শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ।। ইন্দ্রজিৎ রায়

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ২।। ১৫ আগষ্ট, ২০২০




ইন্দ্রজিৎ রায়।। ফালতু ডায়রি, বৈশাখ, বিশেবিষ


হঁসদেও নদী পেরিয়ে আকাশখাওয়া চিমনিগুলো , ডোরাকাটা চিমনি ,এখানে নদী আটকে সেই জল কারখানার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে ,তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে । দিদা বলতো ছাগলের লড়াই ,আনুষ্ঠানিক বাতি ,চোং লাগিয়ে,লোক ডেকে শেষে এই ! নদী পেরিয়ে বিদেশের পোস্টকার্ডের মত ঝকঝকে নগরপ্রতিমা , যা ঠিক এখানকার নয়,এগুলো সরকারের আমদানি ।এই সরকার লোকটা কে বুঝতে সত্তর বছর লাগলো আমাদের ।আজ ও সত্যি জানিনা । জানানার মত। মর্দানা আর জানানা ।দুরকম দেশ,কাল । কারখানা সংলগ্ন বাড়িঘর গুলোতে আমার বাবা মা থাকতেন, কোন পাশাখেলার চালে আমার দিদাও গিয়ে পৌঁছেছিলেন । সেটা প্রথমে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও , পরে বোঝা যায় এর আধিভৌতিক দিকগুলো । নড়াইল সাবডিভিশন কি খুলনা ? দিদার বাবার নাম ছিলো পুলিনবিহারি । রাজরোগ ।বাবা চলে যান ।ঘুরতে ঘুরতে , থিতু কাকে বলে ? কেউ কি হয় । এই যশোর খুলনা ঝিনাইদহ আমি গেছি ।কিন্তু ফিরে এসে বলার কাউকে পাইনি ,কারণ , ততদিনে ...কেন দিদার কথা বলতে হবে । হনুমানজীর কথা ছেড়ে ,কেন বলতে এলাম সেটা হয়ত ঐ বাল্যকালের গাধা পেটাপিটি ।টালিভাঙ্গা টুকরোর একটা স্তুপ বানিয়ে যেন দূর থেকে রবারের বল ছুঁড়ে তা ভেঙ্গে ফেলা ,একটা চিৎকার ওঠে ,হো ও ও ও ও , থেমে যায় আবার । পুনরায় ঝিঁঝি ও পাহাড়ি গুবরে পোকা দখল নেয় নীরবতার । নিশুত রাতে পাহাড়ি গুবরে দিক হারিয়ে ঠং করে ল্যাম্পপোস্টে লাগে এসে । আবার এই চাট্টান ছত্তিসগড় ঝিমোতে থাকে ।
খুব ভোরে উঠে আশপাশের অনেক রাস্তাঘাট বুঝে নেয় দিদা , প্রবল পাঠাভ্যাস ছিলো , শেষ বয়সেও ছানি চোখে , বইয়ের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখেছি ,একেকসময়ে ভাবতাম কোনও বইয়ের মধ্যেই ঢুকে পাতার মত জালজাল ,অশ্বত্থের মত হয়ে আছে কোনও মানুষ ,বই খুললে হয়ত বেরিয়ে আসতে পারে , এসব ভাবতাম । অত বড় কারখানাতে যা হয় , তা কিন্তু আদতে মাছের তেলে মাছ ভাজা ,শিল্প মানে কল কারখানা অথবা লেখাছবি শিল্প , সবই কিন্তু কঁ কাঁচামাল এখানেই পাওয়া । দুনিয়াতে ।কাঁচামাল বানানোর খেমতা নেই কারো । দিদা বলতো , গোলকের পেটের ভেতরেই তেল , সেই তেলে গাড়ি প্লেন চালিয়ে কত ফুটানি দেখ ।এক ফোঁটা পেট্রল বানাতে পারবি ? না ।কেন? এত নপর চপর কথা ,পেট্রল বানা কেনে ! বানাতে সময় লাগবে ।কাল । মহাকাল ঢুকে সব পচিয়ে তবে তো তেল , অত সোজা ।এই যে হঁসদেও নদীর ওপরে বাঁধ , মালগাড়ি ভরতি কয়লা বাষ্প হচ্ছে , সেই ক্ষিপ্ত বাষ্প ঠেলে ঘোরাচ্ছে টারবাইন , আর এখানকার স্থানীয় সফল মানুষ ,তাদের মজদুর ভাই বলে ডেকে,তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে কিছু শহুরে শিল্পী দিব্যি বেঁচে আছে, এও এক বুকভাঙ্গা আখ্যান । এখানে দাঁড়িয়ে দিদা ছাড়াও আরেকজন কে ভাবি ।না তিনি আপনাদের ভাষায় সেলেব্ নন ,তবে ঐ মজদুর ভাইদের কাছে , নিশ্চই । শঙ্কর গুহনিয়োগি । ব্যাস । নামটাই যথেষ্ট ।বাকিটা সংস্থাপক , অধ্যাপক ,ব্যবস্থাপক এঁরা বলবেন ।আমাদের কাজ তো বলা না ,হাতিঘাসের এপার ওপার , টকটকে লাল বৃষ্টিধোয়া একটি টালির দিকে তাকিয়ে আনমনা হতে পারেন বন্ধুরা আজও , হাতিঘাসের ভেতরে টালি ।কী রূপ ! মনে পড়ে দশ বিশটা বছর , দিদার হাসপাতাল বাস । গভীর কোমা । দেয়ালা ।কাউকে চিনতে পারছে না । পেচ্ছাপ বন্ধ ।আমি দৌড়ে এসেছি ।দিদা আ , স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলো দিদা ।তিনদিন পর ।ডাক্তার অবাক ।আসলে ডাক্তারি শাস্ত্রে কি বাৎসল্য পড়ায় ? পঞ্চরসের ভিয়ান ।পড়ায় ? জানি না । পরের দিনও তাই ।অবস্থা খারাপের দিকে ।সাড়া নেই । আমাকে ডাক্তার বললেন , আপনি ডাকুন । সাড়া দিলো দিদা ।যেন পুরুলিয়ার মামাবাড়ির অতলান্ত পাতকুয়ো থেকে গলাটা উঠে এলো , সোনাই ই ই , হাতটা এগোতে আঙুলটা চেপে ধরলো দিদা , আহা বাৎসল্য মহারস কেন ! কী খাবে দিদা ? বলো ,বলো কী খাবে ....এক মুহুর্তের নীরবতা , দহী ভাত খাবো ...আমি দৌড়ে বেরোলাম বাবার স্কুটারটা নিয়ে ,এতক্ষণে ভাত হয়ে গেছে , কিন্তু ,কিন্তু যখন ফিরলাম , দিদা , ওই আর কি । দইভাত টা থেকেই গেলো । আমার প্রিয় একটি পাঞ্জাবি গান , " বিনা হুকম্ দে অন্দর না ,যায়ে রোটি.." , হুকুম ছিলো না ,দই ভাত ,কিন্তু কোমার ভেতরেও শুধু বাৎসল্যের জোরে ,নাতির ডাকে , মৃত্যুর হাত ছাড়িয়ে , সাড়া দেওয়া ।মনে থাকে ।
এরপরেও থাকে আমার ডোমজন্ম । ডোমরাজা । ওখানে শ্মশাণ ছিলোনা, নতুন বসতি তো , বিলাসপুর যেতো সবাই ।আমি রাজি হইনি । বললাম যা হবার ,এখানেই হবে । মানুষজন জুটে গেলেন । কিন্তু হাসপাতাল থেকে দিদা ,মানে দিদার শরীর চলে এলো সন্ধেবেলা ।সারারাত , ড্রয়িং রুমে শুয়ে থাকলেন ।পরদিন , হঁসদেও নদীর ধারে ,কাঠ যোগাড় করে,চিতা বানিয়ে যখন কাজ হচ্ছে , আমার , আশ্চর্যভাবে মনে পড়ছে , অক্ষয় মালবেরি র কথা , দিদা মিশে যাচ্ছে ,হঁসদেও নদীতে ,ছত্তিসগড়ের আকাশে , অক্ষয় মালবেরির দাদুর মত , আমি কিরকম শিক্ষানবিশ ডোমের মত ,হাতে একটা নদীর পাথর নিয়ে , চিতার অনতিদূরে , ঠিক যকৃতের মত দেখতে ,নদীর পালিশ করা পাথর , যা আমাকে ভুলতে দেয় না কিভাবে কোমার গভীর থেকে অত স্পষ্ট সাড়া দিতে পারে জান ।
প্রাণ কি পাখি ? সত্যিই ? ডোমরাজা । গা শিরশির করে । হঠাৎ হঠাৎ । ব্রয়লার হিন্দি ভাষা জানে ,অথবা মৈথিলী ,অবধী ...এটা অনেক আগে একটা লেখার শিরোনাম ছিলো ,মাংসের ভেতরে যেমন কুচকুচে হাড় খুঁজে পাওয়ার একটা এলানো ইচ্ছে থাকে ,সকাল থেকে সাইকেলে গড়াতে গড়াতে যে ব্রয়লারের চিৎকার গুলো শুনি ,ওটা বাংলা হতে পারে না । হিন্দি নাকি ? তাই হবে , ছত্তিসগড়ের ঠেট হিন্দি ,গা শিরশির করে ওঠে .....
(ক্রমশ )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন