শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

কথোপকথন ৷৷ গৌতম চৌধুরী


মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০


কবিতাপত্রের সহিত কথোপকথন ৷৷ গৌতম চৌধুরী




জন্ম : ১৮ ফাল্গুন ১৩৫৮, ২ মার্চ ১৯৫২
প্রথম কবিতাপ্রকাশ : ইসুকলের দেওয়ালকাগজ
প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ : কলম্বাসের জাহাজ (১৯৭৭)
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা : ২১ (কবিতা), ৫ (গদ্যবই)
প্রাপ্ত পুরস্কার / সম্মান : বীরেন্দ্র পুরস্কার (১৯৯৯) 
রাজীব সিংহ-র লিখিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন গৌতম চৌধুরী ।

প্রশ্ন: গত শতাব্দীর ৫-এর দশকের শেষ থেকে বলা ভালো ৬-এর দশক জুড়ে সারা বিশ্বে পুরোনো মূল্যবোধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, আধিপত্যবাদ, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবসমাজ৷ এই সময়ে এসে আপনার কবিতার লেখার শুরু৷ এই ঝড়ো সময় আপনাকে, আপনার কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? 

প্রশ্ন: একদিকে ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ, অন্যদিকে ভাঙনমুখী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবির--- এক দিকের স্বপ্ণভঙ্গের হতাশা--- এই পরস্পর বিরোধিতা সেইসময় আমাদের দেশেও আছড়ে পড়েছিল৷ আপনার নিজের কবিতায়, আপনাদের সময়ের অন্যদের কবিতায় এই ঝড়ো দিনগুলির কোনো ক্ষত কি আদৌ লক্ষ করা যায়?

জবাব ১ ও ২ : দরিয়ার তুলকালাম ঘূর্ণিতরঙ্গে যেসব মাছ বা অপরাপর জলচর প্রাণী পয়দা হয়, তাহারা একরকম প্রাকৃতিক ভাবেই সেই উথালপাথাল নিরুপায়তার ভিতর বাড়িয়া উঠিবার তরিকাটি রপ্ত করিয়া লয়৷ পরিস্থিতি তৈয়ার করিবার পিছনেও তাহাদের যেমন কোনো কৃতিত্ব নাই, তাহাকে মোকাবিলা করিবার ব্যাপারেও অব্যবহিতের বাধ্যবাধকতাই তাহাদের মূল চালিকাশক্তি হইয়া দাঁড়ায়৷ অবশ্য জলচরেরা যতদূর যূথবদ্ধ, মানুষ তত নহে, কবিরা তো আরও নহে৷
আপনারা যে-সময়কালের উল্লেখ করিয়াছেন, তাহার অভিঘাত যে পশ্চিমবঙ্গীয় তারুণ্যের উপর জম্পেশভাবে আছড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই৷ সেকালীন জায়মান কবিরাও তারুণ্যবশত তাহা হইতে আঁচ লইয়াছেন৷ আপন মেজাজ-মর্জি মোতাবেক তাহাতে লিপ্ত হইয়াছেন বা সাধ্যমতো নির্লিপ্ত রহিয়াছেন৷ তবে, সময়ের ঝাঁজ এমনই তীব্র ছিল যে, কেহই হয়তো তাহাকে বিলকুল এড়াইয়া যাইতে পারেন নাই৷
অপরের কথা কহিতে পারি না৷ আমি ক্ষুদ্র প্রাণ এক, কালের বিকিরণে খাক হইয়া ক্ষেপণাস্ত্রের মতো উৎক্ষিপ্ত হইয়াছি একথা বলিবার জো নাই৷ কিছু দগ্ধাইয়াছি, বারনল প্রয়োগে প্রশান্তির খোঁজে ততোধিক দূরত্বে পলাইয়াছি৷ সেই টানাপোড়েনেই হয়তো উঠিয়া আসিয়াছে আমার পহেলা জীবনের সামান্য কবিতাপ্রয়াস৷

প্রশ্ন: তখন আদর্শ হিসেবে কাকে মেনে নিচ্ছেন? আপনার প্রিয় কবি কে?

জবাব : ধ্রুবতারার মতো একজনকেই আদর্শ করিতে পারিলে তো ভালোই হইত৷ অন্তত আজ এতদিন বাদে এই লইয়া জবাবদিহি করিতে বসিয়া থতমত খাইতে হইত না৷ তবে একটি কথা কবুল করা উচিত যে, আধুনিকতাপ্রসূত এক প্রকার আহম্মকি হইতেই হয়তো, রবীন্দ্রনাথ এই তালিকার বাহিরে ছিলেন৷
প্রিয় কবি তো অনেকেই৷ তবে সে-ফর্দ কালে কালে বদলায়মান৷ ইহাতে অবাক হওয়ার কিছু নাই যে, হালফিলে সে-ফর্দের শীর্ষের দিকে রহিয়াছেন রবীন্দ্রনাথ৷

প্রশ্ন: কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ কি আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? কবিতার শরীর অর্থাৎ ফর্ম আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?  

জবাব : দুইটি আলাহিদা প্রশ্ন এইখানে একলপ্তে হাজির৷ তাই একে একে জবাব দিই৷
ক) হ্যাঁ, বুঝিয়া না-বুঝিয়া সেই আকর্ষণের ব্যাপারটিই ঘটিয়া গিয়াছিল বটে৷ তখনও ইস্কুলজীবন শেষ হয় নাই৷ অর্থাৎ, বয়সের দিক দিয়া নাবালকই বলা যায়৷ দুই-চারিটি চটি বহি মারফত, মানবমুক্তির দিশারি ভাবিয়া লইয়াছিলাম মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারাকে৷ এবং মানবমুক্তি দূরপ্রসারী হইলেও বাংলার বুকে বিপ্লব যে আসন্ন, অন্তত তাহা লইয়া কণামাত্র সংশয় ছিল না৷
আপনাদের প্রশ্নে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদের কালটি অতীত৷ কাজেই আমার উত্তরটিও অতীতকালের সহিতই সংলগ্ন রহিল৷ ভাবের ঘরে কোথায় মার খাইয়া সেদিনের বিশ্বাস কতখানি ঝরিয়া পড়িল, আর তাহার কতদূর অন্দরে সিন্ধাইল, তাহা স্বতন্ত্র আখ্যান৷ 
খ) নিতান্ত স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ ছাড়া, আমরা কয়জনই বা শরীকে সহি-সালামতে রাখিবার জন্য হররোজ নিয়ম মানিয়া দৌড়ঝাঁপ করি? যাঁহারা তাহা করেন, তাঁহারা হয়তো-বা বহাল তবিয়তে রহিলেও, নিতান্ত সেই ব্যায়ামচর্চা হইতেই যে তাঁহাদের ভিতর অন্যান্য মানবিক গুণের উৎকর্ষ ঘটিবে, এমন নহে৷ বরং, দুনিয়াকে উপভোগ করিবার যে-সহজাত এলেম লইয়া মানুষ পয়দা হয়, শরীর লইয়া অত্যধিক খুঁতখঁতানি আখেরে সেই আনন্দবোধকেই জখম করে৷
পাশাপাশি এই কথাও সমান সত্য যে, শরীরচর্চা করি বা না-করি, শরীর না-রহিলে যে আমি-নামক অস্তিত্বটিই বরবাদ হইয়া যায়, তাহাও অস্বীকার করিবার জো নাই৷ সেই আমি-র ভিতর মানবিক গুণের যতই পরাকাষ্ঠা ঘটুক না কেন, শরীর নাজুক হইয়া পড়িলে আমি-ও হতমান৷ শরীর লোপাট হইলে, আমি-ও গায়েব৷
কবিতার শরীর বা আঙ্গিকের বিষয়টিও এইরকমই৷ সচেতন কবিতাপ্রয়াসী মাত্রেই আঙ্গিকের মহিমা টের পায়৷ কবিতার ইতিহাস যে তাহার আঙ্গিকের ইতিহাস, এহেন আপ্তবাক্যটির রটনায় কে না ওয়াকিবহাল৷ তবে কিনা সৃজনশীলতার কেতাবে তো আখেরি বচন বলিয়া কিছু নাই৷ তাই এমন এক আর্ষ উক্তিও তাহাকে ভাবায় যে, অন্তঃসারহীন কবিতা একটি শূন্য কফিনের মতো যাহার ভিতর দেহ বা মনের কোনো অস্তিত্ব নাই৷
ভাবনার এই দুই তারেই বাজনা বাঁধিতে হয় বলিয়া আমার ধারণা৷ কোনো একটি তারে বেশি জোর পড়িলে, পুরা বাজনাটিই মাটি হইবার জোগাড়৷

প্রশ্ন: আপনার কবিতায় চিরায়ত রোমান্টিকতার বদলে অত্যন্ত উদাসীন মেধাবী এক সত্তা লক্ষ করা যায়৷ যা অত্যন্ত অনুভূতিসম্পন্ন ও সারাক্ষণ ক্রিয়াশীল৷ দেশি-বিদেশি নানা তত্ত্ব, পুরাণ ও সমাজচিন্তা আপনার কবিতার উপাদান৷ প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গির বিপ্রতীপে আপনার সামগ্রিক উচ্চারণ কেন?

জবাব : আমার সামান্য কবিতাপ্রয়াসের যেসব অভিধা ও বিশ্লেষণ আপনারা উচ্চারণ করিয়াছেন, তাহা আসলেই চমকপ্রদ৷ অন্তত আমার কাছে৷ কারণ আমি বরাবরই এক ধরনের নিরুপায়তা হইতেই লিখিবার কোশেশ চালাইয়া গিয়াছি৷ নিরুপায়তা শব্দটি এস্তেমাল করিলাম এই অর্থে যে, যখন যাহা লিখিয়াছি, তাহা না-লিখিয়া নিস্তার পাইবার কোনো বিকল্প সেই মুহূর্তে আমার সামনে হাজির হয় নাই৷ ‘জনপ্রিয় ভঙ্গি’তে লিখিবার এলেম নাই বলিয়াই তেমন সব কবিতা লিখিয়া উঠা হয় নাই৷ অন্যথায় ওইসব কাজের কারবারিদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নাই৷ দুনিয়ায় সকলেরই আপন আপন তরিকায় নাচিয়া-কুঁদিয়া বেড়াইয়া আমোদ করিবার ও অপরকে সেই আমোদের ভাগ দিবার আজাদি রহিয়াছে৷

প্রশ্ন: কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? অনুজ কবি হিসেবে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

জবাব : যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন আকৃষ্ট বা প্রভাবিত হইবার মতো কোনো সাহিত্য-আন্দোলন তো নজরে পড়ে নাই৷ ইহা হয়তো আমার জ্ঞানেরই স্বল্পতা৷ পরে শুনিয়াছি, ক্ষুধার্ত, শ্রুতি, এমন কিছু কিছু  ইস্তাহারভিত্তিক গোষ্ঠী ওই সময়ের আগুপিছু সক্রিয় ছিল৷ কবুল করিতেই হয়, সেইসব ইস্তাহার এবং তাহাদের নায়কদের রোমাঞ্চকর কাহিনি বিষয়ে সেইসময় ওয়াকিবহাল ছিলাম না৷ কোনো ইস্তাহার নয়, বরং শৈলেশ্বর ঘোষ বা অরুণেশ ঘোষের কবিতাপাঠের সূত্রে অবশ্য পরবর্তীতে তাঁহাদের সহিত প্রীতির সম্পর্কও তৈয়ার হইয়াছিল৷
কৃত্তিবাস পত্রিকার ২/১টি সংখ্যায় আমি লিখিয়া থাকিতে পারি৷ পত্রিকাটিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাগজ বলিয়াই জানিতাম৷ তাঁহার সহিত কিছু পরিচয়ও একদা ছিল৷ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তাঁহার হৃদয়বত্তার গুণে অপরাপর তরুণ-তরুণী কবিদের মতো আমাকেও কিছু স্নেহ করিতেন৷ কিন্তু কৃৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সহিত আমার দীর্ঘ বা স্বল্পমেয়াদি কোনো সম্পর্ক কোনোদিনও গড়িয়া উঠে নাই৷ আমার কবিতাযাপনে ওই কাগজের কোনো ভূমিকা নাই৷

প্রশ্ন: লিটল ম্যাগাজিন, বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান--- প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সম্পর্কে আপনার মত কী?

জবাব : আমি তো বরারব ছোটোদের ভিতরেও ছোটোতর কাগজেই লিখিয়া আসিতেছি৷ কাজেই, ছোটোকাগজকেই আমার কবিতার মাতৃভূমি বলিয়া মনে হয়৷
জিন্দেগিভর প্রতিষ্ঠান-অপ্রতিষ্ঠান লইয়া নানান কচকচিতে বহু সময় কাটিল৷ প্রতিষ্ঠান লইয়া কোনো কথা তুলিলেই কিছু আমোদগেঁড়ে তার্কিক, টেবিলও প্রতিষ্ঠান চেয়ারও প্রতিষ্ঠান ঘরও প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদি আওয়াজ তুলিয়া আলোচনার মর্মশাঁসটি বাঞ্চাল করিতে চান৷ আরে বাবা, প্রতিষ্ঠানের প্রত্যঙ্গ লেহন করিতে তো কোনো বাধা নাই৷ যাও না, করো গিয়া৷ কোনো-না-কোনোভাবে আমরা সকলেই-কিছু-না-কিছু তাহা করিতেছি৷ কারণ প্রতিষ্ঠান তো সহস্রানন৷ আর সময় হইতে সময়ান্তরে তাহার ভেকও বদলায়৷ কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পেয়াদাগিরি করিয়া ‘এ সংসারের হাটে / আমার যতই দিবস কাটে,/ আমার যতই দু-হাত ভরে উঠে ধনে / তবু কিছুই আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে৷/ যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে স্বপনে৷৷’ 

প্রশ্ন: আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের প্রেক্ষিতটি কি?

জবাব : সব তরুণ কবিরাই যাহা হয় আর কী, এক যৌথ উদযাপনের অভিজ্ঞান হিসাবেই আমারও পহেলা কবিতাবইটি বাহির হইয়াছিল৷ সতীর্থ ও ঈষৎ অগ্রজ কবিদের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও সক্রিয় সহযোগিতার ভূমিকাই সেখানে মুখ্য৷ আমি শুধু কবিতাগুলি লিখিয়াছিলাম মাত্র৷
দেশে তখন জরুরি অবস্থা৷ ভূরি ভূরি প্রেমের কবিতার ভিতর গুটিকয় রাজনীতি-আশ্রিত কবিতাও বহিটিতে ছিল বলিয়া সেন্সরশিপ বা আরও খারাপ কিছুর ভয় যে একেবারে ছিল না তাহা নয়৷ (চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির... এই কবিতাও ছাপা যাইত না তখন!) কিন্তু অল্প কিছুদিনের ভিতরেই জরুরি অবস্থা রদ হইল৷ আমরাও হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম৷ সেসব তো কম দিন না, ৪০ বছরের পুরানা কাসুন্দি!

প্রশ্ন: ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার--- আপনি স্বীকার করেন?

জবাব : কোনো এক গভীর স্মৃতিভ্রংশতার দৌলতে আমি যদি আমার মা-বাবার নাম ভুলিয়াও যাই, জিনকোষের ভিতরে আঁকা শতাব্দীবাহিত সংকেতগুলি তো মুছিয়া দিতে পারিব না৷ আমার অব্যবহিত, আমার সমসময়, যেমন আমাকে বৈদ্যুতিক ছোবলে ছোবলে কেবলই পুনর্নির্মাণ করিতে চাহিতেছে, সুদূরতম অতীতের ওই গহন ইশারাগুলি আমার স্বভাবের অমোঘ আদিমতার, আমার শক্তি ও দুর্বলতার অলঙ্ঘ্য বনিয়াদ৷ চাহিলেই তাহাদের খারিজ করিয়া দিতে পারি না৷ একজন সৃজনশীল মানুষের কায়কারবারে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের ভূমিকাও তাই স্মৃতি-বিস্মৃতি অপেক্ষা কিছু বেশি৷

প্রশ্ন: সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি পুরস্কার নিয়ে একই বিতর্ক আছে৷ এই নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগও সর্বজনবিদিত৷ এ বিষয়ে আপনার মত কী?

জবাব : রাষ্ট্র একটি যন্ত্রমাত্র৷ তাহার চালিকাশক্তি হইল রাজনীতি৷ তাহার বেবাক কর্মতৎপরতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতির অঙ্গুলিহেলন৷ পুরস্কার-ব্যবস্থাপনা সেইসব কারসাজির বাহিরে রহিবে কী করিয়া, সে সাহিত্যই হউক আর যেমন-খুশি-সাজো-ই হউক! অবশ্য সেসব কুকথা আমলেই লওয়া জরুরি মনে করেন না কেহ কেহ৷ রাষ্ট্র বাতকর্ম উপহার দিলেও তাঁহারা আহ্লাদে আটখানা৷ আবার এই নির্মম বা নির্মন সত্যগুলিকে জানিয়াই, কোনো কোনো কবি তবু আলোয়ান কাঁধে পুরস্কারের মঞ্চে উঠেন, আত্মকৌতুকের বশে অত্যন্ত নীরব এক অট্টহাস্য করিতে করিতে৷ তাঁহাদের জীবনেও তো মুদ্রারাক্ষসের কিছু ভূমিকা রহিয়া গিয়াছে!

প্রশ্ন: বাংলা কবিতার কলকাতা-কেন্দ্রিকতার অভিযোগ নিয়ে আপনার অভিমত কী?

জবাব : বিগত শতকের ’৭০ দশকে আর কিছু ঘটুক না-ঘটুক, বাংলার কবিতার কলিকাতা-কেন্দ্রিকতার উপকথাটি জববর জখম হইয়াছে৷ এই সময় হইতেই দেবদাস আচার্য, অরুণ বসু, অরুণেশ ঘোষ, নিত্য মালাকার, জয় গোস্বামী, নির্মল হালদার, শ্যামলকান্তি দাশ, অনুরাধা মহাপাত্র প্রমুখের মতো পুরোধা কবিরা একে একে বাংলার গভীর মফস্সল হইতে কবিতার রঙিন নিশানগুলি উড়াইয়া দিলেন৷ পরে তাঁহাদেরই কেহ কেহ খোদ কলিকাতার ক্ষমতাতন্ত্রটি কবজা করিয়া তাহাকে সম্প্রসারিত করিবার কারবারেও লিপ্ত হইলেন৷ কিন্তু তাহাতে যে নূতন করিয়া কলিকাতার হাতে মফসসলের পরাজয় সূচিত হইল, এমন বলা যায় না৷ প্রতিটি প্রজন্মেই বিভিন্ন জেলা-মহকুমা হইতে শক্তিমান কবিরা আসিয়া বাংলা কবিতাকে আজিও বর্ণময় করিয়া তুলিতেছেন৷
তবে, কলিকাতা একটি ক্ষমতাকেন্দ্র বটে৷ রাজধানী হইবার সুবাদে যাহা আমাদের অনেক মূল্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চায়৷ যেমন, বাংলা কবিতার আলোচনা পশ্চিম বাংলার সীমার ভিতর আটকাইয়া রাখার কুসংস্কৃতি তাহাদের একটি৷ ফিলহাল বাংলাদেশের কবিতার কথা যদি-বা কিছু উঠে, বরাক উপত্যকা বা ত্রিপুরার কবিতা এখনও সেইসব সভা-সেমিনারে সমান অজলচল!

প্রশ্ন: অনেকেই দাবি করেন গত শতাব্দীর সাতের দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায় মৌলিক চিন্তার অভাব৷ আপনি কী বলেন?

জবাব : মৌলিক চিন্তা উপস্থাপনা দার্শনিকদের কাজ৷ তাঁহাদের সাফল্য বা ব্যর্থতার দায় তো কবিদের উপর চাপানো যায় না৷ কথিত সমালোচকেরা যদি বলেন, বিগত শতকের সাতের দশকের পরবর্তী আমলে প্রাদুর্ভূত কবিদের ভিতর মৌলিক কণ্ঠস্বরের নিদারুণ অভাব, তাহা হইলে প্রস্তাবটির একরকম অর্থ বুঝা যায়৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে আবার একজন কবিতাপাঠক হিসাবে আমি প্রস্তাবটির সহিত হারগিজ সহমত হইতে পারি না৷ কারণ, গত ৪০ বছর ধরিয়া হামেশাই নূতন নূতন কবিদের রচনা পড়িয়া চমৎকৃত হইবার সুযোগ ঘটিয়া যায়৷ ইহা বাংলা কবিতার প্রবহমানতার একটি স্বাস্থ্যকর নমুনাও বটে৷ একটি ভাষা পরিধির ভিতর সবসময়ই যে যুগান্তকারী কিছু ঘটিতে থাকিবে, এমন তো নহে৷ আপনারা যে-আমলের উল্লেখ করিয়াছেন, তাহারই বা কতটুকু অংশ আখেরে কালের বিচারে টিকিবে, কে বলিতে পারে!

প্রশ্ন: এতটা পথ পেরিয়ে অনুজ কবিদের প্রতি কোনো বিশেষ পরামর্শ?

জবাব : প্রতিটি সৃজনশীল মানুষেরই সংকটও সাধনার স্বরূপ আলাহিদা৷ তাই একের পরামর্শ অপরের খুব একটা কাজে আসে না৷ তাহার উপর আবার প্রজন্ম হইতে প্রজন্মান্তরে অনুভব-উপলব্ধির ভাষাও বদলাইয়া যায়৷ কাজেই অনুজদের কোনো পরামর্শ দেওয়ার হিম্মত আমার নাই৷ তবে স্বগতোক্তির মতো একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করি৷
ফরাসি বিপ্লবের শুরুতে সিয়েস্ নামের এক ধর্মযাজক খুবই সক্রিয় ছিলেন৷ বিপ্লবের বিপুল নৈরাজ্য এবং ডামাডোলের দিনগুলিতে তিনি উধাও হইয়া যান৷ পরে, নেপোলিয়নের পতনের পর তাঁহাকে আবার দেখা গেলে, সংগতভাবেই এই প্রশ্ণ উঠে যে, তিনি এতদিন কোথায় ছিলেন? তাহাতে তিনি যে উত্তর দেন, তাহা এক ঐতিহাসিক প্রবচন হইয়া আছে৷ তিনি বলেন, ---J’ai ve’cu, আমি প্রাণে বাঁচিয়াছি৷ বিখ্যাত কথাশিল্পী জোসেফ কনরাড (১৮৫৭-১৯২৪) তাঁহার আত্মজীবনীর এক জায়গায় যাজক সিয়েস্-এর এই উক্তির প্রসঙ্গ তুলিয়া নিজের বিষয়ে মন্তব্য করেন--I have existed, obscure amongst the wonders & terrors of my time.

সমসময়ের চমৎকারিত্ব এবং সন্ত্রাসসমূহের ভিতর নামহীনভাবে গা-ঢাকা দিয়া সকল রচনাপ্রয়াসীকেই ওইভাবে দিনের পর দিন টিকিয়া থাকিতে হয়৷

প্রশ্ন: কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা না গদ্য আজকের তরুণতমদের কবিতায় কীসের প্রভাব স্পষ্ট বলে আপনি মনে করেন? 

জবাব : এই প্রশ্নটির কোনো উত্তর আমার কাছে নাই৷ 

প্রশ্ন: পরবর্তী-প্রজন্মের কবিদের কাছে কী আশা করেন? 

জবাব : কবিদের কাছে মানুষ কবিতাই আশা করে৷ অন্তত তাহাই করা উচিত৷ আগামী প্রজন্মের কবিদের হাতে বাংলা কবিতা কোনো নূতন দিগ্দর্শন খুঁজিয়া পাইবে, এমন প্রত্যাশা তাই রাখিতেই পারি৷
তবে কবিতা-অতিরিক্ত বাড়তি কোনো প্রত্যাশা জ্ঞাপনের সুযোগ যদি থাকে, তবে আরও চাহিব যে, সমস্ত ঝাড়ঝাপটার মুখে বাঙালি সমাজে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধটিকে চিরজয়ী রাখিবার জন্য নবীন কবিরা সকলেই যেন আপনাপন সামর্থ্য মোতাবেক কিছু ভূমিকা রাখেন৷ সকলের শুভ হোক৷

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা ২০১৮ সংখ্যা থেকে 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'-এ সাক্ষাতকারটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন