শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ।। ইন্দ্রজিৎ রায়ঃ ফালতু ডায়রি,বৈশাখ, বিশেবিষ

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০


ধারাবাহিক মুক্তগদ্য
ইন্দ্রজিৎ রায়।। ফালতু ডায়রি,বৈশাখ, বিশেবিষ 




( পূর্বপ্রকাশিতের পর )

প্রাপ্তবয়স্কদের অনেক সময়ে ডায়াপারের প্রয়োজন হয় ।কবে আবিষ্কার হয়েছিলো জানা নেই কিন্তু আমার মাতামহ শ্রীযুক্ত শচীন্দ্রনাথ রায় মহাশয় কিন্তু সেটা , মানে ডায়াপার , পাননি । আমিই সম্ভবত এই অনিয়ন্ত্রিত জল কাচানোর সবথেকে কাছে ছিলাম । রাতের পর রাত , দাদু সারারাত জেগে থাকতেন , বাথরুম যাওয়া আসা করতেন অজস্রবার , কারণ তাঁর মনে হোতো পুরোটা হয়ত হয়নি , তাই আবার । কোথায় তখন ডায়াপার , তখন তো লোকজন দাদুকে কলকাতার এক মনোবিদের কাছে দেখাবে বলে নিয়ে গেলেন । বড় , বুনিয়াদী বংশ ,নানা মুনি , তা মনোবিদ কী করলেন কে জানে , দাদুর যেটুকু ব্যালান্স ছিলো ,তা লুপ্ত হোলো । প্রকৃত অর্থে , বস্ত্রের ঝামেলা তিনি বাদ দিতেন , মাঝে মাঝে , কিন্তু পুরুলিয়ার বিরাট বাগানবাড়িতে , রাতজাগা দাদুকে আমার অন্তত প্রকৃতিস্থই মনে হোতো , অনেক কথা হোতো , আমিও জেগে থাকতাম , কাল কাউকে কাউকে বিষের পরিবর্তে স্মৃতিভার দিয়ে থাকেন , প্রখরতর স্মৃতি জংধরা ক্ষুধার্ত করাতের মত পাশবালিশের পাশে রাখা হতে থাকে , কমা কমা দাও , দম নেন কথক একটু , কিন্তু যেদিন ভোররাতে , জিজ্ঞেস করলেন আমাকে ,আচ্ছা ,আমার গুরুদেবের নামটা কী যেন ,সেদিন বুঝলাম হয়ত সব ঠিক নেই তেমন , ওরকম সময়েই একদিন বাগানের তালগাছটাতে , শকুন দেখেছিলাম , একবারই , কেমন মুখটা উপরে তুলে , বসেছিলো , ভুলতে পারিনা । মেটে রঙের চিল আসতো বহু , মানভূমের রোদে পুড়ে হয়ত অমন রং , আর তিতিরের মত দেখতে কিছু । মাঝেমাঝেই কালোজিরে কিনে এনে দাদু কেস খেতেন হেঁসেলে , আবার কালোজিরে ? সত্যি বলতে কি আমারও চোখে ওই কালো নক্ষত্রখচিত রোদে পোড়া , হালকা মেটে অথবা সাদা রঙের আসমান প্রতিভাত হয়ে থেকে যেতো , সাদা সাদা মাঠ দেখতাম স্বপ্নে , তাতে কালোজিরে ছড়ানো , ছোট্ট দুটো ডানায় উড়ে উড়ে দাদু কুড়োচ্ছেন সেগুলো , ভোর চারটে দাদুর সঙ্গে পুকুরে স্নান করতে যাচ্ছি , নতুন ছট্ পুজোর গামছার মাধুর্য সকলেই বোঝে । সাদা মাঠের মাঝে নীলচে সবুজ পুকুর , তালা দিতে কোনোদিন মনে থাকে না আমার । থানার বড়বাবু ছিলেন দাদু । বাসায় ওয়েব্লি এন্ড স্কট্ রাইফেল । কিন্তু বেলাইনের পুলিস , গ্রামের কেউ পুকুরের মাছ দিতে এলেও পয়সা দিতে চান । লোক অবাক , এ আবার কী পুলিস ! পয়সা দিতে চায় । সেই ভোররাত , আমি দাদুকে মনে করালাম , কাঠিয়া বাবা । ও হ্যাঁ , শুনে কেমন চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণ , বললেন , শুয়ে পড়ো । কলেজ আছে ।আবার সেই ছবি , আধোঘুমে , একটা সাদা ফলের ভেতর দাদু কোথায় যাচ্ছে , বিখ্যাত বাংলা সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে । বড়বাবু ।সাদার ওপর ছিটছিট কালো , দাদুর কেনা সমস্ত কালোজিরে , অদ্ভুত পোলকা ডটের মাঠ , ফলের গভীরে , পরে চাক্ষুস দেখেছি ফলটা , নাম ড্রাগনফ্রুট্ , গোলাপী সাপের দুটো চারটে ফণা আবৃত ফিসফিসে দর্শন । শুলেই । একটা অন্য রামায়ণ দাদু বলতেন , দোকানে ,একই ইলিশ মাছ লক্ষণ ও রাবণের বোনের পছন্দ হয়েছে , কে সেই মাছটা নিয়ে বাড়ি যাবে , সেই নিয়ে বিবাদ ও যাবতীয় ক্যাচালের শুরু , যা আমরা রামায়ণ নামে পড়ি । অথবা এটা যে পান্ডবদের গরু যদি দুর্যোধনের বেগুনখেতে না ঢুকতো , মহাভারত লেখা হোতো না । এখানেই শেষ নয় , মুরগি লড়াই , লাল কাপড় দিয়ে ষাঁড় কে ক্রুদ্ধ করে তোলার খেলা , দাদু আর আমি একটা নিঃসঙ্গ টিম , চিরকালীন । হনুমানজি কে খুব পছন্দ করতেন , সেই থেকে উনিও আমার সব আকামের সঙ্গী, তবে কি , হনুমানজী কিন্তু বাম্পার । ওঁর সঙ্গে একটা যাকে বলে nexus ইংরেজিতে , সেটা অনুভব করি আজকাল । এর সঙ্গে কোনও ধর্মীয় ব্যপার জড়িত নেই তেমন । কী আছে এ বলা দুষ্কর , তবে অনেক অন্ধকারে দেখেছি মনে পড়ে হনুমানজির সেই পুকুরপাড়ের বাড়ি । ওই চাতালটা খুব চেনা যেন । খুব । ওখানে আজকে যারা বসেন গিয়ে তাদেরও চেনা লাগে । মনে পড়ে বর্ষার ধানক্ষেত জলাশয় , কালভার্টের তলায় খলবল করছে অন্যদেশের চ্যাং মাগুর , ওপর থেকে , শুয়ে মাছ দেখতে দেখতে কখন চোখ লেগে গেছে । বৃষ্টি থেমে গেছে কখন । জ্যোতি মাহাতো , দাদুর ভাগচাষী , সে গরুর গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে বাড়ি । কিন্তু ওই কালভার্টের , এখানকার ভাষায় পোলের তলার মাছগুলো , তাদের উচ্ছাস , শহরবাসের অনেক ভার কাটিয়ে দেয় আজও ।দাদুর সেই মনোবিদ একটি সোনারূপোর দোকানের বিজ্ঞাপন করতেন । হোর্ডিংয়ে তাঁর ছবি । ঢাকুরিয়া ব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখছি , অবাক হয়ে । একসময় তিনি সরে গিয়ে ফুটে উঠছে এক পয়সাও ঘুষ না খাওয়া , ডি.এস.পি শচীন রায় র মুখ , চোখে সংকট , ডায়াপার আসেনি বাজারে তখনও , শুধু মনে হচ্ছে এই বোধহয় আরেকটু হয়ে গেলো প্যান্টে । আবার বাথরুম , আবার সেই বিস্কুটের শহরে , বিস্কুটের বাড়িঘর জানলা , আজ আবহাওয়া পূর্বাভাস , বলছে নিরানব্বই শতাংশ বর্ষা , দাদুর স্মৃতি আবছা , তালগাছে শকুনের ছায়া , আমি জেগে আছি , দাদু আজকাল ভোর তিনটে থেকে ঠাকুরঘরে বসে থাকে । বৃষ্টি এলে ? এই বিস্কুটের ঘরবাড়ি কী হবে ?বাঁচানো যাবে ? দাদু কি ভয় পেতো কাউকে ? কিছু কে ? জপ ধ্যান মনে ছিলো দেখেছি কিছুটা ।আর সব আবছা হয়ে আসছে । এই দাদু ছোট আমাকে অমন গল্প বলতো ! দলমা পাহাড়ের নিচে যে বাড়ি , সেখানে কি আজও স্মৃতিভ্রংশ ঘুঘু , মেটে রং আকাশ ঘিরে ধরছে , সন্ধ্যাশেষে কালো নক্ষত্র ফুটে আছে স্থির , ইটভাটা শ্রমিকদের পাড়া এদিকে , দাদুর সঙ্গে আমার কেমন শেষদিকটা ছিন্ন হয়ে গেলো । কলকাতা , পাটনা ঘুরে ওঁর কী চিকিৎসা হোলো জানা নেই , কিন্তু আমি পেলাম না শেষটা । দাদু চলে যাবার আগে একটা দিন খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছিলেন শুনেছি । খুব পুরুলিয়া যেতে চাইতেন । আমিও চাই যেমন । কিন্তু । কিন্তু । অশোকা গোয়ালিনী কে ছিলেন , আমি জানিনা । দাদু জানতেন । এক সন্ন্যাসী ডাকাতের সত্যি ঘটনা বলতেন খুব । সেটা , অন্যদিন বলা যাবে । 

( ক্রমশ ) 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন