শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

এই সংখ্যায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০



মাসিক কবিতাপত্র-এ আপনি স্বাগত




আমাদের কথা ।। মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০



আমাদের কথা


দেখতে দেখতে আমাদের দেশ 'আনলক ফোর'-এর দোরগোড়ায়। হ্যাঁ, ভিনদেশী বন্ধু, যাঁরা 'মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইনে'র পাঠক, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই যে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারতবর্ষে এই কোভিড ১৯ ভাইরাস-জনিত মহামারীর কারণে পৃথিবীর দীর্ঘতম লকডাউন পালিত হওয়ার পর 'আনলক ওয়ান', 'আনলক টু'... এভাবেই মহামারী মোকাবিলায় এগোচ্ছে আমাদের দেশ। এখনও পর্যন্ত বৃহত্তর যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের দেশে শুরু করা যায়নি। অনাহারে নিত্য ভোগা দেশে হার্ড ইমিঊনিটির স্বপ্ন অনেকটা যেন সোনার পাথরবাটি। তবু সারা দুনিয়ার মতোই মরীয়া হয়ে লড়ছে একটা দেশ। লড়ছেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আম্বুলেন্সচালক থেকে পুলিশকর্মী, ব্যাঙ্ককর্মী, গণপরিবহনকর্মী থেকে বহু ফ্রণ্টলাইনার। 'মাসিক কবিতাপত্র'-র পক্ষ থেকে তাঁদের স্যালুট। এই মহামারী কেড়েছে অনেক প্রাণ, সবাইকে শ্রদ্ধা। জানি না আরও কতোদিন এই অবস্থা চলবে! সারা দুনিয়া এখন তাকিয়ে আছে সেই অলীক ভ্যাকসিনের দিকে। আমরা জানি, শেষ পর্যন্ত জয় হবে মানুষেরই।
এ সংখ্যায় ব্যবহৃত সমস্ত ছবি হিরণদা, শিল্পী হিরণ মিত্র-র আঁকা। থাকলো কবি উৎপলকুমার বসুর স্বনির্বাচিত কবিতাগুচ্ছ ও অরুণেশ ঘোষ-এর অগ্রন্থিত দীর্ঘ গদ্য। এছাড়াও রইলো আমাদের প্রিয় উপন্যাস অ্যালবের কামু-র 'আউটসাইডার'-এর প্রেমেন্দ্র মিত্র-কৃত অনুবাদ। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি রইলো এই সংখ্যায়। আগামী সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে কামু-র আরেক প্রাসঙ্গিক ও আমাদের প্রিয় উপন্যাস 'দ্য প্লেগ'-এর বাংলা অনুবাদ। পাঠক স্বাগত। এছাড়াও এই সংখ্যায় ধারাবাহিক রচনাগুলি ও কবিতার বিভাগ তো রইলো। সাপ্তাহিক কাগজ চালানো খুব কঠিন। তবু কবিতা নিয়ে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আমাদের উন্মাদনার নজির-স্বরূপ 'মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন' আপাতত চলছে। পাঠক, আপনার সমালোচনা/বক্তব্য আমাদের কাছে ভীষণ মূল্যবান। প্রতিটি লেখার নিচে আপনার বক্তব্য আপনি পোস্ট করতে পারেন। আর লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী নিচেই রয়েছে, লেখা পাঠানোর আগে তা একবার পড়ে নিন। সকলে ভালো থাকুন। সাবধানে থাকুন। আগামী শনিবার আবার দেখা হবে। 

ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট ।। রাজীব সিংহঃ মত্তনীল অন্ধকারে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০


ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট

রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে



( গত সংখ্যার পর )

১৩. মনে কি পড়ে প্রিয়?


একটা গান তাকে ফিরে ফিরে তাড়া করে সারাটাদিন৷ পড়ন্ত গ্রীষ্মদুপুরে, বর্ষাদিনের বন্দি জানালায় বা ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে থাকা লেপের ভেতরের ওম সারা গায়ে মেখে নিতে নিতে ফিরে আসে সেই গান৷ দলবেঁধে ছুটে যাওয়া সমুদ্রবন্দরে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে সাজিয়ে রাখা ক্যানবিয়রের খোল অথবা সামুদ্রিক কাঁকড়ার অস্পষ্ট সিলুএটে তাকে ঘিরে রাখে সেই গান৷ ধীরে ধীরে গড়িয়ে যায় একটার পর একটা অলস দিন৷ অন্তর্বর্তী দিনসময়৷
ঘন সবুজ ঢাকা ক্ষেত্রফলের ভেতর দিয়ে ছুটে যায় সেই তেজী ঘোড়া৷ আস্তাবলের খিড়কি পেরিয়ে আসে রোদ৷ ঝলমলে দিন এসে ভুলিয়ে যাও মৃত্যুদিন৷ এক-একটা নারীলোক কিভাবে ছিটিয়ে দ্যায় সোহাগ৷ প্রশ্রয়ের পর প্রশ্রয় দিলে সে-তো উচ্ছন্নে যাবেই৷ তার নাম ধরে শিস্ দিয়ে ডেকে যায় কোনও এঞ্জিন৷ অচেনা স্টেশনে নিচু হয়ে থাকা রেলগুমটির ভেতর হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় মধ্যরাত৷ হাতে হাতে ঘুরে যায় চুল্লু আর জুয়ার ঠেক৷ বৃত্ত হয়ে আসা ধোঁয়াজালে হারিয়ে যায় খুব চেনা একটা মুখ৷ তার চশমার ঘষা-কাচে যে-পৌরুষ তা কামনা করে করে কেটে যায় আরও কিছু অলসদিন৷ চড়া আলোয় পেতে রাখা টেবিলে তাকে ঘিরে ফ্যালে অতিশয় শুভ্র কিছু নিষ্ঠুর অ্যাপ্রন৷ তার মাথার ভেতর অবিশ্রাম ক্ষরণ তখন৷ নীল ঠাণ্ডা ভয় এসে ভিজিয়ে দ্যায় স্নায়ুগুল্মজাল৷
নদীর কাছ থেকে বহুদিন তারা কেউ কেউ ফিরে গেছিলো মাছের বাজারে৷ চিরায়ত সভ্যতার গ্লানিমুক্ত বিস্তীর্ণ মাঠে৷ মুক্ত অর্থনীতির রসনাসিক্ত ম্যাটিনী শোয়ের ফ্রন্টস্টল বৃষ্টিতে৷ নদী তখন গা ধুচ্ছিল দুপুরের মেঘলা আলোয়৷ তারা প্রত্যেকেই লোলুপ বিভূতিভূষণ৷ পুরোপুরি প্রকৃতিমনস্ক৷ বাড়িতে দোর্দন্ডপ্রতাপ অথচ বন্ধুদের কাছে উদার গোস্বামীদা তখন জিভ বের করে রোদ চাটছিলো৷ পকেটভর্তি পয়সা৷ বাজারের গলি তস্য গলি থেকে শঁুটকিমাছ আর সবজির ভ্যাপসা গন্ধ৷ নদী তার অবিরল ধারার মধ্যে ভিজে যেতে দিচ্ছিল সবাইকে৷ অবাক ক’জন শুধু গেয়ে উঠেছিলো সানশাইন৷ সূর্যোদয়ের গান৷ তীব্র বজ্রপাতের মধ্যেও উদার সমাজমনস্করা তখন নদীর বুকে মুখ গঁুজে ঢেউ খঁুজেছিল৷ আর দুপুর তখন ক্রমশ গড়িয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারের দিকে৷ রোমকূপ ভীষণ তীব্রতায় আশ্রয় খঁুজেছিল যেন৷
তখন মন্দারমণি... তরঙ্গমালা গেস্ট হাউস... পায়ের পাতায় জোয়ারের জল... খলবল বুকে উঠে আসা জল... নদী...
গোস্বামীদাকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে সকলে৷ নতুন অর্থনীতির যূপকাষ্ঠে, বাজারের মাছে তাহাদের আসক্তি কম৷ তবু প্রকৃতিপ্রেমিক সকলেই ধরে নিচ্ছে এ সবই ডিজিটাল৷ একটু একটু ছেড়ে যেতে পারবে শ্রাবণ, তোমার খ্যাপামি৷

সকাল পেরিয়ে রাত৷ রাত পেরিয়ে সেই গান৷ সেই সুর৷ গ্রন্থিসময়ের জাল ছাড়াতে ছাড়াতে আরেকটা দিনের শুরু৷ হাঁটুজলে ডুবে থাকা শহর থেকে বড়ো বড়ো ক্যানভাসে ভ্যালেণ্টাইন-চিঠি এঁকে রাখে কেউ৷ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা সেই সকালের মধ্যে থেকে শ্বদন্ত বার করে হাসে ঝিমলিদি৷ স্বপ্নের দুপুরে স্বরলিপি জড়িয়ে উড়ে আসা ডেয়ারিমিল্ক ও দুর্ধর্ষ গোলাপ মনের গহীনে তোলে ঝংকার৷ তাদের সাধ-আহ্লাদ-বিবমিষা পেরিয়ে যায় সেই গান৷ গানের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুকাল আর কোনও প্রযত্ন মানে না এখন৷


১৪.So kiss me and smiles for me... 


তোমার কন্ঠস্বর কেঁপে যায় ফোনে, আচম্বিতে৷ আড়াআড়ি উঠে গ্যাছে দেয়াল অথচ স্বচ্ছ ফড়িঙেরা বিনবিন ওড়ে না কতোদিন এই আবোলতাবোলে৷ তীব্র হয়ে ওঠে দিন৷ অসহ্য গমন আরো নিরীহ হয়ে যায় মায়াবিরাত্রির টলোমলো অন্ধকারে৷
বুড়ো-র‍্যাঁবো স্টিয়ারিঙ আঁকড়ে ধরে আছে এতোদিন৷ আঁকড়ে বসে আছে হৃদযন্ত্র নির্বিকার দাড়িওলা মন্দিরের সেবাইত৷ ঘাটে থমকে আছে মথুরবাবুর সাজানো-বজরা৷ কুলুকুলু বয়ে যায় জল গঙ্গার আদিমক্যানেলে৷ একটি-দুটি কাগজের নৌকো ভেসে যায় দিকচক্রবালে৷ সবুজটিলার চেনা অশনিসংকেতে৷ এই ঘরের থেকে৷
সন্তর্পণে পা ফ্যালো...দূরে বৃষ্টি...যশোর রোড...৷ স্বগতবিষাদ এলো খামে ভরে নিরন্ন এই গ্রামদেশে৷ মুগ্দ চাতকের মতো আলপথে ধুলোপায়ে হেঁটেছিলে গান৷ পাতার মর্মর থেকে আকন্দ-ঝোপের ব্যস্তসমস্ত সব অপরাধ ম্লান হয়ে গ্যালো আত্মার অনির্ণেয় যোজনার অন্তহীন নিষেধে৷ সেই চৈত্রে৷ অথচ তোমার কন্ঠস্বর কেঁপে যায় ফোনে, আচম্বিতে৷ প্রত্যেকবার৷
সেগুলি গোপন-খাতায় লিপির ভাষায় আঁকা কিছুটা গুহাচিত্র আর বাকি সব হায়ারোগ্লিফিক্স৷ যেন আড়াআড়ি উঠে যাওয়া দেয়াল টপকে নগ্ণপায়ে শীতার্ত-স্পায়ের ভেতর৷ সাদাকালো অন্ধকার৷ আর সেলুনের রক্তাক্ত মেঝে থেকে উপত্যকার পাইনজঙ্গল থেকে আরো একবার অচেনা-নটীর দিকে চলে যাওয়া ধূসর-ফিটন খুলে দ্যাখে মায়াবিবোতল৷ গানেগানে রাত বাড়ে৷ টলোমলো সেই রাত৷ 
কোনো কাজ করা বারণ, ক্ষমা কোরো৷ যদি পারো সেই ভালো থাকার কথাও তুমি ছাড়া আর কাউকে বলবো না৷ পুরনো পোশাকের মতো ফিরে চলে যাক দিন৷ ফিরে চলে যাক এই মাতাল সমীরণ৷ খেজুর আর তালগাছে ঘেরা এই অন্ধকার, চাঁদ, আলো৷ পায়ের তলায় মাড়িয়ে যাচ্ছি পড়ে থাকা পলাশ, কৃষ্ণচূড়া৷ দমকা হাওয়ায় উড়ে যায় আঁচল৷ উড়ে যায় খোলামকুচির মতো দিন৷ অথচ নদীরাও কী ভীষণ নিভু নিভু৷ কিচ্ছু দ্যাখা যায় না৷ এলোমেলো পাণ্ডুলিপি আর গীতবিতান৷ চলো, ফিরে যাই, রাত অনেক৷ জোনাকিরা মশারি, বইয়ের তাক আর পিয়ানোর ওপর কী ভয়ানক আকুতিপরায়ণ৷ সমস্ত অলসতা ঘুমিয়ে পড়ক এখুনি৷
ইদানিং একটা দীর্ঘ চিঠি উদ্ধৃত করবার ইচ্ছে হয় কৃষ্ণেন্দুর৷


১৫. রাতজাগা বেলফুল, বুড়ো আবদুল, কুঠিবাড়ি আর প্রেতিনীর গান


রাত্রি ঘনালো যখন ভিজে ঘাস থেকে অবদমন আর অতৃপ্ত ইচ্ছেগুলো গড়িয়ে গেল চিরকালীন ফাঁকা যাত্রীবিহীন রেলস্টেশনে৷নিঝঝুম খালি ওয়াগনে কয়জন বন্ধুস্বজন শুধু আগুন জালিয়ে রেখেছিলে৷ধোঁয়া উড়ছে৷উড়ে যাচ্ছে তরুণ কবিতা-উচ্চারণ৷উড়ে যাচ্ছে কবিতার খাতা৷নীলাভ ডেস্কটপের স্ক্রিন জুড়ে কালো কালো অক্ষরমালা গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত৷গড়িয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতা দেড়শো বছর ধরে এই অক্লান্ত নির্জনতায়৷এই উপত্যকায় তখন শুধুই বৃষ্টিপতনের শব্দ৷কীভাবে করবে সেই পাঠগ্রহণ! কীভাবে বাঁচবে বলো আলো!
এ সেই লেখা যা তুমি লিখতে চাওনি চিঠির আকারে ! যেন বুড়ো আবদুল মাঝি বা কচ্ছপের ডিম... যেন রুদ্রপলাশ ড্রসেডা কুর্চি...কলমির রঙ...যেভাবে গঞ্জ থেকে হাট থেকে নগরীর তলপেট থেকে লিখিত বাংলাকবিতা , সেইসব যা তুমি লিখতে চাওনি--রাসায়নিকে বিষাক্ত টমেটো বা ফুলকপির মতোই মহাজাগতিক আভা নিয়ে এতোদিনে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবার বাসনায় সেইসব এই লেখার মধ্যে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে ! তুমি আর আবদুল চাষাদের পানীয় নিয়ে পদ্মার তীরে৷বেলা গড়িয়ে যায়৷গড়িয়ে যায় রোদ৷দূরে আকাশে দু’একটা শঙ্খচিল,বোটের ভেতর বাসমতীর সুঘ্রাণ আর সর্ষে-ইলিশের ঝাঁঝালো গন্ধ...৷কখনো বড়ো বড়ো জলভরা-মেঘ এসে ঢেকে দেয় রোদ৷আঙ্গুলের দশটি নখ ছিঁড়ে দিতে চায় অভিজাত পর্দা,অভিজাত ঝাড়লন্ঠন৷এই ব্যাপ্ত দুপুর জুড়ে ঝরে পড়ছে নৈঃশব্দ্য৷আর প্রিয় নারীটির নারীলোকটির হৃদয় ঠেঁট বা নাভির তলদেশের ক্ষত ভুলে একতারা বাজিয়ে গান গাইছে তোমার ভাসমান হৃদয়...যে গান তুমি লিখতে চাওনি--৷
বুড়ো আবদুল ঘুমোলে অল্প হাঁ হয়ে থাকে মুখ৷ দু’একটা মাছি মুখের ওপর ভনভন,আবদুল মাছিদের চোখের দিকে তাকায় না৷ তন্দ্রার ভেতর সে তলিয়ে যায় ধীরে ৷ আর তুমি অসম্ভব ছায়ায় ম্যাকবেথের পুরনো পৃষ্ঠাগুলো আঁকড়ে বসে থাকো আশ্চর্য প্রৌঢ় তরুণ ! শিলাইদহের ওই গা-ছমছমে পুকুরপাড়৷ভেজা কাপড়ে সলসলে নরম শীতল আলিঙ্গণ,নদীর মতো হালকা সারল্যে তোমার সমস্ত প্রতিভা গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিচ্ছে...৷ খুলে পড়ছে তোমার বাহারি শিফন, ছিঁড়ে যাচ্ছে অলঙ্কৃত মেরজাইয়ের উষ্ণ হলকা ৷ বাংলাকবিতা এই অসম্ভব বেতের প্রহার থেকে চারদিকের পরিত্রাণ থেকে নিঃসাড়ে গড়িয়ে যাবে দেড়শো বছর৷ আর তুমি দগ্ধ শিরায় উপশিরায় রক্তাক্ত শিলাইদহে আঁকড়ে ধরবে পুরনো ম্যাকবেথ বেঠোফেন বাখ অথবা গগন-লালনের গান ৷
তবু কিছু আলো আর ফড়িঙের ওড়াউড়ি৷নিভে যাওয়া মন জুড়ে অনাম্নী ফুলেদের তীব্র আকর্ষণ করাল বিদ্যুতের মতো প্রেতভাষায় ক্রমশ নির্ভার করে তোলে চতুর্দিক৷কাবার্ডে রাখা বেনারসীর জরি ছিঁড়ে ফালাফালা৷আর এই এতো রাতে ফিটনে চড়ে চারণ বেরিয়েছো পথে৷তোমার জামার লেসে ছড়িয়ে পড়ছে রাতজাগা বেলফুলের বাসি পাঁপড়ি৷ছড়িয়ে পড়ছে আতর৷ছড়িয়ে যাচ্ছে বাহ্মসময়৷ছড়িয়ে যাচ্ছে কুঠিবাড়ি৷ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রেতিনীর গান৷ছড়িয়ে যাচ্ছে মহাজাগতিক আলোর বিচ্ছুরণ শিলাইদহ থেকে শিলংপাহাড়ে...
অসম্ভবের দিনলিপি জুড়ে রোগাক্রান্ত নারীমন যে উপেক্ষার হাসি দিয়ে ভরে রেখেছিলো মধ্যাহ্ণ আকাশ,সামনে তার উপায়হীন শিকল৷তুমি তার নিভে-আসা আগুনের সন্ধান পেয়ে ছুটে চলেছো নির্বিকার৷গাছেরা দৌড়চ্ছে উর্ধমুখ আর সেই অসম্ভব দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত কোপাই খোয়াই দামোদর রূপনারায়ণ থেকে টেমসের দিকে৷চাষার কাদামাখা পা অথবা বোকাহৃদয়ের অনির্বাণ অমোঘ উত্তরীয় নিজের স্রোতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক-অতিমানবদের দিয়ে সেইসব গল্প লিখিয়ে নিচ্ছিলো তোমার কলমে...৷ অথচ তুমি ম্যাজিক জানোনা৷ জানোনা তাজমহল৷ জানোনা ফুলের প্রতিবাদ৷চিরশূন্যে কোথাও উড়ে গেলে সেই জীবন ও তার রূপক আকাশে বদলে যেতে থাকে রঙ৷বদলে যেতে থাকে কবিতার সংকেত৷বদলে যেতে থাকে পাখির গর্জন৷চিরায়ত শোকের আধার ৷ চূর্ণ-বিচূর্ণ শিল্পের জন্য শেষাবধি অনেক নদীর ঢেউ হয়ে আক্রোশের জ্যোৎস্না হয়ে পিয়ানোর কল্লোলিত রিড হয়ে ছুঁয়ে থাকে চোখের পাতায়৷আর তুমি ঘুম ভেঙে জানিলে এ জগৎ স্বপ্ন নয়...


১৬. নোনাঢেউ


মাথার ওপর ক্রমশ রোগা হয়ে গেছে আকাশ৷ দুইধার দিয়ে উঠে গেছে এবরো-খেবড়ো সব বাড়ি৷পুরনো দেয়ালে ঝরে-পড়া পলেস্তরা আর রঙচটা স্বপ্ণসমূহ৷ আমরা ন্যারেশন পছন্দ করি তাই সেই লোলগর্ভে পেতে দিই মাথা, এই রাতে পুরনো রাস্তায় নবীন দুইজন আমিষের খোঁজে নাকাল হলে রাতপাহারা দেওয়া মুহূর্তগুলি পুনরায় মাইক হাতে বসিয়ে দেয় তোমায়৷একটার পর একটা নাম ডেকে চলো তুমি৷ ষণ্ডামার্কা নাম থেকে নিরীহ নামগুলি আসে যায় আসে যায়৷ লেখা পড়ে, মুহূর্তে ফিরেও যায়...৷ যদিও কেউ ডাকেনা তোমার নাম, নিজের লেখা তোমাকে কেউ পড়তে বলে না৷তুমি এক জাদুমাইক হাতে ডেকে চলো একটার পর একটা নাম৷ শুনতে থাকো অন্যের লেখা, অন্যের আলো, অন্যের অন্ধকার, আর ফুরিয়ে আসে রাত৷
ঝিলপাড় বরাবর সারি সারি লাল নীল হলুদ সবুজ৷ স্কেচবুকে আঁকিবুকি৷ গান৷ গাছের গুঁড়িতে এলানো গিটার, রিনরিন শব্দে বাজে বুকপকেটের ফোনযন্ত্র, সমস্ত শরীর জবজবে ঘামে আরো বেশি দিকসচেতন করে তুললে গালের পাশে জমে ওঠে পড়ন্তবেলার রোদ্দুর৷ মাটিতে ছড়ানো পলাশ, থ্যাঁতলানো শিমুল... উল্টোদিকে মাটির গয়নায় সাজানো উদ্ধত গ্রীবা আর উন্মত্ত হৃদয়৷
সেইদিন, রাত্রি যখন ঘনালো নিবিড়, ছাদে, অন্ধকারে নির্বিকার তাকিয়েছিলে দূরে৷কাঁধ ছুঁইয়ে চৈত্রের উদাসী নিঃশ্বাস আর শেষরাতের হিম তবুও একলা করে তোলে তোমাকে৷ একলা তুমি৷ মনে মনে ফিরে যাও অচেনা শহরে, মুঠোয় বন্দি সেই অলীক মাইক্রোফোন ঝিলপাড়ে বাতাসে অল্প অল্প নড়তে থাকে হাওয়ানিশানের ধাতব ব্লেড়..৷ স্নায়ুর গভীরে পিছলে যায় আলো৷ নদীরা ঘুমোয় আর ভোরবেলার কুয়াশারা মশারির মতো আগলে রাখে তোমাকে, ক্রমশ তুমি বুড়িয়ে যেতে থাকো৷
এই উপত্যকায় তখন শুধুই বৃষ্টিপতনের শব্দ৷ কীভাবে করবে সেই পাঠগ্রহণ ! কীভাবে বাঁচবে বলো আলো ! তোমাকে কতোদিন বলা হয়নি এ কথাগুলি৷ বলা হয়নি শীতকাল আর শিরীষ-অর্জুনের কথা--! অথচ নদী ও পাখিদের দল প্রাচীন ফটোগ্রাফের মতো এই বন্দরশহরে আজো অপেক্ষমান৷


এতো কোলাহল চারিদিকে৷ শনিপুজোর উদ্দাম ঢাক, দড়ি দিয়ে বুকে ঝোলানো ঝুড়িতে ''বাদাম বাদাম--’’, এঁড়ের দালালের সাথে হাঘরে পথিকের নির্লজ্জ দরদাম, আসরের নিচু টুলে গড়িয়ে পড়া মাতাল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ঝকঝকে মঞ্চ, ট্যাবলোতে বুলাদি এবং মঞ্চে মাননীয় মশাই, কফিহাউসে চায়ের দোকানে ব্যতিক্রম আর আরো-ব্যতিক্রমের মৃদু হৈ চৈ, ফেসবুকে বইমেলা আসিতেছে, আসিতেছে কতো কতো নতুন প্রচ্ছদ, লাইক দিতে দিতে আর কমেন্ট লিখতে লিখতে যখন ক্লান্ত তুমি, এতশত শব্দের মাঝখান থেকে তখনি ফিরে এলো তোমার নিজের লেখা, তোমার ফেলে আসা শহরের কথা, বাইশে শ্রাবণ নামে নতুন আরেকটি সিনেমার কথা, সরকারি চাকরির বয়সের নতুন নিয়মের কথা, কলকাতা থেকে মুম্বইগামী যন্ত্র-শকটের কথা, ডাগরচোখ শমিতের একঝলক হাসির কথা, যাকে পাকিস্তানি বোলার শোয়েব আখতার বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়...
ডায়মণ্ডহারবারের বৃষ্টিভেজা নোনা রাস্তায় তুমি হাঁটছো, মগজে কখনো সুুমন কখনো সুুনীল কখনো সন্দীপন৷সঙ্গে হস্টেল থেকে বেরনো মেয়েটি, প্রাপ্ত সম্পর্কের বোঝা টেনে টেনে ক্লান্তপ্রায়৷ তুমি সিগারেট থেকে তখনও ঝরিয়ে ফেলছো তামাকের কুচি৷ একদিন ভেবে রেখেছো যাবে বিনয় মজুমদারের বাড়ি অথবা হস্টেলের মেয়েটিকে নিয়েই উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে বাদামপাহাড়ে৷


দু-ধারে চষা জমির আশ্চর্য কোমলতা৷ আলের পর আল সাবধানে হেঁটে যাওয়ার সময় কৃষ্ণেন্দু লক্ষ করেছিলো ‘হরর্-হট্-হট্’ কাদা-মাখা মোষের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে নরম কাদায় হাঁটু পর্যন্ত দেবে যাওয়া কৃষকের হলকর্ষণ৷ সেদিন ভারি হয়ে এসেছিলো মেঘলা দিগন্ত৷ কা-কা চিলচিৎকারে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গিয়েছিলো অতগুলো কাক৷ নদীর সীমান্তে নির্মীয়মান সুকলবাড়ির অফিসঘরে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি, ক্লাশ ফোর পাস, পার্টিক্যাডার স্কুল সেক্রেটারি দেশলাইকাঠি দিয়ে দাঁতের ফাঁকে আটকে যাওয়া সুপারি খোঁচাতে খোঁচাতে তাকে চোখ রাঙিয়েছিলো৷ অর্ধেক দেয়াল গাঁথা ক্লাশঘর দেখিয়ে দাবি করেছিলো ছাদের খরচ৷
অথচ তখনও তিনশো তেত্রিশ কিলোমিটার দূরে তার বন্ধুরা হলুদ বোতলের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পুরনো তর্কে আরও একটা দশক পার করে দ্যায় লুকনো ব্যর্থতায়৷ কফির টেবিল থেকে উদ্বায়ী যুবকেরা ভেসে উড়ে যেতে চায় কোনও দূর দিকচক্রবালে৷ আর ভূতগ্রস্ত কৃষ্ণেন্দু দূরবর্তী কোনও ধূসর গ্রহের বুকে দাঁড়িয়ে থাকে একা৷
ফ্ল্যাশব্যাকে ঔপন্যাসিক চশমা খুলে এইমাত্র টেবিলে রাখছেন৷ তাঁর ভাসা-ভাসা আয়ত চোখদুটোর ওপার থেকে উপচে গড়িয়ে নামে নোনাঢেউ৷ ভাঙা চোয়ালের দাড়িগুলো কুঁকড়ে ওঠে ঠাণ্ডায়৷ একটানা সিটি দিতে দিতে পেটভর্তি বাষ্প নিয়ে গুমরোতে থাকে একলা প্রেসার কুকার৷


১৭. ইতি কৃষ্ণেন্দু


...এখানে নিজের মতো আছি আমি৷ বনবিভাগের সারসার সরলবর্গীয় অরণ্যের মধ্যে দিয়ে দূরে ছুটে গেছে রেলপথ৷ যতোদূর চোখ যায় ছড়ানো সবুজ জমি ও বিক্ষিপ্ত জঙ্গলের মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ এক একটা গ্রাম৷ কুড়িটা-পঁচিশটা বাড়ি নিয়ে৷ ছোটো ছোটো তালবন, পুকুর আর ঘন বাঁশবনের মধ্যে কোনও মতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামগুলি৷ একমাত্র দূরের স্টেশনেই দুটো পাকাঘর৷ তা-ও ব্রিটিশ পিরিয়ডের ৷ লাল রঙা৷ একটা স্টেশন মাস্টারের, অন্যটা স্টোর কাম টিকিট কাউণ্টার৷ নামফলকে লেখা--- ‘দিস ইজ দ্য লাস্ট স্টেশন অব ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন’৷ অনুমানে বুঝি এই সীমান্ত রেলওয়ে স্টেশনটির পত্তন ইংরেজদের হাতেই৷ ইস্পাতের সরীসৃপের মতো রেলপথ চলে গেছে জঙ্গল পেরিয়ে সোজা ওপারে, বাংলাদেশে৷
সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে এইখানে৷ স্টেশনের পাশেই একটা স্কুলবাড়ি৷ তার পাশেই ধুলো-ওড়া লম্বা ন্যাড়া মাঠ৷ এই মাঠেই বসে হাট৷ চাল, গম, সবজি, গামছা, লুঙ্গি, সস্তার শাড়ি থেকে খুকুমণি আলতা, চিরুণি, পাউডার, ক্রিম সবই পাওয়া যায় হাটে৷ গবাদি পশুও কেনা-বেচা হয় এখানে৷ নদীর ওপারের বাংলাদেশের অনেকেই হাটে আসে দোকান দিতে অথবা জিনিস কিনতে৷ একটা হাট-কমিটি আছে৷ সেখানে গ্রামের মুরুবিব-মাতববরদের ভিড়৷ তারা মোটা টাকা আদায় করে বাংলাদেশি দোকানদারদের কাছ থেকে৷ এখানে ইন্ডিয়ান কারেন্সি ও বাংলাদেশি টাকা দুই-ই দেদারে চলে৷ আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করি ওদের, ওপার বাংলাদেশের মানুষদের৷ কেমন যেন সদাসন্ত্রস্ত ওরা৷ শুনেছি যে-কোনও সময়েই বিডিআর বা বিএসএফের হাতে ধরা পড়বার ভয়ে এভাবে গুটিয়ে থাকে ওরা৷
তোমার কথা, কলেজের কথা, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঝিলপার ধরে আমাদের হেঁটে চলা মনে পড়ে খুব৷ মেকানিকালের হাওয়াকলের তলায় উজ্জ্বল দুপুরগুলোয় কোঁচড়ভর্তি কৃষ্ণচূড়া নিয়ে তোমার বসে থাকা, কোণের লবিতে বসে গুনগুন, হঠাৎ গেয়ে ওঠা তোমার রবিঠাকুর, আমার হঠকারী আবেগে হঠাৎ রাগিয়ে দেওয়া তোমার কান্নাভেজা মুখ, চোখ আর ঠোঁট সমস্তই মনে পড়ে আমার৷ কলেজ ইলেকশনের আগে ছোট্ট মিছিল নিয়ে তোমাদের নিঃশব্দে ক্যাণ্টিনে ঢোকা, দলীয় র‍্যাগিংয়ে আক্রান্ত তোমাদের হস্টেলের মেয়েটি--- চুপচাপ ওড়নায় ফাঁস বেঁধে ঝুলে পড়া সিলিং--- এ সবই সীমান্তের আরও ঘন অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে আক্রান্ত করে যায় আমাকে৷ রেলপথের ধার দিয়ে সীমান্তের দিকে প্রতিদিনই টহল দিয়ে যায় একের পর এক মিলিটারি লরি৷
আমার সব কথাই তো ইদানিং তোমার অসংলগ্ণ মনে হয়৷ হয়তো-বা দুর্বোধ্যও৷ ইস্ তোমার এই অভিযোগ থেকে যদি মুক্তি পেতাম কখনও! এখনও মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে শেষট্রেনে দলবেঁধে সমুদ্রবন্দরে ছুটে যেতে চায় মন৷ এক বিস্তীর্ণ রেডিয়াস জুড়ে নড়ে ওঠা মিছিলের গমগমে বৃন্দগান সোহাগ করতে শিখিয়েছিলো আমাদের৷ পার্কের মাটি ফোঁপরা করে দিয়েছে যে ইঁদুরের দল, আগন্তুকেরা তাদের চারিদিকে ভিড় করে খাবার ছুঁড়ে ছুঁড়ে দ্যায়৷ চিড়িয়াখানায় শিম্পাঞ্জীকে পোট্যাটো চিপস, পাউরুটি, কলা অথবা বিসুকট ছুঁড়ে দেওয়ার মতো৷ আর আমরা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্ব লাফিয়ে লাফিয়ে ক্যাচ প্র্যাকটিস করি শুধু৷...


১৮. সাইকো--- পার্ট ওয়ান, পার্ট টু, পার্ট থ্রি


যারা বছরের পর বছর গভীর ঘুমের মধ্যে থেকে আর্তনাদ করে ওঠে, খাঁচায় বন্দি পাখিদের জন্য আশ্চর্য তাদের কোনও মমতা ঝরে পড়ে না৷ ক্যাম্পফায়ার সাজিয়ে প্রচণ্ড শীতে টলমল যে-যুবকের দল নেচে ওঠে গেয়ে ওঠে ধ্বংসের গান কৃষ্ণেন্দু দূর থেকে অপলক চেয়ে থাকে তাদের দিকে৷ নেশায় আচ্ছন্ন কবির জন্য একটি পংক্তি রচনা করে তাকে কাঁদিয়ে তুলেছিলো ও৷ কোনো নির্দিষ্ট কাজলকালো চোখের মায়ায় বিমোহিত না হয়েও ও পড়তে চেয়েছিলো কবিতার প্রথম পাঠ৷ অথচ চাঁদ দেখে ওর কেমন ঘোর লেগে যায়৷ কেমন অবসন্ন হয়ে যায় ও৷ ঝিমঝিম করে মাথা৷ বৃত্ত ঘুরে ঘুরে চন্দ্রছটা ছায়া ফ্যালে মাটির উপর৷ মাথার ওপর ছড়িয়ে থাকা উপগ্রহজালে বন্দি হয় আকাশের মেঘ৷ পায়ের পাতার তলে সিরসির কিলবিল করে ওঠে ট্রামের লাইন৷
কৃষ্ণেন্দুর বন্ধু যেদিন ঔপন্যাসিকের বাড়ি থেকে রাত্রে ফিরে এলো না, তার কিছুদিন পর পূজাবার্ষিকী বেস্টসেলারে ফুলপেজ ইলাস্ট্রেশনে সেজে প্রকাশিত হলো ঔপন্যাসিকের নতুন উপন্যাস৷ ‘তাহলে তো তোমরা মিথ্যা হয়ে যাও’--- ঔপন্যাসিকের এই আশঙ্কা আর পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত উপন্যাস কোথায় গিয়ে যেন একই সুরে কথা বলে৷ তোমাদের জীবনের যাবতীয় ক্ষত, যাপনের আলো ও অন্ধকার এক আশ্চর্য দক্ষতায় ঔপন্যাসিকের লেখায় প্রকাশিত৷ অনেক না-বলা, অনুচ্চারিত ব্যক্তিগত আর ব্যক্তিগত থাকে না তখন আর!
ভোরবেলার ভিক্টোরিয়ায় হঠাৎ একদিন বন্ধুর হাত ধরে পৌঁছে যায় কৃষ্ণেন্দু৷ ময়দান গাঢ় কুয়াশায় ঢেকে আছে৷ ইতঃস্তত ছড়িয়ে আছে পর্ণমোচী ঝরাপাতারা৷ সবুজ ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির৷ দূরের রেডরোড দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুটো গাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে৷ এই ভোরবেলায় নরম সোনালি আলোয় ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় ধীর লয়ে ঘুরে চলেছে অ্যাঞ্জেল অব ভিক্ট্রি, সেই ফ্লুট নিয়ে ঘুরে চলা পরী, কৃষ্টি সুবিচার আর মহানুভবতার বার্তা নিয়ে৷ ক্যানভাসে জমে যাওয়া রঙের মতো স্থির পড়ে আছে মেমোরিয়ালের পেছনের বাঁধানো পুকুর৷ স্বাস্থ্যসন্ধানী স্বাস্থ্যবান মর্নিং ওয়াকাররা কেউ কেউ চেনে বাঁধা সারমেয় নিয়ে ওই সকালবেলাতেই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছেন৷ পুকুরের পাড়ের বেঞ্চে এই সকালও তখন আবেগ-সঘন৷ বাসিমুখ তোলে কেউ সঙ্গিনীর ঠোঁটের উপর৷ গা গুলিয়ে ওঠে কৃষ্ণেন্দুর৷ অসহ্য বমি পায়৷ আস্থার নরম প্রলেপ মাখিয়ে ‘কি হয়েছে’ দৃষ্টি নিয়ে অলক্ষ্যে তাকিয়ে থাকেন ঔপন্যাসিক৷ 
এখন মাঝরাতে বৃষ্টিপতনের শব্দ হয় মাথার গভীরে৷ ভোঁ-ভোঁ করে ওঠে কান৷ এই অসহ্য চরাচর জুড়ে খিলখিল শব্দে হেসে ওঠে স্বপ্নের মিথ্যেরা৷ বুকের ভেতরে এক পুরনো অসহ্য ব্যথা প্রচণ্ড যন্ত্রণায় টনটন করে ওঠে৷ দুইচোখের মাঝখানে জমে ওঠে রক্ত৷ আগ্রার রাস্তায় তখন রুটমার্চ, এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উড়ে যায় গোলাপায়রার দল৷
দূর কুয়াশার ভেতর পড়ে থাকে পাখির ছিন্ন-রোম, বাসি পালক৷ নরম ঘাসের বুকে শুয়ে থেকে আবহমান ক্লান্তি আর মৃত্যুর যৌথ রেখাচিত্রে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে না-লেখা উপন্যাসের বিবর্ণ পাণ্ডুলিপি৷ মাঠে-ঘাটে একা একা ফিরে মরেন আজকের উপন্যাস-লেখক৷ নগরীর বিস্তীর্ণ বাস্তবে একে একে ভেসে ওঠে চরিত্রেরা৷ তাদের মুদ্রাদোষ, লোভ, কামনা আর ভয়৷ তাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা আর দাম্পত্যের গোলোকধাঁধা৷ এক অলীক ছায়াপথ আর মায়াবি সভ্যতার নীতিনিষ্ঠ নিয়মপ্রণালী৷ শরীরে অপ্রকট শরীর আর অমলিন যৌনইচ্ছের বেদনাবিধুর অ্যালবাম৷ সবই ভিড় করে অন্তর্বাস-ছেঁড়া এক দ্রুতগামী মত্ততায়৷ বন্ধুর বিছানায় প্রেমিকার গোপন অন্ধকার৷ এক দীর্ঘতম স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন যেমন অন্তর্গত, সে রকমই৷ কৃষ্ণেন্দু আবারও অনুভব করে, ভয়-বাসনা-পাপবোধ থেকে কেউ মুক্ত নয়৷
প্রিয়তম বন্ধুর জন্য মনখারাপ করে কৃষ্ণেন্দুর৷ কষ্ট হয়৷ কষ্ট হয় ঔপন্যাসিকের জন্য৷ লিপস্টিকে রাঙানো লালঠোঁট বন্ধুর প্রেমিকার জন্য তার কষ্ট হয়৷ কষ্ট হয় মায়ের জন্যও৷ মায়ের বিবর্ণ কুঞ্চিত স্তনের ওপর হামলে পড়েছে একদল চতুষ্পদ৷ হাঁপিয়ে উঠেছে মা৷ জিভ বেরিয়ে পড়েছে৷ ক্রমশ সরু আর লম্বা হয়ে গিয়েছে মুখাবয়ব৷ চেরা ঠোঁট থেকে ঝিলিক দিচ্ছে শ্বদন্ত৷ মুখময় লালাস্রাব গড়িয়ে পড়ছে৷ মেঘ সরে গেলে, চাঁদের পূর্ণ অবয়ব স্পষ্ট হলে, আকাশের দিকে মুখ তুলে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে জান্তব আর্তনাদ করে ওঠে মা৷ সমস্ত চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে যায় সেই অপার্থিব হাহাকার৷ 

(এরপর আগামী সংখ্যায় ) 

'মত্তনীল অন্ধকারে', আগের পর্বগুলি পড়ুন

ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ।। ইন্দ্রজিৎ রায়ঃ ফালতু ডায়রি,বৈশাখ, বিশেবিষ

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০


ধারাবাহিক মুক্তগদ্য
ইন্দ্রজিৎ রায়।। ফালতু ডায়রি,বৈশাখ, বিশেবিষ 




( পূর্বপ্রকাশিতের পর )

প্রাপ্তবয়স্কদের অনেক সময়ে ডায়াপারের প্রয়োজন হয় ।কবে আবিষ্কার হয়েছিলো জানা নেই কিন্তু আমার মাতামহ শ্রীযুক্ত শচীন্দ্রনাথ রায় মহাশয় কিন্তু সেটা , মানে ডায়াপার , পাননি । আমিই সম্ভবত এই অনিয়ন্ত্রিত জল কাচানোর সবথেকে কাছে ছিলাম । রাতের পর রাত , দাদু সারারাত জেগে থাকতেন , বাথরুম যাওয়া আসা করতেন অজস্রবার , কারণ তাঁর মনে হোতো পুরোটা হয়ত হয়নি , তাই আবার । কোথায় তখন ডায়াপার , তখন তো লোকজন দাদুকে কলকাতার এক মনোবিদের কাছে দেখাবে বলে নিয়ে গেলেন । বড় , বুনিয়াদী বংশ ,নানা মুনি , তা মনোবিদ কী করলেন কে জানে , দাদুর যেটুকু ব্যালান্স ছিলো ,তা লুপ্ত হোলো । প্রকৃত অর্থে , বস্ত্রের ঝামেলা তিনি বাদ দিতেন , মাঝে মাঝে , কিন্তু পুরুলিয়ার বিরাট বাগানবাড়িতে , রাতজাগা দাদুকে আমার অন্তত প্রকৃতিস্থই মনে হোতো , অনেক কথা হোতো , আমিও জেগে থাকতাম , কাল কাউকে কাউকে বিষের পরিবর্তে স্মৃতিভার দিয়ে থাকেন , প্রখরতর স্মৃতি জংধরা ক্ষুধার্ত করাতের মত পাশবালিশের পাশে রাখা হতে থাকে , কমা কমা দাও , দম নেন কথক একটু , কিন্তু যেদিন ভোররাতে , জিজ্ঞেস করলেন আমাকে ,আচ্ছা ,আমার গুরুদেবের নামটা কী যেন ,সেদিন বুঝলাম হয়ত সব ঠিক নেই তেমন , ওরকম সময়েই একদিন বাগানের তালগাছটাতে , শকুন দেখেছিলাম , একবারই , কেমন মুখটা উপরে তুলে , বসেছিলো , ভুলতে পারিনা । মেটে রঙের চিল আসতো বহু , মানভূমের রোদে পুড়ে হয়ত অমন রং , আর তিতিরের মত দেখতে কিছু । মাঝেমাঝেই কালোজিরে কিনে এনে দাদু কেস খেতেন হেঁসেলে , আবার কালোজিরে ? সত্যি বলতে কি আমারও চোখে ওই কালো নক্ষত্রখচিত রোদে পোড়া , হালকা মেটে অথবা সাদা রঙের আসমান প্রতিভাত হয়ে থেকে যেতো , সাদা সাদা মাঠ দেখতাম স্বপ্নে , তাতে কালোজিরে ছড়ানো , ছোট্ট দুটো ডানায় উড়ে উড়ে দাদু কুড়োচ্ছেন সেগুলো , ভোর চারটে দাদুর সঙ্গে পুকুরে স্নান করতে যাচ্ছি , নতুন ছট্ পুজোর গামছার মাধুর্য সকলেই বোঝে । সাদা মাঠের মাঝে নীলচে সবুজ পুকুর , তালা দিতে কোনোদিন মনে থাকে না আমার । থানার বড়বাবু ছিলেন দাদু । বাসায় ওয়েব্লি এন্ড স্কট্ রাইফেল । কিন্তু বেলাইনের পুলিস , গ্রামের কেউ পুকুরের মাছ দিতে এলেও পয়সা দিতে চান । লোক অবাক , এ আবার কী পুলিস ! পয়সা দিতে চায় । সেই ভোররাত , আমি দাদুকে মনে করালাম , কাঠিয়া বাবা । ও হ্যাঁ , শুনে কেমন চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণ , বললেন , শুয়ে পড়ো । কলেজ আছে ।আবার সেই ছবি , আধোঘুমে , একটা সাদা ফলের ভেতর দাদু কোথায় যাচ্ছে , বিখ্যাত বাংলা সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে । বড়বাবু ।সাদার ওপর ছিটছিট কালো , দাদুর কেনা সমস্ত কালোজিরে , অদ্ভুত পোলকা ডটের মাঠ , ফলের গভীরে , পরে চাক্ষুস দেখেছি ফলটা , নাম ড্রাগনফ্রুট্ , গোলাপী সাপের দুটো চারটে ফণা আবৃত ফিসফিসে দর্শন । শুলেই । একটা অন্য রামায়ণ দাদু বলতেন , দোকানে ,একই ইলিশ মাছ লক্ষণ ও রাবণের বোনের পছন্দ হয়েছে , কে সেই মাছটা নিয়ে বাড়ি যাবে , সেই নিয়ে বিবাদ ও যাবতীয় ক্যাচালের শুরু , যা আমরা রামায়ণ নামে পড়ি । অথবা এটা যে পান্ডবদের গরু যদি দুর্যোধনের বেগুনখেতে না ঢুকতো , মহাভারত লেখা হোতো না । এখানেই শেষ নয় , মুরগি লড়াই , লাল কাপড় দিয়ে ষাঁড় কে ক্রুদ্ধ করে তোলার খেলা , দাদু আর আমি একটা নিঃসঙ্গ টিম , চিরকালীন । হনুমানজি কে খুব পছন্দ করতেন , সেই থেকে উনিও আমার সব আকামের সঙ্গী, তবে কি , হনুমানজী কিন্তু বাম্পার । ওঁর সঙ্গে একটা যাকে বলে nexus ইংরেজিতে , সেটা অনুভব করি আজকাল । এর সঙ্গে কোনও ধর্মীয় ব্যপার জড়িত নেই তেমন । কী আছে এ বলা দুষ্কর , তবে অনেক অন্ধকারে দেখেছি মনে পড়ে হনুমানজির সেই পুকুরপাড়ের বাড়ি । ওই চাতালটা খুব চেনা যেন । খুব । ওখানে আজকে যারা বসেন গিয়ে তাদেরও চেনা লাগে । মনে পড়ে বর্ষার ধানক্ষেত জলাশয় , কালভার্টের তলায় খলবল করছে অন্যদেশের চ্যাং মাগুর , ওপর থেকে , শুয়ে মাছ দেখতে দেখতে কখন চোখ লেগে গেছে । বৃষ্টি থেমে গেছে কখন । জ্যোতি মাহাতো , দাদুর ভাগচাষী , সে গরুর গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে বাড়ি । কিন্তু ওই কালভার্টের , এখানকার ভাষায় পোলের তলার মাছগুলো , তাদের উচ্ছাস , শহরবাসের অনেক ভার কাটিয়ে দেয় আজও ।দাদুর সেই মনোবিদ একটি সোনারূপোর দোকানের বিজ্ঞাপন করতেন । হোর্ডিংয়ে তাঁর ছবি । ঢাকুরিয়া ব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখছি , অবাক হয়ে । একসময় তিনি সরে গিয়ে ফুটে উঠছে এক পয়সাও ঘুষ না খাওয়া , ডি.এস.পি শচীন রায় র মুখ , চোখে সংকট , ডায়াপার আসেনি বাজারে তখনও , শুধু মনে হচ্ছে এই বোধহয় আরেকটু হয়ে গেলো প্যান্টে । আবার বাথরুম , আবার সেই বিস্কুটের শহরে , বিস্কুটের বাড়িঘর জানলা , আজ আবহাওয়া পূর্বাভাস , বলছে নিরানব্বই শতাংশ বর্ষা , দাদুর স্মৃতি আবছা , তালগাছে শকুনের ছায়া , আমি জেগে আছি , দাদু আজকাল ভোর তিনটে থেকে ঠাকুরঘরে বসে থাকে । বৃষ্টি এলে ? এই বিস্কুটের ঘরবাড়ি কী হবে ?বাঁচানো যাবে ? দাদু কি ভয় পেতো কাউকে ? কিছু কে ? জপ ধ্যান মনে ছিলো দেখেছি কিছুটা ।আর সব আবছা হয়ে আসছে । এই দাদু ছোট আমাকে অমন গল্প বলতো ! দলমা পাহাড়ের নিচে যে বাড়ি , সেখানে কি আজও স্মৃতিভ্রংশ ঘুঘু , মেটে রং আকাশ ঘিরে ধরছে , সন্ধ্যাশেষে কালো নক্ষত্র ফুটে আছে স্থির , ইটভাটা শ্রমিকদের পাড়া এদিকে , দাদুর সঙ্গে আমার কেমন শেষদিকটা ছিন্ন হয়ে গেলো । কলকাতা , পাটনা ঘুরে ওঁর কী চিকিৎসা হোলো জানা নেই , কিন্তু আমি পেলাম না শেষটা । দাদু চলে যাবার আগে একটা দিন খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছিলেন শুনেছি । খুব পুরুলিয়া যেতে চাইতেন । আমিও চাই যেমন । কিন্তু । কিন্তু । অশোকা গোয়ালিনী কে ছিলেন , আমি জানিনা । দাদু জানতেন । এক সন্ন্যাসী ডাকাতের সত্যি ঘটনা বলতেন খুব । সেটা , অন্যদিন বলা যাবে । 

( ক্রমশ ) 


সুজন ঘোষ ।। তিনটি কবিতা

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০






সুজন ঘোষ ।। তিনটি কবিতা 


করোনাকালের ক্রান্তি


ভীষণ রকম বদলে গেছে সব!

আমার এ শহরে সুনসান নীরবতা

প্রশস্ত রাজপথে নেই কলরব।।



অলিতে-গলিতে নেই রিকশার শব্দ!

মিরপুর থেকে মতিঝিল,

নিজের নিঃশ্বাসেও চমকে উঠি, এমনই স্তব্ধ ।।



করোনাকালের ক্রান্তিতে মানুশের গন্ধমাখা এ শহরে,

হটাৎ থেমে যাওয়া যন্ত্রের আড়ালে,

ডেকে ওঠে এক সুকণ্ঠি পাখি, জনমানবহীন প্রান্তরে।।



এ শহরে আছে এমন পাখি জানিনি কখনও আগে !

ভীষণ ভয়ে বদলে গেছে সব, করোনাকালে;

আপাদমস্তক ভীষণ রকম নিরবতা আজ, শাহবাগে ।।



ঠোঁট শুকিয়ে আসে



এই বোশেখে না হয় আমি

বদ্ধ রবো ঘরে,

আবার তোমায় পাবো কি এই

কোয়ারেন্টাইন কাল পরে?

নাখ-মুখ আমার ঢেকে আছে

মহামারীর ত্রাসে,

আবেগ-ঘন অপেক্ষায় বাধা

ঠোঁট শুকিয়ে আসে।।

ঠিক কবে সেই ঋতুর মাসে

জানি বৃষ্টি এলে পর,

সব দ্বিধারা ভাসিয়ে দেবে

মন-কেমনের বর।।


করোনাকাল পরে



সকল মহামারী ত্রাস শেষে,

আমাদের অব্যক্ত সব কথা,

আবারও বলবো আকাশ তলে এসে।।



বৃষ্টি ঝরিয়ে ধুয়ে দেব সব যুদ্ধ জয়ের দাগ,

সন্ধ্যা ছায়ায় ভালোবাসা আবার

জানাবে তার অনুরাগ।।



আমাদের হাসিতে আবার নামবে রাত্রি

সকালে অ্যালার্ম ডাকে,

সারাদিনব্যাপী ফুটন্ত চায়ে, কত গল্প জমবে ফাকে।।



দিনশেষে আরো সহজ হবো, কিংবা আরও জটিল হবো পাছে।

তবুও না হয় বসবো আবার,

আরও আরো হৃদয়ের কাছে।।

কবিতাগুচ্ছ ।। মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া সুপ্রভাত মেট্যা মধুছন্দা মিত্র ঘোষ বিপ্লব চক্রবর্তী লাবণ্য মণ্ডল

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০


কবিতাগুচ্ছ  




মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া ।। চাঁদের পাথর…অহল‍্যা নাম


পাথর থেকে ভেসেছে জল ধ‍্যানের আড়ালে
অন্ধকার যেভাবে ভাসে চোখের পুকুরে
রাত্রি তার দীর্ঘতর আঙুল বাড়ায় যেই
হাওয়ার গহীন ছায়া লুকোয় ত্বকের মুকুরে
শাষনকল‍্যান দুই পুরুষ ইচ্ছেয়
বিবাহ ঋতু দুর্বাঘাস বেঁধেছে এই হাত
সামগানের প্রদীপ মৃদু জড়িয়ে রাখে দ‍্যুতি
অচেনা কোন হাহাকার জানায় ধু ধু রাত?
নৈঋতের আকাশ তবু পাঠালো বিদ্যুৎই
রাত্রি ছিঁড়ে সোনার সাপ জড়ালো পানপাতা
নিয়তি আর স্বপ্ন আজও বৃত্তাকারে ঘোরে
আয়তপথে কাজল দেন স্বয়ং দেবতা
বিছনভূমির কাজল মেঘ শর্তনির্ভর
জলের যেসব শর্তে আকাশ মাটিকে ভেঙে গড়ে
নিষেধ এবং সম্মতির টানা ও পোড়েনে
অনর্থক ইচ্ছে বুনি রাতের অক্ষরে
অপ্রেমের তপস্যায় ঢেকেছি পোড়া রূপ
স্তব্ধতার পাথরে কেবল জমেছে পোড়া ছাই
শুনেছি আমার শাপমুক্তি পায়ের স্পর্শে যার
তিনিও নাকি দেবতা, তবে পুরুষ দেবতাই!



সুপ্রভাত মেট্যা ।। স্নান ইচ্ছে

আর নয়, এবার আমাদের আনন্দ দেখাবার পালা ।বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ।খুশিতে ভরে উঠছে ঘর। হাওয়ায় নেচে উঠছে পাতা, রৌদ্র এবং ধুলো।দুঃখ কস্ট সরে যাচ্ছে দূরে । আর নয়, এবার শহর ছেড়ে আগেভাগেই এসে যাব ঘরে। তোমাকে ডাকব । ডেকে ঐশ্বর্য ভরিয়ে কবিতা লিখব কিছু ; যেহেতু গ্রামের রাস্তা এক টান দেওয়া সুতো , ফিরে আসতেই হবে.... তাই

ভতের নাম এলেই একটা স্নান ইচ্ছে জেগে ওঠে আমার দুপুরের গায়ে । তোমাকে পাই। আমার ক্ষুধা সরে যায় হৃদয় থেকে একটু একটু । একটা না বলা কথার কিছু শব্দ ফুটে ওঠে বুকে। আর ঠিক তখনই দেখি বর্ষা নামের বালিকা মেয়েটি, আমাদের কান্না ঝরা খুশি , ধানের হলুদ স্পর্শে আজ ভাস্কর্য নিপুন যেন গ্রাম হয়ে আসছে !


মধুছন্দা  মিত্র  ঘোষ ।। সাম্পান
     
উল্লেখযোগ্যহারে ডানা ঝাপটিয়ে
     অজস্র সাঁতার, চই চই চই চই
জলের খোলস ভাঙতে ভাঙতে
হাঁসশিশুদের ডুব আমেজ

পালকগুচ্ছ থেকে পিছ্লোচ্ছে জলকনা
কচুরিপানার সবজে চমক
হাঁসছানাদের হিল্লোল, আশ্চর্য মেজাজে 

সরে সরে যাচ্ছে কচুরিপানা
তিরতির গঠিত সাবলীল তরঙ্গ
জল সরে সরে যাচ্ছে
     জল আবার জায়গা পেতে দিচ্ছে

শান্ত জলাশয়, চই চই চই চই
জলখেলায় যে ছানারা মেতে ছিল এতোক্ষণ
     যোগ দিল হাঁস-মায়েরাও
     জলের মায়াটানে
 

ডানা ঝাপটিয়ে, গলা তুলে হাঁস-মায়েরা
জল্ কে চল্ মিছিলে ভাসে
     জলাশয় মাতিয়ে খানিক কুচকাওয়াজ
     খানিক আনন্দ সাম্পান...



বিপ্লব  চক্রবর্তী ।।  বাজার-জাত


আমি বাজারে গেলেই তিনজন হয়ে যাই
চুপচাপ বেরোলেও বাকি ওরা এসে যায়
প্রথমজন  আমার  বোধ বড় খুঁতখুঁতে  
সবার আগাপাশতলা জরিপ করে যায়
প্রিয় মানুষের  কথার ভেতর দেখে শুধু
দ্বিতীয় জন-ই প্রয়োজন আমাকে খোঁজায়
আলুটা মুলোটা থলে ভরতে চায় পেলেই
দেদার খরচ করেন  বাদশাহী  মেজাজে
তৃতীয়জন  আমি দুটোকে দুহাতে ঠেকিয়ে
রাখতে রাখতে অসহায় নত হয়ে  পড়ি
পোশাকের আড়ালে শুধু আমার নড়াচড়া 
একটা বেলুন  আমাদের বাড়ি নিয়ে আসে
বেলুনে বসেই রসিকতা করে  যায় বোধ
 চাহিদা চুপচাপ আসামি থলে হাতে ঢোকে।। 


লাবণ্য মণ্ডল ।। ভূতপূর্ব মানুষের আত্মকাহিনী


আমি প্রদ্বেষী, জন্মান্ধ দীর্ঘতমার বংশবৃদ্ধার্থে আমার জন্ম
তারপর অনেকেই আমাকে অনেক নামে ডাকে অসূর্যস্পর্শা, ললনা, রমনী, অর্ধাঙ্গিনী, জননী, মাগী...
নামহীনতার যুগে অবশ্য মানুষ ছিলাম, আমি।
ভলগা থেকে গঙ্গার চর চষে বেড়িয়েছি শিকারযন্ত্র হাতে
দিনশেষে বাটোয়ারা হয়েছে সবকিছু, বঞ্চিত করিনি কাউকে-নিজেকেও,
উদ্বৃত্তহীনতায় ভুগতে থাকা একপাল মানুষ দীর্ঘমেয়াদী বীমা করে নিল।
যাবতীয় সম্পদের ওয়ারিশ নিজের ঘাড়ে নিয়ে আমাকে
আশ্রয় দিয়েছিল সোনার কাঠি-রূপার কাঠির বিছানায়।
প্রয়োজন মতো কাঠিবদল করে সদব্যবহার করে
ফের কাঠিবদল হয় । 
এভাবেই কাটছিল বেশ, অসূর্যস্পর্শা, ললনা, রমনী, অর্ধাঙ্গিনী, জননী, মাগী...

এরপর এল বর্গী, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনার উপায় কী?
ঐ যে কাঠিবদল; আমি জেগে উঠলাম।
ঘুমাইনি তারপর আর। আমি ভোট দিলাম, মাঠে নামলাম, আজ মানুষের কর্মক্ষেত্রে চরে বেড়াই,
কাজের শোভা বাড়াই।
উপযোগবাদী রাষ্ট্রে আপাদমস্তক মূল্যায়ন পেয়েছি,
অপচয় হয়নি একফোটা।
আমায় ছাড়া অচল বিশ্ববাজার: সাবান, বিড়ি, মোজা,
গাড়ি, সেভিংক্রিম, আন্ডারওয়্যার সর্বত্র অবাধ বিচরণ।
এমনকি আমার প্রত্যেক প্রত্যঙ্গ আজ বিশ্ববাজারে বেস্টসেলার।
এখানে শেষ নয়, রেসের ঘোড়া হয়ে সরেজমিনে এসেছি
মাঠে,
একশ মনের পাথর পায়ে বেঁধে দৌড়ে চলি
সম অধিকারের দাবিতে,
সোনার কাঠি-রূপার কাঠি ফেলে এসেছি বহু আগে।
কর্তার খায়েশ মেটাতে বেরিয়েছি ঘর থেকে,
যা পারিনি, মানুষ-পদবী ফেরত নিতে
তাই বাসে-ঘরে-ঘাটে-মাঠে-মন্দিরে......
নটে গাছটি মুড়োয় আর আমার কথা ফুরোয়।

অগ্রন্থিত রচনা ।। অরুণেশ ঘোষঃ ফ্রানৎস্ কাফকার ভাবশিষ্যের সন্ধানে অথবা নাড়ুদার খেরোর খাতা

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০


অগ্রন্থিত রচনা 

অরুণেশ ঘোষ ।। ফ্রানৎস্ কাফকার ভাবশিষ্যের সন্ধানে অথবা নাড়ুদার খেরোর খাতা



মদ= অহং৷
গাঁজা= আত্মমগ্ণতা৷
ভাঙ্= যৌন সহবাসের ক্ষমতা বৃদ্ধি৷
এ সম্পর্কে গ্রাম্য ছড়াও রয়েছে,যার মর্মার্থ : ভাঙ্গের নেশার পর সহবাসে নারীকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দেওয়া যায়৷
অফিস= সরাসরি সঙ্গমে অক্ষম বুড়ো-বুড়িদের স্বপ্ণিল হাহাকার৷ 
সিদ্ধি= অবান্তর কথা,অকারণ হাসি৷
চরস্= শুরুতে চপেটাঘাত,শেষে মূত্রপাত৷
কোকেন= আত্মহননের প্রবল বাসনা৷
ময়না ফল= সঙ্গমেচ্ছা ও বমনেচ্ছা৷
ধুতুরা= উধর্বমুখী পায়ুদ্বারা সূর্যবন্দনা৷

[এ প্রসঙ্গে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে লিখে রাখছি আমি এক সময় ওস্তাদ নেশাখোরদের খোঁজে গ্রাম থেকে গঞ্জে, গঞ্জ থেকে নগরে ঘুরে বেড়িয়েছি৷ নিছক কৌতূহল বশে নয়, আমার ইচ্ছা ছিল এইসব নেশাখোরদের আচার-আচরণ জীবন-যাপন সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করা, সে আর হয়ে ওঠে নি৷ সে যাই হোক, সে সময়ে আমি শহর থেকে বহুদূর দূরবর্তি একটি গ্রামে ‘পুটকি উদাঙ্’ (খোলা পাছা) নামে এক মহা ওস্তাদ নেশাখোরের দেখা পেয়েছিলাম৷ সে শীতের সকালে ধুতুরার নেশা করার পর বিবস্ত্র পশ্চাদ্দেশটি সূর্যের দিকে তুলে ধরে মাথাটি মাটিতে ঠেকিয়ে স্থির হয়ে ছিল৷ আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়নি আর কোনও কথার জবাবও দেয়নি৷ লোকজনের কাছে শোনা গেল, সে নাকি এভাবেই দুপুর অব্দি থাকে৷ ...এটাকেই আমি উধর্বমুখী পায়ুদ্বারা সূর্যবন্দনা বলে বোঝাতে চেয়েছি]


প্রিয় পাঠক,উপরের পুরো লেখাটি আমার নয়৷ এ হল নাড়ুদা তথা আমাদের এলাকার সাধারণ একজন ভবঘুরে তথা নেশাখোর তথা গেঁজেল নাড়ু ভাঙ্গীর৷ যারা গাঁজা-ভাঙ্গের নেশায় আসক্ত তাদের এ অঞ্চলে বলা হয় ভাঙ্গী৷ নাড়ুদা কোথা থেকে এসেছে--- কী সমাচার কেউ জানত না৷ ব্যক্তিগত সব প্রশ্ণের উত্তর নাড়ুদা কখনই দিত না৷ মানুষজন শেষদিকে তাকে আর বিরক্তও করত না,নাড়ু ভাঙ্গীর অতীত জীবন জানার জন্য কৌতূহল দেখাত না৷ সে সাধারণ হয়েও ছিল অসাধারণ৷
নাড়ু ভাঙ্গী যে উচ্চশিক্ষিত এটি টের পাওয়া যায় ছোট্ট একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে৷
সদরে ইংরেজিতে দরখাস্ত লিখতে হবে কিন্তু লিখবেটা কে? সময়টা তো আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথা,আমাদের (যারা দু-একজন পাশ করেছি সুকলের শেষ পরীক্ষায়) তো ইংরেজীতে দরখাস্ত লেখার কথা শুনেই পেটে মোচড় দিয়ে উঠেছে,ও পারব না বাবা৷ বাংলায় হলে কিছু একটা লিখে দিতে পারি৷ গাঁয়ের মাতববর পড়েছে মুশকিলে,ইংরেজী জানা মুহুরীও নেই আশে পাশে৷ এদিকে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব সরেজমিনে তদন্ত করতে আসবেন সকাল ১০টায়৷ নদীর ওপরের ভাঙা পোলটার একটা ব্যবস্থা এবারই করতে হবে৷ সেটা দেখতে৷ নাড়ু হঠাৎ বলে উঠল,দিন তো দেখি আমায়,আমি লিখতে পারি কি না৷
অবশেষে নাড়ুই লিখল সুন্দর ও গোটা গোটা অক্ষরে ঝকঝকে একখানা দরখাস্ত৷
নাড়ু ভাঙ্গীর জীবন রহস্যের খানিকটা উন্মোচিত হল৷ ম্যাজিষ্ট্রেট সেই দরখাস্ত পড়ে বলেছিলেন, লোকটি কে? এখানে থাকে? ...আমার সঙ্গে একবার যেন দেখা করে যেন৷ নাড়ু যথারীতি দেখা করেনি, হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে৷
আমি আর মৈনুদ্দি তখন সেই বয়সের ছোকরা যাদের নতুন শিং গজিয়েছে এবং যত্রতত্র সেই শিং-এর ধার পরীক্ষা করার জন্য মুখিয়ে আছি৷ অবশ্যই সেই শিং সাহিত্যের, আরও স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে, বিশ্ব সাহিত্যের৷ আমাদের প্রিয় কবি শার্ল বোদলেয়ার ও জাঁ আর্তুর র্যাঁবো৷ প্রিয় লেখক ফ্রানৎস্ কাফকা ও আলবেয়ার কাম্যু৷ খানিকটা বাংলা অনুবাদ,খানিকটা ইংরেজি অনুবাদে পাশে আবার একটা ডিক্শেনারি নিয়ে কী আগ্রহে,কী গভীর মনোযোগে পড়া৷ সেই ‘পড়া’ যে কী বস্তু যে পাঠক সাহিত্যকে পাগলের মত ভালবেসেছে,সেই বুঝবে৷ সে তো ‘পড়া’ নয়, গ্রন্থটির মধ্যে ঢুকে পড়া আর তার চরিত্রদের সঙ্গে,তার স্রষ্টার সঙ্গে এক ভিন্নতর অভিযাত্রা৷ সেখানে ভাষা,দেশ,কাল কোনও অন্তরায়ই নয়,সব তুচ্ছ! ---
আর পাঠক হয়ত ব্যঙ্গের সুরেই বলবেন,ওই গন্ডগ্রামে বিদেশী বই-পত্র পেলে কোথা থেকে হে ছোক্রারা?
আমাদের এক বন্ধুর বাবা বলতেন,মনপ্রাণ দিয়ে ভগবানকে ডাকলে তার দেখা পাওয়া যায়, আর একটা রক্তমাংসের নারীকে ভজনা করলে,যে যত সুন্দরী হোক,তাকে পাওয়া যাবে না,এটা একটা কথা হল?
আমরা তাঁর ঐ ‘নারী’ শব্দটির জায়গায় ‘বই’ শব্দটি বসিয়ে নিতাম,আমাদের প্রিয় ‘রক্তমাংসের গ্রন্থ’৷ মনপ্রাণ দিয়ে যে বই চাইব,তাকে অবশ্যই পাব,এমন স্থির বিশ্বাস ছিল৷ শহর ও শহরতলীতে দিকপাল পড়ুয়াদের বাড়ির লাইব্রেরিতে হানা দিতাম দুজনে,আমাদের এমন বই নিয়ে পাগলামি দেখে অনেকে হেসে দিয়ে দিতেন বই৷ যেমন সেলস্ ট্যাক্সের অফিসার বিশাল বপুর অধিকারী মহান মানুষ পি.কে.ভঞ্জ৷ তিনি আমাদের দান করলেন জেমস্ জয়েস, সাঁর্তের এবং কাফকা আর প্রতিবার কলকাতা যাওয়ার আগে বলতেন,কোন কোন বই লাগবে তার একটা লিষ্ট করে দাও৷....
আমাদের আর পায় কে৷
যা হোক,নাড়ু ভাঙ্গী তথা আমাদের প্রিয় নাড়ুদার কথায় আসা যাক৷ নাড়ুদার আস্তানা ছিল হরিদাস সাহার পরিত্যক্ত গুদাম ঘরে,চটবস্তার উপর একটা মোটা খদ্দরের চাদর,ছেঁড়া ময়লা মশারি,একপাশে কেরোসিন কুকার ও রান্নার সরঞ্জাম৷ হাতা,খুন্তি,কড়া ও ডেকচি৷ নাড়ুদা নিজের হাতে রান্না করে খেতো৷ আর এসবই হাটখোলার বড় ব্যবসায়ী হরিদাস সাহা তাকে দিয়েছেশুধু তাই নয়,প্রতিদিনের চাল-ডাল-তেল-নুন-আনাজ-পাতি হরিদাসের লোক এসে দিয়ে যায় নাড়ুদাকে৷ হরিদাস সাহার বিশ্বাস, নাড়ু ভাঙ্গি তার ভাঙ্গা গুদাম ঘরে বাসা বাঁধার পর থেকেই তার ব্যবসাতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে৷ হরিদাস তাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করে৷
আর আমরা হয়ে গেলাম নাড়ুদার ন্যাওটা৷
তাই ফাই-ফরমাজ খাটি,তার জীবনের-রহস্য জানবার জন্য অদম্য কৌতূহল আমাদের৷ এমন একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ কী করে ছন্নছাড়া-ভবঘুরে হয়ে গেল! কথাবার্তার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে যদি নাড়ুদার গোপন অতীত একটু বেরিয়ে আসে তাহলেই আমরা তাকে চেপে ধরব,নাড়ুদা খুলে বল না নিজের কথা৷ নাড়ু কিন্তু দারুণ সতর্ক,নিজের সম্পর্কে কোনও কথা ভুলেও মুখে আনে না,বলে অন্যের কথা,শোনায় আমাদের তার ভ্রমণবৃত্তান্ত,বিচিত্র সব মানুষের কথা৷...
কিন্তু আমাদের জন্য যে পরম বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে অন্য জায়গায় সেটা আমরা কী করে বুঝব৷
এক দুপুরবেলা রান্নাবান্না শেষে নাড়ুদা গেছে আধমাইল দূরের নদীতে স্নান করতে৷ নদী থেকে স্নান করে ফিরতে নাড়ুদার এক-দেড় ঘন্টার কম লাগে না,সেদিন আবার হরিদাস সাহা পাঠিয়ে দিয়েছে কাপড় কাচার সাবান,সেই সাবান নিয়ে গেছে নদীর ঘাটে,কাপড়-চোপড় কেচে তবে ফিরবে,সময় তো লাগবেই৷


আমরা আঁতি-পাতি করে নাড়ুদার ঘর খঁুজছি,যদি একটা চিঠিও পাওয়া যায় তাহলেও নাড়ু-রহস্য কিছুটা হলেও উদ্ধার করতে পারব৷
হঠাৎ মৈনুদ্দির চাপা গলার চিৎকার,ইউরেকা৷ পেয়ে গেছি৷
তার হাতে একটা খেরোর খাতা,পেয়েছে বিছানার চট-বস্তার গোপন গহ্বর থেকে৷
শুধু সেই খেরোর খাতা নয়,এক এক ক’রে বেরুল,কাফকার গদ্য-সংকলন,চিঠিপত্রের সংকলনের ভল্যুম,কাফকার উপর লেখা মোটাসোটা গ্রন্থ আর অক্সফোর্ড অভিধান একটি,এসব যে গোপন সম্পদ নাড়ুদার তাতে কোনও সন্দেহ নেই,তবে তার সেইসব বইপত্রকে চটের তলায় রেখে মাথার বালিশ হিসেবেই ব্যবহার করত নাড়ুদা৷ প্রিয় বস্তু তো মাথায় করেই রাখতে হয়৷
আমরা,অর্থাৎ আমি মৈনুদ্দি কিন্তু দিশেহারা৷...
নাড়ুদার বইপত্র আর খেরোর খাতা নাড়াচাড়া করে যেটা বোঝা গেল,সে হল এই : নাড়ুর প্রিয় লেখক ফ্রানৎস্ কাফকা,তাকে কাফকার ভাবশিষ্যও বলা যায়৷ অর্থাৎ যাকে আমরা খঁুজছিলাম সে ছিল আমাদের ঘরের কাছেই,নাগালের মধ্যে৷ ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি আমরা৷
অবলীলায় নাড়ুদার বই ও খেরোর খাতাটি আমরা চুরি করতে পারতাম,সেই দুষ্টবুদ্ধি যে মাথায় আসেনি,তা নয়,কিন্তু সেই ইচ্ছা বেশ কঠোর ভাবে দমন করেছি দুজনেই৷ জীবনে কিছু কিছু জায়গায়, কোনও কোনও ব্যক্তিমানুষের কাছে মাথা নত করতে হয়,শ্রদ্ধায় অভিভূত হতে হয়৷ নাড়ুদা সেই রকম একজন মানুষ৷
তবে একটা অপরাধ আমরা করেছি৷
নাড়ুদার অনুপস্থিতিতে তার খেরোর খাতা থেকে যতটা পারা যায় টুকে নিয়েছি৷ লেখার শুরুতেই যার কিছু নমুনা পাঠককে উপহার দিয়েছি৷ বস্তুত খেরোর খাতাটিতে নাড়ুদার কোন দিনলিপি ছিল না,ছিল না অতীত জীবন নিয়ে কোনও সঙ্কেতপূর্ণ লেখা,যা ছিল তা ছোট ছোট গল্প--- ‘গসপেল’ জাতীয়, সহজেই কাফকাকে মনে পড়ে যায়৷ যদিও সেসব লেখা সম্পূর্ণ মৌলিক,নাড়ুদার নিজস্ব লেখা, পড়া মাত্র বুঝেছি৷
খুবই তাড়াহুড়া ক’রে সে সব লেখা আমাদের টুকে নিতে হয়েছিল তাই তার দু-তিনটি পাঠকের জন্য তুলে দিচ্ছি :


১. একটি সাধারণ নরবলির ঘটনা


গল্পটি আমি শুনেছিলাম পিতামহের কাছে৷ পিতামহ আবার শুনেছিল তার পিতামহের কাছে৷
গল্প নয়৷ সত্য ঘটনা৷ ঠাকুরদা বেশ গম্ভীর স্বরেই বলেছিলেন,এরকম নরবলি একটা সময়ে আকছারই দেওয়া হোত--- শুধু একটু গোপনে৷ এই যা৷
এক্ষেত্রে নরবলির ঘটনাটা কিছুটা আলাদা৷ বলি দেওয়ার জন্য যাকে বাছা হয়েছিল তিনি একজন সুদর্শন ব্রাহ্মণ যুবক তদুপরি একজন ঘোরতর নাস্তিক, কালীসাধক ভূতনাথ ও জমিদার অঘোরনাথ পর পর তিন রাত্রি স্বপ্ণ দেখেছিল,গাঁয়ের এই বিদ্রোহী যুবকটিকে ‘মা’ আকুল ভাবে আকাঙ্ক্ষা করছেন৷ তখনই পুরোহিত ও জমিদার মিলে স্থির করে,যুবকটিকে মায়ের কাছে উৎসর্গ করা হবে৷ 
তাঁকে ধরা হয় এবং জমিদারের প্রাসাদের একটি গোপন কুঠুরিতে বন্দী করে রাখা হয়,যতদিন না নির্দিষ্ট অমাবস্যা তিথি না আসে৷
যথারীতি সেই অমাবস্যা তিথির গভীর নিশুতি রাত্রিতে শ্মশানকালীর সম্মুখে তাঁকে আনা হয়৷ তাঁর হাতদুটি পিছমোড়া দিয়ে বাঁধা ছিল মাত্র,সে কোনও চিৎকার করা বা নিজেকে ছাড়াইয়া লইবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে নাই৷ করিয়া কোন লাভ হইবে না বলিয়া৷
শ্মশানকালীর সম্মুখে নিয়ে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,তার শেষ ইচ্ছা কী৷
যুবক নীরব ছিল৷
এমন কি হাঁড়িকাঠে স্বেচ্ছায় সে গলা পাতিয়া দিয়াছিল৷ তখনও পুরোহিত জিজ্ঞাসা করেছে,তার শেষ ইচ্ছা কী?
ঠিক সেই সময়ে যুবক মধ্যরাত্রির স্তব্ধতাকে খানখান করে চিৎকার করে ওঠে,আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও৷ আমি দেবীকে একবার প্রণাম করব৷ উপস্থিত সকলে চমকিত ও বিস্মিত হয়৷ মৃত্যুর আগমুহূর্তে সে যদি আস্তিকও হয় তবু তার নিস্তার নাই সকলে জানত,সম্ভবত যুবকও সে কথা জানে৷ যা হোক,পিছমোড়া দিয়ে বাঁধা হাত দুটি খুলিয়া দেওয়া হল৷ যুবক,দেবী তথা ভয়ংকরী কালীমূর্তির সামনে গিয়া দুই বাহুতে মৃন্ময় মূর্তিকে জড়াইয়া ধরিল এবং একাদিক্রমে তাহার লেলিহান জিহ্বায় ও ওষ্ঠাধরে,দুই স্তনে আর নাভিদেশে প্রগাঢ় চুম্বনশেষে বীরদর্পে পুরোহিত,ঘাতক ও জমিদারের কাছে ফিরিয়া আসিল৷ সকলেই বিমূঢ়!
মাটিতে বুক পাতিয়া স্বেচ্ছায় সটান হাঁড়িকাঠে মাথা দিয়া বধ্য খাঁড়া-হাতে-দাঁড়িয়ে-থাকা ঘাতককে নির্দেশ দিল,হ্যাঁ৷ এখন আমার মুণ্ডুচ্ছেদ কর৷ আমাকে হত্যা কর৷
পিতামহ গভীর রাতে চলিত ও সাধু ভাষায় মিশিয়ে এই সত্য ঘটনার বিবরণ আমাকে শুনিয়েছিলেন৷ কৈশোরে আমি তাঁর সঙ্গেই ঘুমাইতাম ও গল্প বলার জন্য আব্দার করতাম৷
‘এইবার ঘুমাইয়া পড় অনেক রাত হয়েছে’৷ বলে দাদু পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে৷ কিন্তু সেই কিশোরের আর কি ঘুম আসে!


২. জীবনের অনুরূপ বা ‘সংসার-সংসার’ খেলা


কৈশোরে আমি একদল ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে উপরিউক্ত খেলায় অংশ নিয়েছিলাম৷ সবারই বয়স ৮ থেকে ১২-র মধ্যে৷ গ্রীষ্মের একটি দুপুরে বাড়ির বড়রা যখন দিবানিদ্রায় মগ্ণ তখনই পেছনের ঝোপ জঙ্গলের আড়ালে একটি ছায়াময় গোপন স্থান বেছে নেওয়া হয়েছিল৷
বয়সে যে সবার থেকে বড় তাকে আমরা রাঙাদি বলে ডাকতাম,সে-ই খেলার পরিচালনা করছিল, খঁুটিনাটি সব নির্দেশ দিচ্ছিল৷ সাদামাটাভাবে যাকে বলা যায় বড়দের অনুকরণ করা৷ অবশ্য আমাদের খেলাটি তার চেয়েও গভীর ও ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল৷ যার পরিণতি হয় ভয়াবহ৷ 
অনেকেই শৈশবে ‘রান্না-বাটি’ খেলা খেলেছেন নিশ্চয়ই৷ আমাদের খেলাটি রান্না-বান্না দিয়েই শুরু হয়েছিল,ক্রমশ তা জীবনের জটিলতর আবর্তের দিকে বাঁক নেয়৷ অর্থাৎ রান্না-বান্না,বাজার করা,পাটকাঠি ভেঙে বিড়ি-সিগারেটের মত করে টানা,বড়দের মত ভারিক্কী চালে কথাবার্তা বা তর্ক আর ঝগড়াও অভিনীত হল৷ আমরা ছিলাম জোড়ায় জোড়ায়,স্বামী-স্ত্রী হিসেবে৷ আমার স্ত্রী ছিল সেই রাঙাদি, যে কি না আবার গোটা শিশুপরিবারের কর্ত্রী৷ 
তারপর তো ধূলোর ভাত,লতাপাতার ব্যঞ্জন ইত্যাদি খাওয়ার অভিনয় করা এবং তারপর রাত্রি৷ জোড়ায় জোড়ায় ঘাসের উপর শুয়ে পড়া৷ রাঙাদির কঠোর নির্দেশ,শুধু ঘুমের ভান করলে চলবে না,রাত্তিরে বড়রা যা করে সেটিও করতে হবে৷ অর্থাৎ সঙ্গম৷ সে টেনে টেনে সবার ইজের খুলে দিয়ে শুরু করতে বলল৷ ব্যাপারটি সবারই জানা তবে দু-একজন খিক্-খিক্ হেসে ওঠা মাত্র রাঙাদির কড়া ধমক৷ নিঃশব্দে সহবাসের প্রক্রিয়া চলতে লাগল৷ রাঙাদি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে বলল আর আমার পুরুষাঙ্গ তার শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল,এই এভাবে না,গর্দভ কোথাকার,হ্যাঁ এভাবে... এরকম ক’রে উম্ম্...৷ ...এ পর্যন্ত সবই ঠিকই ছিল৷
কিন্তু বিপদটা হল শেষে৷ রাঙাদি হঠাৎ কুঁজো হয়ে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল মানে সে বুড়ো হয়ে গেছে৷ তারপর সে চিৎপাত হয়ে শুয়ে ছটফট করতে লাগল৷ হাতের ইশারায় কাছে ডাকল সবাইকে৷ আমরা সবাই তার মুখের দিকে ঝঁুকে পড়ে কান্নাকাটির অভিনয় শুরু করলাম৷ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, রাঙাদির বুক ওঠা-নামা করছে না,গোটা শরীর বরফ-শীতল হয়ে গেছে,চোখের মণি স্থির৷ সত্যি সত্যি রাঙাদি মরে গেছে৷ আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া বাচ্চারা যে যার মত ছুটে পালাল--- শুধু আমি বাদে৷ সদ্যস্তন ওঠা সেই ১২ বছরের কিশোরীর সুন্দর ও মৃত শরীরের কাছে বসে থাকলাম স্থির হয়ে--- যতক্ষণ না বড়রা কেউ এসে আমাকেই অভিযুক্ত করে!


৩. নিরপরাধীরাই মূল অপরাধী


কচি-কাঁচাদের আসরের বার্ষিক সম্মেলনে আমাদের ছোট গঞ্জ-শহরটির শাখা সংগঠনটিও যোগ দিয়েছিল৷ আমিও তাদের সঙ্গে ছিলাম৷ আমার বয়ক্রম তখন মাত্রই ১২৷
বয়স অল্প হলেও কৌতূহল ছিল আমার অসীম৷ অভিজ্ঞতার দিক থেকে আমি ছিলাম যুবক,যদিও আমার শান্ত-ধীর-স্থির আচরণের জন্য অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারতাম৷
১৬ জন ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের ‘পাহাড়গঞ্জ কচি-কাঁচাদের আসর’৷ আর দাদা তথা শিক্ষক দুজন,একজন মন্টুদা,অন্যজন হাফিজদা৷ দুজনের বয়স ২৫/২৬৷ এই ১৮ জন দিয়ে আমাদের টিম৷ দাদারা আমাদের নাচ,গান,আবৃত্তি,ব্রতচারী শেখাত,মাঝে মধ্যে স্বরচিত পদ্য বা ছড়া পাঠেরও আসর বসত৷ ...এটা ওপরের দিক,আলোকিত অংশের দিক৷ সবকিছুরই যেমন একটা অন্ধকার দিক থাকে,‘কচি-কাঁচাদের আসরে’রও ছিল৷ সেই অন্ধকার দিকটা প্রত্যক্ষভাবে জানার জন্য,দেখার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেছিলাম আমি৷
হফিজদা আর মন্টুদা ছিল উন্মত্ত সমকামী৷ বিশেষ করে হাফিজদা আর হাফিজের প্রভাবে মন্টুও হয়ে ওঠে একজন পাকা শিকারী৷ ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাই তাদের শিকারের লক্ষ্যবস্তু ছিল৷ এটা কিশোর কিশোরীদের মধ্যেও সংক্রামিত হয় দ্রুত৷ তারা গোপনে একে অপরের সঙ্গে সমকামে প্রবৃত্ত হত৷
যা হোক,সেই বার্ষিক সম্মেলনের কথা বলি৷
জেলাশহরের একটি সুকলে সেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে৷ আসরের রাজ্য সম্পাদক তথা প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং আসবেন৷ আমাদের প্রত্যেককে সতরঞ্চি-চাদর-বালিশ ও মশারি নিয়ে সেই সুকলপ্রাঙ্গনে দুপুরের মধ্যে হাজির হতে হবে৷ ১০ টাকা করে চাঁদা সবার কাছ থেকেই নিয়ে নেওয়া হয়েছিল৷
প্রথমে ভেবেছিলাম,আমি যাব না৷
সমকামিতাকে আমি আন্তরিকভাবে ঘৃণা করতাম৷ আমার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস ওরা পায়নি৷ কিন্তু বার্ষিক সম্মেলনের হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে ওরা যদি আমার উপর চড়াও হয়৷ এরকম আশঙ্কায় দ্বিধা একটু ছিল, দ্বিধা কাটিয়ে উঠে অবশেষে গেলাম সেখানে৷
নাচ,গান,নাটক,খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির পর প্রত্যেক শাখা সংগঠনের জন্য বরাদ্দ ক্লাশরুমে ঢুকে গেল ঘুমাবার জন্য সবাই৷ আমরা মেঝের উপর সতরঞ্চি পেতে,চাদর বিছিয়ে নিয়েছি,কেউ মশারি টাঙিয়েছে, কেউ টাঙায়নি৷ ঘরের বড় বড় জানালা,জানলায় কোনও শিক ঠিক নেই৷ দরজার হুড়কোও নেই শুধু ভেজিয়ে দেওয়া হল৷ তখনকার দিনে ক্লাশরুমে সিলিং ফ্যানের বালাই ছিল না৷ আলো নিভিয়ে দিতেই খোলা জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল একরাশ জ্যোৎস্না তার সঙ্গে হু হু বাতাস৷ সময়টা ছিল বসন্তকাল৷
সব বিছানায় জোড়ায় জোড়ায়,আমি শুধু একা৷ দমবন্ধ করে আছি বলা যায়,কখন শুরু হবে সমকামের উৎসব৷ আবার আমিও প্রস্তুতও হয়ে আছি,আমার উপর কেউ চড়াও হলে একটা হেস্ত নেস্ত হয়ে যাবে৷ অবশ্য আমার দিকে কারুর ভ্রূক্ষেপ ছিল না৷
আমার বিছানার পাশেই সমকামী-সম্রাট হাফিজ আলী আর তার শয্যাসঙ্গী নয় শষ্যাসঙ্গিনী হল সীমা, যার বয়স ১৬-র কম হবে না৷ কী আশ্চর্য! লোকটা শুধু সমকামী নয় উভকামীও বটে! ---ভাবছিলাম৷ 
কিন্তু আমার ভুল ভাঙল একটু পরেই৷
নির্ভুল জ্যোৎস্নালোকে দেখলাম,মেয়েটিকে উপুড় ক’রে তার পায়ুপথেই সঙ্গম করার চেষ্টা করছে হাফিজ৷ সীমা কিন্তু মুখে ‘উঁ-আঁ’ শব্দে প্রবল আপত্তি তুলে ঝট্ ক’রে চিৎ হয়ে পা দুটো ভাঁজ ক’রে পদ্ম পাঁপড়ি-সদৃশ মেলে ধরছে,যার অর্থ পায়ুতে নয় হে নির্বোধ, যোনিতে গমন কর৷ কিন্তু যতবার চিৎ হচ্ছিল সীমা ততবারই দুহাতে এক ঝটকায় উপুড় করে নিচ্ছিল তাকে হাফিজ৷ না না যোনি নয়,পায়ুই পরম পথ, রে মূর্খ নারী৷ তার স্নিগ্দ মুখমণ্ডল জ্যোৎস্নালোকে নিঃশব্দে এই কথাই বলছিল৷ আমি হাফিজ আলীর এই নিষ্ঠা ও পায়ুপ্রেমে চমৎকৃত হয়েছিলাম৷ 
এইরূপে যখন নানারকম চাপা শিৎকারধবনিতে আর নানাভঙ্গিতে সমকাম উৎসবে আন্দোলিত-উচ্ছ্রিত-উন্মত্ত জ্যোৎস্নায় অন্ধকারে আচ্ছাদিত গোটা ঘর তখনই ব্রজপাত হল৷
অর্থাৎ ঘরে আলো জ্বলে উঠল৷
আমি ছিলাম একমাত্র দ্রষ্টা,ঘুমের ভান করে দেখছিলাম,ধড়ফড় করে উঠে বসলাম মশারির তলায়৷
দেখি,রাজ্যসম্পাদকসহ আরও কয়েকজন স্তম্ভিত হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে৷ বস্তুত,‘কচি কাঁচাদের আসরে’র দাদামণি ও আরও কয়েকজন কর্মকর্তা ঘর ঘরে আলো জ্বালিয়ে দেখছিলেন সকলের শোবার ব্যবস্থা ঠিক মতন হয়েছে কি না৷ হাজার হলেও এতগুলো শিশু-কিশোরের দায়িত্ব তাদের উপর৷ এ ঘরে এসে এমন দৃশ্য দেখবে তারা কল্পনাও করেনি৷ তারা নিঃশব্দে এসেছিল,নিঃশব্দেই প্রস্থান করল৷
সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে চলছে এটা অনুমান করা মাত্র,সকলেই তাদের ব্যাগ-বিছানা সব ফেলে জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে পালিয়ে যায়৷ একমাত্র একা আমি বসে থাকলাম আমার মশারির তলায়৷
হাতে লাঠি-রড ষন্ডামার্কা কয়েকজন ঢুকল ঘরে :
‘কোথায়,কোথায় শুয়োরের বাচ্চারা’?
‘পালের গোদাদুটোকে ধরতে হবে আগে’
‘ওদের গোয়ায় রড ঢুকিয়ে ইয়ে করার সাধ মিটিয়ে দেব,দাঁড়া’....
কিন্তু কোথায় কে,গোটা ঘর ফাঁকা,একমাত্র আমি চুপচাপ বসেছিলাম৷
‘সব পালিয়েছে,সব পালিয়েছে,গেল কোথায়’
‘ঐ একটা আছে,ওটাকেই ধরে নিয়ে চল,এ্যাই আগেই মারিস না দাদামণির কাছে নিয়ে চল,দাদামণিই বিচার করবে?’’
আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হল অফিসঘরে৷ দাদামণির কাছে৷ দাদামণি রক্তচক্ষু মেলে জিজ্ঞেস করে,‘সব গেল কোথায়?’
‘পালিয়েছে?’ 
‘তুই পালালি না কেন?’
‘আমি কিছু করিনি তো’
‘করিসনি তবে দেখেছিস তো’
‘হ্যাঁ’ মাথা-নিচু সায় দিলাম৷
‘এটাই তো বড় অপরাধ৷ দেখাটাই অপরাধ৷ যা বিছানা প্যাঁটরা কাঁধে করে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা৷’
‘আমার বাড়ি অনেক দূরে,দাদামণি’
‘যত দূরেই হোক৷ এত রাতে হাঁটতে হাঁটতে যাবি,এটাই তোর শাস্তি৷’...


এভাবে নাড়ুদার খেরোর খাতা থেকে কিছু লেখা কপি করে নিতে পেরেছিলাম৷ বলা চলে,‘দুরু দুরু বক্ষে’,একজন চাপা গলায় বলতাম,অন্যজন দ্রুত হাতে লিখে নিত আর বার বার উঁকি দিয়ে দেখতে হত নাড়ুদা আসছে কি না৷ নাড়ুদাকে আসতে দেখা মাত্র তার খাতা বই বিছানার তলায় যথাযথ ভাবে রেখে,সাধু সেজে বসে থাকতাম৷
কিন্তু যেভাবেই হোক নাড়ুদা টের পেয়ে গিয়েছিল,আমরা তার গোপন সম্পদের খোঁজ পেয়ে গেছি৷ এক সকাল বেলা গিয়ে দেখি,নাড়ুদা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেছে৷ আমাদের জন্য রেখে গেছে কাফকার গ্রন্থাবলী,সঙ্গে নিয়ে গেছে তার নিজস্ব খেরোর খাতাটি৷ সেদিন দুজনে কেঁদেছিলাম আর তাঁকে কোনও দিন খঁুজে পাব না বলে৷


(এই অপ্রকাশিত রচনাটি ‘এবং বিকল্প’-র জন্য অরুণেশ পাঠিয়েছিলেন ২০১০-এর মাঝামাঝি সময়ে,‘এবং বিকল্প’ আয়োজিত জীবনানন্দ দাশের জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে গিয়ে৷ তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের পর যখন ‘এবং বিকল্প’ পত্রিকার ‘অরুণেশ ঘোষ স্মরণ সংখ্যা’র প্রস্তুতি চলছে তখন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে প্রেসের ফাইলে লেখাটি খঁুজে পাওয়া যায়নি৷ অথচ এই অপ্রকাশিত লেখাটি প্রকাশিত হবে বলে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল অনেক আগেই৷ অনেকদিন পরে আচমকাই এক গ্রীষ্মদুপুরে ব্যক্তিগত লেখালিখির ফাইল-কাগজপত্রের মধ্যে থেকে উদ্ধার হয় লেখাটি৷ অরুণেশপুত্র নমিতেশ ঘোষের কাছে খোঁজ নেওয়া হয় ইতিমধ্যে এই লেখাটি অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়েছে কি না৷ নমিতেশও কোনও সন্ধান দিতে পারেন নি৷ অতএব, এ সংখ্যায় লেখাটিকে অপ্রকাশিত রচনা হিসেবেই প্রকাশ করা হল৷ প্রসঙ্গত লেখার শেষে তারিখ দেওয়া আছে--- ২২/১০/২০০৯৷ এই তারিখটিকেই লেখাটির রচনাকাল ধরে নেওয়া যায়৷ যদিও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন,যে কোনও সৃজনশীল লেখকের মতোই অরুণেশও একই রচনা ঘুরেফিরে লিখতেন নানান সময়ে নানান শিরোনামে৷ পাঠাতেনও বিভিন্ন পত্রিকায়৷'এবং বিকল্প' (জানুয়ারি ২০১৫) সংখ্যা থেকে রচনাটি অগ্রন্থিত রচনা হিসেবেই এখানে পুনরায় প্রকাশিত হলো। নমিতেশ জানালেন এখনও পর্যন্ত রচনাটি কোনও গ্রন্থভুক্ত হয়নি।   --- রাজীব সিংহ)



স্মরণঃ বিমান মাহাতো

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০


স্মরণঃ বিমান মাহাতো



বিমান মাহাতো ।। চাতক কাঁদছে কেন

চাতক কাঁদছে কেন, তুমিও কি মৃত্যু ভালোবাসো?
নাকি বাঁশবনে তুমি নিরিবিলি বাঘ দেখেছিলে?
ঝিলের জলের মাঝে তাই কি কম্পিত আজ একঝাড় বাঁশও?
এক মুহূর্তের জন্য তুমি কি কখনো দেখেছিলে
ঝিলের জলের মাঝে মিছে জলকেলি করে সাপ-মাছ-হাঁসও?
রূপটা তোমারি নাকি প্রতিবিম্বরাঙা দেখেছিলে?
বুড়ো অশ্বত্থের মতো হাসছে সাহেব বিবি তাসও।
তৃণভোজী ছাগলেরা ছিঁড়ছে না একরাশ ঘাসও।
চাতক কাঁদছে কেন, তুমিও কি মৃত্যু ভালোবাসো?


প্রিয় অগ্রজ ।। উৎপলকুমার বসুর স্বনির্বাচিত কবিতাগুচ্ছ

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০



উৎপলকুমার বসুর স্বনির্বাচিত কবিতাগুচ্ছ




এই বছর

‘বরষাব্যাকুল’ এই শব্দটির আড়ালে আড়ালে
আমি ভ্রাম্যমাণ সারাদিন। ভাবি, সে-ও বনের
ওধারে চলে চলে যেতে পারে সাপুড়ের মতো।
ফনাতোলা রৌদ্র ও উত্তাপে আমি কম্পমান।
আমার অতটা সাহস নেই। যদি প্রতিটি সমাস
আজ ছেড়ে যায়, যদি তৎপুরুষ শেষকালে চিনেও
না চেনে তবে কার আশ্রয়ে যাব, কোথা গেলে
ঝড় আসবে, বৃষ্টি পাবো?
স্বপ্ন-পৃথিবীর সত্য
সরে গেছে নিম্নচাপ।
ধরে গেছে অকালবর্ষণ।
এই স্রোত বৈতরণী বটে।
নদী পাথরের মতো স্থির ---- কখনো উত্তাল।
পুবের বাতাস
কথায় কথায় ধানক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ছে।
আনন্দিত মানুষজনের পিঠে ডানা দেখা যায় ----
তারা পাখি-পতঙ্গের মতো বাতাসে উড্ডীন।
ছোটোরা ইস্কুলে যাচ্ছে ---- বড়োরা চাষের কাজে।
কেউ কেউ শুধুই বাতাসে ওড়ার সুখে
যত্রতত্র ডানা মেলছে।


শাসনযন্ত্র

পাল্লাস ---- প্রসূতিপারা, স্ফীতোদের, নৌবাহিনীর নেতা।
আশ্রয়দাত্রী তুমি, ঐ নাবিকশ্রেষ্ঠরে তীরে বেঁধে রাখো।
সূর্যদেব অকস্মাৎ মধ্যাহ্নকটালে যেন অস্থির, অনিশ্চয়----
ঢেউ দিগন্তে লাফিয়ে ওঠে ---- সাতসমুদ্রের লবণ সাক্ষর
লাগে আকাশের গায়---- হায়, দাগানো তালিকা এই
কর্মচারীর হাতে, তাই নিয়ে ঘুরি, এত নাম, শতাধিক,
এদের কোথায় সন্ধান পাবো? কোন জনপদে? কোন
গোপন কৌশলে এদের দ্বীপান্তরী করা যাবে, জলচর
দেব ও দেবতাগণে মিনতি জানাই, পায়ে পড়ি, এ-যাত্রা
উদ্ধার করো, ঠিক সময় মতই যেন এদের গ্রেপ্তার করি,
অত্যাচারে অভিভূত করে রাখি ---যতক্ষণ জলযান অ-প্রস্তুত,
আমাদেরও তৈরী হতে যতক্ষণ লাগে।


ছায়াছবি

কিমিয়া হে, ফিরে আসি পুরনো ফটোর পাশে ----
আমাকেও নিশ্চয়তা দান করো। ডেকে নাও
শত বছরের অতীত ছবির মধ্যে, বৈঠকখানার
ফরাসের এক কোনে জবুথুবু হয়ে বসি, বাবুদের জন্য
বাজারের যে ক-টি ফল ঐ গামছায় বাঁধা রইল তার দাম
কে দেবে জানি না, এই বিচারাধীনের আবার গারদ হবে,
বিদ্যার নামে যত ছলাকলা, ঘৃণায় শরীর যেন
ক্ষয়ে যেতে থাকে, দরজায় কঙ্কাল ঝোলে,
প্রজা, এই তোর নিশ্চয়তাজ্ঞান? এই তোর নির্ভুল কিমিয়া?


স্মৃতি

এক নগর দেখেছি আমি ---- জনপদ, চৈত্য ও বিহার
দিগন্তের কাছাকাছি ----গয়া থেকে বৌদ্ধগয়ার পথে যেতে যেতে,
রৌদ্রে পোড়া যাত্রীদলে আরো অনেকে দেখেছে,
বলেছে স্তম্ভিত হয়ে ‘ঐ সেই পাটলীপুত্র স্থান...’
গাছে গাছে চৌসা আমের ফল বাতাসে উজ্জ্বল
আমাদের যাত্রাপথে, গতিময় ধ্বংসোন্ম ুখ গ্রীষ্ম-দুপুরের
ঝড় তখনই নামল, নগর-গ্রাম উল্টে দেওয়া কালো
ইতিহাস। আমরা মাটিতে শুয়ে আতঙ্কিত, দৃশ্যহীন, ভূতের স্বরূপ।


স্বাধীনতা দিবস

ভিজে জামা-কাপড়ের স্তূপ উঠোনের তারে
মেলে দিতে গিয়ে দেখি---
একী এ যে কাঁটাতার,
রক্ত ঝরছে
ঐ দিকে, কুয়াশায়, বহু কিছু ছড়িয়ে রয়েছে,
বাল্যের খেলার বাক্স, রাঙা রথ, পাতা-ছেঁড়া বই
এবং অনতিদূরে প্রকান্ড প্রান্তর এক, ছায়াচ্ছন্ন,
শত শত বালক-বালিকা বুঝি কোনো উৎসবে হাজির---
আমি হাত নাড়ি,
তারা যেন দেখেও দেখে না---
ক্রমশই ছায়ায় বিলীন হয়।


উৎপলকুমার বসুর স্বনির্বাচিত কবিতাগুচ্ছ কবি নিজেই নির্বাচন করে আমাকে পাঠিয়েছিলেন, যেগুলি আমার সম্পাদিত 'এবং বিকল্প' পত্রিকায় ২২-তম সংখ্যায় (জানুয়ারি, ২০১১)-তে প্রকাশিত হয়। কবির ছবিগুলি আমার তোলা। ---রাজীব সিংহ

কথোপকথনঃ শংকর চক্রবর্তী

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০



কথোপকথনঃ শংকর চক্রবর্তী



জন্ম: ২৪ সেপ্ঢেম্বর ১৯৪৬, ঢাকা
প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ: এক আকাশে, ১৯৭৫
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা: ২০
শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ফেলে আসা আধকাপ চা, ২০১৭
প্রাপ্ত পুরস্কার / সম্মান : ত্রিবৃত্ত পুরস্কার, অবনি সাহিত্য পুরস্কার (টাংগাইল, বাংলাদেশ) রূপসী বাংলা পুরস্কার ইত্যাদি৷ অতি সম্প্রতি কবিতা আশ্রম পুরস্কার৷ 
রাজীব সিংহ-র লিখিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শংকর চক্রবর্তী।


প্রশ্ণ: গত শতাব্দীর ৫-এর দশকের শেষ থেকে বলা ভালো ৬-এর দশক জুড়ে সারা বিশ্বে পুরোনো মূল্যবোধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, আধিপত্যবাদ, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবসমাজ৷ এই সময়ে এসে আপনার কবিতার লেখার শুরু৷ এই ঝড়ো সময় আপনাকে, আপনার কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?


ছয়ের দশকের প্রথমদিকে, আমি তখন সদ্য কলেজে--- দু-দু’টো যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করি তখন৷ যদিও ওই সময়েই, হয়তো একটু আগে-পরে, নানা আন্দোলনে শামিল হতে অন্তত একবার মিছিলে পা মেলাননি এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা খুবই নগণ্য৷ সে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই হোক বা যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন৷ সরাসরি সেইসব কবিতায় ঢুকে না পড়লেও কবিতা তখন ভিতরে ভিতরে ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করেছে৷


প্রশ্ণ:একদিকে ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ, অন্যদিকে ভাঙনমুখী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবির--- এক দিকের স্বপ্ণভঙ্গের হতাশা--- এই পরস্পর বিরোধিতা সেইসময় আমাদের দেশেও আছড়ে পড়েছিল৷ আপনার নিজের কবিতায়, আপনাদের সময়ের অন্যদের কবিতায় এই ঝড়ো দিনগুলির কোনো ক্ষত কি আদৌ লক্ষ করা যায়?


ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ যতটা আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল, তখনকার অন্য ঘটনাগুলি ততটা প্রভাব ফেলেনি কারণ কোনো কিছুর সেভাবে গভীরে ঢুকে বিশ্লেষণ করতে শিখিনি তখন৷ তবে ছোটোবেলায়, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলাম তা আমার মধ্যে খুবই প্রভাব ফেলেছিল৷ প্রথম প্রথম মানুষে মানুষে বিভেদের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারার যাবতীয় কষ্ট নীরবে কবিতায় ঢেলেছি একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে৷ এখানে বলে রাখা ভালো, এই বিভেদ কিন্তু পরবর্তী সময়েও আমার পেছন ছাড়েনি৷ প্রায় ত্রিশ বছর চাকরি সূত্রে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকাকালীন নিজেও এই বিভেদের শিকার হয়েছি বহুবার৷ তবে তখন মানুষকে বুঝিয়ে, নানাভাবে, নানা মাধ্যমে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেবার ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছিলাম৷ তো সেই সময় থেকেই মানুষ বা প্রকৃতি আমার কবিতার বিষয় হয়ে উঠতে শুরু করল৷ 


প্রশ্ণ: তখন আদর্শ হিসেবে কাকে মেনে নিচ্ছেন? আপনার প্রিয় কবি কে?


একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি৷ সত্তরের শেষ দিকে যখন সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জাতি-বিদ্বেষে উত্তাল হয়ে উঠল, যখন শিলং-এ দিনের পর দিন কার্ফুর মধ্যে দিন কাটাতাম, তখনই ওখানকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষক, বাঙালি-অসমিয়া-খাসিদের বিভিন্ন সাংসৃকতিক সংস্থা ও অন্যান্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রতিনিধি নিয়ে ‘ফরিয়াদ’ নামে একটি সাম্প্রদায়িক বিরোধী ফোরাম তৈরি করলাম৷ সেই সংস্থার তরফ থেকে একটি প্রবন্ধ ও কবিতার সংকলন তৈরির কাজে একবার কলকাতা এসেছিলাম৷ কলকাতায় এসে একদিন আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়ে এক প্রখ্যাত সাহিত্যিকের কাছে সম্প্রীতির বাণী-ছোঁয়া একটি গদ্য চাইতেই তিনি মশকরা করে আমায় বলেছিলেন, ‘আপনাদের খুব মারছে না? মেরে কেটে লাশ ফেলে দিচ্ছে শুনলাম’৷ এই ভাষা তাঁর মুখ থেকে শুনে আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম সেদিন৷ ওঁর ঘর ছেড়ে তৎক্ষাণাৎ বেরিয়ে আসি৷ আর কখনো তাঁর মুখোমুখি হইনি৷ অথচ শিলং থাকাকালীন সেইসময় সুনীলদা ও শঙ্খদা উদ্বিগ্ণ হয়ে চিঠি লিখতেন প্রায়ই৷ তো আদর্শ হিসেবে বাছতে গিয়ে একজন কবি বা লেখকের জীবনযাত্রা, তাঁর সততা ও সুচিন্তিত ভাবনাই সর্বাগ্রে আমায় প্রভাবিত করে৷ তাই এখনও শঙ্খ ঘোষ,নিঃসন্দেহে৷


প্রশ্ণ: কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ কি আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? কবিতার শরীর অর্থাৎ ফর্ম আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? 


এই প্রশ্ণের দু’টি উত্তর হয়৷ প্রথম প্রশ্ণের উত্তরে জানাই-- ছাত্রাবস্থা থেকে আই-পি-টি-এ, গণনাট্য বা বাম রাজনীতির প্রতি পক্ষপাত ছিল৷ নির্দিষ্ট কোনো দলীয় সংগঠনের প্রতি নয়৷ তখন বিশ্বের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকরাই বাম-চিন্তাধারার প্রতি আস্থা রাখতেন৷ এখন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলির ভোটকেন্দ্রিক দিশাহীন অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হয়৷
দ্বিতীয় প্রশ্ণের উত্তরে বলি, কবিতার শরীর বা আঙ্গিকেরও গুরুত্ব কম নয়৷ তবে তা কখনো আরোপিত হলে মুশকিল৷ এত বছর লেখালেখির পর এইসব নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালোই লাগে, তবে,সবার আগে সেটা ভালো কবিতা হয়ে উঠল কি না সেটাই বিবেচ্য৷


প্রশ্ণ: আপনার কবিতায় চিরায়ত রোমান্টিকতার বদলে অত্যন্ত উদাসীন মেধাবী এক সত্তা লক্ষ করা যায়৷ যা অত্যন্ত অনুভূতিসম্পন্ন ও সারাক্ষণ ক্রিয়াশীল৷ দেশি-বিদেশি নানা তত্ত্ব, পুরাণ ও সমাজচিন্তা আপনার কবিতার উপাদান৷ প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গির বিপ্রতীপে আপনার সামগ্রিক উচ্চারণ কেন?


কী বলব বুঝতে পারছি না৷ সত্তরের আগেই রোমান্টিক আবহে আমার লেখা শুরু৷ ‘টুকুন’ সিরিজের কবিতাগুলিই তার প্রকৃত উদাহরণ৷ তবে কলকাতা থেকে শেকড় উপড়ে মেঘালয়ে নির্বাসিত হওয়ার পর, প্রকৃতি ও বিভিন্ন জাতি-উপজাতিদের জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি, তাদের প্রেম ও প্রেমহীনতার বিষয়ই আমার কবিতায় ঢুকে গেল অগোচরে৷ আসলে আমার ব্যক্তিজীবনের নানা অভিজ্ঞতাই কবিতার বিভিন্ন স্তরের দিকে এগিয়ে নিয়েছে৷ এই সুযোগে অভিজ্ঞতার কথা একটু জানিয়ে রাখি৷ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় অফিসের কাজে ত্রিপুরার তেলিয়ামুড়ায় সাময়িকভাবে তৈরি সামরিক বাহিনীর এক বিশাল ক্যান্টনমেন্টে আমাকে আর সঙ্গে অফিস-গাড়ির ড্রাইভারকে একমাত্র অসামরিক মানুষ হিসেবে প্রায় একমাস কাটাতে হয়েছিল৷ সে এক বিরল অভিজ্ঞতা৷ রাতের অন্ধকারে প্রায় পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান যখন অতর্কিতে আক্রমণ করে উড়ে যেত, তখন ওই যুদ্ধ-সন্ত্রস্ত পরিবেশে আমি এক ঢাল-তরোয়ালহীন ভ্যাবলা অন্ধকার তাঁবুতে একা বসে কীভাবে কাটিয়েছি--- সেসবই ছিল আমার পরবর্তী সময়ের মূলধন৷ তো অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই নানা তত্ত্ব ও সমাজচিন্তা আমাকে উসকে দিত৷


প্রশ্ণ: কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? অনুজ কবি হিসেবে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?


এই ধরনের আন্দোলন একেক সময় শিরোনামে এসে পড়ে তা স্তিমিত হতে দেখি৷ তবে গোড়ায় হাংরি আন্দোলনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা-বই খুঁজে সংগ্রহ করে পড়তাম নিয়মিত৷ বলতে দ্বিধা নেই, উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম তখন৷ পরে আমাকে তেমনভাবে টানেনি৷ সত্তরের মাঝামাঝি চাকরি সূত্রে সামান্য সময় পাটনা থাকাকালীন সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে নিয়মিত এ নিয়ে তর্ক করেছি৷ সমীরদা একদিন মলয় রায়চৌধুরীকেও নিয়ে আসেন৷ মলয়দার একটা ইন্টারভিউ ছেপেছিলাম সেই ’৭৫ সালে আমার কাগজের একটি সংখ্যায়৷ আর মাসিক কৃত্তিবাস বেরোবার সময় শিলং থেকে প্রায়ই ছুটি নিয়ে অক্রুর দত্ত লেনের অফিসে গিয়ে নানা কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতাম৷ আমার বন্ধু শ্যামলকান্তি দাশ, দেবাশিস বসু কৃত্তিবাস-এ কাজ করত তখন৷ সন্ধ্যের দিকে আড্ডা হত নিয়মিত৷ শিলং-এ আমাকে লেখা সুনীলদা ও শক্তিদার অনেক চিঠিতেই কৃত্তিবাস-এর প্রসঙ্গ থাকত৷ নানা পরিকল্পনার কথাও৷


প্রশ্ণ: লিট্ল ম্যাগাজিন, বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান--- প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সম্পর্কে আপনার মত কী?


দেখ, সত্তরের একেবারে প্রথম দিকে শিলং থেকে আমার সম্পাদনায় শতাব্দী বেরোতে শুরু করে৷ একটি লিট্ল ম্যাগাজিনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট-বৈষম্য-অপমান সবই সহ্য করার মতন ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে তখন৷ পরে আশির দশকের মাঝামাঝি যখন শিলং-এর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকা উমিয়াম সম্পাদনা শুরু করি, তখনও একই অভিজ্ঞতায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছি৷ আসলে, আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়ে হইচই করিনি কখনো৷ কারণ দু’জায়গায় লেখার গুণগত মানের পার্থক্য বুঝিনি৷ আমি সত্তরের দশকে যেমন অসংখ্য লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছি, তেমনি দেশ পত্রিকাতেও নিয়মিত৷ আমরা যে এখন কবি সম্মেলন পত্রিকাটি মাসে মাসে বের করি, সেটাও নাকি প্রতিষ্ঠান! অনেকেই বলেন, আবার হাসিও পায়৷ দু-চারজনের সম্মিলিত চেষ্টায়, পকেটের পয়সা ঢেলে ঘরের খেয়ে সাজানো প্রতিষ্ঠান! এই প্রতিষ্ঠান অবশ্য লেখককে আর্থিক সম্মানমূল্য দিতেও অপারগ৷


প্রশ্ণ: আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের প্রেক্ষিতটি কি?


অকালপ্রয়াত আমার কবিবন্ধু সোমনাথ মুখোপাধ্যায় আমার সঙ্গে সুকলে পড়ত৷ শিলং থেকে প্রায়ই ছুটি নিয়ে চলে আসতাম কলকাতায়৷ এসে আড্ডার টানে অক্রুর দত্ত লেনের কৃত্তিবাস মাসিক পত্রিকার অফিসে ছুটে যেতাম৷ সোমনাথের অফিস ছিল ‘হিন্দ’ সিনেমার পাশে৷ প্রায়ই ওর অফিস থেকে বেরিয়ে একসঙ্গে ‘কৃত্তিবাস’-এ ঢুকতাম৷ সেখানেই একদিন সোমনাথ আমাদের দু-জনের কবিতা নিয়ে একটি বই বের করার প্রস্তাব দেয়৷ সেটা ছিল ১৯৭৫৷ আমি রাজি হই৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটির নাম রাখলেন এক আকাশে, আমায় এলোমেলো পান্ডুলিপি থেকে কবিতা নির্বাচিত করে দিয়েছিলেন সুনীলদা৷ তারপর সব কিছু সোমনাথের হাতে জমা দিয়ে শিলং ফিরে যাই৷ কিছুদিন পর, বন্ধুদের চিঠিতে বই-একাশের খবর পাই৷ তখনও দেখিনি, ইতিমধ্যে প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় বইটির আলোচনাও করেছেন দেশ-এ--- তাও শিলং-এ বসেই পড়েছি৷ তারও অনেক পরে কলকাতায় গিয়ে বইটির কয়েকটি কপি সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম সোমনাথের কাছ থেকে৷ এই সেদিন বইপত্র গোছাতে গিয়ে মলাট-ছেঁড়া একটি কপি উদ্ধার করতে পারি৷ 


প্রশ্ণ: ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার--- আপনি স্বীকার করেন?


অস্বীকার করার উপায় নেই৷ তবে ভিন্ন প্রেক্ষিতে, এই সব এড়িয়েও বহু উল্লেখযোগ্য কীর্তির উদাহরণ আছে৷


প্রশ্ণ: সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি পুরস্কার নিয়ে একই বিতর্ক আছে৷ এই নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগও সর্বজনবিদিত৷ এ বিষয়ে আপনার মত কী?


এটা চিরকালীন সমস্যা৷ খুব কম প্রাপ্য পুরস্কারই বিতর্কের বাইরে থাকতে পেরেছে৷ তবে এও ঠিক কোনো পক্ষকেই সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়৷ তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত যেকোনো পুরস্কারই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা-মুক্ত থাকা প্রয়োজন৷ অবশ্য যদি সেখানে প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তিরা বিচারকমণ্ডলীতে না থাকেন৷


প্রশ্ণ: বাংলা কবিতার কলকাতা-কেন্দ্রিকতার অভিযোগ নিয়ে আপনার অভিমত কী?


এই অভিযোগ আমারও ছিল যখন ত্রিশ বছর কলকাতার বাইরে, উত্তর পূর্বাঞ্চলে ছিলাম৷ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেসব কবিরা থাকেন, তাঁদের এই অভিমান খুব একটা অমূলক নয়৷ তবে সত্তরের দশকে কিন্তু বাইরে থেকেই কলকাতাকে ঘিরে ধরেছিল বাংলা কবিতা৷ শিলচর-শিলং-জামশেদপুর-মেদিনীপুর-রানাঘাট- কৃষ্ণনগর-শ্রীরামপুর--- বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতায় স্পর্ধা দেখিয়েছে তখন তরুণ কবিরা৷ এই প্রসঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একবার আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্যামল, কমল ও আমার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন৷ তবে আসাম ও ত্রিপুরার কবিদের এই সংগত অভিমান দূর করার জন্য কবি সম্মেলন পত্রিকার তরফ থেকে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷


প্রশ্ণ: অনেকেই দাবি করেন গত শতাব্দীর সাতের দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায় মৌলিক চিন্তার অভাব৷ আপনি কী বলেন?


এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে সত্তরের দশকে বাংলা কবিতায় এক নতুন প্রাণের সংযোজন হয়৷ এবং এরপর থেকে ওই প্রচলিত তৈরি পথেই বাংলা কবিতা এগোয় কয়েক দশক৷ তবে এই মুহূর্তে, সামান্য হলেও বাংলা কবিতায় বিদ্যুৎচমকের মতো নতুন কাব্যভাষায় লেখার চেষ্টা লক্ষ করছি--- যা
নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক৷ তবে তার উত্তরণ কোনো সঠিক পথে এগোয় কি না সেটাই দেখার বিষয়৷


প্রশ্ণ: এতটা পথ পেরিয়ে অনুজ কবিদের প্রতি কোনো বিশেষ পরামর্শ?


অনুজ কবিদের পরামর্শ দেওয়ার মতো স্পর্ধা আমার নেই৷ তবে ইদানীং আমাদের দপ্তরে ভিড়-করে-আসা কবি-যশঃপ্রার্থীদের প্রায়ই নিয়ম করে অগ্রজ কবিদের কবিতা পড়তে বলি৷ কবিতা পড়ার কোনো বিকল্প নেই৷ এভাবে একজন নবীন কবির বিশ্বস্ত জ্ঞানও তৈরি হয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস৷ দুঃখের সঙ্গে জানাই, আলোচনায় বুঝতে পারি, অনেকেরই কবিতা-পাঠের অভিজ্ঞতা কম৷


প্রশ্ণ: কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা না গদ্য আজকের তরুণতমদের কবিতায় কীসের প্রভাব স্পষ্ট বলে আপনি মনে করেন? 


কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবনানন্দের গদ্যের প্রভাবই লক্ষ করি, যা আমার বেশ ভালোই লাগে৷


প্রশ্ণ: পরবর্তী-প্রজন্মের কবিদের কাছে কী আশা করেন? 


ওদের হাতে বাংলা কবিতা আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক--- এই আশা করি৷ 

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা ২০১৮ সংখ্যা থেকে 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'-এ সাক্ষাতকারটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।) 

আরও পড়ুন কথোপকথনঃ গৌতম চৌধুরী