শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট/রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০




রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে



(গত সংখ্যার পর)

৫. ঝিমলিদি, মনা, মনার ঠাকুমা আর মুণ্ডমালিনী

এই শ্যাওলা-ধরা বারান্দার অনেকটা জুড়ে রান্নাঘর৷ দেওয়ালের এক ধারে ইট দিয়ে বাঁধানো দুটো পেল্লাই উনুন৷ হাত দিয়ে কয়লা ভাঙার দিন শেষ৷ উঠোনের কোনে কয়লা ভাঙার ঘরে এখন বস্তা ভর্তি কোক কয়লা আর ঘুঁটের জঙ্গল৷ কালো কালো ডিমের মতো কয়লা৷ জলে ভিজে গেলে বড়ি শুকনোর মতো মনার ঠাকুমা আঙিনায় চটের রোদে মেলে দিত সেইসব ডিম৷ কালো কালো ডিম৷ মনা আর তার ভাই নামতার সুরে ঠাকুমাকে রাগাতো---আঙিনায় কানাই বলাই/রাশি করে সরিষা কলাই৷ বালক-বালিকার সদ্যশেখা সহজ পাঠ মনার ঠাকুমাকে খেপিয়ে তুলতো৷ কাক খেদানোর ভঙ্গিতে ঠাকুমা গাছের ডাল হাতে ছুটে যেত ওদের তাড়া করে৷ বোধিকল্পদ্রুমের উঁচু ডাল থেকে যুবতী কাক চেঁচিয়ে উঠতো, কা---কা! বালক তখন চক দিয়ে খড়িওঠা মেঝেতে ছবি আঁকে খড়্গহস্তী মুণ্ডমালিনীর৷
জেলা স্কুলে যাবার সময় প্রতিদিন পায়ে পায়ে নেতাজী মোড়৷  ওই যে ঘটকবাড়ি, মজুমদার প্রেস, সারিসারি সার, কীটনাশক আর কাগজের দোকান, সাধনা ঔষধালয় ঢাকা, আশুবাবুর সরাফা, বোমকাকু-রামকাকুদের কুমোরটুলি, এইচ আহমেদের লটারি সেণ্টার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারি, নগদ এক লক্ষ টাকা প্রথম পুরস্কার, ফোয়ারা মোড়৷
জেলা স্কুলে যাবার সময় প্রতিদিন পায়ে পায়ে নেতাজী মোড়৷ বুক ডিপো, বুক হাউস, পেপার সিন্ডিকেট, নিউ কাগজ কালি...৷ অসময়ের ফলাহারী কালিকামূর্তির গায়ে মাটির প্রলেপ বোমকাকুর, খাকি স্কুলব্যাগ কাঁধে বালক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে--- চারহাতে চারটি অভিব্যক্তি করালবদনী মাতৃকার! বাড়ি ফিরে সেই খড়্গহস্তী মুণ্ডমালিনীর ছবি আঁকে কৃষ্ণেন্দু৷ প্রতিদিন নিয়ম করে৷ একদিন সেরকমই জেলা স্কুলে যাবার সময় পায়ে পায়ে নেতাজী মোড়৷ বন্ধুর সঙ্গে কৃষ্ণেন্দু৷ লোহার রেলিঙে ঘেরা নেতাজী মূর্তির সামনে কী ভিড় কী ভিড়! দুই জোড়া বালক পা সহসা থমকে দাঁড়ায় একে অন্যের হাত ধরে বালক দু-জন ভিড়ের ফাঁকে তাকায়, শ্বেতশুভ্র আবক্ষ নেতাজি মূর্তিটির কর্তিত মাথা দেখে সমস্ত শরীর জুড়ে একটা ঠান্ডা ভয় বয়ে যায়--- বালকের চোখের সামনে দুলতে থাকে করালবদনীর রক্তপিপাসু সেই ভয়ঙ্কর খড়্গ! সেই ভিড় থেকে হিসহিস স্বরে অনুচ্চকিত দুটি শব্দ শোনা যায়, নকশাল! নকশাল!

মায়ের কাছে জানতে চাইলে, প্রশ্ন করলে, মা ভীত চোখে বালকের মুখ চাপা দেয়৷ কয়েকদিনের জন্য কৃষ্ণেন্দুর একা একা বাড়ির বাইরে বেরনো বন্ধ৷ এমনকী বন্ধুর সঙ্গে স্কুলেও নয়৷ তার কানের ভেতর অনবরত বাজতে থাকে সেই ভিড়ের গুঞ্জন৷ এর আগে দিদির ইতিহাস বইয়ে কনিষ্কের ছবি সে দেখেছে, মুণ্ডবিহীন কনিষ্কের সেই ছবি৷ অথচ আজ প্রতিদিনের চেনা এই নেতাজী মূর্তি কর্তিত মাথায় কী ভয়ঙ্কর! এক অচেনা ভয় এসে গ্রাস করে তাকে৷ সে কোনও কাজে মন বসাতে পারে না৷  কৃষ্ণেন্দুর কানের ভেতর অনবরত বাজতে থাকে সেদিনের সেই ভিড়ের সেই গুঞ্জন৷ হিসহিস স্বরে অনুচ্চকিত দুটি শব্দ শুধু শোনা যায়, নকশাল! নকশাল!


মনাদের বাড়ি আর বালকের বাড়ি পাশাপাশি হলেও মধ্যিখানে এক প্রলম্বিত উদ্যান৷ মনাদের৷ কাঁটাঝোপ, গুল্মলতা, কচুবন, চোরকাঁটা পেরিয়ে৷ খিড়কি দিয়ে আরেক বাড়ির খিড়কি জোড়া৷ সেপথে সচরাচর কেউ যায় না৷ কিছু ধসে যাওয়া পতিত ঘর মনাদের৷ সেখানে সাপ-গিরগিটি-তক্ষক৷ যেন সোরা ও গন্ধকে মোড়া এক হিমযুগ৷ এক তীব্র মনখারাপ৷ কিছু ঘুঘু আর হাঁড়িচাচা৷ অচেনা অর্কিড৷
প্রায় হিংসুটে দৈত্যের বাগান বলা যায় এই মনাদের বাগানকে৷ অথবা বলা যায় মহাকাব্যিক আলোছায়াময় তপোবন৷ মহাকালদ্রুমের মতো মস্তো এক নিমগাছ মাঝখানে৷ গাছের উপরে তাকালে তার ডালে ডালে অনেক পাখির বাসা আর যত্নের খড়কুটো৷ আর এই প্রকান্ড গাছটির ঠিক নিচেই মনাদের রান্নাবাটি৷ ধুলো পাথরকুচি আর ঘাসের বাতায়ন৷ ন্যাকড়ার পুতুলের ঘরসংসার৷ 
দূরে দূরে সুপুরি, বেল, কাঁঠাল, পেয়ারা, আতাগাছ, কচু, সবেদা, সন্ধ্যামণি...৷ দক্ষিণ কোণের ঘরে টাইপরাইটার, সাইক্লোস্টাইল৷ পিটিআই রিপোর্টার সুধীর জ্যেঠু আর তাঁর একান্ত ডার্করুম৷ ছোটো একফালি বারান্দা-ঘেরা একখানি ঘর৷ ঘরের জানালার বাইরে নানা ধরনের ডাকটিকিট আর ফেলে দেওয়া কাগজের রাশি৷ ডাকটিকিটের লোভে একটি বালক, কৃষ্ণেন্দু, মনার ভাইয়ের হাত ধরে ভয়ে ভয়ে খাম থেকে ডাকটিকিট ছিঁড়ে নিজের খাতায় সাঁটে৷ ওদিকে অনেকগুলি বাথরুম৷ লম্বা লম্বা কলাবতী গাছ৷ ফলসা আর করমচা৷ মনাদের খরগোশের পিছু নিয়ে একদিন বালকটি গুটি গুটি পায়ে ভর সন্ধ্যায় সেইদিকে৷ বাড়িতে বাড়িতে তখন সন্ধ্যাকালীন শাঁখ বাজছে৷
---‘এই তুই শিব হবি? আমি মা কালী...!’ 
মনার সেই সম্পর্কিত দিদি, ঝিমলিদি সন্ধ্যার গোধূলি আলোয় খুলে ফেলেছে তার ফ্রক৷ নগ্ন ফরসাবুকে দুটি গোলাপি গম্বুজ৷ অনতিউচ্চ, ঘামে ভেজা৷ 
---‘কিরে? ভয় কিসের? এদিকে আয়---৷ মা কালীকে কি শিববাবা ভয় পায়? দেখিসনি!’ ঝিমলিদির চোখমুখ আরও ভয়ঙ্কর৷ কেমন যেন নিশিতে পাওয়া৷
ভয়ে বালক একছুটে সেখান থেকে পালিয়ে যায়৷ পাগলের মতো দৌড়তে শুরু করে৷ ঘাস, চোরকাঁটা, পাথরকুচি পেরিয়ে দৌড় দৌড়৷ সেদিন রাতে প্রবল জ্বরের মধ্যে বালক স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল মুণ্ডমালিনীর সেই ভয়ঙ্কর মুখ৷ শুনতে পেয়েছিল রক্ত জল করে দেওয়া সেই কাতর আবেদন, ‘কি রে, তুই শিব হবি? আমি মা কালী!’


বিয়ের রাতে ঝিমলিদি খুব সুন্দর সেজেছিল৷ মায়ের কোলে কৃষ্ণেন্দু জেগে বসেছিল বরকে দেখবে বলে৷ অথচ গভীর রাতে আসরে যখন বর এল তখন ও ঘুমে কাদা৷

এরপর থেকে মনাদের বাগান কেমন যেন শুকিয়ে যেতে লাগল৷ ঝিমলিদির বিয়ের পর পাখিরাও এখন আর সুর করে ডাকে না৷ বোধিকল্পদ্রুমের উঁচু ডাল থেকে যুবতী কাক আর ‘কা---কা!’ করে চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে না৷ মনার ঠাকুমাও আগের মতো আর কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকে না৷ মনাদের পুতুলের বিয়ে, রান্নাবাটির সংসার, এক্কা-দোক্কা আগের মতোই নিয়মিত চললেও কাউকেই, এমনকী মা-কেও বালকের কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি, 
---ঝিমলিদির বরকে দেখতে কেমন? শিববাবা? 


কাকিমা, মানে মনার মা একদিন বিকেলে হসপিটালের ডিউটি থেকে আর ফিরলো না৷ মনা আর তার ভাই কেঁদে কেঁদে সারা৷ পাড়ার মাতব্বরদের মিটিং৷ গোলটেবিল৷ বালকও শুনলো অমিতাভ বচ্চনের মতো কানঢাকা চুলের পাড়ার বাবলুকাকুর কথা৷ মনার মায়ের পাশাপাশি বাবলুকাকুকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ মনার বাবা বিকেল থেকে চুপ৷ কোনও কথাই যেন কোথাও নেই৷ ছিল না৷ হঠাৎই, মাতব্বরদের সেই উচ্চকিত মিটিং-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনার ঠাকুমা সবাইকে চলে যেতে বললো৷ অনেকদিন পর বালক স্পষ্টতই ঠাকুমার হাতে সেই কাক খেদানো গাছের ডাল যেন দেখতে পেল৷ যুবতী কাক, শশব্যস্ত, ডেকে উঠলো, কা---কা!


৬. একটা ল্যাম্পোস্ট, তীব্র আলো ঝরানো হ্যালোজেন আর একটা রোগা গলি 

সারারাত বৃষ্টি৷  শনশন্ হাওয়া আর ঝিপঝিপ্ ঝমঝম্৷ এই রোগাগলির দুই ধার ধরে জলের ধারা৷ খলবল খলবল৷ দ্রুতগতিতে উল্টোদিকে ছুটছে৷ ছোটো ছোটো ঢেউ৷
অথচ সমস্ত সকাল জুড়ে কেমন মনখারাপ৷ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নরম এক আলো আর ভেজা ভেজা আঁশটে গন্ধ৷ সকালে বৃষ্টি নেই কোনো৷ পাখির ভাঙা ডিম, ভাঙা বাসা আর ইতঃস্তত গাছের ভাঙা ডাল ছড়িয়ে রাস্তায়৷ ভেজা, বিপর্যস্ত কাক জানলার কার্নিশে চঞ্চু ঘষে নিজেকে প্রস্তুত করছে৷
দূরে কলতলায় মেয়েদের ভিড়৷ বুক পর্যন্ত বাঁধা সায়া৷ ভেজা, বিপর্যস্ত৷ একে অন্যের পিঠে সাবান ঘষে দিচ্ছে৷ অলৌকিক বুদ্বুদের মতো সেই ফেনা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে৷ আঁশটে গন্ধের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সাবানের সুগন্ধি৷
গলিপথে ধীরে ধীরে রোদ ঢোকে৷ পুরনো বাড়িগুলোর স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা তক্ষক সহসা বাইরে আসে৷ শ্যাওলামাখা দরজার পাশে বসে একটি বালক রাস্তার ধারের খলবলে জলের ধারায় অভ্যাসবশত কাগজে তৈরি নৌকো ভাসায়৷ একটার পর একটা৷ তরতরিয়ে ভাসতে থাকে দুলতে দুলতে৷ কোনওটা আবার জল ভরে ডুবে যায়৷
কিন্তু যাদের রান্নাঘর নেই কিন্তু বিছানা আছে, সেই শীলামাসি রত্নামাসিরা প্রতিদিন সকালে জুবলি রোড মোচ-ফরাক্কার চা-দোকান থেকে স্টিলের গ্লাসে চা আর কাগজে জড়ানো বিস্কুট নিয়ে এই গলিপথ দিয়ে ফিরে যায়৷ ফিরে যায় কলতলা৷ মেয়েলোকেদের গায়ে-পড়া ঢলাঢলি, কলকাকলি, সারারাতের ক্লান্তিনিবারণী স্নান আর অলৌকিক সাবান-বুদ্বুদের রহস্যময় আলো-আঁধারিতে৷
আকাশের অনেক উঁচুতে বাবলুকাকু লাটাই থেকে নির্দ্বিধায় তার ঘুড়িকে উড়ে যেতে দিত৷ অনেক শীতের দুপুরে বালক দেখেছে তার পাশে দাঁড়িয়ে৷ আকাশের নরম রোদ পেরিয়ে, অসীম নীল পেরিয়ে টানটান সূতোয় ঘুড়িটা কোন্ উঁচুতে গিয়ে স্থিতপ্রজ্ঞের মতো পতপত করে উড়তো৷
---‘নে-নে, ঢিল দিবি৷ লাটাই থেকে সুতো ছেড়ে যাবি যতক্ষণ উড়তে চায়’৷ 
বালকের হাতে লাটাই ধরিয়ে বাবলুকাকু রেলিঙের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে সিগারেট জ্বালায়৷ অমিতাভ বচ্চনের মতো কানঢাকা চুলের বাবলুকাকু৷ সেদিকের গলিপথ দিয়ে তখন ঘরে ফেরে শ্বেতশুভ্র অ্যাপ্রন, সিস্টার, আমার কাকিমা৷ মনাদের মা৷


৭. কুয়াশাভ্রমণ

ফ্রাঞ্জ কাফকার মতো বন্ধুভাগ্য কৃষ্ণেন্দুর নেই৷ অন্তত থাকলেও কৃষ্ণেন্দুর  তা জানা নেই৷  কাফকাও জানতো না যে সে চলে গেলে ম্যাক্স এতো সব কাণ্ড ঘটাবে! কাফকার পক্ষে জানা সম্ভবও ছিল না৷ গ্রিগর যেভাবে মা-বোন সকলের কাছে শেষপর্যন্ত পোকামাত্র হয়ে গেল তা গ্রিগরেরও জানা ছিল না৷ তার অফিসের বস, কলিগ, বন্ধু কেউই তাকে কখনও মানুষ পদবাচ্য মনেই করেনি৷ বালক যুবক হলে একদিন তারও একটা কর্মক্ষেত্র হয়৷ কলিগ, বস, বন্ধু, প্রেমিকা--- দূর থেকে হাততালি দিয়ে সম্মতি জানাতে ইচ্ছে করে তার গ্রিগরকে৷ তার কিছু কিছু বন্ধুকে এখন টিভিতে, শর্টফিল্মে দেখা যায়৷ কেউ টক শো-তে তর্ক করে৷ কেউ গান গায়৷ কেউ সিনেমা বানায়৷ কেউ আবার অভিনেতার ভূমিকায়৷ ম্যাক্স ব্রডের মতো কৃষ্ণেন্দুর কোনও বন্ধু নেই৷ কাফকারও ছিল না৷ জীবনানন্দের তো তবু সঞ্জয়বাবু ছিলেন, ম্যাক্স ব্রড ছিল না!

দেখিনি কী আলোজ্বলা খোপ খোপ ঘর, পাশাপাশি পেতে রাখা বেড, বুকসেল্ফ, ভাঙা আলনা-ওয়ার্ড্রোবের মুখোমুখি দড়িতে টাঙানো পরিত্যক্ত জিন্স্, ছেঁড়া শার্ট বা বার্মুডার ভিড়!  চটা-ওঠা দেয়ালে চারকোল ও পোস্টার কালারে আঁকা হিজিবিজি শ্লোগান ও ছবির কোলাজ! বেডের তলায় গড়াগড়ি ঠাণ্ডা ও গরম পানীয়ের ঝুলমাখা বোতল৷ রাত জেগে কাটানো স্টাডি-লিভ এবং শীতরাতে উষ্ণ চায়ের সন্ধানে হস্টেল থেকে পঞ্চাননতলা পর্যন্ত কুয়াশাভ্রমণ! তবু তো নির্বিকার জেলাগুলো বছর বছর মেধাবীদের ঠেলে দিচ্ছে ভিড়ে ঠাসা মহানগর আর হঠাৎই জল হয়ে ঝরে যাওয়া গ্লেসিয়ারের মুখে৷ চিরন্তনের কেরিয়ারগ্রাফে৷
 
প্রত্যেক প্রজন্মেরই এমন একটা সময় থাকে যখনও পর্যন্ত যূথবদ্ধতার জন্য জীবনকে বাজি রেখে লড়ে যেতে পারে তারা৷ বন্ধু, বন্ধুতা, প্রেম তখন আর শব্দমাত্র নয়, জীবনের সঙ্গে যুঝতে থাকার অনিবার্য অবলম্বণ হয়ে তাকে প্রতিনিয়ত পোড়াতে থাকে৷ আর এই দহনবেলায় পুড়তে পুড়তে সে হঠাৎ একদিন নিজেকে আবিষ্কার করে মধ্যরাত্রির নিয়ন আলোয় ভেজা জনমানবহীন এক অচেনা দীর্ঘ হাইওয়ের উপর৷ একা৷ সঙ্গীহীন৷ তার চারপাশ দিয়ে সাঁ-সাঁ শব্দে ছুটে যাচ্ছে নানা ধরনের চতুশ্চক্রযান৷ বিষাদ মাখানো সেই রাতে নিজেকে ঠেলতে ঠেলতে কোনও মতে চৌমাথার অচেনা আইল্যান্ডের রেলিঙে দাঁড় করানো৷ নিয়নের সোনালি আলোয় হাইওয়েটা তখন দীর্ঘদেহী অ্যানাকোন্ডার মতো হিসহিস করছে৷ পা পিছলে যেতে পারে বলে কোনও মতে আইল্যান্ডের রেলিঙ ধরে আগ্রাসী ট্যুরিস্টের মতো মোবাইল তাগ করে তুমি সেলফি তুলছো৷ ঠিক যেরকম যাবতীয় যূথবদ্ধতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত লেখার টেবিলে তুমি শেষমেশ একা৷ একা আসলে সমগ্র প্রজন্মটাই৷ নিজেদের লিখনভঙ্গি ঠিক করবে নিজেরাই নাকি টোপ ফেলে রাখা প্রাতিষ্ঠানিক অন্নজলে নিজেকে নধর করবে রাত্রিদিন! এইসব দ্বিধাদীর্ণ সময়ে ক্রমাগত অচেনা হতে থাকে রাস্তারা৷ ঝিলপাড়৷ বন্ধুমুখ৷
 
একটার পর একটা ঠিকানা বদল হয়৷ তুমি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকো স্বর৷ নতুন কণ্ঠস্বর৷ সময় পেরিয়ে যায়৷ ফুটপাথ বদল হয়ে জেগে ওঠে হিমশীতল আইনক্স, সারি সারি গদি-আঁটা চেয়ার, হাতলের গর্তে ঠাণ্ডা পানীয়, সুরভিত উষ্ণ পপকর্ন, এসকালেটর পেরিয়ে সারি সারি ঝুলে থাকা নারী, পুরুষ ও শিশুপোষাক, বাহারি মল, তাহাদের কসমিক প্রেম৷ তবু তুমি খুঁজতে থাকো৷ এই অবসরে কেউ টুক করে প্রতিষ্ঠা পেল৷ চাকরি৷ বাড়ি-গাড়ি-রাজকন্যা৷ কারো কারো বই বের হল৷ বুকস্টলের নরম আলোয় সেইসব বইয়ের উদ্ধত স্পাইন অচেনা ঠেকে খুব৷ চায়ের দোকানে, আড্ডার লবিতে, কফিহাউসে, পানশালার টেবিলে একই কলকাকলি একঘেয়ে করাতকলের শব্দের মতো মাথার ভেতরে ঘুসঘুস করতে থাকে৷ মেলা, আড্ডা, মফসসল সর্বত্রই সেই একঘেয়ে ঘষঘষ-ঘুসঘুস৷ আসলে একটা নতুন কোনও কিছু৷ মগ্নতা বা তারও বাইরে আরও অন্য কোনও কিছু৷ বাউল তার সমস্ত প্যাশন তখন ঢেলে দিচ্ছে ফুরিয়ে আসা রাত্রির শেষযামে নানান বিভঙ্গে, মগ্নচৈতন্যে৷ অথচ আখড়ায় সকলের মাঝে বসে তখনও তুমি বান্ধবীর গলার রবীন্দ্রগানকে অতিক্রম করতে পারছো না৷ কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছো না সেই আনত গ্রীবার অনির্বাণ ঔজ্জ্বল্য৷ ভিড়ের ভিতর থেকেই উঠে এসেছিল সেই অমোঘ সত্য৷ আসলে কিছুই কিছু না৷ নিজস্ব স্বর অর্জন করাটাই শেষ পর্যন্ত শেষ কথা৷
 
এই পথে নোটবন্দি সময়ে গ্রিগরের বন্ধুরা বালকের সঙ্গে পেটাই পরোটা খেত রোজ৷ তারপর চা৷ সিগারেট৷ কলোনি বাজারে লকাই পেটিএম ছাড়াই কাতলা মাছের পেটি রোজ ওজন করতো৷ মিহিরের দোকানে কোনও খাতা ছাড়াই গ্রিগর ডিম, পাউরুটি আর মাখন কিনতো৷ এটিএমের সামনে মানুষদের লম্বা সর্পিল লাইন তখন রোজ৷ কোনও কোনও পোকা সেই লাইনে হঠাৎ দাঁড়ালে মানুষরা তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিত৷  ফ্রাঞ্জ কাফকার মতো বন্ধুভাগ্য ওই পোকাদের একদমই নেই৷ বিউটিফিকেশনের কাজ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত ওই পোকাদের কারও কারও সঙ্গে লালকা পুকুরের ধারে আমোদী, কই অথবা ট্যাংরা মাছ কিনতে গিয়ে কৃষ্ণেন্দুর দেখা হত৷ কৃষ্ণেন্দু এখন বাস নয়, অটো নয়, রিক্সোয় যাতায়াত করে৷ এক রিক্সো থেকে আরেক রিক্সো, আরেক রিক্সো থেকে...

ফ্রাঞ্জ কাফকার মতো বন্ধুভাগ্য কৃষ্ণেন্দুর কখনও ছিল না৷



৮. সাঁওতাল পরগনায়

পাহাড়ি টিলা আর শালবনের ঘন জঙ্গলে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে চাঁদ৷ জ্যোৎস্নার নিবিড় বিস্তার৷ শেষ-ট্রেন চলে গেছে৷ কুপি-জ্বলা হাটের গভীরে ফুলুরি জিলিপি আর মহুয়ার গন্ধ৷ ইতঃস্তত ছড়িয়ে থাকা শালপাতায়, পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ দিয়ে গড়িয়ে যায় হ্যান্ডেলে ব্যাটারির হেডলাইট লাগানো সাইকেল৷ এখানে তীব্র এখন হ্যাজাকের আলো৷ বাদামি৷ ইঙ্গিতপ্রবণ৷ ফুলকপি, রাঙালু, বরবটি, শাকালুদের ঝুড়িতে উড়ে বেড়াচ্ছে জোনাকির আলো৷ শীতের তীব্রতা হাটুরেদের ফিরতি পথে তীব্রতর আরও৷ 

মিস্রাজীর সঙ্গে সাউজীর তুমুল আড্ডা৷ দড়ির খাটিয়ায় প্রতি সন্ধ্যায় খঞ্জনি বাজিয়ে তুলসিদাসী ভজন৷ ধূপ ও কর্পূরের আরতি৷ আর রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে রেডিওয়৷ দূর থেকে শোনা যায়৷ বিনাকা গীতমালায় ঝুমরিতালাইয়ার অনুরোধে গান বাজছে, মোহে আঈ না জগসে লাজ...৷ নিলাজ সেই নারীর মতোই এখন পাহাড়ের এ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খাটো ডুরেকাটা শাড়ি পাথরে খোদাই সেই নারীমূর্তির রক্তে-মাংসে কামোন্মাদ এক পশুকে ডুবে যেতে দেখছে কৃষ্ণেন্দু৷ সমস্ত ‘জগ’ তখন দিশাহারা৷ পাহাড়ের মতো সেই পাথুরে শরীরে তখন জ্যোৎস্নার নগ্ন আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে৷ মাঘের অপ্রতিরোধ্য শীত তখন মহাশূণ্যে ইশারাপ্রবণ৷ ছোট্টো রেলস্টেশনের পাশে কনভেয়র বেল্ট জড়ানো দানবীয় যন্ত্রদুটি প্রবল শব্দে তখনও কুচি কুচি করে দিচ্ছিল কালো পাথরের রক্ত, মাংস৷
 
কৃষ্ণেন্দুরা একই সঙ্গে বড়ো হচ্ছিল৷ গায়ে গা৷ ডিসেম্বরের লম্বা ছুটিতে রঙবেরঙের উলের সোয়েটার৷ টবের চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, গাঁদা বা দোপাটির রাশি কৃষ্ণেন্দুদের ছাদ থেকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিল৷ থানাপাড়া পেরিয়ে ছোটো রাজবাড়ি, বড়ো রাজবাড়ি৷ কৃষ্ণেন্দুদের হাতে দহনপর্বকালীন পোড়াগন্ধ, ছাইয়ের কালো দাগ লেগে আছে৷ 
ওরা একটু একটু বড়ো হচ্ছিল৷ এক সঙ্গে৷ ছুট ছুট অবিশ্রান্ত ছুট৷ ছুটতে ছুটতে যে কোনও ট্রেন কলকাতা অভিমুখী৷ শীতের দুপুরে ছাদের ওপর বিস্ফারিত চোখ চন্দ্রমল্লিকা সুর্যমুখী আর গাঁদার ছানাপোনারা৷ ডাঁই করে রাখা খড়ের গাদায় বয়ঃসন্ধি৷ ঠোঁট ছড়ে গেলে বোরোলীন, আহা বোরোলীন! তুমি কী আহত শার্দুল, বালক, সেইদিন অচেনা স্টেশনে! সঙ্গী কাজিন, তোমার অনুজ কী বুঝেছিল মাঘদুপুরের অভিশপ্ত ইশারা! পাঞ্জাবী ধাবায় রুটি-তড়কা, নিরুপায়ের গ্রাসাচ্ছাদন! বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে এতো এতো এক্সপেরিমেণ্ট শেষে ঋতুপর্ণ ঘোষ মান্যতা দিল উৎসব সিনেমায়৷ তাও প্রায় দেড়-দু দশক পরে৷ 

অবশেষে রাত্রি গড়ায় এসে নির্জন অচেনা স্টেশনে৷ নকশাল আন্দোলন নিয়ে যারা বই লিখেছিল কৃষ্ণেন্দু তাদের লেখা কিছু কিছু পড়েছে৷ কিছু কিছু কৃষ্ণেন্দুর অনুমান ও অভিজ্ঞতা৷ শ্রেণীশত্রুরা এসে লুকোয় তোমার আড়ালে৷ রাঙামা৷ তুমি তাদের মাশরুম কারি রান্না করে ভাত খাওয়াও৷ কলকাতা থেকে অনেক দূরে সাঁওতাল পরগনায়৷ লিন পিয়াও লিন পিয়াও৷ রামপুরহাট থেকে সাঁইথিয়া হয়ে একটি স্টিম-এঞ্জিন কৃষ্ণেন্দুদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল শিয়ালদায়৷ তোমরা দুই কাজিন, বালক, দুই ভাই, বয়ঃসন্ধি থেকে পরস্পরবিরোধী৷ সাহিত্যচর্চার আড়ালে একে অন্যকে বুঝতে দাওনি৷ রাঙামা বুঝতো৷ তোমাকে জন্ম না দিলেও, হে বালক, তোমার প্রতি যে স্নেহপরবশ অধিকারবোধ, রাঙামা অনেক উন্মার্গগামীতায় তোমাকে সময় দিয়েছে৷ সেই সঙ্গ, যা তোমার আজন্মলালিত৷ অথচ সাঁওতাল পরগণার সেই অচলিত গ্রাম থেকে, ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে তোমাকে অনুভব করতে চেয়েছিল একজন৷ বাড়িতে, আত্মীয়স্বজনদের কুচকাওয়াজ থেকে যখন তুমি পিছিয়ে যাচ্ছিলে সমস্তদিন৷ শুধু তোমার বদলে বদলে যাওয়া গৃহকোণে কৃষ্ণেন্দু কোনওদিন একটি ধূপ অথবা মোমবাতি জ্বালাতে পারোনি তুমি রাঙামার স্মৃতিতে৷ বাঘাযতীন থেকে তোমাদের ছোটোমেসো পালিয়ে গিয়েছিল সেই সাঁওতাল পরগণায়, রাঙামার কাছে৷ তুমি শুধু তুকতাক আর মাদারির খেলা দেখছিলে সেদিনের কলকাতায়৷ 

(এরপর আগামী সংখ্যায়)

৫টি মন্তব্য:

  1. আহা ;( মর্মস্পর্শী কলম ,যদিও এত চেনা ,তবুও অপরিচয়ের অশ্রুতে উজ্জ্বল ।

    উত্তরমুছুন
  2. ইন্দ্রজিৎ রায়১৫ আগস্ট, ২০২০ এ ২:০৩ PM

    আহা ,খুব পরিচিত ও কখনও অপরিচয়ের অশ্রুতে উজ্জ্বল । মনোগ্রাহী ;(

    উত্তরমুছুন
  3. এত পরিচিত, তবু অপরিচয়ের অশ্রুতে উজ্জ্বল ।

    উত্তরমুছুন
  4. এত পরিচিত, তবু অপরিচয়ের অশ্রুতে উজ্জ্বল ।

    উত্তরমুছুন
  5. পরিচিত তবু যেন নতুন করে চেনা।দারুণ ।

    উত্তরমুছুন