শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

বিশেষ নিবন্ধ ।। সঞ্জয় রায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



সঞ্জয় রায় ।। অচলায়তন 





'সমস্ত সায়াহ্নে আজ। মেঘে মেঘে কেটে গেলো বেলা। অবহেলায়।' আমিই লিখেছিলাম কোথাও। 

এই বিষণ্ণদিনে যদি পুনরায় ভাবি আমি আত্মবিস্মৃত তাহলে পাপের বোঝা বাড়বে বৈ কমবে না। 

কিছু উক্তি মনে পড়ে। শ্রদ্ধেয় কবি অমিয় চক্রবর্তীর লেখায় জেনেছি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,"সামনে কী আছে জানিনা।যে পথ দিয়ে এসেচি তার দিকে ফিরে চেয়ে আশ্চর্য লাগে। বাঁকে বাঁকে এর অভাবনীয় মুহূর্ত,কত পালা বদল,পরিবেষ্টনের ইতিহাস।"আবার তিনি বলেছিলেন"শান্তিনিকেতনের কোণায় এলাম,নিরাভরণ উৎসব জমে উঠল,নানা জাতির মানুষকে নিয়ে মেলবার পালা।রবীন্দ্রনাথ ভীত ছিলেন তাঁর নিজের হাতের গড়া এই খোলা আশ্রমের বেঁচে থাকার আশঙ্কায় তাই বলেছিলেন "আজকের অতি ধূসর পৃথিবীতে যে-দৃষ্টির বলে বিশ্বভারতী গড়া হয়েছে তার রহস্য ভেদ করতে মানুষের সময় লাগবে।"আশঙ্কা করেছিলেন বলেই হয়তো বহু ভাষী এই দেশ আজ বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে। 

আমার জীবনের কৈশোরে প্রথম রবীন্দ্র পাঠ যা দিয়ে শুরু,হয়তো আপামর বাঙালিরও, তাতে জেনেছিলাম, প্রথম অনুভব করতে শিখেছিলাম যে জল পড়লে নাকি পাতা নড়ে।হ্যা নড়ে। কিন্তু আজকের এই অচলায়তনে সেই কিশোরবেলার অনুভব কিছুটা ম্লান, ভাবতে খারাপ লাগে। না, হয়তো পাতা নড়ে না। এটাই বাস্তব। স্বৈরাচারী আগ্ৰাসনে আজ পাতা নড়ে না। আয়তনের উত্তর দিকে আঁক কাটার অপরাধে সে অপরাধী। সেই ১৯১২। প্রচলিত সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে মুক্তিবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার জয়গান। সেই সময়ের সমকালীন রক্ষনশীল হিন্দু সমাজ এই নাটকটি পড়ে বিরক্ত হয়েছিল।আজ ২০২০।আজো এই সংশোধনাগার। পরিবেষ্টন। দেয়াল। বিভাজন। বর্বরতা। কেননা আজো "ছাগলোমশোধন" শিখতে হবে। "দ্বাবিংশপিশাচভয়ভঞ্জন" শিখতে হবে। না হলে অচলায়তনের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেবো কোন লজ্জায়?মেনে নিচ্ছি, কালের বিবর্তনে ক্রমে ক্রমে অধোগতি মেনে নিতে হয়। হচ্ছে। হয়তো খোয়াইয়ের বুকে পঞ্চবটী বেঁচে থাকলো না। শুকনো মাঠ জয় করেও ছায়াতরুময় বিদ্যায়তন অচলায়তনে পরিণত হলো।অপসংস্কৃতি মেনে নিতে হচ্ছে। তাই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-দর্শন কে শিক্ষা-ধর্ষণ করতে আমাদের লজ্জা নেই। Education আর Perfection এবং Divinityর Manifestation নয়। যা স্বামীজী বলে গিয়েছিলেন। Divinity আশ্রয় নিয়েছে বুলডোজারে। Perfection সশস্ত্র হামলায়। বিশ্বভারতীর  ইতিহাসে রাবীন্দ্রিক ভাবধারার অবমাননা নতুন কিছু নয়। যা প্রায় কয়েক দশকের। এই বৈরীতা আজ আবার নতুন রূপ পেলো। কেন এলো এই আধিপত্য বিস্তারের ঘৃণ্যতম মনোভাব? কোন রাজনীতিবলে? 


আজ রবীন্দ্রভাবধারা অবলুপ্ত প্রায়। বিদ্যাসাগরের উপর চারিত্রিক কলঙ্ক। বাঙালি কি পথভ্রষ্ট তবে? 
কিছুকাল রবীন্দ্রগানের চর্চা করেছি এই প্রতিষ্ঠানে। 
আমার রবীন্দ্রনাথকে চিনতে। যা একান্ত আমার। আপন। কেবল মেধায় নয়। অনুভবে। সন্ধ্যার ম্রিয়মাণ আলোয় কাফি কিংবা বেহাগে।উত্তরায়ণের পাশ দিয়ে আপনমনে হেঁটে যেতে যেতে প্রত্যহ দেখতাম "আনন্দ রূপমমৃতং যদ্বিভাতি একমেবাদ্বিতীয়ং" অর্থাৎ এক এবং অদ্বিতীয় তিনি যিনি অমৃত আনন্দ রূপে বিভা বিতরণ করেন।বিভা।এক অনন্তময় বিভা।যা নিহিত আছে রবীন্দ্র চর্চায়।গীতবিতানের হলুদ পাতায়। 

জানি,প্রোমোটারি রাজনীতিতে আজ খোয়াই বিধ্বস্ত। ভোগবাদী যাপনে আদিবাসী রমনী লালসার শিকার।তাই কি এই সীমান্তপ্রহরী? এই প্রাচীরভেদ? আশাকরি কবিকাহিনীর সেই লেখা মনে আছে সংবেদনশীল বাঙালির: 

"যা দেখিছ, যা দেখেছ, তাতে কি এখনো 

সর্বাঙ্গ তোমার, গিরি, উঠেনি শিহরি? 

কি দারুণ অশান্তি এ মনুষ্যজগতে, 

রক্তপাত, অত্যাচার, পাপ, কোলাহল..." 

যে সংবেদনশীল সত্যদর্শিতার সাহস নিয়ে যিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁর পুঞ্জীভূত বাঙালির আবেগ আজ সংঘর্ষের মুখোমুখি। প্রাসঙ্গিকতার সংশয়ে অপেক্ষমান।দলিত শিক্ষা আর দলীয় রাজনীতির কাঠগড়ায় অপরাধী। 

তাই সমস্ত বিতর্ক ছেড়ে ফিরে যেতে চাই সেই "জল পড়ে,পাতা নড়ে" কৈশোরে। অনুরণন পেতে চাই সেই গানের "তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে/কেউ তা জানেনা"।কিংবা "গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা/আমার যা কথা ছিল,হয়ে গেল সারা..." 

হ্যাঁ, সারা তো হয়েছে তাঁর। সবকিছু বলা। 

পড়ন্ত আলোয় এই ম্রিয়মাণ বেলায় এসে এই তো রবীন্দ্র অনুভব, শিক্ষা, আমার একান্ত রবীন্দ্রনাথ। 

স্বার্থান্বেষী সীমানা প্রাচীর নয়।সবার সাথে রঙ মেলানোর খেলা। তাই তো আশা জাগে। যারা তথাকথিত স্বার্থের উর্ধ্বে, তাঁরা আজো রবীন্দ্র বিস্মৃত নন। বিস্মরণেও আছে আজো আঁকড়ে থাকার ভবিষ্যৎ রবীন্দ্রনাথ।ভাসতে ভাসতেও ধরে থাকা শেষ খড়কুটো। 

সাম্প্রতিক ঘটনাবলী প্রতিবাদযোগ্য। 

পরিশেষে চারটি পঙক্তি দিয়ে শেষ করবো: 

সমস্ত ছিনিয়ে নিতে পারো
বাতাস পারো না। 

পারো না ছিনিয়ে নিতে মাঠ, ফুল, উন্মুক্ত বাগান

একটি সম্পূর্ণ মাঠ গড়ে দেবো শৃংখলের দামে। 





1 টি মন্তব্য:

  1. দারুণ লেখা। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দারুণ বক্তব্য।

    উত্তরমুছুন