শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

বিশেষ প্রবন্ধ ।। ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৩।। ২২ আগষ্ট, ২০২০



ল্যাডলী মুখোপাধ্যায় ৷৷ ইউরোপে নাকাল্ জীবনের কবিতাঃ আর্তো



প্যারিসে মিতেঁরো গ্রন্থাগারে গিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে৷ পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক ও সুবৃহৎ এই লাইব্রেরিতে আতেঁয়া আর্তোর সংগ্রহ দেখার উদ্দেশ্য ছিল৷ গত শতাব্দীর শুরুতে যিনি আভাগার্দ সংসৃকতির প্রাণপুরুষ ছিলেন৷ কবি, নাট্যকার, ও চলচিত্রকার ও অভিনেতা আতেঁয়া আর্তো৷ অনেকানেক লেখক-শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন৷ যার মধ্যে অন্যতম সালভাদোর দালি ও লুই বুনুয়েল৷ যার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল আ সে আলুর’র মতো সিনেভুবন কাঁপানো চলচ্চিত্র৷ সেই আর্তো ছিলেন পরিবর্ত সংসৃকতির জনক৷ আজকে আবার সারা ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে নতুন প্রজন্ম আর্তোরই স্মরণাপন্ন৷ চলতি জীবনের নষ্ট ধারাপাতের বিপরীতে একবিপন্ন সময়ের কাউন্টার কালচার৷ 

প্রকান্ড চারচারটে আকাশ ছোঁয়া বাড়ির এ তল সে তল খুঁজে যখন অবশেষে আর্তোর সংগ্রহের কাছে এসে দাঁড়ালাম তখন আমার চোখ গেল একটি আলমারিতে লেখা এক কাবাকাঠের বাক্সের দিকে৷ নানা ভাষায় অনুদিত (বাংলায় নেই) সেই লেখার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘একাকী মানুষ বসে নির্জন কবিতার খোঁজে’৷ প্রকৃতপক্ষে আমি যা আর্তো সম্পর্কে কোনও সম্পর্ক নেই৷ আর্তো ছিলেন বেপরোয়া৷ জীবনকে যথেচ্ছ যাপনের মধ্যে দিয়ে তিনি মৃত্যুর সঙ্গে কানামাছি খেলে গেছেন জীবনভর৷ হতাশা আচ্ছন্ন এক নিদারুণ বর্ণপরিচয়ের মাধ্যমে তিনি জীবনের ভাষাকে সনাক্ত করতে চেয়েছিলেন৷ সারা পড়েছি তারা ছিটকে গেছি, রক্তাক্ত হয়েছে বারে বারে৷ 

এখানে বলে রাখি, আর্তোর ওপর একটি ছোটো ছবি আমি সংগ্রহ করেছিলাম বছর দশেক আগে৷ যে ছবিতে আতেঁয়া আর্তো স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন৷ এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন আর্তোর ভক্তপ্রেমিকার টাকায় আরেক উন্মাদ কবি৷ তখন আর্তোর শেষ জীবন৷ বহুবারের মতো এবারেও তিনি দশমাস পর মেন্টাল অ্যাসাইলাম থেকে মুক্ত হবেন৷ জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী এক অরক্ষিত উপত্যকার জটিল পর্যবেক্ষণে৷ জ্যান্ত-মরা আর্তো তখনও ‘থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি’কে প্রসারিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ শরীর দিচ্ছে না৷ তাঁর অবশ শিরা-ধমনিতে যৌনতা ডানা মেলেছে, নেশা তাঁর নীল ব্যালেরিনা৷ চোর-জোচ্চর, মাতাল-লম্পট, বেশ্যা-বাটপার, সমকামী-নেশাড়ু তাঁর জীবনের যথেচ্ছ যাপনের পটভূমি৷ নক্ষত্র সংকেতে আর্তো তখন চাঁদে পাওয়া নগ্ণ জীবনের ধারক৷ 

ছবিতে দেখানো হয় যে তাঁর ভক্তরা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন৷ যেখানে বিষয় আতেঁয়া আর্তোপ৷ তাঁর জীবন ও নির্মাণ৷ বহু মানুষ সমবেত হয়েছে৷ চুলচেরা আলোচনা চলছে৷ হাততালি পড়ছে মুহুর্মুহু৷ অন্য এক ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে আর্তো শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়ে, প্রায় ভিক্ষুকের মতো প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছে গেছেন৷ অসুস্থ আর্তোকে ঢুকতে দিচ্ছে না নিরাপত্তা রক্ষীরা৷ আর্তো নিজের পরিচয় দিলে উপহাসে ফেটে পড়ছে তারা৷ এ ছবি ছিল সাদা-কালোর বাস্তবে নির্মিত এক ঐতিহাসিক দলিল৷ 

আতেঁয়া আর্তো ছিলেন সম্পূর্ণতই প্রতিষ্ঠান বিরোধী৷ তাঁর পুরো নাম ছিল আতেঁয়া মেরি জোসেফ আর্তো৷ এই প্রবল পরাক্রান্ত ফরাসী কবি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানকেও তোয়াক্কা করেননি৷ রাষ্ট্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নির্মম সত্যের সঙ্গে ঘর করেছেন৷ ক্ষমতাকে ফুটিফাটা করে তছনছ করে দিয়েছেন৷ ব্যক্তিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে তোয়াক্কা করেননি৷ কখনোও মেইন স্ট্রিম ধারণাকে আজীবন ডোন্ট কেয়ার করেছেন নিজস্ব উচ্চারণে৷ আর্তো ছিলেন কবিতার আঁতুড়ঘরে নির্মোহ এক নাট্যসন্ত্রাসবাদী৷ 

তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি নাটক যদি একইসঙ্গে কবিতার নির্মাণও ধবংস না করতে পারে তবে তা কোনো থিয়েটারই নয়৷ কবিতা নির্মাণের পাশাপাশি তাকে অস্বীকার করতে হবে৷ কবিতা কোনো মোহ নয়৷ কবিতা জীবনকে ছিঁড়েখুড়ে নস্যাৎ করা৷ আর ধবংসকালীন সেই অবস্থায় যাওয়া যা পাঠককে চিহ্ণিত করবে৷ শব্দের মধ্যেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিকতা লুকিয়ে আছে৷ তাকে ভেদ করে রক্তে প্লাবিত ছন্দের আধারে সেই প্রয়োজনীয় শব্দটিকে সনাক্ত করতে হবে৷ খুবই কঠিন ও দুরূহ এই আত্মবিধবংসী কবিকে বুঝে নেওয়া৷ গবেষকরা বলছেন, তিনি আসলে শত শত বছর পার করে তাঁর ভাবনাগুলোকে সাজিয়েছেন৷ আর্তো লিখেছেন, ‘আই উড লাইক টু রাইট আ বুক উইচ উড ড্রাইভ মেন ম্যাড৷ উইচ উড বি লাইক অ্যান ওপেন ডোর লিডিং দেম হোয়ার দে উড নেভার হ্যাভ কনমেন্টেড অনটু রিয়েলিটি৷‘ মারাত্মক উপলব্ধি! 

মিতেঁরো গ্রন্থালয় থেকে মাথা ভারী করে পথে নামলাম৷ চার-চারটি আকাশছোঁয়া বাড়ির প্রত্যেকটা খোলা বইয়ের মতো দেখতে৷ আর যার ভেতরে আছে পঠনপাঠনের আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত ব্যবস্থাদি৷ যে কয়েকবার এসেছি, মনে হয়েছে ফরাসীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখার ঔৎসুক্যে নিরন্তর ক্রিয়াশীল৷ যার কোনো পরিমাপ হয়না৷ এমনই এক ফরাসী ছাত্রের সঙ্গে দেখা বাসস্ট্যান্ডে৷ লোরেন্স সিনেমা করতে চায়৷ বেশ তাগড়া পড়ুয়া৷ আমার তখন ইতালির পথ ধরার কথা৷ রাতভোর বাসে চেপে মিলান যাব৷ তো এই ছাত্রের অনুরোধে একটা পানশালায় ঢুকলাম৷ দু-পাত্র নিয়ে কথায় কথায় চলে এল আতেঁয়া আর্তোর কথা৷ জিজ্ঞেস করলাম, এ কেমন সংগ্রহশালা! আর্তোর কী কথা লিখেছে এখানে৷ এমন কথা তো কখনো পড়িনি৷ ‘লোরেন্সা বলল,’ ওটা একটা মামুলী লাইন আর্েতার কম বয়সে লেখা৷ বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক সমান আর্তোকে মেইন স্ট্রিম সমাজে সালিম করতে চাইছে৷ আরে তা কি কখনো হয়! বুঝলাম, প্রতিষ্ঠান এখনও কেমন ভয় করে আতেঁয়া আর্তোকে৷ আমি এক ধরনের আপাত উত্তরেই সন্তুষ্ঠ হয়ে বাস ধরলাম লোরেন্সকে বিদায় দিয়ে৷ মিলানোতে নেমে আলাপ হল এক মরোক্কান যুবকের সঙ্গে স্টীভ গেলো নামের বিশালাকার এই ছেলেটি বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের গবেষক৷ সে পড়শোনার ফাঁকে ফাঁকে গাঁজার মদ তৈরি করে৷ সবুজ সে পানীয় জিভে ধরে রাখা যায় না৷ এমন তার ঝাঁঝ৷ নেশাখোর আমি বাপের জন্মে গাঁজা থেকে উৎপন্ন মদের কথা শুনিনি৷ স্টীভের বাড়িতে সেই তার গবেষণালব্ধ পানীয় গলাধঃকরণ করতে করতে তাঁর বইয়ের তাকে উঁকিঝুকিঁ মেরে দেখি সেখানেও আতেঁয়া আর্তো৷ 

আমার ভিন্নধর্মী কবিতা, নাটক, সিনেমা নিয়ে উৎসাহ টের পেয়ে সে বলে, ‘দেখো আর্তো তাঁর নাটকে অধিকাংশ সময়ে অভিনেতাদের গা থেকে জামাকাপড় খুলে নিয়েছেন৷ কবিতা যখন লিখেছেন তখন মানুষের শরীরের চামড়া তুলে নিয়ে কবিতাকে মিশিয়ে দিয়েছেন মাংস-মন্থার গভীরে৷ এই কবি সবসময়ই সরাসরি, প্রকাশ্য৷ যাঁর কোনো ভয়ডর নেই৷ যে নিজেকেও রেয়াত করেনি কখনও৷ ফলে আজকের নতুন প্রজন্ম তাঁর প্রতি প্রলুব্ধ হচ্ছে জেনে বা না জেনে৷ ফলে রাষ্ট্র তাঁকে মোলায়েস করে পরিবেশন করবে তাতে অবাক হওয়ার কি আছে!’ মধ্যরাতের সেই আড্ডা ক্রমশ সবুজ মদের প্রবাহে আমাদের দু-জনকেই বোধ হয় আচ্ছন্ন করেছিল৷ হালকা ঠান্ডায় তখন বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিল নিজেকে৷ যখন শুনলাম যে শুধু বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েই আর্তোকে নিয়ে গবেষণা করছে আঠাশজন ছাত্র-ছাত্রী৷ একটা পুরো বিভাগ খোলা হয়েছে আতেঁয়া আর্তোর নামে৷ 

রাষ্ট্র কি চোখে ঠেলে পার পাবে? 

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা ২০১৮ সংখ্যা থেকে 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'-এ প্রবন্ধটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন