শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট/রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে




ছবিঃ হিরণ মিত্র

(গত সংখ্যার পর)


৯. ঘটকবাড়ি


তোমাদের বাড়ির একটা পোশাকি নাম থাকলেও ঘটকবাড়ি বলেই সকলে ডাকে৷ বাড়ির সামনে প্রাচীন কামিনীগাছে এই শেষগ্রীষ্মে থোকা থোকা সাদা ফুল, ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে সাপ আসে৷ বর্ষায় ভেজা গাছের নিচে ঝরে পড়ে থাকে সেই কামিনীফুল৷ দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যায়৷ ফটফটে ছোটো ছোটো অজস্র ফুলের এক আশ্চর্য সৌন্দর্য৷ গন্ধে এক অদ্ভূত মাদকতা৷ আকাশের আলো-অন্ধকার এসে জমে থাকে সেই গলিপথে৷ নির্বিকার সত্যের মতো এক জান্তব বাস্তব এসে ঘিরে ধরে তোমাকে৷
তুমি গা ধুয়ে বারান্দার আলসেতে দাঁড়িয়ে আরেকটা বিকেল পার করো৷ বড়দা হাইকোর্টে৷ ব্যারিস্টারি৷ আরেকজন টালিগঞ্জে সাদাকালো সেলুলয়েডের নায়ক৷ দাদারা সবাই খুবই ব্যস্ত৷ তোমার জন্য কারোর আলাদা করে সময় দেওয়ার নেই৷ পাড়ার পরিচিতদের মধ্যে যে দু-একটি পরিবারের সঙ্গে তোমাদের বাড়ির যোগাযোগ, তার মধ্যে একমাত্র কৃষ্ণেন্দু তোমার কাছে আসে৷ ওই ছোট্ট ছেলেটা কখনও কখনও তোমার সঙ্গে লুডো খেলে৷ সারাদিন একা থাকতে থাকতে তুমি কখন যেন হাঁপিয়ে ওঠো৷ মাঝেমধ্যে তুমি তোমাদের পেল্লাই বাড়ির কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকো৷ চুপচাপ৷ কৃষ্ণেন্দু কিছুই বোঝে না৷ বোঝে না কামিনীফুলের গন্ধে কেন সাপ আসে! কেন অনেক রাতে তোমাদের প্রকাণ্ড ছাদে কেউ পায়চারি করে! এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে! শুধু কুয়াশার মতো স্মৃতির আস্তরণ চারিদিকে৷
তোমাদের বাড়ির একটা পোশাকি নাম যেমন হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে তোমাদের বাড়ির গোলাপায়রার দল, তেমনি কখন যেন হারিয়ে গেছ তুমি, শতরূপা, তিন ভাইবোনের সবার ছোটো৷ কৃষ্ণেন্দু বোঝে না৷ সকলের ছোটো তুমি তাই তোমাকে ছোটকুপিসি ডাকে ও৷ গাছের তলায় এই শেষগ্রীষ্মে থোকা থোকা সাদা কামিনী পড়ে থাকে৷ কেউ কুড়োয় না৷ দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যায়৷


১০. ঝিমলি এখন


একটা ল্যাম্পোস্ট, তীব্র আলো ঝরানো হ্যালোজেন আর ঘন হয়ে আসা নীরবতার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠে এই চুইংগাম-সভ্যতা৷ দুজনের মধ্যেকার একান্ত সম্পর্ক কখন যেন শূন্যতায় ভরে গেছে৷ এখন শুধু ভিড়ের মাঝে দূর থেকে হঠাৎ ভুল করে চোখে চোখ৷ মুহূর্তে হারিয়ে যায় সহজ সাবলীলতা৷ রক্তশূন্য হয়ে যায় ঠোঁট৷ কতোবার ডায়াল করেও কেটে দেওয়া নাম্বার৷ নরম শরীরে ঘন হয়ে জমে ওঠে ছত্রাক আর শ্যাওলার মেঘ৷ সময়ের গোপন অঙ্কুরে তুমি জল দাও৷ আলো দাও৷ তোমাকে ঘিরে রাখে কিছু লোভীচোখ আর হিংস্র কিছু জিভ৷ তুমি আরও একা হয়ে যাচ্ছো আত্মীয়বলয় ভিড়ে৷ তোমার শরীরে ছায়া নেই৷ বৃষ্টি নেই৷ কখন ছেড়ে চলে গেছে প্রিয় ফুল আর প্রজাপতির দল৷ সংস্কারের কঠিন চশমা এসে ঢেকে দ্যায় তোমার কাজলকালো প্রেম-প্রেম দুইচোখ৷
এই দৃশ্যে ঝিমলি একা৷ ক্যুরিঅর-সার্ভিস এসে ফেলে দিয়ে যায় অতীত আবেগের ধারাপাত৷ ধূধূ শূন্যতার বালি এসে ঝরে যায় হৃদয়গভীরে৷ ঝিমলির শরীরের রিড ছুঁয়ে বেজে ওঠে বিচ্ছিন্ন বিষাদের সুর৷ ক্রমশ একা হয়ে যেতে যেতে প্রতিহিংসার ক্ষুব্ধ আগুনে পোড়ে ওর মাথা, বুক৷
অথচ ঝিমলি আজও গান শোনে রোজ৷ গান গায়৷ স্নান সারে৷ উপোসী শরীর ছুটে যায় প্রতিযোগিতার নকল-স্বয়ম্বরে৷ ফাঁকা ছাদে টুপটুপ ঝরে পড়ে হিম৷ চতুর্দিক ছেয়ে যায় বাঁধভাঙা আবেগের ঘন কুয়াশায়৷ ভুতুড়ে ছায়াশরীরের মতো জেগে থাকে লম্বা লম্বা বাড়ি আর নিষ্ঠুর ল্যাম্পোস্ট৷ উজ্জ্বল জোনাকির আলোয় সবুজ গ্রহের বুকে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে স্বপ্নবিশ্বাস৷ তার বুক ছুঁয়ে যায় ঢেউ৷ অশ্রুঢেউ৷

অথচ ঘুম ভেঙে গিয়েছে কখন! চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির৷নরম রোদ ছড়িয়ে আছে সোনালি রঙের আভায়৷ নিশ্চিন্ত শুয়েছিলে তুমি গতরাতে! তুমি নিশ্চিত! জানো না৷ কারা যেন সবকিছু ভুলে আমোদে জড়িয়ে পড়েছে--- জড়িয়ে পড়েছে উৎসবে৷ উৎসব! এতো শব্দ চারিদিকে এতো চিৎকার! কিসের খেলায় যেন সবাই মেতেছে---৷বানভাসি চারিদিক৷ দিকে দিকে আমি তুমি আর তুমি আমি৷অন্যদেশ থেকে ভেসে আসা মৃতদেহের স্তূপ আর শরনার্থীর দল৷তুমি আশ্রয় দেবে কি দেবে না তা নিয়ে নিদান দিচ্ছো৷অথচ নিজের বাড়ির গণ্ডিতেও তুমি কি নিরাপদ! তুমি নিশ্চিত! জানো না৷ক্রমশ অসহিষ্ণু চারিদিক, এতো ঈর্ষা এতো সন্দেহ! অন্যের মশাল আজ তোমাকে পোড়াচ্ছে৷ তোমার মশাল কাল অন্যকে ---? তুমি জানো না৷ঘুম ভেঙে গিয়েছে কখন! চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির৷ নরম রোদ৷ আলো৷ নিশ্ছিদ্র আশ্রয়৷আজ উৎসব৷ আজ আনন্দের দিন৷


১১. নিয়ন্ত্রণরেখা: নভেম্বর, ১৯৯১


প্রথমদিন সোমদত্তা গাঢ় গেরুয়া রঙের কামিজ ও কালো জিন্স পরে দ্যাখা করেছিলো৷ তারপর এই ক’বছরে ও প্যাণ্ট বা শালোয়ার ছেড়ে নিয়মিত শাড়ি পরা শুরু করেছে৷ বিভিন্ন রঙের শাড়ি৷ এখন ভুলেও প্যাণ্ট বা শালোয়ার পরে আসে না৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই ক’বছরে ও যে কতো রকম শাড়ি পরেছে তা কৃষ্ণেন্দুর মনে থাকে না৷ 
একদম প্রথম, সেদিন, কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে ও রেস্টুরেণ্টে বসলো--- ‘ইউটোপিয়া, বার কাম রেস্টুরেণ্ট’--- মুখোমুখি৷ একহাত দূরে৷ দুজনে ঘাড়নিচু অনর্গল কথা৷ মাঝে মাঝে সোমদত্তার ঘনশ্বাস অফ্ হোয়াইট টেবিলের উপর পেতে রাখা কৃষ্ণেন্দুর দু’হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো৷ কৃষ্ণেন্দু নিজের হাত সরিয়ে নিতে চাইছিল না৷ একটা কেমন শিহরণ, ভালো-লাগা, উন্মাদনা৷ সোমদত্তার দু’হাত নিজের কোলে৷ টেবিলের উপর ধূমায়িত কফির কাপদুটো তাপ পরিত্যাগে ক্রমশ ঠাণ্ডা৷ 


---জানো, আজ সকালে মায়ের সঙ্গে খুব তর্ক করেছি৷ জয়া মিত্র নাকি তার বইয়ে বানিয়ে বানিয়ে সব কল্পকাহিনি লিখেছেন৷ মায়ের অফিসের রতনকাকু মাকে এসব বলেছে৷ আমি মা-কে বললাম, তুমি আগে নিজে বইটা পড়ো, তারপর বোলো৷ সত্তরের দিনগুলোকে তোমরা অস্বীকার করতে পারো?
হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি৷ ভার্টিকাল কালো সরু স্ট্রাইপ৷ সম্ভবত তাঁত৷ কবজি পর্যন্ত চাপা কালো রঙের ব্লাউজ৷ একটু উঁচু করে পেছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধা চুল৷ হর্সটেল! অতি সূক্ষ্ম হালকা প্রসাধন আজ সোমদত্তায়৷ গালে ছিটেফোঁটা ব্লাশারের ছোঁয়া৷ সরু লাল ঠোঁটে লিপগ্লস৷ আঁখিপ্রান্তে কাজল৷ চোখদুটো আরও বেশি ব্যক্তিত্বময় আজ৷ কৃষ্ণেন্দু চুপ করে বসে ওর কথা শুনছিলো আর নিবিষ্ট চোখে তাকিয়েছিলো ওর নরম সরু ওষ্ঠদ্বয়ের প্রতি৷
---কি হলো, চুপ করে বসে আছো যে! কফি খাও৷ দ্যাখো কৃষ্ণেন্দু, একটা কথা আমি তোমাকে বলতে চাই যে, আজ যা ঘটছে, বিশেষত রাশিয়ায় যা ঘটলো, তার কি ব্যাখ্যা আছে তোমার কাছে? মানুষকে যে আফিম খাইয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায় না আবার তা প্রমাণিত হলো৷ রেড-আর্মি গিয়ে দিকে দিকে কমিউনিস্ট শাসন চাপিয়ে দিলো আর কমিউনিস্ট দুনিয়া তৈরি হয়ে গ্যালো? হোঃ---
---কিন্তু এ কথাটা তো তুমি নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারো না সোমদত্তা যে মার্ক্স নিজেই বলেছেন যদি ঠিকঠাক ধনতন্ত্রের কামড় চেপে না বসে তবে কখনই সাম্য আসবে না৷
সোমদত্তা এবার বিরক্ত৷ উস্খুস করছে৷ বাঁ হাত তুলে ঘাড়ের পাশটা একটু চুলকুলো৷ মরালগ্রীবা সোমদত্তার শরীরের হাঁস-হাঁস এই জায়গাটা কৃষ্ণেন্দুর সবচেয়ে ফেবারিট৷
---সুতরাং সোমদত্তা, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঘটনা সারা পৃথিবীতে ঘটছে তা সবই মার্ক্স নির্ধারিত পথে ঘটছে বলেই আমার বিশ্বাস৷ যদি আগামী দশ বছরের মধ্যে আমার রাজ্যে, এই পশ্চিমবঙ্গেই রাজপথের উপর লালপতাকা পুড়িয়ে ফেলা হয় তবে আমি অবাক হবো না৷ কারণ কমিউনিজমের বিকৃতি আমার সহ্য হবে না৷
---তাহলে আজ যারা লেনিন ভাঙছে, মার্ক্স ভাঙছে, তাদের তুমি কমিউনিস্ট বলবে কৃষ্ণেন্দু?
---দ্যাখো সোম, কৃষ্ণেন্দু আচমকাই একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাইলো সোমদত্তার সঙ্গে, এই একটা জায়গায় তো আমরা সবাই চাই যে সমস্ত মানুষ সমানভাবে খেয়ে-পরে বাঁচুক৷ কমিউনিজম তার একটা ওয়ে মাত্র৷ নির্দিষ্ট কোনও পলিটিক্যাল পার্টির প্রতি কমিটেড না থেকে যদি একথা মানা যায় তবে তো আমরা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিযে, যে দেশগুলিতে এইসব ঘটনা ঘটছে, সেইসব দেশের শাসক কমিউনিস্ট পার্টিগুলি তাদের কমিউনিস্ট অ্যাটিটিউড বজায় রাখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু নেতা কিছু শোষকের হাতের শোষণযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে৷ সুতরাং সেখানকার শোষিত সাধারণ মানুষজনের কাছে কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্বটাই শোষকের অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে৷ তাই সাধারণ মানুষ কমিউনিস্ট দুনিয়াকে ভেঙে ফেলছে, লেনিন ভাঙছে, মার্ক্স ভাঙছে, পার্টির নাম বদলে দিচ্ছে...
প্রায় কোনও পজ ছাড়াই একটানা মন্ত্রোচ্চারণের মতো কৃষ্ণেন্দু মুখস্থ বলে যায়৷
---এটাকেও কি তুমি কমিউনিস্ট মুভমেণ্ট বলবে?
বড্ড বেশি যেন আগ্রহী সোমদত্তা এ সময়৷ টেবিলের উপর দু’হাতের কনুইয়ের ভর দিয়ে সরাসরি কৃষ্ণেন্দুর চোখে চোখ রাখে৷ এই দৃষ্টি কৃষ্ণেন্দু সহ্য করতে পারে না৷ থার্ড ইয়ারের হার্ট থ্রোব এজিএস সোমদত্তা সেনগুপ্ত৷ কৃষ্ণেন্দু ক্রমশ নার্ভাস হয়ে যায়৷
---অফকোর্স... কৃষ্ণেন্দুর কথা জড়িয়ে যায়৷ কিন্তু এ নিয়ে ডিবেট হতে পারে যে তাদের মুভমেণ্টের স্টাইল আদৌ কমিউনিস্ট কি না!
---এ কথাটাই তো আমি মা-কে বোঝাতে চাই৷ 
সোমদত্তা এখন আপাত গম্ভীর৷ দৃঢ় প্রত্যয় থেকে কিছু বলতে চায়৷ 
---বলি যে সেভেনটিজের ছেলে-মেয়েরা অনেক ভালো কাজের পাশাপাশি অনেক ভুলও করেছে৷ যার খেসারত আজও আমাদের, কমিউনিস্ট দলগুলোকে দিতে হচ্ছে৷ তা-না, মা বলবে, বিপ্লবের সময়ই হয়নি এখনও...

সেদিন দুপুরের গরমটা অসহ্য হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ৷ প্যাচপেচে গরমে এই দুপুরে আবার ভিড়বাসে চড়তে হবে! গোলপার্ক থেকে শ্যামবাজার৷ লাল দোতলা এল নাইনে চড়ে ছুট৷ পেছনের দরজায় ফুটবোর্ডে কন্ডাকটার যেখানে দাঁড়ান, তার পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চেপে ড্রাইভারের মাথার ওপর গিয়ে বসলেই হলো৷ চলন্ত সিনেমাস্কোপ৷ এক অদ্ভূত মুহূর্তের জন্ম৷ হুহু করে দুপাশে ছুটে যাচ্ছে শহর, শহরের গাছগুলি, পাখিদের বিষ্ঠামাখা সাদা ছোপ ছোপ পত্রপল্লব৷ স্টপে বাস দাঁড়ালে জানালার পাশের ডালে বসে নিবিষ্ট মনে ঠোঁট দিয়ে পিঠ চুলকানো কাক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিকের হেলমেটে শুকিয়ে যাওয়া কাকটির অ্যা, সামনের চওড়া স্ক্রিনে রাজপথ পেরিয়ে ঘোলাটে আকাশ, নাগরিক দৈনন্দিনতার মাঝে একটুকরো রিলিফের কাজ করবেই৷
খানিকক্ষণ আগে ‘ইউটোপিয়া’-র আলো-আঁধারির নিশ্ছিদ্র মগ্নতার ভেতর সোমদত্তা কৃষ্ণেন্দুর মুখের ওপর ‘নো’ বলে দিয়ে চলে গেছে৷ সোমদত্তার যাবতীয় তাত্ত্বিক স্পর্শের ভেতরে কৃষ্ণেন্দু তখন প্রাণপণ চেষ্টায় গুঁজে দিতে চাইছিলো ব্যক্তিগত ইচ্ছেকুসুম, প্রেমপ্রস্তাব৷ এখন কৃষ্ণেন্দু একা টেবিলে সোমদত্তার আধখাওয়া কাটলেট-প্লেটের দিকে তাকিয়ে বসে আছে৷ দীর্ঘ এক মাসের ক্রমাগত প্রচেষ্টার পর আজ সোমদত্তার হঠাৎই হতাশ-প্রস্থান৷ সোমদত্তার বাতলে দেওয়া পথে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি সম্ভব কি না এ প্রশ্নে দ্বিধান্বিত হওয়ার বদলে ওর ঈষৎ ঝুলে থাকা দীঘল দুটি স্তন, একফালি সরু ঠোঁট ও উজ্জ্বল গমরঙা শরীরই যে কৃষ্ণেন্দুর একান্ত আকাঙ্ক্ষিত, এই সহজ সত্যটা বোঝামাত্র মাসাধিক কালের এই সম্পর্কটাকে আচমকাই খুন করে সোমদত্তা, কৃষ্ণেন্দুর সোম, চলে গ্যালো৷ 
কৃষ্ণেন্দু বুঝতে পারছে না এখন কী করবে! ওর মনের ভেতর অন্ধকারে ফ্রয়েডের সেই লিবিডো ক্রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ক্রমশ ফনা মেলে ধরছে! সোমদত্তার ফেলে রাখা আধ-খাওয়া কাটলেটটা খাবে না এল নাইন ধরে পালাবে তা ঠিক করে উঠতে না পেরে কৃষ্ণেন্দু একটা সিগারেট জ্বালায়৷ লুকনো সিঁড়ির খোঁজে কৃষ্ণেন্দু আরও একবার লেজ সোজা করে টেরোড্যাকটিলের ভঙ্গিতে মেলে দ্যায় দুই ডানা৷ 


১২. আদমসুমারী


পল্টনবাজার থেকে কেনা একটা অনন্য রুমাল আর জরিবোনা মেখলা তোমার মনখারাপকে আরো একটু উস্কে দিলে শৈলশহরের রাস্তায় রাস্তায় রুটের মিনিবাস গড়িয়ে যায়৷ যেভাবে গড়িয়ে যায় জাতীয় মিউজিয়ম সারস্বত বাঙালি সমাজ আর বিহুর প্রশস্ত প্যাণ্ডেল৷
বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে থাকো তুমি৷ দু-দিক দিয়ে হুহু করে ছুটে যাওয়া বাতাসের সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে কৈশোরের কোনো একটা দুপুর, রেলকলোনির মাঠ, মায়েদের আঙুলে জড়ানো উলকাঁটা, কলাবেণী আড়চোখ, আর তোমাদের হাফপ্যাডেল, একই গলিতে বারবার চক্কর, চেন পড়ে যাওয়া, সরস্বতীপুজোর আগে ভুল করে খেয়ে ফেলা নারকেলকুল, বাড়িতে ঢোকার আগে ফুলপ্যান্ট থেকে লুকিয়ে চোরকাঁটা ছাড়ানো৷
যেন কুয়াশায় মোড়া একটি অমোঘ শীতকাল রাস্তায় পড়ে থাকা খালি সিগারেট-প্যাকেটের মতো উদাসীনতায় সন্তের মতো বিষণ্ণপ্রায়৷ এখনও এই অপ্রবাসে ঝোড়ো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে শৈলশহর জুড়ে তাড়া করে ফেরে একটি শীতকাল৷ সামনে দিয়ে গড়িয়ে যায় কুয়াশায় ভেজা চেনা মুখ৷ গাছের আদল৷ তুমি কেতাবি আগ্রহে শুধু টুকে রাখতে চেয়েছিলে একটি দশনম্বরের রচনা লেখার টীকা ও সংকেত৷ সুুঠাম গোয়ালপারিয়ার সুুর শুধু ভেসে থাকে বাতাসে৷ তারযন্ত্র আর তালবাদ্যে তখন ঈশানকোণ মাতোয়ারা৷ মানুষের আগ্রহে শুধু মোবাইল ফোনযন্ত্রটি রেকর্ড করে রাখে দুর্লভ দুপুরটুকু, পৃথিবীর ইতিহাস৷
দুকুল ছাপানো বহ্মপুত্র, এদিক ওদিক সাদাবালি, ছড়ানো ছিটানো প্রশস্ত চর, সূর্যালোকে চিকচিক করছে৷ দূরে দূরে বোট, নৌকো--- চড়া রোদেই ঝিরিঝির বৃষ্টি৷ এদিকে-ওদিকে ছোটো ছোটো দ্বীপ ভটভটি ভর্তি ট্যুরিস্ট, পুণ্যার্থী৷ আর টপাটপ ডিজিটাল ছবি৷ পাথর বাঁধানো সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেছে কবিতার মতো দিন৷ দ্বীপের ওপরে মহাকাল, আদিপিতার আশ্রম৷
ঝোড়ো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে শৈলশহর জুড়ে তাড়া করে ফেরে তোমার মুখ৷ কামাখ্যাপাহাড়ের পিচমোড়ানো পাকদণ্ডী দিয়ে গড়িয়ে নামছে এই ত্রিচক্রযান, দ্রত, নিম্ন-অভিমুখী৷ স্টার্ট বন্ধ৷ দূষণ কমবে কি? জানা নেই৷ হাতে হাতে ঘুরছে ক্যান--- চিল্ড ফস্টার৷ পড়ন্ত বিকেলে দূরগামী একটি তারা ফিরে যাচ্ছে সেই কবিসম্মেলনে৷ উত্তরপূর্ব আকাশের ভারি ছায়া তখন প্রলম্বিত শৈলশহরের ছোটো ছোটো কাঠের বাড়িগুলোর ছাদে৷ 
অবতরণের পথে কোথাও থেমে যাচ্ছে স্টার্টবন্ধ সেই ত্রিচক্রযান৷ পাহাড়ি বুনো ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিলে অবিরাম কামনার ইচ্ছেরা দমবন্ধ ফিরে যায় সারিসারি সাজানো চেয়ারে কবিদের ঘরে৷ তখন মৃদুস্বরে কবিতা-উচ্চারণ৷ মুগ্ধচোখ অন্যমনে৷ আর পরিযায়ী কবির দল এক ঠিকানা থেকে মুহূর্তে ছুটে যায় অন্য ঠিকানায়৷ তোমার মুখ ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসে৷ আর মোবাইলে ফেসবুক...নতুন তোলা ছবিকে তুমি লাইক করলে কিনা ভাবতে ভাবতেই জেগে ওঠে গেস্টহাউস, মধ্যরাত্রির ঐকতান৷
অথচ অসম নয়, সেই ছোটোবেলায় শেখা আসাম৷ পাহাড়ি আসাম৷ সবুজ পাহাড়ে ঘেরা আর সাদা ব্রহ্মপুত্রের রোদঝিলমিল বেলাভূমি৷ তার ককবরক বরাক উপত্যকা৷ যার বর্ণমালা বাংলারই মতো, যেন সহোদর দুই, তফাৎ শুধু কয়েকটি বর্ণে৷ ‘ব’ আর ‘পেটকাটা ব’, যা নাকি আসামে ‘র’৷
ডিব্রুগড় থেকে আসতো শুভ্রশঙ্কর রায়চৌধুরী... লম্বা-ছিপছিপে... বিকেল বিকেল কৃষ্ণেন্দু সাইকেল নিয়ে রেলকলোনির মাঠ... শীতের বিকেলে ক্রিকেটব্যাট হাতে হোয়াইট ইলেভেন ক্লাব বনাম মালিগাঁও... ‘ব’ আর ‘পেটকাটা ব’-এর দুরন্ত লড়াই...৷ আর একটা কাটাঘুড়ি শুধু উড়ে ষেত তিনসুকিয়া, বঙ্গাইগাঁও, গৌহাটি থেকে... সুদূর ‘মিনির দেশ’ থেকে... প্রতিমা বড়ুয়া... ইন্দিরা রায়সম গোস্বামী... গোয়ালপারীয়া... ভূপেন হাজারিকা...৷ 
অথচ সেই কবে থেকে চলে আসছে ‘বংগাল খ্যাদাও... বংগাল খ্যাদাও...’৷ আবহমানের কুয়াশামাখানো অন্ধ আক্রোশ৷ নামগোত্রহীন শুধু নয়৷ উৎখাত করে দাও জমিজিরেত-চোদ্দোপুরুষের ভিটে থেকে৷ অপ্রবাসে প্রবাসী ...৷ আজ প্রকট ‘ব’-কে তাড়িয়ে ‘পেটকাটা ব’-এর এ কোন্ লড়াই! শুধু লড়াই নয়, যেন দামামা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে গৃহযুদ্ধের৷
অনির্দিষ্টের দিকে গড়িয়ে যাওয়া কাটাঘুড়ির মতো নিজভূমে পরবাসী ডিলিট করে নাম, পদবী, কনট্যাক্ট নাম্বার৷ কান্না চেপে মুখবন্ধ পেরিয়ে চলে যায় অস্থির সময়৷ পেরিয়ে যায় খুনীর হাতের ছাপ লেগে থাকা শরনার্থীশিবির৷ পেরিয়ে যায় লুইতপার ব্রহ্মপুত্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বঙ্গ সম্মেলন৷ পেরিয়ে যায় রেলশহর মালিগাঁও আর তার হিমকুয়াশায় ঢাকা অলীক রেলকলোনি৷ পেরিয়ে যায় সরকারি তালিকার অপমানজনক অন্ধকার...
(এরপর আগামী সংখ্যায়)

1 টি মন্তব্য: