শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

এই সংখ্যার বিষয়সূচি ।। মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০

মাসিক কবিতাপত্র-এ আপনাকে স্বাগত



আমাদের কথা ।। ২২ আগষ্ট, ২০২০ ।। মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



আমাদের কথা


 

এই পৃথিবীতে কবিতা নিয়ে যে কোনও রকম উন্মাদনার সঙ্গী হতে চেয়ে ৬ বছর পূর্ণ করে প্রায় নিয়মিত প্রকাশের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে ৭ বছরে পা দিয়েছে মাসিক কবিতাপত্র৷ ২০১৩-র ১৫ আগষ্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি জেলাশহরের লাইব্রেরি কক্ষে প্রথম প্রকাশিত হয় এই কবিতাপত্রটি৷ গত ১৫ আগষ্ট বর্ষপূর্তি অথবা জন্মদিন সংখ্যা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে কবিতাপত্র ৭ বছরে পা দিয়েছে৷ ২০১৬-র ১৭ সেপ্ঢেম্বর বাংলা আকাদেমির অবনীন্দ্র সভাগৃহে দু-দিনের কবিতা উৎসবের আয়োজন করেছিলাম আমরা৷ ১৭ সেপ্ঢেম্বর বাংলা ভাষার অন্যতম কবি বিনয় মজুমদারের জন্মদিন উপলক্ষে কবিকে নিয়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার আয়োজিত হয়েছিল৷ এছাড়া ১৭ ও ১৮ এই দু-দিনের উৎসবে বাংলা ভাষার অনেক উল্লেখযোগ্য কবি অংশ নিয়েছিলেন৷ লকডাউন ঊঠলে আশা করা যায় এ বছরও কবিতা উৎসব হবে৷ আয়োজিত হবে সেমিনার৷ প্রকাশ পাবে বিশেষ সংখ্যাও৷ প্রায় প্রতিটি সংখ্যাই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকাশ করি৷ অবশ্যম্ভাবী ভাবে সঙ্গে থাকে কবিদের কবিতাপাঠ ও মুক্তচিন্তার বিনিময়৷ আমরা আগামী দিনেও এই প্রথা চালু রাখব৷ নতুন কবিদের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হওয়ার মাধ্যম হিসেবে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ 
বেশিরভাগ লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে যা হয় আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হল না৷ পত্রিকার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা গেল না৷ শারদ সংখ্যা ছাড়াও বিশেষ বইমেলা সংখ্যার পর লকডাউন-এ বিশেষ কোয়ারাণ্টাইন সংখ্যার পর এই নবতম উদ্যোগ, সাপ্তাহিক অনলাইন। এই সংখ্যায় প্রকাশিত বিষয়গুলিও যথেষ্ট পাঠক-মনস্কতা পাবে বলেই আমরা মনে করি৷ অনেক প্রিয়জনের বিয়োগব্যথা এই কয়েকমাসে আমাদের সহ্য করতে হয়েছে৷ চলার পথের পরিচিত গাছের মতোই তাঁদের স্মৃতি আমরা বয়ে চলব আজীবন৷ যথেষ্ট ঝঁুকি নিয়ে আমরা এই সংখ্যা প্রকাশ করছি ‘আশায় মরে চাষা’ আপ্তবাক্যটি মাথায় রেখেই৷ এই নেটবন্দী যুগে বসেও আমরা আশা করছি পাঠক পত্রিকাটি অনলাইনে পড়বেন৷ মোবাইল-এ পড়লে  'ওয়েব ভার্সান' অপশন-এ যান, পড়তে সুবিধে হবে। আর আপনার মূল্যবান মতামত 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র' ওয়েবসাইটে জানানোর অনুরোধ রইলো। তাহলেই আমাদের আয়োজন/উদ্যোগ সফল হবে। 

প্রতি শনিবার বেরোচ্ছে 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'। যাঁরা লেখা পাঠাতে চান, ইউনিকোড-এ টাইপ করে মেল করুন। পিডিএফ/জেপিজি-তে পাঠানো লেখা গৃহীত হয় না। 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'-এ লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী বিশদে দেওয়া আছে। অনুগ্রহ করে তা মেনে চলুন। লেখা পাঠানোর মেল আইডি এখানে দিলামঃ masikkavitapatro@gmail.com

বলাবাহুল্য হিরণদা, শ্রদ্ধেয় শিল্পী প্রিয় হিরণ মিত্র-এর এতোগুলি কাজ 'মাসিক কবিতাপত্র'-কে সমৃদ্ধ করেছে। হিরণদাকে আবারও শ্রদ্ধা।

কবিতার জন্য আমাদের পাগলামি চলছে৷ চলবে৷

বিশেষ সাক্ষাৎকার ।। শান্তিদেব ঘোষ

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০






বিশেষ নিবন্ধ ।। সঞ্জয় রায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



সঞ্জয় রায় ।। অচলায়তন 





'সমস্ত সায়াহ্নে আজ। মেঘে মেঘে কেটে গেলো বেলা। অবহেলায়।' আমিই লিখেছিলাম কোথাও। 

এই বিষণ্ণদিনে যদি পুনরায় ভাবি আমি আত্মবিস্মৃত তাহলে পাপের বোঝা বাড়বে বৈ কমবে না। 

কিছু উক্তি মনে পড়ে। শ্রদ্ধেয় কবি অমিয় চক্রবর্তীর লেখায় জেনেছি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,"সামনে কী আছে জানিনা।যে পথ দিয়ে এসেচি তার দিকে ফিরে চেয়ে আশ্চর্য লাগে। বাঁকে বাঁকে এর অভাবনীয় মুহূর্ত,কত পালা বদল,পরিবেষ্টনের ইতিহাস।"আবার তিনি বলেছিলেন"শান্তিনিকেতনের কোণায় এলাম,নিরাভরণ উৎসব জমে উঠল,নানা জাতির মানুষকে নিয়ে মেলবার পালা।রবীন্দ্রনাথ ভীত ছিলেন তাঁর নিজের হাতের গড়া এই খোলা আশ্রমের বেঁচে থাকার আশঙ্কায় তাই বলেছিলেন "আজকের অতি ধূসর পৃথিবীতে যে-দৃষ্টির বলে বিশ্বভারতী গড়া হয়েছে তার রহস্য ভেদ করতে মানুষের সময় লাগবে।"আশঙ্কা করেছিলেন বলেই হয়তো বহু ভাষী এই দেশ আজ বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে। 

আমার জীবনের কৈশোরে প্রথম রবীন্দ্র পাঠ যা দিয়ে শুরু,হয়তো আপামর বাঙালিরও, তাতে জেনেছিলাম, প্রথম অনুভব করতে শিখেছিলাম যে জল পড়লে নাকি পাতা নড়ে।হ্যা নড়ে। কিন্তু আজকের এই অচলায়তনে সেই কিশোরবেলার অনুভব কিছুটা ম্লান, ভাবতে খারাপ লাগে। না, হয়তো পাতা নড়ে না। এটাই বাস্তব। স্বৈরাচারী আগ্ৰাসনে আজ পাতা নড়ে না। আয়তনের উত্তর দিকে আঁক কাটার অপরাধে সে অপরাধী। সেই ১৯১২। প্রচলিত সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে মুক্তিবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার জয়গান। সেই সময়ের সমকালীন রক্ষনশীল হিন্দু সমাজ এই নাটকটি পড়ে বিরক্ত হয়েছিল।আজ ২০২০।আজো এই সংশোধনাগার। পরিবেষ্টন। দেয়াল। বিভাজন। বর্বরতা। কেননা আজো "ছাগলোমশোধন" শিখতে হবে। "দ্বাবিংশপিশাচভয়ভঞ্জন" শিখতে হবে। না হলে অচলায়তনের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেবো কোন লজ্জায়?মেনে নিচ্ছি, কালের বিবর্তনে ক্রমে ক্রমে অধোগতি মেনে নিতে হয়। হচ্ছে। হয়তো খোয়াইয়ের বুকে পঞ্চবটী বেঁচে থাকলো না। শুকনো মাঠ জয় করেও ছায়াতরুময় বিদ্যায়তন অচলায়তনে পরিণত হলো।অপসংস্কৃতি মেনে নিতে হচ্ছে। তাই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-দর্শন কে শিক্ষা-ধর্ষণ করতে আমাদের লজ্জা নেই। Education আর Perfection এবং Divinityর Manifestation নয়। যা স্বামীজী বলে গিয়েছিলেন। Divinity আশ্রয় নিয়েছে বুলডোজারে। Perfection সশস্ত্র হামলায়। বিশ্বভারতীর  ইতিহাসে রাবীন্দ্রিক ভাবধারার অবমাননা নতুন কিছু নয়। যা প্রায় কয়েক দশকের। এই বৈরীতা আজ আবার নতুন রূপ পেলো। কেন এলো এই আধিপত্য বিস্তারের ঘৃণ্যতম মনোভাব? কোন রাজনীতিবলে? 


আজ রবীন্দ্রভাবধারা অবলুপ্ত প্রায়। বিদ্যাসাগরের উপর চারিত্রিক কলঙ্ক। বাঙালি কি পথভ্রষ্ট তবে? 
কিছুকাল রবীন্দ্রগানের চর্চা করেছি এই প্রতিষ্ঠানে। 
আমার রবীন্দ্রনাথকে চিনতে। যা একান্ত আমার। আপন। কেবল মেধায় নয়। অনুভবে। সন্ধ্যার ম্রিয়মাণ আলোয় কাফি কিংবা বেহাগে।উত্তরায়ণের পাশ দিয়ে আপনমনে হেঁটে যেতে যেতে প্রত্যহ দেখতাম "আনন্দ রূপমমৃতং যদ্বিভাতি একমেবাদ্বিতীয়ং" অর্থাৎ এক এবং অদ্বিতীয় তিনি যিনি অমৃত আনন্দ রূপে বিভা বিতরণ করেন।বিভা।এক অনন্তময় বিভা।যা নিহিত আছে রবীন্দ্র চর্চায়।গীতবিতানের হলুদ পাতায়। 

জানি,প্রোমোটারি রাজনীতিতে আজ খোয়াই বিধ্বস্ত। ভোগবাদী যাপনে আদিবাসী রমনী লালসার শিকার।তাই কি এই সীমান্তপ্রহরী? এই প্রাচীরভেদ? আশাকরি কবিকাহিনীর সেই লেখা মনে আছে সংবেদনশীল বাঙালির: 

"যা দেখিছ, যা দেখেছ, তাতে কি এখনো 

সর্বাঙ্গ তোমার, গিরি, উঠেনি শিহরি? 

কি দারুণ অশান্তি এ মনুষ্যজগতে, 

রক্তপাত, অত্যাচার, পাপ, কোলাহল..." 

যে সংবেদনশীল সত্যদর্শিতার সাহস নিয়ে যিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁর পুঞ্জীভূত বাঙালির আবেগ আজ সংঘর্ষের মুখোমুখি। প্রাসঙ্গিকতার সংশয়ে অপেক্ষমান।দলিত শিক্ষা আর দলীয় রাজনীতির কাঠগড়ায় অপরাধী। 

তাই সমস্ত বিতর্ক ছেড়ে ফিরে যেতে চাই সেই "জল পড়ে,পাতা নড়ে" কৈশোরে। অনুরণন পেতে চাই সেই গানের "তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে/কেউ তা জানেনা"।কিংবা "গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা/আমার যা কথা ছিল,হয়ে গেল সারা..." 

হ্যাঁ, সারা তো হয়েছে তাঁর। সবকিছু বলা। 

পড়ন্ত আলোয় এই ম্রিয়মাণ বেলায় এসে এই তো রবীন্দ্র অনুভব, শিক্ষা, আমার একান্ত রবীন্দ্রনাথ। 

স্বার্থান্বেষী সীমানা প্রাচীর নয়।সবার সাথে রঙ মেলানোর খেলা। তাই তো আশা জাগে। যারা তথাকথিত স্বার্থের উর্ধ্বে, তাঁরা আজো রবীন্দ্র বিস্মৃত নন। বিস্মরণেও আছে আজো আঁকড়ে থাকার ভবিষ্যৎ রবীন্দ্রনাথ।ভাসতে ভাসতেও ধরে থাকা শেষ খড়কুটো। 

সাম্প্রতিক ঘটনাবলী প্রতিবাদযোগ্য। 

পরিশেষে চারটি পঙক্তি দিয়ে শেষ করবো: 

সমস্ত ছিনিয়ে নিতে পারো
বাতাস পারো না। 

পারো না ছিনিয়ে নিতে মাঠ, ফুল, উন্মুক্ত বাগান

একটি সম্পূর্ণ মাঠ গড়ে দেবো শৃংখলের দামে। 





ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট/রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে




ছবিঃ হিরণ মিত্র

(গত সংখ্যার পর)


৯. ঘটকবাড়ি


তোমাদের বাড়ির একটা পোশাকি নাম থাকলেও ঘটকবাড়ি বলেই সকলে ডাকে৷ বাড়ির সামনে প্রাচীন কামিনীগাছে এই শেষগ্রীষ্মে থোকা থোকা সাদা ফুল, ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে সাপ আসে৷ বর্ষায় ভেজা গাছের নিচে ঝরে পড়ে থাকে সেই কামিনীফুল৷ দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যায়৷ ফটফটে ছোটো ছোটো অজস্র ফুলের এক আশ্চর্য সৌন্দর্য৷ গন্ধে এক অদ্ভূত মাদকতা৷ আকাশের আলো-অন্ধকার এসে জমে থাকে সেই গলিপথে৷ নির্বিকার সত্যের মতো এক জান্তব বাস্তব এসে ঘিরে ধরে তোমাকে৷
তুমি গা ধুয়ে বারান্দার আলসেতে দাঁড়িয়ে আরেকটা বিকেল পার করো৷ বড়দা হাইকোর্টে৷ ব্যারিস্টারি৷ আরেকজন টালিগঞ্জে সাদাকালো সেলুলয়েডের নায়ক৷ দাদারা সবাই খুবই ব্যস্ত৷ তোমার জন্য কারোর আলাদা করে সময় দেওয়ার নেই৷ পাড়ার পরিচিতদের মধ্যে যে দু-একটি পরিবারের সঙ্গে তোমাদের বাড়ির যোগাযোগ, তার মধ্যে একমাত্র কৃষ্ণেন্দু তোমার কাছে আসে৷ ওই ছোট্ট ছেলেটা কখনও কখনও তোমার সঙ্গে লুডো খেলে৷ সারাদিন একা থাকতে থাকতে তুমি কখন যেন হাঁপিয়ে ওঠো৷ মাঝেমধ্যে তুমি তোমাদের পেল্লাই বাড়ির কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকো৷ চুপচাপ৷ কৃষ্ণেন্দু কিছুই বোঝে না৷ বোঝে না কামিনীফুলের গন্ধে কেন সাপ আসে! কেন অনেক রাতে তোমাদের প্রকাণ্ড ছাদে কেউ পায়চারি করে! এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে! শুধু কুয়াশার মতো স্মৃতির আস্তরণ চারিদিকে৷
তোমাদের বাড়ির একটা পোশাকি নাম যেমন হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে তোমাদের বাড়ির গোলাপায়রার দল, তেমনি কখন যেন হারিয়ে গেছ তুমি, শতরূপা, তিন ভাইবোনের সবার ছোটো৷ কৃষ্ণেন্দু বোঝে না৷ সকলের ছোটো তুমি তাই তোমাকে ছোটকুপিসি ডাকে ও৷ গাছের তলায় এই শেষগ্রীষ্মে থোকা থোকা সাদা কামিনী পড়ে থাকে৷ কেউ কুড়োয় না৷ দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যায়৷


১০. ঝিমলি এখন


একটা ল্যাম্পোস্ট, তীব্র আলো ঝরানো হ্যালোজেন আর ঘন হয়ে আসা নীরবতার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠে এই চুইংগাম-সভ্যতা৷ দুজনের মধ্যেকার একান্ত সম্পর্ক কখন যেন শূন্যতায় ভরে গেছে৷ এখন শুধু ভিড়ের মাঝে দূর থেকে হঠাৎ ভুল করে চোখে চোখ৷ মুহূর্তে হারিয়ে যায় সহজ সাবলীলতা৷ রক্তশূন্য হয়ে যায় ঠোঁট৷ কতোবার ডায়াল করেও কেটে দেওয়া নাম্বার৷ নরম শরীরে ঘন হয়ে জমে ওঠে ছত্রাক আর শ্যাওলার মেঘ৷ সময়ের গোপন অঙ্কুরে তুমি জল দাও৷ আলো দাও৷ তোমাকে ঘিরে রাখে কিছু লোভীচোখ আর হিংস্র কিছু জিভ৷ তুমি আরও একা হয়ে যাচ্ছো আত্মীয়বলয় ভিড়ে৷ তোমার শরীরে ছায়া নেই৷ বৃষ্টি নেই৷ কখন ছেড়ে চলে গেছে প্রিয় ফুল আর প্রজাপতির দল৷ সংস্কারের কঠিন চশমা এসে ঢেকে দ্যায় তোমার কাজলকালো প্রেম-প্রেম দুইচোখ৷
এই দৃশ্যে ঝিমলি একা৷ ক্যুরিঅর-সার্ভিস এসে ফেলে দিয়ে যায় অতীত আবেগের ধারাপাত৷ ধূধূ শূন্যতার বালি এসে ঝরে যায় হৃদয়গভীরে৷ ঝিমলির শরীরের রিড ছুঁয়ে বেজে ওঠে বিচ্ছিন্ন বিষাদের সুর৷ ক্রমশ একা হয়ে যেতে যেতে প্রতিহিংসার ক্ষুব্ধ আগুনে পোড়ে ওর মাথা, বুক৷
অথচ ঝিমলি আজও গান শোনে রোজ৷ গান গায়৷ স্নান সারে৷ উপোসী শরীর ছুটে যায় প্রতিযোগিতার নকল-স্বয়ম্বরে৷ ফাঁকা ছাদে টুপটুপ ঝরে পড়ে হিম৷ চতুর্দিক ছেয়ে যায় বাঁধভাঙা আবেগের ঘন কুয়াশায়৷ ভুতুড়ে ছায়াশরীরের মতো জেগে থাকে লম্বা লম্বা বাড়ি আর নিষ্ঠুর ল্যাম্পোস্ট৷ উজ্জ্বল জোনাকির আলোয় সবুজ গ্রহের বুকে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে স্বপ্নবিশ্বাস৷ তার বুক ছুঁয়ে যায় ঢেউ৷ অশ্রুঢেউ৷

অথচ ঘুম ভেঙে গিয়েছে কখন! চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির৷নরম রোদ ছড়িয়ে আছে সোনালি রঙের আভায়৷ নিশ্চিন্ত শুয়েছিলে তুমি গতরাতে! তুমি নিশ্চিত! জানো না৷ কারা যেন সবকিছু ভুলে আমোদে জড়িয়ে পড়েছে--- জড়িয়ে পড়েছে উৎসবে৷ উৎসব! এতো শব্দ চারিদিকে এতো চিৎকার! কিসের খেলায় যেন সবাই মেতেছে---৷বানভাসি চারিদিক৷ দিকে দিকে আমি তুমি আর তুমি আমি৷অন্যদেশ থেকে ভেসে আসা মৃতদেহের স্তূপ আর শরনার্থীর দল৷তুমি আশ্রয় দেবে কি দেবে না তা নিয়ে নিদান দিচ্ছো৷অথচ নিজের বাড়ির গণ্ডিতেও তুমি কি নিরাপদ! তুমি নিশ্চিত! জানো না৷ক্রমশ অসহিষ্ণু চারিদিক, এতো ঈর্ষা এতো সন্দেহ! অন্যের মশাল আজ তোমাকে পোড়াচ্ছে৷ তোমার মশাল কাল অন্যকে ---? তুমি জানো না৷ঘুম ভেঙে গিয়েছে কখন! চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির৷ নরম রোদ৷ আলো৷ নিশ্ছিদ্র আশ্রয়৷আজ উৎসব৷ আজ আনন্দের দিন৷


১১. নিয়ন্ত্রণরেখা: নভেম্বর, ১৯৯১


প্রথমদিন সোমদত্তা গাঢ় গেরুয়া রঙের কামিজ ও কালো জিন্স পরে দ্যাখা করেছিলো৷ তারপর এই ক’বছরে ও প্যাণ্ট বা শালোয়ার ছেড়ে নিয়মিত শাড়ি পরা শুরু করেছে৷ বিভিন্ন রঙের শাড়ি৷ এখন ভুলেও প্যাণ্ট বা শালোয়ার পরে আসে না৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই ক’বছরে ও যে কতো রকম শাড়ি পরেছে তা কৃষ্ণেন্দুর মনে থাকে না৷ 
একদম প্রথম, সেদিন, কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে ও রেস্টুরেণ্টে বসলো--- ‘ইউটোপিয়া, বার কাম রেস্টুরেণ্ট’--- মুখোমুখি৷ একহাত দূরে৷ দুজনে ঘাড়নিচু অনর্গল কথা৷ মাঝে মাঝে সোমদত্তার ঘনশ্বাস অফ্ হোয়াইট টেবিলের উপর পেতে রাখা কৃষ্ণেন্দুর দু’হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো৷ কৃষ্ণেন্দু নিজের হাত সরিয়ে নিতে চাইছিল না৷ একটা কেমন শিহরণ, ভালো-লাগা, উন্মাদনা৷ সোমদত্তার দু’হাত নিজের কোলে৷ টেবিলের উপর ধূমায়িত কফির কাপদুটো তাপ পরিত্যাগে ক্রমশ ঠাণ্ডা৷ 


---জানো, আজ সকালে মায়ের সঙ্গে খুব তর্ক করেছি৷ জয়া মিত্র নাকি তার বইয়ে বানিয়ে বানিয়ে সব কল্পকাহিনি লিখেছেন৷ মায়ের অফিসের রতনকাকু মাকে এসব বলেছে৷ আমি মা-কে বললাম, তুমি আগে নিজে বইটা পড়ো, তারপর বোলো৷ সত্তরের দিনগুলোকে তোমরা অস্বীকার করতে পারো?
হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি৷ ভার্টিকাল কালো সরু স্ট্রাইপ৷ সম্ভবত তাঁত৷ কবজি পর্যন্ত চাপা কালো রঙের ব্লাউজ৷ একটু উঁচু করে পেছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধা চুল৷ হর্সটেল! অতি সূক্ষ্ম হালকা প্রসাধন আজ সোমদত্তায়৷ গালে ছিটেফোঁটা ব্লাশারের ছোঁয়া৷ সরু লাল ঠোঁটে লিপগ্লস৷ আঁখিপ্রান্তে কাজল৷ চোখদুটো আরও বেশি ব্যক্তিত্বময় আজ৷ কৃষ্ণেন্দু চুপ করে বসে ওর কথা শুনছিলো আর নিবিষ্ট চোখে তাকিয়েছিলো ওর নরম সরু ওষ্ঠদ্বয়ের প্রতি৷
---কি হলো, চুপ করে বসে আছো যে! কফি খাও৷ দ্যাখো কৃষ্ণেন্দু, একটা কথা আমি তোমাকে বলতে চাই যে, আজ যা ঘটছে, বিশেষত রাশিয়ায় যা ঘটলো, তার কি ব্যাখ্যা আছে তোমার কাছে? মানুষকে যে আফিম খাইয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায় না আবার তা প্রমাণিত হলো৷ রেড-আর্মি গিয়ে দিকে দিকে কমিউনিস্ট শাসন চাপিয়ে দিলো আর কমিউনিস্ট দুনিয়া তৈরি হয়ে গ্যালো? হোঃ---
---কিন্তু এ কথাটা তো তুমি নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারো না সোমদত্তা যে মার্ক্স নিজেই বলেছেন যদি ঠিকঠাক ধনতন্ত্রের কামড় চেপে না বসে তবে কখনই সাম্য আসবে না৷
সোমদত্তা এবার বিরক্ত৷ উস্খুস করছে৷ বাঁ হাত তুলে ঘাড়ের পাশটা একটু চুলকুলো৷ মরালগ্রীবা সোমদত্তার শরীরের হাঁস-হাঁস এই জায়গাটা কৃষ্ণেন্দুর সবচেয়ে ফেবারিট৷
---সুতরাং সোমদত্তা, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঘটনা সারা পৃথিবীতে ঘটছে তা সবই মার্ক্স নির্ধারিত পথে ঘটছে বলেই আমার বিশ্বাস৷ যদি আগামী দশ বছরের মধ্যে আমার রাজ্যে, এই পশ্চিমবঙ্গেই রাজপথের উপর লালপতাকা পুড়িয়ে ফেলা হয় তবে আমি অবাক হবো না৷ কারণ কমিউনিজমের বিকৃতি আমার সহ্য হবে না৷
---তাহলে আজ যারা লেনিন ভাঙছে, মার্ক্স ভাঙছে, তাদের তুমি কমিউনিস্ট বলবে কৃষ্ণেন্দু?
---দ্যাখো সোম, কৃষ্ণেন্দু আচমকাই একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাইলো সোমদত্তার সঙ্গে, এই একটা জায়গায় তো আমরা সবাই চাই যে সমস্ত মানুষ সমানভাবে খেয়ে-পরে বাঁচুক৷ কমিউনিজম তার একটা ওয়ে মাত্র৷ নির্দিষ্ট কোনও পলিটিক্যাল পার্টির প্রতি কমিটেড না থেকে যদি একথা মানা যায় তবে তো আমরা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিযে, যে দেশগুলিতে এইসব ঘটনা ঘটছে, সেইসব দেশের শাসক কমিউনিস্ট পার্টিগুলি তাদের কমিউনিস্ট অ্যাটিটিউড বজায় রাখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু নেতা কিছু শোষকের হাতের শোষণযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে৷ সুতরাং সেখানকার শোষিত সাধারণ মানুষজনের কাছে কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্বটাই শোষকের অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে৷ তাই সাধারণ মানুষ কমিউনিস্ট দুনিয়াকে ভেঙে ফেলছে, লেনিন ভাঙছে, মার্ক্স ভাঙছে, পার্টির নাম বদলে দিচ্ছে...
প্রায় কোনও পজ ছাড়াই একটানা মন্ত্রোচ্চারণের মতো কৃষ্ণেন্দু মুখস্থ বলে যায়৷
---এটাকেও কি তুমি কমিউনিস্ট মুভমেণ্ট বলবে?
বড্ড বেশি যেন আগ্রহী সোমদত্তা এ সময়৷ টেবিলের উপর দু’হাতের কনুইয়ের ভর দিয়ে সরাসরি কৃষ্ণেন্দুর চোখে চোখ রাখে৷ এই দৃষ্টি কৃষ্ণেন্দু সহ্য করতে পারে না৷ থার্ড ইয়ারের হার্ট থ্রোব এজিএস সোমদত্তা সেনগুপ্ত৷ কৃষ্ণেন্দু ক্রমশ নার্ভাস হয়ে যায়৷
---অফকোর্স... কৃষ্ণেন্দুর কথা জড়িয়ে যায়৷ কিন্তু এ নিয়ে ডিবেট হতে পারে যে তাদের মুভমেণ্টের স্টাইল আদৌ কমিউনিস্ট কি না!
---এ কথাটাই তো আমি মা-কে বোঝাতে চাই৷ 
সোমদত্তা এখন আপাত গম্ভীর৷ দৃঢ় প্রত্যয় থেকে কিছু বলতে চায়৷ 
---বলি যে সেভেনটিজের ছেলে-মেয়েরা অনেক ভালো কাজের পাশাপাশি অনেক ভুলও করেছে৷ যার খেসারত আজও আমাদের, কমিউনিস্ট দলগুলোকে দিতে হচ্ছে৷ তা-না, মা বলবে, বিপ্লবের সময়ই হয়নি এখনও...

সেদিন দুপুরের গরমটা অসহ্য হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ৷ প্যাচপেচে গরমে এই দুপুরে আবার ভিড়বাসে চড়তে হবে! গোলপার্ক থেকে শ্যামবাজার৷ লাল দোতলা এল নাইনে চড়ে ছুট৷ পেছনের দরজায় ফুটবোর্ডে কন্ডাকটার যেখানে দাঁড়ান, তার পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চেপে ড্রাইভারের মাথার ওপর গিয়ে বসলেই হলো৷ চলন্ত সিনেমাস্কোপ৷ এক অদ্ভূত মুহূর্তের জন্ম৷ হুহু করে দুপাশে ছুটে যাচ্ছে শহর, শহরের গাছগুলি, পাখিদের বিষ্ঠামাখা সাদা ছোপ ছোপ পত্রপল্লব৷ স্টপে বাস দাঁড়ালে জানালার পাশের ডালে বসে নিবিষ্ট মনে ঠোঁট দিয়ে পিঠ চুলকানো কাক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিকের হেলমেটে শুকিয়ে যাওয়া কাকটির অ্যা, সামনের চওড়া স্ক্রিনে রাজপথ পেরিয়ে ঘোলাটে আকাশ, নাগরিক দৈনন্দিনতার মাঝে একটুকরো রিলিফের কাজ করবেই৷
খানিকক্ষণ আগে ‘ইউটোপিয়া’-র আলো-আঁধারির নিশ্ছিদ্র মগ্নতার ভেতর সোমদত্তা কৃষ্ণেন্দুর মুখের ওপর ‘নো’ বলে দিয়ে চলে গেছে৷ সোমদত্তার যাবতীয় তাত্ত্বিক স্পর্শের ভেতরে কৃষ্ণেন্দু তখন প্রাণপণ চেষ্টায় গুঁজে দিতে চাইছিলো ব্যক্তিগত ইচ্ছেকুসুম, প্রেমপ্রস্তাব৷ এখন কৃষ্ণেন্দু একা টেবিলে সোমদত্তার আধখাওয়া কাটলেট-প্লেটের দিকে তাকিয়ে বসে আছে৷ দীর্ঘ এক মাসের ক্রমাগত প্রচেষ্টার পর আজ সোমদত্তার হঠাৎই হতাশ-প্রস্থান৷ সোমদত্তার বাতলে দেওয়া পথে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি সম্ভব কি না এ প্রশ্নে দ্বিধান্বিত হওয়ার বদলে ওর ঈষৎ ঝুলে থাকা দীঘল দুটি স্তন, একফালি সরু ঠোঁট ও উজ্জ্বল গমরঙা শরীরই যে কৃষ্ণেন্দুর একান্ত আকাঙ্ক্ষিত, এই সহজ সত্যটা বোঝামাত্র মাসাধিক কালের এই সম্পর্কটাকে আচমকাই খুন করে সোমদত্তা, কৃষ্ণেন্দুর সোম, চলে গ্যালো৷ 
কৃষ্ণেন্দু বুঝতে পারছে না এখন কী করবে! ওর মনের ভেতর অন্ধকারে ফ্রয়েডের সেই লিবিডো ক্রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ক্রমশ ফনা মেলে ধরছে! সোমদত্তার ফেলে রাখা আধ-খাওয়া কাটলেটটা খাবে না এল নাইন ধরে পালাবে তা ঠিক করে উঠতে না পেরে কৃষ্ণেন্দু একটা সিগারেট জ্বালায়৷ লুকনো সিঁড়ির খোঁজে কৃষ্ণেন্দু আরও একবার লেজ সোজা করে টেরোড্যাকটিলের ভঙ্গিতে মেলে দ্যায় দুই ডানা৷ 


১২. আদমসুমারী


পল্টনবাজার থেকে কেনা একটা অনন্য রুমাল আর জরিবোনা মেখলা তোমার মনখারাপকে আরো একটু উস্কে দিলে শৈলশহরের রাস্তায় রাস্তায় রুটের মিনিবাস গড়িয়ে যায়৷ যেভাবে গড়িয়ে যায় জাতীয় মিউজিয়ম সারস্বত বাঙালি সমাজ আর বিহুর প্রশস্ত প্যাণ্ডেল৷
বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে থাকো তুমি৷ দু-দিক দিয়ে হুহু করে ছুটে যাওয়া বাতাসের সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে কৈশোরের কোনো একটা দুপুর, রেলকলোনির মাঠ, মায়েদের আঙুলে জড়ানো উলকাঁটা, কলাবেণী আড়চোখ, আর তোমাদের হাফপ্যাডেল, একই গলিতে বারবার চক্কর, চেন পড়ে যাওয়া, সরস্বতীপুজোর আগে ভুল করে খেয়ে ফেলা নারকেলকুল, বাড়িতে ঢোকার আগে ফুলপ্যান্ট থেকে লুকিয়ে চোরকাঁটা ছাড়ানো৷
যেন কুয়াশায় মোড়া একটি অমোঘ শীতকাল রাস্তায় পড়ে থাকা খালি সিগারেট-প্যাকেটের মতো উদাসীনতায় সন্তের মতো বিষণ্ণপ্রায়৷ এখনও এই অপ্রবাসে ঝোড়ো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে শৈলশহর জুড়ে তাড়া করে ফেরে একটি শীতকাল৷ সামনে দিয়ে গড়িয়ে যায় কুয়াশায় ভেজা চেনা মুখ৷ গাছের আদল৷ তুমি কেতাবি আগ্রহে শুধু টুকে রাখতে চেয়েছিলে একটি দশনম্বরের রচনা লেখার টীকা ও সংকেত৷ সুুঠাম গোয়ালপারিয়ার সুুর শুধু ভেসে থাকে বাতাসে৷ তারযন্ত্র আর তালবাদ্যে তখন ঈশানকোণ মাতোয়ারা৷ মানুষের আগ্রহে শুধু মোবাইল ফোনযন্ত্রটি রেকর্ড করে রাখে দুর্লভ দুপুরটুকু, পৃথিবীর ইতিহাস৷
দুকুল ছাপানো বহ্মপুত্র, এদিক ওদিক সাদাবালি, ছড়ানো ছিটানো প্রশস্ত চর, সূর্যালোকে চিকচিক করছে৷ দূরে দূরে বোট, নৌকো--- চড়া রোদেই ঝিরিঝির বৃষ্টি৷ এদিকে-ওদিকে ছোটো ছোটো দ্বীপ ভটভটি ভর্তি ট্যুরিস্ট, পুণ্যার্থী৷ আর টপাটপ ডিজিটাল ছবি৷ পাথর বাঁধানো সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেছে কবিতার মতো দিন৷ দ্বীপের ওপরে মহাকাল, আদিপিতার আশ্রম৷
ঝোড়ো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে শৈলশহর জুড়ে তাড়া করে ফেরে তোমার মুখ৷ কামাখ্যাপাহাড়ের পিচমোড়ানো পাকদণ্ডী দিয়ে গড়িয়ে নামছে এই ত্রিচক্রযান, দ্রত, নিম্ন-অভিমুখী৷ স্টার্ট বন্ধ৷ দূষণ কমবে কি? জানা নেই৷ হাতে হাতে ঘুরছে ক্যান--- চিল্ড ফস্টার৷ পড়ন্ত বিকেলে দূরগামী একটি তারা ফিরে যাচ্ছে সেই কবিসম্মেলনে৷ উত্তরপূর্ব আকাশের ভারি ছায়া তখন প্রলম্বিত শৈলশহরের ছোটো ছোটো কাঠের বাড়িগুলোর ছাদে৷ 
অবতরণের পথে কোথাও থেমে যাচ্ছে স্টার্টবন্ধ সেই ত্রিচক্রযান৷ পাহাড়ি বুনো ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিলে অবিরাম কামনার ইচ্ছেরা দমবন্ধ ফিরে যায় সারিসারি সাজানো চেয়ারে কবিদের ঘরে৷ তখন মৃদুস্বরে কবিতা-উচ্চারণ৷ মুগ্ধচোখ অন্যমনে৷ আর পরিযায়ী কবির দল এক ঠিকানা থেকে মুহূর্তে ছুটে যায় অন্য ঠিকানায়৷ তোমার মুখ ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসে৷ আর মোবাইলে ফেসবুক...নতুন তোলা ছবিকে তুমি লাইক করলে কিনা ভাবতে ভাবতেই জেগে ওঠে গেস্টহাউস, মধ্যরাত্রির ঐকতান৷
অথচ অসম নয়, সেই ছোটোবেলায় শেখা আসাম৷ পাহাড়ি আসাম৷ সবুজ পাহাড়ে ঘেরা আর সাদা ব্রহ্মপুত্রের রোদঝিলমিল বেলাভূমি৷ তার ককবরক বরাক উপত্যকা৷ যার বর্ণমালা বাংলারই মতো, যেন সহোদর দুই, তফাৎ শুধু কয়েকটি বর্ণে৷ ‘ব’ আর ‘পেটকাটা ব’, যা নাকি আসামে ‘র’৷
ডিব্রুগড় থেকে আসতো শুভ্রশঙ্কর রায়চৌধুরী... লম্বা-ছিপছিপে... বিকেল বিকেল কৃষ্ণেন্দু সাইকেল নিয়ে রেলকলোনির মাঠ... শীতের বিকেলে ক্রিকেটব্যাট হাতে হোয়াইট ইলেভেন ক্লাব বনাম মালিগাঁও... ‘ব’ আর ‘পেটকাটা ব’-এর দুরন্ত লড়াই...৷ আর একটা কাটাঘুড়ি শুধু উড়ে ষেত তিনসুকিয়া, বঙ্গাইগাঁও, গৌহাটি থেকে... সুদূর ‘মিনির দেশ’ থেকে... প্রতিমা বড়ুয়া... ইন্দিরা রায়সম গোস্বামী... গোয়ালপারীয়া... ভূপেন হাজারিকা...৷ 
অথচ সেই কবে থেকে চলে আসছে ‘বংগাল খ্যাদাও... বংগাল খ্যাদাও...’৷ আবহমানের কুয়াশামাখানো অন্ধ আক্রোশ৷ নামগোত্রহীন শুধু নয়৷ উৎখাত করে দাও জমিজিরেত-চোদ্দোপুরুষের ভিটে থেকে৷ অপ্রবাসে প্রবাসী ...৷ আজ প্রকট ‘ব’-কে তাড়িয়ে ‘পেটকাটা ব’-এর এ কোন্ লড়াই! শুধু লড়াই নয়, যেন দামামা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে গৃহযুদ্ধের৷
অনির্দিষ্টের দিকে গড়িয়ে যাওয়া কাটাঘুড়ির মতো নিজভূমে পরবাসী ডিলিট করে নাম, পদবী, কনট্যাক্ট নাম্বার৷ কান্না চেপে মুখবন্ধ পেরিয়ে চলে যায় অস্থির সময়৷ পেরিয়ে যায় খুনীর হাতের ছাপ লেগে থাকা শরনার্থীশিবির৷ পেরিয়ে যায় লুইতপার ব্রহ্মপুত্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বঙ্গ সম্মেলন৷ পেরিয়ে যায় রেলশহর মালিগাঁও আর তার হিমকুয়াশায় ঢাকা অলীক রেলকলোনি৷ পেরিয়ে যায় সরকারি তালিকার অপমানজনক অন্ধকার...
(এরপর আগামী সংখ্যায়)

শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ।। ইন্দ্রজিৎ রায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০




ছবিঃ হিরণ মিত্র

ইন্দ্রজিৎ রায় ।। ফালতু ডায়রি , বৈশাখ ,বিশেবিষ 



( পূর্বপ্রকাশিতের পর ) 


ময়লা ফেলার যে জায়গা তাকে সবাই ভ্যাট্ বলে । কদিন ধরে রাত করে শুই , উঠতে পারি না , সকালে ময়লা গাড়ি যখন বাঁশি বাজাচ্ছে আপ্রাণে ,উঠতে পারি না ।বেলার দিকে সব ময়লা নিয়ে ভ্যাটে ফেলতে যাই আর তখন সকলের মতই পূর্ণদাস বাউলের কন্ঠে সেই গান ,ক্যাসেটে শোনা , সেই গান সবার কানে বাজে । কেউ কেউ শুনেও না শোনার ভাণ করে , গুরু আমার মনের ময়লা , যাবে কি করে ... মনে পড়লো গানটা ? আজও পড়লো । রাস্তাটা সুনসান , গতকালই লকডাউন গেছে , আজও তার ঘোর আছে , ভ্যাটের ঠিক সামনে , একটি পাঁচরঙা বড় ছাতার নিচে বসে আছে , একলা লটারি -বালক , সকাল থেকে কেউই আসে নি সম্ভবত , লটারি খেলতে ।বসে আছে ,ছেলেটি , মুখে ভাইরাস মাস্ক , ঘুরে ঘুরে বৃষ্টি হচ্ছে আজ , ময়লা ফেলে রোজই চলে যাই , দ্রুত পায়ে , যেন কোনো এক মুহুর্তে আমার ফেলে যাওয়া সমস্ত ময়লা , উড়ে ফিরে আসবে আমারই হাতে , আধিভৌত বয়া মাঝগঙ্গায় ,হঠাৎ নড়ে ওঠার মত , কিন্তু আজ , তবুও ,থমকে গেলাম । অনেকদিন পর এই পাড়াটার দিকে তাকিয়ে বোঝলাম যে কর্মব্যাস্ত - এই শব্দটির প্রকৃত ব্যঞ্জনাটি কী । নিজেকে ট্যুরিষ্ট মনে হোলো , এই পাড়ায় আছি এতবছর ! এসব কবে হোলো ! কতদিন দেখিইনি তাকিয়ে ! কলোনির পুরাণ যে টিন কাঠের বাড়ি , সেগুলো চলে গিয়ে এই স্বপ্নালু-আলু নব্য বসতি , বেশ লাগলো রঙীন ফ্ল্যাটবাড়িগুলো . ঘাটবাঁধানো পুকুর , যেখানে মা'র অস্থি বিসর্জন দিয়েছিলাম । বাবাকে মিথ্যে বলে , যে বাবুঘাটে গঙ্গায় দিয়েছি । বাড়ির পাশের পুকুরেই রেখে দিয়েছিলাম , যেন কাছেই রইলো , এমনটা ভেবে । ওই আর কি , তো দুবছর আগেও , ঘাট ছিলো না এমন । এখন হয়েছে । অবাক চোখে পাড়া ,পুকুর দেখে , তিনতলায় ওঠা ইস্তক ওই রাস্তা, ময়লার ভ্যাট ও লটারিযোদ্ধার এই ত্রিমাত্রিক আয়না ও সম্পদ । রাস্তা মানেই সম্পদ , নিঃস্ব মানুষের , তার ময়লা , তেলচিটে হাত পা রাখার একমাত্র জায়গা যে সমস্ত ঘরছাড়াদের নিয়ে নেবে ,নিতেই থাকবে বছর বছর , ঋতু ঘুরবে , শুধু ঘুরবে না প্রারব্ধ , বাবা কে নিয়ে , গাড়ি রিজার্ভ করে দেখাতে যাবো আশ্রম , বৃষ্টি হবে ঘুরেফিরে , সাঁঈবাবা শিরদিওয়ালে , স্বপ্নে দেখবে সেই ফেট্টি মাথায় পাগল , বলছে বাড়ি যা বাড়ি যা ,আজ বাস নেই ,বাস বন্ধ , এসব কেন ভাবছি ভ্যাটে ময়লা ফেলতে গিয়ে , লটারিবালকটির মুখ মনে পড়ছে , পয়সাটা বোঝা হোলো না তেমন , আসলে দুটো ব্যপার ছিলো । এক , মা বাচ্চাদের হাতে টাকা দেবার বিরুদ্ধে ছিলেন , আর ক্লাস সেভেনে বাবার ঐ কথাটা , রাজা কখনও পার্স পকেটে নিয়ে বেড়ায় না , বলতেন তোমার কী লাগবে বলো , পারলে এনে দেবো । ব্যাস ।ওই যে , আদি গুরু মাতাপিতা শেষের গুরু বাঁশ - ওই পার্স ছেড়ে গেলো । আজও , কত কত দামী পার্স , আলমারিতে পড়ে । নতুন । আর পদার্থবিদ্যা পড়তে গিয়ে হাতঘড়িটি গেলো । কত হাতঘড়ি পড়ে আছে । এই রাস্তার ওপর এত কিছু । ছেড়ে যাওয়া । পার্স ঘড়ি ক্যালেন্ডার । তবু পয়সা সেই পকেটে নিয়ে ঘুরতেই হোলো । এর থেকে মুক্তি পাইনি । মা যদি ব্যবস্থা করতে পারতো যে বড় হয়েও পয়সা ঘাঁটতে হবে না । যদি করতো । চল্লিশ বছরের জন্মদিনে সেই বাবা দামী একটা পার্স দিলেন , সেই বিস্ময়টা ,সেকি তুমি সত্যিই ...পার্স রাখোনা ? বাবা ভাবতে পারেননি ওই ছোটবেলার কথাটা আমি এত মন দিয়ে শুনবো ।রাস্তার পাগলদের খুব মন দিয়ে দেখি , তাদের উভলিঙ্গতা , কুমিরের চোয়ালের ভেতর চাদর কম্বল প্লাটিক প্যাকেটের , আর্দ্র কলোনি দেখি , মেয়ে পাগলদের সম্ভাব্য অতীতগুলো রাস্তায় ঘষে মসৃণ ,মাঝেমাঝে এই পাড়া শুধু না , এই পুরো বসতটাই , শহরটাও অচেনা লাগে । এটাই হয়তো চেনা অচেনার জাফরি , যার আলো আঁধার তিতিরের পোষা বেড়াল আঁধারমাণিকের মত , বৃষ্টির বাগানে যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় , মাছের লোভ দেখিয়ে যাকে ফেরত আনা যায়না ।ঘন্টা দেড়েক পর বৃষ্টি থামলো । ছাতে উঠি না , অনেকদিন ,রাত করে , আগে রাতে ওপরেই থাকতাম অনেক । ছাতের আলোটা কেটে গেছে আজ অনেকমাস , ওপরে ঈষত আলোকিত আকাশে , নারকেল পাতাগুলো হাওয়ায় মুছিয়ে দিচ্ছে আকাশ । একটু গা টা ছমছম করে উঠলো যেন , শেষে কি ভুতে পেলো আমাকে ।ভুতে পায় কাউকে ।নাকি নিজেকেই খুঁজে পাই , অন্ধকারে , আর বুঝি চটি পরা পা দুইটো জলে ডুবে যাচ্ছে । ছাতে জল জমেছে এত । লকডাউনের নিস্তব্ধতায় কোথায় ব্যাঙ ডাকছে শব্দ আসে । বসে হাতড়ে হাতড় ঝাঁঝরি বসানো ড্রেন খুঁজে পাই । দু চারটে কাঠিকুটো , আর , চুল ।লম্বা , দলাপাকানো চুল । এত চুল ছাতে , কার চুল । ছাতে তো তেমন ...আসেই না কেউ । আঙুলে জড়িয়ে চুলগুলো তুলে দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে মনে পড়ে অত বড় ছাতে আমি একা , রাত , আঙুলে একদলা চুল । ওটা সরিয়ে নেওয়াতে কলকল শব্দে জল ড্রেনে ঢুকছে । মেঘ সরে একছটাক আলোয় জল দৌড়ে যাচ্ছে । পালাচ্ছে । রহস্যের চুল সরিয়ে সরিয়ে । আমি পারছি না । পালাতে । 

(ক্রমশ ) 





দুটি কবিতা ।। মলয় মজুমদার

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



ছবিঃ হিরণ মিত্র

মলয় মজুমদার ।। দুটি কবিতা


ঈশ্বরের পদাবলী

১)


মাথার মধ্যে আঁশটে দুর্গন্ধ -

কেউ যেন ছোবল মেরে নিয়ে গেছে সংসার,

ঘামের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিষাক্ত আগুন ।

দুধেলা শরীরের ভাঁজে পোকা ,

কেউ একজন চেনা মানুষ আমার ,অথবা মানুষী ।

অজানা আকাশ

এখানেই মৃতের গল্প লিখেছিল কবি ।



এখানেই শরীর বিক্রি করেছিল এক নারী

তারই দুর্গন্ধ আমার শরীরে ।

মাংসাশী মেঘ ও মেয়েরা , আমি ও পুরুষেরা,

খাতা ভর্তি করে পাঠানো প্রেম,

খয় হয়ে যাওয়া জীবন নিয়ে বুড়ি বেশ্যার দল বিষাদের

গল্প বলে ।



আমি শুনি , শুনতে থাকি । পোয়াতি শরীরে ক্লান্তির

রকম ভেদ , প্রেমিকার মন । রঙিন খামে

বিষণ্ণ সুখ নিয়ে আসে রোদ্দুর । কে জানে কেন আসে,

কেন বার বার ভালোবাসি ভালোবাসি বলে দুর্বল যৌনতা

নিয়ে আসে দুপুরের ঘাম । তোকে ডাকে , ওই মেয়ে

তোকেই ডাকে কেউ । যোনির প্রয়োজন আজ পুরুষের ।



সব শূন্যতা আজ উন্মাদ , মাথার কোষগুলো বকবক করে,

তুই আছিস , তুই থাকিস । রোদ্দুরে লাল শরীর, একবার

ছায়ার পাশে গিয়ে দেখ

কালো রঙ হৃদয়কে লাথি মেরে

বিক্রি হয় শুধু , নাভি -স্তন-নাভির নীচের আকাশ

এইভাবেই তো একদিন

ঈশ্বরের সাথে দেখা হবে পুরানো চায়ের দোকানে ।

আমার ঘাম, আমার নষ্ট সামগ্রিক , আমার অবৈধ গল্প

ঘুণপোকার সাথে বদল করবো মুখপোড়া খচ্চরের গানে ।


২)


আবরণহীন স্বপ্নের সাথে ভেসেছি বহুকাল,

ক্ষুধা নিঙড়ে নাভির অন্ধকার খোঁজে বুনোহাঁস ।

শিকড়গুলো ছড়িয়ে পড়েছে,

মাটির সাথে সহবাস,

মাটি ও মাটির ভেতর আমি, আমার অচেনা কেউ,

শুধু দুই উরুর ভাঁজে খুঁজে পাওনা

বসন্তের উত্তাপ ।


জেগে থাকি । জেগে থাকি হাহাকার কিছু

শব্দের প্রয়োজনে

ঠিক সেই সময় তুমি আসো, চিমনির

ধোঁয়াটে অন্ধকারে

টিলার উপর সূর্য্যের আগুন, লাল রঙ স্পর্শ করে হাত ,

নদীর বুকে জ্বলে ওঠে প্রেম,

কে যেন সূর্য্যেকে হাতে করে দাঁড়ায় বারান্দায় ।


তবু আবরণহীন স্বপ্নের সাথে ভাঙা রাতের গল্প বলি,

পাখিরা শোনে

উত্তর দেয়না কোন , পাখিরা বোঝে -

বোঝাতে পারেনা কিছু

তখন নদীর ঢাল বেয়ে মাঝির চোখ ছুঁয়ে ফেলে  পূর্নিমার স্রোত ।

মাঝি আবরণহীন ঘাসের সাথে পাথরের বুকে খোঁজে রক্ত গোলাপ, কবিতার জন্যে,

তোমার জন্যে

শব্দ নয় - গোলাপের এক একটি পাপড়িতেই তুমি শুনতে পারবে

প্রেমের কবিতা ।

তারপর হাঙর আর ঈশ্বর এক সাথে

পার হবে চূর্ণীর জল ।

কবিতা ।। কানাইলাল জানা অর্ক রায়হান অরূপ সেনগুপ্ত কাঞ্চন রায় টোকন মান্না সুদীপ্ত বিশ্বাস


মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



কানাইলাল জানা ।। যাদুকর যা করে


তেমন সুসময় এলে অবসরকে কেটে কেটে হাঁস বানাই। পুকুরে ছেড়ে দিলে প্যাঁক প্যাঁক করে ডানা ঝাপটায়। আমি ফিরে পাই পদ্ম আর শালুকে ভরা গ্রাম বাংলা..

যখন খুব লাফিয়ে ওঠে ইচ্ছে শক্তি, সম্ভাবনাকে কেটে কেটে বানাই জিরাফ ও তার বাচ্চা। ছেড়ে দিই রাস্তাঘাটেঃ ছেলে ছোকরারা জিরাফ দেখবে আর জিরাফের মতো লম্বা হতে চেষ্টা করবে...

ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে তাকেও কেটে চানা করি। দুঃসময়কে ঢোক গিলে যারা অগোছালো, এক চানা ছড়িয়ে দিই যাতে বেঁধে ফেলতে পারে অফুরন্ত ভালোবাসা। পাগলের প্রলাপের মতো ভয়

যাদের জড়িয়ে ধরেছে সেখানেও পাঠাই এক চানা,চুমকি লাগানো আকাশ থেকে যাতে ঝরতে পারে কামরাঙা সাইজের ঘুম...


অর্ক রায়হান ।। থিরথির কাঁপছে রঙিন বেলুনগুলো


তেমনিই থিরথির কাঁপছে রঙিন বেলুনগুলো।

থিয়েটার গেটের কাছে মঙ্গোলিয়ান চেহারার

ইউনিফর্ম পরা মেয়েটি আজ আর নেই। সিলন

চা’র আউটলেটের জায়গায় কী এক অস্ট্রেলিয়ান

জুস বার এখন! আগে মাইকেল বাবলের কভার

গান বাজতো। ওই কাউন্টারে তুমি ছিলে। আমি

এখানেই কোনও একটা চেয়ারে বসতাম। আহ্,

এভাবেই থিরথির থিরথির কাঁপতো উৎসবের

লালনীল বেলুনগুলো! নববর্ষ আসন্ন।


অরূপ সেনগুপ্ত  ।। পথিক 

এক রাতে ঘুমের মধ্যে শুরু পথ চলা,

গন্তব্য? নিশ্চিন্তপুর ছাড়িয়ে আরো অনেক অনেক দূর,

পথে একে একে চেনা মানুষগুলো সব যায় হারিয়ে,

প্রতিবারেই কিছু নীরবতা, হা-হুতাশ, নয়নবৃষ্টি এক পশলা;


এখন সবই অচেনা; প্রগাঢ় তমস, খঁয়াটে নগর, শূণ্য খেয়ার তীর,

উজান শেষে ভাটার টানে পঙ্কিলতার ভীড়;

জংধরা ডুবো তরী, অস্পষ্ট অতীত, নৈঃশব্দের কথকতা,

পূর্ব স্মৃতির ন্যায় দীর্ণ প্রহেলিকা, রাত্রির বধিরতা,

কিছু ভগ্নস্তুপ, আশাবরীর ভাঙা আশা, পুরানো পোষাক,

ঐ শোনা যায় আষাঢ় মেঘের গুড়ু গুড়ু, সব বন্ধন ভেঙে ফেলার ডাক!


চোখের নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এক একটা অটুট বন্ধন, অস্ফুট স্বপ্ন,

রাত ভোর হয়, জেগে ওঠে অলীক - ব্যর্থ মনস্কাম;

পথিক চলে পথ অহর্নিশ, আর কিছু দূরেই যে অন্তিম সীমান্ত,

আকাশে রামধনুর ঐ প্রান্তে পূবালির অণ্বেষণ।।

কাঞ্চন রায়  ।। অল্প কথার গল্প

আমি কবিতা লিখেছি তুমি আবৃত্তি করে নিও,

আমার অল্প কথার গল্পটিকে কাহিনী করে দিও।


ছুটির দিনে আনমনা হয়ে পুরোনো কোনো গানের কথায়,

নিখোঁজ মনের ঠিকানা পেতে আমায় ভেবে নিও।


কোনো এক ক্ষণে হারিয়ে ফেলা, আঙ্গুলের কোলে আমার ছোঁয়া;

ভালোবাসা খুঁজো সেই পরশে,আমায় ভালোবেসে ফেলো।


যেদিন তুমি একলা ঘরে বিভোর কোনো বাঁশির সুরে,

কল্পনারই দেয়াল জুড়ে আঁকছো আঁকিবুকি—


কিংবা শ্রাবণ, অগোছালো মন

ভরাট হৃদয় সিক্ত নয়ন;

আশ্রয়হীন খোলাচুলে একলা তুমি একলা মনে,

ভিজছো বিহ্বল দৃষ্টিতে—

পথ হারানোর সময় এলে সঙ্গী আমায় নিও।


এমন যদি নাও বা হয় তোমার মনের জানালাতে,

ভাবনা আমার খেয়ালখুশির থাকুক না হয় আসকারাতে।

প্রেমটা আমি সাজিয়ে নেব

গল্প নাই বা সত্যি হলো,

স্বপ্ন দেখার দলিল আমার

তাই ভাবতে তোমায় দোষ কি বলো?
 


টোকন মান্না ।। প্রতিমা

১.

এখন চাঁদের আলোয়

মাটির ক্ষরণ হয়।

এমনই করে কি হারিয়ে যাবে জীবন

কলাপাতার শিশিরের ফুটো চোখ দিয়ে

প্রতিমা মৃন্ময়।



২.

পাখিদের যাওয়া আসা নিবরতায় বৃষ্টি

প্রতিবাদ

রক্তাক্ত রাজনীতির পোকা খায় শেকড়।

আলো এসে ঘুরে যায় মননে

একটা ঝড়ে ভেঙে যায় নীড়

তবু সে অসহায় নয়

মৃত্যুর কাছে।



৩.

আজ ফিরে যাবো ঘরে

আগুন জ্বলছে আগুনের স্পর্শে

এমনই দেহের বাতাস এসে ডুবে যায়

গাঙনদীতে .


সুদীপ্ত বিশ্বাস ।। শূন্যতা

দিনকে ফাঁকি দিতে পারলেও
রাতের কাছে হেরে যাই রোজ!
স্বপ্নেরা সব মুখ থুবড়ে পড়ে
চোখের জলে বালিস ভিজতে থাকে।

তারপর খুব ক্লান্ত হলে,
গভীর ঘুমে পাই মৃত্যুর স্বাদ।

সারারাত জ্বলতে-জ্বলতে
রাতের তারার সলতে ফুরিয়ে যায়।

আবার একটা দিন...
আবার ছোটা শুরু...



দুটি কবিতা ।। নিসর্গ নির্যাস মাহাতো

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০





ছবিঃ হিরণ মিত্র

নিসর্গ নির্যাস মাহাতো ।। দুটি কবিতা

নির্বাণ


প্রতিটি কান্না বিন্দুর মাঝে

সুপ্ত মোহ ত্যাগ থাকে

ঝরে পড়ে মোক্ষলাভের ক্ষণে

পাপস্খালন করে জল দেয়

নির্বাণ গাছে


ধর্ম


কাজল আর সুর্মার মাঝে

দু গাছা কাঁচের চুড়ির ফাক

উঁকি মারে যে চোখ

তাকে আমি বুক কাঁপা প্রিয়তমা বলি

ধর্ম ভেদে কালোরও সংজ্ঞা হয় বদল

কবিতা ।। পার্থপ্রতিম আচার্য আহমেদ সাকির গোপা রায় অমিত দেশমুখ তাপস ওঝা

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



ছবিঃ হিরণ মিত্র

পার্থপ্রতিম আচার্য ।। আহুতি


চড়াই পাখির শব্দে গড়িয়ে যাচ্ছে দুপুর।
পানা পুকুরের বাতাস
মাঝে মাঝে খেলে যাচ্ছে মাটির দাওয়ায়...
উঠোনে মেলে দেওয়া বৃত্তাকার মুড়ির চালে
হাঁস ঠোঁট দিলে
তেড়ে আসছে তিরিক্ষি কুকুর।

রেডিওতে গান ভাসছে
দেড়তলায় চুল শুকাচ্ছে ধ্বনিহীন পিসি

কপাট আঁটা ঘর...
দুদ্দাড় সিঁড়ি, আঙিনা, গোয়াল, নাটমন্দির
বসন্ত দিঘির ঘাট ছাড়িয়ে
ছাপিয়ে যাওয়া শরীরের গন্ধে
কচুপাতায় লেগেছে মাতন।

বনানীর আলোছায়ায়
রাঙাদিদিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে ঢেউ...

সুপ্রাচীন এই আহুতি
স্থবির এই সময়ে
দাগ টানছে কেন?


আহমেদ সাকির ।। নাটকনামা


স্থান: ব্যালকনি অথবা ছাদ
কাল: রজনী নয় ঘটিকা
পাত্র: দেশপ্রেমিক যে-কেউ


দৃশ্য ১

দীর্ঘ যুদ্ধযাত্রার পথ নেমে গেছে খাড়াই এলোমেলো অসংবৃত...
ঘরবন্দি বহুদিন যাবৎ। অলস শরীরও চলে না ঠিক মতো
হাতে নেই কোনও কাজ। প্রতি মুহূর্তে উৎকণ্ঠা কী হবে এবার ?
যা ছিল ভাঁড়ার, সব শেষ! এভাবে চেয়েচিন্তে কদ্দিন চলে আর!
কোয়ারান্টিন, লকডাউনে এক হয়ে গেছে গ্রাম আর শহর,
এসময় খাদের দিকে তাকানো ছাড়া মনে নেই কোনও জোর।

দৃশ্য ২

প্রথম অঙ্ক

ধর্মাবতার, রক্ষে করুন আমাদের ডালপালা
শিকড় চায় একটু জল নুন
ধর্মাবতার, এই একমুঠো জল পেলে
মুথা ঘাস ঠিকই উঠবে আবার শক্ত পাথর ঠেলে
ধর্মাবতার, এই ঊষর ভূমিতে বৃষ্টি হয়ে নামুন

দ্বিতীয় অঙ্ক

কথামতো অন্ধকারে ডুবেছে প্রায় সিংহভাগ বাড়ি
আলো বন্ধ রেখে চলছে মোমবাতি, টর্চ বা মোবাইলে লাইটিনিং শো
আমাদের দেখাতে হবে একশো ত্রিশ কোটি আমরা সম্মিলিত আছি,
যতই রুটি-রোজগেরেহীন হই, পায়ের থেকে সরে যাক মাটি,
আমরা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বজায় রেখে চলেছি!

দৃশ্য ৩

ধর্মাবতার, ঘর নেই, তায় ব্যালকনি আর ছাদ!
মাথার ওপর যেটুকু আছে আকাশ,
তারার বদলে কালো কালো সব খাত।
ধর্মাবতার, সামর্থ্য নেই মোমবাতি কিনে জ্বালা
বুকের শিশু অন্নহীন, আমিও তিনদিন
কুকুরের পাশে পড়ে আছে খালি থালা।
অনেকের মতো হা-পিত্যেশে আমিও তাকাই দূরে
মোমবাতি, আতশবাজি, পটকা....
ধর্মাবতার, আলোয় আসে কি ক্ষুধার অন্ন উড়ে ?




গোপা রায় ।। মার্জনা

অনেক দিন পরে ঝরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি,
বন্দী দশা ,মনের ব্যথায় আজ কেঁদেছে সৃষ্টি।
গুমরে ওঠে যাতনা সব ,বড্ডো অসহায়,
বিশ্ব জুড়ে মৃত্যু মিছিল দুঃখ রাখা দায়।
অনেক দিলে শাস্তি প্রভু, মার্জনা চায় প্রাণ,
তুমিই বাঁচাও ,তুমি টলাও, তোমারই সব দান।
উদ্ধত মন বুঝলো কি আজ? ক্ষমতা হীন কত,
বড়াই করে চাঁদ ধরেছে, মহাকাশেও ক্ষত।
অতি ক্ষুদ্র অনুর কাছে , হয়েছে পরাজয়,
সমস্ত টা গ্রাস করেছে অবিশ্বাস আর ভয়।
সেখান থেকে ফিরতে হবে, দীর্ঘ পথের শেষে,
সেই আশাতেই চলতে হবে, সেই স্বপ্নেই ভেসে।


অমিত দেশমুখ ।। অঙ্ক 

অচেনা মানুষ যদি ভালবাসতে চায়?

ভালোবাসা দেবো।


অচেনা মানুষ যদি ফুল ভালোবাসে?

ফুল গাছ এনে দেবো।


অচেনা মানুষ যদি সঙ্গ চায়?মুহূর্ত চায়?

সঙ্গ দেবো।ভালোবাসা দেবো।


অচেনা মানুষ যদি পুব দিকে গেলে রেগে যায়?

পুব দিকেই যাবো।


তাপস ওঝা ।। নির্মাণের প্রতিবিম্ব

ভাব মানুষের ছায়া দেখে দেখে

শেষ পর্যন্ত

একটি মানুষের মতো কিছু কাছাকাছি এল।

তেমন মানুষটির মাধুর্যনির্যাসে

কত বৃত্তান্তপাঠের মোহ !

ইতিহাসের একজন রাজা যেমন

বার বার বদলে ফেলে তার অনুসরণকারী

আর নিজেও বদলে যায় বার বার

সেরকম তর্জমার বিহ্বলতায়

ভাব মানুষের ছবি আঁকলাম।


এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমারই

হন্তারক !



গুচ্ছকবিতা ।। শান্তিময় মুখোপাধ্যায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



ছবিঃ হিরণ মিত্র

শান্তিময় মুখোপাধ্যায় ।। জাঢ্যগতির সূত্রাবলী

   

.

জঙ্গমের ইচ্ছে চোয়ালে রেখে কোয়ারেন্টাইন 

লং ড্রাইভে যাবার স্বপ্ন দেখছে


সামাজিক দূরত্বের সালতামামি নিয়ে স্টিয়ারিং 

লুকিয়ে রাখলো পিছু নেয়া ছায়াদের সংক্রমণ 


পলিব্যাগ ভর্তি খিদে নিয়ে তুমিও একসময় 

ঘরে ফেরো কনফেকশনারি সন্ধেয় 


স্থির গতির সূত্রগুলো গোড়ালিতে জড়িয়ে 


.

সংখ্যাগুলো হিসেব ছাড়িয়ে যাচ্ছে 

বিপ বিপ শব্দঘর বা ঠান্ডা স্টিলের দেরাজ

দিন থেকে ঘন্টা থেকে নিমেষ উপচে 


আপাদমস্তক খাঁ খাঁ শহরতলির দিকে 


ফরমালডিহাইডের নেশায় চুর গাজন উৎসবও

আরো জোর হাপর টেনে টেনে   

শুভ মহরতের ঘাড়ে শ্বাস ফেললো


টুকিটাকি সেরে দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের অপেক্ষা এখন 

খুব শান্ত একটা হাত মাধ্যাকর্ষণ বরাবর নেমে আসার 


.

মুখ লুকিয়ে রাখছি আর মুখোশ প্রকাশ্য হয়ে উঠছে

ভার্চুয়াল খুনসুটিগুলো এবার ড্রইংরুম ছাড়িয়ে 


জিরো ওয়াটের ইচ্ছেয় পাল তুলে দে.. 


সিনটেক্স বদলে ফেলছে যাবতীয় পূর্বাভাস

ক্লোরোফিল ঘরাণা আর তার ক্যামোফ্লাজ 


কিছুটা আড়াল হতেই রেমডেসিভির 

তাথৈ তাতাথৈ রক্তজালিকায় 


সাইবার নিষেধের ওয়াল টপকে 


.

ফাঁকা পলিব্যাগ কি গেয়ে উঠলো রেশন 

অর্ধেক স্বপ্নচাল নিয়ে ঘুমের ভেতর  

গৃহস্থের বউ ফিরে এলো


স্যানিটাইজারের মিহিন গন্ধে শ্বাস নিতে নিতে 

তুমিও পেরিয়ে যাচ্ছো মন্থর সভ্যতার ফাটল 

দিনরাত্রির মধ্যবর্তী শুনশান


আখ মাড়াইয়ের কল

গুড়ের মিষ্টি হাওয়ায় ঝুলে থাকা

কয়েক ফালি আকাশ 

আবার কি ফিরিয়ে দেবে 

আইসোলেশনের জমাট অন্ধকার


.

কোথাও লিপটন রেড লেবেল 

ছায়া ফেলছে মানচিত্রে 


হটস্পট ফুটে ওঠা এই নির্জন পাড়াগুলো 

কখন কোরা থান পরে এসে দাঁড়াবে

চোখ রাখছে পরিসংখ্যান 


ইজেলের চোখ থেকে জল গড়িয়ে নামলে 

প্যালেটময় তারাদের অসহনীয় বিদ্রুপ 


কনফারেন্স টেবিল থেকে জিরো আওয়ার 

গোগ্রাসে গিলছে ব্যালান্সশিটের পাতা 


.

পরাজীবনের শিকে আড়াআড়ি ঝুলে আছে মাংসবাজার 

নিশ্বাসের ভাঁজে তার সেঁকোগন্ধ লুকিয়ে পরিযায়ীরা 

উড়ে গেলো অদৃশ্যের মলাট খুলে


একফালি দৃষ্টিবদলে মেরুদন্ডে চাপ চাপ ঠান্ডা 

আলোর খুপরিতে গুঁজে দিচ্ছে সংক্রমণ 


প্রাণে খুশি নয়, সংশয়ের তুফান 

এই ভাসচ্ছে তো ওই ডোবাচ্ছে 


করোটিরেখায় দেয়াল লিখনের ভুলভুলাইয়া  

শংসাপত্র লিখবে বলে নিয়ে এলো ভর্ৎসনা 


.

জিরো পয়েন্টের দুপাশে থেমে আছে

আঙুলের কথাবিনিময়


এপারের খাঁ খাঁ নীরবতা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে 

তোমার অনামিকায় 

বোবা সরোদের পিছুটান রেখে গেলো


নো ম্যানস ল্যান্ড বরাবর ভার্চুয়াল চুম্বনরেখা

পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে ইনবক্সের রেটিনায় 


রাতপোষাকের ওমে আইসোলেটেড শরীর ভিজিয়ে 


.

দরোজার অন্ধকার খুলে এক্ষুণি কেউ ডেকে উঠবে 

কাঁপা গলায় অস্পষ্ট কিছু বোলে মিলিয়ে যাবে হাওয়ায় 


ক্রমাগত হুটারের কঁকিয়ে ওঠা শুনে 

এম্বুলেন্স ক্লান্তিতে ঢলে পড়লো 

কয়েকশো মিলিয়ন ঘুমে


মৃত্যুর সিরিয়াল উপচে পড়ছে 

পরিসংখ্যান থেকে 


আইসোলেশন থেকে মর্গের বারান্দা

দুরত্ব মাপছে প্রাতঃভ্রমণ 


.

বিজ্ঞাপন বিরতির পর বাকিটুকু যা

ফেবলস। তর্জনীর মিথ্যে বসানো 


ট্রাপিজের ছেঁড়া সুতোয় ঝুলছে

 

পরাজীবনের কার্নিভাল নিয়ন্ত্রণকারী

ভাতঘুম আর অত্যাবশ্যক দিনযামিনী 


সামাজিক দূরত্ব রেখেই সংবিধান খসালো

সেইসব পোকায় কাটা অনুচ্ছেদ

উনুনভর্তি গামলায় 


রোগা হাতে মা সেখান থেকে খিদে বেড়ে দিচ্ছেন থালায়


১০.

মৃতদের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলছে লেজিসলেশন 

সংবিধানের অপরিণত আলো এই বিস্তীর্ণ ইয়ার্ডে

দাফনের পূর্ব প্রস্তুতি যেন 

কবরের ভাঁজ খুলে শোনাচ্ছে ডিভাইন কমেডি


স্মৃতিফলকগুলো খুব ঠান্ডা পায়ে এগিয়ে এলে

সবুজের প্রাত্যহিক মেলে ধরছে পরাবাস্তব ঘুণ 


চাপচাপ জড়দের পাশ কাটিয়ে 

শিকড়ের ফিসফাস 

শোনা যাচ্ছে কান পাতলেই