মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০

সাক্ষাৎকার ৷৷ কবি সুব্রত সরকার

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০


সাক্ষাৎকার ৷৷ কবি সুব্রত সরকার 


গত শতাব্দীর সাতের দশকের অন্যতম কবি সুব্রত সরকারের জন্ম ২৭.০৮.১৯৫৬,দমদম এয়ারপোর্টের কাছে মতিলাল কলোনিতে৷ প্রথম কবিতাপ্রকাশ : ১৯৭৩,‘প্রত্যুষ’ পত্রিকায়৷ প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ : ‘দেবদারু কলোনী’ (১৯৭৯)৷ ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ এই ছয়-সাত বছর ‘দেবীমুখ’ নামে একটি কবিতাপত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন৷ এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৩৷ ১১ টি কাব্যগ্রন্থ,কাব্যসমগ্র ও ১টি গদ্যগ্রন্থ (‘পরিচ্ছন্নতা ও বিষাদের দেবী’)৷ শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ‘না স্নেহকরস্পর্শ’ (২০১৪)৷ প্রাপ্ত পুরস্কার/সম্মান: শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৩),বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭)৷ এই লিখিত সাক্ষাৎকারটির প্রশ্ণাবলীর উত্তর তথা এই সামগ্রিক কথোপকথন মূলত জি মেল ও মোবাইলফোন-নির্ভর,১৫ ডিসেম্বর,২০১৪ দুপুর ১১.৫২ থেকে শুরু৷ শেষ হল আজ ১৬.১২.১৪. দুপুর ১ টায়৷ কবির  কাছে প্রশ্ণ রেখেছেন : রাজীব সিংহ৷

মাসিক কবিতাপত্র : গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের শেষ থেকেই বা বলা ভালো ছয়ের দশক জুড়ে সারা বিশ্বে পুরনো মূল্যবোধ,সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন,আধিপত্যবাদ,যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবসমাজ৷ এই সময়ে এসে আপনার কবিতা লেখার শুরু৷ এই ঝোড়ো সময় আপনাকে,আপনার কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
সুব্রত সরকার : সময়টা কেতুর দশক৷ যখন মাথা কম পড়লেই রাত্রে পাড়া থেকে অল্পবয়সিদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো৷ পরদিন সকালে তার ছিন্ন-শিরদেহ পড়ে থাকত শিবমন্দিরের মাঠে৷ একটি কাক উপরে ঘুরে ঘুরে ডাকছে--- কা কা কমরেড৷ এ আমার নিজের চোখে দেখা৷
সদ্য কৈশোর শেষ হচ্ছে৷ সুকলের জানালা দিয়ে দেখছি কৃষ্ণচূড়ার ডালে আগুনের ফুল হাওয়ায় দুলছে৷ একটা আদর্শ,মূল্যবোধ,অপরের জন্য কিছু করার তাগিদ তো সেই বয়সেই আসে৷ গুটিপোকা   থেকে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসার বয়স৷ কিন্তু আমরা ফের ঢুকে গেলাম অন্ধকারে,বিশ্বাস হত্যায়৷ রাজনীতি থেকে সেই যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম আর কখনও সখ্য হয়নি৷ এখন তো খবরের কাগজও পড়তে ইচ্ছে হয় না৷ আমার জন্ম দমদম এয়ারপোর্টের কাছে,বহু প্রতিবাদ,মিছিল স্বচক্ষে দেখা৷ বাংলাদেশ যুদ্ধের তাপ-ও কিছুটা দেখতে পেয়েছি৷ একাকী হয়ে যাচ্ছিলাম,‘বন্ধুদের থেকে বাধ্যতামূলক দূরে’ (বীতশোক ভট্টাচার্য)৷
আমি কলোনির ছেলে৷ সেখানে বেশিরভাগ মানুষ গরীব৷ তবু যিনি চুল কাটতেন,যিনি দুধ যোগান দিতেন,যিনি কাপড় কাচতেন,তাঁরা সকলেই আমার মামা৷ বাড়ি থেকে এমনটা শেখানো হয়েছিল৷ যদিও আমি  স্বচ্ছল পরিবারের৷ ওদিকে ছবির মত পরিচ্ছন্ন এয়ারপোর্টের বসতি৷ অপার প্রকৃতিতে ভরা৷ সুন্দর৷ জীবন এত বিপরীত কেন? ভাবতাম৷ তখন তত্ত্বকথা বোঝার বয়স হয়নি,জানতামও না৷ আমি অসহায় হয়ে আমার দুঃখী,নিরন্ন কলোনিটিকে ভালোবেসে ফেললাম৷ এছাড়া উপায়ও ছিল না৷ একটা ক্ষত,পেরেকের নিচে পাইপগানের গুলির দাগ,যাকে পরে চুনকাম করে দিয়েও ঢেকে দেওয়া যায়নি, মনের অন্তরালে আজও রয়ে গেছে৷ সেখান থেকে আজও রক্ত ঝরে৷                                                                                                                              
মাসিক কবিতাপত্র : একদিকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ,ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ,অন্যদিকে ভাঙনমুখী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবির--- একদিকে নতুন স্বপ্ণ,অন্যদিকে স্বপ্ণভঙ্গের হতাশা--- এই পরস্পরবিরোধিতা সেসময় আমাদের দেশেও আছড়ে পড়েছিল৷ আপনার নিজের কবিতায়, আপনাদের সময়ের অন্যদের কবিতায় এই ঝোড়ো দিনগুলির কোনও ক্ষত কী আদৌ লক্ষ করা যায়?
সুব্রত সরকার : আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটতর্ক খুব বেশি বুঝবার কথা নয় সে বয়সে৷ স্বপ্ণ যা ভাঙার তা পাড়াতেই ঘটেছিল৷ কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধ,উদ্বাস্তুদের স্রোত,ভাষার জন্য একটি রাষ্ট্রের জন্ম আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল৷ জীবনানন্দের নামও তো তখনই শুনলাম৷ আমার এক গদ্যগ্রন্থে এসব কিছু কিছু লিখেছি৷ 
মাসিক কবিতাপত্র : তখন আদর্শ হিসেবে কাকে মেনে নিচ্ছেন? আপনার প্রিয় কবি কে?
সুব্রত সরকার : আমার আদর্শ ছিল পাড়ার দাদা-দিদিরা৷ সুকলের স্যারেরা (তাঁরা তখন খুব কম বেতন পেতেন)৷ গোপনে বলি,আমাদের বাড়ির কাছে কয়লার ইঞ্জিনের এক ড্রাইভার থাকতেন৷ তাঁর কালিমাখা ইউনিফর্ম আমাকে মুগ্দ করেছিল৷ বড়ো হয়ে তাঁর মতো হবো ভাবতাম৷ অথচ পাশেই তো এয়ারপোর্ট,পাইলটদের হরবখত্ দেখেছি,তবু৷ শুধু কষ্ট হত তিনি যখন মাঝে-মধ্যে বাড়ি আসতেন,মদ খেয়ে হল্লা-গুল্লা,ভাঙচুর,বাচ্চা,বউকে পেটানো৷খুব কষ্ট হতো৷ মায়া লাগতো৷ রাগ করতে,ঘৃণা করতে পারতাম না৷
প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ তিনি চিরকাল আমার কাছে ভগবান-সদৃশ৷ জীবনানন্দ দাশ আমার ভালো লাগে না, তা তিনি যত বড়ো কবিই হোন৷ 
মাসিক কবিতাপত্র : কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ কী কখনও আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল? কবিতার শরীর অর্থাৎ ফর্ম আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সুব্রত সরকার : অবশ্যই মার্কসবাদ৷ কিন্তু পরে এ মোহ ভঙ্গ হয়৷ গৌতম বুদ্ধের ত্রিশরণ--- সাম্য,মৈত্রী ও করুণার মধ্যে করুণাটি সেখানে ছিল না,পরে বুঝতে পেরেছি৷ করুণার বদলে মার্ক্সিস্টরা স্বাধীনতা শব্দটি ব্যবহার করেন৷ তার ফল কী হলো বিশ্ব জুড়ে সকলেরই জানা৷
কবিতার ফর্ম নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ,কিন্তু তা স্বতঃস্ফূর্ত হতে হয়৷ চতুর্দশপদী লিখবো বলে লিখলে তার ছন্দবন্ধন হয়তো সঠিক হবে,কিন্তু শেষ অবধি তা কবিতা না হতেও পারে৷ কবিতা আকস্মিকতায় উদিত হয়,সে নিজেই ঠিক করে নেবে কিভাবে সে নিজেকে রচনা করবে৷ কবির কাজ হলো কবিতাকে অনুসরণ করা৷ আমার এমন মনে হয়৷
মাসিক কবিতাপত্র : তা হলে ছন্দ ও নির্মাণ-প্রকৌশল কী একজন কবিকে সেই যোগ্যতামান দেয় না? সবটাই আকস্মিকতা?
সুব্রত সরকার : এখন কেউ উটের মত গলা বাড়িয়ে বলতে পারেন,ছন্দ জানা কী অর্জন নয়? নতমস্তকে তা স্বীকার করছি,এও এক দক্ষতা৷ তবে তা শিল্পীর নয়,কারিগরের৷ তা যারা কারিগর হতে চান, হোন৷ কে বারণ করছে! আরও একটা বিষয় থাকে,যা  অলৌকিক,অতিলৌকিকও বলতে পারো,যা কবিকে ভর করে৷
মাসিক কবিতাপত্র : পত্রিকা সম্পাদনাকে অনেক কবিই লঘু কাজ মনে করেন৷ আপনার মত৷
সুব্রত সরকার : আমি নিজেই দীর্ঘদিন পত্রিকা সম্পাদনা করেছি৷ ‘দেবীমুখ’ বের করেছি৷ সুতরাং আমি এমন মনে করি না৷ কিন্তু এর ফলে নিজের লেখার অনেক ক্ষতি হয়৷ সময় নষ্ট হয়৷ সম্পর্ক নষ্ট হয়৷
মাসিক কবিতাপত্র : আপনার কবিতায় চিরায়ত রোমাণ্টিকতার বদলে অত্যন্ত উদাসীন ও মেধাবী এক  সত্তা লক্ষ করা যায়৷ যা অত্যন্ত অনুভূতিসম্পন্ন ও সারাক্ষণ ক্রিয়াশীল৷ দেশী-বিদেশী নানা তত্ত্ব,পুরাণ ও সমাজচিন্তা আপনার কবিতার উপাদান৷ প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গির বিপ্রতীপে আপনার সামগ্রিক উচ্চারণ৷ কেন?
সুব্রত সরকার : নিজের কবিতা সম্পর্কে কিছু বলা আমার কাছে অরুচিকর৷ প্রত্যেক কবিই চেষ্টা করেন স্বকীয়,স্বতন্ত্র হতে৷ আমি পেরেছি কি না জানা নেই৷
আমি একটি কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠানে ২৭ বছর ধরে কাজ করছি,সহকর্মীরা কেউ কবিতালেখা তো দূরে থাক,পড়েও না৷ তবু আমার নানা বায়না,নানা অস্বাভাবিক আচরণ যা এ ধরণের প্রতিষ্ঠানে কেউ করে না,করেছি,তারা সহ্য করেছে৷ এ জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ৷ এটা খবরের কাগজে কাজ করলে পেতাম না৷ তারা আমি কবিতা লিখি বলে নয় এক বিচিত্র সহকর্মী হিসেবে আমাকে আড়াল করেছে,যাতে ক্ষতি না হয়৷ এইসব আমাকে লেখায়,অতিলৌকিকে পৌঁছে দেয়৷
মাসিক কবিতাপত্র : কোনও নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন কী কখনও আপনাকে প্রভাবিত করেছিল? অনুজ কবি হিসেবে ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? 
সুব্রত সরকার : কোনও সাহিত্য আন্দোলনে জড়িত থাকিনি,প্রভাবিতও হইনি৷ কবিতা একাকী মানুষের সৌন্দর্য--- এরকম আমার বিশ্বাস৷ অগৌণ কবিরা দল পাকায়৷ কৃত্তিবাসে দু-একবার লিখেছি৷ কারুর কারুর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল,এর বেশি কিছু নয়৷ শতভিষা-ও তাই৷
মাসিক কবিতাপত্র : লিটল ম্যাগাজিন-বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সম্পর্কে আপনার মত কী? 
সুব্রত সরকার : এখন আমি একা থাকতে চাই৷ নিজের সেরা লেখাটা আজও লিখতে পারিনি,অন্য কিছুতে মন দিলে কখনও পারবোও না৷ প্রতিষ্ঠানের যেমন বহু বজ্জাতি আছে,লিটল ম্যাগাজিনওয়ালারাও কিছু ধোওয়া তুলসিপাতা নয়৷ এসব পাঁক থেকে দূরে থাকবার জন্যে প্রত্যেক কবির নিজস্ব পদ্ধতি আছে৷ যে যার নিজের চটি পরে হাঁটবেন৷ এখন কারুর পিছনে যদি কাদা ছিটকে যায়,সে তার সমস্যা৷ আমি ভাবতে যাবো কেন?
মাসিক কবিতাপত্র : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের প্রেক্ষিতটি কী? 
সুব্রত সরকার : এয়ারপোর্ট ছিল অপার সবুজে ভরা৷ আমি তার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলাম৷ বিস্তৃত আকাশ আর প্রচুর মহাকায় বৃক্ষ৷ যাদের পাতার আড়ালে অজস্র পাখি কিচ্মিচ্ শব্দ করে চলেছে৷ যেন এক অনন্ত শিল্পী কাঠখোদাই করে অসীম জগৎচিত্র রচনা করে চলেছে জীবন-পারাবারে৷ আমি সেই চিত্রের কানাৎ উঁচু করে নিজের নামটি লিখতে চেয়েছিলাম৷ কী বোকার মতো কাণ্ড,আজ বুঝি৷ কিন্তু ওই পাখির আওয়াজ কী ভয়াবহ,বোঝাতে পারবো না,বোঝাতে পারিনি৷ নিঃশেষ হয়ে গেছি৷ কিচ কিচ করে তারা ডাকছেই৷ জীবন অন্তরালে৷ আর চিরকালীন চিত্র রচিত হয়ে চলেছে অদৃশ্য জগতের ইশারায়৷শুধু সেখানে আমার স্থান হয়নি৷
এর উল্টোদিকে আমাদের কুশ্রী কলোনি৷ অশিক্ষিত,ক্ষুধার্ত৷ তবু তাকে পর ভাবতে পারিনি৷ তারা যে আমার মামা-কাকারা,তাদের ছেলেমেয়েরা যে আমার দাদা-দিদি,ভাই-বোন৷ অতএব আমার লেখায় কলোনিটি কখনও মা,বাবা,ভাই-বোন,বন্ধু,বা কখনও স্বয়ং আমি হয়ে উঠেছি৷ সে যেন এক মানুষ৷ কোনও সুররিয়ালিস্টিক ভাবনা নয়,শব্দটাই জানতাম না তখন৷ কেবল বাড়ির পিছনের একলা,নিঃসঙ্গ দেবদারু বৃক্ষ আমাকে দিয়ে এসব লিখিয়েছিল৷ আমি তাকে দেবু-দা বলে ডাকতাম৷
মাসিক কবিতাপত্র : ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার--- আপনি স্বীকার করেন? 
সুব্রত সরকার : হ্যাঁ৷ ঐতিহ্য--- ইতিহাস৷ উত্তরাধিকার--- বর্তমান৷
মাসিক কবিতাপত্র : সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক একটা আছেই৷ এ নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগও সর্বজনবিদিত৷ এ বিষয়ে আপনার মত কী? 
সুব্রত সরকার : এ বিষয়ে কি আর বলবো! সবাই সব জানে৷ এসব উপেক্ষা করতে হয়৷ তবে কবিও যেহেতু সামাজিক মানুষ,তাই তাকে বহু অভ্যাস করে এই উপেক্ষা-শক্তি অর্জন করতে হয়৷
মাসিক কবিতাপত্র : বাংলা কবিতায় কলকাতা-কেন্দ্রিকতার অভিযোগ নিয়ে আপনার অভিমত কী? 
সুব্রত সরকার : কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী৷ সেখানে থাকলে তো বহু সুযোগ,সুবিধা মিলবেই৷ একটা ভালো বইয়ের খোঁজ পেতেই তো কত দেরি হয়ে যায় দূরের কবিদের৷ হাতে পাওয়া তো পরের ব্যাপার৷ তবে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে৷ এই কেন্দ্রিকতার শাসন আস্তে আস্তে আলগা হচ্ছে৷
মাসিক কবিতাপত্র : অনেকেই দাবি করেন গত শতাব্দীর সাতের দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায় মৌলিক চিন্তার বড়ো অভাব৷ আপনি কী বলবেন? 
সুব্রত সরকার : এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা৷ প্রাকৃতিক ভাবেই এটা হতে পারে না৷ সত্তরের সব কবিই কিছু মৌলিক লেখেনি৷ আবার পরবর্তী দশকের অনেক কবিই আমার প্রিয়৷ এসব নিয়ে গবেষণা,আলোচনা-সভা হওয়া দরকার৷ তবেই প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হবে৷ আলটপকা মন্তব্য করে কেউ কেউ নিজেকে জাহির করবার চেষ্টা করে৷ পদ্ধতিটা ঘৃণ্য৷
মাসিক কবিতাপত্র : এই এতটা পথ পেরিয়ে,‘কবিতাসমগ্র’ প্রকাশের পর ‘দেবদারু কলোনী’,‘তোমাকে মিথ্যে বলেছি’,‘সহ্য করো,বাংলাভাষা’ ইত্যাদি গ্রন্থের কবির তাঁর অনুজ কবিদের প্রতি কোনও বিশেষ পরামর্শ? 
সুব্রত সরকার : আমি পরামর্শ দেবার কোন্ হরিদাস? তারপরেও আমার যত কিছু ষড়যন্ত্র তা তো লেখাতেই রয়ে গেল৷ পড়ে কিছু মনে হলে ভালো৷ না মনে হলেও ভালো৷
মাসিক কবিতাপত্র : কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা না গদ্য, আজকের তরুণতমদের কবিতায় কিসের প্রভাব স্পষ্ট বলে আপনি মনে করেন? 
সুব্রত সরকার : জীবনানন্দ আমার ভালো লাগে না৷ তাঁর গদ্য-পদ্য কিচ্ছু না৷ অনুসরণ করলে কানা গলিতে প্রবেশ করা হবে৷ বরং মধুসূদন এখনও সাহায্য করতে পারেন৷ 
মাসিক কবিতাপত্র : পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের কাছে কী আশা করেন? 
সুব্রত সরকার : বাংলা ক্রিয়াপদের কিছু সমস্যা আছে৷ যার উত্তরণ এখনও হয়নি৷ মনে রাখতে হবে ক্রিয়াপদ সময় নির্দেশক৷ সময় কিন্তু একটা ধারনা,যাকে বাস্তব বলে আমরা দাবি করি৷ সময়ের শক্তি অসীম, অক্ষয়৷ তন্ত্রে কালীমূর্তি সময়ের প্রতীক৷ আমি সারাজীবন ধরে তাঁর ধ্যান করে গেলাম৷ দেখা মেলেনি৷ বঙ্কিমচন্দ্র ধার করে বলি--- মা যা ছিলেন,মা যা হইয়েছেন,মা যা হইবেন৷ নীলসরস্বতী-র প্রকৃত স্বরূপ তরুণেরা প্রকাশিত করুন,এই প্রার্থনা৷ জয় তারা৷ 

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা সংখ্যা, ২০১৫ থেকে পুনঃপ্রকাশিত) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন