শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ।। ইন্দ্রজিৎ রায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০




ছবিঃ হিরণ মিত্র

ইন্দ্রজিৎ রায় ।। ফালতু ডায়রি , বৈশাখ ,বিশেবিষ 



( পূর্বপ্রকাশিতের পর ) 


ময়লা ফেলার যে জায়গা তাকে সবাই ভ্যাট্ বলে । কদিন ধরে রাত করে শুই , উঠতে পারি না , সকালে ময়লা গাড়ি যখন বাঁশি বাজাচ্ছে আপ্রাণে ,উঠতে পারি না ।বেলার দিকে সব ময়লা নিয়ে ভ্যাটে ফেলতে যাই আর তখন সকলের মতই পূর্ণদাস বাউলের কন্ঠে সেই গান ,ক্যাসেটে শোনা , সেই গান সবার কানে বাজে । কেউ কেউ শুনেও না শোনার ভাণ করে , গুরু আমার মনের ময়লা , যাবে কি করে ... মনে পড়লো গানটা ? আজও পড়লো । রাস্তাটা সুনসান , গতকালই লকডাউন গেছে , আজও তার ঘোর আছে , ভ্যাটের ঠিক সামনে , একটি পাঁচরঙা বড় ছাতার নিচে বসে আছে , একলা লটারি -বালক , সকাল থেকে কেউই আসে নি সম্ভবত , লটারি খেলতে ।বসে আছে ,ছেলেটি , মুখে ভাইরাস মাস্ক , ঘুরে ঘুরে বৃষ্টি হচ্ছে আজ , ময়লা ফেলে রোজই চলে যাই , দ্রুত পায়ে , যেন কোনো এক মুহুর্তে আমার ফেলে যাওয়া সমস্ত ময়লা , উড়ে ফিরে আসবে আমারই হাতে , আধিভৌত বয়া মাঝগঙ্গায় ,হঠাৎ নড়ে ওঠার মত , কিন্তু আজ , তবুও ,থমকে গেলাম । অনেকদিন পর এই পাড়াটার দিকে তাকিয়ে বোঝলাম যে কর্মব্যাস্ত - এই শব্দটির প্রকৃত ব্যঞ্জনাটি কী । নিজেকে ট্যুরিষ্ট মনে হোলো , এই পাড়ায় আছি এতবছর ! এসব কবে হোলো ! কতদিন দেখিইনি তাকিয়ে ! কলোনির পুরাণ যে টিন কাঠের বাড়ি , সেগুলো চলে গিয়ে এই স্বপ্নালু-আলু নব্য বসতি , বেশ লাগলো রঙীন ফ্ল্যাটবাড়িগুলো . ঘাটবাঁধানো পুকুর , যেখানে মা'র অস্থি বিসর্জন দিয়েছিলাম । বাবাকে মিথ্যে বলে , যে বাবুঘাটে গঙ্গায় দিয়েছি । বাড়ির পাশের পুকুরেই রেখে দিয়েছিলাম , যেন কাছেই রইলো , এমনটা ভেবে । ওই আর কি , তো দুবছর আগেও , ঘাট ছিলো না এমন । এখন হয়েছে । অবাক চোখে পাড়া ,পুকুর দেখে , তিনতলায় ওঠা ইস্তক ওই রাস্তা, ময়লার ভ্যাট ও লটারিযোদ্ধার এই ত্রিমাত্রিক আয়না ও সম্পদ । রাস্তা মানেই সম্পদ , নিঃস্ব মানুষের , তার ময়লা , তেলচিটে হাত পা রাখার একমাত্র জায়গা যে সমস্ত ঘরছাড়াদের নিয়ে নেবে ,নিতেই থাকবে বছর বছর , ঋতু ঘুরবে , শুধু ঘুরবে না প্রারব্ধ , বাবা কে নিয়ে , গাড়ি রিজার্ভ করে দেখাতে যাবো আশ্রম , বৃষ্টি হবে ঘুরেফিরে , সাঁঈবাবা শিরদিওয়ালে , স্বপ্নে দেখবে সেই ফেট্টি মাথায় পাগল , বলছে বাড়ি যা বাড়ি যা ,আজ বাস নেই ,বাস বন্ধ , এসব কেন ভাবছি ভ্যাটে ময়লা ফেলতে গিয়ে , লটারিবালকটির মুখ মনে পড়ছে , পয়সাটা বোঝা হোলো না তেমন , আসলে দুটো ব্যপার ছিলো । এক , মা বাচ্চাদের হাতে টাকা দেবার বিরুদ্ধে ছিলেন , আর ক্লাস সেভেনে বাবার ঐ কথাটা , রাজা কখনও পার্স পকেটে নিয়ে বেড়ায় না , বলতেন তোমার কী লাগবে বলো , পারলে এনে দেবো । ব্যাস ।ওই যে , আদি গুরু মাতাপিতা শেষের গুরু বাঁশ - ওই পার্স ছেড়ে গেলো । আজও , কত কত দামী পার্স , আলমারিতে পড়ে । নতুন । আর পদার্থবিদ্যা পড়তে গিয়ে হাতঘড়িটি গেলো । কত হাতঘড়ি পড়ে আছে । এই রাস্তার ওপর এত কিছু । ছেড়ে যাওয়া । পার্স ঘড়ি ক্যালেন্ডার । তবু পয়সা সেই পকেটে নিয়ে ঘুরতেই হোলো । এর থেকে মুক্তি পাইনি । মা যদি ব্যবস্থা করতে পারতো যে বড় হয়েও পয়সা ঘাঁটতে হবে না । যদি করতো । চল্লিশ বছরের জন্মদিনে সেই বাবা দামী একটা পার্স দিলেন , সেই বিস্ময়টা ,সেকি তুমি সত্যিই ...পার্স রাখোনা ? বাবা ভাবতে পারেননি ওই ছোটবেলার কথাটা আমি এত মন দিয়ে শুনবো ।রাস্তার পাগলদের খুব মন দিয়ে দেখি , তাদের উভলিঙ্গতা , কুমিরের চোয়ালের ভেতর চাদর কম্বল প্লাটিক প্যাকেটের , আর্দ্র কলোনি দেখি , মেয়ে পাগলদের সম্ভাব্য অতীতগুলো রাস্তায় ঘষে মসৃণ ,মাঝেমাঝে এই পাড়া শুধু না , এই পুরো বসতটাই , শহরটাও অচেনা লাগে । এটাই হয়তো চেনা অচেনার জাফরি , যার আলো আঁধার তিতিরের পোষা বেড়াল আঁধারমাণিকের মত , বৃষ্টির বাগানে যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় , মাছের লোভ দেখিয়ে যাকে ফেরত আনা যায়না ।ঘন্টা দেড়েক পর বৃষ্টি থামলো । ছাতে উঠি না , অনেকদিন ,রাত করে , আগে রাতে ওপরেই থাকতাম অনেক । ছাতের আলোটা কেটে গেছে আজ অনেকমাস , ওপরে ঈষত আলোকিত আকাশে , নারকেল পাতাগুলো হাওয়ায় মুছিয়ে দিচ্ছে আকাশ । একটু গা টা ছমছম করে উঠলো যেন , শেষে কি ভুতে পেলো আমাকে ।ভুতে পায় কাউকে ।নাকি নিজেকেই খুঁজে পাই , অন্ধকারে , আর বুঝি চটি পরা পা দুইটো জলে ডুবে যাচ্ছে । ছাতে জল জমেছে এত । লকডাউনের নিস্তব্ধতায় কোথায় ব্যাঙ ডাকছে শব্দ আসে । বসে হাতড়ে হাতড় ঝাঁঝরি বসানো ড্রেন খুঁজে পাই । দু চারটে কাঠিকুটো , আর , চুল ।লম্বা , দলাপাকানো চুল । এত চুল ছাতে , কার চুল । ছাতে তো তেমন ...আসেই না কেউ । আঙুলে জড়িয়ে চুলগুলো তুলে দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে মনে পড়ে অত বড় ছাতে আমি একা , রাত , আঙুলে একদলা চুল । ওটা সরিয়ে নেওয়াতে কলকল শব্দে জল ড্রেনে ঢুকছে । মেঘ সরে একছটাক আলোয় জল দৌড়ে যাচ্ছে । পালাচ্ছে । রহস্যের চুল সরিয়ে সরিয়ে । আমি পারছি না । পালাতে । 

(ক্রমশ ) 





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন