কথোপকথন : মৃদুল দাশগুপ্ত
গত শতাব্দীর সাতের দশকের অন্যতম কবি মৃদুল দাশগুপ্ত-র জন্ম: ০৩.০৪.১৯৫৫৷ প্রথম কবিতাপ্রকাশ: ১৯৬১,‘শীর্ষবিন্দু’ পত্রিকায়৷ প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ : ‘জলপাই কাঠের এসরাজ ’ (১৯৮০)৷ এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৫ টি৷ শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : সোনার বুদ্বুদ (২০১০)৷ প্রাপ্ত পুরস্কার/সম্মান: অনেক পুরস্কার/সম্মান পেয়েছেন৷ উল্লেখযোগ্য ন্যাশনাল রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড, বাংলা আকাদেমি পুরস্কার,রবীন্দ্র পুরস্কার৷
২৬.০৫.২০১৬
দুপুর ১২.৪২-এ
শুরু হওয়া
এই কথোপকথন
গড়িয়ে যায়
বিকেলের দিকে৷
কবির সঙ্গে
কথা বলেছেন
রাজীব সিংহ৷
মাসিক কবিতাপত্র : গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের শেষ থেকেই বা বলা ভালো ছয়ের দশক জুড়ে সারা বিশ্বে পুরনো মূল্যবোধ,সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন,আধিপত্যবাদ,যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবসমাজ৷ এই সময়ে এসে আপনার কবিতা লেখার শুরু৷ এই ঝোড়ো সময় আপনাকে,আপনার কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
মৃদুল দাশগুপ্ত : আমি এটাকে নানা ভাবে ভেবে দেখেছি যে আমাদের ওই সময়ে আমার সমসাময়িক যে সঙ্গীরা লেখালিখি শুরু করলেন এবং আমিও চেষ্টা চালালাম৷ আমরা যেটুকু কবিতা লিখেছি সেটা সময় বিচার করবে... ওই ঝোড়ো সময়... সময় তখন ছিল নৃত্যরত... সে সময় ছিল স্বপ্ণের, আশা-আকাঙ্ক্ষার, তো সময় ছিল ছন্দিত, তাই যাদের সত্তর দশকের কবি বলা হয়, তাঁরা ওই ছন্দিত সময়ের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন৷ তাঁরা সকলেই ছন্দ জানেন৷ এই যে ব্যাপারটা ঘটে গেল, আমি মনে করি আমরা সময়েরই দান৷
মাসিক
কবিতাপত্র: একদিকে
ভিয়েতনামের
গেরিলাযুদ্ধ,অন্যদিকে
পরবর্তীতে ভাঙনমুখী
আন্তর্জাতিক
কমিউনিস্ট শিবির--একদিকে
নতুন স্বপ্ণ,অন্যদিকে
স্বপ্ণভঙ্গের
হতাশা---আপনার
নিজের কবিতায়,আপনাদের
সময়ের অন্যদের
কবিতায় এই
ঝোড়ো দিনগুলির
কোনও ক্ষত
আদৌ কী
লক্ষ করা
যায়?
মৃদুল
দাশগুপ্ত:
ভিয়েতনামের
গেরিলাযুদ্ধ এবং
তার বিজয়
এবং আন্তর্জাতিক
কমিউনিজমের ক্ষয়
বা অবক্ষয়
এটা ঠিক
একই সময়ে
ঘটেনি৷ আর
ভিয়েতনামের যে
বিজয় আর
কি ,সে
সময়টাতেও কমিউনিজমের
জয়যাত্রা সম্পূর্ণ
মুছে যায়নি৷
ঠিক একই
সময়ের ঘটনা
এ দুটো
নয়৷ কমিউনিজমের
পতন মোটামুটি
ভাবে লেট
এইট্টিজ থেকে
অর্থাৎ আশির
দশকের শেষে
নববই দশকের
গোড়ায় ঘটেছে৷
দুটো এক
জায়গায় নয়৷
ভিয়েতনামের বিজয়ের
সময়ও কমিউনিস্টদের
বিস্তার এবং
স্বপ্ণ, আশা-আকাঙ্ক্ষা
ইত্যাদি দূর
হয়নি৷ দুটো
একই সময়ের
ঘটনা নয়৷
এর মাঝখানে
অন্তত পনেরো-কুড়ি
বছরের ব্যবধান
আছে৷
মাসিক
কবিতাপত্র: বুঝতে
পারছি,কিন্তু
আমার প্রশ্ণটা
ছিল ভিয়েতনামের
গেরিলাযুদ্ধ যেমন
একদিকে স্বপ্ণ
দেখাচ্ছে,তেমনি
অপরদিকে পরবর্তীতে
আন্তর্জাতিক
কমিউনিস্ট শিবিরের
পতন স্বপ্ণভঙ্গের
বার্তা নিয়ে
আসছে, এই
পরস্পরবিরোধিতা
আপনাদের সময়ের
কবিতায় কেমন
প্রভাব বিস্তার
করল?
মৃদুল
দাশগুপ্ত:সেটা
এইভাবে যে
আশির দশকের
সময়টা এল
এবং ধরা
যাক উল্টোদিক
থেকে মানে
ধনতন্ত্রের নানারকম
শাখা-প্রশাখা
বিচ্ছুরিত হতে
লাগল, সমাজে
কর্পোরেটদের দাপাদাপি
নয়ের দশকে
শুরু হল,
গ্লোবালাইজেশনের
যে ব্যাপার-স্যাপার
এল, সেই
সময়ের কাছে
তাকিয়ে দেখার
অনেক কিছু
আছে৷ আবার
নানারকম হতাশার
বোধও আছে৷
আহত হবার
বোধ আছে৷
যন্ত্রণার বোধ
আছে৷ সেসব
আমাদের সময়ের
কবিদের, বা
আমরা যারা
সময়ের ভেতর
দিয়ে চলেছি,
তাদের কবিতায়
তার লক্ষণ
আছে তো৷
মাসিক
কবিতাপত্র: এইরকম
একটা পরিবর্তিত
পরিস্থিতি,তখন
আদর্শ হিসেবে
কাকে মেনে
নিচ্ছেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত: মানে
আদর্শ হিসেবে
মেনে নেওয়া
বা এরকম
জায়গা থেকে
নয়৷ আমাদের
ভাষায় বিভিন্ন
যুগে বড়ো
বড়ো কবিরা
এসেছেন৷ আমাদের
যুগে বিভিন্ন
সময়ে যাঁদের
আমরা মহৎ
কবি বলতে
পারি,সেই
কবিদের উত্থান
ঘটেছে৷ তাঁরা
ভাষায় অভূ্যত্থান
ঘটিয়েছেন৷ রবীন্দ্রনাথ
তো বটেই৷
তার আগে
থেকেই মহাকবি
ভারতচন্দ্র,কবি
মাইকেল মধুসূদন
দত্ত আমাদের
ভাষায় বিপ্লব
ঘটিয়েছেন৷ আমাদের
কবিতাকে সমৃদ্ধ
করেছেন৷ আমার
তো মনে
হয়েছে যে,জীবনানন্দ
পরবর্তীকালে শক্তি
চট্টোপাধ্যায়,
বিনয় মজুমদার
এঁরা আমাদের
ভাষায় বড়ো
বড়ো কবি৷
বাংলা কবিতার
এই যে
ধারা,সেই
স্রোতোধারার ভিতর
দিয়েই আমরা
চলেছি আর
কি৷ আমাদের
নানাবিধ প্রাপ্তি
ঘটেছে এই
বড়ো কবিদের
কাছ থেকে৷
মাসিক
কবিতাপত্র : কোনও
নির্দিষ্ট রাজনৈতিক
মতবাদ কী
কখনও আপনাকে
আকৃষ্ট করেছিল?
মৃদুল
দাশগুপ্ত: হ্যাঁ,
করেছিল৷
মাসিক
কবিতাপত্র : এই
বিষয়ে যদি
দু-এক
কথা আমাদের
জানান---
মৃদুল
দাশগুপ্ত: সেটা
সেই সময়ের
স্বপ্ণের সঙ্গে
জড়িত৷ সেই
সময়ের তরুণেরা
ভেবেছিলেন যে,
একটা মুক্তির
আনন্দ জাগবে৷
মানুষ সেই
মুক্তির আস্বাদ
পাবে৷ এই
স্বপ্ণ ছিল
তো৷
মাসিক
কবিতাপত্র: এটা
আপনাদের সময়ে,
সত্তর দশকে
যে নকশালবাড়ি
আন্দোলন গড়ে
উঠছে, সেই
চেতনাতেই আপনারা
স্নাত হয়েছিলেন,
একথা বলা
যায় কি?
মৃদুল
দাশগুপ্ত: সেই
নকশালবাড়ি বাংলাকে
অনেক কিছুই
দিয়েছে৷ সেটা
শুধু অশ্রু,
রক্ত,
ভস্ম নয়৷
সেই নকশালবাড়ি
বাংলাকে অনেক
কিছু দিয়েছে৷
আমাদের মেয়েরা
নীরব বিপ্লব
ঘটিয়ে দিয়েছেন৷
আমাদের ভাষা
বদলেছে৷ নকশালবাড়ি
অনেক কিছু
দিয়েছে, আবার
অনেক ক্ষতিও
হয়েছে৷ সামাজিক
জায়গায় অনেক
ক্ষতিও হয়েছে৷
কিন্তু অনেক
কিছু দিয়েছে৷
মাসিক
কবিতাপত্র: সত্তর
দশকের এই
অভূত্থান বলি,আন্দোলন
বলি,বিপ্লব
বলি তা
সামাজিক জীবনে
অনিবার্যই ছিল,
নয়তো একটা
চিরাচরিত যে
জীবনের মধ্যে
দিয়ে বাঙালি
জাতিটি যাচ্ছিল,সেখানে
বোধহয় একটা
পরিবর্তন---
মৃদুল
দাশগুপ্ত:
হ্যাঁ,ব্যাপারটা
হচ্ছে স্বাধীনতার
সময়কালে যাঁদের
জন্ম, যাঁরা
ওই নতুন
দেশ ঘিরে
নানাবিধ স্বপ্ণ
দেখেছিলেন, সেইসব
শিশুরা যখন
কৈশোর-তারুণ্যে
এল, আলোকপ্রাপ্ত
হল, তাঁরা
একটা কিছু
বদল ঘটাতে
চাইলেন৷ তাঁরা
একটি বৈপ্লবিক
পরিবর্তন চাইলেন৷
এইটা থেকেই
ওই আন্দোলন
শুরু হয়ে
গ্যালো এবং
সেই আন্দোলন
এই সমাজকে
অনেক কিছু
দিয়েছে৷ এই
অঞ্চলকে অনেক
কিছু দিয়েছে
এবং ইতিহাসের
যে ঘূর্ণিঝড়
ওই সময়টা
এই মহাভারতের
এই অঞ্চলের
ওপরেই ঘুরপাক
খেয়েছিল, তাতে
ধরো, একইরকম
ভাবে যে
বাংলাদেশেও
গণ-অভূ্যত্থান
ঘটেছিল এবং
স্বাধীন বাংলাদেশের
অভূ্যদয় হয়৷
কিন্তু নকশালবাড়ি
আন্দোলন তার
ধারাবাহিকতা নানাবিধ
রয়েছে, অত
বছর আগের
আন্দোলন, আজও
সেই আন্দোলনের
ধারাবাহিকতাটা
সজীব, আজও
কিছু লোক,
সেটা ভুল
হোক, ভ্রান্তি
হোক, নানা
ভাবে তার
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
চালিয়ে যাচ্ছেন,
এইটা একটা
ঘটনা আর
কি৷ এটা
একটা ঘটনা৷
মাসিক
কবিতাপত্র: এই
নকশালবাড়ি আন্দোলনের
পাশাপাশি ধরুন
বাংলাদেশের যে
মুক্তিযুদ্ধ বা
তার পূর্ববর্তী
সময়টা, মানে
একই সময়ে
প্রায় ঘটছে
প্রতিবেশী রাষ্ট্রে,
ফলে প্রচুর
শরণার্থী বলি,
বা বাংলাদেশ
থেকে পালিয়ে
আসা মানুষজন
বলি, তারা
এসে আমাদের
পশ্চিমবাংলার নানান
অঞ্চলে ছড়িয়ে
পড়লেন, এই
সামগ্রিক ভাবে
একটা পরিবর্তিত
সমাজব্যবস্থা
আপনারা দেখছেন
আপনাদের সময়ে
দাঁড়িয়ে, যখন
‘সেপ্ঢেম্বর অন
যশোর রোড’-এর
মতো কবিতা
গিন্সবার্গ লিখছেন,
সেই সময়ে
দাঁড়িয়ে আপনার
ব্যক্তিগত লেখালিখি
আগের লেখালিখির
চেয়ে কতোটা
পালটে গেল?
মৃদুল
দাশগুপ্ত: এখন
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ
বা নকশালবাড়ি
আন্দোলন, এগুলো
আমার লেখালিখির
একদম গোড়ার
দিক৷ এই
সময়টা আমার
লেখালিখিকে পালটে
দেবার কিছু
না৷ কারণ,
ওই সময়
থেকেই আমার
লেখালিখির শুরু৷
আমার শুরুর
সময়টাই ওইটা৷
মাসিক
কবিতাপত্র: আচ্ছা
মৃদুলদা, কবিতার
শরীর অর্থাৎ
ফর্ম আপনার
কাছে কতটা
গুরুত্বপূর্ণ?
মৃদুল
দাশগুপ্ত:আমি
এই বিষয়গুলো
নিয়ে খুব
একটা ভাবি
না৷ মানে,কবিতার
শরীর অর্থাৎ
ফর্ম বা
আঙ্গিক যা
তুমি বলছো,এই
বিষয়গুলো আমার
ভেতর কোনও
কাজ করে
না৷ আমি
মনে করি
কবিতা আকাশ
থেকে নামে
এবং আমি
যেভাবে লিখি
সেভাবেই সে
আসে৷ এটাকে
সাজানোর কোনও
চেষ্টা করি
না৷
মাসিক
কবিতাপত্র:
শুরুতেই
আপনি জানিয়েছেন
যে সত্তর
দশকের কবিরা
প্রায় প্রত্যেকেই
ছন্দ জানতেন
এবং আঙ্গিকের
অন্যতম একটা
দিক ছন্দ,
অথচ আপনি
তা নিয়ে---
মৃদুল
দাশগুপ্ত: না,
আমি এটা
নিয়ে ভাবি
না৷ আমি
এটা ভাবি
না৷
মাসিক
কবিতাপত্র : আপনার
কবিতা পড়লে
আমরা দেখি
চিরায়ত রোমাণ্টিকতার
বদলে অত্যন্ত
উদাসীন ও
মেধাবী এক
সত্তা আপনার
কবিতায় যেন
সব সময়
প্রচ্ছন্ন রয়েছে,
যা অত্যন্ত
অনুভূতিসম্পন্ন
ও সারাক্ষণ
ক্রিয়াশীল৷ দেশী-বিদেশী
নানা তত্ত্ব,
পুরাণ ও
সমাজচিন্তা আপনার
কবিতার উপাদান৷
প্রচলিত জনপ্রিয়
ভঙ্গির বিপ্রতীপে
দাঁড়িয়ে আপনার
সামগ্রিক উচ্চারণ৷
কেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত: মোটামুটি
এইসব বিষয়ে
আমি ভাবতে
শুরু করলাম
আশির দশকে৷
‘জলপাই কাঠের
এসরাজ’-এ
নানা রকম
কবিতা আছে৷
এই ‘জলপাই
কাঠের এসরাজ’
আমার প্রথম
বই৷ কিন্তু
আশির দশকে
যখন সমস্ত
বিষয়গুলো গুটিয়ে
এল, এবং
মানুষের নানা
আশা-আকাঙ্ক্ষার
যে স্বপ্ণ
সেই জায়গা
থেকে একটা
আত্মসমর্পণ জেগে
উঠল৷ আমি
আমার কবিতা
নিয়ে ভাবতে
বসলাম৷ সেইখানে
আমার মনে
নানাবিধ সংযম
এল এবং
আমার মনে
হল ব্যাপারটা
জমাট বাঁধানো
দরকার৷ আমি
‘এভাবে কাঁদে
না’-র
কবিতাগুলো লিখতে
শুরু করলাম৷
এইটাই, আমার
ভেতরে সংযম
কাজ করেছিল,
এবং এই
জায়গাটা আমার
ভেতরে বরাবর
থেকে গ্যালো৷
এইটা বলতে
পারি আর
কি!
মাসিক
কবিতাপত্র :
বুঝতে
পেরেছি৷ আচ্ছা,
মৃদুলদা,
কোনও নির্দিষ্ট
শিল্পসাহিত্য
আন্দোলন অথবা
কবিতা আন্দোলন
কী কখনও
আপনাকে প্রভাবিত
করেছিল?
মৃদুল
দাশগুপ্ত: একটা
বয়সে আমরা
অনেক বন্ধু
একত্রে চলাফেরা
করতাম৷ আমাদের
ভেতর নানাবিধ
সহমর্মিতা তৈরি
হয়েছিল বা
হয়ে আছে৷
এবং এই
একত্রিত হওয়ায়
আমরা নানাবিধ
কাজ করেছি৷
কখনও একটা
পত্রিকা ঘিরে
একত্রিত হয়েছি৷
পত্রিকা প্রকাশ
করেছি৷ একটা
বড়ো ব্যাপার
ঘটেছিল, এই
মাঝ-আশির
দশকে, আমরা
যারা লিটল
ম্যাগাজিনে লেখালিখি
করি, আমরা
যারা লিটল
ম্যাগাজিন করি,
আমরা একত্রিত
হয়ে কিছু
বিষয়ে সিদ্ধান্ত
নেবার পরিকল্পনা
করেছিলাম,আমরা
কৃষনগর শহরে
‘শতজল ঝর্ণার
ধবনি’ নামে
একটি সমাবেশ
করেছিলাম৷ এর
পরেও সিউড়িতে
এবং ধানবাদে
এই সম্মেলন
হয়েছিল৷ পরের
দু-তিন
বছর৷ এ
রকম একটা
মঞ্চ আমরা
তৈরি করেছিলাম৷
সেখানে আমরা
নিজেদের মতামত
বলেছিলাম এবং
কিছু কিছু
সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম৷
এইটা ঘটেছিল৷
তবে---
মাসিক
কবিতাপত্র:
সিদ্ধান্ত
বলতে? আমরা
কি সেটিকে
ম্যানিফেস্টো বলতে
পারি?
মৃদুল
দাশগুপ্ত: হ্যাঁ,
কিছুটা
ম্যানিফেস্টো,
কিছুটা
ম্যানিফেস্টোর
মতো৷ আমরা
সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম৷
এগুলো ঘটেছিল৷
কিন্তু এই
জায়গা থেকে
এখন যেটা
আমার মনে
হয়, সাহিত্যের
ক্ষেত্রে লেখক-কবিদের
একার ভূমিকাটি
প্রবল এবং
সে একাকী৷
মানে সাহিত্যের
আন্দোলন, ব্যক্তির
আন্দোলন৷ একজন
ব্যক্তিই অনেক
কিছু করে
দিতে পারে৷
অনেক কিছু
করাটাই তার
কাজ৷ সেটা
একার কাজ৷
সমবেত ভাবে
বা সংঘ
গড়ে সাহিত্যের
কিছু হয়
না৷
মাসিক
কবিতাপত্র : অনুজ
কবি হিসেবে
‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর
সঙ্গে আপনার
সম্পর্ক কেমন
ছিল?
মৃদুল
দাশগুপ্ত:
‘কৃত্তিবাস’
গোষ্ঠীর সঙ্গে
আমার সম্পর্ক
খুবই ভালো৷
একদম ছোটোবেলায়
আমি যখন
কলেজছাত্র তখন
উত্তরপাড়ায় একটা
কবিসম্মেলনে সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়,
শক্তি
চট্টোপাধ্যায়,
তারাপদ রায়
এসেছিলেন, এঁরা
‘কৃত্তিবাস’-এর
জন্য আমার
কবিতা নিয়ে
নেন, এটা
’৭২-’৭৩
সালে, কি
’৭৪ সালে,
মানে আমি
যখন কলেজে
পড়েছি, তখন
‘কৃত্তিবাস’-এ
আমার কবিতাগুচ্ছ
ছাপা হয়৷
এর পরেও
বিভিন্ন সময়ে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমার কাছে
কবিতা চেয়েছেন৷
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
মৃত্যুর পর
এখন যাঁরা
দায়িত্বে আছেন
তাঁরা আমার
সঙ্গে যোগাযোগ
রাখেন এবং
আমার কবিতা
তাঁরা চেয়ে
নেন, বা
‘কৃত্তিবাস’-এর
বিষয়ে আমাদের
কথাবার্তা হয়,
এই আর
কি৷
মাসিক
কবিতাপত্র: লিটল
ম্যাগাজিন-বিগ
ম্যাগাজিন,প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা
নিয়ে কিছু
বলুন৷
মৃদুল
দাশগুপ্ত : এইসব
বিষয়ে আমার
কোনও ব্যক্তিগত
মত নেই৷
আমার মত
হচ্ছে, বড়ো
বাজারি যেসব
পত্রপত্রিকা---
বাংলা কবিতা
সেখানে নেই৷
বাংলা কবিতা
কবিতার পত্রগুলিতে
আছে এবং
চিরকালই এই
ব্যবস্থা ছিল৷
কবিতা মঞ্চের
ব্যাপার নয়৷
কবিতা আলো
ঝলমল ক্ষেত্রের
ব্যাপার নয়৷
বড়ো বাজারি
সাপ্তাহিক,
পাক্ষিক,
শারদীয়া
সংখ্যা এইসব
জায়গায় কোনও
কবিতা নেই৷
মাসিক
কবিতাপত্র: আপনার
প্রথমকাব্যগ্রন্থ
‘জলপাইকাঠের
এসরাজ’প্রকাশের
প্রেক্ষিতটি জানতে
চাই৷
মৃদুল
দাশগুপ্ত : এই
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের
প্রেক্ষিত হচ্ছে,
আমি কবিতা
লিখতাম, আমি
কবিতা লিখতাম
যখন আমি
সুকলে নাইন-টেনে
পড়েছি, তারপর
আমি কলেজে
পড়েছি, এইসব
সময়ে আমি
কবিতা লিখতাম৷
আমার কবিতা
লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে
আমার বন্ধুরা
ছাপতেন৷ আমার
যখন মনে
হল একটা
বই করার
দরকার তখন
আমি কলেজে
পড়ি বা
আমি কলেজ
পাশ করে
চাকরি-বাকরি
খুঁজছি৷ আমি
ঠিক করলাম
আমি যখন
চাকরি পাবো
তখন আমি
কবিতার বই
প্রকাশ করবো৷
হাতে কিছু
টাকা জমলে
আমি বই
প্রকাশ করবো৷
এইবার আমি
চাকরি পাবার
আগে কিছু
আধা-চাকরিও
করলাম টুকটাক৷
সেইসব ক্ষেত্রে
আমি কিছু
টাকা জমাতে
লাগলাম৷ এরকম
করতে করতে
আমার টাকা
জমল তখন
আমি মাকে
বললাম যে
আমার চারশো
টাকা জমেছে,
আমি একটা
বই করবো৷
তো এইসব
যখন চলছে
তখন আমার
বাড়িতে একটি
ছেলে এল,
সে আমার
কবিতা পড়েছে৷
সে বললো,
আপনার বই
করতে বাকি
যা লাগে
আমি করে
দেব৷ তা
আমি সেই
ছেলেটিকে বললাম,
ঠিক আছে৷
ওই আমার
চারশো টাকা
আর সে
কিছু টাকা
দিল৷
মাসিক
কবিতাপত্র : তিনি,
মানে সেই
ছেলেটি পত্রপত্রিকার
সঙ্গে যুক্ত
ছিলেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : হ্যাঁ
হ্যাঁ৷
মাসিক
কবিতাপত্র : তিনিও
লেখালিখি করতেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : না,
সে লেখালিখি
করত না৷
সে একজন
ব্যবসায়ীর ছেলে৷
সে করল৷
মাসিক
কবিতাপত্র :
তারপর?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : তারপর
কি? তারপর
সে ধীরে
ধীরে প্রকাশক
হয়ে গ্যালো৷
মাসিক
কবিতাপত্র : আপনার
বই সেখান
থেকে প্রকাশ
পেল তো?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : হ্যাঁ
হ্যাঁ৷
মাসিক
কবিতাপত্র: তো
সেই প্রকাশনীর
নাম কি
যেখান থেকে
আপনার প্রথম
বই প্রকাশ
পেল?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : সেটার
নাম ছিল
‘দেশকাল প্রকাশনী’৷
মাসিক
কবিতাপত্র: আচ্ছা,এবার
একটু অন্য
প্রসঙ্গ,ঐতিহ্য
ও উত্তরাধিকার---আপনি
স্বীকার করেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : ঐতিহ্য
তো স্বীকার
করিই৷ নইলে
ভারতচন্দ্র-মাইকেলের
কথা বলব
কেন? মানে,
কিছুই আকাশ
থেকে পড়েনা
বা নতুন
গজিয়ে ওঠে
না৷ মানে,
একটা ভাষা
এগিয়ে চলেছে
তার কবিদের
নিয়ে৷
মাসিক
কবিতাপত্র :
সাহিত্যের
ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়
পৃষ্ঠপোষকতা,
সরকারি
পুরস্কার নিয়ে
বিতর্ক একটা
আছেই৷ এ
নিয়ে সংকীর্ণ
রাজনীতির অভিযোগও
সর্বজনবিদিত৷ এ
বিষয়ে আপনি
কি বলবেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : যাঁরা
পুরস্কার দেন,
মানে এই
যে কর্তৃপক্ষীয়
যারা আর
কি পুরস্কারটা
তো তাদের
নিজেদের৷ তাই
তো? এবার
তাদের... সেই
একটা সুনির্মল
বসুর ছড়া
আছে, তাদের
পাঁঠা তারা
লেজের দিকে
কাটবে, না
মাথার দিকে
কাটবে সেটা
ভেবে লাভ
কি? তাঁরা
যাকে খুশি
পুরস্কার দেবেন৷
এ বিষয়ে
আমার কোনও
অভিযোগ নেই৷
মানে কোনও
ক্লেম নেই৷
একটা বাড়ি
সে বলেছে
আমি পুরস্কার
দেবো, কেমন,
সে কাকে
পুরস্কার দেবে
সে তো
জনমতভিত্তিক
দেশভিত্তিক কোনও
ন্যায়ও নয়৷
একটা মুষ্টিমেয়
কয়েকজন সেটা
ঠিক করছেন৷
সেটা তো
কোনও ন্যায়বিচারের
আদালত নয়৷
ন্যায়ও নয়৷
এক্স যাকে
খুশি মনে
করবে সে
পুরস্কার দেবে,
কারণ,
পুরস্কারটা
সে নিজে
দিচ্ছে...
মাসিক
কবিতাপত্র : একটি
বিখ্যাত বাংলা
দৈনিকের সঙ্গে
জীবিকাজনিত কারণে
আপনার সংযুক্তি
আপনাকে কবি
হিসেবে প্রতিষ্ঠা
পেতে আদৌ
কোনও সহায়তা
করেছে কি?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : সেটা
তো আমি
বলতে পারি
না৷ সেটা
আমার পাঠক
বলতে পারবে৷
আমি কি
করে বলব?
আমি সেখানে
সাংবাদিকতা করি৷
সাংবাদিকতা একটা
অন্য বিষয়৷
আমি সাংবাদিকতাকে
সাহিত্য বলে
মনে করি
না৷ বা
আমি সংবাদ-সাহিত্য
করি না৷
আমি সেখানে
সাংবাদিকতা করি৷
আমার লেখালিখি
আর জীবিকা
দুটি স্বতন্ত্র
কাজ৷
মাসিক
কবিতাপত্র :
বাংলাকবিতায়
কলকাতা-কেন্দ্রিকতার
দীর্ঘকালীন অভিযোগ,আপনি
কি কিছু
বলবেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : হ্যাঁ
হ্যাঁ৷ এটা
ঘটনাই৷ কিন্তু
সত্তর দশক
এটা ভেঙে
দিয়েছিল৷
মাসিক
কবিতাপত্র : গ্রাম
দিয়ে শহর
ঘিরে ফেলেছিল৷
অন্তত কবিতা
তথা সাহিত্যের
ক্ষেত্রে৷
মৃদুল
দাশগুপ্ত : হ্যাঁ
হ্যাঁ...সত্তর
দশক এটা
তছনছ করে
দিয়েছিল...এই
যে নতুন
যে ভোগবাদী
ব্যাপারটা এসেছে,
এটাই কলকাতা
আবার, কলকাতায়
আবার ব্যাপারগুলো
ফ্লপ করে
গেছে৷ কিন্তু
মফস্সল বাংলা
গ্রাম সে
অনেক এগিয়ে৷
মেধা মননে
সে অনেক
এগিয়ে৷ কলকাতা
সেসব কল্পনাও
করতে পারে
না৷ অমিয়ভূষণ
(মজুমদার)
বলেছিলেন,কলকাতা
আসলে গুদামঘর৷
মাসিক
কবিতাপত্র :
অনেকেই
দাবি করেন
গত শতাব্দীর
সাতের দশকের
পরে পশ্চিমবঙ্গের
বাংলা কবিতায়
মৌলিক চিন্তার
বড়ো অভাব৷
আপনি কী
একমত?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : এ
বিষয়টাও আমার
কিছু বলা
ঠিক নয়৷
কিন্তু আমি
আশাবাদী৷ আমি
খুঁজে খঁুজে
কিছু বৈশিষ্ট্য
বা কিছু
ঔজ্জ্বল্য সেগুলো
পেয়েছি৷ পাই৷
আশা করি৷
মাসিক
কবিতাপত্র : এই
যে এতটা
পথ পেরিয়ে
এলেন আপনি৷
আপনার ‘কবিতাসমগ্র’
প্রকাশ পেয়েছে৷
এই এতদূর
হাঁটবার পর
‘জলপাইকাঠের এসরাজ’,
‘এভাবে
কাঁদে না’,‘রান্নাঘর
সিরিজ’,‘সূর্যাস্তে
নির্মিত গৃহ’
ইত্যাদি গ্রন্থের
কবির তাঁর
অনুজ কবিদের
প্রতি কোনও
বিশেষ পরামর্শ?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : আমি
কোনও কিছু
চাপিয়ে দিতে
পারি না৷
কিন্তু আমি
এইটা বলতে
পারি যে
উঁচু উঁচু
জায়গাগুলোতে কবিতা
টাঙিয়ে দেওয়াতে
কোনও লাভ
নেই৷ এবং
খ্যাতি বা
জনপ্রিয়তা--- এটা
কবিদের পথ
নয়৷
মাসিক
কবিতাপত্র : কবি
জীবনানন্দ দাশের
কবিতা না
গদ্য, আজকের
তরুণতমদের কবিতায়
কিসের প্রভাব
স্পষ্ট বলে
আপনি মনে
করেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত :
শোনো,জীবনানন্দের
কবিতা বা
গদ্য... বিষয়টা
ঠিক এরকম
নয়৷ জীবনানন্দ
দাশ গদ্যকার
হিসেবেও বিরাট...তবে
আমার যেটা
ধারনা যে
এই সময়ের
কবিতা সেই
জীবনানন্দের বলয়
থেকে বেরিয়ে
গেছে৷ ভাষার
একটা বদল
হয়েছে এই
গত দশ,পনেরো,কুড়ি
বছরে৷ ভাষার
বিবিধ বদল
হয়েছে৷ এই
প্রযুক্তি-বাহিত
ভাবে নানারকম
সংকেত, নানারকম
কিছু ঠার-ঠোর
এগুলো জেগে
উঠছে৷ সেই
জায়গায় ভাষার
একটা বিরাট
বদল হয়েছে৷
কিন্তু মোদ্দা
কথা যেটা
হয়েছে এখনকার
কবিতাপাঠে যে
অস্বস্তি কমন
পাঠকদের জাগছে,
সেটা জাগার
একটা কারণ
অভ্যাসগত পরিবর্তন
ঘটেছে৷ সেইটা
জীবনানন্দের যে
বলয় সেইটা
থেকে বাংলা
কবিতা ছিটকে
এসেছে৷ সেইজন্য
অস্বস্তি জাগছে
এই ভাষাটাকে
নিয়ে৷
মাসিক
কবিতাপত্র :
অনেকক্ষণ
ধরে আপনার
সঙ্গে, হয়তো---
মৃদুল
দাশগুপ্ত: না,না,
বলো---
মাসিক
কবিতাপত্র : একদম
শেষ প্রশ্ণ,পরবর্তী
প্রজন্মের কবিদের
কাছে আপনি
কী আশা
করেন?
মৃদুল
দাশগুপ্ত : যেটা
আশা করি,
সেটা হচ্ছে,
তারা সকল
বাধা সকল
লোভ সকল
প্রলোভন ---এগুলো
টপকে যাক৷
মাসিক
কবিতাপত্র :
আপনাকে
অসংখ্য ধন্যবাদ
মৃদুলদা৷ ভালো
থাকুন৷ সুস্থ
থাকুন৷
মৃদুল দাশগুপ্ত : তুমিও ভালো থেকো।
('মাসিক কবিতাপত্র-১৯' তম সংখ্যা, ১৫ জুন, ২০১৬ সংখ্যা থেকে 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'-এ সাক্ষাতকারটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন