সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আমাদের কথা

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 


আমাদের কথা  


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণতম কবিদের সুনীলদা, চিরতরুণ এক আবেগমাত্র নয়, বাংলা ভাষায় সেই চিরন্তন পথিকদের অন্যতম যিনি প্রশ্রস্ত হৃদয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় তাঁর সমকালে প্রধানতম ভূমিকা নিয়েছিলেন।যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, তখন নবপর্যায় 'কৃত্তিবাস' বের করতে শুরু করলেন।ভালো কবিতার পাশাপাশি শুধুমাত্র তরুণ ও নবীন কবিদের কবিতা প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশ করবার জন্য। অনেক কবি ও লেখক পত্রিকা সম্পাদনাকে লঘুকাজ মনে করে থাকেন। কিন্তু, তিনি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর সৃজনসময়ে বারবার 'কৃত্তিবাস' কবিতা পত্রিকা বের করবার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।অথচ তিনি কবিতা লেখবার নামে কবির অজ্ঞানতাকে কখনও প্রশ্রয় দিতে চাননি।তাঁর সম্পাদিত 'কৃত্তিবাস' পত্রিকায় লেখা পাঠানোর নিয়মাবলীতে তাই লেখা থাকতো,''কৃত্তিবাস' পত্রিকার পৃষ্ঠা সকলের জন্যই, যদিও নবীন ও তরুণ কবিদেরই প্রাধান্য দেওয়া হবে। নবীন কবিরা যদৃচ্ছ পাগলামিও পাঠাতে পারেন, তবে ভাষা ও বানান-ত্রুটি থাকলে তা বিবেচনার অযোগ্য হবে।' এই ছিলেন তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।ভাষা ও বানান-ত্রুটি থাকলে তা লেখা-প্রকাশের জন্য বিবেচনার অযোগ্য বলে গণ্য হবে এই ছিল তাঁর মুক্তকণ্ঠ ঘোষণা। আজকের সর্বজ্ঞ প্রজন্মের কী কিছুই শেখার নেই তাঁর কাছে! নিজের মাতৃভাষা না জানাটা যাদের কাছে গৌরবের! তিনি সমালোচনা সাহিত্য সম্পর্কেও নিজের স্পষ্ট মনোভাব 'কৃত্তিবাসে'র প্রথম দিকের দিনগুলিতেই ব্যক্ত করছেন, 'আমাদের দেশে সাহিত্য আলোচনায় যে একটা দাঁতে দাঁত চেপে অতি সিরিয়াস ভঙ্গি থাকে, সেটি আমার পছন্দ না। সাহিত্য চরিত্র-উন্নয়নের মাধ্যম কিংবা সাহিত্যিকরা জ্যাঠামশাইয়ের মতন শ্রদ্ধেয়, এমনও আমি মনে করি না। সাহিত্য আনন্দের সামগ্রী, যেমন সঙ্গীত বা চিত্রকলা। সুতরাং খোলামেলা হাসিখুশিভাবে একে গ্রহণ করাই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়' (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কৃত্তিবাস,১৯৭৯)।এই মুক্তচিন্তা ও ঋজু মনোভাব আমৃত্যু তাঁর অলংকার ছিল।সেজন্যই তিনি চিরতরুণ।
কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ফরিদপুর জেলায়, বর্তমানে যা বাংলাদেশের অন্তর্গত। জন্ম বাংলাদেশে হলেও তিনি বড় হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পড়াশুনো করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তখন ব্যাংকের পিয়নের চেয়েও স্কুলমাস্টারের বেতন ছিল কম। পড়াশুনা শেষ করে কিছুদিন তিনি আপিসে চাকুরি করেছেন। তারপর সাংবাদিকতায়। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি. পলেন কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। সেই সূত্রে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে মার্কিন মুলুকে গেলেন সুনীল।ডিগ্রী হয়ে গেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসাবে সেখানে কিছুদিন কাজ করেন তিনি। তাঁর পিতা তাঁকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতিদিন এখান থেকে দু’টি করে কবিতা অনুবাদ করবে। এটা করা হয়েছিল তিনি যাতে দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। পিতার নির্দেশে তিনি প্রতিদিন অনুবাদের কাজ করতেন। বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখত, বিড়ি ফুঁকত সুনীল তখন পিতৃআজ্ঞা শিরোধার্য করে সারা দুপুর ধরে কবিতা অনুবাদ করতেন।একসময় এই অনুবাদকর্ম একঘেঁয়ে উঠলে তিনি নিজেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। ছোটোবেলার প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করা লেখা কবিতাটি তিনি 'দেশ' পত্রিকায় পাঠালে তা ছাপা হয়।পরবর্তী সময়ের তরুণ কবিদের প্রধানতম মুখ হয়ে উঠবেন তিনি।'আত্মপ্রকাশ', 'একা এবং কয়েকজন' থেকে 'নীরা সিরিজ' বা 'স্মৃতির শহর'-এর আদ্যন্ত রোমাণ্টিক ও স্পষ্টবাদী সুনীলের বহুমুখী প্রকাশ ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতকে প্রভাবিত করেছে।
“...নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে 
সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়
নীরা আজ ভালো আছে?” 
গদ্যসাহিত্য, বিশেষ করে উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ--- সাহিত্যের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ জুড়ে তাঁর ব্যাপ্তি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে লেখালেখি করেছেন। কখনো ‘নীললোহিত’, কখনো ‘সনাতন পাঠক’ আবার কখনো ‘নীল উপাধ্যায়’ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। 'বুধসন্ধ্যা' (নাট্যচর্চার জন্য), 'আত্মীয়সভা' (দুঃস্থ কবিলেখকদের আর্থিক সহায়তার জন্য), 'ভাষা শহীদ স্মারক সমিতি' ও 'বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব' তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা অনেকের ঈর্ষার কারণ হলেও তিনি এসবের পরোয়া করেননি কখনো। সংকীর্ণ রাজনীতি তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর অনমনীয় মনোভাব তাঁকে মানুষের আরও কাছে নিয়ে এসেছে। তাঁর চলে যাওয়ার আট বছর পরেও আজও তিনি সমান ভাবে জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক। তাঁর ৮৭তম জন্মদিনের প্রাক্কালে 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর এই সামান্য প্রয়াস পাঠকদের ভালো লাগলে আমরা ধন্য হবো।আর আরেকটি কথা না বললেই নয়, বিশ্বব্যাপী মহামারীর সময়ে, এই গৃহবন্দী লকডাউন পর্বে, এই বিশেষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণ সংখ্যা সম্পাদনা করতে এসে আমরা বিশিষ্ট কবি চিত্রা লাহিড়ী, 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর আত্মজন চিত্রাদির যে সহায়তা পেয়েছি তা অভূতপূর্ব। চিত্রাদিকে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করতে চাই না। সুনীলদাকে নিয়ে বিশ্বের যে প্রান্তে যে উদ্যোগই আয়োজিত হোক না কেন, 'মাসিক কবিতাপত্র' নিজেকে সেই উদ্যোগ-আয়োজনের অংশীদার মনে করে। স্বাতীদিকে 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাই।সুস্থ থাকুন স্বাতীদি। ধন্যবাদ জানাই 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর এই বিশেষ সুনীল সংখ্যার সমস্ত লেখকসহ সুনীলদার দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী ধনঞ্জয়বাবুকে। এভাবেই কবির জন্মদিনে আমাদের সম্মিলিত সুনীল-তর্পণ।সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।। 
০৬.০৯.২০২০

1 টি মন্তব্য:

  1. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিশেষ সংখ্যার জন্য'মাসিক কবিতাপত্র'-কে অনেক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই। মাসিক কবিতাপত্র-র কাছে বাংলা কবিতা পাঠকের অনেক প্রত্যাশা। এ ভাবেই আপনারা বাংলা কবিতার জগতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুন এই আশা রইল।

    উত্তরমুছুন