মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০

তুষার পণ্ডিত ।। জয়দেব বসুকে যেমন জেনেছি তাঁর ডায়েরিতে

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০


তুষার পণ্ডিত ।। জয়দেব বসুকে যেমন জেনেছি তাঁর ডায়েরিতে

 

‘‘তরুণ, ওগো তরুণ, আমার অস্থি দিয়ে বজ্র বাঁধবে না?’’--- ৫০ পেরোনোর আগেই বেজে উঠলো তবে সময়ের ঘড়ি? ফুরিয়ে গেলেন কবি জয়দেব বসু (১২.০৫.১৯৬২-২৩.০২.২০১২)৷ এ-ও এক আত্মহনন বোধহয়৷ তাঁর এই ‘উজ্জ্বল’ অনুপস্থিতি বাংলা কবিতায় অপূরণীয় ক্ষতি৷ এই ‘অপূরণীয়’ শব্দটা বহু বহু অপ-ব্যবহারে ক্ষিণ্ণ্ কিন্তু সে কথা কি সাজে কবি জয়দেব সম্পর্কেও? খুব দায়িত্ব নিয়েই বলা যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় পরবর্তী রাজনৈতিক শিল্পভাষ্য নির্মাণে তিনি ছিলেন ও আছেন বিকল্পহীন৷ তথাকথিত ‘প্রগতি’ সাহিত্যের গৌড়ীয় ছক ভেঙেচুরে এক নতুন ‘ডিক্শন’ এর কারিগর৷ ‘রাজনীতি’ শব্দটাকে এখানে ছোট মাপে বাঁধতে চাইলে মুশকিল৷ যে মার্কসীয় দর্শনের প্রতি জয়দেব আমৃত্যু অনুগত, প্রায় তাঁর সব অক্ষরকর্মই সে-দর্শনের শিল্পরূপ, এমনকি প্রেমের কবিতাও তার ছোঁয়াচমুক্ত নয়৷ প্রায় কবচকুণ্ডলের মতো যে পার্টি তাঁর যাপনসঙ্গী--- তার ভেতরের সহস্র আঘাত বিচূর্ণ করেছে জয়দেবকে৷ তবু হাল ছাড়েননি তিনি৷ কারণ-অকারণ বিতর্কও পিছু ছাড়ে নি তাঁর৷ এমন এক রঙ-বেরং মানুষের দিনলিপির ধূসর পৃষ্ঠায় চোখ রাখতে একটা অতিরিক্ত কৌতূহল স্বাভাবিক৷
২০১২-র ফেব্রুয়ারিতে অকালমৃত্যুর পরে আবিষৃকত হয় একটি ‘বঙ্গলিপি’ খাতায় লেখা ডায়েরি--- যেখানে জয়দেব অনিয়মিত লিখেছেন ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত৷ গড়পরতা রোজনামচা বলতে যা বোঝায়, এ লেখা তেমন নয়৷ ২০ বছরে মাত্র ৪৭ দিন৷ নিজস্ব গোপনকথা লেখার তাগিদ জয়দেবের ছিল না৷ ‘‘গোপনকথা লেখার জন্য ডাইরিলিখিয়েদের দলে আমি নেই৷’’ রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি ঘিরে যা কিছু ভালোমন্দ লাগা, তার কিছুটা আভাস সেই সব অক্ষরমালায়৷ এ লেখা কেউবা একদিন পড়বে, এমন সচেতনতা জয়দেবের ছিল৷ ৭.১২.৮৬-তে প্রথম ডায়েরিতেই বলছেন : ‘‘সত্যি সত্যিই যদি জানতাম যে আর কেউ কোনওদিন পড়বে না আমার ডাইরী, যদি পেতাম এই নিশ্চিতি, তবে বোধহয় লেখার ইচ্ছে থাকত না আরও৷’’ আমার যেটুকু মনে হয়েছে, কোন গভীরতর নিঃসঙ্গতার বেদনভার থেকে মুক্তি পেতেই তাঁর ডায়েরি শরণাপন্ন৷ এ-যেন এক মোচনের তৃপ্তি৷ অন্যর্থে ‘ক্যাথারসিস্৷’’
জয়দেব ডায়েরি লেখা শুরু করছেন যখন, বয়স চবিবশ৷ তাঁর নতুন কাব্যস্বর ইতোমধ্যে মুগ্দ করেছে অগ্রজদেরও৷ লিখে ফেলেছেন ‘ভ্রমণকাহিনী’ কাব্যের রাধাকথন, বসন্তের প্রথম লিরিক, কু---
সে এসে দাঁড়াল তামসী মেঘের বুক ছিঁড়ে, তার...
দুই চোখ থেকে শ্মশানকালীর বিষ ও ভস্ম আমি ভয়ার্ত ...
কন্ঠে বলেছি, ‘‘কে তোকে মেরেছে?’’--- এক থুৎকারে
আমার সাহস ছারখার করে সে শুধু বলল, ‘‘তু ... 
গঞ্জের নাম শ্রেণীসংগ্রাম, মেয়েটির নাম কু৷ 
    (৭.৯.৮৬)
রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, বীরেন চাটুজ্জে প্রমুখ কবিদের প্রসঙ্গসূত্রে জয়দেব বসু তখন ভাবছেন গ্রহণ-বর্জনের কথা৷ পূর্বসূরিদের নির্বিচার অনুকরণ বা প্রত্যাখ্যান না--- ‘খুবই সচেতন, আলোময় ও বিনম্র স্বীকার’-ই প্রকৃত পথ জেনেছেন৷ নিজের ভাষারীতি নিয়েও ভাবছেন অবিরত৷ সেই কবিতাই লিখতে চাইছেন--- যে কবিতায় প্রখর তাপ, যে কবিতায় হেমন্তের সন্ধ্যা, যে কবিতায় শীতের প্রথম রোদ৷ রাজনীতির দলাদলির চেয়েও কুৎসিৎ কাব্য-দলাদলির কদর্যতা থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে চাইছেন প্রাণপণে : ‘‘সারাক্ষণ এর পিছনে ওর পিছনে কাঠি না দিয়ে লেখো, ইডিয়ট, লেখো৷ শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে, যদি পারো এই ফাঁকে আরো কয়েকটি কবিতা সংযোজন করে যাও মানুষের স্মৃতির পাতায়’’ (৮.১২.৮৬)৷ সে-শক্তি যে জয়দেবের করতলগত, বাংলা ভাষার পাঠক তার সাক্ষী :
‘‘মার্চ সন্ধ্যার বৃষ্টিতে আজ ইষ্ট হল না মিষ্টিকুটুম
ভীষণ কষ্টে রাস্তার মাঝে দু-হাঁটু আমার নবনীতোপম
গন্ধবাতাস সন্ধ্যার দিকে এ কেমনতর উত্তেজনায়
ঝোড়ো নিঃশ্বাসে, বিশ্বাস করো, রাগী-রাগী মুখ ফিরিয়ে তাকাল
আমি ভয় পেয়ে তোমার দুয়ারে দাঁড়ালাম যেই, বারি ঝর-ঝর
জ্বরে-উত্তাপে মহল হঠাৎ ভরে গেল দেখে সরে যাব বলে
যেই ইতিউতি তাকিয়ে দেখছি দরজায় তুমি নিজেই আড়াল
ভেঙে দিলে আর অনাবশ্যক বাক্যালাপের এক্কা জুড়ল...’’ (স্রোত, ২.৩.৮৭)
‘আরো ভালো লিখতে হবে, আরো ভালো’--- এক সুতীব্র অতৃপ্তির চুড়োয় বসে জয়দেব প্রকাণ্ড হাতুড়ি হাতে ভেঙেছেন নিজের কাব্যপ্যাটার্ন৷ সেই সৃজন-সরণিতে মাইলফলকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, ভবিষ্যৎ, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়, জনগণতান্ত্রিক কবিতার ইশতেহার ও অন্যান্য, আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ, মেঘদূত, আর এস চতুর্দশপদী, সাইকোপ্যাথ---এইসব হীরকখণ্ডগুলি৷
মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার প্রতি আস্থার টানেই এস এফ আই ও সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে জয়দেব বসুর সংযুক্তি৷ কিন্তু তত্ত্ব আর বাস্তবের পাহাড়প্রমাণ ব্যবধান বিপন্ন করেছে তাঁকে, বারংবার৷ সেই বিপন্নতাজাত অসহায়তার অজস্র চিহ্ণ ছড়িয়ে রয়েছে ডায়েরির পাতায়৷ দক্ষিণ চবিবশপরগণা জেলা পার্টির উঁচু থেকে নিচু স্তর পর্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার কথা বলেছেন জয়দেব৷ যাদবপুরে এক ‘কমরেড’ এর মৃত্যুর জন্যে আঙুল তুলেছেন ওই অঞ্চলের এক ‘দাদা-নেতা’র দিকে৷ ‘এদের কমরেড সম্বোধন করতেও শরীর খারাপ লাগে’ জয়দেবের৷ অথচ পার্টির সঙ্গে বিযুক্তি কল্পনাও তাঁর স্বপ্ণের অতীত---
মন কি আজো পার্টি চায়?
মনকে বলো, হ্যাঁ৷ তবু, হ্যাঁ৷ (২৫.০২.৮৬)
তাই সহস্র গুঁতোগুতি সত্ত্বেও আমৃত্যু তিনি পার্টি মেম্বার৷ ১৯৮৭-র ২৯ মার্চ জয়দেব লিখছেন--- ‘‘আমরা কমিউনিস্ট, আমাদের গোটা দেশে বিপ্লব করতে হবে, একথা যেন ভুলে না যাই৷’’ এক শোষণুক্ত পৃথিবী গড়ার লড়াইতে জয়দেব নিজেকে নিষ্ঠ সৈনিক ভাবছেন৷ বিপ্লব মুখোপাধ্যায় নামের এক মেধাবী তরুণ কবির পারিবারিক বিপর্যয়ের প্রসঙ্গসূূত্রে জয়দেবের আত্মপ্রশ্ণ--- ‘‘আমরা কি আগামী বিপ্লবদের এমন একটা সময় উপহার দিতে পারব, যেখানে তার মা আত্মহত্যা করবে না? যেখানে বাবার সঙ্গে সম্পর্ক হবে সহজ ও স্বাভাবিক? যেখানে সে অহং ছাড়িয়ে উঠতে পারবে? (২৩.২.৮৯) আবার বিশ্বজোড়া সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় জেগেছে সংবেদনশীল কবি-মনে৷ সোভিয়েত, চিন, চেকোস্লোভাকিয়ার সমকালীন ঘটনাবলী জয়দেবকে কাতর করে৷ ‘‘তবে কি মানুষের ইতিহাস দীর্ঘ দীর্ঘতম বিষন্নতার ইতিহাস?’’ তবুও মৌল মার্কসবাদকে আঁকড়ে ধরেই সান্ত্বনা খঁুজেছেন এই যুক্তিবাদী তরুণ৷
নয়ের দশক থেকেই জয়দেব বসুর মনে প্রগাঢ় হয়েছে নিজের পার্টির প্রতি অভিমান, বিরূপতা৷ ১৯৯২-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি পার্টি থেকে ৬ মাসের জন্য সাসপেন্ড হয়েছেন ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা লেখার কারণে৷ জয়দেবের মতে, ‘আসল কারণটা নোংরা’৷ এ অভিজ্ঞতা শুধু জয়দেবের না মৌলিক সৃজনশক্তি সম্পন্ন বহু বামমার্গী কবি-সাহিত্যিকের ঝুলিয়ে রয়েছে এমন তিক্ত সঞ্চয়৷ তথাপি জয়দেব পার্টি ছাড়েন নি৷ একটা শনিমন্দির নির্মাণে উৎসাহী স্থানীয় পার্টি সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন জয়দেব, আক্রান্ত হন৷ লোকাল কমিটি তাঁর আক্রমণকারীদের প্রশ্রয় দিলেও, রাজ্যকমিটির প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন! ১৯৯৪ এর আগস্টে লেখা তাঁর সেই বহুপঠিত কবিতার একাংশ :
এল-সি বলেছে, একা কোন কাজ নয়
হঠকারীরাই কেবল ওসব করে
এল-সি বলেছে, আমাদের আগে মানো,
রাজ্য-কমিটি যা-বলছে সেটা পরে৷
(আমার লোকাল কমিটি/আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ)
আদতে সেটা জয়দেবের স্বপ্ণভঙ্গের কাল৷ ফলত তাঁর পঙ্ক্তিমালায় চুঁয়ে চঁুয়ে পড়েছে এক অসহ্য আর্তনাদ:
‘‘কী বেচছে তারা? এতদিন যত মুক্তো
চোখের মণিতে লালন করেছি--- তা-ই
এতদিন যারা ছিল ইমনের রক্ষী
মোটামুটি আজ ফিরিলা সববাই৷

দেখি, একলাই চলেছি, শিরস্ত্রাণ
খসে গেছে কবে, আড়ষ্ট অঙ্কুশ
শোনো আমি এক উত্তর-ফাল্গুনী,
বীর নই, কাপুরুষ৷’’
(আমার পুরসভা অঞ্চল, আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ)
পার্টিচালিত গণশক্তি ও নন্দন পত্রিকার কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও, জয়দেব ভেতরে-ভেতরে সরে গেছেন পার্টির কাছ থেকে৷ পার্টি কর্মসূচির সঙ্গে শতকরা ৯৯ ভাগ সহমত সত্ত্বেও, কমিউনিস্ট-সংস্রব তাঁর কাছ শেষপর্যন্ত অসহনীয় মনে হল--- ‘‘একটা কথা অনেকদিন ধরেই মনে হচ্ছে--- আজ পষ্টাপষ্টি লিখেই ফেলি৷ কমিউনিস্টদের সঙ্গে বোধহয় দূর থেকে সুসম্পর্ক রাখাই শ্রেয়৷’’ বিহারে সি পি আই (এম.এল) এর সশস্ত্র সংগ্রামে মুগ্দ জয়দেবের তীক্ষ্ন শ্রেষ : ‘‘কিছু ভীতু, অশিক্ষিত, হামবড়া মধ্যবিত্তের বাচ্চা এখন পশ্চিমবঙ্গ চালায়৷’’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিক্রিয়া : ‘‘সি পি আই (এম) ভয়ংকর দল৷ মৃত শত্রুও তার কাছে সহনীয় নয়৷’’ একমাত্র জ্যোতি বসুই কিছুটা আস্থাভাজন মনে হয় তাঁর৷ রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য আরো বিস্ফোরক : ‘‘সে ভদ্রলোক, অনিল বিশ্বাস, তো রাতকে দিন এবং দিনকে রাত করতে পারেন’’৷ এমনকি অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পর জয়দেব বসু লিখলেন : ‘‘আমার জীবনের ১০/১২ বছর শেষ করে দিয়েছিলেন এই লোকটি’’৷ (২৬.০৩.২০০৬) এ লেখার পর আরো ৬ বছর বেঁচে ছিলেন জয়দেব৷ একটা আঁচড়ও পড়ে নি বঙ্গলিপির সাদা পৃষ্ঠায়৷ এক প্রগাঢ় হতাশা হয়তো তাঁকে সরিয়ে নিয়েছে ডায়েরির কাছ থেকেও৷
   সাহিত্য-সংসৃকতি বিষয়ে জয়দেব বসুর বিশ্বাসের ভুবনে মার্কসবাদের যান্ত্রিক প্রয়োগ অচ্ছ্যুৎ৷ হাত-তোলা-মার্কা সাহিত্যে তাঁর বিবমিষা৷ এ বিষয়ে জয়দেবের ধারণা অনেকটাই স্পষ্টতা পেয়েছে ‘হোপ-৮৬’ প্রসঙ্গে৷ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর এই আয়োজন নিয়ে তীব্র বিতর্ক পার্টির ভেতরে ও বাইরে৷ সেই অনুষঙ্গে মুক্তিচিন্তক জয়দেব একটা গুরুতর প্রশ্ণ তুলেছেন৷ ‘‘শুধু পচাগলা এই সংসৃকতিই বা কেন, তলিয়ে ভাবলে, তথাকথিত গণতান্ত্রিক সংসৃকতির সঙ্গে আপোষ করাও ঠিক নয়৷’’ বুঝতে অসুবিধে হয় না, সি পি আই (এম) এর শাখা সংগঠন গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-এর দিকেই তাঁর অঙ্গুলিনির্দেশ৷ ‘‘এদের কাজকর্ম এত নিস্প্রাণ যে গা ঘিনঘিন করে ওঠে৷ মৌলিকভাবে জীবনটাই আসল৷’’ সেই চল্লিশের দশক থেকে বামপন্থী সংসৃকতির ঘরানা তাঁকে এতটুকু মুগ্দ করেনি৷ একচক্ষু হরিণের মতো জীবনকে দেখতে চান নি বলেই, জয়দেব বসু বলতে পারেন :
‘‘মার্কস পড়ো, সংখ্যাও পড়ো
ঝাণ্ডাকবিদের মতো সরিয়ে রেখো না পাশে হিমেনেথ৷’’
স্বাভাবিকভাবেই এই ‘ঝান্ডাকবি’রা সময়সুযোগ মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে জয়দেবের ওপর৷ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির হাতে যত মার খেয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ত ঝরেছে ‘আত্মীয়’-দের হাতে৷ অথচ ‘সুস্থ, চনমনে, বুদ্ধিমান এক পার্টিজান সংসৃকতি’র কথাই তো ভেবেছেন জয়দেব৷ আর একটা ‘জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়’ বাংলা ভাষায় লেখা হল কই, কমরেড?
বঙ্গলিপির এই পৃষ্ঠাবদ্ধ অক্ষরগুলি আসলে এক তরুণ কবির ‘শ্বাসপ্রশ্বাসের গ্রাফ্শীট’৷ নিজের অন্তর্গত যাবতীয় বিষন্নতা, ব্যর্থতাবোধ যেন মাথা কুটে মরেছে ডায়েরির লাইনে লাইনে৷ ‘ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসছে যে লেখা আমার দ্বারা হবে না’ ভাবছেন ২৪ বছরের যুবক৷ অগাধ আত্মকন্ডুয়ন আর অসীম আত্মধিক্কার--- এদুয়ের মাঝে দোলায়মান তিনি৷ ‘আরো ভালো লিখতে হবে, আরো ভালো’, ‘আমার কাজ লেখা, লেখা এবং লেখা--- এ ভাবেই নিজেকে অতিক্রমের চেষ্টায় মরিয়া জয়দেব৷ ‘লেখা আমার দ্বারা হবে না, --- (৩.৩.৯২) এ অতৃপ্তিই তাঁর হাত ধরে লিখিয়ে নিয়েছে এমন সুন্দর সব চরণগুচ্ছ :
‘যখন আমায় নিঃশেষিত ভাবো
তখন আমি উড়াল দিই হাওয়ায়
যখন আমায় দ্বীপান্তরী ভাবো
তখন আমি তোমার ঘরের দাওয়ায়৷’’
শেষের দিকে কবিতা লেখাও কমে গিয়েছিল তাঁর৷ এই বেদনাময় ক্ষমাহীন আত্মধবংসের একমাত্র কারণ শুধুই অ্যালকোহল? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়৷ ৩.৩.৯২-এর ডায়েরিতে স্বগতোক্তি: ‘‘আমি বোধহয় অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছি৷ এটাই দুশ্চিন্তার৷ কারণ, এর বিরুদ্ধে যে লড়াই জারি আছে বিশেষ, এমনটা নয়৷’’ জয়দেব বসুর ঘনিষ্ঠ কবি চিরঞ্জীব বসু, তাঁর মৃত্যুর পরে এক স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘‘জয়দেব অভিমানী ছিল, নৈর্ব্যক্তিক এক অভিমান যা অনেকের কাছেই ঔদ্ধত্য বলে মনে হত৷ ঐহিক অমনযোগ ছিল ওর চোখ দুটোতে৷ এবং এতটাই ছিল যেন মনে হত মরুভূমির উট, দুপাত্র কাঁটাগাছ ছাড়া যার চাহিদা বলতে আর অন্য কিছু থাকতে পারে না৷’’ (আজকাল পত্রিকা, ৩ মার্চ ২০১২)৷ এমন জয়দেবের অকাল প্রয়াণ কালের এক নিষ্ঠুর রসিকতা ছাড়া আর কিছুই না৷
‘‘অনন্তের কাছাকাছি কোন এক দীর্ঘ সময় জুড়ে
নির্বিকার শৈত্যের পর--- সন্তানেরা শোনো,
প্রসারণশীল এই অতিবিশ্ব ঢেকে যায় মেঘে৷
স্পন্দন শুরু হয় অতঃপর, ঝাঁকে ঝাঁকে প্লাজমা ফড়িং
আবার উড়াল দিয়ে নতুন নিষেক শুরু করে,
স্পার্তাকুস দেখেছিল মৃত্যুর মুহূর্তে সেই উড়ালের অতিবর্ণালী,
চাটগাঁ-র পাহাড়ের গায়ে
অকালে মরতে তাই টেগারের শোচনা হয় নি৷
তোমরা অপেক্ষা করো,
ফড়িঙেরা একদিন উড়েছিল--- আবারও উড়বে৷’’
(যখন ফড়িংরা ওড়ে)
দুচোখে দুকুলপ্লাবী স্বপ্ণ গেঁথে সমাজবদলের গান শুনিয়েছিল জয়দেব৷ তবু কেন তাঁর ডায়েরির পৃষ্ঠা জুড়ে অন্তহীন বিষাদ, দু-হাত বাড়িয়ে মৃত্যুকে আবাহন? আফগানিস্তানে কমরেড নাজিবুল্লাকে ফাঁসিতে লটকানোর সংবাদে বিপর্যস্ত জয়দেব কেন লিখে যান--- ‘‘কমরেড, তুমি তো মরলে, আমায় ফেলে গেলে কেন?’’ (২৭.০৯.১৯৯৬) এসব নিছকই এক আদ্যন্ত রোমান্টিকের মৃত্যুবিলাস? কোথাও কি অভাব ছিল শুশ্রূষার? কিছুই জানি না, আজ জেনে লাভই বা কী?
২০১৬-তে ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’ প্রকাশিত জয়দেব বসুর ‘ডায়েরি থেকে’ পাঠ শেষ করে, স্তব্ধ হয়ে যাই স্তম্ভিত বিষ্ময়ে৷ সে-বিস্ময় এক মহৎ প্রতিভার অপচয়ের শূন্যতায়৷ 
জয়দেবের মৃত্যু, কেন জানি না, আমাকেও অপরাধী করে দেয়৷

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা ২০২০ সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন