রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মজিদ মাহমুদ ।। সুনীলের কবিতায় এক আশ্চর্য যাদুকরী ক্ষমতা আছে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 


মজিদ মাহমুদ ।। সুনীলের কবিতায় এক আশ্চর্য যাদুকরী ক্ষমতা আছে

ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লে একসঙ্গে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়- আমার বন্ধুরা এই কৌশল শিখেছিলেন সুনীলের কবিতা পড়ে। আর সেই সত্য প্রমাণের জন্য কলেজের মাঠে, বিশ্বাবদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, বন্ধুদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে, দিনে কিংবা জোছনায় অন্ধকারে শিশিরের রোমে ভেজা শুকনো ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে চোখের সীমাবদ্ধ গোলের ভেতর সবটুকু আকাশ লুকানোর খেলায় মত্ত হয়ে পড়েছিলাম আমরা। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের কবি জীবন শুরু হয়েছিল সুনীলের সঙ্গে- জীবনের গভীর মায়া ও মমতায়, কান্না ও নস্টালজিয়ায়। কবি বলতে আমরা যে ভাবে নজরুল-জীবনানন্দ-সুকান্তকে বুঝতাম ঠিক সুনীল-শক্তি, শামসুর রাহমান-আল মাহমুদও আমাদের মধ্যে সেই ব্যঞ্জনা তৈরি করেছিলেন। সমকালে আরো গুরুত্বপূর্ণ কবি ছিলেন। কিন্তু সুনীল আমাদের বয়ঃসন্ধিক্ষণের যুবরাজ। মথের শরীর থেকে শুককীটের জীবন শেষে আমরা যখন কৈশোরের খোলস ছাড়তে শুরু করেছিলাম, সেই রূপান্তরের কষ্ট আমাদের ক্ষয়িত ব্যথিত করে তুলছিল, আমরা তখন রবীন্দ্রনাথের ফটিক, জীবন ও জগতের অসঙ্গতি, অবজ্ঞা ও অবহেলার সঙ্গে বিকাশমান চিন্তার দ্বারা একা, তখন সুনীল ছাড়া সরাসরি আমাদের এই প্রাত্যহিকতার যন্ত্রণা কেউ ঢাকতে পারেননি।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আগত কাব্যবাতিক তরুণদের প্রতি হিমশীতল অবজ্ঞা, সচেতন উপেক্ষা, বান্ধবীদের এড়িয়ে চলার প্রবণতার কষ্ট থেকে পরিত্রাণে সুনীল ছাড়া কে আমাদের সুশ্রুষা দিয়েছিল? সুনীলের কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের চোখ জ্বালা করে উঠতো, হৃদপিণ্ড কণ্ঠনালির কাছে আটকে থাকতো, বন্ধুদের কাছে এই দুর্বলতা ঢাকা দিতে কটুকিছু পড়ার ভান করে কতবার চোখ ধুতে উঠে গেছি কলতলায়। তাই বলে আমরা কখনো সুনীলের মতো কবিতা লেখার কথা ভাবিনি। সুনীলের মতো অন্য কেউ লিখুক তাও আমরা চাইনি। সুনীলের কবিতার ফর্মটি কখনো আটোসাটো ঠিকঠাক মাপ মতো নয়। উপমা অলঙ্কার ছন্দের গাঁথুনি- কবিতার প্রচলিত ঘরানার মতো নয়। এমনকি খুব সহসাই তার কবিতার দুএকটি পংক্তি কিংবা বাক্যাংশ দিয়ে শ্রোতাকে তাক লাগিয়ে দেয়া যায় না। তবু সমকালে সুনীল ছাড়া আর কাকে পাঠকের এতখানি ঠোঁটে ও মনে ধরেছে? কবিতার অনেক কৌশলের মতো এই কৌশলটি কেবল সুনীলই রপ্ত করেছেন। এরপরেও অনেক মিল ও ছন্দের স্মরণযোগ্য পংক্তি রচনা করেছেন তিনি।
সুনীলের এই ছেড়ে দেয়া প্রকাশ ভঙ্গি, গদ্য ও পদ্যের ছুঁচিবায়ুগ্রস্ততা ঘুচে দেয়ার প্রবণতা, রিপোর্টিং ও মেসেজের আধিক্য তাঁর কবিতা থেকে আমাদের কতবার দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি, সুনীল এখনো তার সমকালে প্রজ্জ্বলিত হুতাশন জাগিয়ে রেখেছে। এর কারণ হিসেবে মনে হয়েছে, নজরুল, সুভাষ ও সুকান্ত পরবর্তীকালে বাংলা কবিতায় আর কেউ এমন সহজ মানুষের মতো বালতিতে তোলেনি কো জল। রবীন্দ্র-পরবর্তী এমনকি তিরিশের পরে গভীর ব্যঞ্জনাময় কাব্য রচনার প্রতি কবিদের নিষ্ঠার কমতি না হলেও নজরুল কিংবা উত্তরকালে সুকান্তের মাধ্যমে কবিতায় যে জনসম্পৃক্তি ঘটেছিল পরবর্তীকালে তার পরিচর্যা হয়েছে সামান্যই। হয়তো সচেতনভাবেই- কলাকৈবল্যবাদের দোহাই দিয়ে। মার্কসবাদের প্রপঞ্চ সমকালীন কবিদের আকৃষ্ট করলেও কবিতায় প্রোলিতারিয়েতদের কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা ছিল না মোটেও- বিশেষ করে কবিখ্যাতির দাবিদারদের। যে কারণে কবিতা সত্যিই যোগাযোগের ক্ষমতা কিছুটা হারিয়ে ফেলেছে।

তিরিশের শুরু থেকেই কবিতার প্রতি মানুষের দুর্বোধ্যতার অভিযোগ, দূরে ঠেলে দেয়ার প্রবণতা- কেউ পাঠকের কথা ভাবছেন না- যে পাঠক মধ্যবিত্ত জীবন থেকে উঠে আসা, গ্রাম গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো জীবনের আঘ্রাণ। কেবল ব্যতিক্রম সুনীল, সার্থকভাবে সেইসব মানুষের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে পড়েছেন তিনি। তাদের টুকরো টুকরো দুঃখ, কান্না ও ভালোবাসা, না পাওয়ার বেদনাসমূহ পরম মমতায় তুলে নিয়েছেন তার কলমে। যে কারণে আমাদের মতো তরুণ কবি সুনীলকে খুঁজে পেয়েছিল তাদের কলমে-
সদ্য তরুণটির প্রথম কবিতার বই আমি হাতে তুলে নিই
ঈষৎ কাঁচা প্রচ্ছদে সবুজ সবুজ গন্ধ
প্রজাপতির মতন হালকা পাতাগুলি চলমান অক্ষরে ভরা
শিরোনাম উড়ে যেতে চায়, শব্দগুলি জায়গা বদলের জন্য ব্যাকুল
ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব
                    অহংকার-ভয়-লজ্জা-স্পর্ধা
সে কথা বলে না তার নীরবতা অত্যন্ত বাঙ্মময়
আমাকে সে কি চোখে দেখে তা আমি জানি না
কিন্তু আমি তার মধ্যে দেখতে পাই অবিকল আমাকে
চোরা চোখে লক্ষ করি তার জামার কলারের পাশটা ফাটা কিনা
প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সে নিশ্চয় খুচরো পয়সা গুনছে।
আমার ইচ্ছে করে ওর সঙ্গে জায়গা বদলাবদলি করে নিতে, এক্ষুণি...

কিংবা

অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়, জীবন বদলে নিলাম আমি ও নিখিলেশ
হাতঘড়ি কলম, পকেট বই রুমাল
রেডিওতে পাঁচটা বাজলো, আচ্ছা কাল
দেখা হবে- বিদায় নিলাম, -সন্ধ্যে বেলার
রক্তবর্ণের বাতাস ও শেষ শীতের মধ্যে, একা সিড়ি দিয়ে
নামবার সময় মনে পড়লো- ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার
এসবও বদলানো দরকার, যেমন মুখভঙ্গি দুঃখ ও হাসির মুহূর্ত
নিখিলেশ ক্রুদ্ধ ও উদাসীন, এবং কিছুটা ধূর্ত।

রবীন্দ্রনাথ জীবন-সায়াহ্নে এসে ‘পুনশ্চ’ কাব্যে ‘ছেলেটা’ কবিতায় এ সব কষ্টের কথা বলতে চেষ্টা করেছিলেন। মানব জীবনে যেমন বোধের ভেতর অসংখ্য অনুভূতি জেগে ওঠে তেমনি বহির্জগতেও অসংখ্য মানব-জীবন- যারা মানহারা, ভাষা খুঁজে পায় না, তাদের জন্যও বাড়তে থাকে কবির দায়িত্ব। আমরা কিছুতেই বলতে পারি না, রবীন্দ্র জীবনের শেষাংশের সহজ অথচ হৃদয়গ্রাহী মানবিক কাব্যগুলো তাঁর প্রথমাংশের জটিল ও হৃদয় উদ্বোধিত কাব্যগুলোর চেয়ে শিল্পেতর। রবীন্দ্রনাথের এ পর্যায়ের কবিতাগুলো কেবল সহজই নয়, পুরোপুরি রিপোর্টিং। ‘ব্যাঙের খাঁটি কথাটি’ লিখতে না পারার যন্ত্রণা বার্ধ্যকে বিশ্বকবিকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছিল। যদিও জীবদ্দশাতেই তিনি সেই হতাশা পূরণ করে দিয়েছিলেন ‘পুনশ্চ’ ‘পত্রপুট’ পর্বে। ‘পুনশ্চে’র ভাষাভঙ্গির সঙ্গে সুনীলের রয়েছে অদ্ভূত মিল-

তার ছেলেটি মরে গেছে সাত বছর হল,
    বয়সে ওর সঙ্গে তিন দিনের তফাত।
        ওরই মতো কালোকালো,
            নাকটা ওই রকমই চ্যাপ্টা।
ছেলেটার নতুন নতুন দৌরাত্মি এই গোয়ালিনী মাসীর ’পরে।
    তার বাধা গোরুর দড়ি দেয় কেটে,
        তার ভাড় রাখে লুকিয়ে,
    খয়েরের রঙ লাগিয়ে দেয় তার কাপড়ে।
‘দেখি না কী হয়’ তারই বিবিধ রকম পরীক্ষা।...
অম্বিকে মাস্টার আমার কাছে দুঃখ করে গেল,
    ‘শিশুপাঠে আপনার লেখা কবিতাগুলো
        পড়তে ওর মন মানে না কিছুতেই,
            এমনই নিরেট বুদ্ধি।
সুনীল তাঁর কবি জীবনে রচনা করেছেন অসংখ্য জীবন বদলের কবিতা। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে আত্মা বদলের কাহিনি। ঈশ্বরবিহীন মানুষ খুঁজে বেরিয়েছেন সর্বেশ্বর।

ধরা যাক, আজ থেকে আমি আমার বাবার নাম দিলুম
                    নিরাপদ হালদার
মাঝারি উচ্চতা, সারা দেহে ঘামাচি রঙের ঘাম মাখা সেই মানুষটি
রানাঘাটের এক ভাতের হোটেলের ম্যানেজার
তা হলে আমি  কি মফস্বলের ক্লাস এইটে পড়া রাধারমণ?
আমাকে ফর্সা ছেলেরা চাটি মারে যখন তখন!
ধরা যাক আমার মা চৌধুরী বাড়ির ঠিকে ঝি
গালে মেছতা দাগ!
        একটু মুখ খারাপ করা স্বভাব
তা হলে আমি কি সন্ধেবেলা দেশবন্ধু পার্কের ছিনতাইবাজ
আমার ভাই হিন্দমোটরে ট্রেন আটকাতে যেয়ে গুলি খেয়েছে
আমি নিজেও ফিস প্লেট বিষয়ে শিখে নিয়েছি আনেক কিছু
আমার বোন পোড়া কয়লা কুড়োয় রামরাজতলায়

কিংবা

আমিই সেই মানুষ, আমাকে চেয়ে দ্যাখো...
আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি
আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে
আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ...
রাস্তায় একটা বাচ্চা ছেলে বমি করল
আমি ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী
পিছনের দরজায়, বস্তাভর্তি টাকা ঘুষ নিচ্ছিল যে লোকটা...
আমি তার হত্যার জন্য দায়ী 

সুনীলের কবিতা মূলত কনফেসনাল কবিতা। সেক্ষেত্রে তিনি মানবপুত্রের সবচেয়ে কাছাকাছি মানুষ। যিশুর ক্রুশবিদ্ধতা যেমন মানুষকে কাছে নিয়ে এসেছে তেমনি তার যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয় এবং সেই হৃদয়ে অনুভূতি পাঠককে সহজেই নাড়া দিতে পারে। ১৩৬৭ সালে প্রকাশিত ‘একা এবং কয়েকজন’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যে ভাবে ‘বিবৃতি’ দিয়েছেন ঠিক ৪০ বছর পর ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘সেই মুহূর্তে নীরা’ কাব্যগ্রন্থের ‘না পাঠানো চিঠি’তেও তিনি একই মেসেজ দিয়েছেন। কিন্তু সময়ের জীর্ণতা তাকে আক্রান্ত করতে পারেনি।

উনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উনতিরিশে এসে
গর্ভবর্তী হলো, তার মোমের আলোর মতো দেহ
কাঁপলো প্রাণান্ত লজ্জা, বাতাসে কূটিল সন্দেহ
সমস্ত শরীরের মিশে, বিন্দু বিন্দু রক্ত অবশেষে
যন্ত্রণায় বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক,
এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর প্রেমিক।

তলস্তয়ের ‘রিজারেকশনে’র নখলিউদভের মতো ‘বিবৃতি’ কবিতায় সুনীলের এই পুনরুত্থান নীতি বাগিশ সমাজের মুখোশ দেখিয়ে দিতে সহায়তা করে। তেমনি রুশ গল্পকার আদ্রে শাখারভের না পাঠানো চিঠি পড়ে অতি বড় পাষণ্ডের পক্ষেও যেমন না কেঁদে থাকা সম্ভব নয়, তেমনি সুনীলের ‘না-পাঠানো চিঠি’ পড়েও না কেঁদে পারা যায় না। একটা নষ্ট মেয়ের (!) এমন কষ্ট সুনীল ছাড়া বাংলা ভাষার পাঠকদের আর কে জানাতে পেরেছেন? যদিও এর কবিত্ব নিয়ে পাঠক নিঃসংশয় হতে পারেননি। কিন্তু কবিতা কি? এই প্রশ্নের মীমাংসা কেবল সেদিনই সম্ভব যেদিন কবিতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে সম্ভানাহীন এক কানা গলিতে রূপ নেবে। এটিও কবিতার একটি সংজ্ঞা হতে পারে- স্মরণযোগ্য পংক্তি এবং পংক্তির সমষ্টিই কবিতা। সুনীলের এই কবিতাটিও পাঠকের পক্ষে কখনো ভোলা সম্ভব নয়। সুনীলের এই কবিতার বিশেষ কোনো অংশকে কবিতা বলা যাবে না। তার কবিতার টোটালিটি নিহিত তার এই কবিতার ভেতর।

তাৎক্ষণিকতা সুনীলের কবিতাকে পেয়ে বসলেও একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা করার অপরিসীম দক্ষতা রয়েছে তাঁর। সুনীলের কবিতা পাঠের পরে একটি দীর্ঘশ্বাস, একটি কষ্ট মোচনের তৃপ্তি আমাদের অধিকার করে বসে।

সুনীলের কবিতা নিয়ে অভিযোগ করার কিছু নেই। তার নিজেরই কৈফিয়ত:
‘আমার কবিতাগুলি অতিশয় ব্যক্তিগত বা স্বীকারোক্তিমূলক। কোনো স্থির কাব্যআদর্শ আমার নেই। একজন কবির সমাজের সঙ্গে যুক্ত বা বিযুক্ত থাকার প্রশ্ন নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামায়নি। নারীর ভেতরে নারী, রূপের ভেতরে বিষাদ, জলের মধ্যে জল রং, গাড়ি বারান্দার নিচে উপবাসী মানুষ, শ্রেণি বিভৎস প্রকাশ আমাকে যে কোনো সময় বিচলিত করে- এইসব বিষয়ই কখনো প্রশ্নে, কখনো বিষাদে, কখনো ব্যকুলতায়, চিৎকারে আমি নানা রকম ভাষায় প্রকাশের চেষ্টা করি। কবিতা মানে এই সবই, এ ছাড়া আর কি। অনেকটা নিজেরই দুটি মূর্তির মুখোমুখি কথা বলার মতন।’
সুনীলের কবিতা কিছুটা স্বীকারোক্তিমূলক হওয়ায় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তার যতো ক্ষোভ। দেশকাল সময় চেতনা তাকে কালের বরমাল্য পড়িয়ে দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশে লেখা গুজরাটের বন্যার কবিতা কি ভয়ঙ্কর সত্য হয়ে আছে। কবির পক্ষেই কেবল তা উচ্চারণ করা সম্ভব-

প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানালায় বসে,
            গুজরাটের বন্যা দেখতে যেয়ো না...
উড়ে এসো না জলপাইগুড়ি, আসামের আকাশে...
মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়ি, কাণ্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা
ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে
        বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ কী সুন্দর!

সুনীলের কবিতায় এক আশ্চর্য যাদুকরী ক্ষমতা আছে। সেই ম্যাজিকের মুখোমুখি হতে পুরো কবিতাটি পড়ে যেতে হয়। পরিণামে সুনীলের কবিতা হতাশ করে না।

জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসেও সমাজ ও জীবনের দায়বদ্ধতার পাশ কেটে যান না সুনীল। রাজনৈতিক কানাগলির ঘুপচি পচা অন্ধকার তুলে আনতে তিনি এখনো সমান সক্রিয়। ‘স্বপ্ন দর্শন’
কবিতাটি স্মরণ করা যেতে পারে-
সরজু নদীর তীরে গাঢ় সন্ধ্যাকালে
বাবরের সঙ্গে দেখা! তিনি হাঁটু গেড়ে
সোনালি উষ্ণিষ খুলে নামাজ আদায়ে
বসেছেন...
নিবেদন করি তাঁকে, হে শাহেনশাহ
এই যে অযোধ্যা, আর রাম পরিবার
সত্য হোক বা না হোক, নেই ইতিহাস
তবুও অজস্র লোক কল্পনায় মানে
এখানে কি মসজিদ না বানালেই নয়...
রামের মন্দিরটাও প্রয়োজনহীন
কোনো শাস্ত্রে মন্দিরের কথা কিচ্ছু নেই...
সম্রাট বাবর তাঁর নীল চক্ষে হেসে
চুপিচুপি বললেন, অচেনা কুমার
আমি এবংবিধ প্রশ্ন বড় ভালোবাসি...
সুন্দরের পীঠস্থান এই বসুন্ধরা
যারা কলুষিত করে, তারা কি জানে না
এ জীবন অসীমের একটি ফুৎকার!

তবে সবচেয়ে বেশি বলার আছে, সুনীলের প্রেমের কবিতা নিয়ে, এতবেশি, এত জান্তব প্রেমের কবিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে সুনীল ভক্তদের- যা এক বিরল অভিজ্ঞতা। এমনকি তাদের নারী কল্পনার ধরন হয়ে পড়েছে সুনীলের মতো কিংবা সুনীল তার পাঠকের নারী কল্পনাকে তুলে এনেছেন কলমে। সুনীলের প্রেমের জগতই এক সময় পরিণত হয়েছিল কবিতা পাঠকের নিজস্ব প্রেমের জগতে। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের পাশে তিনিও একটি ‘নীরা’র জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন। তবে জীবনানন্দের বনলতা সেন মৃত্যুর মতো বিশাল আর সুনীলের নীরা জীবনের মতো বড়ো। জীবনবাদি কবির স্বাতন্ত্র্য এখানেই। 

উনিশ তিপান্ন সালের শ্রাবণ মাসে সুনীল সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রের পর এটিই কোলকাতা কেন্দ্রিক কবিতার সবচেয়ে আলোচিত কাগজ ছিল। তাছাড়া বাংলা ভাষার কবিতা পত্রিকা হিসেবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এতো দীর্ঘদিন টিকে থাকা একটি বিরল ঘটনা। এই কৃত্তিবাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল কৃত্তিবাস গোষ্ঠী। বিশেষকরে কল্লোলের পরে কৃত্তিবাস ভিন্ন এমন সুষ্পষ্ট কোনো গোষ্ঠী গড়ে ওঠেনি। কবিতার ভাষা নিয়ে হৈহুল্লোড় ভাংচুর সামাজিক রীতির প্রতি অবজ্ঞা, এই গোষ্ঠীর কবিদের প্রতি পাঠককে আকৃষ্ট করে তুলেছিল। তাছাড়া তিরিশের কবিতার দুর্বোধ্যতা পরিণামে পাঠক বিমুখতা এবং চল্লিশের কবিতার বিপ্লববাদী চেতনা থেকে কৃত্তিবাস গোষ্ঠী বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। সুনীল ব্যক্তিগত জীবনে যদিও কিছুটা মাকর্সবাদী, তবু কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কোনো চেতনা তাকে সীমায়িত করতে পারেনি। কৃত্তিবাসকে কেন্দ্র করে সুনীলের বিকাশটি আরো দৃশ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া একটি গোষ্ঠীবদ্ধতা কবিতার প্রচারণার ক্ষেত্রে তাদের জন্য একটি সুবিধে বয়ে আনতে পেরেছিল। ‘কৃত্তিবাস’ নামের কবিতায় সুনীল লিখেছিলেন-

গা দিয়ে মড়া পোড়ার গন্ধ বেরোয়, তখন আমরা প্রায়ই যেতাম
শ্মশানে, শরতের কৌতুক ও শক্তির দুর্দান্তপনা, সন্দীপনের চোখ মচকানো,
                    আর কী দুরন্ত নাচ
সমরেন্দ্র, তারাপদ আর উৎপলের লুকোচুরি, খোলা হাস্য...

আমাদের সবচেয়ে আকৃষ্ট করে সুনীলের কবিতায় অমিত জীবনবাদিতা। সর্বাবস্থায় জীবনকে আকণ্ঠ পানই সুনীলের কবিতার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য।

নিঃসঙ্গ কুষ্ঠরোগীকে, পথভ্রান্ত জন্মান্ধকে, হাড়া কাটার
বাতিল বেশ্যাকে বলেছি, বেঁচে থাকো
            বেঁচে থাকো
হে ধর্মঘটী, হে অনশনী, হে চণ্ডাল, হে কবরখানার ফুলচোর
                        বেঁচে থাকো
হে সন্তানহীন ধাইমা, তুমিও বেঁচে থাকো, হে ব্যর্থ কবি তুমিও
বাঁচো, বাঁচো , হে আতুর, হে বিরহী, হে আগুনে পোড়া সর্বস্বান্ত, বাঁচো
বাঁচো জেলখানায় তোমরা সবাই, বাঁচো হাসপাতালে তোমরা
বাঁচো, বাঁচো, বেঁচে থাকো...

পরিশেষে বলতে হয়, ঢাকার কবিতা এবং কোলকাতার কবিতার মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। এক ভাষাভাষী হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামশীলতা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রয়েছে কোলকাতার থেকে এক পৃথক ঐতিহ্য। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কবি ও কবিতার মধ্যে তা পৃথকভাবে বাঙ্ময় হচ্ছে। যদিও প্রকৃত কবিতার কোনো দেশকাল নেই, মানুষের বোধের জগতে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনি নেই। কোলকাতাকে কেন্দ্র করেই সুনীলের সাহিত্যিক রাখালিপনা, আর যাবতীয় গোঠলীলা। তবু এই সত্য অনস্বীকার্য, সুনীলের ধাতৃভূমি কোলকাতার হলেও পিতৃভূমি বাংলাদেশ। শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিময় বাংলা তার রচনার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। ‘এখানে এখন শুধু মুখোমুখি বসে রবো আমি আর হাসন রাজা।’ তাই উনিশশো একাত্তরের পটভূমিতে সুনীলের কবিতা একটুও বানানো মনে হয় না।

মা তোমার লাবণ্যকে দেখি জুলাইয়ের তেরসা
শয়তানের তাড়া খেয়ে ঝাঁপ দিল ভরা বর্ষা নদীর পানিতে
জাল ফেলে তবু ওকে টেনে তুললো, ছটফটাচ্ছে যেন
                        এক জলকন্যা
স্টিমারঘাটায় আমি তখন খুঁটির সঙ্গে পিছমোড়া বাঁধা!

কিংবা

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্টে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো!
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
    নদীর শিয়রে ঝুকে পড়া মেঘ
    প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ
    এ আমারই সাড়ে-তিন হাত ভূমি

(সৌজন্য ঃ 'প্রিয়.কম', বাংলাদেশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন