বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০

এই সংখ্যার সূচি

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০



অনলাইন 'মাসিক কবিতাপত্র'-এ আপনি স্বাগত

এই সংখ্যার সূচি 




আমাদের কথা

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০


আমাদের কথা


আর সাপ্তাহিক নয়, অনলাইন মাসিক 


দীর্ঘ ৬ মাস 'মাসিক কবিতাপত্র'-র কোনও মুদ্রিত সংখ্যা বের না হলেও অনলাইনে কখনও পিডিএফ আকারে, কখনও অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে, আবার কখনও ব্লগারের সহায়তায় এই ভাবে প্রতি সপ্তাহে অনলাইন ম্যাগাজিন হিসেবে 'মাসিক কবিতাপত্র' বেরিয়েছে। নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ রচনা ছাড়াও নিয়মিত তরুণ কবিদের কবিতা প্রকাশ করেছি আমরা। ধারাবাহিক উপন্যাস, ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ছাড়াও অনুবাদ-উপন্যাসও প্রকাশ করেছি আমরা। প্রকাশ করেছি কবিদের সাক্ষাৎকার । সুখের কথা, শারদ উৎসব-এর আগেই 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর মুদ্রিত শারদ সংখ্যা ২০২০ প্রকাশিত হবে। এই মুহূর্তে চুড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। সময়ের কলতানের মধ্যেই এই বিশ্বব্যাপী লকডাউন পর্বে 'মাসিক কবিতাপত্র'-এর যাবতীয় উদ্যোগ আয়োজন ধরা রইলো গুগল, ফেসবুক, ব্লগার আর ইউ টিঊবে। পাঠক, আপনার সমর্থন ছাড়া আমাদের পক্ষে কিছুই কী করা ছিল সম্ভব!
সবাই ভালো থাকুন। উৎসব-এর দিনগুলিতে সুস্থ থাকুন এই কামনা। আমাদের এই প্রিয় গ্রহও সুস্থ হয়ে উঠবে তাড়াতাড়ি এই আশা রাখি।।  

সাক্ষাৎকার ৷৷ কবি সুব্রত সরকার

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০


সাক্ষাৎকার ৷৷ কবি সুব্রত সরকার 


গত শতাব্দীর সাতের দশকের অন্যতম কবি সুব্রত সরকারের জন্ম ২৭.০৮.১৯৫৬,দমদম এয়ারপোর্টের কাছে মতিলাল কলোনিতে৷ প্রথম কবিতাপ্রকাশ : ১৯৭৩,‘প্রত্যুষ’ পত্রিকায়৷ প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ : ‘দেবদারু কলোনী’ (১৯৭৯)৷ ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ এই ছয়-সাত বছর ‘দেবীমুখ’ নামে একটি কবিতাপত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন৷ এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৩৷ ১১ টি কাব্যগ্রন্থ,কাব্যসমগ্র ও ১টি গদ্যগ্রন্থ (‘পরিচ্ছন্নতা ও বিষাদের দেবী’)৷ শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ‘না স্নেহকরস্পর্শ’ (২০১৪)৷ প্রাপ্ত পুরস্কার/সম্মান: শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৩),বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭)৷ এই লিখিত সাক্ষাৎকারটির প্রশ্ণাবলীর উত্তর তথা এই সামগ্রিক কথোপকথন মূলত জি মেল ও মোবাইলফোন-নির্ভর,১৫ ডিসেম্বর,২০১৪ দুপুর ১১.৫২ থেকে শুরু৷ শেষ হল আজ ১৬.১২.১৪. দুপুর ১ টায়৷ কবির  কাছে প্রশ্ণ রেখেছেন : রাজীব সিংহ৷

মাসিক কবিতাপত্র : গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের শেষ থেকেই বা বলা ভালো ছয়ের দশক জুড়ে সারা বিশ্বে পুরনো মূল্যবোধ,সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন,আধিপত্যবাদ,যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবসমাজ৷ এই সময়ে এসে আপনার কবিতা লেখার শুরু৷ এই ঝোড়ো সময় আপনাকে,আপনার কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
সুব্রত সরকার : সময়টা কেতুর দশক৷ যখন মাথা কম পড়লেই রাত্রে পাড়া থেকে অল্পবয়সিদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো৷ পরদিন সকালে তার ছিন্ন-শিরদেহ পড়ে থাকত শিবমন্দিরের মাঠে৷ একটি কাক উপরে ঘুরে ঘুরে ডাকছে--- কা কা কমরেড৷ এ আমার নিজের চোখে দেখা৷
সদ্য কৈশোর শেষ হচ্ছে৷ সুকলের জানালা দিয়ে দেখছি কৃষ্ণচূড়ার ডালে আগুনের ফুল হাওয়ায় দুলছে৷ একটা আদর্শ,মূল্যবোধ,অপরের জন্য কিছু করার তাগিদ তো সেই বয়সেই আসে৷ গুটিপোকা   থেকে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসার বয়স৷ কিন্তু আমরা ফের ঢুকে গেলাম অন্ধকারে,বিশ্বাস হত্যায়৷ রাজনীতি থেকে সেই যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম আর কখনও সখ্য হয়নি৷ এখন তো খবরের কাগজও পড়তে ইচ্ছে হয় না৷ আমার জন্ম দমদম এয়ারপোর্টের কাছে,বহু প্রতিবাদ,মিছিল স্বচক্ষে দেখা৷ বাংলাদেশ যুদ্ধের তাপ-ও কিছুটা দেখতে পেয়েছি৷ একাকী হয়ে যাচ্ছিলাম,‘বন্ধুদের থেকে বাধ্যতামূলক দূরে’ (বীতশোক ভট্টাচার্য)৷
আমি কলোনির ছেলে৷ সেখানে বেশিরভাগ মানুষ গরীব৷ তবু যিনি চুল কাটতেন,যিনি দুধ যোগান দিতেন,যিনি কাপড় কাচতেন,তাঁরা সকলেই আমার মামা৷ বাড়ি থেকে এমনটা শেখানো হয়েছিল৷ যদিও আমি  স্বচ্ছল পরিবারের৷ ওদিকে ছবির মত পরিচ্ছন্ন এয়ারপোর্টের বসতি৷ অপার প্রকৃতিতে ভরা৷ সুন্দর৷ জীবন এত বিপরীত কেন? ভাবতাম৷ তখন তত্ত্বকথা বোঝার বয়স হয়নি,জানতামও না৷ আমি অসহায় হয়ে আমার দুঃখী,নিরন্ন কলোনিটিকে ভালোবেসে ফেললাম৷ এছাড়া উপায়ও ছিল না৷ একটা ক্ষত,পেরেকের নিচে পাইপগানের গুলির দাগ,যাকে পরে চুনকাম করে দিয়েও ঢেকে দেওয়া যায়নি, মনের অন্তরালে আজও রয়ে গেছে৷ সেখান থেকে আজও রক্ত ঝরে৷                                                                                                                              
মাসিক কবিতাপত্র : একদিকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ,ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ,অন্যদিকে ভাঙনমুখী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবির--- একদিকে নতুন স্বপ্ণ,অন্যদিকে স্বপ্ণভঙ্গের হতাশা--- এই পরস্পরবিরোধিতা সেসময় আমাদের দেশেও আছড়ে পড়েছিল৷ আপনার নিজের কবিতায়, আপনাদের সময়ের অন্যদের কবিতায় এই ঝোড়ো দিনগুলির কোনও ক্ষত কী আদৌ লক্ষ করা যায়?
সুব্রত সরকার : আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটতর্ক খুব বেশি বুঝবার কথা নয় সে বয়সে৷ স্বপ্ণ যা ভাঙার তা পাড়াতেই ঘটেছিল৷ কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধ,উদ্বাস্তুদের স্রোত,ভাষার জন্য একটি রাষ্ট্রের জন্ম আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল৷ জীবনানন্দের নামও তো তখনই শুনলাম৷ আমার এক গদ্যগ্রন্থে এসব কিছু কিছু লিখেছি৷ 
মাসিক কবিতাপত্র : তখন আদর্শ হিসেবে কাকে মেনে নিচ্ছেন? আপনার প্রিয় কবি কে?
সুব্রত সরকার : আমার আদর্শ ছিল পাড়ার দাদা-দিদিরা৷ সুকলের স্যারেরা (তাঁরা তখন খুব কম বেতন পেতেন)৷ গোপনে বলি,আমাদের বাড়ির কাছে কয়লার ইঞ্জিনের এক ড্রাইভার থাকতেন৷ তাঁর কালিমাখা ইউনিফর্ম আমাকে মুগ্দ করেছিল৷ বড়ো হয়ে তাঁর মতো হবো ভাবতাম৷ অথচ পাশেই তো এয়ারপোর্ট,পাইলটদের হরবখত্ দেখেছি,তবু৷ শুধু কষ্ট হত তিনি যখন মাঝে-মধ্যে বাড়ি আসতেন,মদ খেয়ে হল্লা-গুল্লা,ভাঙচুর,বাচ্চা,বউকে পেটানো৷খুব কষ্ট হতো৷ মায়া লাগতো৷ রাগ করতে,ঘৃণা করতে পারতাম না৷
প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ তিনি চিরকাল আমার কাছে ভগবান-সদৃশ৷ জীবনানন্দ দাশ আমার ভালো লাগে না, তা তিনি যত বড়ো কবিই হোন৷ 
মাসিক কবিতাপত্র : কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ কী কখনও আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল? কবিতার শরীর অর্থাৎ ফর্ম আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সুব্রত সরকার : অবশ্যই মার্কসবাদ৷ কিন্তু পরে এ মোহ ভঙ্গ হয়৷ গৌতম বুদ্ধের ত্রিশরণ--- সাম্য,মৈত্রী ও করুণার মধ্যে করুণাটি সেখানে ছিল না,পরে বুঝতে পেরেছি৷ করুণার বদলে মার্ক্সিস্টরা স্বাধীনতা শব্দটি ব্যবহার করেন৷ তার ফল কী হলো বিশ্ব জুড়ে সকলেরই জানা৷
কবিতার ফর্ম নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ,কিন্তু তা স্বতঃস্ফূর্ত হতে হয়৷ চতুর্দশপদী লিখবো বলে লিখলে তার ছন্দবন্ধন হয়তো সঠিক হবে,কিন্তু শেষ অবধি তা কবিতা না হতেও পারে৷ কবিতা আকস্মিকতায় উদিত হয়,সে নিজেই ঠিক করে নেবে কিভাবে সে নিজেকে রচনা করবে৷ কবির কাজ হলো কবিতাকে অনুসরণ করা৷ আমার এমন মনে হয়৷
মাসিক কবিতাপত্র : তা হলে ছন্দ ও নির্মাণ-প্রকৌশল কী একজন কবিকে সেই যোগ্যতামান দেয় না? সবটাই আকস্মিকতা?
সুব্রত সরকার : এখন কেউ উটের মত গলা বাড়িয়ে বলতে পারেন,ছন্দ জানা কী অর্জন নয়? নতমস্তকে তা স্বীকার করছি,এও এক দক্ষতা৷ তবে তা শিল্পীর নয়,কারিগরের৷ তা যারা কারিগর হতে চান, হোন৷ কে বারণ করছে! আরও একটা বিষয় থাকে,যা  অলৌকিক,অতিলৌকিকও বলতে পারো,যা কবিকে ভর করে৷
মাসিক কবিতাপত্র : পত্রিকা সম্পাদনাকে অনেক কবিই লঘু কাজ মনে করেন৷ আপনার মত৷
সুব্রত সরকার : আমি নিজেই দীর্ঘদিন পত্রিকা সম্পাদনা করেছি৷ ‘দেবীমুখ’ বের করেছি৷ সুতরাং আমি এমন মনে করি না৷ কিন্তু এর ফলে নিজের লেখার অনেক ক্ষতি হয়৷ সময় নষ্ট হয়৷ সম্পর্ক নষ্ট হয়৷
মাসিক কবিতাপত্র : আপনার কবিতায় চিরায়ত রোমাণ্টিকতার বদলে অত্যন্ত উদাসীন ও মেধাবী এক  সত্তা লক্ষ করা যায়৷ যা অত্যন্ত অনুভূতিসম্পন্ন ও সারাক্ষণ ক্রিয়াশীল৷ দেশী-বিদেশী নানা তত্ত্ব,পুরাণ ও সমাজচিন্তা আপনার কবিতার উপাদান৷ প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গির বিপ্রতীপে আপনার সামগ্রিক উচ্চারণ৷ কেন?
সুব্রত সরকার : নিজের কবিতা সম্পর্কে কিছু বলা আমার কাছে অরুচিকর৷ প্রত্যেক কবিই চেষ্টা করেন স্বকীয়,স্বতন্ত্র হতে৷ আমি পেরেছি কি না জানা নেই৷
আমি একটি কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠানে ২৭ বছর ধরে কাজ করছি,সহকর্মীরা কেউ কবিতালেখা তো দূরে থাক,পড়েও না৷ তবু আমার নানা বায়না,নানা অস্বাভাবিক আচরণ যা এ ধরণের প্রতিষ্ঠানে কেউ করে না,করেছি,তারা সহ্য করেছে৷ এ জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ৷ এটা খবরের কাগজে কাজ করলে পেতাম না৷ তারা আমি কবিতা লিখি বলে নয় এক বিচিত্র সহকর্মী হিসেবে আমাকে আড়াল করেছে,যাতে ক্ষতি না হয়৷ এইসব আমাকে লেখায়,অতিলৌকিকে পৌঁছে দেয়৷
মাসিক কবিতাপত্র : কোনও নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন কী কখনও আপনাকে প্রভাবিত করেছিল? অনুজ কবি হিসেবে ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? 
সুব্রত সরকার : কোনও সাহিত্য আন্দোলনে জড়িত থাকিনি,প্রভাবিতও হইনি৷ কবিতা একাকী মানুষের সৌন্দর্য--- এরকম আমার বিশ্বাস৷ অগৌণ কবিরা দল পাকায়৷ কৃত্তিবাসে দু-একবার লিখেছি৷ কারুর কারুর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল,এর বেশি কিছু নয়৷ শতভিষা-ও তাই৷
মাসিক কবিতাপত্র : লিটল ম্যাগাজিন-বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সম্পর্কে আপনার মত কী? 
সুব্রত সরকার : এখন আমি একা থাকতে চাই৷ নিজের সেরা লেখাটা আজও লিখতে পারিনি,অন্য কিছুতে মন দিলে কখনও পারবোও না৷ প্রতিষ্ঠানের যেমন বহু বজ্জাতি আছে,লিটল ম্যাগাজিনওয়ালারাও কিছু ধোওয়া তুলসিপাতা নয়৷ এসব পাঁক থেকে দূরে থাকবার জন্যে প্রত্যেক কবির নিজস্ব পদ্ধতি আছে৷ যে যার নিজের চটি পরে হাঁটবেন৷ এখন কারুর পিছনে যদি কাদা ছিটকে যায়,সে তার সমস্যা৷ আমি ভাবতে যাবো কেন?
মাসিক কবিতাপত্র : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের প্রেক্ষিতটি কী? 
সুব্রত সরকার : এয়ারপোর্ট ছিল অপার সবুজে ভরা৷ আমি তার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলাম৷ বিস্তৃত আকাশ আর প্রচুর মহাকায় বৃক্ষ৷ যাদের পাতার আড়ালে অজস্র পাখি কিচ্মিচ্ শব্দ করে চলেছে৷ যেন এক অনন্ত শিল্পী কাঠখোদাই করে অসীম জগৎচিত্র রচনা করে চলেছে জীবন-পারাবারে৷ আমি সেই চিত্রের কানাৎ উঁচু করে নিজের নামটি লিখতে চেয়েছিলাম৷ কী বোকার মতো কাণ্ড,আজ বুঝি৷ কিন্তু ওই পাখির আওয়াজ কী ভয়াবহ,বোঝাতে পারবো না,বোঝাতে পারিনি৷ নিঃশেষ হয়ে গেছি৷ কিচ কিচ করে তারা ডাকছেই৷ জীবন অন্তরালে৷ আর চিরকালীন চিত্র রচিত হয়ে চলেছে অদৃশ্য জগতের ইশারায়৷শুধু সেখানে আমার স্থান হয়নি৷
এর উল্টোদিকে আমাদের কুশ্রী কলোনি৷ অশিক্ষিত,ক্ষুধার্ত৷ তবু তাকে পর ভাবতে পারিনি৷ তারা যে আমার মামা-কাকারা,তাদের ছেলেমেয়েরা যে আমার দাদা-দিদি,ভাই-বোন৷ অতএব আমার লেখায় কলোনিটি কখনও মা,বাবা,ভাই-বোন,বন্ধু,বা কখনও স্বয়ং আমি হয়ে উঠেছি৷ সে যেন এক মানুষ৷ কোনও সুররিয়ালিস্টিক ভাবনা নয়,শব্দটাই জানতাম না তখন৷ কেবল বাড়ির পিছনের একলা,নিঃসঙ্গ দেবদারু বৃক্ষ আমাকে দিয়ে এসব লিখিয়েছিল৷ আমি তাকে দেবু-দা বলে ডাকতাম৷
মাসিক কবিতাপত্র : ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার--- আপনি স্বীকার করেন? 
সুব্রত সরকার : হ্যাঁ৷ ঐতিহ্য--- ইতিহাস৷ উত্তরাধিকার--- বর্তমান৷
মাসিক কবিতাপত্র : সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক একটা আছেই৷ এ নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগও সর্বজনবিদিত৷ এ বিষয়ে আপনার মত কী? 
সুব্রত সরকার : এ বিষয়ে কি আর বলবো! সবাই সব জানে৷ এসব উপেক্ষা করতে হয়৷ তবে কবিও যেহেতু সামাজিক মানুষ,তাই তাকে বহু অভ্যাস করে এই উপেক্ষা-শক্তি অর্জন করতে হয়৷
মাসিক কবিতাপত্র : বাংলা কবিতায় কলকাতা-কেন্দ্রিকতার অভিযোগ নিয়ে আপনার অভিমত কী? 
সুব্রত সরকার : কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী৷ সেখানে থাকলে তো বহু সুযোগ,সুবিধা মিলবেই৷ একটা ভালো বইয়ের খোঁজ পেতেই তো কত দেরি হয়ে যায় দূরের কবিদের৷ হাতে পাওয়া তো পরের ব্যাপার৷ তবে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে৷ এই কেন্দ্রিকতার শাসন আস্তে আস্তে আলগা হচ্ছে৷
মাসিক কবিতাপত্র : অনেকেই দাবি করেন গত শতাব্দীর সাতের দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায় মৌলিক চিন্তার বড়ো অভাব৷ আপনি কী বলবেন? 
সুব্রত সরকার : এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা৷ প্রাকৃতিক ভাবেই এটা হতে পারে না৷ সত্তরের সব কবিই কিছু মৌলিক লেখেনি৷ আবার পরবর্তী দশকের অনেক কবিই আমার প্রিয়৷ এসব নিয়ে গবেষণা,আলোচনা-সভা হওয়া দরকার৷ তবেই প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হবে৷ আলটপকা মন্তব্য করে কেউ কেউ নিজেকে জাহির করবার চেষ্টা করে৷ পদ্ধতিটা ঘৃণ্য৷
মাসিক কবিতাপত্র : এই এতটা পথ পেরিয়ে,‘কবিতাসমগ্র’ প্রকাশের পর ‘দেবদারু কলোনী’,‘তোমাকে মিথ্যে বলেছি’,‘সহ্য করো,বাংলাভাষা’ ইত্যাদি গ্রন্থের কবির তাঁর অনুজ কবিদের প্রতি কোনও বিশেষ পরামর্শ? 
সুব্রত সরকার : আমি পরামর্শ দেবার কোন্ হরিদাস? তারপরেও আমার যত কিছু ষড়যন্ত্র তা তো লেখাতেই রয়ে গেল৷ পড়ে কিছু মনে হলে ভালো৷ না মনে হলেও ভালো৷
মাসিক কবিতাপত্র : কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা না গদ্য, আজকের তরুণতমদের কবিতায় কিসের প্রভাব স্পষ্ট বলে আপনি মনে করেন? 
সুব্রত সরকার : জীবনানন্দ আমার ভালো লাগে না৷ তাঁর গদ্য-পদ্য কিচ্ছু না৷ অনুসরণ করলে কানা গলিতে প্রবেশ করা হবে৷ বরং মধুসূদন এখনও সাহায্য করতে পারেন৷ 
মাসিক কবিতাপত্র : পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের কাছে কী আশা করেন? 
সুব্রত সরকার : বাংলা ক্রিয়াপদের কিছু সমস্যা আছে৷ যার উত্তরণ এখনও হয়নি৷ মনে রাখতে হবে ক্রিয়াপদ সময় নির্দেশক৷ সময় কিন্তু একটা ধারনা,যাকে বাস্তব বলে আমরা দাবি করি৷ সময়ের শক্তি অসীম, অক্ষয়৷ তন্ত্রে কালীমূর্তি সময়ের প্রতীক৷ আমি সারাজীবন ধরে তাঁর ধ্যান করে গেলাম৷ দেখা মেলেনি৷ বঙ্কিমচন্দ্র ধার করে বলি--- মা যা ছিলেন,মা যা হইয়েছেন,মা যা হইবেন৷ নীলসরস্বতী-র প্রকৃত স্বরূপ তরুণেরা প্রকাশিত করুন,এই প্রার্থনা৷ জয় তারা৷ 

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা সংখ্যা, ২০১৫ থেকে পুনঃপ্রকাশিত) 

চিত্রা লাহিড়ী ।। দুটি কবিতা

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০


চিত্রা লাহিড়ী ।। দুটি কবিতা 





সহজ মনের দেশে 

ভাসছে মেঘ সহজ মনের দেশে 
শুন্যে উড়ে পাখির ডানার মত 
কবে কোথাও জীবন দেখার শেষে 
জোৎস্নারাতে বৃষ্টি অবিরত 

অতিমারি 

নাবিকের মতো ভেসেছিল এক প্রাণ 
জীবন গতিতে ছোটো ছোটো ঢেউ সারি 
মধ্যরাত্রে দূরে ছিল জলযান
আনতপ্রাণের আজ নাম অতিমারি


ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট/রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে

মাসিক কবিতাপত্র অনলাইন ।। সংখ্যা ৬।। ০৬ অক্টোবর, ২০২০



রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে



ছবিঃ হিরণ মিত্র 

( গত সংখ্যার পর )

৯. রোগমুক্তি

জ্যাঠামশাই বেশ দৃঢ়-স্বরেই বলেছিলেন, ‘বাড়ির দলিল তোমাকে নিজে খুঁজে নিতে হবে৷ আমি দিতে পারবো না৷’
কৃষ্ণেন্দুর বাবা সরল বিশ্বাসে দাদার কাছে জমা রেখেছিল দলিল তথা বন্টননামার আসল কপি৷ তার ছোটোকাকাও এ নিয়ে কখনও আপত্তি করেনি৷ চাকরি পেয়ে প্রথমবার ব্যাঙ্কলোনের জন্য বালকের দলিলের খোঁজ৷ ততোদিনে বালক কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যুবক৷ পৈতৃক-বাড়ির যতোটুকু বাবার ভাগে, তার কিছু জরুরি সংস্কার করা প্রয়োজন৷
---দেখেছিস, রতনের মাথার পেছনটা জয়সওয়ালের মতো৷
বরং অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে জ্যাঠামশাইয়ের কোনও জুড়ি নেই৷ অসুবিধে তো নেই-ই৷ কৃষ্ণেন্দু জ্যাঠামশাইয়ের এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে৷ তাদের এই পারিবারিক দোতলা বাড়িটির তিনদিকে তিনটি দালান কোঠা৷ একতলা-দোতলা মিলিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে ওদের বাস৷ মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে উঠোন, অর্থাৎ কমন-স্পেস৷ তার পেছনদিকে একফালি বাগান৷ অযত্নে থাকলেও দু-চারটি গাছগাছালি সেখানে রয়ে গেছে৷ তার ঠিক পেছনেই খিড়কি৷
রতন অর্থাৎ কৃষ্ণেন্দুদের পাড়ার রতনদা ওদের পাশের বাড়ির মিত্রকাকুর ছেলে৷ কৃষ্ণেন্দুর মিত্রকাকুর একমাত্র সন্তান৷ জয়সওয়ালজী আবার মিত্রকাকুর পারিবারিক বন্ধু৷ কাকিমারও৷ জ্যাঠামশাইয়ের এই কুৎসিত ইঙ্গিতটা বালকের পছন্দ হয়নি৷ সে জ্যাঠামশাই ঠিক কি বলতে চাইছে, তা আন্দাজ করতে পারলেও এ বিষয়ে তার কোনও কৌতূহল বা আগ্রহ কোনওটাই নেই৷ চিরকাল জ্যাঠামশাই এটাই করে এসেছে৷ মূল প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছে৷ রতনদা সরকারি চাকরি পায়নি৷ বাড়ির নিচেই তার স্টেশনারী কাম মুদির দোকান৷ বউদি একটা প্রাইভেট স্কুলে ভূগোল পড়ায়৷ বাড়িতে টিউশন-ব্যাচ৷ ওদের একমাত্র মেয়ে খুব ভালো গান করে৷ রবিঠাকুর৷ বেশ কিছু প্রাইজও পেয়েছে গান গেয়ে৷
রেজিস্ট্রি আপিস থেকে দলিলের সার্টিফায়েড কপি বের করে ব্যাঙ্কলোন স্যাংশন করাতে কৃষ্ণেন্দুকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি৷ মাসখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছে শুধু৷ তারপর এক সন্ধ্যায় বালক জ্যাঠামশাইয়ের সামনে মিঠুন চক্রবর্তীর মতো পা বেঁকিয়ে ব্রেকডান্স৷ ছোঃ! বালক ততোদিনে পড়ে ফেলেছে টমাস হার্ডি, অমিয়ভূষণ মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস!  
কৃষ্ণেন্দুর বাবা কখনও চা খাননি৷ পান-বিড়ি-সিগারেট অনেক দূর৷ এক কথায় প্রথাগত নেশা থেকে বাবা শত হস্ত দূর৷ তাঁর শখ ছিল ঠিক কোনটা তা কৃষ্ণেন্দু ছোটো থেকে আজও বুঝতে পারেনি৷ প্রতি রোববার দুপুরে নিয়ম করে মাংস-ভাত, তখনও মাংস মানে মাটনই বোঝাতো, চিকেন যে বছরে-দুবছরে বাড়িতে কেউ আনতো না, তা নয়, তবে তা এলে খিড়কির দিকে তোলা উনুনে রান্না হতো৷ রান্নাঘরে তার প্রবেশাধিকার ছিল না৷ বিরানববই বছর বয়সে নিরোগ দেহে চলে যাওয়ার বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত কৃষ্ণেন্দুর বাবা দু-পিস হলেও মাটনই খেয়েছেন৷ চিকেন কোনও দিন দাঁতেও কাটেননি৷ 
নজরুল যেদিন মারা গেলেন, কৃষ্ণেন্দুর বাবা অসময়ে অফিস থেকে ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসেছিলেন৷ এখনও কৃষ্ণেন্দুর মনে আছে সেই দিনটার কথা৷ তখন ও অনেকটাই ছোটো৷ স্কুলেও যেতে শুরু করেনি৷ অল ইন্ডিয়া রেডিওয় খবর৷ বাবার কাছেই কৃষ্ণেন্দু শুনেছিলো নজরুলের বাকরহিত দিনগুলির কথা৷ কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ, কল্যাণী কাজীর কথা৷ সেই প্রথম সে দেখেছিলো বাবা সেদিন আর অফিসে ফিরে যাননি৷ সারাটাদিন কেমন যেন নির্বাক, অন্যমনস্ক৷ ফুলের সেই ক্রন্দনরত জলসায়৷ 
আরও পরে কৃষ্ণেন্দু যখন স্কুলে পড়তে গেলো, একদিন ছুটির দুপুরে ওর কলম্বাসী মন ঠাকুরদার ঘরের বাঙ্কে কাপড়ের কাভার পরানো ধূলিধূসর বীণা খুঁজে পেয়ে বাবাকে জানাতেই ও জানতে পারলো, ওটা বীণা নয়, তানপুরা৷ আরও পরে ও মায়ের কাছে জেনেছিলো তানপুরাটির মালিক ওর বাবা৷ যদিও কোনও দিন ও বাবাকে রেওয়াজে বসতে দেখেনি৷ অথচ বাবার হাত ধরেই কৃষ্ণেন্দুর প্রথম বড়ে গুলাম, আলাউদ্দিন, আল্লারাখা, আমজাদ আলী, রামকুমার, বেগম আখতার...৷ 
কৃষ্ণেন্দুদের বসবার ঘরে, যাকে ওদের বাড়িতে বাইরের ঘর বলা হত, সেই ঘরে কৃষ্ণেন্দুর জ্ঞান হওয়ার আগে থেকে চারটি কাচ-বাঁধানো ছবি টাঙানো থাকতো, একটু বিবর্ণ, ফ্যাকাশে রঙের৷ চারজন পুরুষের৷  বালক অবাক চোখে দেখতো৷ দু-জনের মাথায় পাগড়ি, একজন টাকমাথা গলা পর্যন্ত চাদর জড়ানো, আর চতুর্থ জনকে বালক ততোদিনে চেনে, মিলিটারির মতো পোশাকে তিনি নেতাজী৷ বাবা বলেছিলেন, ওই যে ডোরাকাটা পাগড়ি উনি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, আর আরেকজন স্বামী বিবেকানন্দ, আর উনি বিদ্যাসাগর৷ অবাক বালক ভাবতো তাহলে তো সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা সাহিত্যসম্রাটের৷ সম্রাট বলে কথা! মনে মনে ভাবতো আমিও বড়ো হয়ে ওঁর মতো সম্রাট হবো! জ্যাঠামশাই কৃষ্ণেন্দুকে বলেছিলেন, ওই অসম্ভব সুন্দর আপাত বিবর্ণ পোর্ট্রেটগুলো কৃষ্ণেন্দুর বাবার আঁকা৷ 
বাবার শখ ঠিক কী ছিল তা কৃষ্ণেন্দু আজও বোঝেনি৷ কোনওদিন বুঝতেই পারেনি৷ লরেল-হার্ডি, চার্লি চ্যাপলিন, বেনহুর, ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন, ইভান্স চাইল্ডহুড, পথের পাঁচালী ... ভস্তক থেকে প্রগতি প্রকাশন... চীনদেশের রূপকথা, গ্রীমভাইদের রূপকথা, ফোক টেলস্ অব বেঙ্গল, রেভারেণ্ড লালবিহারী দে, আর্কাদি গাইদারের ইশকুল... সবই প্রথমবার ওর বাবার হাত আঁকড়ে ধরেই৷ অথচ, কৃষ্ণেন্দুর বাবার শখ ঠিক কী ছিল তা ও আজও বোঝেনি৷ কৃষ্ণেন্দুর স্মৃতিতে এখনও রোববারের প্রলম্বিত সকালে জ্যাঠামশাইয়ের রেকর্ড প্লেয়ার চিৎকার করে কেঁদে ওঠে--- কোয়েলিয়া, মৎ কর্ পুকার...
পাড়ার মোড়ে তখন একটিই দোকান খোলা৷ সেটি মেডিসিন ফার্মেসি৷ নাম : রোগমুক্তি৷ 

২০. মত্তনীল অন্ধকারে

ছবির মতোন একটা সকাল৷ রাত ভিন্নতর৷  উঠতে বসতে সারাক্ষণ কৃষ্ণেন্দুর কেটে যায় বৈষয়িক চিত্রনাট্যের যাবতীয় শুভ ও অশুভে৷ ব্রিজের রেলিঙে হেলান দিয়ে এখন দাঁড়িয়ে৷ একফোঁটা বৃষ্টির ছোঁয়া৷ স্কাইলাইন জুড়ে স্লেট রঙের ঘনকালো মেঘের প্রতাপ৷ মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ ঝলক৷ কৃষ্ণেন্দুর মনে হয় এ সবই তোমার লেখার অনিবার্য শৃঙ্খল আর মুক্তি, যা জলভর্তি ট্রে-তে রাখা বাজারের খলবলে মাছের মতোন জীবন্ত৷ ব্যাঙ্কের পাশবই, সরকারি টিকিট ছাপা কাগজে গিফটডিড আর কবেকার কিনে রাখা টুকরো টুকরো কথার ইশারা৷ জীবনের সকলই৷ জীবন্ত এবং অবয়ববিহীন৷ তার ঠাকুরদা অঘোরবাবু মাঝেমধ্যে এদিকে আসেন৷ ঘুরেফিরে এসে বসেন সেইসব কর্দমাক্ত দুপুরের ম্যাটিনী শো-য়ে৷ গালভর্তি পান-দোক্তা আর জর্দার গন্ধমাখা অনুরোধের আসরে, ভ্যাটের ছড়ানো ময়লায় পড়ে থাকা কাঁঠালের ভুতি আমের আঁটি আর পাড়ার মোড়ে মোড়ে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের চিংড়ি-ইলিশ রেডিও-লড়াইয়ে, সাদাকালো বুলেটবাইকে সাদাকালো রাস্তায় উড়ে যাওয়া সাদাকালো নায়কনায়িকার পথ যদি না শেষ হয় গানে, লম্বা কলার চাপা শার্ট আর কানঢাকা চুলের বেলবটস প্যান্ট ছেলেছোকরাদের আরে দিওয়ানো মুঝে পহেচানো আত্মরতিকালীন খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি দাড়িমুখ ঝোলাঘাড়ে দেশোদ্ধারীর ফাউন্টেন পেনে লেখা কবিতার খাতায় অঘোরবাবু এসে বসেন কিছুক্ষণ৷ তারপর উড়ে যান যাবতীয় বিরোধিতার প্রাচীর পেরিয়ে৷
লেকের দুপুরে তবুও পাগল বিড়বিড় করে৷ ছবি আঁকে অদৃশ্য চক দিয়ে৷ মনে মনে৷ আবার  চুমুও খায় নিঃশব্দে অন্যের প্রেমিকাকে৷ পাগলের মন৷ পাগলমন৷ চুমু৷ অন্যের প্রেমিকাকে৷ তোমার লেখার অনিবার্য শৃঙ্খল আর মুক্তি৷ বাজারে সদ্য নামা চওড়া গোল পেটের রুপোলি ইলিশগুলো বরফকুচির স্তরে স্তরে আঁটোসাটো শরীরে গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থেকে ইশারা করে ডাকে৷ দোকানীর অবিরাম মূল্য-উচ্চারণ থামিয়ে দেয় অলৌকিক সতর্কীকরণে৷ ফিরতিপথে চায়ের দোকানে বসেও সেই আঁশগন্ধ লেগে থাকে নাকে৷ জেগে থাকে ওইসব বরফে শুয়ে থাকা রুপোলি সুন্দরীদের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ৷
ক্যামেরা তোলে ছবি৷ রোল অন৷ ঝরাপাতা গড়ায় শিয়রে৷ পোড়ে সিগারেট জাতীয় সড়কের ঘর্মাক্ত দুপুরে৷ বাড়ির দলিল ওড়ে... বসবাস পালটে যায় চৌখুপি ফ্ল্যাটের বারান্দায়...৷ অঘোরবাবু উড়ে বেড়ান মনখারাপ নিয়ে হাওয়ায় বাতাসে৷ কৃষ্ণেন্দুর লেখার অনিবার্য শৃঙ্খল আর মুক্তি আরো একবার ফিরে আসে ধূপজ্বালানো সন্ধ্যার ড্রয়িংকোটরে৷ খোপে খোপে বারান্দা৷ বারান্দায় বাড়ন্ত মেয়েদের ফেসিয়াল করা কৈশোর৷ কলোনি পাড়াতেও অপটু দোকানির স্পা আর বায়ুনিয়ন্ত্রিত পুরুষ-পার্লার৷ লোকনাথপুজোর পায়েস আর শনিঠাকুরের সিন্নি৷ সান্ধ্যকালীন সংকীর্তন আর তোমাদের পোস্টমডার্ন আড্ডা৷ পুকুর বোজানো পার্ক আর ভাই ভাই সংঘের ক্যারম টুর্নামেন্ট৷ এপারের ফ্ল্যাগচেনে ব্রাজিল আর নতুন ফ্ল্যাটবাড়ির ক্যাম্পাসে নীলসাদা আর্জেন্টিনা৷ চারবছরে এখন এই একটিবারের ফুটবলপ্রেম৷ অঘোরবাবু উড়ে এসে বসেছেন ফ্ল্যাটবাড়ির মেধাবী ডিশ-অ্যান্টেনায়৷ দরমার ধূসর ক্লাবঘরে আজ রাত্রিবাস৷ নির্বাচনে উপহার পাওয়া এলইডি-র বিরাট স্ক্রিনে আজ ফাইনাল... ফিস্ট... হাঁড়িতে টগবগ মাংস... নীল-সাদা জার্সি-টিশার্ট... কাচের গ্লাসের টুংটাং... তোমার লেখার অনিবার্য শৃঙ্খল আর মুক্তি৷ পাগলের মন৷ পাগলমন৷ চুমু৷ অন্যের  প্রেমিকাকে৷
কৃষ্ণেন্দু জানে সে বাড়ি হারিয়ে যাবে৷ সুপারবিল্ট আর কার্পেট এরিয়ার যোগবিয়োগে সারাটাদিন৷ অঘোরবাবু লেকের দিক থেকে দ্রুত ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে আসছেন... 
---তোমাগো আর কোনো কাম নাই বাড়ি ভাংগা ছাড়া! আমাগো হক্কলের দুতলা একতলা দরমার ঘর, কেরোসিন টিন হাতে লম্বা লাইন, র‍্যাশন দুকান--- 
পাতাঝড়া মিলিটারি রোড এক অচেনা স্বপ্ণের মতো স্মৃতিতে ফিরে আসে৷ আই ব্লক, শ্যাওলা-পুকুর, লালকার মাঠ৷ এবাড়ি ওবাড়ি ডিশে ঢাকা পুঁইশাক-লাউচিংড়ি, ফিরতি ডিশে তেলকই-চর্বির বড়া৷ বটার মিষ্টির দোকান থেকে কাগজের ঠোঙায় দুটাকার মহার্ঘ গুজিয়া৷ পদ্মপাতায় শীতলহিম সাদা ও সবুজ কুলপি, শালপাতার বাটিতে আলুর দম প্লাইয়ের চামচ, অন্নপূর্ণা থেকে সুলেখা কালির ফ্যাক্টরি পর্যন্ত অলৌকিক সাইকেল যান৷ হাফপ্যান্টের হাফপ্যাডেল অবাক বিস্ময়ে দেখে টিমটিমে বাল্বের চায়ের দোকানে দেশকাল সমাজচেতনার ঘর্মাক্ত সহাবস্থান৷ তলায় রাবার লাগানো ওয়াকিং স্টিকের পাশে কলার তোলা হাতপাখা কেরানি৷ দফায় দফায় চা... টিনের কৌটোয় বিড়ি... কেরোসিন ভরা সাবেকি লাইটার... কৃষ্ণেন্দু, তোমার লেখার অনিবার্য শৃঙ্খল আর মুক্তি! 
সে বাড়ি তোমার কথা বলে৷ তোমার শৈশবে তোমার সামনেই দরমাঘেরা দুকামরা৷ বারান্দার কোমর পর্যন্ত পাকা হলো প্রথমে৷ নতুন সিমেন্টের মেঝেতে মায়ের দেওয়া কোজাগরীর প্রথম আলপনা... লক্ষ্মীর পা...! বাইরের বারান্দায় হাতলতোলা চেয়ারে বসে অঘোরবাবুর পরিতৃপ্ত ধুম্রপান... টিনের কৌটোয় বিড়ি... কেরোসিন ভরা সাবেকি লাইটার...৷ সে বাড়ি দ্রুত পাকা হলো৷ একতলা... দোতলা... ছাদে সিমেন্টবাঁধানো জলের ট্যাঙ্ক...৷ অঘোরবাবু উড়ে এসে বসছেন সেই জলের ট্যাঙ্কের নিরালা ছায়ায়৷ দ্রুত উড়ে এসেছেন, একটু জিরিয়ে পাড়া ঘুরতে বেরোবেন৷ কার রেশন কার্ড এখনো হয়নি... কার লিভ অ্যাপ্লিকেশন...কার বাচ্চার ফর্মফিলাপ করে দিতে হবে উদ্বাস্তু স্কুলে ক্লাশ ফাইভে ভর্তির!
লেকের হাওয়ানিশান আর জোড়ায়-জোড়ায় বসে থাকা এই দুপুরে সে বাড়ি কৃষ্ণেন্দুর অবচেতন থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ স্মৃতির সরণিতে ক্রমাগত ক্যামেরার রোল অন... দরমার ফাঁকে সূর্যালোক, তোমার প্রথম লেখা কবিতা  হারিয়ে যাওয়া পাইলট পেন সে বাড়ি৷ স্কুলের খাতায় জলছাপে অরণ্যদেব, ব্রুস লী, হ্যাঙারে লুকোনো নানচাকু সেই বাড়ি৷ বর্ষার দিনে কাদাছড়ানো উঠোনে সাজানো ইটের ওপর পা টিপে টিপে হাঁটা সে বাড়ি৷ নীল কালো লাল সবুজ সুলেখাকালির হাতের লেখা সে বাড়ি৷ হালখাতার সন্ধ্যায় গিলে করা পাঞ্জাবি আর ফুরফুরে ধুতির অঘোরবাবু, কাঁধের ঝোলায় ক্যালেন্ডারের গোছা আর মিষ্টির অসংখ্য প্যাকেট সেই বাড়ি৷ চৌকির ওপর বিছানো মাদুর, একটু দূরে হাতলতোলা নড়বড়ে কাঠের চেয়ার, মাটির মেঝেতে ঝাপসা কাচের ড্রেসিং টেবিল সেই বাড়ি৷ সবই কৃষ্ণেন্দু তোমার সেই লেখা আর তার অনিবার্য শৃঙ্খলমুক্তি৷ মধ্যরাতে স্বপ্ণের ভেতর বিশালাকায় ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে আসে তোমার ঘরে৷ তুমি ঘুম থেকে ধড়ফর করে উঠে বসো৷ ঘুমন্ত শরীর অল্প ঝাঁকিয়ে লেজ সোজা করে টেরোড্যাকটিলের মতো দ্রুত উড়ে যেতে চাও সেই মত্তনীল অন্ধকারে৷

২১. প্রেম কহানিমে

ধরা যাক একটা লম্বা রাস্তার কথা৷ পথের দু-ধারে ধূ-ধূ বালি আর নোনা-ধরা কালো কালো ক্যাকটাস৷ আকাশের বিস্তীর্ণ দিগন্তে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলা টেরোড্যাকটিল আর নিচে, আরও নিচে তীব্র গতিতে ছুটে যাওয়া নীল রানওয়ে৷ সনাতন কাঠবিড়ালীদের ঘুরে-ফিরে চলা পথে নিচু এয়ে নেমে আসে অন্ধকার অথবা মারুতিভ্যান৷ অনূদিত শোকগাথা পেরিয়ে তীব্র হয় বাঙালি-মন,পরবাসী সত্তার আকুতি৷ মামনি রাইসম আর ভূপেন হাজারিকা গলা মেলায় শচীন কর্তার ভাটি গাঙে৷ তোমাদের গিটারে বরাকের মেঘলা দুপুর৷ লুইত পারে তখন সূর্যাস্ত৷ সন্ধের অচেনা অন্ধকার এসে গ্রাস করে কৈশোরের চেনা মেলট্রেনকে৷ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আধেকলীন হৃদয় কখন যেন ওইসব মেঘেদের শৈলনিবাসে দূরগামী রাতভোর৷ অথচ সেতুর জন্য মেঘের জন্য তোমাদের জলন্ত কাঠ আর কয়লা সাজিয়ে তোলে ক্যাম্পফায়ার, আগুনের সেঁক৷ এবং আরেকটি নতুন বাংলা গান শৈলশহর থেকে অনেক দূরে তখন৷ তোমার মুখ কুয়াশার ধূসরে ক্যালেণ্ডারের মতোই স্মৃতির চাদরে ছেঁড়াখোঁড়া৷
 
শূন্য পৃষ্ঠার মুখোমুখি অক্ষরসাধনা৷ দিন মাস বছর পেরিয়ে পল অনুপল৷  ট্র্যাপিজের ঝুলন্ত দোলনা থেকে গলন্ত মোমের মতো পিছলে যাচ্ছে হাত, মুঠোধরা আঙুল, গেরস্থালির সর্বংসহা নিশ্চিন্তি৷

দোতলার ক্লাশরুম৷ বন্দী জানালায় মগ্নদুপুর৷ ভ্যাগাবণ্ড ইচ্ছের চিৎকারে চিৎকারে হঠাৎই অঝোর ধারায় বৃষ্টি মেঘছোঁয়া জঙ্গলে জঙ্গলে৷ রোগা-রোগা নদী ও পিচরাস্তার অদ্ভুত যুগলবন্দী৷ ওদিকে ধূসর আকাশ জুড়ে একঝাঁক সাদাপাখি৷ রুকস্যাক, চেনা রিংটোন আর ফ্ল্যাশগানের ঝিলিকে পথ হারায় ছায়াসবুজ অন্ধকার৷

হারিয়ে যাওয়া বসন্তদিন এসো৷ এসো হারিয়ে ফেলা নদীতীর৷ কোথায় যেন হারিয়ে গ্যাছে ঘরে ফেরার গান৷ একা এবং সমবেত সেই দু’মলাট শুশ্রুষাদ্বীপের মতো জেগে ওঠে এখনো৷ আর রোগা মেয়েটি,কালোচোখ নারীলোকটি, হস্টেলের নির্জন ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে৷ আস্তাবলের পেছনের মাঠ ও সার্কাসের তাঁবু ফিরিয়ে নিয়ে যায় হাওয়াকলের ঘাসে৷ শীত চলে এলো শহরে৷ কমলালেবুর চিবোনো কোয়ার মতো সম্পর্কেরা রাজপথে সভা করে৷ গান ও শ্লোগান৷ এখনো প্রজাপতিরা ঋতুমতী হয়৷ বিবর্ণ মথ এসে ওড়াউড়ি করে ড্রইংরুমে৷ চলো,যৌনভাবে কামনা করি অপর লিঙ্গকে৷ প্রেমভাবে কামনা করি অপর লিঙ্গকে৷ বন্ধুভাবে কামনা করি অপর লিঙ্গকে৷ বন্ধু ভেবে কামনা করি অপর লিঙ্গকে৷ আকাশের অন্ধকারে ঠায় জেগে থাকে ধ্রুবতারা,কালপুরুষ,সপ্তর্ষিমণ্ডল৷

এইসব করুণ উৎরোল-শেষে কেঁদে কেঁদে ঘুরে-মরা চিল ভালোবেসে সাজিয়ে রেখেছিলো আগুন৷ প্রচণ্ড শীতের রাতে গিটারের শীর্ণ তারে বাজিয়ে তোলা মৃত্যুসঙ্গীতে একা চিল পেতে চেয়েছিলো বান্ধবীর মন৷ তখনই আকুল বাতাসে উড়ে যায় শত সহস্র অক্ষরের লিখনভঙ্গিমা৷ চক্রাকারে উড়ে উড়ে মৃদুডানা গোঁত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়ে টেরোড্যাকটিল৷ লেডিজ হস্টেলের খোলা ছাদে৷

রাস্তাটার স্বপ্ন দেখে দেখে যারা কাটিয়ে যায় রাত, তাদের রাত্রির মধ্যবর্তী সময়ে একা কেউ চলে যায় ছাদে৷ রাস্তার মোড়ে হিমঠাণ্ডায় স্থির জমে থাকা মনীষীর স্ট্যাচু গোপন ইশারা করে মুখ ভ্যাঙচায় তাকে৷ তার অধোবদন লজ্জায় রাঙানো ভারি অক্ষিপল্লবে লেপ্টে থাকা কুয়াশা আর ত্রিমাত্রিক সংরাগে নিষিক্ত হয় অন্যের হৃদয়৷ কলেজ-ক্যাম্পাসে ছিটিয়ে রাখা তামাককুচি আর অন্ধকার ও পলাশ দিয়ে গাঁথা সেই মালিকায় সে কামনা করে প্রেম৷ ফ্রিল দেওয়া তার গাউনের শুভ্র-স্বচ্ছ ঘের উড়ে যায় দমকা হাওয়ায়৷ উঁচুবাড়ির ওপর থেকে ক্রমশ ছোটো হয়ে আসে কৃষ্ণেন্দুদের স্কিজোফ্রেনিক নাগরিক-জীবন৷ আর রাতশেষে প্রতিদিন তার স্বপ্নের অক্ষরেখা ছিঁড়ে দূরে ছুটে চলে যায় নগ্ন-ন্যাড়া-বিষণ্ণ্ আলপথ৷  
 
কখনো মনে মনে লোভ করিনি তোমার৷ কখনো একা নিজে চেয়েছি তোমায়, মনেও পড়ে না৷ অন্ধকারে, স্বমেহনে মাথা জুড়ে পাখি আর নদীদের চোরাগোপ্তা প্রেম৷ বুক ছঁুয়ে গা ছঁুয়ে দেখা৷ আলজিভে অনুভবে জেনেছিলাম তুমিই পৃথিবী৷ শব্দব্রহ্মে ভেসে যাক সঘন সম্পর্ক, দুপুরের ফাঁকা বাড়ি৷ কলেজপালানো অনর্গল কথাস্রোত৷ হাসি৷ বিশাল জঙ্ঘা শুধু স্বপ্ণে ভাবি৷ রোমশ অন্ধকার ঝঁুকে আসে মুখের উপর৷ তার খোলা সর্পিল কেশরাশি জড়িয়ে ধরেছে মুখ বুক আর প্রত্যঙ্গসকল৷ ক্লান্ত প্রেমিক ছোটে মাঝদরিয়ায়, ঠোঁট ফেটে রক্ত৷ দুঃস্বপ্ণ জেগে থাকে হিমছুরিকায়৷ আমিই পুরুষ৷ দক্ষপ্রজাপতি বৃক্ষ৷ আমিই হিমগিরি৷ পাতালে খুলে রাখো মৃত-খোলস৷ হাঁ-মুখ বড়ো করো,খুলে দাও ঠোঁট, জিহ্বায় জিহ্বায় প্রসারিত করো লাভাস্রোত৷ গরম আদর৷
বন্ধ জুটমিলের মতো দুর্গম তোমার শরীরে কখনো অসৎমনে প্রবেশ করিনি৷ অথচ তোমায় রোজ স্বপ্ণে অথবা স্বপ্ণদোষে দীর্ঘক্ষণ৷ ঘোলাটে আকাশে এসে জমে ঘনকালো মেঘের শরীর৷ কাচের চুড়ির মতো রিনঝিন শব্দে পাল্টে যায় দিন৷ পেছনে রাস্তায় ট্রামের ঘরঘর ঢংঢং৷ শিশিরে-ভেজা স্তন পাগলীর একটা পা উঠে আছে ফুটপাথের রেলিঙে৷ আর অন্য পা ও নগ্ণ শরীরে লেগে আছে ভোরের শিশির, ধর্ষণের ক্ষত৷
ক্লান্ত টেরোড্যাকটিল ঘুমোয় তখন৷ তার মস্তিষ্কের কোটরে কোটরে বাসা বাঁধে উই৷ সৌরজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন গ্রহের বুকে সাজানো থাকে শেষবিচারের নকল আদালত৷ যেন প্রত্নসময় থেকে কেউ এসে ক্রমাগত প্রশ্ণ করে তাকে৷ রাক্ষুসীর কঠিন নিষ্ঠুরতায় কেউ এসে আঁকড়ে ধরে তাকে৷ তার শরীরের যাবতীয় ওম্, তার শীতলতা নিংড়ে নিয়ে দূরে ছঁুড়ে ফ্যালে তাকে৷ একটা বিচ্ছিরি ঘণ্টাধবনি বেজে যায় একটানা৷ ওদিকে আরও দূর বিদর্ভনগরে তখন বন্দিমেঘ বৃষ্টি হয়ে মুক্তি পেতে চায় খ্যাপার পাণ্ডুলিপি জুড়ে৷ এইসব অনিবার্য জাগতিকতায় তাহাদের মধ্যবিত্ত-প্রেম একছুটে পালিয়ে যেতে চায় বালিয়াড়ি পেরিয়ে দূর উপন্যাসে৷ যেখানে এখনও স্তব্ধ অপেক্ষায় রৌদ্রে পড়ে আছে স্বপ্ণের এলডোরাডো, একা চিল অথবা ক্লান্ত টেরোড্যাকটিলের আছড়ে ভেঙে যাওয়া প্রেমের গল্প৷      

২২. থার্টিফার্স্ট

এই ছুটির দুপুরে উল্টোদিকের ত্রিকোণ একফালি পার্কে স্তূপ হয়ে জমে আছে ঝরাপাতারা৷ ঝাউ আর ইউক্যালিপটাস গাছগুলির লম্বা ছায়া পার্কে আলোছায়ার জ্যামিতি এঁকেছে৷ ভাঙা বেঞ্চে দু-জন পাতাখোর ঝিমোচ্ছে, ইতস্তত রোদে পোড়া কাক৷বালক ছুটছে একজন ডাক্তারের খোঁজে৷দুপুরে সমস্ত দোকান বন্ধ৷ মোবাইল সুইচডফ৷ হঠাৎই তোমার অস্বস্তি, দু-দিন ধরেই৷ রিক্সো ছুটে যাচ্ছে তোমাকে নিয়ে বারোভূতের মেলার মাঠ পেরিয়ে পলি ক্লিনিক৷ ব্লাড-ইউরিন-এক্স রে...৷ তুমি খেতে চাইছো না কিছুই৷ ডাক্তারের দেওয়া ট্যাবলেট!কোথাও কী ভুল ছিল কোনও! জানি না৷ বালক পালস পাচ্ছে না তোমার৷ অল্প হাঁ হয়ে আছে তোমার মুখ৷ ঘুমের কোন অতলে তলিয়ে গেছ তুমি! তোমাকে নিয়ে তারপর সারাটা সন্ধে, রাত৷ একই রকম শুয়ে আছো তুমি৷ তোমার স্ট্রেচার ছুঁয়ে বসে আছে বালক৷একা, অনন্তকাল৷ সময় যেন ফুরোয় না৷মাঝে মাঝে তোমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে ঝুঁকে দেখছে বালক৷ সমস্ত চরাচর স্তব্ধ৷ অন্ধকার৷ এই ক্রিমেটোরিয়ামে৷ দূর থেকে ভেসে আসছে অদেখা বিড়ালের মড়াকান্না৷ বালকের দু-কান বন্ধ৷ বুক ফেটে যাচ্ছে কান্নায়৷ রুক্ষ দুই চোখ জ্বালা করছে৷

এই তো নামছি দেখ এক পা দুই পা
ডেকেছো যতো দূর নিরুত্তর
সঙ্গী স্বজনেরা আঁকড়ে ধরে আছে
আগুনে লেলিহান প্রবেশমুখ
তোমার এইটুকু শরীর পেয়েছি
মাটির মালসায় ছাইয়ের স্তূপ
চলেছি ভাসাতে অকূল ধারাস্রোতে
একটি প্রাণফুল নাভির মূল
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি 
গৃহ্ণাতি নরোহপরানি
শরীর ত্যাগ করে ফিরবে আর কী
জানি না নিশ্চিত নিঝুম রাত
আমি তো স্নান শেষে নবীন বস্ত্রে
গলায় চাবি আঁটা অশ্রুঢেউ
আরেক প্রাণফুল জীবনে জড়িয়ে
ফিরেছি শেষরাত লালকা লেন

কৃষ্ণেন্দুরা চার নম্বর থেকে চলে এসেছে অনেকদিন৷ শুধু বালক জানে না...৷

গয়নার বাক্স আর পাণ্ডুলিপির চিহ্ণ আঁকা আছে সেই পথে৷ ক্রমশ এগিয়ে চলেছে দিন৷ থার্টিফার্স্ট৷ আরেকটা নতুন বছর৷ কতোদিন তোমার সঙ্গে দেখা নেই৷ অথচ নির্বিকার হাঁটাপথ, পথে পথে ছড়ানো পাথরে পায়ে-পা লেগে হোঁচট খেয়েছে আলো৷ শহর জমজমাট৷ ধুন্ধুমার লেগে গেছে বেলুন আর মাইকের তারস্বর চিৎকারে৷ হাঁড়িতে টগবগ রক্তিম মাংস থেকে পাকে পাকে উঠে যাচ্ছে ধোঁয়া৷ পাখিরা স্বয়ংক্রিয় হয়ে উড়ে যাচ্ছে নিঃসঙ্গ স্টেশনচত্বরে৷ শব্দ করে মোবাইলে এসেমেস এলো, ছ্যাঁৎ করে উঠলো বুকের ভেতর৷ ন্যারেশন তোমার ভীষণ পছন্দ জানি৷ অথচ এক অদেখা মানুষের মুখের মতো এই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসা৷ বেলুনের নীল রঙ৷ ক্রমশ ধূসর হয়ে আসা স্মৃতির মিছিল৷ নির্দিষ্ট গানটিও কখন যেন হারিয়ে গেছে সেই পথে৷ আর তীব্র বাজনার সাথে কোমর দুলিয়ে একটু একটু বুকের কাছে বুক৷ মুখের কাছে মুখ৷ ঠেঁটের কাছে ঠেঁট৷ থার্টিফার্স্ট৷ আরেকটা নতুন বছর৷ অথচ কতোদিন দেখা নেই৷ নির্বিকার হাঁটাপথ৷ সেই পথে একটি নৌকো নামানো আছে ঘাটে৷

২৩. অ্যাসাইলামে একা৷ ফার্স্ট সিটিং

---কী নাম আপনার?
পরিশীলিত ভারি কণ্ঠে জানতে চান ডক্টর শর্মা৷
---আজ্ঞে কৃষ্ণেন্দু৷ কৃষ্ণেন্দু মল্লিক৷
একটু থেমে থেমে উত্তর দ্যায় কৃষ্ণেন্দু৷
---ও আচ্ছা৷ থ্যাঙ্ক ইউ৷ আচ্ছা মিস্টার মল্লিক, বাড়িতে কে কে আছেন আপনার?
---আমি, আমার স্ত্রী সোমদত্তা আর...৷
কৃষ্ণেন্দু একটু থামে৷
---আর?
ডক্টর শর্মার উদ্গ্রীব প্রশ্ণ৷
---না, ও তো হস্টেলে থাকে৷ বাড়িতে থাকে না৷
বেশ জোরের সঙ্গে বলে কৃষ্ণেন্দু ৷
---কে?
ডাক্তার আরও কৌতূহলী৷
---আমাদের একমাত্র সন্তান বৃষ্টি৷ আমার আর সোমদত্তার৷
কেমন যেন উদাসীন আর বিষণ্ণ্ শোনায় কৃষ্ণেন্দুর কণ্ঠ৷
---ও আচ্ছা৷ ভেরি গুড৷ তা কোন্ হস্টেলে থাকে বৃষ্টি?
---না, দূরে নয়৷ কাছেই একটা হস্টেলে থাকে ও৷
বেশ অপ্রস্তুত কৃষ্ণেন্দু ৷ 
---সরিষা সারদা মিশনে৷ ক্লাশ সিক্স৷
---ও, ইটস্ অলরাইট৷
খানিক নীরবতা৷ ডক্টর শর্মা তাঁর ডায়েরিতে নোট নিতে মগ্ন৷
---আচ্ছা মিস্টার মল্লিক, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
খানিকক্ষণ পরে ডাক্তার নীরবতা ভাঙেন৷
---বলুন৷
---ওই অতোটুকু মেয়েকে হস্টেলে পাঠালেন কেন আপনারা? স্যরি, কিছু মনে করবেন না৷ জানি এটা আপনাদের পারসোনাল ম্যাটার৷ কিন্তু কী করবো বলুন, ডাক্তার হিসেবে আমাকে তো এটুকু জানতেই হবে৷ বাড়িতে কোনও প্রবলেম---?
ডক্টর শর্মার এই প্রশ্ণের কৃষ্ণেন্দু কোনও উত্তর দ্যায় না৷ ও শক্ত করে চেয়ারের হাতল ধরে চুপ করে বসে থাকে৷ ধীরে ধীরে প্রিয় ঔপন্যাসিকের মুখটা ওর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ প্রায় প্রতি উইকেন্ডে যিনি গল্প-শিকার করতে বেরিয়ে পড়েন এদিক-ওদিক৷ অন্যের জীবনের ব্যক্তিগত আলো ও অন্ধকারের প্রতি যাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ৷ ঔপন্যাসিকের সেই কৌতূহলী মুখের সঙ্গে এই ডাক্তারের প্রশ্ণ করবার ধরন, মুখাবয়ব ও ম্যানারিজমের কোথায় যেন এতোটা মিল৷ যেন একটাই লোক৷ চরিত্র পালটে পালটে মঞ্চে আসছে বারবার৷
---ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ নো প্রবলেম৷ আয়্যাম স্যরি৷
ডাক্তারের সপ্রতিভ আচরণে কৃষ্ণেন্দুর ঘোর কাটে৷
---দেখুন কোনও তাড়া নেই আমাদের৷ আপনার যখন ইচ্ছে হবে বলবেন৷ ইচ্ছে না হলে বলবেন না৷ কিন্তু আপনি তো জানেন, ডাক্তার বা উকিলকে সবটা না বললে সমস্যার সমাধান হবে কী করে! খুব স্ট্রেস লাগছে বুঝি৷ এসি-টা আরেকটু চিল করি? জল খাবেন একটু?
বেশ আন্তরিক দেখায় ডাক্তারবাবুকে৷ কৃষ্ণেন্দু এক গ্লাস জল খায়৷
---দেখুন মিস্টার মল্লিক, মনের ওপর অকারণে কোনও স্ট্রেস পড়তে দেবেন না৷ অকারণ চিন্তাকে  একদম আমল দেবেন না৷ আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন৷ আমাকে ফ্র্যাঙ্কলি বলুন আপনার কথা, আপনার পরিবারের কথা, আপনার প্রবলেমের কথা৷
টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখা ডাক্তারের হাতদুটো হঠাৎই চেপে ধরে কৃষ্ণেন্দু ৷ তারপর কেমন ফ্যালফ্যাল চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাকে আপনি বাঁচান ডাক্তারবাবু৷ কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার---৷’
---কৃষ্ণেন্দুবাবু, ডোণ্ট গেট আপসেট৷ আপনি আমাকে ডিপেন্ড করতে পারেন৷ সব কথা খুলে বলুন৷ বলুন, কী প্রবলেম আপনার?
কৃষ্ণেন্দু ধীরে ধীরে কয়দিন আগে কাগজে বেরনো খবরটার কথা ডক্টর শর্মাকে বলে৷ বলতে বলতে ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়৷ শক্ত হাতে চেয়ারের হাতল ধরে হাঁফাতে থাকে ও৷

স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন

নিজস্ব সংবাদদাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, ২৪ জুন: স্বামীর কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যৌন নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তিন সন্তানের এক জননী৷ গতকাল দুপুরে দক্ষিণ চবিবশ পরগণার কুলতলি গ্রামে নিজের বাড়িতে নিজের স্ত্রীর হাতে খুন হলেন তাঁর স্বামী রবি বিশ্বাস (২৮)৷ রবি পেশায় দিনমজুর ছিলেন৷ খবরে প্রকাশ, গতকাল দুপুরে তিন সন্তানকে নিয়ে রবির স্ত্রী যখন ঘুমোচ্ছিলেন, তখন উন্মত্ত অবস্থায় ঘুমন্ত স্ত্রীর উপর হঠাৎ চড়াও হওয়ায় তার স্ত্রী লুকনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে আচমকা ছিন্ন করে দেয় রবির পুরুষাঙ্গ৷ পরে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রবিকে নিয়ে গেলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়৷ তার স্ত্রী এখন পুলিশি হেফাজতে৷ তাকে সোমবার আদালতে তোলা হবে৷

---কেন? কেন ডাক্তারবাবু? কতোটা নিপীড়ন হতে পারে যে স্ত্রী তার স্বামীর সঙ্গে এরকম ভয়ানক আচরণ করতে পারে? দেশে কী পুলিশ-প্রশাসন-আইন-কানুন কিচ্ছু নেই? ওই মহিলা কী প্রতিবেশী বা পুলিশের কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারতেন না নিজে এতোটা নিষ্ঠুর না হয়ে? এ কেমন রিলেশনশিপ? আমরা কী এখনও মিডিয়েভাল এজে রয়ে গেছি? উফ্! কী ভয়ঙ্কর প্রেমহীনতা৷ না হলে সম্ভব কারও পক্ষে এতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া?
ডাক্তারের দিকে টানা প্রশ্ণগুলি ছুঁড়ে দিয়ে কৃষ্ণেন্দু হঠাৎই চুপ করে যায়৷ ও অপেক্ষা করে থাকে ডক্টর শর্মার কাছ থেকে কিছু উত্তর পাওয়ার আশায়৷ কিন্তু এক অদ্ভূত নীরবতা এখন ঘরের ভেতর৷ ঘাড় গোঁজ করে ডক্টর শর্মা তাঁর ডায়েরিতে টানা কীসব লিখে চলেছেন৷ কৃষ্ণেন্দুর ভালো লাগে না৷ ও অধৈর্য হয়ে ওঠে৷
---দেখুন ডক্টর শর্মা---
কৃষ্ণেন্দু ডাক্তারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়৷ কিন্তু ডাক্তার তখনও লিখে চলেছেন৷ যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না৷ কৃষ্ণেন্দুর তাঁকে কেমন অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হয়৷ তবু কৃষ্ণেন্দু  হাল ছাড়ে না৷ কেমন যেন একটা আচ্ছন্নতা, একটা ঘোরের মধ্যে থেকে ও নিজের মনেই বলে যেতে থাকে কতোকিছু৷ হয়তো ডাক্তার ওর কথা শুনছেন, অথবা শুনছেন না৷ কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না কৃষ্ণেন্দুর৷ এ কথাগুলো তাকে বলতেই হবে যে৷
---হয়তো খবরের কাগজের এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা একটা ছোট্ট খবর৷ হয়তো কেউ কেউ পড়েছেন৷ আবার অনেকেই পড়েননি৷ কোনও চ্যানেলও হয়তো কাভার করবে না৷ কিন্তু তাতে সত্যিটা অথবা বাস্তবটা পালটে যেতে পারে না৷ এ কোন্ সময়ের মধ্যে বেঁচে আছি আমরা? এতো হিংসা, এতো ভায়োলেন্স কেন চারদিকে? এই আপাত ছোট্ট নিউজটা পড়বার পর থেকেই আমার নিজের কাছে পৃথিবীর যে-কোনও সম্পর্ক, যে-কোনও রিলেশন কেমন যেন অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হচ্ছে৷ মিথ্যে বলে হচ্ছে৷ খবরটা আমি সোমকে, মানে আমার স্ত্রী সোমদত্তাকে ও আমার কোনও কোনও বন্ধুকে দেখাতে চাই, কিন্তু তারা প্রত্যেকেই এতো ব্যস্ত যে আমার কথা শোনার কারও কোনও সময়ই নেই...
একটানা কথাগুলো বলে কৃষ্ণেন্দু থামে৷ ওর বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা যন্ত্রণা হচ্ছে৷ চারিদিকে কেমন অদ্ভূত এক শূন্যতা ছড়িয়ে আছে যেন৷
---মিস্টার মল্লিক...
ডাক্তারের কণ্ঠস্বর৷ সেই শ্যাওলা-পুকুরে ভারি জলের অতল থেকে যেন ভেসে আসছে ডাক্তারের ডাক৷ ভারি অন্ধকার জলের অনেক নিচে তখন তলিয়ে যাচ্ছে দুপুর৷ ঝাঁঝি-মাছ আর ব্যাঙাচিদের ভিড়ে যেন এক হিলহিলে লাউডগা সাপ তার চুলের মুঠি ধরে অন্ধকার অতল থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তরল আলোর দিকে৷ সেই ভারিজল নাকে চোখে মুখে ঢুকে বালকের অন্ধকার দিন৷ ডুবন্ত খেয়ার মতো কৃষ্ণেন্দু চার হাতপায়ে জড়িয়ে ধরতে চায় ঝিমলিদিকে৷ তীব্র প্রখর রোদে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকে বালক ও প্রকৃতি৷
---মিস্টার মল্লিক? শুনতে পাচ্ছেন?
ধীরে ধীরে কৃষ্ণেন্দুর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ডাক্তারের অবয়ব৷ ডাক্তারের কণ্ঠস্বর৷
---হ্যাঁ... বলুন ডাক্তারবাবু... শুনতে পাচ্ছি...
ঘর্ঘর জান্তব শব্দের মতো কৃষ্ণেন্দুর গলা দিয়ে কথাগুলি বেরিয়ে আসে৷
---কৃষ্ণেন্দুবাবু, আপনি কী লক্ষ করেছেন ইনসিডেণ্টটা একটা রিমোট ভিলেজে ঘটেছে! সেখানে, ওই কমিউনিটিতে তো এখনও শিক্ষার আলো প্রপারলি...
---চুপ৷ চুপ করুন ডাক্তার!
কেমন যেন হিসহিস করে ওঠে কৃষ্ণেন্দুর কণ্ঠ৷ 
---আর ইউ সিওর যে আপনার সো-কলড্ মডার্ন জেনারেশন এইসব নিষ্ঠুরতা-বর্বরতা-প্রতিহিংসা থেকে মুক্ত? যদি তা-ই হবে তাহলে কেন আপনারা ভাঙবেন প্রাচীন সব সৌধ? বাবরি মসজিদ অথবা বামিয়ানের বুদ্ধ বা ঈশ্বরচন্দ্র? কেন আগুন লাগিয়ে দেবেন গোধরায় সবরমতী এক্সপ্রেসে? কেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেণ্টারের টুইন-টাওয়ার ধবংস হবে আপনাদের আক্রমণে? কেন রক্তাক্ত হবে সংসদ ভবন বা অক্ষরধাম মন্দির? কেন আফগানিস্তান বা ইরাককে যুদ্ধে বিধবস্ত করে নিঃস্ব করে দেবেন আপনারা? শিক্ষাদীক্ষায় এনলাইটেন্ড টোয়েণ্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরির সুসভ্য সমাজ? কেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষিজমি রক্ষা কমিটির গরীব মানুষদের ওপর আক্রমণ? কেন ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড? থার্ড ওয়ার্ল্ড? কেন সারা পৃথিবী জুড়ে এতো কাঁটাতার? পাশপোর্ট? ভিসা? কেন নোটবন্দি? কিসের গ্লোবালাইজেশন? মুক্ত অর্থনীতি? এন.আর.সি.? নিজের দেশেই নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারলে একের পর এক আত্মহত্যা? বলতে পারবেন কেন? কেন নির্বাচন মানেই গায়ের জোরে ক্ষমতাদখল? রিগিং? খুন? রাজ্যে রাজ্যে সুসংগঠিত ট্রেন্ড মাফিয়াবাহিনির এতো রমরমা কেন? কেন একজন প্রতিবেশী তার পাশের বাড়ির অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিবেশীর জায়গার দখল সহজেই নিয়ে নেয়? কেন এতো হিংসা? এতো লড়াই? এ সবই কী আপনার ওই রিমোট ভিলেজের গ্রাম্য চাষা-ভুষোর ব্যাপার ডাক্তার?
একটানা কথাগুলো বলতে বলতে কখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণেন্দু৷ ওর হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আছে৷ শরীরে একদম জোর পাচ্ছে না৷ তবু এতোক্ষণ ধরে তার কথা কেউ শুনছে দেখে কৃষ্ণেন্দু  উৎসাহ পায়৷ ওর নিজের পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র ঔপন্যাসিক ছাড়া আর কারো ওর এইসব ছাইপাঁশ শোনার সময় নেই৷ ধৈর্য তো নেই-ই৷ ডক্টর শর্মা এতোক্ষণ ধরে, ওকে এতোটা সময় দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছে দেখে কৃষেন্দু কী রকম যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ে৷ শেষের কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে মঞ্চে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলতে বলতে ওর পা টলমল করে ওঠে৷ আরেকটু হলেই ও পড়ে যেতো মাটিতে৷ ডক্টর শর্মা ওকে ধরে ফেলেন৷ হাত ধরে ধীরে ধীরে বসিয়ে দেন চেয়ারে৷

---কৃষ্ণেন্দুবাবু৷
শান্তস্বরে ডাকেন ডক্টর শর্মা৷
---আপনি একা একা এতো ভাবছেন কেন বলুন তো? এতোসব চিন্তা করবার কী দরকার আপনার! এসব নিয়ে ভাববার জন্য তো অনেকেই আছেন...৷
ডাক্তার বোঝাতে চান কৃষ্ণেন্দুকে৷ কৃষ্ণেন্দু চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসেছিলো চেয়ারে৷ ঘরে এসি চললেও ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে৷ পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে মুখ মোছে ও৷ 
---একটা সিগারেট হবে ডাক্তারবাবু?
ডক্টর শর্মা একটা ফিল্টার উইলস্ কৃষ্ণেন্দুকে দিয়ে নিজেও একটা জ্বালান৷ একবুক ধোঁয়া ইনহেল করে চারিদিকে ছড়াতে ছড়াতে কৃষ্ণেন্দু এতোক্ষণে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকায়৷ খুব মনোযোগ দিয়ে ডাক্তারের মুখটা লক্ষ করতে থাকে৷ বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে ডক্টর শর্মাকে৷ গায়ের ফরসা রঙ নিয়মিত যত্নে গোলাপি আভায় বিভাবিত৷ চামড়ায় রোদ-বৃষ্টি লাগে না বলেই মনে হয়৷ ক্লিন-শেভড্ গাল৷ ছোটো করে ছাঁটা গোঁফের নিচে সারাক্ষণ মৃদু হাসি লেগেই আছে৷ চোখে ওয়াইন রঙের লেন্স৷ গালে-ঘাড়ে অল্প অল্প মেদ৷ একটু ভারি শরীর৷ বয়স কৃষ্ণেন্দুর মতোই প্রায়৷ হয়তো দু-চার বছরের জুনিয়র হবে৷ নিপাট ভদ্রলোক৷ অত্যন্ত কোপারেটিভ৷ সত্যিই তো এতো সব কিছু ভাবছে কেন কৃষ্ণেন্দু ? এসব ভাবার জন্য, এ সব নিয়ে থিসিস লিখে নোবেল পাওয়ার জন্য সারা বিশ্বে কতো লোক রয়েছেন৷ খামোখা কৃষ্ণেন্দুর এতো মাথাব্যথা কেন?
অর্ধেক সিগারেট খেয়ে বাকিটা অ্যাশট্রেতে চালান করতে করতে নিজের ডায়েরিটা বন্ধ করেন ডক্টর শর্মা৷ 
---ঠিক আছে মিস্টার মল্লিক, অনেকক্ষণ কথা হলো৷ এবার আপনার রেস্ট দরকার৷ আগামীকাল না হয় আবার কথা বলা যাবে৷ শুনুন, ক-টা দিন আপনাকে আমাদের এখানে থাকতে হবে৷ এই ক’দিন খাবার আর ওষুধগুলো নিয়ম করে খাবেন৷ এখানে টিভি আছে, লাইব্রেরি আছে৷ ভালো না লাগলে যেতে পারেন সেখানে৷ কিছু মনে করবেন না, একটাই রিকোয়েস্ট, এখানে মোবাইল ফোন একেবারেই অ্যালাউড না৷ ফোন করবার ইচ্ছে হলে রিসেপশনে যাবেন৷
---ডাক্তারবাবু---
মনে হয় না কৃষ্ণেন্দু ডক্টর শর্মার কথাগুলো শুনছিলো এতোক্ষণ৷ ও বোধহয় নিজের কথা বলবার জন্য একটা বিরতি বা অবকাশ খুঁজছিলো৷ যেন কোন্ গভীর অতল থেকে ভেসে আসে ওর কণ্ঠ৷
---অনেকদিন আগে পড়া একটা কবিতার খানিকটা মনে পড়ছে৷ দয়া করে শুনবেন একটু!
অবাক চোখে ডক্টর শর্মা তাকিয়ে থাকেন কৃষ্ণেন্দুর দিকে৷
কৃষ্ণেন্দু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের এক কোণ ধরে চোখ বন্ধ করে অন্তর্গত রক্তক্ষরণের মতো উচ্চারণ করতে শুরু করে:
...সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
      আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
      আমার পায়েই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
      সন্তানের মতো হ’য়ে,---
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
      যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিম্বা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
      যাহাদের কিম্বা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
     জন্ম দেবে--- জন্ম দেবে ব’লে
     তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
     আমার হৃদয় নাকি? ---তাহাদের মন
     আমার মনের মতো নাকি?
---তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী!
হঠাৎই চুপ করে যায় কৃষ্ণেন্দু ৷ ওর বন্ধ দুই চোখের কোণ দিয়ে উপচে গড়িয়ে যায় অশ্রুধারা৷ গাল-বুক সব ভিজে গেছে৷ 

ঘরের বাইরে সামনের লনে কেয়ারি করা ফুলগাছগুলোর মাথায় হালকা হালকা বিকেলের রোদ এসে পড়েছে৷ ইতঃস্তত ছড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস আর ঝাউয়ের নিচে শুকনো পাতার স্তূপ৷ আকাশের পূর্বকোণে এক টুকরো স্লেট রঙের মেঘ৷ ধীরে ধীরে কমে আসছে আলো৷

২৪. যাই ক্রমে সরে সরে

যাপনের মধ্যেকার নিষ্ঠুর মুদ্রাদোষগুলি তাড়া করে ক্ষেপিয়ে তুললো যাকে, সে তখন নিবিড় মগ্ণ ডুবে যাচ্ছিলো কেবল-চ্যানেলের রামধনুরঙ-জালিকায়৷  তার ঘৃণা, লোভ, প্রেম নেতিয়ে রেখেছিলো ফনা৷ আর সে যাবতীয় বিব্রত অবস্থার বিরুদ্ধে একা একা খুঁজে ফিরছিলো সেইসব কালো কালো অক্ষর, যা তাকে আশৈশব বোধি দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে রেখেছিলো৷ প্রবল ঝড় আর তুফানের ভয়াবহতার মধ্যে এক টুকরো লাইফবোট নিয়ে সে পার হতে চাইছিলো সমস্ত প্রতিকূলতা৷ আর অনবরত উড়ে আসা ঝোড়ো পাতা ও গুল্মের দল এসে ঢেকে দিচ্ছিলো তার নিরক্ষর নগ্ন অনার্য শরীর৷
অথচ স্বপ্নের ভেতর তাকে হাতছানি দেয় নিরঙ্কুশ সংখ্যালঘুর দল৷ তার ভাইরাস-বিদ্ধ ক্লান্তমন আর চেতনা জুড়ে জমে থাকা মেঘ ও ক্ষয়ে-আসা বর্ণমালা ঝরে পড়ে সাদা পৃষ্ঠার উপর৷ সারাদিন  শব্দ বুনে চলে তার মন৷ আর বিদেহী অক্ষরেরা বৃষ্টি হয়ে ভাসিয়ে দ্যায় তার অশান্ত মনোভূমি৷ নির্দিষ্ট স্থানাঙ্কে ব্যাপৃত থাকতে চায় তার মন৷ মনের কুসুমকোরক থেকে উপ্চে ওঠে মধুস্রাব৷ পদ্মগন্ধে ঝিম হয়ে থাকা মস্তিষ্কের কোষে কোষে দাপিয়ে চলে মাতাল হাতির দল৷ রাত বেড়ে গেলে নিভে আসে শরীরের কাম৷ প্রবৃত্তির টুকরো ইচ্ছে থেকে তীব্র বেজে ওঠে সাইরেন৷ অসময়ের পাগলাঘণ্টি৷
বস্তুজগৎ তখন দুলে ওঠে পরীদের গানে৷ আজন্মলালিত যতো হঠকারী স্বেচ্ছাচার লিখে ভরে ওঠে ডায়েরির পাতা৷ কালো কালো অক্ষরের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা কবিতারা হঠাৎই ডানা মেলে উড়ে যায় রূপকথার তেপান্তরে৷ সাদা আলো গোল হয়ে জমে থাকে মাঠে৷ মাথাভর্তি গজগজ করতে থাকা ইচ্ছেরা যে-যার মতো বাস্তবতার ইশারা পেয়ে ফিরে যায় কুয়াশা পেরিয়ে৷ বৃষ্টিভেজা শীর্ণ কিছু কাক পরস্পর ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে গেয়ে ওঠে বাল্যের করুণ ধারাপাত৷ তীব্রতম সাইরেনে আচমকাই কেঁপে যায় তার স্থাবর, অস্থাবর৷

২৫. চাইছি তোমার বন্ধুতা

প্রায় এক ঘণ্টা আগে স্নান-খাওয়া হয়ে গেছে কৃষ্ণেন্দুর৷ তারপর কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খেয়েছে ও৷ শুয়ে থাকতে একঘেয়ে লাগছিলো, তাই ঘরের সামনের একফালি বারান্দায় একটা সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে  কৃষেন্দু৷ ওর মাথা ও ঘাড়ের দু-পাশ কিরকম যেন ভারি-ভারি হয়ে আছে! গলায় মাছের কাঁটা আটকে গেলে যেমন ঢোক গিলতে গেলে ব্যথা হয়, ওর গলায় সেরকম একটা ব্যথা খচ্খচ্ করছে৷ ঢোক গিলতে গেলে কেমন যেন ব্যথা-ব্যথা৷ বারবার জল খেতে হচ্ছে৷ মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে৷ সারাক্ষণ কেমন যেন ঘুম-ঘুম ভাব! এসবই ডক্টর শর্মার দেওয়া ওষুধগুলোর রিয়্যাকশন নিশ্চয়ই৷  কৃষ্ণেন্দুর মন এক অজানা ভয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে৷ ডক্টর শর্মা এগুলো কিসের ওষুধ দিচ্ছেন! সব সময় তার নিজের মধ্যে এতো কিসের অবসাদ! এগুলো ডাক্তারের ওষুধের সাইড এফেক্ট নাকি ও নিজেই এখন আর নিজের সঙ্গে যুঝতে পারছে না! তবে কী  কৃষ্ণেন্দু সত্যি সত্যি পাগলই হয়ে গেছে?
এই দোতলা থেকে সামনের দিকে তাকালে লাইব্রেরি বিল্ডিংটা দেখতে পাওয়া যায়৷ ফটফটে সাদা বিল্ডিংটার অর্ধেক দেয়াল জুড়ে পড়ন্ত দুপুরের সোনালি রোদ ঝিকঝিক করছে৷ চারিদিকে গাছগাছালির ভিড়৷ ব্যাপ্ত বাগানের মাঝখানে জল, নির্দিষ্ট দূরত্বে সাজানো ফোয়ারা৷ ফোয়ারা থেকে কাতর জল
ওঠে উধর্বমুখে ফিনকি দিয়ে, উঁচু-নিচু, কতো না বাহার! বাগানের কেয়ারি করা ভেলভেট ঘাসে লেজ উঁচু করে খেলে বেড়ায় কাঠবিড়ালিরা৷ সবুজ ঘাসের ছড়ানো লনে লক্ষ করলে মাঝে মধ্যে একটা-দুটো কাঠবেড়ালিকে দেখতেও পাওয়া যায়৷ তারা ক্ষিপ্র পায়ে এ গাছ থেকে আরেক গাছের দিকে চলে যাওয়ার সময় তাদের পিঠের নদীচিহ্ণ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়৷ তাদের ধূসর ছোটো পিঠে উল্কির মতো সাদা-কালো দাগ নদীচিহ্ণ হয়ে আছে৷ বালক আকৃষ্ট হয় সহজেই, কাঠবিড়ালিদের পিছু পিছু তারও ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়৷  ছোটো ছোটো দাঁত দিয়ে কাঠবিড়ালিরা কুটুস কুটুস চিবোতে থাকে সেইসব নদী--- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না... 


এমনিতে সেরকম কোনও ঝুটঝামেলা নেই এখানে৷  কৃষ্ণেন্দুর ভালোই লাগছে এই জায়গাটা৷ একটা নির্দিষ্ট নিয়ম, ডিসিপ্লিনের মধ্যে চলতে হয় এখানে৷ অনেকটা সেই ছাত্রাবস্থার মতো৷ খুব ভোর-ভোর ঘুম থেকে উঠতে হয় এখানে৷ তারপর সবাইকে জড়ো হতে হয় মাঠে৷ এখানে যারা বোর্ডার, তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় মাঠে পিটি করানোর জন্য৷ সে অবশ্য এক কাণ্ড! মনে মনে হাসে কৃষেন্দু ৷ বোর্ডারদের অনেকেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে চায় না৷ কেউ কেউ আবার সত্যি সত্যি পারে না৷ কারো কারো মুখ দিয়ে অনর্গল লালা ঝরছে৷ তার নিজের সে-সব মোছার কোনও বালাই নেই৷ কেউ কেউ আবার সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক, মাঠে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে৷ বেশ ষণ্ডাগণ্ডা স্বাস্থ্যের অ্যাটেনডেণ্টরা  যে কী কসরতে ওদের দিয়ে এক্সারসাইজ করায় সে চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না৷ এই পিটি ক্লাশে মেল-ফিমেল সব বোর্ডারদের এক সঙ্গে ব্যায়াম করতে হয়৷ এক্সারসাইজ শেষ হলে রোদের তাপ বাড়বার আগেই প্রতিদিন আধ ঘণ্টার কালচারাল অ্যাকটিভিটিজ৷ সেখানে গান-আবৃত্তি সবই হয়৷ রত্না নামের একটি মেয়ে, কুড়ি-বাইশ বছর বয়স হবে, সমস্ত মুখে এক অদ্ভূত অন্ধকার আর বিষাদ ছড়ানো, মুখে কোনও হাসি নেই, পৃথিবীর সব দুঃখ-কষ্ট যেন এসে জড়ো হয়েছে ওইটুকু মেয়েটির মুখে, প্রতিদিন সকালে এক আশ্চর্য পরিশীলিত কণ্ঠে রজনীকান্তের ‘আমায় ডেকে ডেকে ফিরে গেছ মা’ গায়৷ ওই একই গান প্রতিদিন কৃষ্ণেন্দুর মনে এক অন্য রকম  মাত্রা এনে দেয়৷ ওর সমস্ত শরীর জুড়ে একটা হালকা শিহরণ খেলে যায়৷ মুহূর্তে সারা শরীরের রোম খাড়া হয়ে ওঠে৷ অনেকক্ষণ পর্যন্ত রত্নার গানের রেশ থেকে যায় কৃষ্ণেন্দুর মনের ভেতর৷ বৃষ্টির জন্য  কৃষেন্দুর মন কেমন করে ওঠে৷ ওইটুকু মেয়েটা একা একা হস্টেলে৷ সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতে পারছে তো মেয়েটা! কখনও তো আর মা-বাবাকে ছেড়ে একা থাকেনি৷ সোম ওর সঙ্গে উইকেন্ডে দেখা করতে যায় তো! অনেক প্রশ্ণ এসে কৃষ্ণেন্দুর মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে৷ ও নিজে তো কখনও চায়নি বৃষ্টি হস্টেলে যাক৷ এ নিয়ে সোমের সঙ্গে কম কথা কাটাকাটি হয়নি৷ সোম নিজেও কী চেয়েছিলো বৃষ্টি হস্টেলে যাক! নিশ্চয়ই না৷ অন্তত এখন কৃষ্ণেন্দুর তা-ই মনে হয়৷ সোম-ই বা কী করবে ওর দশটা-পাঁচটার অফিসের ডিউটি সামলে ওদের এই ছোট্ট সংসারটাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য৷ ওর মনেও নিশ্চয় কষ্ট হয়! কই, কৃষ্ণেন্দু নিজে কী কখনও সোমের, সোমদত্তার মনের খবর নিতে চেয়েছে! আজ খুব আফশোস হয় কৃষ্ণেন্দুর৷ সত্যিই তো, একবার ভালো করে সোমকে জিজ্ঞেস করলেই তো হতো! ছিঃ! নিজের উপর রাগ হয় ওর৷ না-না, খুব তাড়াতাড়ি সোমের সঙ্গে ওর কথা বলা দরকার৷ সেই বকখালির হোটেলের রাত থেকে আজ পর্যন্ত কখনও সোমদত্তাকে বুঝতে চেয়েছে সে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ণ করে কৃষ্ণেন্দু৷ সারাক্ষণ নিজেকে নিয়েই ও ব্যস্ত৷ সে-ই যে বকখালিতে ঋত্বিকের সঙ্গে মোহর না সোমদত্তা কে পরিচয় করিয়ে দিলো, সেই থেকে এই ক’বছরে সিনেমার ভূত আজও নামলো না কৃষ্ণেন্দুর! 
কতো কিছু বিষয় নিয়েই না ঋত্বিকের সঙ্গে কথা হয় ওর৷ বিশেষ করে সিনেমার কনটেণ্ট৷ মানুষের সামাজিক জীবন, দাম্পত্য, অসহায়তা৷ এই যে এতো এতো মানুষের স্নায়ুর গভীরে পিছলে যাওয়া অন্ধকার, মনের ডাক্তারের কাছে এতো ভিড়, এ সবের জন্য কে দায়ী! কৃষ্ণেন্দুর তো কখনও কখনও মনে হয়, মানুষ নিজেই দায়ী৷ আর্রে, স্বাভাবিকতা কী এই প্রশ্ণ যদি করা যায় তার ঠিকঠাক উত্তর মানুষের জানা আছে তো! কে স্বাভাবিক? কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি নিধন যজ্ঞের নায়ক হিটলার, না কি ট্রটস্কির ঘাতক, না কি কসাকবাহিনির শিরোমণি, না কি সারা বিশ্বব্যাপী নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠা তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীরা! ভবতারিণীর মন্দিরে নিজের এঁটো-পাত থেকে দেবীমূর্তিকে ভাত খাওয়ানো পরমহংস, না কি নিজের শরীরেই রাধাকে অনুভব করে হা কৃষ্ণ-হা কৃষ্ণ ছুটে চলা শ্রীচৈতন্য! নীলাচলে মহাপ্রভু! গানে বলছে, এ জন্মে তো আর হলো না বনমালী, বরং তুমি ‘পরজনমে হইও রাধা’৷ এই যে চারিদিকে অগণিত মেয়েলি পুরুষ অথবা পুরুষালি মেয়েরা নিজের স্থানাঙ্ক ঠিক করতেই, দিক ঠিক করতেই একটা জীবন পার করে দ্যায়৷ পুরাণ থেকে মহাভারত সর্বত্রই যার রেফারেন্স পাওয়া যাচ্ছে--- অর্ধনারীশ্বর থেকে বৃহন্নলা! আজ মেডিক্যালি সেক্স পালটাতে পারলে তার একটা পোষাকি নাম হয়েছে, ট্রান্সজেন্ডার! পুরুষ ও প্রকৃতি, প্রকৃতি ও পুরুষ! এখানেই কৃষ্ণেন্দুর মুখের সামনে এক বিরাট বড়ো প্রশ্ণচিহ্ণ এসে দাঁড়ায়--- তাহলে স্বাভাবিক কোনটা? কে স্বাভাবিক? 
না-না, একবার সোমের সঙ্গে কথা বলতে হবে কৃষেন্দুকে৷ ওর নিজের ব্যর্থতার কথা, নিজের হেরে যাওয়ার কথা, নিজের ফ্রিজিড-দশার কথা বলতে হবে সোমদত্তাকে৷ ছাত্রাবস্থায় বকখালির হোটেলের সেই রাত, সোমের আবেগসঘন আকুতিকে স্যাটিসফাই করতে গিয়েই কৃষ্ণেন্দু ব্যাকফুটে৷ সেই থেকে একই নিয়ম চলেছে এই ক’বছর ধরে৷ মাঝে মাঝে সোমের এই কামনার সঙ্গে কৃষেন্দু নিজেকে ঠিক মিলিয়ে নিতে পারে না৷ কেমন শামুকের মতো খোলের ভেতরে সেঁধিয়ে যায় সে৷ সোমের যাবতীয় চাহিদা পূর্ণ করবার জন্য যেন তাদের যৌনজীবন৷ এরকম অবান্তর চিন্তাও ওর মাথায় ঘোরাফেরা করে৷ সোমের অনাবৃত দুটি বুকের গভীরে মুখ গুঁজে দিতে গিয়ে ও স্পষ্ট শুনতে পায় ঝিমলিদির কণ্ঠস্বর, এই তুই শিব হবি? আমি মা কালী৷ এক ঝটকায় নিজেকে সোমের আলিঙ্গণ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জঙ্গল, চোরকাঁটা পেরিয়ে পালিয়ে যেতে চায় কৃষ্ণেন্দু৷ কিন্তু সোমদত্তা তখন মত্তনীল অন্ধকারে৷ সে কৃষ্ণেন্দুকে দু-হাতে জাপটে ধরে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায়৷ কৃষ্ণেন্দুর দমবন্ধ হয়ে আসে৷ খাটের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে শঙ্খ-লাগা দুটি অনাবৃত অবয়ব৷ কখন কৃষ্ণেন্দু সেই ছাত্রাবস্থার মতোই সোমের শরীরের তলায় চলে আসে৷ সোম তখন আহত বাঘিনী৷ জোয়ার এলে যেমন ফুঁসে ওঠে নদীর জল, সেরকমই পূর্ণচন্দ্র এখন সোমদত্তা৷ তার গমরঙা শরীর জুড়ে বিন্দু-বিন্দু ঘাম৷ কামিনীফুলের মাতাল করে দেওয়া সেই গন্ধ তার দুই রেশমের মতো রোমশ বাহুসন্ধি থেকে নির্গত হতে থাকে৷ সেই গন্ধে ঝিমঝিম করতে থাকে কৃষ্ণেন্দুর মাথা৷ সে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে৷ তার শরীরে পিছলে যেতে থাকে সোমের ঘামেভেজা দুই স্তন, জানু ও গ্রীবা৷ সোমের উষ্ণ নিঃশ্বাসের হলকায় ক্রমশ প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে কৃষ্ণেন্দু৷ সে মুখের ভেতরে পুরে নেয় সোমদত্তার দুই ঠোঁট৷ আজন্মলালিত তৃষ্ণায় চুষতে থাকে৷ সোমদত্তার একরাশ কালো চুল এসে ঝামড়ে পড়ে তার মুখে৷ নির্দিষ্ট ছন্দে উপর-নিচ দুলতে থাকে দুটি শরীর৷ কৃষ্ণেন্দু মন-প্রাণ দিয়ে নিজেকে সমর্পণ করে দ্রুত৷ তখনই ওই সংবাদপত্রের সংবাদের রবি বিশ্বাসের সঙ্গে সোমের কোথায় যেন মিল খুঁজে পায় ও৷ সোমদত্তাও তো তার শরীর দিয়ে নিংড়ে নিচ্ছে কৃষ্ণেন্দুকে৷ ওই সেই বকখালির হোটেলের মতোই৷ সবসময় সোমদত্তাই কেন? ও নিজে কেন নয়! নিজেকে প্রশ্ণ না করে ভাবতে থাকে কৃষ্ণেন্দু৷ ওর তখন প্রথমবার লুকনো অস্ত্রে ওই সেই কুলতলির রবি বিশ্বাসের বউয়ের মতোই খুন করতে ইচ্ছে করলো সোমদত্তাকে৷ কোথায় যেন ছন্দপতন৷ কৃষ্ণেন্দু গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের মধ্যে৷ ওর সমস্ত শরীর কেমন শীতল হয়ে আসে৷ শামুকের খোলের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছে করে৷ কৃষ্ণেন্দু তার শরীর থেকে এক ঝটকায় নামিয়ে দিতে চায় সোমকে৷ কিন্তু পারে না৷ সোমদত্তা তখন আরও নিপুণ শৈলীতে৷ সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে কৃষ্ণেন্দুকে৷ কৃষ্ণেন্দু তার আগ্রহে আবার নিজেকে মেলে ধরতে বাধ্য হয়৷ ধীরে ধীরে দুই হাতে সোমদত্তার দুই হাত জড়িয়ে ও ক্রমশ সোমকে ঠেলতে থাকে পর্বতচূড়ার দিকে৷ সোম তখন আগ্ণেয়গিরির চূড়ায় দুই-পা ফাঁক করে নির্দিষ্ট ছন্দে৷ তার লতাগুল্মময় জানুসন্ধি আগ্ণেয়গিরির চূড়াকে সমস্ত শক্তি দিয়ে কামড়ে ধরেছে৷ ফিনকি দিয়ে ওঠা উর্দ্ধমুখী লাভাস্রোত দমকে দমকে তাকে আরও আগ্ণেয় করে তুলেছে৷ ওর বুকের দুটি কুসুম ওই নির্দিষ্ট ছন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে৷ এক আদুরে বেড়ালের মতো সোমদত্তার দুইচোখ বন্ধ হয়ে এসেছে৷ ওর সমস্ত শরীর থেকে, প্রতিটি রোমকূপ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেই কামিনীফুলের মাদকতাময় গন্ধ৷ এই গন্ধের টানে কামিনীফুলগাছে সাপ আসে৷ কৃষ্ণেন্দু আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না৷ ও দুই হাত দিয়ে নিষ্পেষিত করতে থাকে সোমের উল্লম্ফনরত খয়েরি বৃন্তের গমরঙা স্বেদসিক্ত দুইটি কুসুম৷ কৃষ্ণেন্দুর দুইচোখ বন্ধ হয়ে আসে৷ দুইটি শরীর ক্রমশ ভিজে যায় সেই লাভাস্রোতে৷     
নেতিয়ে পড়া পুরুষকার জাগিয়ে তুলতে হবে নিজেকেই৷ কেউ পারবে না কৃষ্ণেন্দু জানে৷ ডাক্তারের ওই ওষুধগুলোও না৷ ওগুলো সাময়িক ভাবে মেণ্টাল স্ট্রেস থেকে রিলিফ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিন এটা চলতে পারে না৷ ডক্টর শর্মার সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলতে হবে৷ রত্নার গায়কী ও মুখের অসহায়তার মধ্যে কোথায় যেন বৃষ্টির ছোঁয়া খুঁজে পায় কৃষ্ণেন্দু৷ মেয়েটার জন্য একটা তীব্র মনখারাপ কৃষ্ণেন্দুকে আরও একা করে দেয়৷ একলা করে দ্যায়৷ এখন ওর খুব ক্লান্ত লাগছে৷ খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে হবে৷

২৬. অত্যাগসহন: ৪ নম্বর লালকা লেন

এই ছুটির দুপুরে উল্টোদিকের ত্রিকোণ একফালি পার্কে স্তূপ হয়ে জমে আছে ঝরাপাতারা৷ ঝাউ আর ইউক্যালিপটাস গাছগুলির লম্বা ছায়া পার্কের সর্বত্র এক অদ্ভূত  আলোছায়ার জ্যামিতি এঁকেছে৷ ভাঙা বেঞ্চে দু-জন পাতাখোর ঝিমোচ্ছে, ইতস্তত রোদে পোড়া কাক৷ বালক ছুটছে একজন ডাক্তারের খোঁজে৷ দুপুরে এ তল্লাটে সমস্ত দোকান বন্ধ৷ মোবাইলও সুইচড্ অফ৷ আপাত নিরুত্তাপ কলোনিজীবন এভাবেই দ্বিপ্রাহরিক নিস্তরঙ্গ যাপনে৷ হঠাৎই তোমার অস্বস্তি, দু-দিন ধরেই৷ কিছু খেতে ভালো লাগছে না৷ সারা শরীর জুড়ে একটা অস্বস্তি৷ বারোভূতের মেলার মাঠ পেরিয়ে রিক্সো করে তোমাকে নিয়ে ছুটছি৷ পলি ক্লিনিক, ব্লাড-ইউরিন-এক্স রে...৷ তুমি খেতে চাইছো না কিছুই৷ ডাক্তারের দেওয়া ট্যাবলেট...! কোথাও কী ভুল ছিল কোনও! জানি না৷ হঠাৎই সেদিন বিছানায় শুয়ে পড়বার পর বালক পাল্স পাচ্ছে না তোমার৷ অল্প হাঁ হয়ে আছে তোমার মুখ৷ ঘুমের কোন্ অতলে তলিয়ে গেছ তুমি! তোমাকে নিয়ে তারপর সারাটা সন্ধে, রাত৷ তোমার ঘুমন্ত চোখ ফাঁক করে তুলো দিয়ে মুছে দিলেন ডাক্তার! তারপর কাচঢাকা গাড়ি৷ স্বর্গরথ৷ এই পথ বুঝি স্বর্গে গিয়ে পৌঁছয়! আপাতত সেই রথ গিয়ে থামে বোড়াল মহাশ্মশানে৷ ক্রিমেটোরিয়ামে৷
বাবার শখ ঠিক কী ছিল তা কৃষ্ণেন্দু আজও বোঝেনি৷ কোনওদিন বুঝতেই পারেনি৷ অথবা বলা যায়, কোনওদিন কী বুঝতে চেয়েছিলো! অতো সময় কোথায় তার! ঠাকুরদা অঘোরবাবু তো এখনও প্রতি সকালে উড়তে উড়তে পাড়া ঘুরতে বের হন৷ সে-বাড়ি তো কবেই জলাঞ্জলি৷ নিজেদের ব্যস্ততা আর আত্মমৈথুনের মধ্যে দিয়েই তো একটার পর একটা দিন পেরিয়ে যায়৷ বাবার হাত আঁকড়ে ধরেই প্রথমবার লরেল-হার্ডি, চার্লি চ্যাপলিন, বেনহুর, ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন, ইভান্স চাইল্ডহুড, পথের পাঁচালী ... ভস্তক থেকে প্রগতি প্রকাশন... চীনদেশের রূপকথা, গ্রীমভাইদের রূপকথা, ফোক টেলস্ অব বেঙ্গল, রেভারেণ্ড লালবিহারী দে, আর্কাদি গাইদারের ইশকুল... সবই৷ অথচ, কৃষ্ণেন্দুর বাবার শখ ঠিক কী ছিল তা ও আজও বোঝেনি৷ 
একই রকম শুয়ে আছো তুমি৷ মাঝে মাঝে তোমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে ঝুঁকে দেখছে বালক৷ সমস্ত চরাচর স্তব্ধ৷ অন্ধকার৷ দূর থেকে ভেসে আসছে অদেখা বিড়ালের মড়াকান্না৷ বালকের দু-কান বন্ধ৷ বুক ফেটে যাচ্ছে কান্নায়৷ দুই চোখ জ্বালা করছে৷ তখন শহরে ঢল নেমেছে সান্ধ্যকালীন জনতার, রাস্তার মোড়ে চৌরাস্তায় অগুণতি মানুষ৷ মাথার ওপরের ধূসর আকাশ ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধ৷ শীতের নরম আলোর সন্ধ্যায়, চারিদিক ঢাকা বিজ্ঞাপনে হোর্ডিঙে আর বিষাদের করুণ আলোয়, সিগন্যালে সিগন্যালে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে পিলপিল মানুষ, যখন কনভেয়র বেল্টের হিংস্র আগুন মুহূর্তে গিলে নেয় তোমার স্ট্রেচার শুশ্রূষা-সময় থেকে আগুনের করাল বিছানায় চলে গেলে তুমি৷
কৃষ্ণেন্দু ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে৷ নিচে লেলিহান তাপ, চতুর্দিকে ছাই, জ্বলন্ত অঙ্গার৷ সমবেত হাতেরা জল উৎসর্গ করে তোমায়৷ মাটির মালসা হাতে নির্বাক হেঁটে চলে তোমার আত্মজ৷
অশ্রু নেই৷ আলো নেই৷ রাত্রি নেই৷ আদি গঙ্গার ওপারে তখন কোনও চাঁদ নেই৷ কৃষ্ণেন্দু ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে৷ মাটির মালসায় ছাই হয়ে আছো তুমি৷ মাটির মালসা হাতে নির্বাক হেঁটে চলে যায় কৃষ্ণেন্দু৷ তোমার এইটুকু শরীর পেয়েছে৷ চলেছে ভাসাতে অকূল ধারাস্রোতে তোমার প্রাণফুল, নাভির মূল৷ বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরানি...
বালকরা চার নম্বর থেকে চলে এসেছে অনেকদিন৷ শুধু কৃষ্ণেন্দু জানে না৷


২৭. কফিহাউসে

পুজোর আগে কোনও কোনও দিন এভাবেই বৃষ্টিভেজা আটকে পড়তো সুকিয়া স্ট্রিটে৷ অথবা হেদুয়ার দিকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিটের কোনও আটপৌরে বাড়ির দোতলায় মাইল মাইল পথ পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য এসেছে এইখানে৷ গালি-প্রুফ আর কফিহাউসের ঘূর্ণায়মান ফ্যানের টেবিলে প্রেমিকার মতোন বান্ধবীরা ইশারায় ডাকে রোগা গলিপথে৷ চক্রবৎ সিগারেট, আলোছায়া, ঘেমো শরীরে মরুভূমির শূণ্যতা৷ প্রেমচিঠি অথবা প্রার্থিত চুম্বনের পরিবর্তে তারা নিজেদের কবিতা গুঁজে দেয় সর্বত্র, একশিরা হাইড্রোসিল অথবা শীঘ্র পতনের পোস্টার জড়ানো টয়লেটে তুমি সাবধানী, সাবধানী প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের উল্টোদিকের ফুটপাথে, এমনকী ধোঁয়া-ওঠা ভাঁড়ের চায়েও৷ প্রলম্বিত ছায়া রাস্তায় ছড়িয়ে পাখিরা উড়ে যেতে চেয়েছিল রেডরোডের দিকে অথবা আমেরিকান সেণ্টার লাইব্রেরির দোতলায়৷ প্রেমিকার মতোন বান্ধবীরা ‘পাগলের সঙ্গ করো, বাউলের সঙ্গ করো’ বলে চলে যেতে চেয়েছিল সিমোন দ্য বোভোয়া, মল্লিকা সেনগুপ্ত, অথবা তসলিমা নাসরিনের বাড়ি৷ কবিতা সিংহ অবাক হয়ে দেখছিলেন এসব, সবকিছু৷ বাতাসের অগ্রিম বারতা শুধু শুনতে পেয়েছিলেন পিডিজি, প্রণবেন্দুবাবু৷ আলোবাতাসের এই নৈসর্গিক জ্যামিতি আঁকবার কথা কবির ছিল না৷ বান্ধবীর মতোন প্রেমিকারা একমাত্র উৎপলকুমার বসুকে এসেমেস করেছিলেন৷ কবি কালীকৃষ্ণ গুহ কবিতা নয়, চতুর্দিকে শুধু রাশিরাশি প্রবন্ধ দেখতে পেয়েছিলেন৷ অনেক অনেকদিন পরে কবি সুকিয়া স্ট্রিটে ফিরেছেন আজ৷
কখন ফুরিয়ে গেছে কথা! টেবিলের দু-পারে দু-কাপ কফি, ঠাণ্ডা হয়ে গ্যাছে৷ কাপের শরীরে লেগে আছে ধোঁয়ার ঘাম৷ একটা নিঃশব্দ দিন জুড়ে কান্না চেপে চেপে চুপ৷ খানিক আগে তা প্রপাতের মতো ঝরে পড়েছে অঝোরে৷ লালাভ দুই গাল আর অসাড় চিবুক দিয়ে৷ ঘট্ ঘট্ শব্দে মাথার উপর ঘুরে চলেছে সিলিং থেকে ঝুলন্ত ঝুলমাখা বাদামি ফ্যান, পুরনো অথচ সচল৷ মুহূর্তমাত্র থেমে আছে, গুলিয়ে উঠছে গা৷ কবেকার মৃত ফড়িঙের স্বচ্ছ ডানা রুকস্যাকের মতো পিঠ ফঁুড়ে কামিজ ফঁুড়ে বেরিয়ে এসেছে৷ কান্নার দমকে দমকে সেই ডানা অল্প অল্প কাঁপছে... দু-হাজার ঊনিশ আর উনিশশো নিরানববই... প্রায় কুড়ি বছর... একথা জানতেন একজন... ঠিকই জানতেন... প্রচারবিমুখ সেইসব জ্যোতিষীদের মতো... তার সঙ্গে যদি দেখা হয়... আবার বছর কুড়ি পরে...!  আশ্চর্য, প্রাজ্ঞ সেই জীবনানন্দ শুধু জানতেন না একটাই কথা, সারাক্ষণ মোবাইল ঘেঁটে চলা দুটো হাতে ক্রমশ প্রকট হয়ে আছে শতাব্দীর তীব্র শীতলতা আর ফাংগাসের বর্ণহীন ছোপ৷ পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা ওই মৃত ফড়িঙের স্বচ্ছ ডানা এখন হেলিকপ্ঢারের ব্লেডের মতো সজোরে কাঁপছে৷ উড়ে যেতে চাইছে প্রস্তুতিপর্বের দিকে৷ চোখের কোলে শুকিয়ে গ্যাছে অশ্রু৷ গাল চটচটে৷ আঠালো৷ টেবিলের দু-পারে দু-কাপ কফি, ঠাণ্ডা হয়ে গ্যাছে৷

২৮. সন্ত্রস্ত স্নায়ুসমাবেশে   

সামনের লনে কেয়ারি করা ফুলগাছগুলোর মাথায় হালকা রোদ এসে পড়েছে৷ ইতঃস্তত ছড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস আর ঝাউয়ের নিচে ঝিরিঝিরি ছায়া৷ ওই ছায়ার নিচে গিয়ে বসতে ইচ্ছে করলেও কৃষ্ণেন্দুর কোনও উপায় নেই৷ সিঁড়ির নিচে মেনগেটে, বড়ো কলাপসিবল গেটে এখন তালা৷ বিকেল পাঁচটার সময় একজন দারোয়ান এসে ওই গেটের কাছে টুল নিয়ে বসবে৷ তারপর যে-সব বোর্ডারদের ভিজিটররা সবুজ কার্ড এনে দেবে, তাদের বাইরে বেরনোর মানে ভিজিটরস্ রুম বা বড়োজোর মাঠে যাওয়ার অনুমতি মিলবে৷ মাঠের এক কোণে ক্যাণ্টিন, সেখানেও যাওয়া যেতে পারে৷ লাইব্রেরি যেতে হলেও সেই পাঁচটার আগে যাওয়া যাবে না৷ আবার যে-সব বোর্ডাররা খুব ভায়োলেণ্ট স্টেজে আছে, তাদের কোনও অবস্থাতেই সেল-এর বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই৷ একদিন কৃষ্ণেন্দু শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় একজনকে দেখেছে৷ উস্কোখুস্কো চেহারার মাঝবয়সী লোকটাকে ওভাবে শেকলবন্দি অবস্থায় দেখে ওর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠেছিলো৷ বড়ো মায়া হয়েছিলো লোকটাকে দেখে৷ আহা রে! কবে থেকে হয়তো এভাবেই পড়ে আছে এখানে৷ আদৌ সুস্থ হয়ে উঠবে তো মানুষটা! এখানেই বোর্ডারদের কারো কারো মুখে কৃষেন্দু শুনেছে, বাড়ির লোকেরা, আত্মীয়স্বজনেরা এখানে একবার চিকিৎসার জন্য রেখে গেলে সহজে আর ফেরত নিয়ে যেতে আসে না৷ প্রথম প্রথম ভিজিটিং আওয়ার্সে দেখা করতে এলেও ধীরে ধীরে সেই আসাটাও কমে যায়৷ কৃষেন্দুর ভয় হয় মাঝে মাঝে, সোম তাকে এখান থেকে ফেরত নিয়ে যাবে তো! বৃষ্টি! সে কী আদৌ জানে তারা বাবা, বাবি কোথায়? কী দরকার ছিলো তার বারবার সমস্তকিছুর জন্য সোমকেই দায়ী করবার! কী দরকার ছিল ও ভাবে লুকিয়ে সোমকে আক্রমণ করার! আসলে তখন তার মাথার ঠিক ছিল না৷ এক গোঁয়াড়ের মতো রাগ চড়ে গিয়েছিলো মাথায়৷ সুস্থ ভাবে কিছুই চিন্তা করবার ক্ষমতা বোধহয় তার হারিয়ে গেছিলো৷ সেদিন তো বৃষ্টির সামনেই...৷ উফ্! সেদিনের কথা আর মনে করতে চায় না কৃষেন্দু ৷ ঠিক তার দু-দিন পরেই মিড সেশনে বৃষ্টিকে সরিষায় দিয়ে এলো সোম৷ কৃষেন্দু জানতেও পারেনি৷ ও-যে রাজি হবে না তা জানতো সোমদত্তা৷ তাই নতুন করে আর কোনও আলোচনার অবকাশই সোম রাখেনি৷ একটার পর একটা সুযোগ সে কৃষেন্দুকে দিয়েছে৷ ওইটুকু মেয়েটাকে কৃষেন্দুর উৎপাত থেকে সুস্থ পরিবেশে রাখবে বলেই মা হয়েও কতোটা নিষ্ঠুর হয়ে সোমকে এমন একটা ডিসিশন নিতে হয়েছে৷ আজ বুঝতে পারে কৃষেন্দু  নিজের গোঁয়ার্তুমির কথা, অক্ষমতার কথা৷ তার এই পাগলামির জন্য ওইটুকু মেয়েটার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে৷ উফ্! বুক ঠেলে কান্না বের হয়ে আসে কৃষেন্দুর৷ ও নিজেকে এজন্য কোনওদিনই ক্ষমা করতে পারবে না৷ সোমও কী পারবে ওকে ক্ষমা করতে! সোমদত্তা! বৃষ্টি! না, সত্যিই, পাপ করেছে কৃষেন্দু ৷ অপরাধ৷ আর এ অপরাধের সত্যিই কী কোনও ক্ষমা হয়! এতো কীসের রাগ ওর? নিজের ব্যর্থতা, নিজের অক্ষমতা, নিজের অপারঙ্গমতাকে আড়াল করতেই কী ওর এই অদ্ভূত আচরণ? পাগলামি? চার হাত-পায়ে শেকল, দাড়িভর্তি মুখ, একটা বন্য পশুর মতো অস্ফুট গোঁ-গোঁ আর্তনাদ করছিলো লোকটা৷ কৃষ্ণেন্দুর মনে হচ্ছিলো খুব কষ্ট, খুব কষ্ট জমে আছে লোকটার বুকের ভেতরে৷ ওর চোখে চোখ পড়তেই কেমন শিশুর মতো ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো লোকটা৷ কৃষ্ণেন্দু লোকটার চোখে চোখ রাখতে পারে না৷ ও নিজের মুখটা ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে৷

আগষ্ট মাস শেষ হতে চলেছে৷ এখন পরিস্কার নীল আকাশ৷ রোদের রঙ এখন গাঢ় সোনালি৷ দূরে আকাশে স্তূপ স্তূপ সাদা সাদা জলভরা মেঘ৷ ভেসে ভেসে যাচ্ছে৷ হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হয় এসময়৷ এই ক্যাম্পাসটার বাইরে মেনরোড থেকে বড়ো বড়ো বাস আর লরি চলে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই এখন৷ এই অলস দুপুরে চারিদিক ঘুমে অচেতন৷ কৃষেন্দুর চোখেই শুধু ঘুম নেই৷  নানারকমের ভাবনা এসে ভিড় করছে মাথার ভেতর৷ ও নিজে তো কখনই উচ্চকিত নয় ওদের দু-জনের সম্পর্কের ব্যাপারে! হ্যাঁ, সোমকে সম্পূর্ণত পেতে চায় ও৷ সমস্ত রকম ভাবে৷ কিন্তু সোম ওর সম্পর্কে এ ধরনের ভাববে কেন! এতোই সামান্য ও! এতোটাই তুচ্ছ! না-না, কই কখনও তো কৃষ্ণেন্দু  মনে মনে লোভ করেনি তোমার৷ কখনো নিজে একা একা চেয়েছে তোমায়, মনেও পড়ে না৷ একলা অন্ধকারে, স্বমেহনে কৃষ্ণেন্দুর মাথা জুড়ে বরং পাখি আর নদীদের চোরাগোপ্তা প্রেম৷ বুক ছঁুয়ে গা ছঁুয়ে পরস্পরকে দেখা৷ চেনা৷ চুম্বণ-মুহূর্তে আলজিভে অনুভবে তোমাকেই প্রকৃতিরূপে জানা প্রথমবার৷ অনর্গল কথাস্রোত৷ হাসি৷ অনাবৃত বিশাল জঙ্ঘাদেশ শুধু স্বপ্ণে৷ গমরঙা রোমশ অন্ধকার ঝঁুকে আসে মুখের উপর৷ তার খোলা সর্পিল কেশরাশি জড়িয়ে ধরেছে কৃষেন্দুর মুখ বুক আর প্রত্যঙ্গসকল৷ লেজ সোজা রেখে ক্লান্ত টেরোড্যাকটিল ছোটে মাঝদরিয়ায়, তার ঠোঁট ফেটে ঝরতে থাকে রক্ত৷ দুঃস্বপ্ণ জেগে থাকে হিমছুরিকায়৷ এই তো আদিপুরুষ৷ আদম৷ দক্ষপ্রজাপতি৷ বৃক্ষ৷ এই তো হিমগিরি৷ ঔপন্যাসিক৷ আমাদের উপন্যাস-লেখক৷ পাতালে খুলে রাখো মৃত-খোলস৷ হাঁ-মুখ বড়ো করো, খুলে দাও ঠোঁট, জিহ্বায় জিহ্বায় প্রসারিত করো লাভাস্রোত৷ গরম আদর৷ ঘোলাটে আকাশে এসে জমে যায় ঘনকালো মেঘের শরীরে৷ কাচের চুড়ির মতো রিনঝিন শব্দে পাল্টে যায় দিন৷ পেছনে রাস্তায় ট্রামের ঘরঘর ঢংঢং৷ বস্তিদেশ পেরনো হা-মুখ পেরিয়ে আরো বেশি অন্ধকারে নিজেকে ছড়িয়ে আরো একবার করে ফেলা ভুল৷ গভীর রোমের তলায় ডুবে যাওয়া এতোটুকু রোদ৷ আধ-খাওয়া সিগারেট থেকে আরো একটা ভাণ্ডের প্রতি ধীর পর্যটন৷ অতিদ্রুত যেভাবে ছেয়ে যায় মেঘ, শ্মশানের নিকষ অন্ধকার, সেভাবেই ট্যুরিস্ট-বাসের থেকে ডেকে ফেরা হর্ন বেজে চলে অবিরাম৷ বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে তখনই ঢলে আসে রঙ, ছাত্র-করোটি৷ অন্ধকার আরো বেড়ে যায়, মন্দিরে মন্দিরে ঘন্টার তুমুল আর্তনাদ,অটোর ভিড়৷ বাসস্টপে একলা মেয়েটি৷ রাজনীতির ভাষা আর বোঝেনা মানুষে৷ 
ফেলে রাখা সকাল থেকে খঁুটে নেওয়া রোদ৷ ঘন দুধে জ্বাল দেওয়া কফির জন্য ব্যাকুল করা মন৷ ক্রমাগত বিগড়ে যাওয়া সম্পর্কে আবারো জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা দু-জনেরই৷ খেপে গেলে হঠাৎ দানোয় পাওয়া মস্তিষ্কে জমে যাওয়া ভারিজল কৃষ্ণেন্দুর৷ ক্রমশ বয়স বেড়ে গেলে ওইসব হাতছানিসকল ফিকে হয়ে আসে৷ যেন একটা সরলরেখার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছো তুমি৷ তেজী হলে দুপুরের রোদ অথবা ঘনকালো আকাশে মেঘ জমে এলে অলীক দেয়ালে ঝুলে থাকে স্লেট-নেট ইত্যাকার পদকের মুখ৷ টেবিলে ঢাকা দেওয়া রাতের খাবারে তোমার হিম জমে৷ কোটরে কোটরে উত্তেজক পুস্তকাদি অগ্ণি জ্বালিয়ে দেয় তোমার ঘিলুতে৷ একটার পর একটা পরিসংখ্যান৷ মেলে না কিছুই৷ মেলানোর আর কী কিছু আছে! অথচ মিছিলে পা মেলাও না ইচ্ছে করেই ৷ সন্ত্রস্ত স্নায়ুসমাবেশে ক্রমাগত আটকে পড়ো তুমি৷ কৃষ্ণেন্দুর চোখেই শুধু ঘুম নেই৷ বুকের ভেতরে খচ্ করে বিঁধে থাকা একটা কাঁটার মতো ব্যথাটা তবু রয়ে গেছে৷ ডক্টর শর্মা ওকে বলেছেন, দ্রুত বাড়ি ফেরাটা ওর কতোটা জরুরি৷ পরিবারের সকলের ওকে কতোটা দরকার৷ সোমদত্তা, বৃষ্টি প্রত্যেকের৷

২৯. অলটার ইগো

শুনে শুকনো হেসেছে কৃষ্ণেন্দু৷ খানিকটা লজ্জাও পেয়েছে৷ এই ডাক্তারটা তো সব জেনে গেছে ওর সম্পর্কে৷ ও নিজে থেকে যতোটা বলেছে তা-তো জানেই৷ আর ও নিজে যা চেপে গেছে, সেগুলি নিশ্চয়ই সোম বলেছে৷ কৃষ্ণেন্দু খুব ভালো ভাবেই জানে, ওর মতো সোমেরও কাউন্সিলিং চলছে৷ তবে ওর মতো ভিক্টিম হিসেবে নিশ্চয়ই না৷ সোমকেও নিজের ভারসানে সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ বলতে হচ্ছে৷ আচ্ছা, এই ডাক্তারটা বৃষ্টির সঙ্গেও কথা বলেছে কি! কৃষ্ণেন্দুর কুরোসাওয়ার সেই সিনেমাটার কথা মনে পড়ে যায়৷ খুব সম্ভবত রাসোমন৷ ওই সেই একই ঘটনার তিন তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভারসানে তিন তিনবার নির্মাণ৷ প্রতিবারই, কী আশ্চর্য একটা পর্যায়ের পর ঘটনাপ্রবাহ পালটে যাচ্ছে৷ এই ডক্টর শর্মার অবস্থাও তো অনেকটা সেরকমই৷ কৃষেন্দু ভাবে৷ প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভারসান শুনে, ডায়েরিতে নোট টুকে ডক্টর শর্মকে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়৷ সেক্ষেত্রে কী ঘটনাপ্রবাহরও বদল হয় না! সবটাই কী ওই সত্যি ঘটনা অবলম্বনে সম্ভব! কে জানে!  এই কাউন্সিলিং পেশাটিকে কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর দিব্য লাগছে৷ ঋত্বিক ঘটক অ্যাসাইলামে থাকাকালীন ‘জ্বালা’ নাটকটি লিখেছিলেন, অভিনয়ও করিয়েছিলেন ওখানকার বোর্ডারদের দিয়ে৷ কৃষ্ণেন্দুর নিজের তো আজও সিনেমা বানানো হলো না, বরং এই ডক্টর শর্মা লোকটির চরিত্র নিয়ে ও নিজে একটা চিত্রনাট্য লিখবে মনস্থির করেছে৷ সুতরাং ডাক্তার যেমন তার কাউন্সিলিং করছে, তেমনই কৃষ্ণেন্দুও ডাক্তারকে নিরন্তর স্টাডি করে চলেছে৷


---না, না৷ এ আপনি কী বলছেন ডাক্তারবাবু--- আমাকে আবার কার দরকার?
লজ্জায় কৃষ্ণেন্দু সঙ্কুচিত হয়ে যায়৷
---বললাম না আপনাকে, সবার দরকার৷ সকলের৷ আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব প্রত্যেকের৷
আজকে ডাক্তার শেভ করেনি কেন? কৃষ্ণেন্দু ভাবে৷ এরকম একজন ডিসিপ্লিন্ড পরিপাটি লোক, আজ পর্যন্ত কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে যতোগুলি সিটিং হয়েছে, কোনও দিন কৃষ্ণেন্দু এরকম দেখেনি৷ একবার জিজ্ঞেস করবে কি না ভাবে৷ না, থাক৷ লোকটা ভীষণ ভদ্র ও ভালো হলেও ওর কোন্ কথার কী মানে করবে লোকটা কে জানে!
---কী হলো মিস্টার মল্লিক? এতো কী ভাবছেন?
---না, ডাক্তারবাবু, না৷ সেরকম কিছু না৷
একবার জিজ্ঞেস করেই ফেলবে কি না কৃষ্ণেন্দু ভাবে৷
---এতো ভাববেন না৷ মনের ওপর স্ট্রেস পড়বে৷
আর্রে, এ কি বলেন ভদ্রলোক! ভাববেন না৷ কোথায় জাতির উদ্দেশে ঋত্বিক বলছেন, ভাবো৷ ভাবা প্র্যাকটিস করো৷ আর সেখানে এই লোকটি কি না বলে ভাববেন না! স্ট্রেঞ্জ!
---হ্যাঁ মিস্টার মল্লিক, সকলের আপনাকে দরকার৷
---ডাক্তারবাবু, জানি৷ সবাই আমাকে খোঁজে নিজের নিজের দরকারে৷ নিজের নিজের প্রয়োজনে৷ আলাদা করে কেউই বুঝতে চায় না যে আমারও একটা মন, একটা আলাদা জগৎ আছে৷ আমি জানি আমি ব্যর্থ৷ কিছুই করতে পারিনি৷ কিন্তু আমারও তো একটা স্পেস দরকার---
এ আবার কী বলছে কৃষ্ণেন্দু! এই কথাগুলো তো ও আর বলতে চায় না৷ তাহলে আবার এই কথাগুলো উঠে আসছে কেন? যবে থেকে এখানে এসেছে ও, এই এতোগুলো দিন ধরে বৃষ্টি বা সোমদত্তা কারোর সঙ্গেই ওর দ্যাখা হয়নি৷ এমনকী ফোনেও কথা হয়নি৷ ও আকুল হয়ে আছে ওদের কাছে যাবে বলে৷ ওদের দেখবে, আদর করবে, কথা বলবে বলে৷ তাহলে এ কার কণ্ঠস্বর? কৃষ্ণেন্দুর নিজের? নাকি ওর ইগোর? এই ট্রমাটাইজড্ ফেজের? কৃষ্ণেন্দু কিছুই বুঝতে পারে না৷
---এ আপনি কী বলছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু? আপনি বোধহয় জানেন না আপনার বাড়ির লোক আপনার প্রতি কতোটা কনসার্ন৷ দে আর ওয়েটিং ফর ইউ৷ তারা কতোটা আগ্রহ নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছেন!
---আমি কিছু জানি না৷ কিচ্ছু বুঝতে পারছি না ডাক্তারবাবু৷
কৃষ্ণেন্দুর দুইচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে৷ বালকের মতোই হাউ-হাউ করে কেঁদে ওঠে কৃষ্ণেন্দু৷
---ইটস্ ওকে! প্লিজ---
নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে কৃষেন্দুর পিঠে হাত বোলাতে থাকেন ডক্টর শর্মা৷
---এ ভাবে ভেঙে পড়বেন না প্লিজ৷ একটা গোটা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে৷
---না, ডাক্তারবাবু, না৷ কারোর কোনও কিছু করার নেই৷ কোনও দোষ নেই৷ চারিদিকের এই বদলে যাওয়া দুনিয়ার সঙ্গে, বদলে যাওয়া এই জগতের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না আমি৷ পালটে যাওয়া বন্ধুমুখ কী ভীষণ হিংসায় আত্মকেন্দ্রিক! চারিদিকে কী ভয়ঙ্কর ম্যানিপুলেশন৷ দুর্নীতি৷ স্কুল-কলেজের চাকরি, পিওনের চাকরি থেকে সুকল-কলেজে ভর্তি সর্বত্র ম্যানিপুলেশনের ভয়ঙ্কর রমরমা৷ সর্বত্রই একটা সর্বগ্রাসী ক্ষয়রোগ৷ গত কয়েক দশক জুড়ে ধান্দাবাজি লাইনবাজিতে ভরে গেছে চারদিক৷ সারা দুনিয়া৷ সমস্ত শরীরে ক্যানসারের জীবাণু নিয়ে টোটাল সমাজটা কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে! কোথাও এক চুল প্রতিবাদ নেই৷ উল্টে জাত-পাতের রাজনীতিতে প্রতিদিন আমরা পরস্পরের  কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি৷ যাদের হাতে সুপরিচালনার ভার, তারাই ধর্মের ভিত্তিতে এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশটাতে বিভাজন আনতে চাইছে৷ মানুষে মানুষে এতো হিংসা, হানাহানি, রেষারেষি! উফ্! দম আটকে আসছে৷ কোন্ সমাজব্যবস্থা আমরা রেখে যাচ্ছি আগামী প্রজন্মের জন্য?
---ধীরে মিস্টার মল্লিক, ধীরে৷ বি কোয়ায়েট৷ শান্ত হোন৷ এতোটা এক্সাইটেড হবেন না৷
ডাক্তার তার সেই ডায়েরিতে নোট নিতে ব্যস্ত৷ 
---বুঝতে পারছি, আজকের এই সিস্টেমে আপনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না৷ আপনার অসুবিধে হচ্ছে৷ আপনি ভয়ঙ্করভাবে শক্ড ...
ডাক্তারের মুখের দিকে তাকায় কৃষ্ণেন্দু৷ বুঝতে পারে ডাক্তার নিজেও কনফিউজড্৷ কৃষ্ণেন্দুর এসব আজেবাজে কথার সত্যি কী কোনও উত্তর হয়! এতো সংবাদপত্রে পোস্ট-এডিটোরিয়াল বা নিউজ চ্যানেলের টক্ শো-র বিষয়৷ এই দল গাল দ্যায় ওকে তো অন্য দল আরেক দলকে৷
---না, ডাক্তারবাবু৷ হয়তো আপনারাই ঠিক৷ আমি নিজেই নিজের মুদ্রাদোষে, নিজের ভুলে সকলের চেয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছি৷ সবকিছুই হয়তো স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে৷ কারোরই কোনও অসুবিধে হচ্ছে না৷ শুধু আমার মতো গুটিকয় কিছু মানুষ, যারা প্রকৃতই সংখ্যালঘু, তাদের মাথার ভেতরে এইসব অকারণ পোকা তাড়া করছে শুধু৷ এর প্রভাব তাদের ব্যক্তিগত জীবনে, পরিবারে, এমনকি কনজুগাল লাইফেও পড়ছে...
দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে বলতে হাঁফিয়ে ওঠে কৃষ্ণেন্দু৷ ও হঠাৎই চুপ করে যায়৷
---ডোণ্ট গেট আপসেট মিস্টার মল্লিক৷ বি রিল্যাক্সড৷ এতো ভাবছেন কেন আপনি? এক্ষুণি এতো সব কিছু নিয়ে ভেবে আমাদের কাজ নেই কোনও৷ মনে রাখবেন এটা একটা কণ্টিনিউয়াস প্রসেস৷ এতো কুইক আমরা কেউ-ই কিছু করতে পারবো না৷ আগে আপনাকে নিজেকে ফিট হতে হবে৷ ইওর ফ্যামিলি ইজ ওয়েটিং ফর ইউ৷
ডক্টর শর্মা কৃষ্ণেন্দুর কাঁধে হাত রাখেন৷ এই স্পর্শে কৃষ্ণেন্দুর আশ্বাসের ছোঁয়া পায়৷
---অ্যাট ফার্স্ট ইউ হ্যাভ টু রেসপনসিবল টু ইওর ফ্যামিলি৷ আপনি নিজের পরিবারের প্রতি আপনার কমিটনেণ্ট অস্বীকার করতে পারেন না৷ সেকেন্ডলি, আগেও বলেছি, আবারও বলবো, মনের ওপর কোনও স্ট্রেস পড়তে দেওয়া আপনার উচিত নয়৷ আপনাকে মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে আপনি লড়াই করছেন নিজেই নিজের সঙ্গে৷ আপনার অলটার ইগোর সঙ্গে৷ এ এক জাতীয় ট্রমা৷ আপনার মনেরই বিশেষ এক স্থিতি৷ একটা দশা৷ সে কারণেই এমনকী আপনি আপনার কনজুগাল লাইফে, যৌনমুহূর্তেও প্যাসিভ হয়ে যাচ্ছেন৷ কোথাও নিজের কথা আপনি বলতে পারছেন না৷ এই দশাটার সঙ্গেই আপনার লড়াই৷ ফাইট৷ আমরা সবাই আছি আপনার সঙ্গে৷ বাট ইউ হ্যাভ টু উইন৷ আপনাকে জিততেই হবে৷

২৯. পুরুষকার

ধুলো উড়ছে, উড়ে যাচ্ছে কাক ও চিল, প্রখর রোদে পাখিদের ডানা থেকে গলে পড়ছে পালক৷ ছিপি খুলে তরল চলে যাচ্ছে ক্লান্ত পথিকের পেটে, মুহূর্তেই নেতিয়ে যাওয়া পুরুষকার ঘেমে-নেয়ে শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুচ্ছের অপেক্ষায়৷এই ঘনিয়ে আসা দ্বিপ্রহর, গ্রীষ্মের এই শুকনো নয়ানজুলি, ছোটো ছোটো দরমা ও টিনের গৃহকোণ আঁচল সামলেও বেআব্রু... দূরে কবরখানা... আরও দূরে ইস্পাতের ফলার মত রেলপথ... দেহাতি বস্তিতে মজে যাওয়া পুকুর আর কলমির জঙ্গল খর রৌদ্রে আরও ইঙ্গিতময়...৷ এই ধূসর নিঃশব্দ গলিপথে গলে পড়ছে পুরুষকারের টালমাটাল ধবস্ত ছায়া৷ লু বইছে৷ বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে খড়কুটো---৷ পুরুষের মান, অভিমান৷
প্রাচীন বৃক্ষটির নিচে মাটির পুতুল সাজায় দোকানি৷ কাঁচামাটি৷ পোড়ামাটি৷ হাসান হোসেন৷ অপটু হাতের ঘোড়া৷ ডিডিম ডিডিম শব্দে মাঠের পর মাঠ পেরোচ্ছে মহরমের তাজিয়া...৷ মেঠো মেলায় দেদার বিকোচ্ছে ফুলুরি পাঁপড় বাতাসা মণ্ডা আর চেনা মুখোশের স্পাইডার ম্যান...৷
এই বসন্তে ফিরে আসবার কথা হয়েছিল অশ্রু ও বিষাদের৷ সেই দুপুরে কয়েকটি অচেনা পাখির মতো হাঁটু পর্যন্ত পরাগে ডোবানো এ ক্যাম্পাস থেকে অচেনা ক্যাম্পাসে৷ নিভৃত প্রাণ এক সখারূপে টবের বাগানে৷ অচেনা প্রজাপতির মতো গলে যাওয়া আঙুলগুলো মনখারাপের দুঃখ ভুলতে চেয়ে ফিরে আসবে বলেছিলে রাস্তার পাশের বেলুনলার ঝুড়িতে৷ এই বসন্তে ফিরে আসতে চেয়েছিলে অফপিরিয়ডে ইসুকল-পালানো বিকেলে অপমান ও যাবতীয় তাচ্ছিল্যকে সঙ্গী করে৷ এ রাস্তা থেকে ওই রাস্তা--- এই সিগন্যাল থেকে ওই সিগন্যাল৷ হাত ধরে চিনিয়ে দিচ্ছে তোমাদের৷ চিনিয়ে দিচ্ছে তোমাদের কাঠগোলাপ বাগান আখরোট ক্ষেত আর অশ্রু ও বিষাদময় সারাটা দুপুর৷
এই বসন্তে তুমি ফিরে আসবে বলেছিলে সমুদ্রবন্দরে, রুখাশুখা পলাশপরবে, রাঙামাটির ধুলোর জঙ্গলে৷পাশাপাশি অপেক্ষায় লেখার আদলে চিরকালীন বোধির প্রত্যয় কফির টেবিলে৷ঙ চেনা রাস্তায় বালকদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন... মরতে চেয়েও মরে যেতে পারে না সে...৷ আর্তুর এসে বলেছিল মা ও মেয়ের সেই গল্প৷ তোমাদের চেনা সেই বৃষ্টিভেজা রাত, গলে-পড়া হ্যালোজেন... প্রবল ঝড়ের শেষে যেভাবে উল্টে থাকে ফুলের টব... গাছের ভাঙা ডাল ছেঁড়া ব্রেসিয়ার৷আর্তুর এসে বলেছিল সেই গল্প, মায়ের অথবা মেয়ের৷ বৃষ্টিভেজা বাইপাসে ওলা ধরে দরজায় হাজির সেই ভাঙা ফুলের টব, চোখের কোলে কাদা৷ দু-বুকে চাপা উদ্বেগ আর আহত পশুর ভয়...৷ কবিরা সেই রাতে আপন করে নিলো তাকে৷ আর্তুর নিজে বলেছিল সেই মা ও মেয়ের গল্প৷ চারদিক ভেসে যাওয়া বৃষ্টিতে কাফে কবীরায় বসে কবিদল সমূহ উত্তেজনা এড়িয়ে মনের মধ্যে ভাব আসতে দিয়েছে ... আসতে দিয়েছিল নতুন পংক্তি, কবিতার লাইন৷
জাঁ আর্তুর লিখতে চেয়েছিল সেই বৃষ্টিপতন আর ভাঙা ফুলের টব৷নীহারিকাপুঞ্জ থেকে খসে-পড়া একটি একক নক্ষত্র যেভাবে প্রিন্সেপঘাটে অপেক্ষা করে বাদাম কিনেছিল শুধু সেভাবেই উড়ে যাওয়া গলে যাওয়া মাতৃজন্মের দিকে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়েছিল কেউ একটি রক্তমাখা ব্লেড আর স্যানিটরি ন্যাপকিনের রাশি...
বুড়ো র‍্যাঁবো শুধু এইসব গল্পগাছায় তোমাদের সঙ্গ চেয়েছিল৷

৩০. বৃষ্টি 

কৃষ্ণেন্দু যে ঘরে আছে, সেই ঘরের বারান্দার ঠিক নিচেই একটা কদম ফুলের গাছ৷ ক্যাম্বিসের ছোটো ছোটো টেনিস বলের মতো হলুদ ফুল ফুটে আছে গাছে৷ আর নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একটা একটা  করে কদম ফুল ‘টুপ’ শব্দে ঝরে পড়ে এই দীর্ঘ অপেক্ষার দুপুরের নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে মাঝে মাঝে৷ গতকাল বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে সোম এসেছিলো৷ একা৷ সেই প্রথম দিন৷ ইউটোপিয়ার আলো অন্ধকারের মতো৷  একদম প্রথম, সেদিন, কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে ও এই অ্যাসাইলামের ক্যাণ্টিনে বসলো৷ মুখোমুখি৷ একহাত দূরে৷ দুজনে ঘাড়নিচু অনর্গল কথা৷  মাঝে মাঝে সোমদত্তার ঘনশ্বাস অফ্ হোয়াইট টেবিলের উপর পেতে রাখা কৃষ্ণেন্দুর দু’হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো৷ কৃষ্ণেন্দু নিজের হাত সরিয়ে নিতে চাইছিলো না৷ সেই হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি৷ ভার্টিকাল কালো সরু স্ট্রাইপ৷ সম্ভবত তাঁত৷ কবজি পর্যন্ত চাপা কালো রঙের ব্লাউজ৷ একটু উঁচু করে পেছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধা চুল৷ হর্সটেল! অতি সূক্ষ্ম হালকা প্রসাধন আজ সোমদত্তায়৷ গালে ছিটেফোঁটা ব্লাশারের ছোঁয়া৷ সরু লাল ঠোঁটে লিপগ্লস৷ আঁখিপ্রান্তে কাজল৷ চোখদুটো আরও বেশি ব্যক্তিত্বময় আজ৷ কৃষেন্দু চুপ করে বসে ওর কথা শুনছিলো আর নিবিষ্ট চোখে তাকিয়েছিলো ওর নরম সরু ওষ্ঠদ্বয়ের প্রতি৷
বৃষ্টি আবার আগের স্কুলে৷ এখন বাড়ি থেকে আগের মতোই স্কুলে যাচ্ছে৷ ইচ্ছে করেই বৃষ্টিকে এখানে আনেনি সোমদত্তা৷ কারণ, এখানে এভাবে ওর বাবিকে দেখলে ভীষণ আপসেট হয়ে পড়বে বৃষ্টি৷ কৃষ্ণেন্দু যতো দ্রুত ফিরে আসবে বাড়ি, ততো দ্রুত ওরা কয়েকদিনের জন্য বেরিয়ে আসবে৷ সোমদত্তার প্রস্তাব৷ 
---কোথায় যাওয়া যায় বলো তো ক্রিশ?
হ্যাঁ, কৃষ্ণেন্দুকে একান্তে এ নামেই ডাকে সোম, সোমদত্তা৷
---পুরী না দার্জিলিং?
কৃষ্ণেন্দুর সম্মতির অপেক্ষায় সোম৷
---না, না৷ বকখালি৷
সোমদত্তার চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে দ্রুত উত্তর দ্যায় কৃষ্ণেন্দু৷
---ঠিক বলেছো, অনেকদিন বকখালি যাইনি৷ এখন তো ব্রিজ হয়ে গেছে৷ আগের মতো ভেসেলের জন্য ওয়েট করতে হবে না৷ একটা গাড়ি নিয়ে আমরা চলে যাবো৷
সোমদত্তা এক বাক্যে রাজি হয়ে যায়৷ কৃষ্ণেন্দুর কানে ডক্টর শর্মার সেই কথাগুলি বাজতে থাকে, ‘এই মুহূর্তে আপনি লড়াই করছেন নিজেই নিজের সঙ্গে৷ আপনার অলটার ইগোর সঙ্গে৷ এ এক জাতীয় ট্রমা৷ আপনার মনেরই বিশেষ এক স্থিতি৷ একটা দশা৷ সে কারণেই এমনকী আপনি আপনার কনজুগাল লাইফে, যৌনমুহূর্তেও প্যাসিভ হয়ে যাচ্ছেন৷ কোথাও নিজের কথা আপনি বলতে পারছেন না৷ এই দশাটার সঙ্গেই আপনার লড়াই৷ ফাইট৷ আমরা সবাই আছি আপনার সঙ্গে৷ বাট ইউ হ্যাভ টু উইন৷ আপনাকে জিততেই হবে৷’ হ্যাঁ, জিততে কৃষ্ণেন্দুকে হবেই৷ নিজের জন্য না হলেও সোমের জন্য, বৃষ্টির জন্য৷ তাই তো সে সবকিছু আবার প্রথম থেকেই শুরু করতে চায়৷ শুরু করতে চায় সেই বকখালি থেকেই৷
কদম ফুলের গাছটার তলায় অনেক ঝরে পড়া কদম ফুল পড়ে আছে৷ কিছু কিছু ফুল এখনও অক্ষত, জীবন্ত৷ কোনওটা কোনওটা থেঁতলে গেছে কারোর পায়ের তলায় পড়ে৷ কৃষ্ণেন্দু লক্ষ করে তার ডানদিকের দেওয়ালে মুখে সাদা ডিম নিয়ে পিলপিল পায়ে এগিয়ে চলেছে সারিসারি পিঁপড়ের দল৷ তার মানে, খুব জোর বৃষ্টি আসছে৷
(শেষ)