মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০

দীপক লাহিড়ী ।। খন্ডবৈচিত্রের জর্নাল :'সময়ের ঘর'

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০



দীপক লাহিড়ী ।। খন্ডবৈচিত্রের  জর্নাল :'সময়ের ঘর'



সময়কে কাছে টানা যায় না---দিনের স্রোতে সে ক্রমাগত হারিয়ে যেতে থাকে।অনেকটা আমাদের বাড়ির বিশাল গোলাকৃতি শ্বেতপাথরের টেবিলের মতো।দিন যায় স্মৃতি থেকে যায়,রঙিন বেলোয়ারি কাচের ঝাড়লন্ঠনের খন্ড অস্তিত্বগুলোয় হারালো একদিন।তাতে আলো পড়লে কতরকম রঙের বিচ্ছুরণ হতো!সত্যিই দৃশ্য মূলত কাব্য।এ আমার আমি কোথায় যাচ্ছি কেনো যাচ্ছি নিজেরই ঠাওর থাকেনা।জানলার ওপারে খোলা আকাশের নিচে আমার জ্ঞানহওয়া ইস্তক দেখা একটা তালসুপুরি গাছ এখনও তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে।এখন আমি প্রকৃতঅর্থে আবরণহীন।অনেক খন্ডবিভক্ত,সবগুলো ঠিকমতো জোড় লাগেনি।আমার আনন্দ যখন অন্যজনের বেদনা হয়ে ধরা দেয় তখন তাতে কোনো আস্তিক্যের সুর থাকেনা।আমরা কী পথভোলা পথিক কিংবা 'মিউট ইনগ্লোরিয়স মিল্টন'--যিনি তর্কাতীত অন্ধতার পরে রচনা করেন সনেটগুচ্ছ বা হার্টক্রেন কবির মতো আমি কী খুঁজে নিতে পারি নির্জন লেভেলক্রসিং-এ আত্মহননের পথ!কবিতার অভিমুখ ধরে নাড়া দিলে তৈরি হয় নিস্তরঙ্গ মায়াজাল।সেখানে কোনো 'ব্লাসফেমি'-র প্রয়োজন পড়ে না।শান্তিনিকেতনে এক চরম অন্ধকার রাত্রিতে অস্তিত্বের ছবি বোঝাতে চেয়েছিলেন শিল্পী রামকিংকর,আমি বা বাপিদা সেদিন কেউই ঠিকমতো বুঝিনি!যেমন পিকাসোর কিউবিজম বা সালভাদোর দালির চিত্রাঙ্কন অনেকটাই অধরা থেকে গেলো আমার।প্যারিসের 'লুর্ভ'( Louvre) মিউজিয়াম-এ দাঁড়িয়ে চিত্রকলার চিত্রিত মায়ায় যেমন দ্য ভিঞ্চি-কে একটা স্বপ্ন ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারিনি।
All the years of life
I walked around looking
                         for them
                (Pablo Neruda)
আমার চতুর্দিকে পালামৌর নির্জন বনস্থলীর হলুদ বিবর্ণ পাতা ঝরে পড়ে,লাতেহারে 'হো' রমণীরা বিক্রি করে শালপাতার ডোঙায় ভরা হাঁড়িয়া।বনজ গন্ধ আর তারাভরা রাতে চাঁদের আলোয় গাছের কোটর থেকে কোনো রাতপাখির ডাক শোনা যায়,হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় মহুয়ার গন্ধ।মনে হতো কী অদ্ভুত মায়া এই পৃথিবীতে!কবিতা মনে পড়ে যেত :"দেহ হোক মন,মন হোক প্রাণ,প্রাণে হোক মৃত্যুর সংগম"।-(দ্রৌপদীর শাড়ি/বুদ্ধদেব বসু)।
কজন মানুষের নৈরাত্মসিদ্ধি সম্ভব কিংবা কালকবিতার কাছে আত্মসমর্পণ?নিঃসঙ্গ,নিরীশ্বর মহাজগৎ থেকে নেমে আসে তাবৎ ভাবনা আর ভাবনাগুলো যখন জটপাকিয়ে যায় তখনই আলবেয়র কামু-র 'মিথ অফ সিসিফাসে' ঘনিয়ে ওঠে অসম্ভব প্রতর্কের মেঘ--'The divorce between a man and his life'.।
অন্য ভাবনায় আবার মন শান্ত হয়,বিশ্বচৈতন্যবাদ বা মরমিয়াবাদের কাছে যখন আত্মসমর্পণ করি।এক রোমান্টিক মিস্টিসিজম শ্রাবণের ক্ষ্যাপা মেঘের মতো মনের দখল নেয়।অবিশ্রান্ত বৃষ্টির আওয়াজে সে বলতে থাকে :"দুচর এখন রহস্যময়/তোমার হাতে অনেক সময়"--শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
এমনকরেই একদিন ঘরের দেখা মেলে,তারজন্যে শতদ্রু,বিপাশার তীরে যেতে হয়না---সন্তোষপুর,বেহালা,মুন্সীরহাট যথেষ্ট।ফকির লালন সাঁই বা গগন হরকরা নয় বরঞ্চ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন দিয়ে এই লেখার ইতি টানি : 'কী ঘর বানাইছে দ্যাখো সাহেব কোম্পানি/এক অঙ্গে লক্ষমুখ শতেক বাখানি/কী ঘর বানাইছে দ্যাখো সাহেব কোম্পানি'।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন