সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

এই সংখ্যায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 


এই সংখ্যায়

এই সংখ্যার সম্পাদনাঃ চিত্রা লাহিড়ী রাজীব সিংহ

মাসিক কবিতাপত্র-এ আপনি স্বাগত


আমাদের কথা

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 


আমাদের কথা  


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণতম কবিদের সুনীলদা, চিরতরুণ এক আবেগমাত্র নয়, বাংলা ভাষায় সেই চিরন্তন পথিকদের অন্যতম যিনি প্রশ্রস্ত হৃদয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় তাঁর সমকালে প্রধানতম ভূমিকা নিয়েছিলেন।যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, তখন নবপর্যায় 'কৃত্তিবাস' বের করতে শুরু করলেন।ভালো কবিতার পাশাপাশি শুধুমাত্র তরুণ ও নবীন কবিদের কবিতা প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশ করবার জন্য। অনেক কবি ও লেখক পত্রিকা সম্পাদনাকে লঘুকাজ মনে করে থাকেন। কিন্তু, তিনি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর সৃজনসময়ে বারবার 'কৃত্তিবাস' কবিতা পত্রিকা বের করবার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।অথচ তিনি কবিতা লেখবার নামে কবির অজ্ঞানতাকে কখনও প্রশ্রয় দিতে চাননি।তাঁর সম্পাদিত 'কৃত্তিবাস' পত্রিকায় লেখা পাঠানোর নিয়মাবলীতে তাই লেখা থাকতো,''কৃত্তিবাস' পত্রিকার পৃষ্ঠা সকলের জন্যই, যদিও নবীন ও তরুণ কবিদেরই প্রাধান্য দেওয়া হবে। নবীন কবিরা যদৃচ্ছ পাগলামিও পাঠাতে পারেন, তবে ভাষা ও বানান-ত্রুটি থাকলে তা বিবেচনার অযোগ্য হবে।' এই ছিলেন তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।ভাষা ও বানান-ত্রুটি থাকলে তা লেখা-প্রকাশের জন্য বিবেচনার অযোগ্য বলে গণ্য হবে এই ছিল তাঁর মুক্তকণ্ঠ ঘোষণা। আজকের সর্বজ্ঞ প্রজন্মের কী কিছুই শেখার নেই তাঁর কাছে! নিজের মাতৃভাষা না জানাটা যাদের কাছে গৌরবের! তিনি সমালোচনা সাহিত্য সম্পর্কেও নিজের স্পষ্ট মনোভাব 'কৃত্তিবাসে'র প্রথম দিকের দিনগুলিতেই ব্যক্ত করছেন, 'আমাদের দেশে সাহিত্য আলোচনায় যে একটা দাঁতে দাঁত চেপে অতি সিরিয়াস ভঙ্গি থাকে, সেটি আমার পছন্দ না। সাহিত্য চরিত্র-উন্নয়নের মাধ্যম কিংবা সাহিত্যিকরা জ্যাঠামশাইয়ের মতন শ্রদ্ধেয়, এমনও আমি মনে করি না। সাহিত্য আনন্দের সামগ্রী, যেমন সঙ্গীত বা চিত্রকলা। সুতরাং খোলামেলা হাসিখুশিভাবে একে গ্রহণ করাই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়' (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কৃত্তিবাস,১৯৭৯)।এই মুক্তচিন্তা ও ঋজু মনোভাব আমৃত্যু তাঁর অলংকার ছিল।সেজন্যই তিনি চিরতরুণ।
কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ফরিদপুর জেলায়, বর্তমানে যা বাংলাদেশের অন্তর্গত। জন্ম বাংলাদেশে হলেও তিনি বড় হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পড়াশুনো করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তখন ব্যাংকের পিয়নের চেয়েও স্কুলমাস্টারের বেতন ছিল কম। পড়াশুনা শেষ করে কিছুদিন তিনি আপিসে চাকুরি করেছেন। তারপর সাংবাদিকতায়। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি. পলেন কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। সেই সূত্রে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে মার্কিন মুলুকে গেলেন সুনীল।ডিগ্রী হয়ে গেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসাবে সেখানে কিছুদিন কাজ করেন তিনি। তাঁর পিতা তাঁকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতিদিন এখান থেকে দু’টি করে কবিতা অনুবাদ করবে। এটা করা হয়েছিল তিনি যাতে দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। পিতার নির্দেশে তিনি প্রতিদিন অনুবাদের কাজ করতেন। বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখত, বিড়ি ফুঁকত সুনীল তখন পিতৃআজ্ঞা শিরোধার্য করে সারা দুপুর ধরে কবিতা অনুবাদ করতেন।একসময় এই অনুবাদকর্ম একঘেঁয়ে উঠলে তিনি নিজেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। ছোটোবেলার প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করা লেখা কবিতাটি তিনি 'দেশ' পত্রিকায় পাঠালে তা ছাপা হয়।পরবর্তী সময়ের তরুণ কবিদের প্রধানতম মুখ হয়ে উঠবেন তিনি।'আত্মপ্রকাশ', 'একা এবং কয়েকজন' থেকে 'নীরা সিরিজ' বা 'স্মৃতির শহর'-এর আদ্যন্ত রোমাণ্টিক ও স্পষ্টবাদী সুনীলের বহুমুখী প্রকাশ ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতকে প্রভাবিত করেছে।
“...নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে 
সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়
নীরা আজ ভালো আছে?” 
গদ্যসাহিত্য, বিশেষ করে উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ--- সাহিত্যের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ জুড়ে তাঁর ব্যাপ্তি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে লেখালেখি করেছেন। কখনো ‘নীললোহিত’, কখনো ‘সনাতন পাঠক’ আবার কখনো ‘নীল উপাধ্যায়’ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। 'বুধসন্ধ্যা' (নাট্যচর্চার জন্য), 'আত্মীয়সভা' (দুঃস্থ কবিলেখকদের আর্থিক সহায়তার জন্য), 'ভাষা শহীদ স্মারক সমিতি' ও 'বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব' তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা অনেকের ঈর্ষার কারণ হলেও তিনি এসবের পরোয়া করেননি কখনো। সংকীর্ণ রাজনীতি তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর অনমনীয় মনোভাব তাঁকে মানুষের আরও কাছে নিয়ে এসেছে। তাঁর চলে যাওয়ার আট বছর পরেও আজও তিনি সমান ভাবে জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক। তাঁর ৮৭তম জন্মদিনের প্রাক্কালে 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর এই সামান্য প্রয়াস পাঠকদের ভালো লাগলে আমরা ধন্য হবো।আর আরেকটি কথা না বললেই নয়, বিশ্বব্যাপী মহামারীর সময়ে, এই গৃহবন্দী লকডাউন পর্বে, এই বিশেষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণ সংখ্যা সম্পাদনা করতে এসে আমরা বিশিষ্ট কবি চিত্রা লাহিড়ী, 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর আত্মজন চিত্রাদির যে সহায়তা পেয়েছি তা অভূতপূর্ব। চিত্রাদিকে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করতে চাই না। সুনীলদাকে নিয়ে বিশ্বের যে প্রান্তে যে উদ্যোগই আয়োজিত হোক না কেন, 'মাসিক কবিতাপত্র' নিজেকে সেই উদ্যোগ-আয়োজনের অংশীদার মনে করে। স্বাতীদিকে 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাই।সুস্থ থাকুন স্বাতীদি। ধন্যবাদ জানাই 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর এই বিশেষ সুনীল সংখ্যার সমস্ত লেখকসহ সুনীলদার দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী ধনঞ্জয়বাবুকে। এভাবেই কবির জন্মদিনে আমাদের সম্মিলিত সুনীল-তর্পণ।সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।। 
০৬.০৯.২০২০

স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ।। একটি শুভেচ্ছাবার্তা

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০  



স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ।। একটি শুভেচ্ছাবার্তা 

 

চিত্রা, 'মাসিক কবিতাপত্র' সুনীলের জন্মদিনে একটি বিশেষ সুনীল সংখ্যা প্রকাশ করছে এবং তুমি তার অন্যতম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছো জেনে আমার খুব আনন্দ হলো। তোমরা এই সময়ে সুনীল সম্পর্কে কিছু কথা আমার কাছে জানতে চেয়েছো জেনে ভালো লাগলো। অনেক দিন হলো চলে গেছে সুনীল আমাকে ছেড়ে। সুনীলের কথা সব সময় সব ক্ষণে আমার মনে হয়। খুব দেখতে ইচ্ছে করে। কতবার ভেবেছি হয়তো স্বপ্নে দেখবো। কিন্তু স্বপ্নেও কখনো সুনীলকে দেখিনি আমি। এই না দেখা আমার কষ্টের। তবে মনে মনে সব সময় আমি ওকে দেখতে পাই আর অনুভব করি ও পাশেই আছে। তবে বিশ্বাস করি এ ভুবন ছেড়ে গিয়ে অন্য ভুবনে একদিন আমি ঠিক সুনীলকে খুঁজে নেবো আর স্বর্গের বাগানে ওর হাত ধরবো এবং হাত ধরবো এবং হাত ধরবো। তোমাদের অনেক ধন্যবাদ আমার মনের এই কথাগুলো আমাকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়ার জন্য। তোমাদের শুভেচ্ছা জানাই। ভালো থেকো।
তোমাদের স্বাতীদি 



    

ধনঞ্জয় পয়ড়্যা ৷৷ স্মৃতি থেকে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০  




ধনঞ্জয় পয়ড়্যা ৷৷ স্মৃতি থেকে


নেই নেই করে, প্রায় আট বছর হতে চললো৷ এখনও সেই জন্মদিনের কথাগুলো মনে পড়ে৷ কতো নামী-দামি মানুষজন আসতেন, আমিও খুব ব্যস্ত থাকতাম৷ এখন সেইদিন আর নেই৷ এখন আর কেউ তেমন আসে না৷ জন্মদিনের দিনটি এলে মনে পড়ে যায় আগের কথা৷ ইে বছর লকডাউনে আরও মনখারাপ৷ অন্যান্য বছর যদিও বা কেউ আসতো, এই বছর এই পরিস্থিতিতে সেটাও হয়তো সম্ভব হবে না৷ সেই শেষদিনটির কথা আজও মনে পড়ে৷ মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়৷ অনেক ছোটোবেলায় কাজের সূত্রে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল৷ নিজের অভিভাবক হিসেবেই পেয়েছিলাম ওঁকে৷ ওঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার অনেক আগেই পিতৃবিয়োগ হয়েছিল আমার৷ আমার বাবার মৃত্যুর সময় কাছে ছিলাম না৷ কিন্তু ওঁর মৃত্যুটা আমার স্বচক্ষে দেখা৷ ওঁর মতো একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে হয়তো ইহজনমে আর সাক্ষাৎ হবে না৷ আমার কাছে উনি ভগবানতুল্য৷ ভগবানের কাছে এটাই প্রার্থনা করি, উনি যেখানেই আছেন, উনি যেন ভালো থাকেন৷ পরজন্ম বলে যদি কিছু হয়, আমি চাই আবার যেন ওঁর স্নেহের ছায়ায় আমি আসতে পারি৷

জয় গোস্বামী৷৷ ২৫ অক্টোবর, ২০১২

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০  




জয় গোস্বামী৷৷ ২৫ অক্টোবর, ২০১২


একবার আকাশ আর দু’বার আকাশ আর তিনবার আকাশ
এইভাবে সতেরো বছর 
তারপর ক্রমাগত শেষ হয় আলো
সমুদ্রের দিকে ফেরে রক্তমাখা জ্বর
লোহাপাথরের শব্দ ঢুকে পড়ে মনের ভিতর
সেই অবকাশে
হাড়ের অন্দরে কীট একদিন দু’দিন তিনদিন
খেতে থাকে সব স্নেহঋণ
কীটদল ক্রমশ অঙ্গার
জ্বালা শুধু জ্বালা শুধু জ্বালা
যতটুকু নীল ছিল পুড়ে ছারখার
বড় হল আমার-ই অহং
অন্যের কারণে শুধু অন্যের কারণে অন্যদের কারণে কারণে
একদিন তোমার কাছ থেকে 
সম্পূর্ণ ফিরিয়ে আনলাম
মন৷

তুমি কিছু বলোনি তখন৷
স্মিত হেসেছিলে শুধু৷
পোড়া একটা হাওয়া উঠল৷ কালো জল ঘূর্ণিপাক মেরে
উঠে গেল আমার মাথায়
যেদিকে তাকাই দেখি বিষ ভেসে যায় শুধু বিষ ভেসে যায়
সেই বিষস্রোত ধরে এতদূর এসে পৌঁছলাম
রইল না ফেরার উপায়
যা হল তা হয়ে গেল৷ দিন গেল একের পর এক

বিরোধিতা করলাম অনেক৷
তোমার সুস্পষ্ট বিরোধিতা৷
আজ তোমার মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে
মনে হয় ভুল-ই করেছি৷ মনে হয় সমস্ত কারণই অকারণ
সজোরে সমূহ বাধা ঠেলে একবার সামনে গিয়ে যদি বসতাম
একবার পা ছুঁতাম যদি
আবার আগের মতো পা ছুঁতাম যদি...

কিন্তু তা হওয়ার নয়৷ তুমি রইলে না
মানুষের মুখে মুখে রয়ে গেল আমাদের মধ্যেকার সেই বিষনদী
তুমি যে-স্নেহের ডালা হাতে দিয়েছিলে
তা কবেই ভেসে গেছে রক্তমাখা অহং-এর জ্বরে
সমুদ্র ছাপিয়ে যাওয়া তোমার নামের পাশে 
আমার ধূলিকণার নাম
শোকের সুযোগ পায় না---
অনুশোচনায় পুড়ে মরে

(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর কবিতাটি ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ পরবর্তীতে জয় গোস্বামীর ‘কবিতা সংগ্রহ’ ৫ম খণ্ডে সংকলিত হয়৷ এখানে জয় গোস্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে কবিতাটি পুনঃপ্রকাশিত হল৷ কবির দ্বিধা, মৃত্যুদিনে লেখা কবিতা কী জন্মদিনে প্রকাশ করা যায়!)

সুবোধ সরকার ।। আমার কবি

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০  



সুবোধ সরকার ।। আমার কবি  


হরিণ থাকে বারোতলায়
হরিণ থাকে নদীর ধারে ধারে
আমার কবি হরিণ ধরে আনে
সব কবি কী হরিণ ধরতে পারে?

শ্যামলকান্তি দাশ ৷৷ সেদিন দেখলাম তাঁকে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০  




শ্যামলকান্তি দাশ ৷৷ সেদিন দেখলাম তাঁকে


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণীয়েষু

সেদিন দেখলাম তাঁকে খুব কাছে... এই তো এখানে,
আজ তিনি দশতলা বাড়ির চেয়ে আরও উঁচু
অনেকটাই দূরে,
বলছেন মনের কথা ঠাকুর-কবির সঙ্গে, হাসতে হাসতে,
দিকশূন্যপুরে৷

এখানেও কিনেছেন স্বপ্ণঘেরা লেখার টেবিল,
একটাকার বলপেন... বঙ্গলিপি খাতা...
লেখা আসছে লেলিহান, পাকিয়ে পাকিয়ে,
ছ’পাতা ন’পাতা৷

এখানেও করেছেন ‘একা এবং কয়েকজন’ বাড়ি

জানালায় পুঞ্জ মেঘ... তারাভর্তি শত শত বই
পুকুরে সাঁতার কাটছে সাদা হাঁস কালো হাঁস
আয় চই চই৷

সেদিন দেখলাম তাঁকে... ঠোঁটে জব্দ জ্বলন্ত আগুন
টবের লঙ্কাগাছে সাদা ফুল... দিকে দিকে অসীম বাতাস
আঁচড় কামড় নেই ময়লা কয়লা নেই... পরিস্কার পরিচ্ছন্ন
সুনীল আকাশ


রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

তুষার পণ্ডিত ।। হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রতিরোধের গাণ্ডীব

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 




তুষার পণ্ডিত ।। হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রতিরোধের গাণ্ডীব


'ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে ' - 

এইসব অনিন্দ্যসুন্দর ধ্বনির মায়াবী আলোয় সেদিন কেঁপে কেঁপে উঠেছে যৌবনের দিনরাতগুলি। তাঁর কবিতার শক্তি এমনি আবেগময়, সুপ্ত যৌনকাতর। আনন্দ আর বিষাদের যুগলবন্দিতে এমন চোরাটান আগে টের পাইনি কখনো। না, চন্দনের বনে নয়, তাঁর সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি ভুবনডাঙার মাঠে। তাঁর 'একা এবং কয়েকজন' বাড়িতে। এই তিনিই তো নবীন কিশোরের হাতে স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছেন ভুবনডাঙার খোলা মাঠ, তাঁর যা কিছু সম্বল। সুতরাং সেই মাঠে প্রবেশের কোনো সংকোচ ছিল না। ২০০৭ সালের নয় জুন ওই সন্ধ্যায় কাটোয়া শহরে বসবে বঙ্গ সংস্কৃতির উৎসবের আসর। ভাষা শহিদ স্মারক সমিতির সভাপতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া আর কার অধিকার এই উৎসবের ফিতে কাটার! ঘরে - বাইরে যখন মরতে বসেছে আ-মরি বাংলা ভাষা, তখন তিনি বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক - - যিনি হাতে তুলে নিয়েছেন প্রতিরোধের গাণ্ডীব। তাই তো বাংলা কবিতার যুবরাজকে বরণের জন্য প্রস্তুত চৈতন্যভূমির নাগরিকজন।

বেলা দেড়টায় জুন মাসের আকাশে তাপের খরস্রোত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে কাটোয়া অভিমুখী আমরা চারজন। তিনি সামনের সিটে আর পিছনে আমার সঙ্গে দুই সফরসঙ্গী - কবি অসীম বিশ্বাস এবং সাংবাদিক রূপক মজুমদার। বোলপুর থেকে কাটোয়া এই দুই ঘণ্টার যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা কোনোকালেই ভুলব না। দেশজোড়া খ্যাতিমান একজন মানুষ কোন উচ্চতায় পৌঁছলে আমার মত অতি তুচ্ছ প্রাণির আবদার মেটাতে পারেন এককথায় - তা আমার অজানা। তাও তো তিনি সামনের সিটে বসে। আর প্রশ্নকর্তা পিছনে। তখন কৃষি বনাম শিল্পের দ্বৈরথে বাংলার বুধমণ্ডলী প্রায় আড়াআড়ি বিভক্ত। শঙ্খ ঘোষ থেকে জয় গোস্বামী, অভীক সরকার থেকে হর্ষ দত্ত - কে আসেননি সেই কথোপকথনে! আমার নানা প্রশ্নের বিপ্রতীপে তিনি যথেষ্ট খোলামেলা অথচ সংযত। এসব কথাবার্তা নিঃশব্দে রূপকের ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছে, কিন্তু তিনি উদাসীন। ভাষাকর্মীদের বারংবার দাবি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে মাতৃভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে নীরব। এ সম্পর্কে তাঁর মত, 'সরকার বোধহয় অবাঙালি ভোট হারানোর ভয় পাচ্ছে।' আবার নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে শঙ্খবাবুর সিদ্ধান্তকে ভুল বলতেও তাঁর গলা কাঁপেনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক কবিতায় প্রসঙ্গক্রমে এসেছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। 'তোমার করুণ ওষ্ঠে কতদিন চুম্বনের রেখা পড়েনি।' এ লেখার জন্য তাঁকে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। তবে ইংরেজি অনুবাদ পড়ে ইন্দিরা গান্ধী মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'নটি, ভেরি নটি।' সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ হলে তাঁকে নির্ঘাত জেলে পোরা হত।

কাটোয়ার সংস্কৃতিচক্র প্রাঙ্গণে তিনি উদ্বোধন করলেন ভাষা উদ্যানের। প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষা পিছু হটে যাওয়ায় তিনি যে কতটা বিচলিত, সেটা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর বক্তৃতার প্রতিটি ভাঁজে। মাতৃভাষা থেকে সরে যাওয়ার অর্থ যে জাতিসত্ত্বার অপমৃত্যু, জোরের সঙ্গে বলেছিলেন। সবার অনুরোধে নিজের গলায় পাঠ করলেন, 'চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।' তাঁর সঙ্গে ছিলেন সুবোধ সরকার, পঙ্কজ সাহা, চিত্রা লাহিড়ি, অংশুমান কর, স্বপ্নকমল সরকার। প্রবীণ লোকশিল্পীদের সংবর্ধনার সময় তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশের মুহূর্তে নাগরিক ভাঁড়ামি মুখ লুকিয়েছে লজ্জায়।

আসলে ছোট-বড় সব মানুষের জন্যই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বুকের দরজা ছিল খোলা। একটা ছোট ঘটনার উল্লেখে এই চির যুবকের সহজতা বোঝা যায়। কাটোয়ার কলম পত্রিকার পুজোসংখ্যার জন্য একটা কবিতা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তারপর কোনো কারণে কবিতাটা আনা হয় নি। শেষমেশ তাঁকে ফোনে কবিতাটা বলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। আমার অনুরোধকে তিনি স্পর্ধা ভেবে উড়িয়ে দেননি। তিনি ফোনে মফস্বলের এক অখ্যাত অক্ষরকর্মীকে কবিতা বলে যাচ্ছেন পরম ধৈর্যের সঙ্গে -- এ দৃশ্য অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।

এমন মানুষকে না ভালবেসে দূরে রাখা যায়?

চিত্রা লাহিড়ী ।। দুটি কবিতা

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০  



চিত্রা লাহিড়ী ।। দুটি কবিতা 


সেদিন সুনীল সন্ধ্যায়


সুরের মূর্ছনাও ছিল সেদিন

         সেই কবিতার সন্ধ্যায়

অকারণ বৃষ্টিতে ভিজে ছিল ভাষা

      সুনীলের সকল অধ্যায়


সুনীল নদী

 

সব মৃত্যু মৃত্যু নয়

কবির মৃত্যু যদি

জন্মদিনে উচ্চারণে

নীল সুনীলের নদী

 


শংকর চক্রবর্তী ।। সুনীল হৃদয়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০


শংকর চক্রবর্তী ।। সুনীল হৃদয় 













    ('কবিসম্মেলনে'র সৌজন্যে)


দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ।। সুনীল আকাশ

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০




দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ।। সুনীল আকাশ


সাহিত্যের গন্ডি নেই, 

বাঁধা নয় কালের সাম্পানে, 

দেশজয়ী কালজয়ী 

সৃষ্টি চলে উন্মুক্ত উড়ানে। 

রবির কিরণে আজও 

বঙ্গভাষা ভাসে অনাবিল, 

মুক্তির আস্বাদ নিয়ে 

আমাদের আকাশ সুনীল।

কৃষ্ণা বসু ।। প্রিয় ও প্রণম্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 


কৃষ্ণা বসু ।। প্রিয় ও প্রণম্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে



মাথার ওপর ছায়াদাতা গাছ যে ছিলে তুমি, 

তোমায় নিয়ে গর্বে ভরে সারা বঙ্গভূমি 

গদ্যে এবং পদ্যে তুমি সমান সচল ছিলে, 

তরুণ কবির কপালে তাই জয়তিলক দিলে 

সাহিত্যপ্রাণ রাজাধীরাজ সবার তুমি প্রিয়, 

শতকোটি প্রণাম জানাই মুগ্ধতাও নিও

রূপক চক্রবর্তী ।। সুনীলদা ও আমি

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 





রূপক চক্রবর্তী ।। সুনীলদা ও আমি



সম্পর্ক ভারত পাক গোলা এসে পড়ে, 

সম্পর্ক ক্রিকেট যুদ্ধ তিন বলে ছয় 

অশেষ কাহিনী জানি সম্পর্কজনিত, 

এ বিষয়ে না না বাবা আজ আর নয়

সৈয়দ কওসর জামাল ।। ডাক

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 




সৈয়দ কওসর জামাল ।। ডাক


'বাতাসে কিসের ডাক, শোনো' 

                       ---সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 



আমাদেরও ডেকেছে বাতাস, যেতে হবে 

ভাঙাচোরা এই পথে, অনন্য কোথাও, 

যেখানে সুন্দর মেশে প্রশান্তির স্তবে 

বেজেছে নগ্নতা, অরূপের সোনাটাও। 

কবিও কি শুনেছেন প্রলয়ের ডাক? 

হঠাৎ ঠোক্কর মারে নশ্বরতার কাক।

তন্ময় চক্রবর্তী ।। চিরতরুণের জন্মদিন

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 




তন্ময় চক্রবর্তী ।। চিরতরুণের জন্মদিন


দশতলা ঘর, আড্ডা তুমুল, কৃত্তিবাসের 

কে যে কবি, কে কবি নয়, মধ্যরাতের। 

স্মৃতির শহর, নীরার বাড়ি, খুঁজছে যারা 

নীললোহিত আর কাকাবাবুর বন্ধু তারা। 

জন্মদিনে 'প্রথম আলো' ডাকছে যাকে 

একলা চেয়ার খুঁজছে শুধু সুনীলদাকে। 

রৌদ্রদিনে, শব্দ ফুলে , আনন্দ দিন 

সুনীল আলোয়, গল্প কথায়, সে জন্মদিন....

সার্থক রায়চৌধুরী ।। তুমি

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০




সার্থক রায়চৌধুরী ।। তুমি


একটি সুনীল আকাশ ছিল তাই 

দুটি পাখি মেলেছে তার ডানা, 

একটি গহন বনের অন্ধকারে 

ফুটেছে এক অন্ধ হাস্নুহানা... 



অবুঝ হাওয়া কাদের কথা বলে? 

কিসের তরে তুমুল দরিয়ায় 

একটি সুনীল সাগর ছিল বলে 

মাঝির দল পাগল তরি বায়!.. 



স্নিগ্ধ কিছু পরশ আছে লেগে- 

ভ্রমর আজও হঠাৎ দ্বিপ্রহরে 

গুনগুনিয়ে অবাক দ্যাখে রাই 

ডুব দিয়েছে সুনীল সরোবরে!.

সুজিত সরকার ।। অনি:শেষ

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০





সুজিত সরকার ।। অনি:শেষ  


(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণে) 


এক জাদুঘড়া ; 

বার বার উপুড় করে দিলেও যার জল 

ফুরোয় না !

রামকিশোর ভট্টাচার্য ।। কোলাজ

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 




রামকিশোর ভট্টাচার্য ।। কোলাজ


বৃষ্টি বাজছে জানলার কাচে ৷ 

একটা সেতার মল্লার খেলতে খেলতে 

বদলে দিচ্ছে সন্ধ্যা ৷ কলমের একদিকে 

নীল আর অন্যদিকে বিষণ্ণ, 

সংকট ছুঁয়ে সময় চলেছে ... 

সঙ্গে কিছু নিকুচি অভিমান, 

ছোটো হ'তে হ'তে কখন যে 

হারিয়ে গেল কাকাবাবু সন্তুর 

মনখারাপ মোছা দুপুরগুলো 



একটা সাদা কাগজে শুধু কিছু বাসন্তী রং লেগে আছে...

মজিদ মাহমুদ ।। সুনীলের কবিতায় এক আশ্চর্য যাদুকরী ক্ষমতা আছে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 


মজিদ মাহমুদ ।। সুনীলের কবিতায় এক আশ্চর্য যাদুকরী ক্ষমতা আছে

ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লে একসঙ্গে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়- আমার বন্ধুরা এই কৌশল শিখেছিলেন সুনীলের কবিতা পড়ে। আর সেই সত্য প্রমাণের জন্য কলেজের মাঠে, বিশ্বাবদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, বন্ধুদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে, দিনে কিংবা জোছনায় অন্ধকারে শিশিরের রোমে ভেজা শুকনো ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে চোখের সীমাবদ্ধ গোলের ভেতর সবটুকু আকাশ লুকানোর খেলায় মত্ত হয়ে পড়েছিলাম আমরা। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের কবি জীবন শুরু হয়েছিল সুনীলের সঙ্গে- জীবনের গভীর মায়া ও মমতায়, কান্না ও নস্টালজিয়ায়। কবি বলতে আমরা যে ভাবে নজরুল-জীবনানন্দ-সুকান্তকে বুঝতাম ঠিক সুনীল-শক্তি, শামসুর রাহমান-আল মাহমুদও আমাদের মধ্যে সেই ব্যঞ্জনা তৈরি করেছিলেন। সমকালে আরো গুরুত্বপূর্ণ কবি ছিলেন। কিন্তু সুনীল আমাদের বয়ঃসন্ধিক্ষণের যুবরাজ। মথের শরীর থেকে শুককীটের জীবন শেষে আমরা যখন কৈশোরের খোলস ছাড়তে শুরু করেছিলাম, সেই রূপান্তরের কষ্ট আমাদের ক্ষয়িত ব্যথিত করে তুলছিল, আমরা তখন রবীন্দ্রনাথের ফটিক, জীবন ও জগতের অসঙ্গতি, অবজ্ঞা ও অবহেলার সঙ্গে বিকাশমান চিন্তার দ্বারা একা, তখন সুনীল ছাড়া সরাসরি আমাদের এই প্রাত্যহিকতার যন্ত্রণা কেউ ঢাকতে পারেননি।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আগত কাব্যবাতিক তরুণদের প্রতি হিমশীতল অবজ্ঞা, সচেতন উপেক্ষা, বান্ধবীদের এড়িয়ে চলার প্রবণতার কষ্ট থেকে পরিত্রাণে সুনীল ছাড়া কে আমাদের সুশ্রুষা দিয়েছিল? সুনীলের কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের চোখ জ্বালা করে উঠতো, হৃদপিণ্ড কণ্ঠনালির কাছে আটকে থাকতো, বন্ধুদের কাছে এই দুর্বলতা ঢাকা দিতে কটুকিছু পড়ার ভান করে কতবার চোখ ধুতে উঠে গেছি কলতলায়। তাই বলে আমরা কখনো সুনীলের মতো কবিতা লেখার কথা ভাবিনি। সুনীলের মতো অন্য কেউ লিখুক তাও আমরা চাইনি। সুনীলের কবিতার ফর্মটি কখনো আটোসাটো ঠিকঠাক মাপ মতো নয়। উপমা অলঙ্কার ছন্দের গাঁথুনি- কবিতার প্রচলিত ঘরানার মতো নয়। এমনকি খুব সহসাই তার কবিতার দুএকটি পংক্তি কিংবা বাক্যাংশ দিয়ে শ্রোতাকে তাক লাগিয়ে দেয়া যায় না। তবু সমকালে সুনীল ছাড়া আর কাকে পাঠকের এতখানি ঠোঁটে ও মনে ধরেছে? কবিতার অনেক কৌশলের মতো এই কৌশলটি কেবল সুনীলই রপ্ত করেছেন। এরপরেও অনেক মিল ও ছন্দের স্মরণযোগ্য পংক্তি রচনা করেছেন তিনি।
সুনীলের এই ছেড়ে দেয়া প্রকাশ ভঙ্গি, গদ্য ও পদ্যের ছুঁচিবায়ুগ্রস্ততা ঘুচে দেয়ার প্রবণতা, রিপোর্টিং ও মেসেজের আধিক্য তাঁর কবিতা থেকে আমাদের কতবার দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি, সুনীল এখনো তার সমকালে প্রজ্জ্বলিত হুতাশন জাগিয়ে রেখেছে। এর কারণ হিসেবে মনে হয়েছে, নজরুল, সুভাষ ও সুকান্ত পরবর্তীকালে বাংলা কবিতায় আর কেউ এমন সহজ মানুষের মতো বালতিতে তোলেনি কো জল। রবীন্দ্র-পরবর্তী এমনকি তিরিশের পরে গভীর ব্যঞ্জনাময় কাব্য রচনার প্রতি কবিদের নিষ্ঠার কমতি না হলেও নজরুল কিংবা উত্তরকালে সুকান্তের মাধ্যমে কবিতায় যে জনসম্পৃক্তি ঘটেছিল পরবর্তীকালে তার পরিচর্যা হয়েছে সামান্যই। হয়তো সচেতনভাবেই- কলাকৈবল্যবাদের দোহাই দিয়ে। মার্কসবাদের প্রপঞ্চ সমকালীন কবিদের আকৃষ্ট করলেও কবিতায় প্রোলিতারিয়েতদের কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা ছিল না মোটেও- বিশেষ করে কবিখ্যাতির দাবিদারদের। যে কারণে কবিতা সত্যিই যোগাযোগের ক্ষমতা কিছুটা হারিয়ে ফেলেছে।

তিরিশের শুরু থেকেই কবিতার প্রতি মানুষের দুর্বোধ্যতার অভিযোগ, দূরে ঠেলে দেয়ার প্রবণতা- কেউ পাঠকের কথা ভাবছেন না- যে পাঠক মধ্যবিত্ত জীবন থেকে উঠে আসা, গ্রাম গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো জীবনের আঘ্রাণ। কেবল ব্যতিক্রম সুনীল, সার্থকভাবে সেইসব মানুষের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে পড়েছেন তিনি। তাদের টুকরো টুকরো দুঃখ, কান্না ও ভালোবাসা, না পাওয়ার বেদনাসমূহ পরম মমতায় তুলে নিয়েছেন তার কলমে। যে কারণে আমাদের মতো তরুণ কবি সুনীলকে খুঁজে পেয়েছিল তাদের কলমে-
সদ্য তরুণটির প্রথম কবিতার বই আমি হাতে তুলে নিই
ঈষৎ কাঁচা প্রচ্ছদে সবুজ সবুজ গন্ধ
প্রজাপতির মতন হালকা পাতাগুলি চলমান অক্ষরে ভরা
শিরোনাম উড়ে যেতে চায়, শব্দগুলি জায়গা বদলের জন্য ব্যাকুল
ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব
                    অহংকার-ভয়-লজ্জা-স্পর্ধা
সে কথা বলে না তার নীরবতা অত্যন্ত বাঙ্মময়
আমাকে সে কি চোখে দেখে তা আমি জানি না
কিন্তু আমি তার মধ্যে দেখতে পাই অবিকল আমাকে
চোরা চোখে লক্ষ করি তার জামার কলারের পাশটা ফাটা কিনা
প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সে নিশ্চয় খুচরো পয়সা গুনছে।
আমার ইচ্ছে করে ওর সঙ্গে জায়গা বদলাবদলি করে নিতে, এক্ষুণি...

কিংবা

অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়, জীবন বদলে নিলাম আমি ও নিখিলেশ
হাতঘড়ি কলম, পকেট বই রুমাল
রেডিওতে পাঁচটা বাজলো, আচ্ছা কাল
দেখা হবে- বিদায় নিলাম, -সন্ধ্যে বেলার
রক্তবর্ণের বাতাস ও শেষ শীতের মধ্যে, একা সিড়ি দিয়ে
নামবার সময় মনে পড়লো- ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার
এসবও বদলানো দরকার, যেমন মুখভঙ্গি দুঃখ ও হাসির মুহূর্ত
নিখিলেশ ক্রুদ্ধ ও উদাসীন, এবং কিছুটা ধূর্ত।

রবীন্দ্রনাথ জীবন-সায়াহ্নে এসে ‘পুনশ্চ’ কাব্যে ‘ছেলেটা’ কবিতায় এ সব কষ্টের কথা বলতে চেষ্টা করেছিলেন। মানব জীবনে যেমন বোধের ভেতর অসংখ্য অনুভূতি জেগে ওঠে তেমনি বহির্জগতেও অসংখ্য মানব-জীবন- যারা মানহারা, ভাষা খুঁজে পায় না, তাদের জন্যও বাড়তে থাকে কবির দায়িত্ব। আমরা কিছুতেই বলতে পারি না, রবীন্দ্র জীবনের শেষাংশের সহজ অথচ হৃদয়গ্রাহী মানবিক কাব্যগুলো তাঁর প্রথমাংশের জটিল ও হৃদয় উদ্বোধিত কাব্যগুলোর চেয়ে শিল্পেতর। রবীন্দ্রনাথের এ পর্যায়ের কবিতাগুলো কেবল সহজই নয়, পুরোপুরি রিপোর্টিং। ‘ব্যাঙের খাঁটি কথাটি’ লিখতে না পারার যন্ত্রণা বার্ধ্যকে বিশ্বকবিকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছিল। যদিও জীবদ্দশাতেই তিনি সেই হতাশা পূরণ করে দিয়েছিলেন ‘পুনশ্চ’ ‘পত্রপুট’ পর্বে। ‘পুনশ্চে’র ভাষাভঙ্গির সঙ্গে সুনীলের রয়েছে অদ্ভূত মিল-

তার ছেলেটি মরে গেছে সাত বছর হল,
    বয়সে ওর সঙ্গে তিন দিনের তফাত।
        ওরই মতো কালোকালো,
            নাকটা ওই রকমই চ্যাপ্টা।
ছেলেটার নতুন নতুন দৌরাত্মি এই গোয়ালিনী মাসীর ’পরে।
    তার বাধা গোরুর দড়ি দেয় কেটে,
        তার ভাড় রাখে লুকিয়ে,
    খয়েরের রঙ লাগিয়ে দেয় তার কাপড়ে।
‘দেখি না কী হয়’ তারই বিবিধ রকম পরীক্ষা।...
অম্বিকে মাস্টার আমার কাছে দুঃখ করে গেল,
    ‘শিশুপাঠে আপনার লেখা কবিতাগুলো
        পড়তে ওর মন মানে না কিছুতেই,
            এমনই নিরেট বুদ্ধি।
সুনীল তাঁর কবি জীবনে রচনা করেছেন অসংখ্য জীবন বদলের কবিতা। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে আত্মা বদলের কাহিনি। ঈশ্বরবিহীন মানুষ খুঁজে বেরিয়েছেন সর্বেশ্বর।

ধরা যাক, আজ থেকে আমি আমার বাবার নাম দিলুম
                    নিরাপদ হালদার
মাঝারি উচ্চতা, সারা দেহে ঘামাচি রঙের ঘাম মাখা সেই মানুষটি
রানাঘাটের এক ভাতের হোটেলের ম্যানেজার
তা হলে আমি  কি মফস্বলের ক্লাস এইটে পড়া রাধারমণ?
আমাকে ফর্সা ছেলেরা চাটি মারে যখন তখন!
ধরা যাক আমার মা চৌধুরী বাড়ির ঠিকে ঝি
গালে মেছতা দাগ!
        একটু মুখ খারাপ করা স্বভাব
তা হলে আমি কি সন্ধেবেলা দেশবন্ধু পার্কের ছিনতাইবাজ
আমার ভাই হিন্দমোটরে ট্রেন আটকাতে যেয়ে গুলি খেয়েছে
আমি নিজেও ফিস প্লেট বিষয়ে শিখে নিয়েছি আনেক কিছু
আমার বোন পোড়া কয়লা কুড়োয় রামরাজতলায়

কিংবা

আমিই সেই মানুষ, আমাকে চেয়ে দ্যাখো...
আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি
আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে
আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ...
রাস্তায় একটা বাচ্চা ছেলে বমি করল
আমি ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী
পিছনের দরজায়, বস্তাভর্তি টাকা ঘুষ নিচ্ছিল যে লোকটা...
আমি তার হত্যার জন্য দায়ী 

সুনীলের কবিতা মূলত কনফেসনাল কবিতা। সেক্ষেত্রে তিনি মানবপুত্রের সবচেয়ে কাছাকাছি মানুষ। যিশুর ক্রুশবিদ্ধতা যেমন মানুষকে কাছে নিয়ে এসেছে তেমনি তার যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয় এবং সেই হৃদয়ে অনুভূতি পাঠককে সহজেই নাড়া দিতে পারে। ১৩৬৭ সালে প্রকাশিত ‘একা এবং কয়েকজন’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যে ভাবে ‘বিবৃতি’ দিয়েছেন ঠিক ৪০ বছর পর ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘সেই মুহূর্তে নীরা’ কাব্যগ্রন্থের ‘না পাঠানো চিঠি’তেও তিনি একই মেসেজ দিয়েছেন। কিন্তু সময়ের জীর্ণতা তাকে আক্রান্ত করতে পারেনি।

উনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উনতিরিশে এসে
গর্ভবর্তী হলো, তার মোমের আলোর মতো দেহ
কাঁপলো প্রাণান্ত লজ্জা, বাতাসে কূটিল সন্দেহ
সমস্ত শরীরের মিশে, বিন্দু বিন্দু রক্ত অবশেষে
যন্ত্রণায় বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক,
এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর প্রেমিক।

তলস্তয়ের ‘রিজারেকশনে’র নখলিউদভের মতো ‘বিবৃতি’ কবিতায় সুনীলের এই পুনরুত্থান নীতি বাগিশ সমাজের মুখোশ দেখিয়ে দিতে সহায়তা করে। তেমনি রুশ গল্পকার আদ্রে শাখারভের না পাঠানো চিঠি পড়ে অতি বড় পাষণ্ডের পক্ষেও যেমন না কেঁদে থাকা সম্ভব নয়, তেমনি সুনীলের ‘না-পাঠানো চিঠি’ পড়েও না কেঁদে পারা যায় না। একটা নষ্ট মেয়ের (!) এমন কষ্ট সুনীল ছাড়া বাংলা ভাষার পাঠকদের আর কে জানাতে পেরেছেন? যদিও এর কবিত্ব নিয়ে পাঠক নিঃসংশয় হতে পারেননি। কিন্তু কবিতা কি? এই প্রশ্নের মীমাংসা কেবল সেদিনই সম্ভব যেদিন কবিতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে সম্ভানাহীন এক কানা গলিতে রূপ নেবে। এটিও কবিতার একটি সংজ্ঞা হতে পারে- স্মরণযোগ্য পংক্তি এবং পংক্তির সমষ্টিই কবিতা। সুনীলের এই কবিতাটিও পাঠকের পক্ষে কখনো ভোলা সম্ভব নয়। সুনীলের এই কবিতার বিশেষ কোনো অংশকে কবিতা বলা যাবে না। তার কবিতার টোটালিটি নিহিত তার এই কবিতার ভেতর।

তাৎক্ষণিকতা সুনীলের কবিতাকে পেয়ে বসলেও একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা করার অপরিসীম দক্ষতা রয়েছে তাঁর। সুনীলের কবিতা পাঠের পরে একটি দীর্ঘশ্বাস, একটি কষ্ট মোচনের তৃপ্তি আমাদের অধিকার করে বসে।

সুনীলের কবিতা নিয়ে অভিযোগ করার কিছু নেই। তার নিজেরই কৈফিয়ত:
‘আমার কবিতাগুলি অতিশয় ব্যক্তিগত বা স্বীকারোক্তিমূলক। কোনো স্থির কাব্যআদর্শ আমার নেই। একজন কবির সমাজের সঙ্গে যুক্ত বা বিযুক্ত থাকার প্রশ্ন নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামায়নি। নারীর ভেতরে নারী, রূপের ভেতরে বিষাদ, জলের মধ্যে জল রং, গাড়ি বারান্দার নিচে উপবাসী মানুষ, শ্রেণি বিভৎস প্রকাশ আমাকে যে কোনো সময় বিচলিত করে- এইসব বিষয়ই কখনো প্রশ্নে, কখনো বিষাদে, কখনো ব্যকুলতায়, চিৎকারে আমি নানা রকম ভাষায় প্রকাশের চেষ্টা করি। কবিতা মানে এই সবই, এ ছাড়া আর কি। অনেকটা নিজেরই দুটি মূর্তির মুখোমুখি কথা বলার মতন।’
সুনীলের কবিতা কিছুটা স্বীকারোক্তিমূলক হওয়ায় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তার যতো ক্ষোভ। দেশকাল সময় চেতনা তাকে কালের বরমাল্য পড়িয়ে দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশে লেখা গুজরাটের বন্যার কবিতা কি ভয়ঙ্কর সত্য হয়ে আছে। কবির পক্ষেই কেবল তা উচ্চারণ করা সম্ভব-

প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানালায় বসে,
            গুজরাটের বন্যা দেখতে যেয়ো না...
উড়ে এসো না জলপাইগুড়ি, আসামের আকাশে...
মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়ি, কাণ্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা
ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে
        বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ কী সুন্দর!

সুনীলের কবিতায় এক আশ্চর্য যাদুকরী ক্ষমতা আছে। সেই ম্যাজিকের মুখোমুখি হতে পুরো কবিতাটি পড়ে যেতে হয়। পরিণামে সুনীলের কবিতা হতাশ করে না।

জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসেও সমাজ ও জীবনের দায়বদ্ধতার পাশ কেটে যান না সুনীল। রাজনৈতিক কানাগলির ঘুপচি পচা অন্ধকার তুলে আনতে তিনি এখনো সমান সক্রিয়। ‘স্বপ্ন দর্শন’
কবিতাটি স্মরণ করা যেতে পারে-
সরজু নদীর তীরে গাঢ় সন্ধ্যাকালে
বাবরের সঙ্গে দেখা! তিনি হাঁটু গেড়ে
সোনালি উষ্ণিষ খুলে নামাজ আদায়ে
বসেছেন...
নিবেদন করি তাঁকে, হে শাহেনশাহ
এই যে অযোধ্যা, আর রাম পরিবার
সত্য হোক বা না হোক, নেই ইতিহাস
তবুও অজস্র লোক কল্পনায় মানে
এখানে কি মসজিদ না বানালেই নয়...
রামের মন্দিরটাও প্রয়োজনহীন
কোনো শাস্ত্রে মন্দিরের কথা কিচ্ছু নেই...
সম্রাট বাবর তাঁর নীল চক্ষে হেসে
চুপিচুপি বললেন, অচেনা কুমার
আমি এবংবিধ প্রশ্ন বড় ভালোবাসি...
সুন্দরের পীঠস্থান এই বসুন্ধরা
যারা কলুষিত করে, তারা কি জানে না
এ জীবন অসীমের একটি ফুৎকার!

তবে সবচেয়ে বেশি বলার আছে, সুনীলের প্রেমের কবিতা নিয়ে, এতবেশি, এত জান্তব প্রেমের কবিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে সুনীল ভক্তদের- যা এক বিরল অভিজ্ঞতা। এমনকি তাদের নারী কল্পনার ধরন হয়ে পড়েছে সুনীলের মতো কিংবা সুনীল তার পাঠকের নারী কল্পনাকে তুলে এনেছেন কলমে। সুনীলের প্রেমের জগতই এক সময় পরিণত হয়েছিল কবিতা পাঠকের নিজস্ব প্রেমের জগতে। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের পাশে তিনিও একটি ‘নীরা’র জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন। তবে জীবনানন্দের বনলতা সেন মৃত্যুর মতো বিশাল আর সুনীলের নীরা জীবনের মতো বড়ো। জীবনবাদি কবির স্বাতন্ত্র্য এখানেই। 

উনিশ তিপান্ন সালের শ্রাবণ মাসে সুনীল সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রের পর এটিই কোলকাতা কেন্দ্রিক কবিতার সবচেয়ে আলোচিত কাগজ ছিল। তাছাড়া বাংলা ভাষার কবিতা পত্রিকা হিসেবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এতো দীর্ঘদিন টিকে থাকা একটি বিরল ঘটনা। এই কৃত্তিবাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল কৃত্তিবাস গোষ্ঠী। বিশেষকরে কল্লোলের পরে কৃত্তিবাস ভিন্ন এমন সুষ্পষ্ট কোনো গোষ্ঠী গড়ে ওঠেনি। কবিতার ভাষা নিয়ে হৈহুল্লোড় ভাংচুর সামাজিক রীতির প্রতি অবজ্ঞা, এই গোষ্ঠীর কবিদের প্রতি পাঠককে আকৃষ্ট করে তুলেছিল। তাছাড়া তিরিশের কবিতার দুর্বোধ্যতা পরিণামে পাঠক বিমুখতা এবং চল্লিশের কবিতার বিপ্লববাদী চেতনা থেকে কৃত্তিবাস গোষ্ঠী বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। সুনীল ব্যক্তিগত জীবনে যদিও কিছুটা মাকর্সবাদী, তবু কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কোনো চেতনা তাকে সীমায়িত করতে পারেনি। কৃত্তিবাসকে কেন্দ্র করে সুনীলের বিকাশটি আরো দৃশ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া একটি গোষ্ঠীবদ্ধতা কবিতার প্রচারণার ক্ষেত্রে তাদের জন্য একটি সুবিধে বয়ে আনতে পেরেছিল। ‘কৃত্তিবাস’ নামের কবিতায় সুনীল লিখেছিলেন-

গা দিয়ে মড়া পোড়ার গন্ধ বেরোয়, তখন আমরা প্রায়ই যেতাম
শ্মশানে, শরতের কৌতুক ও শক্তির দুর্দান্তপনা, সন্দীপনের চোখ মচকানো,
                    আর কী দুরন্ত নাচ
সমরেন্দ্র, তারাপদ আর উৎপলের লুকোচুরি, খোলা হাস্য...

আমাদের সবচেয়ে আকৃষ্ট করে সুনীলের কবিতায় অমিত জীবনবাদিতা। সর্বাবস্থায় জীবনকে আকণ্ঠ পানই সুনীলের কবিতার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য।

নিঃসঙ্গ কুষ্ঠরোগীকে, পথভ্রান্ত জন্মান্ধকে, হাড়া কাটার
বাতিল বেশ্যাকে বলেছি, বেঁচে থাকো
            বেঁচে থাকো
হে ধর্মঘটী, হে অনশনী, হে চণ্ডাল, হে কবরখানার ফুলচোর
                        বেঁচে থাকো
হে সন্তানহীন ধাইমা, তুমিও বেঁচে থাকো, হে ব্যর্থ কবি তুমিও
বাঁচো, বাঁচো , হে আতুর, হে বিরহী, হে আগুনে পোড়া সর্বস্বান্ত, বাঁচো
বাঁচো জেলখানায় তোমরা সবাই, বাঁচো হাসপাতালে তোমরা
বাঁচো, বাঁচো, বেঁচে থাকো...

পরিশেষে বলতে হয়, ঢাকার কবিতা এবং কোলকাতার কবিতার মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। এক ভাষাভাষী হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামশীলতা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রয়েছে কোলকাতার থেকে এক পৃথক ঐতিহ্য। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কবি ও কবিতার মধ্যে তা পৃথকভাবে বাঙ্ময় হচ্ছে। যদিও প্রকৃত কবিতার কোনো দেশকাল নেই, মানুষের বোধের জগতে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনি নেই। কোলকাতাকে কেন্দ্র করেই সুনীলের সাহিত্যিক রাখালিপনা, আর যাবতীয় গোঠলীলা। তবু এই সত্য অনস্বীকার্য, সুনীলের ধাতৃভূমি কোলকাতার হলেও পিতৃভূমি বাংলাদেশ। শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিময় বাংলা তার রচনার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। ‘এখানে এখন শুধু মুখোমুখি বসে রবো আমি আর হাসন রাজা।’ তাই উনিশশো একাত্তরের পটভূমিতে সুনীলের কবিতা একটুও বানানো মনে হয় না।

মা তোমার লাবণ্যকে দেখি জুলাইয়ের তেরসা
শয়তানের তাড়া খেয়ে ঝাঁপ দিল ভরা বর্ষা নদীর পানিতে
জাল ফেলে তবু ওকে টেনে তুললো, ছটফটাচ্ছে যেন
                        এক জলকন্যা
স্টিমারঘাটায় আমি তখন খুঁটির সঙ্গে পিছমোড়া বাঁধা!

কিংবা

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্টে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো!
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
    নদীর শিয়রে ঝুকে পড়া মেঘ
    প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ
    এ আমারই সাড়ে-তিন হাত ভূমি

(সৌজন্য ঃ 'প্রিয়.কম', বাংলাদেশ)


দীপক লাহিড়ী ।। 'তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী তুমি নিজে'

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 



দীপক লাহিড়ী ।। 'তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী তুমি নিজে' 


(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণ) 

ইংরেজ কবি লর্ড টেনিসনের অনুবাদ বা গৃহশিক্ষক হয়ে ছাত্রীর উদ্দেশে কবিতা 'একটি চিঠি' যেটাই লেখেন না কেনো,সম্পর্কের কাছে আপনি বহুবার নত হয়েছেন।প্রেম আপনাকে দিয়েছিল মানসিক ঐশ্বর্য,স্বপ্নের সোনার চাবি,নিমফুলের ভেসে আসা গন্ধ আর মদিরার স্বাদ।কবিতা আপনার চারপাশে তৈরি করল বলয়,আপনি সূর্যগ্রহণ দেখে বলে উঠলেন,হীরের নাকছাবি।রবি ঠাকুরের গান,মাতাল সমীরণ,চাঁদেরভেলা, খোয়াইয়ের নির্জনতা ছাড়াও মানুষ,মানুষ আর মানুষের কাছে আপনার আত্মসমর্পণ।ভবঘুরে মানুষ,কবিতাছাপানোর সুলুকসন্ধানী মানুষ, চরিত্রহননকারী মানুষ সবাইকে আপনি বিশ্বাস করেছেন কমবেশি।আর আত্মানুসন্ধানের বেশিরভাগ পর্বে ঠোঁটে রেখেছেন জলন্ত সিগারেট।হয়ত সবকিছুই ছিল আপনার কাছে বসন্ত দিনের ডাক।জীবন ও জীবিকার সঙ্ঘবদ্ধতার মধ্যে আপনার কাব্যের অতিক্রান্ত পথিক একদিন সন্ধান পেল গদ্যের।এক অনায়াস পরিশ্রমী গদ্য নিয়ে এলো নীললোহিত,সনাতন পাঠক-কে।গল্প-উপন্যাসের শুরুর মুখে 'আত্মপ্রকাশ'-এর বৈচিত্র্যপূর্ণ সমআধুনিক পটভূমি,দৈনন্দিন জীবনযাপনকে নানা বর্ণে চিত্রিত করল।অভিব্যক্ত বাংলার ফরিদপুরের অখ্যাত 'মাইজ গাঁ' থেকে পিতার কর্মস্থল উত্তর কলকাতায় বড় হওয়া বা পরবর্তীতে দমদম -এ বসবাস নিজের দৃষ্টিভঙ্গি-কে প্রসারিত করেছে।পরে পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে অবিরত ভারত ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিরবচ্ছিন্ন ঘোরাফেরা সৃষ্টির সামগ্রিক দিক কে উদ্ভাসিত করেছে। 

'একা এবং কয়েকজন'-এর কাব্যময়তা থেকে গদ্যের সম্ভার থেকে ধীরে ধীরে ইতিহাস ভিত্তিক লেখা ও বাঙালির সমাজজীবনের পালাবদল নিয়ে লিখলেন-- 

'সেই সময়','প্রথম আলো','পূর্বপশ্চিম'-এর মতো উপন্যাস।পাঠক অভিভূত হয়েছে তবুও আপনার সমগ্র সত্তায় অবিরত ঝরে পড়েছে কাব্যের বৃষ্টিধারা অথবা আগুন বৈশাখের সূর্য রশ্মি।নাটকের অপরূপ সংলাপ ও তার নির্মাণ কখনও বা সৌখিন অভিনয়,রবীন্দ্রগানের মধ্যমণি সর্বত্র ছিল আপনার বিচরণ!আর একসময়ে তারুণ্যের জোয়ারে গা ভাসিয়ে 'কৃত্তিবাস' পত্রিকা প্রকাশ যা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বজায় ছিল একথা বেশিরভাগ সাহিত্যপ্রেমী মানুষমাত্রই জানেন। 

আবার হয়তো এই বহুমাত্রিকতার মধ্যেও আপনি একলা ছিলেন।যে শুধুই পৃথিবী,প্রকৃতি আর নারীর কাছে চেতনাশূন্য নতজানু। 

বাংলাভাষার অস্তিত্বরক্ষার জন্য সংগ্রাম,সংগঠনের মঞ্চ তৈরি করে পথে নামা,অবিরত সংবাদপত্রের কলমে সোচ্চার হওয়া এসব নিয়েই আপনি হয়ে উঠেছিলেন সময়ের এক বৃহৎ কর্ণধার।বাংলা রচনাশৈলীর সরল সহজ সরল ধারা নদীর মতো বইত রচনা বরাবর।তাই ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের বহুতলে জীবনের চরমতম শেষবাক্য উচ্চারণ :আমার কী পক্ষাঘাত হচ্ছে !আশ্বিনের দুর্গোৎসবের আলোর মালায় তখন উদ্ভাসিত পল্লীর মুখ অথচ বাসস্থলের অঙ্গন জুড়ে হঠাৎ নেমে পড়ল অন্ধকারের চন্দ্রাতপ।কেনো যেন ভেসে আসে মার্লোর ব্যবহৃত 'ডক্টর ফাউস্ট'-নাটকে সেই অবিস্মরণীয় সংলাপ : "make me immortal with a kiss".

কথোপকথনঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 


কথোপকথনঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


জন্ম: ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪/(২১ ভাদ্র, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ)
মৃত্যু: ২৩ অক্টোবর, ২০১২
এই কথোপকথনটি 'দ্বিতীয় রবিবার', রূপান্তরের পথে থেকে পুনঃপ্রকাশিত হল। 
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সংগে কথা বলেছিলেন রাজীব সিংহ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।। ৫০টি নির্বাচিত কবিতা

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।। ৫০টি নির্বাচিত কবিতা


হিমযুগ

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে আসি শরীরের কাছে
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-
শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি
মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-

আমার নিশ্বাস পড়ে দ্রুত, বড়ো ঘাম হয়, মুখে আসে স’তি
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।
নয় ক্রুদ্ধ যুদ্ধ, ঠোঁটে রক্ত, জঙ্ঘার উত্থান, নয় ভালোবাসা
ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতোরো দিন পরে
অথবা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর
তুমি হও নদীর গর্ভের মতো, গভীরতা, ঠান্ডা, দেবদূতী
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।

মৃত শহরের পাশে জেগে উঠে দেখি আমার প্লেগ, পরমাণু কিছু নয়,
স্বপ্ন অপছন্দ হলে পুনরায় দেখাবার নিয়ম হয়েছে
মানুষ গিয়েছে মরে, মানুষ রয়েছে আজও বেঁচে
ভুল স্বপ্নে, শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মতো যোনী
তুমি কথা দিয়েছিলে…..
এবার তোমার কাছে হয়েছি নিঃশেষে নতজানু
কথা রাখো! নয় রক্তে অশ্বখুর, স্তনে দাঁত, বাঘের আঁচড় কিংবা
ঊরুর শীৎকার
মোহমুগ্ধরের মতো পাছা আর দুলিও না, তুমি হৃদয় ও শরীরে ভাষ্য
নও, বেশ্যা নও, তুমি শেষবার
পৃথিবীর মুক্তি চেয়েছিলে, মুক্তি, হিমযুগ, কথা দিয়েছিলে তুমি
উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।।

কেউ কথা রাখেনি

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
                      শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী 
                                                    আর এলোনা
                      পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।

মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
                      তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
                      সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর 
                                                                  খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো?  আমার মাথা এ ঘরের ছাদ 
               ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় 
                                 তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
                                     ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
                      কত রকম আমোদে হেসেছে
                      আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
                                        আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
                      সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
                                         এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!

হঠাৎ নীরার জন্য

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল
                                   স্বপ্নে বহুক্ষণ
দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।

দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি
আজই কি ফিরেছো?
স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন
তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে
তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,
অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।

এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম
ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়
বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা
নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি
এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে
বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে
পুণ্যবান হবো।

বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,
                                   বাড়িতে আসবেন!’

রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।
‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে
কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে
সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন
ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে
পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্‌টের দরজায়।

বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।।

যদি নির্বাসন দাও

কাব্যগ্রন্থঃ আমার স্বপ্ন

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
                       আমি বিষপান করে মরে যাবো!
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
                       নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
                       প্রান্তরে দিগন্ত নিনির্মেষ-
                       এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
                              আমি বিষপান করে মরে যাবো।

ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
                    এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
             মোচার খোলায় ঘোরে

                    লুঠেরা, ফেরারী!
শহরে বন্দরে এত অগ্নি বৃষ্টি
                    বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
                    বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
                              বুলেট ও বিস্ফোরণ
                              শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
                              রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল-
            এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
                 আমি বিষপান করে মরে যাবো।

কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দিঘির পাড়ে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
                    স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?
আমি কি দেখিনি কোনো মন্থর বিকেলে
                    শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি?
মোষের ঘাড়ের মত পরিশ্রমী মানুষের পাশে
                    শিউলি ফুলের মত বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
                        তীক্ষ স্বর?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
                        এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
                        আমি বিষপান করে মরে যাবো।


মন ভালো নেই

কাব্যগ্রন্থঃ মন ভালো নেই

মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি সুরা এমনকি ভাষা
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায় ..

ভালোবাসা

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

ভালোবাসা নয় স্তনের ওপরে দাঁত?
ভালোবাসা শুধু শ্রাবণের হা-হুতাশ?
ভালোবাসা বুঝি হৃদয় সমীপে আঁচ?
ভালোবাসা মানে রক্ত চেটেছে বাঘ!

ভালোবাসা ছিল ঝর্ণার পাশে একা
সেতু নেই আকাশে পারাপার
ভালাবাসা ছিল সোনালি ফসলে হওয়া
ভালোবাসা ছিল ট্রেন লাইনের রোদ।

শরীর ফুরোয় ঘামে ভেসে যায় বুক
অপর বহুতে মাথা রেখে আসে ঘুম
ঘুমের ভিতরে বারবার বলি আমি
ভালোবাসাকেই ভালবাসা দিয়ে যাবো।

দেখা হবে

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

ভ্রূ-পল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে-
সগন্ধের সঙ্গে পাবো, দ্বিপ্রহরে বিজন ছায়ায়
আহা, কি শীতল স্পর্শ হৃদয়-ললাটে, আহা, চন্দন চন্দন
দৃষ্টিতে কি শান্তি দিলে, চন্দন, চন্দন
আমি বসে থাকবো দীর্ঘ নিরালায়

প্রথম যৌবনে আমি অনেক ঘুরেছি অন্ধ, শিমূলে জরুলে
লক্ষ লক্ষ মহাদ্রুম, শিরা-উপশিরা নিয়ে জীবনের কত বিজ্ঞাপন
তবুও জীবন জ্বলে, সমস্ত অরণ্য-দেশ জ্বলে ওঠে অশোক আাগুনে
আমি চলে যাই দূরে, হরিণের ক্রস্ত পায়ে, বনে বনান্তরে,অন্বেষণ।

ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে ….এতকাল ডাকো নি আমায়
কাঙালের মতো আমি এত একা, তোমায় কি মায়া হয়নি
শোনো নি আমার দীর্ঘশ্বাস?
হৃদয় উন্মুক্ত ছিল, তবুও হৃদয় ভরা এমন প্রবাস!

আমার দুঃখের দিনে বৃষ্টি এলো, তাই আমি আগুন জ্বেলেছি,
সে কি ভুল!
শুনিনি তোমার ডাক, তাই মেঘমন্দ্র স্বরে গর্জন করেছি, সে কি ভুল?
আমার অনেক ভুল, অরন্যের একাকীত্ব অসি’রতা ভ্রাম্যমান ভুল!
এক মুহুর্তেই
সর্ব অঙ্গে শিহরণ, ক্ষণিক ললাট ছুঁয়ে উপহার দাও সেই
অলৌকিক ক্ষণ
তুমি কি অমূল-তরু, স্নিগ্ধজ্যোতি, চন্দন, চন্দন,
দৃষ্টিতে কি শান্তি দিলে চন্দন, চন্দন
আমার কুঠার দূরে ফেলে দেব, চলো যাই গভীর গভীরতম বনে।

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে। আমি আক্রোশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-
(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)

আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়িরে ছেলে
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পার। নিখিলেশ, তুই একে
কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেকেরে
বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা;
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি ফুলের পাশে ফূল হয়ে ফূটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একি নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত
দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই,
আমার ঘরের
দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি ….., ব্যক্তিগত জিরো আওয়অর;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাত্‌ড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদুরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না। আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে
বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।

প্রেমহীন

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

শেষ ভালোবাসা দিয়েছি তোমার পূর্বের মহিলাকে
এখন হৃদয় শূন্য, যেমন রাত্রি রাজপথ
ঝকমক করে কঠিন সড়ক, আলোয় সাজানো, প্রত্যেক বাঁকে বাঁকে
প্রতীক্ষা আছে আঁধারে লুকানো তবু জানি চিরদিন
এ-পথ্‌ থাকবে এমনি সাজানো, কেউ আসবে না, জনহীন, প্রেমহীন
শেষ ভালোবাসা দিয়েছি তোমার পূর্বের মহিলাকে!

রূপ দেখে ভুলি কী রূপের বান, তোমার রূপের তুলনা
কে দেবে? এমন মূঢ় নেই কেউ, চক্ষু ফেরায়, চক্ষু ফেরাও
চোখে চোখে যদি বিদ্যুৎ জ্বলে কে বাঁচাবে তবে? এ হেন সাহস
নেই যে বলবো; যাও ফিরে যাও
প্রেমহীন আমি যাও ফিরে যাও
বটের ভীষণ শিকড়ের মতো শরীরের রস
নিতে লোভ হয়, শরীরে অমন সুষমা খুলো না
চক্ষু ফেরাও, চক্ষু ফেরাও!
টেবিলের পাশে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ালে তোমার
বুক দেখা যায়, বুকের মধ্যে বাসনার মতো
রৌদ্যের আভা, বুক জুড়ে শুধু ফুলসম্ভার,-
কপালের নিচে আমার দু’চোখে রক্তের ক্ষত
রক্ত ছেটানো ফুল নিয়ে তুমি কোন্‌ দেবতার
পূজায় বসবে? চক্ষু ফেরাও, চক্ষু ফেরাও, শত্রু তোমার
সামনে দাঁড়িয়ে, ভূরু জল্লাদ, চক্ষু ফেরাও!
তোমার ও রূপ মূর্ছিত করে আমার বাসনা, তবু প্রেমহীন
মায়ায় তোমায় কাননের মতো সাজাবার সাধ, তবু প্রেমহীন
চোখে ও শরীরে এঁকে দিতে চাই নদী মেঘ বন, তবু প্রেমহীন
এক জীবনের ভালোবাসা আমি হারিয়ে ফেলেছি খুব অবেলায়
এখন হৃদয় শূন্য, যেমন রাত্রির রাজপথ।।

নীরার জন্য কবিতার ভূমিকা

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি, নীরা
এ-কবিতা মধ্যরাত্রে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে
ঘুমের ভিতরে তুমি আচমকা জেগে উঠে টিপয়ের
থেকে জল খেতে গিয়ে জিভ কামড়ে একমুহূর্ত ভাবলে
কে তোমার কথা মনে করছে এত রাত্রে–তখন আমার
এই কবিতার প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কম ড্যাস রেফ্‌
ও রয়ের ফুট্‌কি সমেত ছুটে যাচ্ছে তোমার দিকে, তোমার
আধোঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও
বিছানায় আমার নিশ্বাসের মতো নিঃশব্দ এই শব্দগুলি
এই কবিতার প্রত্যেকটি অক্ষর গুণিনের বাণের মতো শুধু
তোমার জন্য, এরা শুধু তোমাকে বিদ্ধ করতে জানে

তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও, আমি বহু দূরে আছি
আমার ভয়ংকর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে
আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্খা ও
চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না–আমার সম্পূর্ণ আবেগ
শুধু মোমবাতির আলোর মাতো ভদ্র হিম,
                  শব্দ ও অক্ষরের কবিতায়
তোমার শিয়রের কাছে যাবে–এরা তোমাকে চুম্বন করলে
তুমি টের পাবে না, এরা তোমার সঙ্গে সারারাত শুয়ে থাকবে
এক বিছানায়–তুমি জেগে উঠবে না, সকালবেলা তোমার পায়ের
কাছে মরা প্রজাপতির মতো এরা লুটোবে। এদের আত্মা মিশে
থাকবে তোমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, চিরজীবনের মতো

বহুদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্ণার জলের মতো
হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে। নীরা, আমি তোমার অমন
সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো। আমি অন্য কথা
বলার সময় তোমার প্রস্ফুটিত মুখখানি আদর করবো মনে মনে
ঘরভর্তি লোকের মধ্যেও আমি তোমার দিকে
                            নিজস্ব চোখে তাকাবো।
তুমি জানতে পারবে না–তোমার সম্পূর্ণ শরীরে মিশে আছে
আমার একটি অতি-ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা।।

নীরা তোমার কাছে

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

সিঁড়ির মুখে কারা অমন শান্তভাবে কথা বললো?
বেরিয়ে গেল দরজা ভেজিয়ে, তবু তুমি দাঁড়িয়ে রইলে সিঁড়িতে
রেলিং-এ দুই হাত ও থুত্‌নি, তোমায় দেখে বলবে না কেউ থির বিজুরি
তোমার রঙ একটু ময়লা, পদ্মপাতার থেকে যেন একটু চুরি,
দাঁড়িয়ে রইলে
নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।

নীরা, তোমায় দেখি আমি সারা বছর মাত্র দু’দিন
দোল ও সরস্বতী পূজোয়–দুটোই খুব রঙের মধ্যে
রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে সারা বছর মাত্র দু’দিন–
ও দুটো দিন তুমি আলাদা, ও দুটো দিন তুমি যেন অন্য নীরা
বাকি তিনশো তেষট্টি বার তোমায় ঘিরে থাকে অন্য প্রহরীরা।
তুমি আমার মুখ দেখোনি একলা ঘরে, আমি আমার দস্যুতা
তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, আমরা কেউ বুকের কাছে কখনো
কথা বলিনি পরস্পর, চোখের গন্ধে করিনি চোখ প্রদক্ষিণ–
                                       আমি আমার দস্যুতা
তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, নীরা তোমায় দেখা আমার মাত্র দু’দিন।

নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।
আমি তোমায় লোভ করিনি, আমি তোমায় টান মারিনি সুতোয়
আমি তোমার মন্দিরের মতো শরীরে ঢুকিনি ছল ছুতোয়
রক্তমাখা হাতে তোমায় অবলীলায় নাশ করিনি;
দোল ও সরস্বতী পূজোয় তোমার সঙ্গে দেখা আমার–সিঁড়ির কাছে
                                            আজকে এমন দাঁড়িয়ে রইলে
নীরা, তোমার কাছে আমি নীরার জন্য রয়ে গেলাম চিরঋণী।

উত্তরাধিকার

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ 
তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর 
ফুসফুস-ভরা হাসি 
দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হ’য়ে শুয়ে থাকা 
এসব এখন তোমারই, তোমার হাত ভ’রে নাও আমার অবেলা 
আমার দুঃখবিহীন দুঃখ ক্রোধ শিহরণ 
নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম আমার যা-কিছু ছুল আভরণ 
জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, সিগারেট চুরি, জানালার পাশে 
বালিকার প্রতি বারবার ভুল 
পরুষ বাক্য, কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা, ছুরির ঝলক 
অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মত আর যা-কিছুর 
বুক চিরে দেখা 
আত্মহনন, শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত 
একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী — 
এ-সবই আমার পুরোনো পোষাক, বড় প্রিয় ছিল, এখন শরীরে 
আঁট হয়ে বসে, মানায় না আর 
তোমাকে দিলাম, নবীন কিশোর, ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও 
অথবা ঘৃণায় দূরে ফেলে দাও, যা খুশি তোমার 
তোমাকে আমার তোমার বয়সী সব কিছু দিতে বড় সাধ হয়

ইচ্ছে হয়

কাব্যগ্রন্থঃ দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়

এমনভাবে হারিয়ে যাওয়া সহজ নাকি
ভিড়ের মধ্যে ভিখারী হয়ে মিশে যাওয়া?
এমনভাবে ঘুরতে ঘুরতে স্বর্গ থেকে ধুলোর মর্ত্যে
মানুষ সেজে এক জীবন মানুষ নামে বেঁচে থাকা?

রূপের মধ্যে মানুষ আছে, এই জেনে কি নারীর কাছে
রঙের ধাঁধা খুঁজতে খুঁজতে টনটনায় চক্ষু-স্নায়ু
কপালে দুই ভুরুর সন্ধি, তার ভিতরে ইচ্ছে বন্দী
আমার আয়ু, আমার ফুল ছেঁড়ার নেশা
নদীর জল সাগরে যায়, সাগর জল আকাশে মেশে
আমার খুব ইচ্ছে হয় ভালোবাসার
মুঠোয় ফেরা!


চোখ নিয়ে চলে গেছে

কাব্যগ্রন্থঃ দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়

এই যে বাইরে হু হু ঝড়, এর চেয়ে বেশী
বুকের মধ্যে আছে
কৈশোর জুড়ে বৃষ্টি বিশাল, আকাশে থাকুক যত মেঘ,
যত ক্ষণিকা
মেঘ উড়ে যায়
আকাশ ওড়ে না
আকাশের দিকে
উড়েছে নতুন সিঁড়ি
আমার দু বাহু একলা মাঠের জারুলের ডালপালা
কাচ ফেলা নদী যেন ভালোবাসা
ভালোবাসার মতো ভালোবাসা
দু‘দিকের পার ভেঙে
নরীরা সবাই ফুলের মতন, বাতাসে ওড়ায়
যখন তখন
রঙিন পাপড়ি
বাতাস তা জানে, নারীকে উড়াল দেয়ে নিয়ে যায়
তাই আমি আর প্রকৃতি দেখি না,
প্রকৃতি আমার চোখ নিয়ে চলে গেছে!

তুমি

কাব্যগ্রন্থঃ একা এবং কয়েকজন

আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভূরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশের মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করোছো অসীম।

বেদনা মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনও ভাবি অপার্থিব কিনা।

সারাদিন পৃথিবীকে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে সি’র জানি তুমি দেবে ক্ষমা।

তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কার মুখর
তোমার সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখে জয়ের স্বাক্ষর।

যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্পূটে
অসি’র অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।

ব্যর্থ প্রেম

কাব্যগ্রন্থঃ দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়

প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়
আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি
দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে যায়
আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক
অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে
হেঁটে যাই

সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না
আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই
রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট
অন্ধ মানুষের শাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে
খসে পড়ে
আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ
ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে
মনে হয় খুব আপন

আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা
প্যান্ট শার্ট পরে
আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে
আমি নিজেই আদর করি
খুব গোপনে

আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ
আমার সর্বাঙ্গে কোথাও
একটুও ময়লা নেই
অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার
মাথার পেছনে

আর কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।

তুমি যেখানেই যাও

কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ

তুমি যেখানেই যাও
আমি সঙ্গে আছি
মন্দিরের পাশে তুমি শোনো নি নিঃশ্বাস?
লঘু মরালীর মতো হাওয়া উড়ে যায়
জ্যোৎস্না রাতে
নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়
ভ্রমণকারিণী হয়ে তুমি য়েলে কার্শিয়াং
অন্য এক পদশব্দ পেছনে শোনো নি?
তোমার গালের পাশে ফুঁ দিয়ে কে সরিয়েছে
চুর্ণ অলক?

তুমি সাহসিনী,
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনি
রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে
আমি দেখি
তোমার সুটাম তনু
ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত
আমি থাকি তোমার প্রহরী।
তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না
শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয়
সে এসেছে
চড়ুই পাখিরা জানে
আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি
এলচের দানা জানে
কার ঠোঁট গন্ধময় হবে-
তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো
সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি
দেখা দাও, দেখা দাও,
পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি
হেঁসে বলি,
তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি!

প্রেমিকা

কাব্যগ্রন্থঃ দাঁড়াও সুন্দর

কবিতা আমার ওষ্ঠ কামড়ে আদর করে
ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে যায়
ছাদের ঘরে
কবিতা আমার জামার বোতাম ছিঁড়েছে অনেক
হঠাৎ জুতোর পেরেক তোলে!
কবিতাকে আমি ভুলে থাকি যদি
অমনি সে রেগে হঠাৎ আমায়
ডবল ডেকার বাসের সামনে ঠেলে ফেলে দেয়
আমার অসুখে শিয়রের কাছে জেগে বসে থাকে
আমার অসুখ কেড়ে নেওয়া তার প্রিয় খুনসুটি
আমি তাকে যদি
আয়নার মতো
ভেঙ্গে দিতে যাই
সে দেখায় তার নগ্ন শরীর
সে শরীর ছুঁয়ে শান্তি হয় না, বুক জ্বলে যায়
বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়।

অপেক্ষা

কাব্যগ্রন্থঃ জাগরণ হেমবর্ণ

সকালবেলা এয়ারপোর্টে গেয়েছিলাম একজন বৃদ্ধ আন্তর্জাতিক
ফরাসীর সঙ্গে দেখা করার জন্য, যিনি নিজের শৈশবকে ঘৃণা
করেন।
তিনি তখনো আসেননি, আমি একা বসে রইলাম ভি আই পি
লাউঞ্জে। ঠান্ড ঘর, দুটি টাটকা ডালিয়া, বর্তমান রাষ্ট্রপতির
বিসদৃশ রকমের বড় ছবি। সিগারেট ধরিয়ে আমি বই খুলি।
যে- কোনো বিমানের শব্দে আমার উৎকর্ণ হয়ে ওঠার দরকার
নেই। বিশেষ অতিথির ঘর চিনতে ভুল হয় না। সিকিউরিটির
লোক একবার এসে আমাকে দেখে যায়। আমি অ্যাশট্রের
বদলে ছা‌ই ফেলি সোফার গদিতে-কারণ, এতে বিছু যায়
আসে না।
সময়ের মুহূর্ত, পল, অনুপল স্তব্ধ হয়ে থকে-এক বন্ধ
বিরাট নির্জন ঘর, আমি একা, আমার পা ছড়ানো -আকাশ
থেকে মহাকাশে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় স্মৃতি, তার মধ্যে একটা
সূর্যমুখী ক্রমশ প্রকাণ্ড থেকে আরও বিশাল, লক্ষ লক্ষ
সমান্তরাল আলো, যুদ্ধ-প্রতিরোধের মিছিলের মতন,
যেন অজস্র মায়াময় চোখ দংশন করে নির্জনতা, ঘুমের
মধ্যে পাশ ফেরার মতন-
একটা টেলিফোন বেজে ওঠে। আমার জন্য নয়, আমার
জন্য নয়-||

স্বপ্নের কবিতা

কাব্যগ্রন্থঃ মন ভালো নেই

আমি তো দাঁড়িয়েছিলাম পাশে, সামনে বিপুল জনস্রোত
হলুদ আলোর রাস্তা চলে গেছে অতিকায় সুবর্ণ শহরে
কেউ আসে কেউ যায়, কারো আঙুল থেকে ঝরে পড়ে মধু
কেউ দাঁতে পিচ কাটে, সুবর্ণষ্ঠীবীর স্মৃতি লোভ ক’রে
কেউ বা ছুঁয়েছে খুব লঘু যত্নে, সুখী বারবনিতার
তম্বুরাযুগল হেন পাছা
কারো চুলে রত্নচ্ছটা, কারো কণ্ঠে কাঁচা-গন্ধ বাঘনখ দোলে
আমি তো দাঁড়িয়েছিলাম পাশে, সামনে বিপুল জনস্রোত।

কোথায় সুবর্ণ সেই নগরীটি? কোন্‌ রাস্তা হলুদ আলোয় আলোকিত?
কে দাঁড়িয়েছিলাম সেই পথপ্রান্তে? আমি নয়, কোনোদিন দেখিনি সে পথ
আঙুল কী করে ঝরে মধু? কেন কেউ কন্ঠে রাখে কাঁচা বাঘনখ?
কিচুই জানি না আমি, এমনকি সুবর্ণষ্ঠীবীর ঠিক বানানেও রয়েছে সন্দেহ
তবু কেন কবিতা লেখার আগে এই দৃশ্য, অবিকল, সম্পূর্ণ অটুট
স্বপ্ন, কিংবা তার চেয়ে বেশী সত্য হয়ে ওঠে, আমার চৈতন্য বেঁধে সুঁচ
প্রায় কোনো কাটাকাটি না-করেই অফিস- টেবিলে বসে আমি
ঐ দৃশ্য লিখে যাই।।

নীরা তুমি…

কাব্যগ্রন্থঃ সোনার মুকুট থেকে

নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র
আমাকে দেবে না?
শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি
নদী-সহবাসে কাটে দিন
এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল
পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল
এই নদী তুমি!

বড় দেরি হয়ে গেল, আকাশে পোশাক হতে বেশি বাকি নেই
শতাব্দীর বাঁশবনে সাংঘাতিক ফুটেছে মুকুল
শোনোনি কি ঘোর দ্রিমি দ্রিমি?
জলের ভিতর থেকে সমুত্থিত জল কথা বলে
মরুভূমি মেরুভূমি পরস্পর ইশারায় ডাকে
শোনো, বুকের অলিন্দে গিয়ে শোনো
হে নিবিড় মায়াবিনী, ঝলমলে আঙুল তুলে দাও।
কাব্যে নয়, নদীর শরীরে নয়, নীরা
চশমা-খোলা মুখখানি বৃষ্টিজলে ধুয়ে
কাছাকাছি আনো
নীরা, তুমি নীরা হয়ে এসো!

অপমান এবং নীরাকে উত্তর

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, নীরা, কেন হেসে উঠলে, কেন
সহসা ঘুমের মধ্যে যেন বজ্রপাত, যেন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, নীরা, হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে কেন সাক্ষী কেন বন্ধু কেন তিনজন কেন?
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন!

একবার হাত ছুঁয়েছি সাত কি এগারো মাস পরে ঐ হাত
কিছু কৃশ, ঠাণ্ডা বা গরম নয়, অতীতের চেয়ে অলৌকিক
হাসির শব্দের মতো রক্তস্রোত, অত্যন্ত আপন ঐ হাত
সিগারেট না-থাকলে আমি দু’হাতে জড়িয়ে ঘ্রাণ নিতুম
মুখ বা চুলের নয়, ঐ হাত ছুঁয়ে আমি সব বুঝি, আমি
দুনিয়ার সব ডাক্তারের চেয়ে বড়, আমি হাত ছুঁয়ে দূরে
ভ্রমর পেয়েছি শব্দে, প্রতিধ্বনি ফুলের শূন্যতা–

ফুলের? না ফসলের? বারান্দার নিচে ট্রেন সিটি মারে,
                                     যেন ইয়ার্কির
টিকিট হয়েছে কেনা, আবার বিদেশে যাবো সমুদ্রে বা নদী…
                                         আবার বিদেশে,
ট্রেনের জানালায় বসে ঐ হাত রুমাল ওড়াবে।
রাস্তায় এলুম আর শীত নেই, নিশ্বাস শরীরহীন, দ্রুত
ট্যাক্সি ছুটে যায় স্বর্গে, হো-হো অট্টহাস ভাসে ম্যাজিক-নিশীথে
মাথায় একছিটে নেই বাষ্প, চোখে চমৎকার আধো-জাগা ঘুম,
ঘুম! মনে পড়ে ঘুম, তুমি, ঘুম তুমি, ঘুম, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন ঘুম
ঘুমোবার আগে তুমি স্নান করো? নীরা তুমি, স্বপ্নে যেন এরকম ছিল…

কিংবা গান? বাথরুমে আয়না খুব সাঙ্ঘাতিক স্মৃতির মতন,
মনে পড়ে বস স্টপে? স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্নে–স্বপ্নে, বাস-স্টপে
কোনোদিন দেখা হয়নি, ও সব কবিতা! আজ যে রকম ঘোর
দুঃখ পাওয়া গেল, অথচ কোথায় দুঃখ, দুঃখের প্রভূত দুঃখ, আহা
মানুষকে ভূতের মতো দুঃখে ধরে, চৌরাস্তায় কোনো দুঃখ নেই, নীরা
বুকের সিন্দুক খুলে আমাকে কিছুটা দুঃখ বুকের সিন্দুক খুলে, যদি হাত ছুঁয়ে
পাওয়া যেত, হাত ছুঁয়ে, ধূসর খাতায় তবে আরেকটি কবিতা
কিংবা দুঃখ-না-থাকার-দুঃখ…। ভালোবাসা তার চেয়ে বড় নয়!

শুধু কবিতার জন্য

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু
কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।

তোমার কাছেই

কাব্যগ্রন্থঃ মন ভালো নেই

সকাল নয়, তবু আমার
প্রথম দেখার ছটফটানি
দুপুর নয়, তবু আমার
দুপুরবেলার প্রিয় তামাশা
ছিল না নদী, তবুও নদী
পেরিয়ে আসি তোমার কাছে
তুমি ছিলে না তবুও যেন
তোমার কাছেই বেড়াতে আসা!
শিরীষ গাছে রোদ লেগেছে
শিরীষ কোথায়, মরুভূমি!
বিকেল নয়, তবু আমার
বিকেলবেলর ক্ষুৎপিপাসা
চিঠির খামে গন্ধ বকুল
তৃষ্ণা ছোটে বিদেশ পানে
তুমি ছিলে না তবুও যেন
তোমার কাছেই বেড়াতে আসা!

শরীর অশরীরী

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

কেউ শরীরবাদী বলে আমায় ভর্তসনা করলে, তখনই ইচ্ছে হয় 
অভিমানে অশরীরী হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাই।
আবার কেউ ‘অশরীরী’ শব্দটি উচ্চারন করলে আমি কান্নার মতন
ভয় পেয়ে তীব্র কন্ঠে বলি, শরীর, তুমি কোথায়? লুকিও না
এসো, তোমাকে একটু ছুঁই!
এই রকমই জীবন ও মানুষের হাঁটা চলার ভাষা-
সুতরাং ‘ভাষা’ শব্দটি কারুর মুখে শুনলে মনে হয় পৃথিবীর
যাবতীয় ক্ষত্রিয় গদ্যের
বিনাশ করে যেতে হবে।
কোথাও ‘ব্রাহ্মণ’ শুনলে মনে পড়ে ভাঙা মৃৎ-শকটের জন্য কান্না
এ-সবই তো আকাশের চিচে, তোমার মনে পড়ে না?
দেখো,আবার ‘তুমি’ বলছি, অর্থাৎ শরীর
এখন আমি শরীরবাদী না অশরীরী?
অশরীরী, অশলীরী, তাই তো শরীর ছুঁতে ইচ্ছে হয়,
এসো শরীর, তোমায় আদর করি
এসো শরীর, তোমায় ছাপার অক্ষরের মতো স্পষ্টভাবে চুম্বন করি
তোমায় সমাজ-সংস্কারের মতন আদর্শভাবে আলিঙ্গন করি
এসো, ভয় নেই, লজ্জা করো না, কেউ দেখবে না-দেখতে জানে না
সত্যবতী, তোমার দ্বীপের চারপাশ আমি ঢেকে দেবো কুয়াশায়
তোমার মীনচিহ্নিত দেহে ছড়িয়ে দেবো যোজনব্যাপী গন্ধ-
কবিও তো সন্ন্যাসীই, সন্ন্যাসীরই মতন সে হঠাৎ কখনো
যোগভ্রষ্ট হয়ে কামমোহিত হয়-
সেই বিস্মৃত মুহূর্তের লিপ্সা বড় তীব্র, তাকে অপমান করো না
যে যখন জ্যোৎস্নাকে ভোগ করতে চায়, তখন উম্মত্তের মতন
লন্ডভন্ড করে রাত্রি, সে যখন পৃথিবীকে দেখে, তখন
দশ আঙুলের মতন ভয়াবহ চোখে এই শৌখিন ধরিত্রীর সঙ্গে
সঙ্গম করে-যার ডাকনাম ভালোবাসা,-আঃ কেন আবার
একথা, আমি অশরীরী এখন, আমি এখন গীর্জার অন্দরের মতন
পবিত্র বিশেষণ, সমস্ত প্রতীক অগ্রাহ্য করা শ্রেষ্ঠ প্রতীক, এখন
‘সমাজ’ শব্দটি শুনলে পাট ভেজানো জলের গন্ধ মনে পড়ে, কেউ
ক্ষিদে পেয়েছে’ বললে মনে হয়, আহা লোকটি বড় নিষ্ঠাবান
অর্থাৎ ধ্যান, এখন আমার ধ্যান, আর বিস্মরণ নয়, ধ্যান-
কিন্তু যাই বলো, চারপাশে অপ্সরীর নৃত্য না থাকলে চোখ বুঝে
ধ্যানও জমে না!

আবার? আস্তে, না, শরীর নয়, আমি এখন আকাশের নিচে
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, সমস্ত অন্তরীক্ষ জুড়ে তালগাছের মতন
দীর্ঘ কোনো কন্ঠস্বর আমায় বলেছে, দাঁড়াও!
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, আমি এ-রকমও জানি,
চোখে জল এলে বুঝতে পারি, এও তো শরীর, পায়ের ধুলোও শরীরবাদী
আহা. শরীরের ধোষ নেই, সে অশীরীর সামনে হাত জোড়
করে দাঁড়িয়ে আছে।।

পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না
আয়না
ভেঙে
বিচ্ছুরণ
একদিন
বিস্ফোরণ হয়
বুক ভেঙে কান্না এলে কান্নাগুলি ছুটে যায় ধূসর অন্তিমে স্বর্গের অলিন্দে-
স্বর্গ থেকে
তারপর ঢলে পড়ে
মহিম হালদার স্ট্রীটে
প্রাচীন গহ্বরে
মধ্যরাতে।

জানলা ভেঙে বৃষ্টি এলে বুকে যে-রকম পাপ হয়
যে-রকম স্মৃতিহীন মহিম হালদার কিংবা আমি ও মোহিনী
পুরুষের ভাগ্য আর স্ত্রী-শরীর চরিত্র নদীর……
দীপকের মাথাব্যথা হাঁসের পালক ছুঁয়ে হাসাহাসি করে
যে-রকম শান্তিনিকেতন কোনো ত্রিভুবনে নেই
দীপক ও তারাপদ দুই কম্বুকন্ঠ জেগে রয়…….
যে রকম তারাপদ গান গায় গোটা উপন্যাসে সুর দেয়া
কবিতার লাইন ছুঁড়ে পাগলা-ঘন্টি বাজিয়ে ঘুরেছে-

নিকষ বৃত্তের থেকে চোখগুলি ঘোরে ও ঘুমোয়,
শিয়রে পায়ের কাছে বই-বই-বই
তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র-রচনাবলী লুটোয় পাপোশে।
আরো নিজে পাপোশের নিচে এক আহিরীটোলায়
বৃষ্টি পড়ে,
রোদ আসে,
বিড়ালীর সঙ্গে খেলে
বেজম্মা বালিকা-
ছাদে পায়চারি করে গিরগিটি,

শেয়াল ঢুকেছে নীল আলো-জ্বালা গরে
রমণী দমন করে বিশাল পুরুষ তবু কবিতার কাছে অসহায়-
থুতু ও পেচ্ছাব সেরে নর্দমার পাশে বসে কাঁদে-

এ-রকম ছবি দেখে বাতাস অসহ্য হয় বুকের ভিতরে খুব
কশা অভিমানে
শব্দ অপমান করে- ভয় আমাক নিয়ে যায় পুনরায় দক্ষিণ নগরে
মহিম হালদার স্ট্রীটে ঘুরে ফিরে ঘুরে আমি মহিম, মহিম
বলে ডাকাডাকি করি, কেই নেই, মহিম, মহিম, এসো তুমি আর
আমি ও মোহিনী
ফের খেলা শুরু করি, মহিম! মোহিনী।
কোনো সাড়া নেই। ক্রমশ গম্ভীর হয় বাড়িগুলি, আলো
হাড় হিম হয়ে আসে স্মৃতিনষ্ট শীতে।।

নীরার অসুখ

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে
সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়
নীরা আজ ভালো আছে?
গীর্জার বয়স্ক ঘড়ি, দোকানের রক্তিম লাবণ্য–ওরা জানে
নীরা আজ ভালো আছে!
অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে মুখে রটে যায়
নীরার খবর
বকুলমালার তীব্র গন্ধ এসে বলে দেয়, নীরা আজ খুশি
হঠাৎ উদাস হাওয়া এলোমেলো পাগ্‌লা ঘন্টি বাজিয়ে আকাশ জুড়ে
খেলা শুরু করলে
কলকাতার সব লোক মৃদু হাস্যে জেনে নেয়, নীরা আজ বেড়াতে গিয়েছে।

আকাশে যখন মেঘ, ছায়াচ্ছন্ন গুমোট নগরে খুব দুঃখ বোধ।
হঠাৎ ট্রামের পেটে ট্যাক্সি ঢুকে নিরানন্দ জ্যাম চৌরাস্তায়
রেস্তোরাঁয় পথে পথে মানুষের মুখ কালো, বিরক্ত মুখোস
সমস্ত কলকাতা জুড়ে ক্রোধ আর ধর্মঘট, শুরু হবে লণ্ডভণ্ড
টেলিফোন পোস্টাফিসে আগুন জ্বালিয়ে
যে-যার নিজস্ব হৃৎস্পন্দনেও হরতাল জানাবে–
আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, আমি জানি, আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই, গিয়ে বলি,
নীরা, তুমি মন খারাপ করে আছো?
লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে দাও, আয়না দেখার মতো দেখাও ও-মুখের মঞ্জরী
নবীন জনের মতো কলহাস্যে একবার বলো দেখি ধাঁধার উত্তর!
অমনি আড়াল সরে, বৃষ্টি নামে, মানুষেরা সিনেমা ও খেলা দেখতে
চলে যায় স্বস্তিময় মুখে
ট্রাফিকের গিঁট খোলে, সাইকেলের সঙ্গে টেম্পো, মোটরের সঙ্গে রিক্সা
মিলেমিশে বাড়ি ফেরে যা-যার রাস্তায়
সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ কেউ বলে ওঠে, বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না!

সত্যবদ্ধ অভিমান

কাব্যগ্রন্থঃ সত্যবদ্ধ অভিমান

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
                তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
                      নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়–
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
                          মনে মনে বলি,
                          যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো–
                          ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
            আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
                                       পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
            সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
                কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে….
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান–চোখ জ্বালা করে ওঠে,
                                   সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?

চে গুয়েভারার প্রতি

কাব্যগ্রন্থঃ সত্যবদ্ধ অভিমান

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত-
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-
কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!

এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা
ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!

তুমি

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

তুমি অপরুপ, তুমি সৃষ্টির যথেষ্ট পূজা পেয়েছো জীবনে?
তুমি শুভ্র, বন্দনীয়, নারীর ভিতরে নারী, আপাতত, একমাত্র তুমি
বাথরুম থেকে এলে সিক্ত পায়ে, চরণকমলযুগ চুম্বনে মোছার যোগ্য ছিল-
তিন মাইল দুরে আমি ওষ্ঠ খুলে আছি, পূজার ফুলের মতো ওষ্ঠাধর

আমি পুরোহিত, দেখো, আমার চামর, বাহু স্বতোৎসার শ্লোক
হৃদয় অহিন্দু, মুখ সোমেটিক, প্রেমে ভিন্ন কোপটিক খৃষ্টান
আশৈশব থেকে আমি পুরোহিত হয়ে উঠে তোমার রূপের কাছে ঋণী
তোমার রূপের কাছে অগ্নি, হেম, শস্য হবি-পদাঘাতে পূজার আসন
ছড়িয়ে লুকাও তুমি বারবার, তখন তন্ত্রের ক্ষোভে অসহিষ্ণু আমি
সবলে তোমার বুকে বসি প্রেত সাধনায়, জীবন জাগাতে চেয়ে জীবনের ক্ষয়
ওষ্ঠের আর্দ্রতা থেকে রক্ত ঝরে, নারীর বদলে আমি স্ত্রীলোকের কাছে
মাথা খুঁড়ি, পুরোহিত থেকে আমি পুরুষের মতো চোখে ক্রুরতা ছড়িয়ে
আঙুলে আকাশ ছুঁই, তোমার নিঃশ্বাস থেকে নক্ষত্রের জন্ম হলে
আমি তাকে কশ্যপের পাশে রেখে আসি।
এ রকম পূজা হয়, দেখো ত্রিশিরা ছায়ায় কাঁপে ইহকাল
এমন ছায়ার মধ্যে রূপ তুমি রূপের কঠিন ঋণ বিশাল মেখলা
আমি ঋণী আমি ক্রীতদাস নই, আরাধনা মন্ত্রে আমি
তোমাকে সম্পূর্ণ করে যাবো।।

ভালোবাসার পাশেই

কাব্যগ্রন্থঃ দাঁড়াও সুন্দর

ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে
ওকে আমি কেমন করে যেতে বলি
ও কি কোনো ভদ্রতা মানবে না?
মাঝে মাঝেই চোখ কেড়ে নেয়,
শিউরে ওঠে গা
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

দু’হাত দিয়ে আড়াল করা আলোর শিখাটুকু
যখন তখন কাঁপার মতন তুমি আমার গোপন
তার ভেতরেও ঈর্ষা আছে, রেফের মতন
তীক্ষ্ম ফলা
ছেলেবেলার মতন জেদী
এদিক ওদিক তাকাই তবু মন তো মানে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

তোময় আমি আদর করি, পায়ের কাছে লুটোই
সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আগুন নিয়ে খেলি
তবু নিজের বুক পুড়ে যায়, বুক পুড়ে যায়
বুক পুড়ে যায়
কেউ তা বোঝে না

ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

দ্বারভাঙা জেলার রমণী

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

হাওড়া ব্রীজের রেলিং ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল
দ্বারভাঙা জেলা থেকে আসা টাট্‌কা রমনী
ব্রীজের অনেক নিচে জল, সেখানে কোনো ছায়া পড়ে না
কিন্তু বিশাল এক ভগবতী কুয়াশা কলকাতার উপদ্রুত অঞ্চল থেকে
গড়িয়ে এসে
সভ্যতার ভূমধ্য অরিন্দে এসে দাঁড়ালো
সমস্ত আকাশ থেকে খসে পড়লো ইতিহাসের পাপমোচানবারী বিষণ্ণতা
ক্রমে সব দৃশ্য, পথ ও মানুষ মুছে যায়, কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু রইলো সেই
লাল ফুল-ছাপ শাড়ি জড়ানো মূর্তি
রেখা ও আয়তনের শুভবিবাহমূলক একটি উদাসীন ছবি-
আকস্মাৎ ঘুরে গাঁড়ালো সে, সেই প্রধানা মচকা মাগি, গোঠের মল ঝামড়ে
মোষ তাড়ানোর ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো, ইঃ রে-রে-রে-রে-
মুঠো পিছলোনো স্তনের সূর্যমুখী লঙ্কার মতো বোঁটায় ধাক্কা মারলো কুয়াশা
পাছার বিপুল দেলানিতে কেঁপে উঠলো নাদব্রহ্ম
অ্যাক্রোপলিসের থামের মতো উরুতের মাঝখানে
ভাটফুলে গন্ধ মাখা যোনির কাছে থেমে রইলো কাতর হওয়া
ডৌল হাত তুলে সে আবার চেঁচিয়ে উঠলো, ইঃ রে-রে-রে-রে-
তখন সর্বনাশের কাছে সৃষ্টি হাঁটু গেড়ে বসে আছে
তখন বিষণ্নতার কাছে অবিশ্বাস তার আত্মার মুক্তিমূল্য পেয়ে গেছে…
সব ধ্বংসের পর
শুধু দ্বারভাঙা জেলার সেই রমণীই সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো
কেননা ‌ঐ মুহূর্তে সে মোষ তাড়ানোর স্বপ্নে দেখছিল।।

ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জনলায় বসে,
গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না
এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা
ক্রুদ্ধ জলের প্রবল তোলপাড়ের উপড়ে গেছে রেললাইন
চৌচির হয়েছে ব্রীজ, মৃত পশুর পেটের কাছে ছন্নছাড়া বালক
তরঙ্গে ভেসে যায় বৃদ্ধের চশমা, বৃক্ষের শিখরে মানুষের
আপৎকালীন বন্ধুত্ব
এইসব টুকরো দৃশ্য- এক ধরনের সত্য, আংশিক, কিন্তু বড় তীব্র
বিপর্যয়ের সময় এই সব আংশিক সত্যই প্রধান হয়ে ওঠে
ইন্দিরা, লক্ষ্মীমেয়ে, তোমার এ-কথা ভোলা উচিত নয়
মেঘের প্রাসাদে বসে তোমার করুণ কন্ঠস্বরেও
কোনো সার্বজনীন দু:খ ধ্বনিত হবে না
তোমার শুকনো ঠোঁট, কতদিন সেখানে চুম্বনের দাগ পড়েনি,
চোখের নিচে গভীর কালো ক্লান্তি, ব্যর্থ প্রেমিকার মতো চিবুকের রেখা
কিন্তু তুমি নিজেই বেছে নিয়েছো এই পথ
তোমার আর ফেরার পথ নেই
প্রিয়দর্শিনী, তুমি এখন বিমানের জনলায় বসে
উড়ে এসো না জলপাইগুড়ি, আসামের আকাশে
এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা
আমি তোমাকে আবার সাবধান করে দিচ্ছি-
উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা
প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা
নতুন জলের প্রবাহ, তেজে স্রোত-যেন মেঘলা আকাশ উল্টো
হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে
মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়িও কান্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা
ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে
বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ, কী সুন্দর

নির্বাসন

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

আমি ও নিখিলেশ, অর্থাৎ নিখিলেশ ও আমি, অর্থাৎ আমরা চারজন
একসঙ্গে সন্ধেবেলা কার্জন
পার্কের মধ্য দিয়ে,- চতুর্দিকে রাজকুমারীর মত আলো-
হেঁটে যাই, ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ঘড়ি ভয় দেখালো
উল্টো দিকে কাঁটা ঘুরে, আমাদের ঘাড় হেট
করা মূর্তি, আমরা চারজন হেটে যাই, মুখে সিগারেট
বদল হয়, আমরা কথা বলি না, রেড রোডের দু’পাশের
রঙিন ফুলবাগান থেকে নানা রঙের হাওয়া আসে, তাসের
ম্যাজিকের মতো গাড়িগুলো আসে ও যায়, আমরা এক ভাঙা কারখানায়
শিকল কিনতে গিয়েছিলাম, ফিরে যাচ্ছি, আমি বাকি তিনজনকে
চেয়ে দেখলুম, ওরাও আমাকে আড়চোখে…..
ছোট-বড়ো আলোয় বড়ো ছোট ছায়া সমান দুরত্বে
আমাদের, চাঁদ ও জ্যোৎস্নার মাঠে ইঁদুর বা কেঁচোর গর্তে
পা মচকে আমি পিছিয়ে পড়ি, ওরা দেখে না, এগিয়ে যায়
কখনো ওরা আলোয়, কখনো গাছের নিচে ছায়ায়
ওরা পিছনে ফেরে না, থামে না, ওরা যায়-
আমি নাস্তিকের গলায় নিজের ছায়াকে ডাকি, একশো মেয়ের চিৎকার
মেমোরিয়ালের পাশ থেকে হাসি-সমেত তিনবার
জেগে উঠে আড়াল করে, এবার আমি নিজের নাম
চেচাঁই খুব জোরে, কেউ সাড়া দেবার আগেই একটা নিলাম-
ওয়ালা ‘কানাকড়ি’, ‘কানাকড়ি’ হাতুড়ি ঠোকে, একটা ঢিল
তুলে ছুঁড়তে যেতেই কে যেন বললো, ‘সুনীল,
এখানে কী করছিস? আমি হাঁটু ও কপালের
রক্ত ঘাসে মুছে তৎক্ষণাৎ অন্ধকার সুবজ ও লালের
শিহরণ দেখি, দু’হাত উপরে তুলে বিচারক সপ্তর্ষিমন্ডল
আড়াল করতে ইচ্ছে হয়, ‘ওঠ্‌ বাড়ি চল্‌, কিংবা বল্‌
কোথায় লুকিয়েছিস নীরাকে? গলার স্বর শুনে মানুষকে
চেনা যায় না, একটি অন্ধ মেয়ে আমাকে বলেছিল, দু’চোখ উস্কে
আমি লোকটাকে তদন্ত করি; পাপ নেই, দুঃখ নেই এমন
পায়ে চলা পথ ধরে কারা আসে। যেন গহন বন
পেরিয়ে শিকারী এলো, জীবনের তীব্রতম প্রশ্ন মুখে তুলে
দাঁড়িয়ে রইলো, যেন ছুঁয়ে দিল বেদান্তের মন্দিরচূড়ার মতো আঙুলে
নীলিমার মতো নিঃস্বতা,- যেন কত চেনা, অথচ মুখ চিনি না, চোখ
চিনি না, ছায়া নেই, লোকটার এমন নির্মম, এক-জীবনের শোক
বুকে এলো, ‘কোথায় লুকিয়েছিস?’ ‘জানি না’ এ-কথা
কপালে রক্তের মতো, তবু বোঝে না রক্তের ভাষা, তৃষ্ণা ও ব্যর্থতা
বার বার প্রশ্ন করে, জানি না কোথঅয় লুকিয়েছি নীরাকে, অথবা নীরা কোথায়
লুকিয়ে রেখেছে আমা! কোথায় হারালো নিখিলেশ, বিদ্যমানতায়
পরস্পর ছায়া ও মূর্তি, ‘…. আবার একা হাঁটতে লাগলুম, বহুক্ষণ
কেউ এলো না সঙ্গে, না প্রশ্ন, না ছায়া, না নিখিলেশ, না ভালোবাসা
শুধু নির্বাসন।।

একটি কথা

কাব্যগ্রন্থঃ দাঁড়াও সুন্দর

একটি কথা বাকি রইলো, থেকেই যাবে
মন ভোলালো ছদ্মবেশী মায়া
আর একটু দূর গেলেই ছিল স্বর্গ নদী
দূরের মধ্যে দূরত্ব বোধ কে সরাবে।

ফিরে আসার আগেই পেল খুব পিপাসা
বালির নীচে বালিই ছিল, আর কিছু না
রৌদ্র যেন হিংসা, খায় সমস্তটা ছায়া
রাত্রি যেমন কাঁটা, জানে শব্দভেদী ভাষা

বালির নীচে বালিই ছিল, আর কিছু না
একটি কথা বাকি রইলো, থেকেই যাবে।

একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল…

কাব্যগ্রন্থঃ এসেছি দৈব পিকনিকে

একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল আর এর এক নৈঃশব্দকে ছুঁতে
তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,
এ জীবনে দেখাই হলো না।
জীবন রইলো পড়ে বৃষ্টিতে রোদ্দুরে ভেজা ভূমি
তার কিছু দূরে নদী-
জল নিতে এসে কোনো সলাজ কুমারী
দেখে এক গলা-মোচড়ানো মারা হাঁস।
চোখের বিস্ময় থেকে আঙুলের প্রতিটি ডগায় তার দুঃখ
সে সসয় অকস্মাৎ ডঙ্কা বাজিয়ে জাগে জ্যোৎস্নার উৎসব
কেন, তার কোনো মানে নেই
যেমন বৃষ্টির দিনে অরণ্য শখরে ওঠে
সুপুরুষ আকাশের সপ্তরং ভুরু
আর তার খুব কাছে মধুলোভী আচমকা নিশ্বাসে পায়
বাঘের দুর্গন্ধ!
একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল
আর এক নৈঃশব্দ্যকে ছুঁতে
তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,
এ জীবনে দেখাই হলো না! 


আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

যে পান্থনিবাসে যাই দ্বার বন্ধ, বলে, ‘ঐ যে রুগ্ন ফুলগুলি
বাগানে রয়েছে শুধু, এখন বসবেন?’ কেউ মুমূর্ষু অঙ্গুলি
আপন উরসে রেখে হেসে ওঠে, পাতা ঝরানোর হাসি, 'এই অবেলায়
কেন এসেছেন আপনি, কী আছে এখন? গত বসন্তমেলায়
সব ফুরিয়েছে, আর আলো নেই, দেখুন না তার ছিঁড়ে গেছে, সব ঘরে
ধুলো, তালা খুলবে না এ জন্মে; পরিচারিকার হাতে কুষ্ঠ!' ভগ্ন কণ্ঠস্বরে
নেবানো চুল্লীর জন্য কারো খেদ, কেউ আসবাববিহীন
বুকের শীতের মধ্যে শুয়ে আছে, মৃত্যু বহুদূর জেনে, চৈত্র রুক্ষ দিন 
চিবুক ত্রিভাঁজ করে, প্রতিটি সরাইখানা উচ্ছিষ্ট পাঁজর ও রক্তে ক্লিন্ন হয়ে আছে
বাগানে কুসুমগুলি মৃত, গন্ধহীন, ওরা বাতাসে প্রেতের মতো নাচে।
আমার আগের যাত্রী রূপচোর, তাতার দস্যুর মতো বেপরোয়া, কব্জি শক্তিধর
অমোঘ মৃত্যুর চেয়ে কিছু ছোটো, জীবনের প্রশাখার মতো ভয়ঙ্কর
সেই গুপ্তচর পান্থ আগে এসে ছেঁচে নিল শেষ রূপ রস-
ক্ষণিক সরাইগুলি, হায়! এখন গ্রীবায় ছিন্ন ইতিহাস, ওষ্ঠে, চোখে, মসীলিপ্ত পুঁথির বয়স।
আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়, জুতোয় পেরেক ছিল, পথে বড় কষ্ট, তবু ছুটে
এসেও পারি না ধরতে, ততক্ষণে লুট শেষ, দাঁড়িয়ে রয়েছে সব ম্লান ওষ্ঠপুটে।

সুন্দরের পাশে

কাব্যগ্রন্থঃ মন ভালো নেই

সে এত সুন্দর, তাই তার পাশে বসি
রূপের বিভায় আমি সেরে নিই লঘু আচমন
রূপের ভিতর থেকে উঠে আসে বুকভরা ঘুম
আমি তার চোখ থেকে তুলে নিই
মিহিন ফুলের পাপড়ি।

গন্ধ শুঁকি, পুনরায় ঘুম থেকে জাগি
উজ্জল দাঁতের আলো রক্তিম ওষ্ঠকে বহু দূরে নিয়ে যায়
রূপের সুদূরতম দেশে চলে যাবে এই ভয়ে
আমি দ্রুত সিঁড়ি গিয়ে নেমে…
সে এত সুন্দর তাই তার পাশে এশে বসি।

রূপ যেন অভিমান, আমি কোনো সান্তনা জানি না
যতখানি নিতে পারি, দিই না কিছুই
জানলার পাশ দিয়ে উঁকি মারে কার ছায়া?
ওকি প্রতিদ্বন্দ্ব?
ওকি নশ্বরতা?
শিখেছি অনেক অনেক কষ্টে তার চোখে ধূলো দেওয়া
এই শিল্পরীতি
চিরকাল না হলেও, বারবার ফেরানো যাবেই জেনে
রূপ থেকে সুধা পান করি
ঠিক উম্মাদের মত চোখ থেকে ঝড়ে পড়ে হাসি।

প্রকৃতির অলঙ্কার সে রেখেছে অনন্ত সীমানা জুড়ে জুড়ে
তাই প্রকৃতির কাছে অন্ধ হলে যাবো
সুমেরু পর্বতে আমি মাথা রাখি
সমুদ্রের ঢেউ লাগে হাতের আঙুলে
উরুর ভিতরে অগ্নি…এত মোহময়
অণ্যের গন্ধমাখা ….
নিঃশ্বাসে পলাশ ঝড়, বারবার
যুদ্ধের সুমিষ্ট স্বপ্ন, চোখ ঘুরে ঘুরে
যায়, আসে
যুদ্ধের অমর শিল্প….
সে এত সুন্দর তাই তার পাশে বাস!

মৃত্যুদণ্ড

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

একটা চিল ডেকে উঠলো দুপুরবেলা
বেজে উঠলো, বিদায়,
চতুর্দিকে প্রতিধ্বনি, বিদায়
বিদায়, বিদায়!
ট্রামলাইনে রৌদ্র জ্বলে, গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলাম আমি
হঠাৎ যেন এই পৃথিবী ডেকে দেখালো আমায়
কাঁটা-বেধাঁনো নগ্ন একটি বুক;
রূপ গেল সব রূপান্তরে আকাশ হল স্মৃতি
ঘুমের মধ্যে ঘুমন্ত এক চোখের রশ্মি দেখে
অন্ধকারে মুখ লুকালো একটি অন্ধকার।

হঠাৎ যেন বাতাস মেঘ রৌদ্র বৃষ্টি এবং
গলির মোড়ের ঐ বাড়িটা, একটি-দুটি পাখি
চলতি ট্রামের অচেনা চোখ, প্রসেশনের নত মুখের শোভা
সমস্বরে ডেকে বললো, তোমায় চিরকালের
বিদায় দিলাম, চিরকালের বিদায় দিলাম, বিদায়;
চতুর্দিকে প্রতিধ্বনি, বিদায়, বিদায় বিদায়।।

নীরা ও জিরো আওয়ার

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

এখন অসুখ নেই, এখন অসুখ থেকে সেরে উঠে
পরবর্তী অসুখের জন্য বসে থাকা। এখন মাথার কাছে
জানলা নেই, বুক ভরা দুই জানলা, শুধু শুকনো চোখ
দেয়ালে বিশ্রাম করে, কপালে জলপট্টির মতো
ঠাণ্ডা হাত দূরে সরে গেছে, আজ এই বিষম সকালবেলা
আমার উত্থান নেই, আমি শুয়ে থাকি, সাড়ে দশটা বেজে যায়।

প্রবন্ধ ও রম্যরচনা, অনুবাদ, পাঁচ বছর আগের
শুরু করা উপন্যাস, সংবাদপত্রের জন্য জল-মেশানো
গদ্য থেকে আজ এই সাড়ে দশটায় আমি সব ভেঙেচুরে
উঠে দাঁড়াতে চাই–অন্ধ চোখ, ছোট চুল–ইস্ত্রিকরা পোশাক ও
হাতের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে আমি এখন তোমার
বাড়ির সামনে, নীরা থুক্‌ করে মাটিতে থুতু ছিটিয়ে‌
বলি : এই প্রাসাদ একদিন আমি ভেঙে ফেলবো! এই প্রাসাদে
এক ভারতবর্ষব্যাপী অন্যায়। এখান থেকে পুনরায় রাজতন্ত্রের
উৎস। আমি
ব্রীজের নিচে বসে গম্ভীর আওয়াজ শুনেছি, একদিন
আমূলভাবে উপড়ে নিতে হবে অপবিত্র সফলতা।

কবিতায় ছোট দুঃখ, ফিরে গিয়ে দেখেছি বহুবার
আমার নতুন কবিতা এই রকম ভাবে শুরু হয় :
          নীরা, তোমায় একটি রঙিন
                        সাবান উপহার
                        দিয়েছি শেষবার;
আমার সাবান ঘুরবে তোমার সারা দেশে।
       বুক পেরিয়ে নাভির কাছে মায়া স্নেহে
       আদর করবে, রহস্যময় হাসির শব্দে
       ক্ষয়ে যাবে, বলবে তোমার শরীর যেন
                        অমর না হয়…

অসহ্য! কলম ছুঁড়ে বেরিয়ে আমি বহুদূর সমুদ্রে
চলে যাই, অন্ধকারে স্নান করি হাঙর-শিশুদের সঙ্গে
ফিরে এসে ঘুম চোখ, টেবিলের ওপাশে দুই বালিকার
মতো নারী, আমি নীল-লোভী তাতার বা কালো ঈশ্বর-খোঁজা
নিগ্রোদের মতো অভিমান করি, অভিমানের স্পষ্ট
শব্দ, আমার চা-মেশানো ভদ্রতা হলুদ হয়!

এখন, আমি বন্ধুর সঙ্গে সাহাবাবুদের দোকানে, এখন
বন্ধুর শরীরে ইঞ্জেকশন ফুঁড়লে আমার কষ্ট, এখন
আমি প্রবীণ কবির সুন্দর মুখ থেকে লোমশ ভ্রুকুটি
জানু পেতে ভিক্ষা করি, আমার ক্রোধ ও হাহাকার ঘরের
সিলিং ছুঁয়ে আবার মাটিতে ফিরে আসে, এখন সাহেব বাড়ীর
পার্টিতে আমি ফরিদপুরের ছেলে, ভালো পোষাক পরার লোভ
সমেত কাদা মাখা পায়ে কুৎসিত শ্বেতাঙ্গিনীকে দু’পাটি
দাঁত খুলে আমার আলজিভ দেখাই, এখানে কেউ আমার
নিম্নশরীরের যন্ত্রনার কথা জানে না। ডিনারের আগে
১৪ মিনিটের ছবিতে হোয়াইট ও ম্যাকডেভিড মহাশূন্যে
উড়ে যায়, উন্মাদ! উন্মাদ! এক স্লাইস পৃথিবী দূরে,
                                          সোনার রজ্জুতে
বাঁধা একজন ত্রিশঙ্কু। কিন্তু আমি প্রধান কবিতা
পেয়ে গেছি প্রথমেই, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫…থেকে ক্রমশ শূন্যে
এসে স্তব্ধ অসময়, উলটোদিকে ফিরে গিয়ে এই সেই মহাশূন্য,
সহস্র সূর্যের বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়ে ওপেনহাইমার
প্রথম এই বিপরীত অঙ্ক গুনেছিল ভগবৎ গীতা আউড়িয়ে?
কেউ শূন্যে ওঠে কেউ শূন্যে নামে, এই প্রথম আমার মৃত্যু
ও অমরত্বের ভয় কেটে যায়, আমি হেসে বন্দনা করি :
ওঁ শান্তি! হে বিপরীত সাম্প্রতিক গণিতের বীজ
তুমি ধন্য, তুমি ইয়ার্কি, অজ্ঞান হবার আগে তুমি সশব্দ
অভ্যুত্থান, তুমি নেশা, তুমি নীরা, তুমিই আমার ব্যক্তিগত
পাপমুক্তি। আমি আজ পৃথিবীর উদ্ধারের যোগ্য

আমি ও কলকাতা

কাব্যগ্রন্থঃ আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি

কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে
আমি এর সর্বনাশ করে যাবো-
আমি একে ফুসয়িয়ে নিয়ে যাবো হলদিয়া বন্দরে
নারকোল নাডুর সঙ্গে সেঁকো বিষ মিশিয়ে খাওয়াবো-
কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে।

কলকাতা চাঁদের আলো জাল করে, চুম্বনে শিয়ালকাঁটা
অথবা কাঁকর
আজ মেশাতে শিখেছে,
চোখের জলের মতো চায়ে তুমি চিনি দিতে ভুলে যাও এত
উপপতি
তোমার দিনে দুপুরে, ঊরুতে সম্মতি!
দিল্লির সুপ্রিমকোর্টে, সুন্দরী, তোমাকে আমি এমন সহজে
যেতে দিতে পারি? তার বদলে হৃদয়ে সুগন্ধ মেখে সন্ধেবেলা
প্রখর গরজে
তোমার দু’বাহু চেপে ট্যাক্সিতে বাতাস খেতে নিয়ে যাবো-
হোটেলে টুইস্ট নাচবে, হিল্লোলে আঁচল খুলে বুকে রাখবে দু’দুটো
ক্যামেরা
যদু….মধু এবং শ্যামেরা তুড়ি দেবে;
শরীরে অমন বজনা, আয়নার ভিতরে অতি মহার্ঘ আলোর মতো
তুমি, তোমার চরণে
বিশুদ্ধ কবিতাময় স্তাবকতা দক্ষিণ শহর থেকে এনে দিতে পারি
সোনার থালায় স’লপদ্ম চাও দুই হাতে?
তুমি খুন হবে মধ্যরাতে।
কলকাতা আমার হাত ছাড়িয়ে কোতায় যাবে, তুমি
বিছুতে ক্যানিং স্ট্রীটে লুকোতে পারবে না-
চীনে-পাড়া-ভাঙা রাস্তা দিয়ে ছুটলে, আমিকও বাঘের মতো
ছুটে যাবো তোমার পিছনে
ডিঙিয়ে ট্রাফিক বাতি, বড়বাজার, রোগীর পথ্যের মতো
চৌরঙ্গি পেরিয়ে
আমার অনুসরণ, বয়ুভুক নিরালম্ব আত্মার মতন ভঙ্গি
কতর ভালোবাসার, প্রতিশোধে-
কোথায় পালাবে তুমি? গঙ্গা থেকে সব ক’টা জাহাজের মুখগুলো ফিরিয়ে
অন্ধকার ময়দানে প্রচন্ড সার্চলাইট ফেলে
টুঁটি চেপে ধরবো তোমার- তোমার শরীর ভরা পয়ঃপ্রণালীর মধ্যে বরুদ ছড়িয়ে
আমার গোপন যাত্রা, একদিন শ্রেণীযুগে জ্বালবো দেশলাই-
উড়ে যাবে হর্ম্যসারি, ছেটকাবে ইঁটকাঠ, ধ্বংস হবে
সব লাস্য, অলংকার, চিৎপুরের অমর ভুবন
আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলে যদি, তোমার সহমরণ তবে কি বাঁচবে?

নীরা তুমি কালের মন্দিরে

কাব্যগ্রন্থঃ বাতাসে কিসের ডাক, শোন

চাঁদের নীলাভ রং, ওইখানে লেগে আছে নীরার বিষাদ
ও এমন কিছু নয়, ফুঁ দিলেই চাঁদ উড়ে যাবে
যে রকম সমুদ্রের মৌসুমিতা, যে রকম
         প্রবাসের চিঠি
অরণ্যের এক প্রান্তে হাত রেখে নীরা কাকে বিদায় জানালো
আঁচলে বৃষ্টির শব্দ, ভুরুর বিভঙ্গে লতা পাতা
ও যে বহুদূর,
পীত অন্ধকারে ডোবে হরিৎ প্রান্তর
ওখানে কী করে যাবো, কী করে নীরাকে
        খুঁজে পাবো?

অক্ষরবৃত্তের মধ্যে তুমি থাকো, তোমাকে মানায়
মন্দাক্রান্তা, মুক্ত ছন্দ, এমনকি চাও শ্বাসাঘাত
দিতে পারি, অনেক সহজ
কলমের যে-টুকু পরিধি তুমি তাও তুচ্ছ করে
যদি যাও, নীরা, তুমি কালের মন্দিরে
ঘন্টধ্বনি হয়ে খেলা করো, তুমি সহাস্য নদীর
জলের সবুজে মিশে থাকো, সে যে দূরত্বের চেয়ে বহুদূর
তোমার নাভির কাছে জাদুদণ্ড, এ কেমন খেলা
জাদুকরী, জাদুকরী, এখন আমাকে নিয়ে কোন রঙ্গ
       নিয়ে এলি চোখ-বাঁধা গোলকের ধাঁধায়!

সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম

কাব্যগ্রন্থঃ স্বর্গ নগরীর চাবি

সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না

বুঝি পাহাড়ের পায়ে পড়েছিল নীরব গোধূলি
নারী-কলহাস্য শুনে ভয় পেল ফেরার পাখিরা
পাথরের নিচে জল ঘুমে মগ্ন কয়েকশো বছর
মোষের পিঠের মতো, রাত্রির মেঘের মতো কালো
পাথর গড়িয়ে যায়, লম্বা গাছ শব্দ করে শোয়
একজন ক্ষ্যাপা লোক ঝর্নাটিতে জুতোসুদ্ধু নামে
কেউ কোনো দুঃখ পায় না, চতুর্দিকে এমনই স্বাধীন!

সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না

এই যে সবুজ দেশ, এরও মধ্যে রয়েছে খয়েরি
রূপের পাতলা আভা, তার নিচে গহন গভীর
অ্যালুমিনিয়াম-রঙা রোদ্দুরের বিপুল তান্ডব
বনের ভিতরে এত হাসিমুখ ক্ষুধার্ত মানুষ
যে-জন্য এখানে আসা, তার কোনো নাম গন্ধ নেই

সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না

এখানে ছিল না পথ, আজ থেকে যাত্রা শুরু হলো
একটি সঠিক টিয়া নামটি জানিয়ে উড়ে যায়
বিবর্ণ পাতায় ছোঁয়া ভালোবাসা-রিস্মৃতির খেদ
পা-ছড়িয়ে বসে আছে ছাগল-চরানো বোবা ছেলে
উদাসী ছায়ার মধ্যে ভাঙা কাচ, নরম দেশলাই
এইমাত্র ছুটে এল যে-বাতাস তাতে যেন চিরুনির দাঁত

সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না…



নীরার কাছে

কাব্যগ্রন্থঃ এসেছি দৈব পিকনিকে

যেই দরজা খুলে আমি জন্তু থেকে মানুষ হলাম
শরীর ভরে ঘূর্ণি খেললো লম্বা একটি হলদে রঙের আনন্দ
না খুলতেও পারতে তুমি, বলতে পারতে এখন বড় অসময়
সেই না-বলার দয়ায় হলো স্বর্ণ দিন, পুষ্পবৃষ্টি
                                ঝরে পড়লো বাসনায়।

এখন তুমি অসম্ভব দূরে থাকো, দূরত্বকে সুদূর করো
নীরা, তোমার মনে পড়ে না স্বর্গনদীর পারের দৃশ্য?
যুথীর মালা গলায় পরে বাতাস ওড়ে একলা একলা দুপুরবেলা
পথের যত হা-ঘরে আর ঘেয়ো কুকুর তারাই এখন আমার সঙ্গী।

বুকের ওপর রাখবো এই তৃষিত মুখ, উষ্ণ শ্বাস হৃদয় ছোঁবে
এই সাধারণ সাধটুকু কি শৌখিনতা? ক্ষুধার্তের ভাতরুটি নয়?
না পেলে সে অখাদ্য কুখাদ্য খাবে, খেয়ার ঘাটে কপাল কুটবে
মনে পড়ে না মধ্যরাতে দৈত্যসাজে দরজা ভেঙে কে এসেছিল?
ভুলে যাওয়ার ভেতর থেকে যেন একটি অতসী রং হল্‌কা এলো
যেই দরজা খুললে আমি জন্তু থেকে মানুষ হলাম।

নীরা তুমি কালের মন্দিরে

কাব্যগ্রন্থঃ বাতাসে কিসের ডাক, শোন

চাঁদের নীলাভ রং, ওইখানে লেগে আছে নীরার বিষাদ
ও এমন কিছু নয়, ফুঁ দিলেই চাঁদ উড়ে যাবে
যে রকম সমুদ্রের মৌসুমিতা, যে রকম
         প্রবাসের চিঠি
অরণ্যের এক প্রান্তে হাত রেখে নীরা কাকে বিদায় জানালো
আঁচলে বৃষ্টির শব্দ, ভুরুর বিভঙ্গে লতা পাতা
ও যে বহুদূর,
পীত অন্ধকারে ডোবে হরিৎ প্রান্তর
ওখানে কী করে যাবো, কী করে নীরাকে
        খুঁজে পাবো?

অক্ষরবৃত্তের মধ্যে তুমি থাকো, তোমাকে মানায়
মন্দাক্রান্তা, মুক্ত ছন্দ, এমনকি চাও শ্বাসাঘাত
দিতে পারি, অনেক সহজ
কলমের যে-টুকু পরিধি তুমি তাও তুচ্ছ করে
যদি যাও, নীরা, তুমি কালের মন্দিরে
ঘন্টধ্বনি হয়ে খেলা করো, তুমি সহাস্য নদীর
জলের সবুজে মিশে থাকো, সে যে দূরত্বের চেয়ে বহুদূর
তোমার নাভির কাছে জাদুদণ্ড, এ কেমন খেলা
জাদুকরী, জাদুকরী, এখন আমাকে নিয়ে কোন রঙ্গ
       নিয়ে এলি চোখ-বাঁধা গোলকের ধাঁধায়!


আথেন্‌‌ থেকে কায়রো

কাব্যগ্রন্থঃ বন্দী জেগে আছো

বিমানের মধ্যে টাই খুলে ফেলে, সিট্বেল্ট বরিয়ে

উঠে দাঁড়ালুম

চিৎকার করে বললুম কে কোথায় আছো?

পেঁজা তুলোর মতন তুলতুলে মুখ দুজন হাওয়া-সখী ছুটে এলো-

তখন মাথার ওপর নিচে ভূমধ্য আকাশ এবং রূপালি সাগর

মাঝখানে নীল মেঘ ফড়িং

পিছনে সন্ধেবেলার ইওরোপ জ্বলছে দাউ দাউ আগুনে

সামনে প্রাচ্যদেশ জুড়ে অন্ধকার

আমি কর্কশভাবে বললুম, কোথায় থাকে এতক্ষণ, আমি

আধঘন্টা আগে পানীয় চেঁয়েছি,

তা-ছাড়া আমার খিদে পেয়েছে-

বালিকা-সাজা দুই যুবতী অপ্রতিভ ভাবে হাসলো

সেই আগুন অন্ধকারের মাঝখানে নারী-হাস্য খুব অবান্তর লাগে

তাদের শরীরের রেখা-বিভঙ্গের দিকে চোখ পড়ে না

ভূমধ্যসাগরের অন্তরীক্ষে নিজেকে বন্ধনমুক্ত সরল সত্যবাদী

মনে হয় অকস্মাৎ-

পিছনে জ্বলন্ত ইউরোপ, সামনে ভস্মসাৎ কালো প্রাচ্যদেশ

এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি নিঃসঙ্গ ভারতীয়, আমি সম্রাটের পুত্র

সমস্ত পৃথিবীর উদ্দেশ্যে এখন আমি তীব্য কন্ঠে বলতে চাই,

আমার খিদে পেয়েছে, আমার খিদে পেয়েছে

আমি আর সহ্য করতে পারছি না-

আমি কামড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে খাবার জন্য উদ্যত হয়েছি।

 

 একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল

কাব্যগ্রন্থঃ এসেছি দৈব পিকনিকে


একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল আর এর এক নৈঃশব্দকে ছুঁতে

তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,

জীবনে দেখাই হলো না

জীবন রইলো পড়ে বৃষ্টিতে রোদ্দুরে ভেজা ভূমি

তার কিছু দূরে নদী-

জল নিতে এসে কোনো সলাজ কুমারী

দেখে এক গলা-মোচড়ানো মারা হাঁস

চোখের বিস্ময় থেকে আঙুলের প্রতিটি ডগায় তার দুঃখ

সে সসয় অকস্মাৎ ডঙ্কা বাজিয়ে জাগে জ্যোৎস্নার উৎসব

কেন, তার কোনো মানে নেই

যেমন বৃষ্টির দিনে অরণ্য শখরে ওঠে

সুপুরুষ আকাশের সপ্তরং ভুরু

আর তার খুব কাছে মধুলোভী আচমকা নিশ্বাসে পায়

বাঘের দুর্গন্ধ!

একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল

আর এক নৈঃশব্দ্যকে ছুঁতে

তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,

জীবনে দেখাই হলো না

 

 নারী শিল্প


কাব্যগ্রন্থঃ দাঁড়াও সুন্দর 

ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে আমি তাকে দেখি

উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু

ঠোঁটে স্বপ্ন বিংবা অসমাপ্ত কথা

যেন এক নারীর মধ্যে বহু নারী, বিংবা

দর্পণের ঘরে বস

চিবুকের ওপরে এসে পড়েছে চুলের কালো ফিতে

সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না, কেননা আবহমান কাল

থেকে বেণীবন্ধনের বহু উপমা কয়েছে

 

আঁচল ঈষৎ সরে গেছে বুক থেকে-এর নাম বিস্রস্ত,

রকম হয়

পেটের মসৃণ ত্বক, ক্ষীণ চাঁদ নাভি, সায়ার দড়ির গিট

উরুতে শাড়ীর ভাঁজ, রেখার বিচিত্র কোলাহল

পদতল-আল্পনার লক্ষ্মীর ছাপের মতো

এই নারী

নারী ঘুমন্ত নারী এক নয়

এই নির্বাক চিত্রটি হতে পারে শিল্প, যদি আমি

ব্যবধান টিক রেখে দৃষ্টিকে সন্ন্যাসী করি

হাতে তুলে খুঁজে আনি মন্ত্রের অক্ষর

তখন নারীকে দেখা নয়, নিজেকে দেখাই

বড় হয়ে ওঠে বলে

নিছক ভদ্রতাবশে নিভিয়ে দিই আলো

তারপর শুরু হয় শিল্পকে ভাঙার এক বিপুল উৎসব

আমি তার ওষ্ঠ উরুতে মুখ গুঁজে

জানাই সেই খবর

কালস্রোত সাঁতরে যা কোথাও যায় না

 

স্বপ্নের কবিতা


কাব্যগ্রন্থঃ মন ভালো নেই


আমি তো দাঁড়িয়েছিলাম পাশে, সামনে বিপুল জনস্রোত

হলুদ আলোর রাস্তা চলে গেছে অতিকায় সুবর্ণ শহরে

কেউ আসে কেউ যায়, কারো আঙুল থেকে ঝরে পড়ে মধু

কেউ দাঁতে পিচ কাটে, সুবর্ণষ্ঠীবীর স্মৃতি লোভ রে

কেউ বা ছুঁয়েছে খুব লঘু যত্নে, সুখী বারবনিতার

তম্বুরাযুগল হেন পাছা

কারো চুলে রত্নচ্ছটা, কারো কণ্ঠে কাঁচা-গন্ধ বাঘনখ দোলে

আমি তো দাঁড়িয়েছিলাম পাশে, সামনে বিপুল জনস্রোত

 

কোথায় সুবর্ণ সেই নগরীটি? কোন্রাস্তা হলুদ আলোয় আলোকিত?

কে দাঁড়িয়েছিলাম সেই পথপ্রান্তে? আমি নয়, কোনোদিন দেখিনি সে পথ

আঙুল কী করে ঝরে মধু? কেন কেউ কন্ঠে রাখে কাঁচা বাঘনখ?

কিচুই জানি না আমি, এমনকি সুবর্ণষ্ঠীবীর ঠিক বানানেও রয়েছে সন্দেহ

তবু কেন কবিতা লেখার আগে এই দৃশ্য, অবিকল, সম্পূর্ণ অটুট

স্বপ্ন, কিংবা তার চেয়ে বেশী সত্য হয়ে ওঠে, আমার চৈতন্য বেঁধে সুঁচ

প্রায় কোনো কাটাকাটি না-করেই অফিস- টেবিলে বসে আমি

দৃশ্য লিখে যাই।

 

 

যে আমায়


কাব্যগ্রন্থঃ মন ভালো নেই


যে আমায় চেনে আমি তাকেই চিনেছি

যে আমায় ভুলে যায়, আমি তার ভুল

গোপন সিন্দুকে খুব যত্নে তুলে রাখি

পুকুরের মরা ঝাঁঝি হাতে নিয়ে বলি,

মনে আছে, জলের সংসার মনে আছে?

যে আমায় চেনে আমি তাকেই চিনেছি!

 

যে আমায় বলেছিল, একলা থেকো না

আমি তার একাকিত্ব অরণ্যে খুঁজেছি

যে আমায় বলেছিল, অত্যাগসহন

আমি তার ত্রাগ নিয়ে বানিয়েছি শ্লোক

যে আমার বলেছিল, পশুকে মেরো না

আমার পশুত্ব তাকে দিয়েছে পাহারা!

দিন গেছে, দিন যায় যমজ চিন্তায়

যে আমায় চেনে আমি তাকেই চিনেছি!