলিয়ে দিয়ে।
আমার যেন কেমন বিশ্রী লাগছিল এবার। যেতে পারলে বাঁচি। মোটা স্ত্রীলোকটির খনখনে গলায় কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে, তবু মারীর সঙ্গ যতখানি সম্ভব পাওয়ার জন্য মনে উৎসুক।
কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল বলতে পারি না। মারী সেই একরকম হাসিমুখে তার কাজের কথা বলে গেল মনে আছে। এক মুহূর্তের জন্যে গোলমাল চেঁচামেচির বিরাম নেই। আর সারাক্ষণ সেই চাপা গুঞ্জন। এরই মধ্যে সেই ছোকরা আর তার বৃদ্ধা মা-র নীরবতা যেন শান্তির সরোবরের মত।
তারপর এক এক করে আরবদের নিয়ে যাওয়া হল। প্রথমজনকে নিয়ে যাবার পর প্রায় সকলেই একবার দু’এক মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল।
বৃদ্ধা গরাদের  গায়ে নিজেকে চেপে ধরে আছে। একজন পাহারাদার এসে ছোকরার পিঠে টোকা দিলে।
‘আসি মা।’ ছোকরা বলে উঠল। বৃদ্ধা একটা হাত গরাদের ভেতর দিয়ে গলিয়ে আস্তে আস্তে তখন নাড়ছে।
বৃদ্ধা চলে যেতে টুপি হাতে আর একজন এসে তার জায়গা নিলে। আমার পাশের খালি জায়গাতেও আর একজন কয়েদী এসে দাঁড়াল। তারা দুজনে গলার স্বর না চড়িয়েই দ্রুত আলাপ চালাতে লাগল। কারণ ঘরটা হঠাৎ অনেক নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে। আমার পাশের লোকটির এবার যাবার পালা। চেঁচাবার আর দরকার না থাকলেও তারা চীৎকার করে তাকে সাবধান করে দিলে, সাবধানে থেকো, আর গোঁয়ার্তুমি কিছু করে বসো না যেন।
এইবার আমাকে যেতে হচ্ছে। মারী আমার দিকে একটা চুমু ছুড়ে  দেবার ভঙ্গী করলে। সে তখনো ঠিক একভাবে গরাদগুলোর ওপর মুখ চেপে ধরে সেই রকম ব্যগ্র হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুদিন বাদেই মারীর কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। তখন থেকেই জীবনের যেসব কথা আমি বলতে চাই না সেগুলো শুরু হল। সেগুলো যে খুব বিশ্রী তা নয়। বাড়িয়ে বলবার ইচ্ছে আমার নেই। অন্যদের চেয়ে এই অবস্থায় কষ্টও আমি বোধ হয় কম পেয়েছি। তবে একটা ব্যাপারে সেই গোড়ার দিকেই বিরক্ত লাগত। নিজেকে স্বাধীন ভাবার অভ্যাস থেকেই বাধত গোল। যেমন হঠাৎ কোনো সময়ে সমুদ্রে গিয়ে স্নান করবার প্রবল ইচ্ছা হত। পায়ের কাছে ঢেউয়ের সেই ছলাৎ ছল শব্দটা ভাবতেই, শরীরের ওপর জলের মোলায়েম স্পর্শ কল্পনা করতেই, আর তাতে যে অপূর্ব মুক্তির আস্বাদ তার কথা মনে করতেই আমার কুঠুরির সঙ্কীর্ণতা অত্যন্ত নির্মমভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠত।
মনের এই অবস্থাটা কয়েক মাস মাত্র ছিল। এর পরের যা ভাবনা তা কয়েদীরই উপযোগী।
দৈনিক বেড়াবার সময়টুকুর জন্যে আমি তখন অপেক্ষা করতে শিখেছি। আমার উকিলের আসার সময় আমি গুনি। বাকি সময়টা সত্যিকথা বলতে গেলে আমি বেশ একরকম কাটাবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। অনেকবার ভেবেছি যে আমায় যদি কোন মরা গাছের কোটরে থাকতে হত আর মাথার ওপরের আকাশের টুকরোটুকু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ না থাকত তা হলেও ধীরে ধীরে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে বোধ হয় পারতাম। তখনো পাখি উড়ে যাওয়া বা মেঘ ভেসে যাওয়ার আশায় বসে থাকতে আমি শিখতাম। এখন যেমন আমার উকিলের অদ্ভুত সব নেকটাই দেখবার জন্যে আমি তৈরী থাকি, বা আগেকার জীবনে রবিবারে মারীর সঙ্গে একটু প্রণয়লীলার জন্যে সারা হপ্তা যেমন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতাম সেই রকমই আর কি!
যাই হোক এখানে অন্তত মরা গাছের কোটরে থাকতে হচ্ছে না। দুনিয়ায় কত লোকের দিন আমার চেয়েও খারাপ কাটছে। মার একটা পুরনো কথা মনে পড়ল। প্রায়ই তিনি বলতেন,  শেষ পর্যন্ত সব কিছুই মানুষের সয়ে যায়। 
সাধারণত কোনো কিছু অত তলিয়ে আমি ভাবতাম না। প্রথম কয়েকটা মাস অবশ্য বেশ কষ্ট হত। কিন্তু সে কষ্ট সইতে সইতেই তা কাটিয়ে উঠবার পথ পেলাম।
দৃষ্টান্ত হিসাবে নারী দেহের জন্যে আমার অদম্য কামনার কথা বলা যায়। আমার বয়সে সেটা স্বাভাবিক। আমি বিশেষভাবে শুধু মারীর কথাই ভাবতাম না। এ, ও, সে-নানা মেয়ের কথাই আমার তীব্রভাবে মনে হত। যার যার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, যে অবস্থায় যাকে ভালোবাসা নিবেদন করেছি সকলের কথাই এত বেশী করে ভাবতাম যে আমার কুঠুরিটা যেন সেই সব অতীত কামনার ছায়ামূর্তি, যেই সব চেনা মুখের ভিড়ে ভরে থাকত। আমি বিচলিত হতাম সন্দেহ নেই কিন্তু সময় কাটাবার সুবিধেও তাতে হত।
জেলের সর্দার প্রহরীর সঙ্গে ক্রমশ আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। খাবার সময় সে রান্নাঘরের অন্য যোগাড়দারের সঙ্গে সমস্ত কয়েদীদের খাবার দিয়ে যেত।
সে-ই একদিন মেয়েদের কথা তুললে । - কয়েদীরা ওই নিয়েই সবচেয়ে গজগজ করে, সে আমায় বললে।
বললাম যে আমারও তাদের মতো খারাপ লাগে।
- এক হিসেবে এটা কিন্তু অন্যায়। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা গোছের !
-কিন্তু আসল কথাটা তো তাই।
সে বললে, - সেই জন্যেই তোমাদের জেলে রাখা হয়েছে।
-বুঝতে পারলাম না।
সে বললে, - স্বাধীনতা মানে যা, তা থেকে তোমাদের বঞ্চিত করবার জন্যেই জেলে রাখা।
ঠিক এই দিক থেকে কথাটা কখনও ভাবিনি। তার বক্তব্যটা কিন্তু বুঝলাম। বললাম, - তা ঠিক। তা না হলে শাস্তি হবে কিসে?
সিগারেটের অভাব আর এক যন্ত্রণা ! জেলে ঢোকবার পর আমার কোমরবন্ধ, জুতোর ফিতে, আর সিগারেট ইত্যাদি পকেটের সব কিছুই নিয়ে নিয়েছিল। একলা একটা কুঠুরি পাওয়ার পর আমি আর কিছু না হোক সিগারেটগুলো ফেরত চেয়েছিলাম। সিগারেট কয়েদীদের খেতে দেওয়া হয় না, তারা জানিয়েছিল। সব চেয়ে জব্দ ওতেই হয়েছিলাম। প্রথম কদিন তো কষ্টের সীমা ছিল না। আমার খাটের তক্তা থেকে কাঠের চোকলা ভেঙে নিয়ে চুষতাম। সমস্ত দিন কেমন দুর্বল মনে হত নিজেকে। গা বমি বমি করত। কেন যে আমায় সিগারেট খেতে দেওয়া হবে না আমি বুঝতে পারিনি। তাতে কারুর তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।
পরে উদ্দেশ্যটা বুঝেছিলাম। এটাও একটা শাস্তি। কিন্তু তখন সিগারেটের আগ্রহ আমার চলে গেছে সুতরাং শাস্তিটাও আর নেই।
এই সব অসুবিধাগুলো বাদ দিলে আমি যে খুব অসুখী ছিলাম তা বলতে পারি না। তবে আসল সমস্যা হল কি করে সময় কাটান যায়। একবার আগেকার কথা স্মরণ করবার কায়দাটা আয়ত্ত করবার পর কিন্তু সময় কাটাবার জন্যে আর আমায় ভাবতে হয় নি। কখনো আমি আমার শোবার ঘরটার কথা ভাবতাম। এক কোণ থেকে শুরু করে পর পর সমস্ত কিছু খুঁটিনাটি স্মরণ করবার চেষ্টা করতাম। প্রথম প্রথম দু এক মিনিটেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এই মনে করার খেলাটা আবার যতবার খেলেছি ততই সময় আরো বেশী লেগেছে। প্রত্যেকটি আসবাবপত্র স্পষ্টভাবে কল্পনা করবার চেষ্টা করতাম, যা যা তাতে আছে সব। তন্ন তন্ন করে খুঁটিনাটিরও খুঁটিনাটি আমি স্মৃতি থেকে খুঁজে বার করতাম, যেমন কোথায় একটা সামান্য ঠোকার দাগ, কোথায় এতটুকু চোকলা ওঠার চিহ্ন, কাঠের নির্ভুল রঙ আর তার আসল চেহারা। সেই সঙ্গে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত তালিকাটা ঠিক পরপর আমি মনে রাখবার পণ করতাম।
তার ফলে কয়েক সপ্তাহ বাদে ঘন্টার পর ঘন্টা আমি শুধু আমার ঘরের জিনিসপত্রের হিসেব করেই কাটিয়ে দিতে শিখলাম। তখনই দেখেছিলাম যে যত ভাবা যায় ততই ঝাপসা আধ ভোলা সব খুঁটিনাটি স্মৃতি থেকে স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে। এ ব্যাপারের আর শেষ যেন নেই।
এই থেকেই আমার মনে হয়েছিল যে বাইরের জগতের একদিনের অভিজ্ঞতা দিয়েই মানুষ একশ বছর কারাগারে কাটিয়ে দিতে পারে। এত স্মৃতির সঞ্চয় তার থাকে যে কখনো একঘেয়েমিতে হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। একদিক দিয়ে এটা একটা ক্ষতিপূরণ বলা যায়।
তারপর ছিল আমার ঘুম।
গোড়ার দিকে রাত্রে আমার ভালো ঘুম হত না, দিনেও ঘুমোতে পারতাম না। ক্রমশ রাত্রে ভালোই ঘুম হতে লাগল, দিনেও তন্দ্রার ঘোরে গড়াতে পারলাম। শেষ ক-মাস তো দিন রাতে ষোলো থেকে আঠারো ঘন্টা ঘুমিয়েছি। বাকি থাকত মাত্র ছ ঘন্টা - খাওয়া দাওয়া, প্রাতঃকৃত্যাদি শারীরিক প্রয়োজন স্মৃতি নিয়ে খেলা আর সেই ‘চেক’-এর গল্প দিয়ে ভরিয়ে রাখবার চেষ্টা।
একদিন আমার খড়ের তোষকটা ওল্টাতে গিয়ে তার তলায় এক টুকরো খবরের কাগজ এঁটে আছে দেখলাম। কাগজটা এত পুরানো যে জিরজিরে হলদে হয়ে এসেছে কিন্তু তবু তার লেখাগুলো কষ্ট করে পড়া যায়। সেখানে একটা অপরাধের কাহিনী ছাপা। প্রথম অংশটা নেই, কিন্তু বাকিটা পড়ে আমি বুঝলাম ব্যাপারটা চেকোশ্লোভাকিয়ার কোনো গ্রামে ঘটেছিল। গ্রামের একজন ভাগ্য পরীক্ষা করতে দেশ ছেড়ে চলে যায়। পঁচিশ বছর বাদে বড়লোক হয়ে সে তার স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে গ্রামে ফেরে। ইতিমধ্যে তার মা ও বোন গ্রামে একটা হোটলে খুলে চালাচ্ছে। তাদের চমকে দেবার জন্য সে অন্য এক সরাই-এ  স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে একা ছদ্মনামে গিয়ে মার হোটেলে ঘর ভাড়া নেয়। তার মা ও বোন তাকে চিনতেই পারে নি। রাত্রে খাওয়ার সময় সে নিজের কাছে যে প্রচুর টাকা আছে তা তাদের দেখায়। সেই রাত্রেই মা আর বোন মুগুর মেরে তাকে হত্যা করে। টাকাগুলো নিয়ে তারা লাশটা নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। পরের দিন লোকটির স্ত্রী এসে সরলভাবে স্বামীর পরিচয় জানায়। মা তারপর গলায় দড়ি দিয়ে মরে আর বোন কুয়ায় ঝাপ দেয়।
গল্পটা আমি কমপক্ষে হাজার বার পড়েছি। কিন্তু কেমন আজগুবিই মনে হয়। তবে এ রকম ঘটনা অসম্ভবও নয়। যাই হোক লোকটা সেধেই নিজের সর্বনাশ ডেকেছিল। বোকার মত ওরকম চালাকি করার কোনে মানেই হয় না।
এইভাবে লম্বা ঘুম, স্মৃতির পরীক্ষা, সেই খবরের কাগজের টুকরো পড়া আর আলো অন্ধকারের পালায় আমার দিনগুলো বয়ে গেল। কোথায় যেন পড়েছিলাম যে জেলখানায় কারুর সময়ের হিসাব থাকে না। কিন্তু তা থেকে স্পষ্ট কিছু বুঝি নি। দিন যে অতি ছোট বা অত্যন্ত বড় কি হতে পারে, আমার ধারণায় আসে নি। কাটাবার পক্ষে দিন অতি দীর্ঘ অবশ্য হতে পারে, এত দীর্ঘ যে শেষ পর্যন্ত একটির সঙ্গে আর একটি মিশে যায়। ঠিক দিন বলে কিছুর হিসাব আমার ছিল না। গত আর আগামীকাল এই দুটো কথারই কিছু মানে শুধু পেতাম।
একদিন সকালে জেলার আমায় জানালে যে ছ মাস ধরে আমি জেলে আছি। তার কথা আমি বিশ্বাস করলাম কিন্তু মনে তাতে কোনো দাগ কাটল না। আমার মনে হল যেন সেই একই দিন আমার এই জেলের কুঠুরিতে আসার পর ঘুরে ঘুরে আসছে। যেন সেই একই কাজ আমি নিত্য করে চলেছি।
জেলার চলে যাবার পর আমার টিনের থালাটা ঘসে ঘসে চকচকে করে তাতে আমরা মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করবার চেষ্টা করলাম। মনে হল আমায় অত্যন্ত গম্ভীর  দেখাচ্ছে হাসবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও। থালাটা নানাভাবে ঘুরিয়ে বেঁকিয়ে দেখলাম কিন্তু আমার মুখের সেই এক বিষণœ গম্ভীর চেহারা।

সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। এই সময়টার কথা না বলা ভালো। এ সময়টার আমি বলি নাম নেই। যেন চুপি চুপি সন্তর্পণে জেলখানার সব কটা তলা থেকে সন্ধ্যার সব শব্দ এই সময়ে সার বেঁধে আসতে থাকে।
গরাদ দেওয়া জানলাটার কাছে গিয়ে শেষ     আলোয় আমার মুখটা আবার দেখলাম। সেই গাম্ভীর্য। তাতে অবাক হবার কিছু অবশ্য নেই কারণ সত্যিই আমি তখন গম্ভীর হয়ে গেছি। কিন্তু সেই সঙ্গে এমন একটা শব্দ আমি শুনলাম  বহুকাল যা শুনি নি। সেটা কন্ঠস্বরের শব্দ - আমার নিজেরই কন্ঠস্বর। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ আর নেই। আমি বুঝতে পারলাম এই শব্দই কিছুদিন থেকে প্রায়ই আমার কানে বাজছে। বুঝলাম যে আমি নিজের মনে বকি।
অনেক কাল আগের শোনা একটা কথা এবার আমার মনে পড়ল - মার শেষকৃত্যের সময় নার্স যা বলেছিল।
না কোথাও কোনো পথ নেই আর কারাগারের সন্ধ্যা যে কি বস্তু কেউ কল্পনাও করতে পারে না।


নয়
মোটামুটি বলতে গেলে মাসগুলো যে একেবারে কাটতে চায়নি এমন নয়। প্রথমবারের গ্রীষ্ম গেছে কিনা গেছে টের পেতে না পেতেই আবার গরম পড়ে গেল। আমি বুঝেছিলাম যে সত্যিকারের গ্রীষ্মের দিন শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা আমার কপালে ঘটবে। আমার মামলা একেবারে আদালত বন্ধের দিকে হবে শুনেছিলাম। জুন মাসেই আদালত বন্ধ হয়।
বিচার যেদিন শুরু হল সেদিনটা রোদে ঝলমল করছে। আমার উকিলের কাছে আশ্বাস পেলাম যে দু তিন দিনের বেশি বিচারে লাগবে না। যা শুনেছি, উকিল আমায় জানালেন, - তাতে আপনার মামলা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আদালত চুকিয়ে দেবে কারণ এর চেয়ে শক্ত বড় মামলা আছে। আপনার পরই একটা পিতৃহত্যার কেস উঠবে। সময় নেবে সেইটেই।
সকাল সাড়ে সাতটায় আমায় নিতে এল। কয়েদীদের ঢাকা গাড়িতে আমায় আদালতে নিয়ে যাওয়া হল। আমার সঙ্গে দুজন পুলিশ। তারা ছোট্ট একটা কুঠুরিতে আমায় নিয়ে গিয়ে তুলল। সেখানে অন্ধকারেরই কেমন যেন একটা গন্ধ।; একটা দরজার কাছে আমরা বসলাম। দরজার ওধার থেকে কথাবার্তা চেঁচামেচি চেয়ার টানাটানির শব্দ মিলে এমন একটা গোলমাল আসছিল যাতে মফস্বল শহরের সামাজিক সম্মেলন গোছের ব্যাপার মনে পড়ে যায়। কনসার্ট শেষ হয়ে গেলে নাচের জন্যে হল খালি করতে গিয়ে যে রকম সোরগোল শুরু হয়ে যায় কতকটা সেই রকম।
জজেরা এখনো আসে নি জানিয়ে একজন পুলিশ আমায় একটা সিগারেট দিতে চাইলে। দরকার নেই বললাম। খানিকবাদে সে আবার জিজ্ঞেস করলে আীমি ঘাবড়ে গেছি কিনা। বললাম - না, মামলার বিচার দেখার বরং একটু আগ্রহই আছে জানালাম কারণ আগে কখনও এ সুযোগ আমার হয় নি।
- তা হতে পারে। অন্য পুলিশটি বললে, - তবে ঘন্টা দুয়েকের পরই দিক ধরে যায়। 
কিছুক্ষণ বাদে কামরায় একটা বিজলী ঘন্টা আস্তে বেজে উঠল। আমার হাতকড়া খুলে পুলিশ দুজন আমায় আসামীর কাঠগড়ায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো।
আদালত-ঘরে বেশ ভিড়। বড় বড় জানার্লার খড়খড়িগুলো নামানো। তবু তার ফাঁক দিয়ে বেশ আলো আসছে। হাওয়া  এর মধ্যেই বেশ গরম। জানালাগুলো আগে থেকেই বন্ধ করা ছিল। আমি বসবার পর পুলিশ দুজন আমার চেয়ারের দুধারে দাঁড়াল।
এইবার আমার ওধারে এক সারি মুখ আমার নজরে পড়ল। তারা কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম তারাই জুরী। কেন বলা যায় না, তাদের আলাদা আলাদা মানুষ হিসাবে আমি যেন ভাবতেই পারি নি। রাস্তায় মাঝপথে ট্রামে উঠলে অন্য দিকের সীটে বসা সব যাত্রী মজার কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখবার জন্যে যখন একদৃষ্টে তাকায় তখন যে রকম লাগে আমার অনেকটা সেই রকম লাগছিল। অবশ্য তুলনাটা ঠিক নয়। আমারী মধ্যে এরা মজার কিছু নিশ্চয় খুঁজছিল না, খুঁজছিল অপরাধের ছাপ কি আমার মধ্যে পাওয়া যায় তাই। যাই হোক দুই-এ তফাতটা এমন কিছু নয়। আর আমায় অন্তত ওই রকমই মনে হয়েছিল।
একে ভিড় তারপর আদালতের বন্ধ গুমোট। আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। চারদিকে তাকিয়ে একটা চেনা মুখও দেখতে পেলাম না। প্রথমে তো বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না যে  এত লোক শুধু আমার জন্যেই এসেছে। এত লোকের লক্ষ্যবস্তু হওয়া একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সাধারণত আমায় বড় কেউ নজর করে দেখে না।
- কি গাদাগাদি লোক। আমার বাঁ দিকের পুলিশকে বললাম।
সে বোঝালে যে খবরের কাগগুলোর জন্যেই এত বড় ভিড় হয়েছে।
জুরীদের আসনের নিচেই একটা টেবিলে কয়েকজন বসে আছে তাদের দেখিয়ে দিয়ে সে বললে, - ওই তো ওরা।
-কারা? জিজ্ঞেস করলাম।
-খবরের কাগজের লোক। সে বললে, ওদের একজন আবার আমার পুরনো বন্ধু।
একটু বাদেই খবরের কাগজের সেই লোকটি আমাদের দিকে চেয়ে কাঠগড়ার কাছে এসে পুলিশ বন্ধু সঙ্গে সোৎসাহে করমর্দন করলেন। লোকটির বয়স হয়েছে, মুখটা কড়া রকমের গম্ভীর। কিন্তু ব্যবহার বেশ ভালো। এই সময়েই চোখে পড়ল যে আদালতের  প্রায় সব লোকই যে ওকে প্রীতি সম্ভাষণ জানিয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেছে। যেন এটা কোন জমায়েৎ হবার  আড্ডা, নিজের মনের ও রুচির মানুষ পেয়ে যেখানে সহজ হওয়া যায়।
সেই জন্যেই নিজেকে কেমন অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছিল - যেন অনাহূত এসে পড়েছি।
খবরের কাগজের লোকটি অমায়িক ভাবেই আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। বললেন, - আশা করি হ্যাঙ্গামাটা ভালোয় ভালোয় কাটিয়ে উঠবেন।
ধন্যবাদ জানাতে তিনি একটু হেসে বললেন,- জানেন আপনাকে নিয়ে কাগজে একটু লেখালেখি করছি। এই গ্রীষ্মের সময় লেখবার মত রঙদার তেমন কিছু বড় থাকে না। আপনার আর আপনার পরে যে মামলা উঠবে তা ছাড়া জোরালো খবর  এতদিন কিছু জোটেনি বললেই হয়। পরের মামলাটা কথা শুনেছেন বোধ হয় - বাপকে খুন করার দায়ে ছেলের বিচার।
সাংবাদিকদের টেবিলে যাঁরা বলেছিলেন তাঁদের মধ্যে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা ছোটখাট্ট নাদুসনূুদুস একজনকে দেখিয়ে তিনি বললেন - উনি প্যারিসের একটি - দৈনিক কাগজের বিশেষ সংবাদদাতা। পিততৃহত্যার মামলাটার বিবরণ দেবার জন্যেই ওকে পাঠান হয়েছে। তবে আপনার মামলাটা সম্বেন্ধেও উনি লিখবেন।
লোকটিকে দেখে আমার মানে হল যেন হৃষ্টপুষ্ট একটি ভাম।
ওদের খুব অনুগ্রহ বলতে হবে। - বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু কথাটা নেহাৎ হাস্যকর শোনাবে বুঝলাম।র্
লোকটি প্রসন্নভাবে হাত নেড়ে বিদায় নিলেন। কিছুক্ষণ তারপর আর কিছুই হল না।
এরপরই আর কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে আমার উকিল ব্যস্তসমস্ত হয়ে আদালতে ঢুকলেন। গায়ে তাঁর উকিলের গাউন। তিনি প্রথমেই সাংবাদিকদের টেবিলে গিয়ে সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন। খানিকক্ষণ তারা গল্পগুজব হাসি ঠাট্টায় কাটাবার পর একটা ঘন্টার চড়া আওয়াজ শোনা যেতেই যে যার জায়গায় গিয়ে বসল।
আমার উকিল আমার কাছে এসে করমর্দন করে আমায় সব প্রশ্নের যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত জবাব দেবার পরামর্শ দিলেন। আমি যেন নিজে থেকে কোন খবর না বলি আর তাঁর ওপর ভরসা রাখি, এই তাঁর বলবার কথা।
আমার বাঁদিকের একটা চেয়ার টানার কর্কশ আওয়াজ হল। পাঁস নে - পর রোগা লম্বা একটি লোক তাঁর লাল গাউন গুটিয়ে নিলে বসলেন। ইনিই সরকার পক্ষের উকিল বুঝলাম। আদালতের পেয়াদা হাঁক দিয়ে জানাল যে মহামান্য বিচারকেরা আসছেন। বিচারকেরা আদালতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপর দুটো বড় বড় বিজলী পাখা ভন ভন করে ঘুরতে শুরু করল। আদালতের মেঝে থেকে কয়েক হাত উঁচু বেদীর ওপর পাতা আসনে বিচারকেরা বেশ দ্রুতপদে এসে বসলেন। বিচারক সবশুদ্ধ তিনজন। দুজনের পোশাক কালো একজনের লাল। তাঁদের প্রত্যেকের বগলে একটা করে ব্রীফ কেস। মাঝখানের সবচেয়ে বড় পিঠওয়ালা চেয়ারটায় যাঁর গায়ে লাল পোশাক তিনিই বসলেন। তাঁর দুধারে বাকি দুজন। মাথা থেকে বিচারকের টুপিটা নামিয়ে টেবিলের ওপর রেখে একটা রুমাল টাকের ওপর বুলিয়ে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করলেন যে, মামলার শুনানি এবার শুরু হবে।
সাংবাদিকেরা তখন কলম বাগিয়ে তৈরী। একজন ছাড়া তাদের সবারই মুখে একটা বিদ্রƒপের তাচ্ছিল্য ফুটে উঠেছে। সে লোকটির বয়স অন্যদের তুলনায় কম। পরনে ছাই রঙের ফ্ল্যানেলের ট্রাউজার। গলায় নীল রঙের টাই। কলমটা টেবিলের ওপর রেখে সে তীক্ষè কঠিন দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিল। সাদাসিদে থ্যাবড়া মুখ, কিন্তু চোখগুলোর বিশেষত্ব আছে। খুব ফিকে নীল উজ্জ্বল চোখ। আমাকে তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখলেও তার মুখে স্পষ্ট কোন ভাব আছে কিনা বোঝা গেল না।
মুহুর্তের জন্যে আমার অদ্ভুতভাবে মনে হল আমি যেন নিজেই নিজেকে তন্ন তন্ন করে দেখছি। সেই জন্যে আর হয়ত কোর্টের কাজের দস্তুর আমার  জানা না থাকায় প্রথমটা কি হল আমি ভালো করে খেয়াল করতে পারি নি। জুরীদের জন্যে লটারী করা, প্রধান বিচারপতির সরকারী উকিল, জুরীদের নেতা ও আমার উকিলকে নানা প্রশ্ন (বিচারপতির প্রতিটি কথায় জুরিদের মাথাগুলো একসঙ্গে তাঁর দিকে ঘুরে যাচ্ছিল) আমার বিরুদ্ধে নালিশটা পড়া, আমার উকিলকে উপরি কয়েকটা প্রশ্ন করা সব যেন কেমন গোলমালের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি পড়বার সময় কয়েকটা পরিচিত জায়গা আর লোকের নাম শুধু আমি চিনতে পারলাম।
বিচারক এবার সাক্ষীদের তালিকা জানান হবে বললেন। তালিকায় কয়েকটি নাম শুনে আমি বেশ অবাকই হলাম।, আদালতের যে ভীড় এতক্ষণ আমার কাছে অস্পষ্ট কটা মুখ ছিল মাত্র তার ভেতর থেকে একে একে রেমন্ড মাস সালামানো, আতুরাশ্রমের সেই দারোয়ান, বুড়ো পেরেজ আর মারী উঠে দাঁড়িয়ে পর পর পাশের একটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। মারী শুধু যাবার আগে আমার দিকে কেমন সঙ্কুচিত ভাবে একবার হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানালে।
এদের কাউকে আগে লক্ষ্য করিনি ভেবে আমার আশ্চর্য লাগছিল। শেষ নামটা এবার শুনলাম। সেলেস্তিও সাক্ষীদের মধ্যে আছে তাহলে। সে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে তার পাশের মহিলাটির দিকে নজর গেল। পুরুষালী কোট পরা চটপটে আত্মম্ভরি যে অদ্ভূত মহিলা রেস্তোরাঁয় আমার টেবিলে বসে খেয়েছিলেন তিনি এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর এখানে আসায় অবাক হবার সময়ই পেলাম না। প্রধান বিচারক তাঁর কথা তখন শুরু করেছেন।
আসল বিচার এবার শুরু হবে জানিয়ে তিনি বললেন, বিচার যাঁরা শুনতে এসেছেন তাঁরা যেন শান্ত শিষ্ট হয়ে থাকেন একথা জানানই বাহুল্য। তিনি এখানে এক রকম মধ্যস্থ হয়ে বিচার যাতে সুপরিচালিত হয় তারই তদারক করতে উপস্থিত। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষই তিনি থাকবেন। জুরীদের রায় তিনি ন্যায়ের দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন। সব শেষে তিনি আবার জানালেন কোথাও একটু আধটু গোলমাল হলেই আদালত থেকে বাইরের সবাইকে তিনি বার করে দেবেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে গরমও বাড়ছে। সাধারণ দর্শকদের অনেকে খবরের কাগজ নেড়ে হাওয়া খাচ্ছে। আদালতে সারাক্ষণ কাগজের খসখস শব্দ। প্রধান বিচারক ইশারা করায় একজন চাপরাশী খড়ের বোনা তিনটে হাত-পাখা, এনে দিলে। বিচারেকরা তার সদ্ব্যবহার শুরু করলেন।
আমার জবানবন্দী এইবার শুরু হল। বিচারপতি খুব শান্তভাবে এবং আমার যেন মনে হল একটু অন্তরঙ্গ হয়েই আমায় প্রশ্ন করতে লাগলেন। এই নিয়ে কতবার যে জানি না আমায় নিজের বিস্তারিত পরিচয় দিতে হল। একঘেয়ে ব্যাপারটায় একেবারে বিরক্তি ধরে গেলেও বুঝলাম এরকমটা না হয়ে উপায় নেই। আদালত যদি ভুল লোককে বিচার করতে বসে তাহলে তো সর্বনাশ!
বিচারক, এবার আমি যা যা করেছি তার বিবরণ দেওয়া শুরু করলেন। একটু বাদে বাদেই থেমে তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করেন - কি, ঠিক তো? আমি তাতে সায় দিয়ে বলি, - আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার উকিল আমায় এই পরামর্শই দিয়েছে।
ব্যাপারটা অনেকক্ষণ চলল। কারণ বিচারক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটি বিষয় বলতে লাগলেন। সাংবাদিকদের কলম তখন সবেগে চলছে। মাঝে মাঝে শুধু টের পাচ্ছিলাম কমবয়সী সেই লোকটি আর সেই অদ্ভুত কলের পুতুলের মত মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। জুরীদের সকলের নজর লাল পোশাক পরা প্রধান বিচারকের দিকে। আবার আমার সেই ট্রামের যাত্রীর সারির কথা মনে পড়ে গেল।
এইবার একটু কেশে নিয়ে, নিজের কাগজ পত্রের ফাইলটার কটা পাতা উলটে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বিচারক গম্ভীরভাবে আমায় কয়েকটি কথা বললেন।
তিনি জানালেন যে, ভাসাভাসা ভাবে দেখলে অবান্তর মনে হতে পারে এমন কয়েকটি প্রসঙ্গ এবার তিনি তুলতে চান কারণ তাঁর মতে আসলে সেগুলি অত্যন্ত  দরকারী।
বুঝলাম তিনি মা-র কথা এবার বলবেন। কি বিশ্রীই যে এসব কথা লাগবে তাও বুঝতে পারলাম।
প্রথমেই তিনি জানতে চাইলেন, মা-কে আমি আতুরাশ্রমে পাঠিয়েছিলাম কেন।
বললাম, সে কারণটা বোঝা খুবই সহজ। তাঁকে বাড়িতে রেখে ঠিকমত যতœ নেবার মত সঙ্গতি আমার ছিল না।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন মার সঙ্গে ছাড়াছাড়িতে আমার কষ্ট হয়েছে কিনা।
বুঝিয়ে বললাম যে মা বা আমি দুজনেই পরস্পরের কাছে, আর পরস্পরের কাছে কেন, কারুর কাছেই বিশেষ কিছু আশা করতাম না তাই অতি সহজেই নতুন অবস্থার সঙ্গে আমরা মানিয়ে নিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে আর তাঁর বাড়াবার ইচ্ছে নেই জানিয়ে বিচারক সরকারী উকিলকে তাঁর কিছু জিজ্ঞেস করবার কথা মাথায় এসেছে কিনা জানতে চাইলেন।
সরকারী উকিল আমার দিকে সম্পূর্ণ না ফিরে ও আমার দিকে না চেয়েই বললেন যে বিচারপতির অনুমতি নিয়ে তিনি জানতে চান যে আমি খাঁড়িটার কাছে যখন ফিরে যাই তখন সেই আরবকে মারবার মতলব নিয়েই গিয়েছিলাম কিনা।
উত্তরে আমি বললাম যে, না সেরকম মতলব আমার ছিল না।
তাহলে রিভালভারটা নিয়ে গিয়েছিলাম কেন, আর কেনই বা ঠিক সেই জায়গাটাতেই গিয়েছিলাম?
বললাম, নেহাৎ দৈবাৎ।
সরকারী উকিল মুখ বাঁকিয়ে বিশ্রীভাবে বললেন, -আচ্ছা, আপাতত এ পর্যন্তই থাক।
তারপর কি কি হল আমি ঠিক সব বুঝত পারলাম না।
যাই হোক সরকারী উকিল, বিচারপতিরা ও আমার উকিল খানিকক্ষণ কি পরামর্শ করবার পর প্রধান বিচারপতি  জানালেন যে এখন বিরতি হয়ে আবার বিকালে বিচার আরম্ভ হবে। সাক্ষীদের তখন ডাক পড়বে।
কি হল বুঝতে না বুঝতেই দেখলাম আমায় তাড়াহুড়ো করে জেলখানার গাড়িতে তোলা হয়েছে। জেলখানায় নিয়ে গিয়ে আমায় দুপুরের খাবার দেওয়া হল। তারপর কি ক্লান্ত যে হয়েছি, তা বোঝবার সময়টুকু যেন শুধু দিয়ে আমায় আবার সেই আদালত ঘরে নিয়ে গিয়ে ওরা তুললে। সেই সব মুখের জটলার মাঝে আবার সেই বিচার শুরু হল।
ইতিমধ্যে কিন্তু গরম অত্যন্ত বেড়েছে। কোন ভোজবাজিতে যেন সকলের হাতেই এখন একটা করে পাখা। জুরী, আমার উকিল,সরকারী উকিলের হাতে তো বটেই, সাংবাদিকদের হাতেও পাখা চলছে। সেই কমবয়সী সাংবাদিক আর সেই কলের পুতুল মহিলাটি তাঁদের জায়গায় ঠিক বসে আছেন। তবে তাঁরা পাখা চালাচ্ছেন না। আগের মতই একদৃষ্টে আমায় লক্ষ্য করছেন।
মুখের ঘামটা মুছলাম। কোথায় যে আছি বা কেন, সব যেন  কেমন গুলিয়ে গেছে। সাক্ষী হিসেবে আতুরাশ্রমের পরিচালকের নাম ডাকতে একটু হু’স হল।
আমার মা আমার ব্যবহার  নিয়ে ক্ষোভ জানাতেন কিনা জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন যে, হ্যাঁ, তা জানাতেন। সেই সঙ্গে অবশ্য বললেন যে সে ক্ষোভটা এমন কিছু ধর্তব্য নয়, কারণ আতুরাশ্রমের  প্রায় সবারই আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে ওরকম নালিশ আছে।
বিচারপতি ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে বোঝাতে বললেন, জিজ্ঞেস করলেন যে আতুরাশ্রমে পাঠিয়েছে বলে আমার মা-র আমার বিরুদ্ধে নালিশ ছিল কিনা।
পরিচালক বললেন, - ছিল। এবারে ওইটুকুর বেশী আর কিছু তিনি বললেন না।
আরেকটি প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন যে মা-র শেষকৃত্যের  দিন আমার কোনরকম অস্থিরতার  অভাব দেখে তিনি একটু অবাক হয়েছিলেন। অস্থিরভাব অভাব বলতে কি বোঝাতে চান জিজ্ঞেস করায় তিনি মাথা নিচু করে একবার তাঁর জুতোর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন যে, আমি মা-র মৃতদেহ প্রথমে দেখতে চাইনি, এক ফোঁটা চোখের জলও সেদিন ফেলিনি, আর শেষকৃত্য হয়ে যাবার পরই কবরের কাাছে একটু না থেকেই তৎক্ষণাৎ চলে এসেছি। আর একটি ব্যাপারেও তিনি বিস্মিত হয়েছেন। আমার মা - কে যারা কবর দিয়েছে তাদের একজনের কাছে তিনি শুনেছেন যে আমি নাকি মার কত বয়স হয়েছিল তাও বলতে পারি নি।
সবাই তারপর কিছুক্ষণ চুপ।
বিচারক এবার জিজ্ঞেস করলেন যে কাঠগড়ার আসামীর কথাই তিনি বলছেন কিনা।
আতুরাশ্রমের পরিচালক প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে যেন ধাঁধায় পড়েছেন মনে হল।
বিচারক বুঝিয়ে বললেন, ----প্রশ্নটা আদালতের দস্তুর বলে আমি করতে বাধ্য।
সরকারী উকিলের কোন কিছু জেরা করবার আছে কিনা  জিজ্ঞেস করা হল।
তিনি বড় গলায় চেঁচিয়ে বললেন, - না কিছু নেই। যা চাই সবই আমিই পেয়েছি।
তাঁর গলার স্বর আর তাঁর মুখের জয়োল্লাসের ভাবটা এমন যে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলবার সময় আহাম্মকের মত আমার চোখ ফেটে জল বেরুতে চাইল। এই প্রথম আমি বুঝলাম যে এখানকার সবাইকার কাছে আমি কি ঘৃণার  পাত্র।
জুরীদের আর আমার উকিলকে তাদের জেরা করবার কিছু আছে কিনা  জিজ্ঞেস করে বিচারক এবার আতুরাশ্রমের দারোয়ানের সাক্ষ্য নিলেন।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে আমার দিকে একবার তাকিয়েই সে চোখ ফিরিয়ে নিলে।
জেরায় সে বললে যে আমি মার মৃতদেহ দেখতে চাইনি। সিগারেট খেয়েছি, ঘুমিয়েছি আর সরেস কফি খেয়েছি। তখনই টের পেলাম একটা ঘৃণার ঢেউ যেন আদালতের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। এইবার প্রথম বুঝলাম যে আমি অপরাধী।র্
দারোয়ানকে দিয়ে আমার সিগারেট আর কফি খাওয়ার কথা আবার বলান হল।
সরকারী উকিল আমার দিকে ফিরলেন। তাঁর চোখে শিকারকে বাগে পেয়ে জব্দ করতে পারার একটা কুৎসিৎ পরিতোষের দৃষ্টি। 
আমার উকিল দারোয়ান নিজে সিগারেট খেয়েছিল কিনা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু সরকারী উকিল তাতে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে উষ্ণস্বরে বললেন, আমি জানতে চাই এ মামলায় আসামী কে? কিংবা আমার বিজ্ঞ বন্ধু কি মনে করেন যে বাদী পক্ষের সাক্ষীর ওপর কাদা ছিটিয়ে আসামীর বিরুদ্ধে আসল প্রমাণ যা প্রচুর ও প্রাসঙ্গিক সব উড়িয়ে দিতে পারবেন?
বিচারক এ প্রতিবাদ সত্ত্বেও দরোয়ানকে জবাব দিতে বললেন। 
দরোয়ান একটু উসখুস করে তারপর আমতা আমতা করে নিচু গলায় বললে, - কি বলে, আমার অবশ্য উচিত ছিল না জানতাম, তবে উনি সিগারেট দিলে একটা আমি খেয়েছিলাম - ভদ্রতার খাতিরেই।
আমার কিছুূ বক্তব্য আছে কিনা বিচারপতি জিজ্ঞেস করলেন।
বললাম - না। শুধুূ এইটুকুই বলতে চাই যে সাক্ষী যা বলেছে তা ঠিক। আমিই ওকে সিগারেট খেতে দিই।
দরোয়ান আমার দিকে অবাকী হয়ে একটু সকৃতজ্ঞভবেই চাইল। তারপর কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে নিজে থেকে জানার্লে যে সে-ই কফি খাওয়ার প্রস্তাবটা করেছিল।
আমার উকিল একেবারে উল্লাসিত হয়ে উঠলেন। বললেন, দরোয়ান যে কথা স্বীকার করেছে তার মূল্য যেন জুরীরা বোঝেন।

দশ
আমার, উকিলের কথা শেষ হতে না হতে সরকারী উকিল প্রায়  লাফিয়ে উঠে বললেন - ঠিক কথা। জুরীরা এ স্বীকারোক্তির মূল্য নিশ্চয় বুঝবেন। তাঁরা এই কথাই বুঝবেন যে বাইরের কেউ কফি খেতে দিতে চাইলেও আসামেীর পক্ষে তা প্রত্যাখ্যান করাই শোভন ছিল - যিনি  তাকে এই পৃথিবীতে  জন্ম দিয়েছেন সেই হতভাগিনী মা-র মৃতদেহের প্রতি এতটুকু সন্মান যদি তার মনে থাকত।
দরোয়ান এবার তার জায়গায় গিয়ে বসল।
টমাস পেরেজের ডাকে পড়তে আদালতের একজন কর্মচারী তাঁকে হাত ধরে কাঠগড়ায় উঠতে সাহায্য করলেন। পেরেজ তাঁর জবানবন্দীতে বললেন যে আমার মার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও আমায় তিনি মার শেষকৃত্যের দিন ছাড়া আর কখনেরা দেখেন নি। সেদিন আমার চালচলন কি রকম দেখেছেন জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন - দেখুন আমি নিজে সেদিন একটু  বেশী ভেঙে পড়েছিলাম। কোনো কিছু লক্ষ্য করবার মত অবস্থা আমার ছিল না। মনে এত বেশী আঘাত পেয়েছিলাম যে শেষ কাজের সময় একবার অজ্ঞান-ই হয়ে যাই। এ ছেলেটির দিকে তাই নজরই দিইনি বললে হয়।
সরকারী উকিল পেরেজকে আমায় কাঁদতে দেখেছেন কিনা আদালতে জানাতে বললেন। পেরেজ দেখেন নি বলায় সরকারী উকিল জোর দিয়ে বললেন, - আমার বিশ্বাস জুরীরা এ কথাটাও  মনে রাখবেন।’
আমার উকিল তৎক্ষণাৎ উঠে পেরেজকে একটু যেন বেশী রূঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন - ভালো করে ভেবে দেখুন , আসামী যে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে নি, একথা শপথ করে আপনি বলতে পারেন?
পেরেজ বললেন - না
আদালতে কেউ কেউ এক কথায় একটু হেসে ওঠায় আমার উকিল তাঁর গাউনের একটা হাতা গুটিয়ে নিয়ে কঠিন স্বরে বললেন, - এ মামলা যেভাবে চালান হচ্ছে, এটা তার একটা উদাহরণ। সত্যি ঘটনা কি তা বার করবার কোনো চেষ্টাই নেই।
সরকারী উকিল এ মন্তব্য গ্রাহ্যই করলেন না। যেন এ ব্যাপারো তাঁর কোন গা-ই নেই, এইভাবে তাঁর নথির ওপরকার কাগজে তিনি তখন পেন্সিল ঠুকছেন।
পাঁচ মিনিটের জন্যে আদালতের কাজ বন্ধ রইল। আমার উকিল সেই অবসরে আমায় জানাল যে আমার মামলা ভালোর দিকেই যাচ্ছে।
এবার ডাক  পড়ল সিলেস্তির। আসামী পক্ষ, মানে আমার তরফে সে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াল।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সিলেস্তি মাঝে মাঝে আমার দিকে চাইছিল। মাথায় পানামা টুপিটা সাক্ষ্য দিতে দিতে সে দুহাতে টিপছিল। তার সবচেয়ে ভালো স্যুটটা সে পরে এসেছে। এইটে পরেই মাঝে মাঝে রবিবার আমার সঙ্গে সে ঘোড়দৌরের মাঠে যেত। গলার কলারটা অবশ্য সে লাগাতে পারে নি। সার্টের গলাটা শুধু একটা পেতলের বোতাম দিয়ে আটকানো দেখলাম। আমি তার একজন খদ্দের কিনা জিজ্ঞেস করায় সে‘ বললে যে শুধুূ খদ্দের নয় আমি তার বন্ধুও বটে। আমার সম্বন্ধে কি তার ধারণা প্রশ্ন করায় জানালে যে আমি লোক ভালো। কথাটা বুঝিয়ে দিতে বলায় সে বললে যে এ কথার মানে সবারই বোঝা উচিত।
আমি চাপা গোছের মানুষ কিনার জারনতে চাওয়ায় সে বললে, না, আমি তা বলি না। তবে অনেকের মত অকারণে বকবক করে না।
সরকারী উকিল জিজ্ঞেস করলেন, আমি রেস্তোরা মাসিক পাওনা ঠিকমত বরাবর চুকিয়ে দিই কিনা।
সিলেস্তি হেসে উঠে বললে, হ্যাঁ ঠিক মতই চুকিয়ে দেয়, তবে পাওনা গন্ডার ওসব হিসেব আমাদের দুজনের নিজস্ব ব্যাপার।
খুনের অভিযোগ সম্বন্ধে তার ধারণা কি এবার তাকে জিজ্ঞেস করা হল। কাঠগড়ার রেলিং-এর ওপর যেভাবে সে হাত রাখল তাতে বোঝা গেল একটা বক্তৃতা সে তৈরি করেই এনেছে।
সে বলতে শুরু করলে, - আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা নেহাত আকস্মিক দুর্ঘটনা বলতে পারেন। হঠাৎ এরকম সময়ে মানুষ  কেমন বেসামাল হয়ে যায়।
আরো কিছু  বলার ইচ্ছে তার ছিল, কিন্তু বিচারক তাতে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাই বটে। আচ্ছা ধন্যবাদ।
এক মুহূর্তের জন্যে সিলেস্তি যেন হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর সে বোঝাবার চেষ্টা করলে যে, তার কথা এখনো শেষ হয়নি।
আদালত থেকে তাকে সংক্ষেপে আবার অনুমতি দেওয়া হল। কিছু ব্যাপারটা নেহাৎ আমস্মিক দুঘর্টনার ছাড়া কিছু নয় - এর বেশী আর কিছু বলতে পারল না।
তা হতে পারে - বলে বিচারক মন্তব্য করলেন, কিন্তু আমরা এখানে আইন অনুসারে এই ধরনের দুর্ঘটনার বিচারই করতে বসেছি। আপনি এখন বসতে পারেন।
সিলেস্তি ফিরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকাল। তার চোখেরী পাতা ভিজে ঠোঁট কাঁপছে। তার ভাব দেখে মনে হল সে যেন বলতে চাচ্ছে, - তোমার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম ভাই। লাভ কিছু হল না বলেই ভয় হচ্ছে। সত্যি আমি দুঃখিত।
কিছুই আমি বললাম না, একটু নড়লাম না পর্যন্ত, কিন্তু জীবনে এই প্রথম মনে হল একটি পুরুষমানুষকে আমি জড়িয়ে চুমু খেতে পারি।
বিচারক আবার তাকে নেমে যেতে বলায় সিলেস্তি ভিড়ের মধ্যে তার জায়গায় গিয়ে বসল। যতক্ষণ তারপর মামলার শুনানি চলল, হাঁটুর ওপর কনুই-এ ভর দিয়ে পানামা টুপিটা হাতে ধরে ঝুঁকে পড়ে যেরকম ব্যগ্রভাবে সে বসে রইল তাতে মনে হল একটা কথাও সে না শুনে  ছাড়ছে না।
এবার মারীর পালা। সে টুপি মাথায় দিয়ে এসেছে। বেশ ভালোই তাকে দেখাচ্ছিল, তবে আমার তাকে খোলা চুলেই বেশী ভালো লাগে। আমি যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে মাঝে মাঝে তার বুকের নরম ডৌল আর তার নিচের ঠোঁটের সেই আদুরে উল্টোন ভাবটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম। ঐ দেখে  আমি বরাবর মুগ্ধ হয়েছি। মনে হচ্ছিল সে বেশ ঘাবড়ে গেছে।
প্রথম প্রশ্ন তাকে করা হল, কতদিন সে আমায় জানে। সে বললে আমাদের অফিসে কাজ করবার সময় থেকে। আমার সঙ্গে তার সম্বন্ধটা কি বিচারক জানতে চাইলেন। মারী জানালে সে আমার বান্ধবী। আর একটি প্রশ্নের জবাবে সে আমায় বিয়ে করতে রাজী হওয়ার কথা স্বীকার করলে।
সরকারী উকিল তাঁর নথিপত্র দেখতে দেখতে বেশ একটু চড়া গলায় হঠাৎ জিজ্ঞেসা করলেন, - আমাদের ঘনিষ্ঠতটা কবে থেকে শুরু হয়েছে। মারী তারিখটা জানালে।
সরকারী উকিল নেহাৎ যেন সাধারণভাবে বললেন, - তার মানে আসামীর মায়ের শেষকৃত্যের পরের দিন।
কথাটা বেশ ভালো করে জুরীদের মনে বসতে দিয়ে তিনি একটু বিদ্রুপভরে বললেন যে প্রসঙ্গটা যদিও ঠিক প্রকাশ্য আলোচনায় নয়, এবং তরুণী সাক্ষীর মনের অবস্থা যদিও তিনি বোঝেন তবু কর্তব্যের  খাতিরে যা কিছু সঙ্কোচ তাঁকে জয় করতে হচ্ছে। শেষ কথাগুলো বলবার সময় তাঁর কন্ঠ কঠিন হয়ে এল।
এই ভূমিকাটুকুর পর মারীকে আমাদের প্রথম দিনের মিলনের সম্পূর্ণ বিবরণ তিনি দিতে বললেন। মারী প্রথমে কিছু বলতে চাইলে না। কিন্তু সরকারী উকিল ছাড়বার পাত্র নয়। মারী তখন বললে যে স্নান   করতে গিয়ে আমাদের দেখা হয়, তারপর আমরা সিনেমায় ছবি দেখতে যাই শেষে সে আমার বাসায় আসে।
সরকারী উকিল এবার আদালতকে শোনালেন যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মারী যে জবানবন্দী দিয়েছিল তা দেখে তিনি সেই দিন নানা সিনেমায় যে সব ছবি দেখান হয়েছিল তার খোঁজ নিয়েছেন।
মারীর দিকে ফিরে কি ছবি আমরা সেদিন দেখেছি তিনি জানতে চাইলেন।
মৃদু গলায় মারী বললে যে, সে ছবিতে ফার্ণান্ডেল অভিনয় করেছিল। 
মারীর কথা যখন শেষ হল তখন আদালতে আলপিন ফেললে শোনা যায়।
অত্যন্ত গম্ভীরভাবে সরকারী উকিল আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে এমনভাবে কয়েকটি কথা এবার বললেন যে, তিনি সত্যি সত্যি মর্মাহত হয়েছেন বলে আমার মনে হল।
তিনি বললেন - জুরীদের কাছে আমার নিবেদন এই যে মার শেষকৃত্যের পরদিনই আসামী যে সাঁতার কাটতে গেছে, একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম জানিয়েছে ও একটা হাসির ছবি দেখতে গেছে এইটুকু আপনারা মনে রাখবেন। আমার আর কিছু বলবার নেই।
সরকারী উকিল বসবার পর আদালতে আবার সেই  নিস্তব্ধতা। হঠাৎ মারী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
উনি যা বুঝেছেন সব ভুল, সে বলতে লাগল সত্যি ওরকম মোটেই কিছু হয়নি। সে যা বলতে চেয়েছিল সরকারী উকিল জবরদস্তি করে তার ঠিক উল্টোটা তাকে বলতে বাধ্য করেছে, এই তার বক্তব্য।
সে আমাকে ভালো করে জানে। আমি অন্যায় কিছু করিনি এ তার দৃঢ় বিশ্বাস।
মারী আরো অনেক কিছুই বলে যাচ্ছিল। শেষে প্রধান বিচারপতির ঈঙ্গিতে আদালতের একজন কর্মচারী তাকে ধরে নামিয়ে নিয়ে গেলেন। আবার শুনানি চলল।
পরের সাক্ষী ম্যাসন। তার কথায় কেউ যেন কান-ই দিলে না মনে হল। সে বলতে চাইলে যে আমি শুধু ভদ্রই নয় সত্যি ভালো ছেলে।
সালামানো যখন তারপর-এসে আমি কুকুরটার ওপর বরাবর কি রকম মায়া দেখিয়েছি - জানালে তখন তার কথাও কেউ যেন গ্রাহ্যই করলে না। এমন কি আমার মা-র কথা ওঠায় সে যখন বললে যে মা-র সঙ্গে আমার তেমন কোন বিষয়ে মিল ছিল না বলেই মা কে আমি আশ্রমে রেখেছিলাম তখনও  তার কথা মাঠেই মারা গেল।
- আপনাদের বোঝা উচিত, সে দুবার বললে। কিন্তু কেউ যেন বুঝতেই পারল না। তাকে নেমে যেতে বলা হল।
এরপর শেষ সাক্ষ্য দিতে এল রেমন্ড। সে হাত নেড়ে আমার সম্ভাষণ জানিয়ে প্রথমেই বললে যে আমি নির্দোষ।
বিচারপতি তাকে বলে উঠলেন, - আপনি এখানে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন, এ মামলা সম্বন্ধে আপনার মতামত জানাতে নয়। আপনাকে যা প্রশ্ন করা হবে তার উত্তর দেওয়া ছাড়া বেশী কিছু বলবেনা না।
খুন হওয়া লোকটির সঙ্গে তার সম্বন্ধটা বুঝিয়ে দিতে বলায় রেমন্ড সেই সুযোগ নিয়ে জানাল যে আমার বিরুদ্ধে নয় তার বিরুদ্ধেই নিহত লোকটির রাগ ছিল, কারণ সে তার বোনকে মারধর করেছিল।
বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, আমার ওপরও নিহত লোকটির আক্রোশ হবার কোন কারণ ছিল কিনা। রেমন্ড তাতে জানালে যে সেদিন সকালে সমুদ্রের চড়ায় আমার যাওয়াটা নেহাৎ দৈবাৎ।
সরকারী উকিল জিজ্ঞেস করলেন যে তাহলে এই দুর্ঘটনার যা মূল সেই চিঠিটা আসামীর হাতে লেখা হল কেন?
রেমন্ড বললে যে এ ব্যাপারটাও আকস্মিক।
সরকারী উকিল তাতে বলে উঠলেন যে এ মামলায় ‘ঘটনা চক্র’ দৈবাৎ প্রভৃতির বড় ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। রেমন্ড যখন তার রক্ষিতাকে  মারধর করে তখন আসামী যে বাধা দেয় নি সেটা কি দৈবাৎ? আসামী  যে থানায় রেমন্ডের কথা সমর্থন করে তার হয়ে সাউখুড়ি করে সেটাও কি সুবিধে মত ঘটনাচক্র বলে ধরতে হবে? 
শেষ সরকার উকিল জানতে চাইলেন রেমন্ড কি করে।
রেমন্ড জাহাজী মাল গুদামে কাজ করে বলায় সরকারী উকিল জুরীদের জানালেন যে সাক্ষীর আসলে জীবিকা হল পতিতাদের রোজগারে ভাগ বসানো; আর আমি হলাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর সঙ্গী। সত্যি কথা বলতে কি এই খুনের পেছনে যে সব ব্যাপার আছে তা অত্যন্ত জঘন্য রকম নোংরা। সমস্ত আরো কুৎসিত করে তলেছে আসামীর চরিত্র সে এমন একটা নরাধম পিশাচ যার নীতিবোধের কোন বালাই-ই নেই।
রেমন্ড আপত্তি জানাতে লাগল। আমার উকিলও প্রতিবাদ করলেন। সরকারী উকিলকে তাঁর বক্তব্য শেষ করতে দিতে হবে এই কথাই তাদের জানান হল।
‘আমার আর বেশী কিছু বলবার নেই’ জানিয়ে সরকারী উকিল রেমন্ডের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, - আসামী কি আপনার বন্ধু?
- নিশ্চয়। আমরা যাকে  বলে প্রাণের বন্ধু ছিলাম।
সরকার উকিল এবার আমাকেও ওই প্রশ্ন করলেন।
আমি রেমন্ডের দিকে সোজা তাকিয়ে  রইলাম। সে দৃষ্টি ফেরাল না।
তখন জবাব দিয়ে বললাম, - হ্যাঁ।
সরকারী উকিল এবার জুরীদের দিকে ফিরলেন। বললেন, - আপনাদের সামনে কাঠগড়ায় যে দাঁড়িয়েছে মায়ের শেষ কাজের পরদিনই সে শুধু জঘন্য সব নারকীয় স্ফূর্তি নিয়ে মাতেনি গণিকা আর তাদের দালালদের জগতের অতি ঘৃণ্য এক প্রতিহিংসা মেটাতে বিনা উত্তেজনায় একটি মানুষকে খুন করেছে। আসামী কি চরিত্রের মানুষ আপনারা বুঝতেই পারছেন।
সরকারী উকিল বলতে না বসতেই উকিল অধৈর্যের সঙ্গে তাঁর হাত দুটো এমন উঁচু করে তলে ধরলেন যে জামার হাতাগুলো নেমে গিয়ে তাঁর সার্টের কফ্ পুরো বেরিয়ে পড়ল।
আমার মক্কেলের কোন্ অপরাধের বিচার হচ্ছে, মা-কে কবর দেওয়ায় না মানুষ খুন করান? তিনি জিজ্ঞেস করলেন। 
আদালতে চাপা হাসির আওয়াজ শোনা গেল।
সরকারী উকিল এবার লাফিয়ে উঠে গাউনটা ভালো করে গায়ে চড়িয়ে নিয়ে বললেন যে, এ মামলার এ দুটি দিকের মধ্যে সম্বন্ধ যে কি না আমার উকিল ধরতে না পারায় তিনি বিস্মিত। সম্বন্ধটা এক হিসেব মনের ক্রিয়া-ঘটিত বলা যায়। এক কথায়, সরকারী উকিল কথাগুলোতে বেশ জোর দিয়ে বললেন, ‘আসামীর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ এই যে মা-র শেষ কাজের দিন যে ব্যবহার সে করেছে তাতে বোঝা যায় তখনই মনে মনে সে অপরাধী।’
আদালতের লোকজন ও জুরীদের মনে কথাগুলি বেশ দাগ কাটল মনে হল। আমার উকিল শুধু ঘাড়টায় একটু ঝাঁকুনি দিয়ে কপালের ঘাম  মুছলেন। বাইরে যাই-ই দেখান ভেতরে তিনিও বেশ একটু বিব্রত  হয়েছেন সন্দেহ নেই। আমারও মনে হল মামলাটা আমার পক্ষে খুব ভালো রাস্তায় যাচ্ছে না।
এর খানিকটা পরেই সেদিনকার মত বিচার শেষ হল। আদালত থেকে জেলখানার গাড়িতে আমায় নিয়ে যাওয়ার সময় বাইরের গ্রীষ্মসন্ধ্যার পুরানো মাধুর্যটি একটু যেন অনুভব করতে পারলাম। অন্ধকার গাড়ির ভেতর বন্দী অবস্থায় মনে হল আমার ক্লান্ত মস্তিষ্কের ভেতর আমার প্রিয় শহরের সমস্ত পরিচিত শব্দ যেন প্রতিধ্বনি তুলছে। সন্ধ্যার বাতাসে এর মধ্যেই একটা অবসাদের আভাস এসেছে। তার ভেতর হকার ছোকরারা হেঁকে হেঁকে খবরের কাগজ ফিরি করছে শুনলাম। পার্কগুলো থেকে পাখিদের শেষ কিচির-মিচির কানে এল। স্যান্ডউইচ যারা ফিরি করে তাদের ডাক শহর, যে দিকে উঁচু সেখানকার খাড়া বাঁকগুলোতে ট্রামের কর্কশ চাকার আওয়াজ আর বন্দরের ওপর অন্ধকার নেমে আসবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে সেই মৃদু মর্মর ধ্বনি - সব মিলে আমার জেলখানায় ফিরে যাওয়া অজস্র স্মৃতিতে ভরে তুলল। এ যেন অতি পরিচিত রাস্তায় কোন অন্ধের যাত্রা।
হ্যাঁ সন্ধ্যায় এই সময়টিতেই - সে যেন কতকাল আগে আমি বরাবর একটি অপূর্ব প্রশান্ত তৃপ্তি অনুভব করেছি। এই সন্ধ্যার পর জানতাম আসবে স্বপ্নহীন ঘুমের রাত।
সেই সময়টিই এসেছে কিন্তু কত তফাত। এখন ফিরছি আমার জেলের কুঠুরীতে। সেখানে যে রাত আসছে তা আগামী দিনের দুর্ভাবনায় কন্টকিত। আজ এই কথাটিই বুঝলাম যে গ্রীষ্মের গোধূলি বেলায় বহু স্মৃতিজড়িত পথ নিশ্চিন্ত নিদ্রার রাত্রির দিকে যেমন তেমনি জেলখানাতেও নিয়ে যেতে পারে।
আসামীর কাঠগড়া থেকেও নিজেকে আলোচিত হতে শনুলে মজা লাগে। সরকারী ও আমার উকিলের বক্তৃতায় আমার সম্বন্ধ অনেক কথাই বলা হয়েছে। আমার অপরাধ সম্বন্ধে যত না আলোচনা হয়েছে তার চেয়ে বেশী হয়েছে আমার ব্যক্তিগত চরিত্র সম্বন্ধে।
দুই উকিলের বক্তৃতার মধ্যে খুব বেশী কিছু তফাত সত্যি নেই। আসামীর উকিল শূন্যে হাত তুলে অপরাধ কবুল করে তার কারণ দেখাতে চেয়েছেন। সরকারী উকিলও সেই ভঙ্গী করে আসামীকে অপরাধী বলেছেন। এ অপরাধের কোন বাহ্যিক কারণ থাকতে পারে তিনি মানতে রাজী নন।
বিচারের এই পর্বে একটা ব্যাপার বড় বিশ্রী লেগেছে। আর সকলের কথা শুনতে শুনতে প্রায়ই দু একটা কথা নিজে থেকে বলতে লোভ হয়েছে। কিন্তু আমার উকিল আমায় নিষেধ করেছেন। আমায় সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, তাতে আমার মামলায় সুবিধা হবে না। মনে হচ্ছিল বিচারের সব কিছু থেকে আমায় বাদ দেবার যেন একটা ষড়যন্ত্র চলছে। আমার নিয়তির যেখানে হেস্তনেস্ত হচ্ছে সেখানে আমার কিছু বলার উপায় নেই।
এক এক সময়ে খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলাতে হয়েছে। হঠাৎ অদম্য ইচ্ছে হয়েছে সকলকে থামিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠি। - বলি বিচারটা হচ্ছে কার? আমি জানতে চাই। খুনের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ান খেলার কথা নয় আর আমার সত্যিকার জরুরী কিছু জানাবার আছে।
কিন্তু তারপর একটু ভেবে নেবার পর মনে হয়েছে সত্যিই বলবার তো কিছু আমার নেই। আমার দিক থেকে স্বীকার করছি যে নিজের সম্বন্ধে আলোচনাতেও কিছুক্ষণ বাদে আর মন লাগে না। সরকারী  উকিলের বক্তৃতাতে তো কিছুক্ষণ বাদেই বিরক্তি ধরে গেল। মাঝে মাঝে দু একটা বকুনি তাঁর অঙ্গভঙ্গি আর খুব ফলাও কিছু গালাগাল যা একটু আধটু মনে রইল।
খুনটা আগে থাকতেই আমি এঁচে রেখেছিলাম এই দেখানই সরকারী উকিলের উদ্দেশ্য বুঝলাম। মনে পড়ছে, একবার তিনি জুরীদের উদ্দেশ্য করে বললেন যে তাঁর কথাটা অক্ষরে অক্ষরে তিনি প্রমাণ করতে পারেন।
প্রথমে খুনের ঘটনাগুলো ধরুন, যা দিবালোকের মত স্পষ্ট। তারপর যাকে বলা যায় এ মামলার অন্ধকার দিকটাও বুঝুন - এক পাষন্ডের মনের বিচিত্র গতি সেখানে পাবেন।
আমার মা-র মৃত্যু থেকে পর পর সমস্ত ঘটনাগুলো এবার সরকারী উকিল সংক্ষেপে সাজিয়ে গেলেন। আমার নির্মমতার ওপর জোর দিয়ে মার- বয়স বলতে না পারার কথা তুলে, সাঁতার কাটতে গিয়ে মারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, ফার্ণান্ডেল-এর হাসির ছবি দেখতে যাওয়া ও মারীকে আমার ঘরে নিয়ে আসা পর্যন্ত কিছু উল্লেখ করতে ভুললেন না। তারপর রেমন্ডের কথা পড়লেন। যেভাবে ঘটনাগুলো তিনি বললেন তাতে ভেতরে ভেতরে একটা চালাকি আছে মনে হল। তাঁর কথাগুলো শুনলে বিশ্বাস হয়। আমি রেমন্ডের সঙ্গে ষড় করে তার রক্ষিতাকে ফন্দি করে তার ঘরে আপনার জন্যে চিঠি লিখেছি। যাকে দিয়ে সেই মেয়েটিকে মার-ধোর খাইয়েছি সেই রেমন্ডের চরিত্র কি রকম তা ব্যাখ্যা করে সরকারী উকিল বললেন যে রেমন্ডের সঙ্গে যাদের ঝগড়া তাদের আমি খুঁচিয়ে একটা গোলমাল বাধিয়েছি। রেমন্ড তাতে আহত হয়েছে। তার রিভলভার চেয়ে নিয়ে গুলি করবার জন্যেই আমি ফিরে গেছি। একবার গুলি করে আমি একটু অপেক্ষা করেছি, তারপর একেবারে কাজে কোন খুঁত না রাখবার জন্যে পর পর আরো চারবার গুলি যখন ছুড়েছি তখন উত্তেজনার কিছু ছিল না, রক্ত গরম হবার কোন কারণও নয়।
- আমার এর বেশী কিছু বলবার নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে আসামী যে এই খুন করেছে ঘটনাগুলি থেকে আমি তা দেখিয়ে দিয়েছি। হঠাৎ মাথা গরম হয়ে এ খুন হয় নি, তাহলে অন্তত আসামীর স্বপক্ষে কিছু বলার থাকত। আসামী যে শিক্ষিত তা জুরীদের আমি মনে রাখতে বলি। সে বুদ্ধিমান, ভাষার মূল্য বোঝে। আমার জেরার জবাব যেভাবে সে দিয়েছে তা নিশ্চয় আপনারা লক্ষ্য করেছেন।  আমি আবার বলছি যে খুন করার সময় কি করছিল সে বুঝতে পারে নি  এ অনুমান কোন মতেই করা চলে না।
দেখলাম আমার বুদ্ধির ওপর সরকারী উকিল খুব জোর দিলেন। সাধারণ লোকের বেলা যেটা গুণ, অপরাধী হিসেবে যে অভিযুক্ত তার বেলা সেইটেই অপরাধের মস্ত প্রমাণ কেন ধরা হয় বুঝতে পারলাম না। এই কথাটা ভাবতে ভাবতেই সরকারী উকিলের পরের কয়েকটা কথা শুনতে পাই নি। হঠাৎ চমকে উঠে শুনলাম তীব্র ঘৃণাভরে তিনি বলছেন, আর এই নৃশংস হত্যার জন্যে একবারও তার একটু অনুশোচনা আমরা দেখেছি? একটি কথাতেও না। এই মামলার সমস্ত শুনানির মধ্যে তার এতটুকু অনুতাপের পরিচয় পাওয়া যায় না।
কাঠগড়ায় আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে সেই সুরেই আরো অনেক  কিছুই বলে চললেন। ওই এক কথাই বারবার বলার কি মানে বুঝতে পারছিলাম না। তিনি বেঠিক কিছু বলেন নি অবশ্য স্বীকার করছি। খুব বেশী অনুতাপ যে আমার হচ্ছিল তা বলতে পারি না। তবে উনি যেন একটু বাড়াবাড়ি করছিলেন। সুযোগ থাকলে তাঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে বুঝিয়ে বলতাম যে জীবনে কোন কিছুর জন্যে খুব আফশোস কখনো আমার হয় নি। যা হচ্ছে আর হবে তাইতেই সাধারণ আমি এত মশগুল থাকি যে পিছুপানে চাইবার-ই আমার ফুরসত থাকে না। অবশ্য আমার যা অবস্থা তাতে কারুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সুরে কথা বলাই আমার অসম্ভব। কারুর প্রতি প্রীতি দেখানো কি মনে কোন সদিচ্ছা থাকার যেন আমার অধিকারই নেই।
সরকারী উকিল এখন আমার ‘আত্মা’র কথা বলছিলেন। তাঁর কথায় মন দেবার চেষ্টা করলাম।
তিনি বললেন যে আমার ওই বস্তুটি নাকি তিনি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছন এবং শেষ পর্যন্ত জেনেছেন যে ওই বস্তুটিরই আমার অভাব। সত্যি আমার আত্মা বলে কিছু নেই। সবই আমার অমানুষিক। যে সব নীতিবোধ সাধারণ মানুষের থাকে তার কোন চিহ্ন আমার মধ্যে পাওয়া যায় না।
এর জন্যে তিনি যেন আমার স্বপক্ষেই বললেন, ‘ওকে অবশ্য নিন্দা করা যায় না। এ বস্তু অর্জন করা যদি কারুর ক্ষমতার বাইরে হয় তাহলে তা না থাকার জন্যে তাকে দোষী করা উচিত নয়। তবে ফৌজদারী আদালতে উদার সহিষ্ণুতার  আদর্শ অচল। আরো মহৎ কঠিন সুবিচারের আদর্শই এখানে অনুসরণীয়। বিশেষ করে সেই মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণ সুপ্রবৃত্তি ও নীতিবোধের অভাবে যে মানব সমাজের শত্র“।’
আবার আমার মা-র প্রতি ব্যবহারের আলোচনা চলল। এত কথা আমার অপরাধ সম্বন্ধে তিনি বলে চললেন যে আমি ক্রমশ খেই হারিয়ে ফেললাম। শুধু তখন টের পাচ্ছিলাম যে গরম ক্রমশ বাড়ছে।
কিছুক্ষণ বাদে সরকারী উকিল একবার হঠাৎ থেকে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চাপা কম্পিত গলায় বললেন, এই আদালতেই আপনারা জানে বোধ হয় কাল গর্হিততম এক অপরাধের বিচার হবে - পিতৃহত্যার বিচার।
এ অপরাধ যে তাঁর কাছে প্রায় কল্পনাতীত তা বুঝিয়ে দিয়ে সরকারী উকিল সে মামলার সুবিচার হবে বলে আশা জানালেন। সেই সঙ্গে না বলে পারলেন না যে আমার অমানুষিক হৃদয়হীনতায় যে ঘৃণা তাঁর হচ্ছে তার কাছে সেই পিতৃহত্যার পাতকের বিভীষিকাও ম্লান হয়ে গেছে।

মা-র মৃত্যুর জন্যে নৈতিকভাবে যে দায়ী আর নিজের পিতাকে যে হত্যা করেছে এরা দুজেনই মানুষের সমাজে স্থান পাবার সমান অযোগ্য। আর বলতে গেলে একটি অপরাধ থেকেই আর একটি আপনা থেকে আসে। এই দুই অপরাধীর মধ্যে আজ যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে সেই একরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলা যায়।
সরকারী উকিল গলাটা আর একটু চড়িয়ে বললেন, ‘আমি কিছু বাড়িয়ে বলছি না। কাল আদালতে যে অপরাধের বিচার হবে আজকের আসামী তার জন্যেও দায়ী বলে আমি মনে করি। আপনাদের কাছে তাই উপযুক্ত রায়ই পাব বলে আমি আশা রাখি।’
সরকারী উকিল মুখ থেকে ঘাম মোছবার জন্যে থামলেন। তাঁর কর্তব্য যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক তা বুঝিয়ে দিয়ে তিনি জানালেন যে তবু তিনি পেছপাও নন।
অম্লান বদনে সে সমাজের মূল নীতি এই আসামী লঙঘন করে সে সমাজে তার স্থান নেই। নিজে হৃদয়হীন হয়ে ক্ষমা পাবার দাবিও সে করতে পারে না। আমি আপনাদের আইনের চরম দন্ডই দিতে বললব, বলব অকম্পিত  চিত্তে। দীর্ঘকাল আমি ওকালতি করছি। অনেকবারই মৃত্যুদন্ড কতর্ব্যবোধে আমায় চাইতে হয়েছে, কিন্তু এমন দ্বিধাহীন বুঝি কোন অপরাধীর বেলা আমি হতে পারি নি। আজ এই দন্ড দাবি করে আমি শুধু আমার বিবেকের নির্দেশই অনুসরণ করছি।’
সরকারী উকিল এবার বসলেন।  বেশ কিছুক্ষণ সমস্ত আদালত একেবারে স্তব্ধ। আমি নিজে, কতকটা যা শুনলাম তাতে অবাক হয়ে, কতকটা অসহ্য গরমে তখন অভিভূত।
প্রধান বিচারপতি একটু কেশে অত্যন্ত মৃদুকন্ঠে আমার কিছু বলবার আছে কিনা আমায় জিজ্ঞেস করলেন।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। তখন কথা বলবার ঝোঁক এসেছে, প্রথমেই যা মনে এল তা বলে ফেললাম। বললাম যে লোকটিকে খুন করবার কোন বাসনা আমার ছিল না।
বিচারক বললেন যে আদালত এ কথা বিচার করে দেখবে। তবে আমার উকিলের বক্তব্য শুরু হবার আগে তিনি এ অপরাধের মূলে কি আছে জানতে উৎসুক। এখনও পর্যন্ত আমার কৈফিয়ত যে কি তিনি তা ভালো করে বুঝতে পারেন নি বলে স্বীকার করলেন।
শুধু রোদের তাতেই ব্যাপারটা ঘটেছে আমি বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কথা আমি তখন বড্ড তাড়াতাড়ি বলছি। কথার সঙ্গে কথা জড়িয়ে গিয়ে সব যে প্রলাপের মত শোনাচ্ছে তা বেশ ভালোই টের পাচ্ছিলাম। চাপা হাসির শব্দও চারিধারে শুনতে পেলাম।
আমার উকিল হতাশা ও বিরক্তির সঙ্গে কাঁধ দুটোয় একটু ঝাঁকুনি দিলেন। তাঁকে এবার যা বলবার বলতে নির্দেশ দেওয়া হল। কিন্তু তিনি আর সময় নেই বলে পরের দিন বিকেল পর্যন্ত বিচার স্থগিত রাখবার আর্জি জানালেন।
বিচারকেরা তাঁর আর্জি মঞ্জুর করলেন।
পরের দিন আমায় যখন আদালতে নিয়ে এল তখনও তেমনি গরম। ইলেকট্রিক ফ্যানগুলো যে আগের মতই ভারী হাওয়া ছড়াচ্ছে। জুরীরা তাদের বাহারে পাখাগুলো এক ছন্দে নেড়ে চলেছে।
মনে হল আমার উকিলের বক্তৃতা আর শেষ হবে না। একবার একটা কথায় আমার কান খাড়া হয়ে উঠল। শুনলাম আমার উকিল বলছেন - ‘আমি একজন মানুষ খুন করেছি সত্য।’
আমার উকিল ওই সুরেই বলে চললেন। আমার ওকালতি করতে গিয়ে সব জায়গায় তিনি ‘আমি’ ‘আমি’ই করছেন। দেখলাম। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল বলে আমার পাহারার পুলিসকে মানেটা জিজ্ঞেস করায় সে আমায় প্রথম চুপ করতে বলল। খানিকবাদে চুপি চুপি জানালে যে এই রকম বলাই এখানকার দস্তুর। আমার মনে হল সমস্ত মামলার ব্যাপার থেকে আমায় দূরে সরিয়ে রাখাই যেন এ ব্যাপারের উদ্দেশ্য। আমার বদলী আমার উকিলকে দাঁড় করিয়ে আমাকে একেবারে উড়িয়েই যেন এরা দিতে চায়। যাই হোক কিছু এমন তাতে এসে যায় না। এমনিতেই যেন এ মামলা আর এই আদালত থেকে বহু দূরে আমি চলে গেছি মনে হচ্ছিল।
আমার উকিলের ওকালতি এত দুর্বল যে আমার প্রায় হাস্যকর মনে হচ্ছিল। আমার উত্তেজনার কারণ থাকার অজুহাতটা কোন রকমে দেখিয়ে তিনিও আমার ‘আত্মা’ নিয়ে পড়লেন। সরকারী উকিলের তুলনায় তাঁকে নিরসই আমার মনে হল।
তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমিও আসামীর আত্মা ভালো করে বিচার করে দেখেছি। আমার বিজ্ঞ বন্ধু সেখানে কিছু পান নি। কিন্তু আমি পেয়েছি। সত্যি করে বলতে পারি যে আসামীর মন আমার কাছে খোলা বই-এর মত সুস্পষ্ট।
খোলা বই-এ তিনি যা পড়েছেন তা এবার জানালেন। আমি তাঁর মতে চমৎকার মানুষ। অস্থির চঞ্চল নই, কাজে মন আছে মনিবের কাজে ফাঁকি দিতে জানি না। সকলে আমায় ভালবাসে অন্যের দুঃখ কষ্টে আমার প্রাণ গলে। ছেলে হিসেবেও আমার কর্তব্যজ্ঞান যথেষ্ট। যতদিন ক্ষমতা ছিল কোন আশ্রমে থাকলে মা অনেক সব সুখ সুবিধা পেতে পারেন, পয়সার অভাবে আমার কাছে যা পাবার আশা নেই।
আমার বিজ্ঞ বন্ধু আশ্রম সম্বন্ধে যে মনোভাব দেখিয়েছেন তাতে আমি বিস্মিত। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল্য যে কতখানি এগুলি সরকারী সাহায্যে ও উৎসাহে প্রতিষ্ঠিত বললেই আশা করি বোঝা যাবে।
দেখলাম আমার উকিল মার শেষকৃত্য সম্বন্ধে কিছু বললেন না। এ প্রসঙ্গ বাদ দেওয়াটা গুরুতর ত্র“টি বলেই মনে হল। কিন্তু তাঁর অফুরন্ত বক্তৃতা দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘন্টা আমার ‘আত্মা’ নিয়ে ওদের আলোচনা সব মিলে আমার মনটা কেমন যেন ঝাপসা করে দিয়েছে। একটা ধোঁয়াটে তরল কুয়াশায় যেন সব কিছু গলে গেছে।
একটা ঘটনাই শুধু তার মধ্যে জেগে আছে স্মৃতিতে। আমার উকিল তখন বকে চলেছেন। হঠাৎ রাস্তায় এক আইসক্রীম ফেরিওয়ালার টিনের ভেঁপুর আওয়াজ শুনতে পেলাম। তীক্ষè শব্দটা কথার স্রোত কেটে যেন বেরিয়ে এল। সেই সঙ্গে স্মৃতির বন্যা আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। যে জীবনে আমার আমার কোন স্থান নেই তার স্মৃতি। একদিন সামান্য যে সব বস্তু ও বিষয় থেকে সত্যিকার আনন্দ পেয়েছি, সেই গ্রীষ্মের পৃথিবীর ঘ্রাণ, আমার পরিচিত সব রাস্তার ছবি, সন্ধ্যায় আকাশের রূপ, মারীর নানা পোশাক আর তার হাসি পর পর মনের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। এখানে যা হচ্ছে তার নিষ্ফলতায় যেন আমার দম বন্ধ হয়ে এল। মনে হল বমি হয়ে যাবে। এখন শুধু এই সব কিছু শেষ করে দিয়ে নিজের জেলের কুঠুরিতে ফিরে যেতে চাই - চাই ঘুমোতে শুধু ঘুমোতে....
অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম আমার উকিল শেষ আবেদন জানাচ্ছেন।
‘জুরী মহোদয়গণ, শুধু একটি মুহূর্তের জন্য আত্মসংযম হারিয়েছে বলে ভদ্র একটি পরিশ্রমী যুবককে আপনারা নিশ্চয় মৃত্যুদন্ড দেবেন না। সারাজীবন যে অনুশোচনায় সে দগ্ধ হবে তাই কি তার যথেষ্ট শাস্তি নয়? আমি আপনাদের দন্ডাদেশের অপেক্ষাই রইলাম, নিশ্চিন্ত মনেই রইলাম
এই জেনে যে এ ব্যাপারে আনুসঙ্গিক কারণ আছে বুঝে উপযুক্ত দন্ডবিধানই আপনারা করবেন।’
আমার উকিল বসলেন। আদালতের শুনানিও তখনকার মত স্থগিত রইল। আমার উকিলকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাঁর কয়েকজন সতীর্থ এসে তাঁর করমর্দন করলেন। ‘চমৎকার বলেছ বন্ধু?’ একজনকে মন্তব্য করতে শুনলাম। আরেকজন উকিল তো আমাকেই সালিসি মেনে বললেন - ‘খুব ভালো না হে?’ আমি সায় দিলাম, তবে সরল মনে নয়। তখন আমি এত ক্লান্ত যে ভালো মন্দ বোঝবার ক্ষমতা আমার নেই।
বেলা এদিকে পড়ে এসেছে। গরম এখন অনেক কম। বাইরে থেকে অস্পষ্ট যা দু-একটা আওয়াজ আসছিল তাতে বুঝলাম সন্ধ্যার সঙ্গে বাইরে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। আমরা সবাই অপেক্ষা করে বসে আছি। অপেক্ষা যে জন্যে করছি তা কিন্তু আর কারুর নয় শুধু আমার একলারই ভাগ্যের সঙ্গে জড়ানো।
আদালতের চারিদিকে একবার চোখ বুলোলাম। প্রথম দিন যেমন দেখেছিলাম সবই ঠিক সেই রকম। ছাই রঙের পোশাক পরা সেই সাংবাদিকের সঙ্গে চোখাচোখি হল। সেই কলের পুতুলের মত মহিলাকেও দেখলাম। এই বার মনে পড়ল যে এতক্ষণে একবারও মারীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়ের চেষ্টা করিনি। তার কথা যে ভুলে গেছি তা নয়, শুধু সময়ই যেন পাই নি। দেখলাম সিলেস্তি আর রেমন্ডের মাঝখানে সে বসে আছে। আমায় দেখে একবার হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানালে। যেন সে বলতে চাইলে - এতক্ষণে ! সে হাসছে, কিন্তু বুঝতে পারলাম মনে তার উদ্বেগ। আমার বুক কিন্তু যেন পাথর হয়ে গেছে। তার হাসির জবাবে হাসতেও পারলাম না।
বিচারেকরা তাঁদের আসনে ফিরে এসে বসলেন। কে একজন খুব তাড়াতাড়ি জুরীদের কি সব পড়ে শোনালে। একটা আধটা কথা ধরতে পারলাম। ‘হিংসাবশে পূর্বকল্পিত হত্যা’.... ‘উত্তেজনার হেতু’ ....‘আনুসঙ্গিক কারণ।/‘
জুরীরা বেরিয়ে গেলেন। আমায় আগের ঐ কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। আমার উকিল আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁর মুখে এখন খই ফুটছে। তাঁর কথাবার্তায় ব্যবহারে আরো ঘনিষ্ঠতা ও আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া গেল। তিনি আমায় আশ্বস্ত করে বললেন সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়েক বছর জেল বা বড় জোর দ্বীপান্তর আমার হতে পারে।
জানতে চাইলাম খালাসের কোন আশা আছে কিনা। তিনি বললেন যে আশা নেই। আইনের কোন প্রশ্ন তিনি তোলেন নি কারণ তাতে জুরীরা বিগড়ে যেতে পারেন। কোন রায় একমাত্র আইনের মার - পাঁচেই বাতিল করে দেওয়া যায়। নইলে তা বাতিল করান অত্যন্ত কঠিন। তাঁর কথাটা বুঝলাম। নির্লিপ্তভাবে বিচার করে তাঁর মতটাই ঠিক মনে হল। ব্যাপার অন্যরকম হলে মামলার আর শেষ থাকবে না। ‘ যাই হোক’, আমার উকিল বললেন, ‘আপনি সাধারণভাবে আপীল করতে পারেন। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস রায় আপনার পক্ষেই দেওযা হবে।’
অনেকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হল। প্রায় পৌনে এক ঘন্টা। তারপর একটা ঘন্টা বাজল। আমার উকিল উঠে যেতে যেতে বললেন, - ‘জুরীদের মাতব্বর এবার তাঁদের জবাব পড়ে শোনাবেন। তারপর আপনাকে রায় শোনাবার জন্যে ডাকা হবে।’
দরজার শব্দ এদিকে ওদিকে শোনা গেল। সিঁড়ি দিয়ে নানা জনের নামা ওঠার শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু কাছে না দূরে বুঝতে পারলাম না। তারপর শুনলাম আদালতে একঘেয়েভাবে কে কি যেন বলে চলেছে। আবার ঘন্টা বাজবার পর আমি কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আদালতের নিস্তব্ধতা আমায় ঘিরে ধরল। আর সেই নীরবতার মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি টের পেলাম। দেখলাম সেই তরুণ সাংবাদিক আমার দিক থেকে মুখটা ফিরিয়ে রেখেছে। 
মারীর দিকেও আমি চাইনি। চাইবার সময়ও ছিল না, কারণ প্রধান বিচারপতি তখন আদালত প্যাঁচাল ভাষায় তাঁর রায় দিতে দিতে এই কথাই বলেছেন ফরাসী জাতির নামে কোন প্রকাশ্য স্থানে আমার শিরñেদ করা হবে।
মনে হল উপস্থিত সকলের চোখের দৃষ্টির মানে আমি যেন তখন বলে দিতে পারি। প্রায় সকলেরই চোখে বেদনা, সহানুভূতি। পুলিস কনস্টেবল পর্যন্ত আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে। আমার উকিল আমার হাতটা একবার ছুঁলেন।
আমার চিন্তা করবার কোন ক্ষমতা তখন আর নেই। শুনতে পেলাম আমার কিছু আর বলবার আছে কিনা বিচারক জিজ্ঞেস করছেন। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললাম, - না।
পুলিস কনস্টেবল আমায় বাইরে নিয়ে গেল।
এই নিয়ে তিনবার জেলের পাদ্রীর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেছি। তাঁকে কিছু আমার বলবার নেই। বলবার ইচ্ছেও হয় না। আর শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে শীগগির দেখা তো হচ্ছেই।
এখন আমার একমাত্র চিন্তা এই যান্ত্রিক নাগপাশ থেকে মুক্তির উপায় আছে কিনা, - যা অমোঘ তারও কোন ছিদ্র কোথায় পাওয়া যেতে পারে কিনা তাই জানা।
আমাকে আরেকটা কুঠুরিতে এরা এনেছে। এখানে চিৎ হয়ে শুয়ে আমি আকাশ দেখতে পাই। আর কিছু দেখবার নেই। আমি শুধু দেখি আকাশের রঙ কেমন ধীরে ধীরে বদলায় তারপর রাত্রি নামে।
কোথাও ছিদ্র কিছু থাকতে পারে কিনা এই আমার এখন একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। ভাবি ফাঁসির কোন আসামী কোথাও শেষ মুহূর্তে পুলিশ পাহারা এড়িয়ে গিলোটিনের খাঁড়া ঠিক পড়বার আগে পালাতে পেরেছে  কিনা। আফশোষ হয় কেন এ বিষয়ে আগে তেমন মন দিই নি। কি যে হতে পারে কেউ বলতে পারে না। আর সকলের মত খবরের কাগজে ফাঁসির বর্ণনা পড়েছি, কিন্তু এ বিষয়ে বিশদ বিবরণের বই নিশ্চয় আছে।  তাতে হয়ত ফাঁসির আসামীর পালাবার খবর পেতাম। তাতে হয়ত এমন কোন ঘটনার উল্লেখ থারকত যাতে নিয়তির অমোঘ চাকা ঘুরতে ঘুরতে থেমে  গিয়ে কাউকে বাঁচাবার একটা শুভ সুযোগ দিয়েছ। একটা এরকম দৃষ্টান্ত পেলেই আমি খুশি হতাম। বাকি আমি কল্পনা করে নিতে পারতাম।
খবরের কাগজে লেখে ----‘সমাজের কাছে ঋণ’। তাদের মতে অপরাধীকে এই ঋণ শোধ করতে হয়। এ ধরনের কথা মনে দাগ কাটে না। কোন রকমে এক ছুটে তাদের এই হিংস্র অনুষ্ঠান ব্যর্থ করে পালাতে পারি কিনা আমার কাছে এইটেই একমাত্র চিন্তা। এক মুহূর্তের আশা তা হলে আমি পাই, জুয়াড়ীর শেষ ‘দান’ এর মত।
তার পাগলামি কি তা অবশ্য জানি। মোড় না ঘুরতেই মাথায় বাড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া কিংবা পিঠে একটি গুলি। তবু সেটুকু কল্পনা বিলাসের সুযোগও আামার নেই। আমি ইঁদুর কলে জম্পেশ করে আটকানো।
এই নিষ্ঠুর নিশ্চয়তাটাই সহ্য করতে পারি না কিছুতে। দন্ডাদেশ আর অপরিবর্তনীয় যে ঘটনাপরম্পরায় তা দেওয়া হয়েছে দুইয়ের মধ্যে কোথায় একটা গরমিল যেন আছে। বিকেল পাঁচটার বদলে সন্ধ্যে আটটায় যদি রায় দেওয়া হয়, তাহলে এই রায়ই যে ভিন্ন হতে  পারত, যারা দন্ডাদেশ দিয়েছে তারাও যে অন্তর্বাস বদলায়, রায়টা যে ফরাসী জাতির নামে বলে অস্পষ্ট একটা কথার সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে - এই সব কিছু মিলে যেন তার গুরুত্ব হালকা করে দিয়েছে। সত্যিই ফরাসী জাতির নামে যদি হয় তো চীনা কি জার্মান জাতির নামেই বা নয় কেন।
কিন্তু রায় একবার উচ্চারিত হবার পরই - তা আমি যে দেওয়ালটা পিঠ দিয়ে আছি তারি মত অটল কঠিন সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই সব কথা ভাবলে মার কাছে শোনা একটা গল্প মনে পড়ে যায়। বাবার গল্প। তাঁকে আমি অবশ্য চোখে কখনও দেখিনি। মা তাঁরসম্বন্ধে যা বলেছেন তাইতেই তাঁর যা কিছু পরিচয় পেয়েছি। বাবা নাকি একবার গিলোটিনে এক খুনীর মুন্ডচ্ছেদ দেখতে গেছিলেন। ব্যাপারটা ভাবতেই না কি তার গা গুলিয়ে উঠত। তবু শেষ পর্যন্ত তিনি দেখেছিলেন আর বাড়ি ফিরে বমি করেছিলেন। গল্পটা যখন শুনি তখন বাবার কান্ড বিশ্রী লেগেছিল। এখন বুঝি সেটা স্বাভাবিক। কেন তখন বুঝি নি যে কারুর মৃত্যদন্ডের চেয়ে গুরুতর ব্যাপার আর কিছু নেই। এক দিক দিয়ে দেখলে মানুষ শুধু এই ব্যাপারেই উৎসুক হতে পারে।
ভাবলাম যদি কখনো ছাড়া পাই মৃত্যুদন্ড যেখানে যেখানে দেওয়া হবে সব জায়গার যাব। এরকম সম্ভাবনার কথা ভাবাই অবশ্য উচিত হয় নি। কারণ ছাড়া পাবার কথা চিন্তা করবার সঙ্গে সঙ্গে কল্পনা করে নিয়েছি পুলিশ পাহারার বাইরে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আর যে খুশিমত কিছু দেখতে এসে ইচ্ছেমত বাড়ি ফিরে বমি করতে পারে নিজেকে এরকম একজন দর্শক ভাবতেই উদ্দাম অর্থহীন এক উল্লাসে মন ভরে গেছে।
কল্পনার এমন রাশ ছেড়ে দেওয়া বোকামীর চূড়ান্ত। এর পরই সারা শরীরে এমন কাঁপুনি এল যে কম্বলে আগাগোড়া মুড়ি দিয়েও সামলাতে পারলাম না। দু পাটি দাঁতের ঠকঠকানি আর থামান গেল না।
কিন্তু সব সময়েই কি সাবধানে হুঁশ রেখে চলা যায়। মাঝে মাঝে আমার মনের একটা কাজ হল নতুন আইন তৈরি করে সাজা বদলে দেওয়া। অপরাধীকেও একটা সুযোগ দিতে হবে, তা যত সামান্যই হোক না এমন কোন ওষুধ তো দেওয়া যায় যাতে রুগীর (অপরাধীকে আমার রুগীই মনে হয়েছে) হাজারে ন-শ নিরেনব্বই বার মরবার সম্ভাবনা। এটা তার আবার জানাও দরকার। অনেক ভেবে চিন্তে আমার মনে হয়েছে, গিলোটিনের আসল দোষ হল এই যে তা থেকে দন্ডিতের পরিত্রাণের বিন্দুমাত্র আশাও নেই। তার মৃত্যু একেবারে অবধারিত। যদি কোন কারণে খাঁড়াটায় একবার কাজ না হয় তাহলে আবার তা চালান হবে। তাতে দাঁড়াচ্ছে এই যে মৃত্যুদন্ড যে পেয়েছে তাকে খাঁড়াটা যাতে নির্ভুল ভাবে পড়ে সেই আশাই করতে হবে। এ ব্যবস্থায় এইটেই ত্র“টি। আরেক দিক দিয়ে দেখলে এ ব্যবস্থা অবশ্য নিখুঁত। দন্ডিতকে মনে মনে অন্তত দন্ড পাওয়ার সাহায্য করতে হবে।
আরেকটা বিষয়ে আমার ভুল ধারণা ছিল। আমি বরাবরই জানি যে গিলোটিন মঞ্চে দন্ডিতকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে হয়। হয়ত ১৭৮৯-এর বিপ্লবের কাহিনী থেকেই এ ধারণা আমার জন্মেছে। স্কুলে যা পড়েছি ও যে সব ছবি দেখেছি তাতে ওই রকমই মনে করা স্বাভাবিক। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। মনে পড়ল খবরের কাগজে একবার এক নামকরা বদমায়েসের গিলোটিনে শিরচ্ছেদের ছবি দেখেছি। যন্ত্রটা আসলে মাটিতেই বসান থাকে। সেটা খুব চওড়াও নয়। এতদিন কেন সে ছবি কথা মনে পড়েও নি ভেবে অবাক লাগল। তখন গিলোটিন-এর পরিপাটি চেহারাটাই মনে লেগেছিল। বিজ্ঞানের কোন যন্ত্রের মত ঝকঝকে চকচকে। যা মানুষ জানে না তার সম্বন্ধে একটু কল্পনার বাড়াবাড়ি থাকে-ই। গিলোটিন-এ মাথা দেওয়াটা কিছুমাত্র গোলমেলে ব্যাপার নয় মানতেই হল। যন্ত্রটা সাধারণ মানুষের চেয়ে উঁচু নয়। যেন চেনা কারুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি এমনিভাবে তার দিকে এগিয়ে যেতে হয়। এ ব্যাপারটাও ভালো লাগে না। একটা উঁচু মঞ্চে ওঠবার সময় সমস্ত পৃথিবীকে এক হিসেবে নিচে ফেলে যাওয়ার মধ্যে কল্পনার একটু অবসর অন্তত আছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা এমন যে যন্ত্রই যেন সবচেয়ে প্রধান মাথাটা বেশ বিবেচনার সঙ্গে নিপুণভাবেই নেওয়া হয় শুধু তাতে একটু গ্লানি ও লজ্জার আভাস।
আর দুটো বিষয়ের কথা প্রায়ই ভাবি। একটা সেই শেষ সকালের কথা, আর আমার আপীলের । এ ভাবনা অবশ্য যথাসম্ভব মন থেকে ঠেলে রাখতে চাই। শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে সেইটেই লক্ষ্য করবার চেষ্টা করি। আলো যখন সবজে হয়ে আসে তখন বুঝি রাত্রির আর দেরি নেই। মাঝে মাঝে নিজের হৃৎপিন্ডের শব্দও শুনি। সারাজীবন যে শব্দ আমার সঙ্গী তা একেবারে থেমে যাবে এ যেন ভাবতেই পারি না। কল্পনা শক্তি আমার খুব জোরালো কখনো নয়। তবু বুকটা যখন আর ধুক ধুক করবে না এমন একটা সময় ভাবতে চেষ্টা করি। বৃথাই । মাথায় সেই  শেষ সকাল আর আপীলের ভাবনাই ফিরে ফিরে আসে। মনকে জোর করে তার রাস্তা ছাড়ানো অসম্ভব বুঝেই শেষে হাল ছেড়ে দিই।
মৃত্যুদন্ডের আসামীকে সকালবেলাই নিয়ে যায় এইটুকু আমি জানি। রাতগুলো সেই সকালের অপেক্ষাতেই কাটে। আচমকা কিছু হাওয়া কোনকালে আমি পছন্দ করি না। যা কিছু ঘটবে তার জন্যে আমি প্রস্তুত থাকতে চাই। এখন তাই যখন পারি দিনের বেলা একটু আধটু ঘুমিয়ে নিই আর রাত্রে ভোরের প্রথম আভাসের জন্যে ওপরের গম্বুজের দিকে চেয়ে থাকি। সবচেয়ে খারাপ লাগে ভোরের সেই আগের সময়টা যখন ওরা সাধারণত নিতে আসে। মাঝরাতের পর থেকেই আমি কান খাড়া করে অপেক্ষা করি। এত রকম শব্দ এর আগে কখনও লক্ষ্য করিনি। কি সব ছোটখাট শব্দ।
এক বিষয়ে তবু আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। এর মধ্যে কোনদিন পায়ের শব্দ আমি শুনিনি। মা বলতেন যে যত দুঃখেই মানুষ পড়–ক কিছু তার মধ্যে সান্ত্বনা থাকেই। সকালে যেই আকাশ ফরসা হয়ে আলোয় আমার কুঠুরি ভরে যায় সেই কথাই আমি ভাবি। পায়ের শব্দও তো শুনতে পারতাম আর বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে যেত তাহলে।
সামান্য একটু আওয়াজেও অবশ্য আমি একেবারে লাফ দিয়ে উঠে ঠান্ডা দরজার কাঠে কান লাগিয়ে দাঁড়াই। তখন একাগ্রতায় নিজের নিঃশ্বাসের শব্দই আমি শুনতে পাই, ঠিক যেন কুকুরের মত হাঁপাচ্ছি। তবু তারও একটা শেষ হয়। আবার চব্বিশ ঘন্টায় মেয়াদ আমি পাই।
আমার আপীল-এর কথাও ভাবি। তা থেকে যতখানি সম্ভব সান্ত্বনা নিঙড়ে নেবার চেষ্টা করি। সবচেয়ে মন্দটাই আগে ভাবি। ভাবি আপিল নামঞ্জুর হয়েছে। তার মানে আমায় মরতে হবে। অন্যদের আগে, নিজেকে বোঝাই যে যাই বলো বাঁচার কোন সুখ তো সত্যি নেই। ত্রিশ  আর তিয়াত্তরে, সবই এক। কারণ যখনই মরি না কেন দুনিয়ায় আর অনেকেই বেঁচে থাকবে, সংসার চলবে আগের মতোই। আজই হোক আর চল্লিশ বছর বাদেই হোক না মরে উপায় নেই। এত সব ভেবেও ঠিক যেরকম সান্ত্বনা পাবার তা কিন্তু পেলাম না।
তবে আয়ুর মেয়াদ ফুরলে মৃত্যু আসবার সময় মনের ভাব কি হতে পারে কল্পনা করে এই হতাশাটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা যায়। মৃত্যু যখন সত্যিই আসে তখন তার সঠিক ধরনটার এমন কোন মূল্য থাকে না। সুতরাং - এই পৌঁছোবার খেই সহজেই হারিয়ে- যায় আপীল নামঞ্জুর হওয়ার জন্যে আমার তৈরি থাকা উচিত। 
অন্য সম্ভাবনাটার কথা ভাববার অধিকার এখন বোধ হয় আমি দাবি করতে পারি। আমার আপীল যদি মঞ্জুর হয়। কথাটা ভাবতেই যে আনন্দের ঢেউ সমস্ত দেহ মন উত্থলে উঠে, চোখে জল এনে দেয় তা থামিয়ে রাখাই কঠিন। আমাকেই কিন্তু শক্ত হয়ে মনটাকে স্থির করতে হবে। কারণ এমনটা হতে পারে ভেবে, সব চিন্তা এলোমেলো হতে দিলে অন্যরকম সম্ভাবনার জন্যে যে সব সান্ত্বনা জমিয়ে রেখেছি তার মানে থাকবে না। মনটা শক্ত করতে পারলে তবেই বেশ কিছুক্ষণের একটা শান্তি পাওয়া যায়। সেটাও কম কথা নয়।
এইরকম একটা সময়ে আবার পাদ্রীর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করলাম। তখন শুয়ে শুয়ে আকাশে গ্রীষ্ম সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার রূপ দেখছি। সমস্ত আকাশে একটা স্নিগ্ধ সোনালী আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে। মনে মনে এইমাত্র আপীল নামঞ্জুর করে দিয়েছি। টের পাচ্ছিলাম নাড়িটা ধীর মন্থর গতিতে চলছে। না, পাদ্রীর সঙ্গে দেখা করতে আমি চাই না।
অনেককাল যা করিনি তাই এবার করলাম। মারীর কথা ভাবতে লাগলাম। বহুদিন সে কোন চিঠি দেয় নি। ফাঁসির আসামীর সঙ্গে ভালবাসার সম্বন্ধ রাখায় তার অরুচি ধরে গেছে বোধ হয়। কিংবা হয়তো তার অসুখ করেছে, মারাই গেছে হয়তো। এ রকমতো হয়। কি করে আর আমি জানব এমন কিছু যোগ দুজনের মধ্যে নেই যাকে পরস্পরের কথা মনে পড়ে। যদি সে মারাই গিয়ে থাতে তার স্মৃতির কি আর দাম! মরে গেলে তার সম্বন্ধে আর কিছু নিশ্চয় ভাবব না। এইটেই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। আমি মরে গেলেও লোকে আমার কথা ভুলে যাবে জানি। সত্যি কথা বলতে গেলে এতে দুঃখের এমন কিছু নেই। যে কোন ধারণাই  একদিন অনায়াসে মেনে নেওয়া যায়।
এই পর্যন্ত ভেবেছি এমন সময় পাদ্রী নিজেই খবর না দিয়ে চলে এলেন। তাঁকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। তিনি সেটা লক্ষ্য করে আমায় ভয় না পেতে বললেন। তাঁকে মনে কেিয় দিলাম যে অন্য এক সময়ে সেই দারুন দিনে ছাড়া তার তো আসবার কথা নয়। তিনি বললেন যে শুধু একটা আলাপ সালাপ করবার জন্যে তিনি এসেছেন। এ আসার সঙ্গে আমার মামলার আপীলের কোন সম্পর্ক নেই। আপীলের কি হয়েছে তিনি জানেনও না।
পাদ্রী আমার বিছানার ওপর বসে আমায় পাশে বসতে বললেন।
আমি রাজী হলাম না। তাঁর ওপর রাগ করে অবশ্য নয়। রাগের কিছু নেই। লোকটিকে অমায়িক ভালোমানুষ মনে হল।
দুই হাঁটুর ওপর হাত রেখে তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলে। হাত দুটো সরু শির ওঠা। যেন ছোট ছোট দুটো চঞ্চল কোনো প্রাণী বলে আমার মনে হচ্ছিল। এরপর তিনি হাত দুটো একবার ধীরে ধীরে ঘষলেন। একইভাবে এতক্ষণ বসে থাকায় তিনি যে ঘরে আছে আমি  যখন প্রায় ভুলেই গেছি তখন হঠাৎ মাথাটা ঝাঁকানি দিয়ে তুলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন - ‘কেন আপনি আামার সঙ্গে দেখা করতে চান নি?’
বললাম যে আমি ভগবানে বিশ্বাস করি না।
‘বিশ্বাস যে করেন না তা ঠিক জানেন?
বললাম ও ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো মানে পাই না। বিশ্বাস আমি করি কি না করি তার এমন কিছু মূল্য নেই।
দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত দুটো তিনি এবার উরুর ওপর রাখলেন। আমার দিকে একরকম না চেয়েই তিনি বললেন যে, ‘অনেক সময়ে মানুষ নিশ্চিত জানে বলে যা মনে করে তা ঠিক নয়।’
আমি উত্তর না দেওয়ায় তিনি আমায় দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি তাই না?’
বললাম, হতে পারে। তবে তিনি যে কথা তুলেছেন তাতে আমার কোন আগ্রহ নেই।’
মুখটা অন্য দিকে একটু ফিরিয়ে তিনি জানতে চাইলেন একেবারে হতাশ হয়ে আমি একথা বলছি কিনা।
বললাম, ‘হতাশা নয় ভয়। আর সেটাই স্বাভাবিক।’
‘তাহলে’ তিনি জোর দিয়ে বললেন,‘ভগবান আপনার সহায় হতে পারেন। আপনার মত অবস্থার যে ক’জনকে, আমি দেখেছি সবাই চরম বিপদে ভগবাণের শরণ নিয়েছে।’
বললাম, তারা যা ভালো বুঝেছে , করেছে। আমার সাহায্যের কোন দরকারই নেই। আর যা ভালো লাগে না তার জন্যে উৎসাহী হয়ে ওঠার সময়ও না।’
হাত দুটো ক-বার নেড়ে তিনি উঠে বলেন। তারপর আলখাল্লাটা একটু টান করে নিয়ে আমায় বন্ধু বলে সম্বোধন করে বললেন যে আমার মৃত্যুদন্ড হয়েছে বলে এসব কথা তিনি আমায় বলছেন না।
তাঁর মতে পৃথিবীর সবাই মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত।
বাধা দিয়ে বললাম, ‘প্রথমত দুটো ব্যাপার এক নয়, দ্বিতীয়ত তাতে কোনো সান্ত্বনাও পাওয়া যায় না।
‘হয়ত তাই।’ বলে তিনি মাথা নাড়লেন, ‘তবু এখুনি না হোক একদিন আপনাকে মরতে হবে-ই। তখন সেই প্রশ্নই উঠবে। সেই ভয়ংকর মুহূর্তে কি করবেন?
‘ঠিক এখন যা করছি তাই।’
এবার তিনি দাঁড়িয়ে উঠে সোজা আমার চোখের দিকে তাকালেন। এ কায়দা আমার জানা। ইমানুয়েল আর সিলেস্তির ওপর এই কায়দা চালিয়ে কতবার মজা করেছি। দশ-বারের মধ্যে ন-বার তারা অস্বস্তির সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দেখলাম পাদ্রী এ কায়দায় পাকা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে স্থির কন্ঠে তিনি বললেন, ‘কোন আশা কি আপনার নেই? আপনি কি মনে করেন মরলেই সব ফুরিয়ে যাবে, কিছু থাকবে না?’
‘তাই মনে করি’ - জানালাম।
চোখ নামিয়ে তিনি আবার বসলেন। জানালেন যে আমার জন্যে সত্যিই তিনি  দুঃখিত। আমার মত যারা ভাবে তাদের জীবন তো দুর্বহ তিনি মনে করেন।
এইবার আমার বিরক্তি লাগছিল। দেয়ালে একটা কাঁধ ঠেকিয়ে ভর দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইলাম। তাঁর কথায় তেমন কান না দিলেও বুঝলাম তিনি আমায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছেন। তাঁর গলার স্বরের উত্তেজনা থেকে মনে হল সত্যি তিনি ব্যথিত। তাই তাঁর কথায় একটু মন দিলাম।
তিনি বলছিলেন যে আমার আপীল মঞ্জুর হবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। তবে আমার পাপের ভাব থেকে আমায় মুক্ত হতে হবে। তাঁর মতে মানুষের বিচার নিতান্তই ভুয়ো, ঈশ্বরের বিচারই সত্য।
বললাম মানুষের বিচারেই আমি দন্ডিত।’
‘তা ঠিক। তবে তাতেও আপনার পাপের স্খলন হবে না’।
জানলাম যে কোন পাপের গ্লানি আমার মনে নেই। আমি এইটুকু জানি যে, একটা অন্যায় অপরাধ আমি করেছি। সে অপরাধের শাস্তি যখন আমি নিচ্ছি তখন আমার কাছে আর কিছু কারুর আশা করা উচিত নয়।
তিনি আবার উঠে দাঁড়ালেন। সংকীর্ণ ঘর। দুজনের নড়াচড়ার মত জায়গা কম। তিনি আমার দিকে এক পা এগিয়ে থামলেন। আর এগুবার যেন তাঁর সাহস নেই।
ওপরের দিকে চেয়ে তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, - আপনি ভুল করছেন। আপনার কাছে আশা করবার এখনো কিছু আছে। সে আশা এখনো যায় নি।’
‘কি বলতে চান আপনি’
‘আপনাকেই হয়ত দেখতে হবে.....’
‘কি?’
পাদ্রী আমার কুঠুরির চারিধারে তাকালেন। এবার তাঁর গলার স্বর করুণ।
বললেন, - ‘এই যে পাথরের দেওয়াল, এ দেওয়াল আমার ভালো করে জানা। মানুষের বেদনায় এ দেওয়াল গাঁথা। তাই ওদিকে চাইলে আমি শিউরে উঠি। কিন্তুূ, বিশ্বাস করুন আমি প্রাণ থেকে বলছি যে একদিন এই দেওয়ালের ধূসরতা থেকেই অতি বড় পাষন্ডের চোখেও এক স্বর্গীয় মুখ ফুটে ওঠে। সেই মুখই আপনাকে দেখতে হবে’।
কথাগুলো একটু সাড়া জাগাল। তাঁকে জানালাম যে মাসের পর মাস ওই দেওয়ালগুলোর দিকে চেয়ে আমি কাটিয়েছি। আমার সব মুখস্থ। এককালে একটা মুখ ওখানে দেখবার চেষ্টা আমি করেছি। কিন্তু সে মুখে সোনালী রোদের আভা, তাতে কামনার দীপ্তি। সে মুখ মারীর। কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ। সে মুখ আমি দেখতে পাই নি। দেখবার চেষ্টাও এখন ছেড়ে দিয়েছি। আমি অন্তত তাঁর ভাষায় ওই দেওয়ালে কোন মুখ ফুটেই উঠতে দেখিনি।
আমার দিকে বিষণœভাবে চেয়ে মৃদুকন্ঠে কি তিনি বললেন আমি ধরতে পারলাম না। তারপর হঠাৎ তিনি জানতে চাইলেন আমাকে তিনি চুমু খেতে পারেন কিনা।
বললাম, - না।! তিনি কাছে এসে দেওয়ালে একবার হাত বুলিয়ে গলা নামিয়ে বললেন - ‘এই সব পার্থিব জিনিস কি আপনি এত ভালেবাসেন?’
উত্তর দিলাম না।
কিছুক্ষণ অন্য দিকে চেয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। ক্রমশই আরো বিরক্তি লাগছিল। তাঁকে চলে যেতে বলতে যাচ্ছি এমন সময় তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে আবেগভরে বললেন, - ‘না, না এ আমি বিশ্বাস করি না। নিশ্চয়ই আপনি কখনো না কখনো মৃত্যুর পর কিছু আছে বলে ভেবেছেন।’
‘তা তো ভেবেইছি।’ তাঁকে জানালাম, - ‘সকলেই একবার না একবার ভাবে। কিন্তু সে তো বড়লোক হতে চাওয়া কি সাতারে আরো ভালো হওয়া বা আরো সুন্দর হতে চাওয়ার মতই। তার কোন দাম নেই।’
আরো অনেক কিছু বলছিলাম। তিনি বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন - মৃত্যুর পর কি হতে পারে বলে আমি ভেবেছি।
প্রায় চীৎকার করে বললাম - ‘এমন কোন অবস্থা যেখানে এ জীবনের সব কিছু আমি স্মরণ করতে পারি, এর বেশী কিছু নয়।’
ওই সঙ্গে তাঁকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বললাম।
কিন্তু ঈশ্বর সম্বন্ধে এখনো আরো কিছু বলা তাঁর বাকি, বোঝা গেল।
আমি তাঁর কাছে গিয়ে শেষবার বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে আমার জীবনের মেয়াদ যেটুকু আছে ঈশ্বর নিয়ে ভেবে তা আমি নষ্ট করতে নারাজ।
তিনি কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, যে পাদ্রী জেনেও তাঁকে আমি যথোচিত পিতৃ সম্বোধন কেন করিনি।
আরো জ্বলে উঠে বললাম যে তিনি তো আমার সত্যি বাবা নন! বরং তিনি আমার বিপক্ষ দলের লোক।
‘না, না, আমি তোমারই দিকে।’ আমার কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, - ‘তোমার হৃদয় পাথর হয়ে গেছে বলে তুমি বুঝতে পারছ না। তবু তোমার জন্যে আমি প্রার্থনা করব।’
কি যে তারপর হয়ে গেল আমি জানি না। আমার ভেতরে কি যেন চুরমার হয়ে গেল। প্রাণপণে চীৎকার করে আমি তাঁকে গালাগাল দিতে লাগলাম। বললাম, আমার জন্যে প্রার্থনার পন্ডশ্রম তাঁর দরকার নেই। তাঁর আলখাল্লার গলার দিকটা তখন আমি চেপে ধরেছি। রাগে আর তার সঙ্গে কি এক উল্লাসের উত্তেজনায় যা কিছু এতদিন আমার মগজের মধ্যে গজগজ করেছে সব আমি উগরে দিতে লাগলাম।
কি সবজান্তা তাঁর ভাব! অথচ তাঁর তত্ত্বকথার দাম এক কানাকড়িও নয়। একটা মড়ার যা তাঁর জীবনও তাই। বেঁচে আছেন কিনা তাই ঠিক জানেন না। আমার কিছু নেই মনে হতে পারে কিন্তু আমি তবু নিজেকে জানি। সব কিছু সম্বন্ধে আমার অন্তত যেটুকু স্পষ্ট ধারণা আছে তাঁর তাও নেই। আমার এ জীবন আমি বুঝি, আসন্ন মৃত্যু সম্বন্ধেও আমি সচেতন। এর বেশী আমার কিছু অবশ্য নেই। কিন্তু  এই যে নিশ্চয়তাটুকু - এও খাঁটি বাস্তব, কামড়ে ধরবার মত। এ নিশ্চয়তা যেমন আমার কামড়ে ধরেছে। আমি যা করেছি ঠিকই করেছি। একভাবে আমি জীবন কাটিয়েছি। চাইলে অন্যভাবেই কাটাতে পারতাম। এ ছিল আমার জীবনের ধারা, অন্যরকম নয়। আমি, ধরা যাক, ক-এর রাস্তায় চলিনি। চলেছি খ কি গ এর রাস্তায় তাতে কি বোঝায়? এই বোঝায় যে বরাবর আমি বর্তমানের সেই মুহূর্তটির জন্যেই অপেক্ষা করেছিলাম, সেই ভোরটির জন্যে কাল কি অদূর ভবিষ্যতে যা আসছে। এই মুহূর্তটিই আমায় সার্থক করবে। আর কিছু কোন মূল্য নেই। কেন নেই তা আমি জানি । এই পাদ্রীও জানেন। আমার ভবিষ্যতের অন্ধকার দিগন্ত থেকে একটা মৃদু অবিরাম বায়ুস্রোত আমার দিকে বয়ে আসছে বহুকাল ধরে। আর সবাই যে সব ধারণা আমার মনে গাঁথতে চেয়েছে সেই বাতাসেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। যে জীবন আমি কাটিয়েছি তা ওই ধারণাগুলোর মতই অবাস্তব। অন্যদের মৃত্যু, মায়ের ভালোবাসা, ওই পাদ্রীর ভগবান, কোন একবারে বাঁচার সম্বন্ধ, যে নিয়তি মানুষ মনে করে তার নিজের বাছাই - এসবে কি আসে যায় আমার। কারণ সেই একই নিয়তি, শুধু আমার নয় আরো লক্ষ লক্ষ যে ভাগ্যবান মানুষ ওই পাদ্রীর মত নিজেদের আমার ভাই বলে, তাদেরও বেছে নেবে। পাদ্রী এটুকু নিশ্চয়ই বোঝে। মানুষ মাত্রেই এক হিসেবে ভাগ্যবানের দলে। দুনিয়ায় মানুষের একটাই জাত আছে ভাগ্যবানের জাত। একদিন সবাইকেই মৃত্যুদন্ড নিতে হবে। ওই পাদ্রীরও দিন একদিন আসবে। আর খুনের দায়ে পড়ে ফাঁসি হলে মার শেষ কাজের সময় কাঁদে নি বলে তফাটতটা হবে কি। কারণ শেষে তো সব সেই এক। সালামানোর স্ত্রীর বেলাও যা তার কুকুরের বেলাও তাই। ওই কলের পুতুলের মত মহিলা আর মাসিকে যে বিয়ে করেছে সেই মেয়েটি সমান অপরাধী। যে আমায় বিয়ে করতে সেধেছিল সেই মারীও তাই। রেমন্ড যে সিলেস্তির মতই আমার বন্ধু তাতে হয়েছে কি? হোক না রেমন্ড মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। এই মুহূর্তে মারী যদি নতুন কোন পুরুষবন্ধুকে চুমু খায় তাতেই বা কি আসে যায়। তার মাথার ওপর ফাঁসির দড়ি ঝুলছে। দন্ডিত হিসেবে ভবিতব্যের সেই কালো হাওয়ার মানে কি সে বুঝতে পারে না?
চেঁচাতে চেঁচাতে আমার দম ফুরিয়ে গেছিল। জেলের পাহারাদারেরা ঠিক এই সময় এসে আমার হাত থেকে পাদ্রীকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে। একজন তো আমাকে মারতেই উঠল। পাদ্রী-ই তাদের শান্ত করে নীরবে এক মুহূর্ত আমার দিকে চেয়ে রইলেন। দেখলাম তাঁর চোখে জল।
মুখ ফিরিয়ে তারপর তিনি গারদঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
তিনি চলে যাবার পর আবার শান্ত হলাম। কিন্তু এই উত্তেজনায় একেবারে তখন ক্লান্ত হয়ে গেছি। শোবার খাটটার ওপর ভেঙে পড়ে অনেকক্ষণ বোধ হয় ঘুমিয়েছিলাম। যখন জেগে উঠলাম তখন আমার মুখে তারার আলো পড়েছে। বাইরের মাঠঘাটের ক্ষীণ সব শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। মাটি আর সমুদ্রের লোনা গন্ধ মেশানো রাত্রের ঠান্ডা হাওয়া আমার গালে এসে লাগছে। ঘুমন্ত গ্রীষ্ম-রাত্রির অপরূপ শান্তি যেন বন্যার মত আমার ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। তারপর ঠিক ভোরের আগে একটা স্টীমারের ভোঁ শুনলাম। মানুষেরা এমন এক জগতের যাত্রায় বেরুচ্ছে যার সঙ্গে চিরকালের মতো আমার সম্পর্ক ঘুরে গেছে।
অনেককাল বাদে এই প্রথম আমার মা-র কথা মনে পড়ল। মনে হল কেন যে তিনি জীবনের প্রান্তে এসে ভালেবাসার লোক খুঁজেছিলেন, কেন যে জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করবার ছল করেছিলেন, এতদিনে যেন বুঝলাম। যেখানে জীবনের সব দীপ কেবলই নিভে নিভে যাচ্ছে সেই আশ্রমেও সন্ধ্যা আসে করুণ সান্ত্বনার মত। মৃত্যুর অত কাছে সে, যেন স্বাধীনতার প্রান্তে এসে পৌঁছেছিলেন বলে মার মনে হয়েছিল। আবার যেন জীবন নতুন করে আরম্ভ করার সময় এসেছে। কারুর পৃথিবীতে কারুর তাঁর জন্যে কাঁদার অধিকার নেই। আমারও মনে হচ্ছে যেন জীবনের নতুন যাত্রা শুরু করবার জন্যে আমি প্রস্তুত। ওই যে রাগে জ্বলে উঠেছিলাম তাতেই যেন আমাকে একেবারে নির্মল করে দিয়েছে সব আশা আমার ভেতর থেকে শুষে নিয়েছে। রাত্রির তারার ইঙ্গিতভরা অন্ধকারের দিকে চেয়ে এই প্রথম সৃষ্টির প্রশান্ত ঔদাসীন্যের কাছে হৃদয় মুক্ত করে দিলাম। এ সৃষ্টির সঙ্গে আমার মিল খুঁজে পেয়ে তার সৌহার্দ্য অনুভব করে এই প্রথম বুঝলাম যে জীবনে আমি সুখীই ছিলাম। এখনও আমি সুখী। একটি আশা এখন শুধু রইল। তাহলেই সব কিছু পূর্ণ হয়। নিজেতে অত নিঃসঙ্গ আর তাহলে লাগবে না। শুধু যদি আমার মৃত্যুদন্ডের সময়ে অনেক লোক আসে দেখতে আর চিৎকার করে গালাগাল দিয়ে যদি তারা আমার অভ্যর্থনা জানায়।

আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে নতুন ধারাবাহিক অ্যালবের কামু-র 'দ্য প্লেগ'-এর বঙ্গানুবাদ




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন