রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দীপক লাহিড়ী ।। 'তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী তুমি নিজে'

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 



দীপক লাহিড়ী ।। 'তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী তুমি নিজে' 


(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণ) 

ইংরেজ কবি লর্ড টেনিসনের অনুবাদ বা গৃহশিক্ষক হয়ে ছাত্রীর উদ্দেশে কবিতা 'একটি চিঠি' যেটাই লেখেন না কেনো,সম্পর্কের কাছে আপনি বহুবার নত হয়েছেন।প্রেম আপনাকে দিয়েছিল মানসিক ঐশ্বর্য,স্বপ্নের সোনার চাবি,নিমফুলের ভেসে আসা গন্ধ আর মদিরার স্বাদ।কবিতা আপনার চারপাশে তৈরি করল বলয়,আপনি সূর্যগ্রহণ দেখে বলে উঠলেন,হীরের নাকছাবি।রবি ঠাকুরের গান,মাতাল সমীরণ,চাঁদেরভেলা, খোয়াইয়ের নির্জনতা ছাড়াও মানুষ,মানুষ আর মানুষের কাছে আপনার আত্মসমর্পণ।ভবঘুরে মানুষ,কবিতাছাপানোর সুলুকসন্ধানী মানুষ, চরিত্রহননকারী মানুষ সবাইকে আপনি বিশ্বাস করেছেন কমবেশি।আর আত্মানুসন্ধানের বেশিরভাগ পর্বে ঠোঁটে রেখেছেন জলন্ত সিগারেট।হয়ত সবকিছুই ছিল আপনার কাছে বসন্ত দিনের ডাক।জীবন ও জীবিকার সঙ্ঘবদ্ধতার মধ্যে আপনার কাব্যের অতিক্রান্ত পথিক একদিন সন্ধান পেল গদ্যের।এক অনায়াস পরিশ্রমী গদ্য নিয়ে এলো নীললোহিত,সনাতন পাঠক-কে।গল্প-উপন্যাসের শুরুর মুখে 'আত্মপ্রকাশ'-এর বৈচিত্র্যপূর্ণ সমআধুনিক পটভূমি,দৈনন্দিন জীবনযাপনকে নানা বর্ণে চিত্রিত করল।অভিব্যক্ত বাংলার ফরিদপুরের অখ্যাত 'মাইজ গাঁ' থেকে পিতার কর্মস্থল উত্তর কলকাতায় বড় হওয়া বা পরবর্তীতে দমদম -এ বসবাস নিজের দৃষ্টিভঙ্গি-কে প্রসারিত করেছে।পরে পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে অবিরত ভারত ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিরবচ্ছিন্ন ঘোরাফেরা সৃষ্টির সামগ্রিক দিক কে উদ্ভাসিত করেছে। 

'একা এবং কয়েকজন'-এর কাব্যময়তা থেকে গদ্যের সম্ভার থেকে ধীরে ধীরে ইতিহাস ভিত্তিক লেখা ও বাঙালির সমাজজীবনের পালাবদল নিয়ে লিখলেন-- 

'সেই সময়','প্রথম আলো','পূর্বপশ্চিম'-এর মতো উপন্যাস।পাঠক অভিভূত হয়েছে তবুও আপনার সমগ্র সত্তায় অবিরত ঝরে পড়েছে কাব্যের বৃষ্টিধারা অথবা আগুন বৈশাখের সূর্য রশ্মি।নাটকের অপরূপ সংলাপ ও তার নির্মাণ কখনও বা সৌখিন অভিনয়,রবীন্দ্রগানের মধ্যমণি সর্বত্র ছিল আপনার বিচরণ!আর একসময়ে তারুণ্যের জোয়ারে গা ভাসিয়ে 'কৃত্তিবাস' পত্রিকা প্রকাশ যা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বজায় ছিল একথা বেশিরভাগ সাহিত্যপ্রেমী মানুষমাত্রই জানেন। 

আবার হয়তো এই বহুমাত্রিকতার মধ্যেও আপনি একলা ছিলেন।যে শুধুই পৃথিবী,প্রকৃতি আর নারীর কাছে চেতনাশূন্য নতজানু। 

বাংলাভাষার অস্তিত্বরক্ষার জন্য সংগ্রাম,সংগঠনের মঞ্চ তৈরি করে পথে নামা,অবিরত সংবাদপত্রের কলমে সোচ্চার হওয়া এসব নিয়েই আপনি হয়ে উঠেছিলেন সময়ের এক বৃহৎ কর্ণধার।বাংলা রচনাশৈলীর সরল সহজ সরল ধারা নদীর মতো বইত রচনা বরাবর।তাই ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্সের বহুতলে জীবনের চরমতম শেষবাক্য উচ্চারণ :আমার কী পক্ষাঘাত হচ্ছে !আশ্বিনের দুর্গোৎসবের আলোর মালায় তখন উদ্ভাসিত পল্লীর মুখ অথচ বাসস্থলের অঙ্গন জুড়ে হঠাৎ নেমে পড়ল অন্ধকারের চন্দ্রাতপ।কেনো যেন ভেসে আসে মার্লোর ব্যবহৃত 'ডক্টর ফাউস্ট'-নাটকে সেই অবিস্মরণীয় সংলাপ : "make me immortal with a kiss".

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন