মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০

সুমিতাভ ঘোষাল ।। না জেনে জাঁ জেনে প্রবীর দাশগুপ্ত

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০


সুমিতাভ ঘোষাল ।।  না জেনে জাঁ জেনে প্রবীর দাশগুপ্ত


কয়েক বছর আগে ‘বোধশব্দ’ নামের একটি পত্রিকা একটি অদ্ভুত সংখ্যা প্রকাশ করেছিল৷ সংখ্যাটির বিষয় ছিল ‘কবিতা যেমন দেখায়’৷ অদ্ভুত বললাম এই কারণে যে এইরকম একটা বিষয় নিয়ে যে গোটা একটা সংখ্যা হতে পারে তা ভেবে ওঠাও বেশ কঠিন৷ কবিতার শরীর৷ অর্থাৎ কিনা, কবিতার ভাষা, ছন্দ, বার্তা--- এসব তো কবি লিখবেনই৷ কিন্তু একইসঙ্গে কবিতাটা কিরকম দেখতে হবে সেটাও তো কবিরই নির্মাণ৷ তো, সেই নির্মাণ কি কবি যখন কবিতাটা লেখেন বা ভাবেন তখন কি তার মনের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায়? নাকি যখন ভাবেন তখন তৈরি হয়, না যখন লেখেন তখন তিনি তা নির্মাণ করেন? অনেক কবি আছেন যাঁরা প্রচলিত কবিতার যে আকার তার বাইরে গিয়েও অনেক রকম আকার দেন৷ ফুল, পাখি, পিরামিড--- এইরকম নানা রকম আকারের কবিতা৷ এছাড়া প্রচলিত কবিতার অবয়বেও তো নানান রকমফের আছেই৷ গদ্য কবিতা একরকম, সনেট একরকম, কাপলেট আরেকরকম৷ তো কবিতার এই যে নানানরকম আকার এতে কি কবিতার ভাব বা আত্মাতেও কোনও রকমফের ঘটে যায়? আমি ঠিক জানি না৷ আমি নিজেও যে নানানরকম শরীরের কবিতা লিখি সেটাও কেন লিখি ঠিকঠাক বলতে পারব না৷ এটা জানা যে খুব জরুরী তা নয়৷ কিন্তু জানতে ভারি ইচ্ছা করে৷ এই নিয়ে লেখালিখিও খুব একটা পড়েছি বলে মনে পড়ে না৷ তবে অনেকদিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘অন্য দেশের কবিতা’ নামের একটা বই পড়েছিলাম৷ খুব বিখ্যাত বই৷ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কবির কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং তাঁদের কবিতার অনুবাদ৷ সেই বইতেই কোনও এক কবির বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে সুনীল লিখেছিলেন যে, ওই কবি ইংরেজি ভি অক্ষরটি ব্যবহার করতেন এইজন্য এবং এইভাবে যে পাঠকের সামনে যোনির একটা প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে৷ কোন কবি সম্পর্কে এটি লিখেছিলেন আমার এই মুহূর্তে সেটা মনে পড়ছে না৷
একথা বলাই যায় প্রথাগত যৌনতা সম্পর্কে গড়বাঙালির যা ধারণা, অথবা জীবনপ্রণালী বলতে বাঙালি যা বোঝে তার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে ছিল প্রবীর৷ আমরাও আছি৷ জীবনকে, যাপনকে এভাবে চ্যালেঞ্জ করবার স্পর্ধা বাংলা কবিতায় প্রবীরের আগে খুব বেশি ঘটেনি৷ প্রেম আর যৌনতা যে বস্তুত অস্তিত্বের আরেক মাত্রা এবং একই ভাবে মুদ্রার পরস্পর বিপরীত দিক, যা আসলে সমার্থক--- এই ট্যাবু প্রবীর মেনেছিল প্রত্যয়রূপে, যাবতীয় ভন্ডামির ট্যাবুকে অস্বীকার করেই৷ কবিতা ও যাপন প্রবীরের কাছে সমার্থক ছিল৷ বস্তুত ও কবিতায় জীবন-ই লিখতে চেয়েছিল৷

‘যে-জন্ম আমাদের ঝাঁঝালো কেসুতপাতা মদ
তার কি অনর্থ হ’তে আছে
ঘাসের বাহান্নপথে পোকাদের হাঁটিহাঁটি গ্রাম
কেউটের এলেবেলে বিষ পড়ে থাকে
যে-ছেলেটি শান্ত আর যে-মেয়েটি আছাড়ি-পিছাড়ি
উহাদের দেখা হোক, শালিখঠাকুর---’

সত্যি কথা বলতে কি, প্রবীর এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে মিথ হয়ে যাওয়া একটি চরিত্র৷ আজ তরুণ কবিদের মুখে মুখে ঘোরে ওর কবিতার লাইন৷ সবে লিখতে আসা ছেলেমেয়েরা যখন প্রবীরের কবিতা পড়তে আগ্রহী হয় তখন একটা জিনিষ বুঝতে পারি কবিতার জোর থাকলে কালের বুকে অনেকদিন টিকে যাওয়া যায়৷ যদি কোনও প্রভাবশালী দাদা বা মিডিয়ার হাত মাথায় না থাকে, কোনও পুরস্কার-প্রাপ্তি না-ঘটে তবুও৷ অকালপ্রয়াত এই কবির জীবৎকালে কোনও বইও বেরোয়নি৷ মৃত্যুর পর বন্ধুরা মিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কবিতা জড়ো করে একটি চটি বই প্রকাশ করেছিল৷ প্রধান উদ্যোগ নিয়েছিল ওর বন্ধু অভীক মজুমদার৷ আমার সংগ্রহ থেকে একটি না-ছাপা কবিতা দিয়েছিলাম৷ প্যাপিরাস থেকে বেরুনো সেই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন যিনি তিনিও প্রয়াত হয়েছেন৷ ভূমিকা লিখেছিলেন প্রবীরের অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু অচ্যুত মণ্ডল৷ যিনি নিজেও একজন নানা কারণেই স্মরণযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব৷ কবি অচ্যুত মণ্ডল অসাধারণ সেই ভূমিকায় প্রবীরকে ডার্ক হর্স অফ মহেঞ্জোদাড়ো নামে অভিহিত করে একটি কবিতা লিখেছিলেন৷ সেই কবিতার শেষ কয়েকটি লাইন এইরকম:

‘এঁকেছে সিন্ধুর লিপি বেদবাক্য গঠনের বেণী
বোঝেনি বিদ্যুৎগর্ভ ‘লোহা ও তামাক মেশা জল’
‘গুটিশুটি সর্ষে-মাছে’ গাঢ়রঙ কলাপাতাটির
নিচু বারান্দার ঘরে অন্ধকার পিঠে নিয়ে ঢুকি
আমাকে ভোরের বাসে তুলে দিয়ে অনিদ্রা অসুখী
রাতে ফিরে গেছো তুমি, ঘুমিয়েছো এখন, প্রবীর?
মরা মাস্তুলের ডেকে স্তব্ধ করে সীগালের ওড়া---
চকিতে পেরোয় মাঠ মহেঞ্জোদাড়োর কালো ঘোড়া’

প্রথমে যে-বিষয়টি নিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, সেটা প্রবীরের কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷  প্রবীরের কবিতায় কবিতা কেমন দেখতে হবে সেটা তো আছেই, কিন্তু আরও যেটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, ওর কবিতায় সেমিকোলন, হাইফেন, ড্যাশ এবং উর্দ্ধ কমা-র ব্যবহার৷ অনেক কবিতাই শেষ হচ্ছে ড্যাশ দিয়ে৷ অর্থাৎ কথা কিছু বাকি রইলো, প্রয়োজনে পাঠকও নিজের মতো বিস্তৃত করে নিতে পারেন৷ প্রবীরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, লোকাচার ও মিথের ব্যবহার৷ এই প্রয়োগ সচেতনভাবে নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছে ওর কবিতায়৷ দেশি এবং বিদেশি মিথ মিলেমিশে গেছে ওর লেখায়৷ কলম্বাসের ডুবে যাওয়া জাহাজের অনুষঙ্গে লেখা ‘পিন্তানিনা সান্তামারি’ কবিতাটি পড়লেই তা বোঝা যায়৷ অস্তিত্বের সংকট ফালাফালা করে দেয় প্রবীরের জীবন ও সময়কে৷ না-হলে এই দীর্ঘ ও আশ্চর্য কবিতাটি বাংলাভাষায় কখনই লেখা হতো না৷ 

‘...ইজের শুদ্ধু খুলে
কতক্ষণ ডুবে থাকি তারপর সেরে উঠে দেখি যে আলোর বন্যা
নীল আলপিন কাঁধে প্রথম চাষীরা যাচ্ছে পুবের জমিতে
রাত্তিরের ভুতো ভয়,সাপখোপ,হিশিমাখা বিছানার
সংস্রব ত্যাগ করে একটি খুকুও জাগল,
চোখের পিচুটি ধুয়ে এইবার সুকলে যাবে-
ওদিকে কাঁকর রাস্তা টেনিসের কোর্ট পাশে ফেলে
একটি সাইকেল আসছে,সামনে জোতা পাঁউরুটির ভ্যান
আর আসছে পোস্টম্যান,হাতের তালুতে তার চিঠি নয়,
এক সেণ্ট মাত্র দাম ব্রিটিশ গায়নার সেই মহামূল্য স্ট্যাম্প
কিন্তু কাঁদছে সে...’
এভাবেই প্রবীর প্রণোদিত করলো আমাদের৷ প্রণোদিত করলো নিজেকেও৷
‘...আমিও হেলায় ছুঁড়ি পর্যটক পাখিদের ডিম
পিজারোর বাহিনীর সাথে এই দেশে এসে
সমস্ত হত্যার সাক্ষী,আমিই আদেশদাতা
পিতৃনাম বালভার্দি, পেশায় যাজক
যদিও প্রাচীন ধর্মে, লোকাচারে, নদী গুহা পাথরের
পুজোর বেদিতে আর রাঙা চোখে-চোখে উন্মাদ সমুদ্রগাথা
এই-সে খানকি মাগি,কর্ষণ চিহ্ণের কাছে
ইনকা লাঙলখানি জেগে আছে জেগেছে প্রমেহ রোগ
শ্বেতপ্রদরের মতো মানুষের ধাতু-দিগ্বিজয়
এবং হে ক্যারাভান আমার কেচ্ছাগুলি
সর্বত্র-ই র’টে গেছে, জেনেছে প্রকৃত বন্ধু
বন্ধুর পরিজন--- এইরূপে বিশ্বময়
দড়ির গিঁটের লিপি সমূহ নাবিক চিঠি আর নীল কবিতার
সানুদেশে...’

প্রকৃত বন্ধু বলতে প্রবীর সেই একক বন্ধুতা থেকে প্রজন্মের স্বীকারোক্তিমূলক যে দাবি তার নিজের সময়ের কাছে করেছে বারবার, একজন প্রকৃত কবি সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ণেই একটা সমগ্র জীবনকে বাজি রাখতে পারে সময়ের কাছে৷ প্রবীর ওর কবিতার কাছে এতোটাই সৎ ছিল যে কবিতায় কেচ্ছা, গুজব, অপবাদ কোনও কিছুকেই অস্বীকার করেনি৷ এখানেই প্রবীর অনেকের থেকে স্বতন্ত্র, সাহসী ও স্মার্ট৷ আর যে-কারণেই বন্ধুমুখে ওকে বলা হতো প্রবীর ছিল , ‘না জেনে জাঁ জেনে’৷ এই পরিচয়েই প্রবীর ছড়িয়ে পড়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা কবিতার বিস্তৃত উঠানে৷
এত কথা বলার একটাই কারণ৷ শুধুমাত্র কবিতা দিয়েই যে স্মরণযোগ্য হয়ে থাকা যায় প্রবীর তার বিরলতম উদাহরণ৷ মৃত্যুর পরেও কিন্তু প্রবীরকে নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়েছে বা প্রবীরের কবিতাকে চিনিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে তা কিন্তু নয়৷ কিন্তু তবু প্রবীরের পাঠক সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ওই একটি মাত্র চটি বই কবিতাপ্রেমীরা খুঁজে খুঁজে বার করেছে এবং পড়েছে৷ জীবিতাবস্থায় একটিমাত্র বই-ও না-বেরোনো কোনও কবির মৃত্যুর কম-বেশি পঁচিশ বছর বাদেও এই জনপ্রিয়তার উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে আর আছে কিনা আমার জানা নেই৷ প্রকাশিত বইটিতে প্রবীরের সব কবিতা সংকলিত করা যায়নি কারণ সব কবিতা সংগ্রহ করা যায়নি৷ সুতরাং, ‘প্রবীর দাশগুপ্তের কবিতা’ নামের বইটিতে যেসব কবিতা আছে তার বাইরেও অনেক কবিতা অ-সংকলিত আছে৷ তবে শুধুমাত্র একটি কবিতা ‘পিন্তানিনা সান্তামারি-র জন্যই প্রবীর অমর হয়ে থাকতে পারে৷ সন্দীপন লিখেছিলেন, জীবিতের শোক মৃতেরা গ্রহণ করে না৷ অসময়ে চলে যাওয়া বন্ধুদের জন্য উৎসর্গ করা পানপাত্র রেখে একথাই উচ্চারিত করতে পারি---

‘ধরতে চেয়েছি বৈদুর্যের আলো 
ধরতে চেয়েছি অক্ষরের খিদে 
ধরতে চেয়েছি ওঁ কারের ধবনি
বদলে উঠে এসেছে মুঠো মুঠো বালি

জয়দেব , শৌভিক , নিবেদিতা ....
নিমেষে নক্ষত্রের উপমা হয়ে গেল
যতই টেলিফোন করি 
নিশাচর রিংটোন বেজে বেজে চুপ করে যায়

মাথার মধ্যে দপদপ করে প্রবীর
দপদপ করে অচ্যুত , দীপঙ্কর , শ্যামল
অলোকচৃর্ণে বিদ্যুতের আলো খেলা করে
নম্বর রাখবো না ডিলিট করবো বুঝতে পারি না

চলকে পড়ে যাওয়া চনমনে সন্ধেবেলাগুলি 
নিথর তাকিয়ে থাকে অনন্তের দিকে
টুকরো সময় সব গবলেটে জমা হয়
মৃতের সম্মানটুকু বড় আদরের , জেনে

প্রবীরের আর একটা বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে উল্লেখ করি৷ যা খুব কম কবির মধ্যেই আমি দেখেছি৷ খুব কম বললেও ভুল বলা হবে৷ আমি অন্তত কারুর মধ্যেই এই গুণ দেখিনি৷ কবিতা লেখার আগেই প্রবীর মনে মনে কবিতাটা রচনা করে ফেলতে পারতো৷ সেটা ও শোনাতোও অন্যকে৷ অনেক সময়ই কবিতাটা পরে লিপিবদ্ধ করতো কবিতাটা৷ আমার বাড়িতে বসে না লিখে মনে মনে ও এরকম দু একটা কবিতা রচনাও করেছিল৷

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা ২০২০ সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত)

1 টি মন্তব্য:

  1. এত তাড়াতাড়ি যারা স্মৃতি হয়ে গেলেন তাদের জন্য
    কালের বাইরে কোনো এক জায়গা দিল লেখাটা
    পড়ে আনন্দ না বিষাদ ভোগ করলাম

    উত্তরমুছুন