শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট ।। রাজীব সিংহঃ মত্তনীল অন্ধকারে

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০


ধারাবাহিক পদ্য-নভেলেট

রাজীব সিংহ।। মত্তনীল অন্ধকারে



( গত সংখ্যার পর )

১৩. মনে কি পড়ে প্রিয়?


একটা গান তাকে ফিরে ফিরে তাড়া করে সারাটাদিন৷ পড়ন্ত গ্রীষ্মদুপুরে, বর্ষাদিনের বন্দি জানালায় বা ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে থাকা লেপের ভেতরের ওম সারা গায়ে মেখে নিতে নিতে ফিরে আসে সেই গান৷ দলবেঁধে ছুটে যাওয়া সমুদ্রবন্দরে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে সাজিয়ে রাখা ক্যানবিয়রের খোল অথবা সামুদ্রিক কাঁকড়ার অস্পষ্ট সিলুএটে তাকে ঘিরে রাখে সেই গান৷ ধীরে ধীরে গড়িয়ে যায় একটার পর একটা অলস দিন৷ অন্তর্বর্তী দিনসময়৷
ঘন সবুজ ঢাকা ক্ষেত্রফলের ভেতর দিয়ে ছুটে যায় সেই তেজী ঘোড়া৷ আস্তাবলের খিড়কি পেরিয়ে আসে রোদ৷ ঝলমলে দিন এসে ভুলিয়ে যাও মৃত্যুদিন৷ এক-একটা নারীলোক কিভাবে ছিটিয়ে দ্যায় সোহাগ৷ প্রশ্রয়ের পর প্রশ্রয় দিলে সে-তো উচ্ছন্নে যাবেই৷ তার নাম ধরে শিস্ দিয়ে ডেকে যায় কোনও এঞ্জিন৷ অচেনা স্টেশনে নিচু হয়ে থাকা রেলগুমটির ভেতর হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় মধ্যরাত৷ হাতে হাতে ঘুরে যায় চুল্লু আর জুয়ার ঠেক৷ বৃত্ত হয়ে আসা ধোঁয়াজালে হারিয়ে যায় খুব চেনা একটা মুখ৷ তার চশমার ঘষা-কাচে যে-পৌরুষ তা কামনা করে করে কেটে যায় আরও কিছু অলসদিন৷ চড়া আলোয় পেতে রাখা টেবিলে তাকে ঘিরে ফ্যালে অতিশয় শুভ্র কিছু নিষ্ঠুর অ্যাপ্রন৷ তার মাথার ভেতর অবিশ্রাম ক্ষরণ তখন৷ নীল ঠাণ্ডা ভয় এসে ভিজিয়ে দ্যায় স্নায়ুগুল্মজাল৷
নদীর কাছ থেকে বহুদিন তারা কেউ কেউ ফিরে গেছিলো মাছের বাজারে৷ চিরায়ত সভ্যতার গ্লানিমুক্ত বিস্তীর্ণ মাঠে৷ মুক্ত অর্থনীতির রসনাসিক্ত ম্যাটিনী শোয়ের ফ্রন্টস্টল বৃষ্টিতে৷ নদী তখন গা ধুচ্ছিল দুপুরের মেঘলা আলোয়৷ তারা প্রত্যেকেই লোলুপ বিভূতিভূষণ৷ পুরোপুরি প্রকৃতিমনস্ক৷ বাড়িতে দোর্দন্ডপ্রতাপ অথচ বন্ধুদের কাছে উদার গোস্বামীদা তখন জিভ বের করে রোদ চাটছিলো৷ পকেটভর্তি পয়সা৷ বাজারের গলি তস্য গলি থেকে শঁুটকিমাছ আর সবজির ভ্যাপসা গন্ধ৷ নদী তার অবিরল ধারার মধ্যে ভিজে যেতে দিচ্ছিল সবাইকে৷ অবাক ক’জন শুধু গেয়ে উঠেছিলো সানশাইন৷ সূর্যোদয়ের গান৷ তীব্র বজ্রপাতের মধ্যেও উদার সমাজমনস্করা তখন নদীর বুকে মুখ গঁুজে ঢেউ খঁুজেছিল৷ আর দুপুর তখন ক্রমশ গড়িয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারের দিকে৷ রোমকূপ ভীষণ তীব্রতায় আশ্রয় খঁুজেছিল যেন৷
তখন মন্দারমণি... তরঙ্গমালা গেস্ট হাউস... পায়ের পাতায় জোয়ারের জল... খলবল বুকে উঠে আসা জল... নদী...
গোস্বামীদাকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে সকলে৷ নতুন অর্থনীতির যূপকাষ্ঠে, বাজারের মাছে তাহাদের আসক্তি কম৷ তবু প্রকৃতিপ্রেমিক সকলেই ধরে নিচ্ছে এ সবই ডিজিটাল৷ একটু একটু ছেড়ে যেতে পারবে শ্রাবণ, তোমার খ্যাপামি৷

সকাল পেরিয়ে রাত৷ রাত পেরিয়ে সেই গান৷ সেই সুর৷ গ্রন্থিসময়ের জাল ছাড়াতে ছাড়াতে আরেকটা দিনের শুরু৷ হাঁটুজলে ডুবে থাকা শহর থেকে বড়ো বড়ো ক্যানভাসে ভ্যালেণ্টাইন-চিঠি এঁকে রাখে কেউ৷ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা সেই সকালের মধ্যে থেকে শ্বদন্ত বার করে হাসে ঝিমলিদি৷ স্বপ্নের দুপুরে স্বরলিপি জড়িয়ে উড়ে আসা ডেয়ারিমিল্ক ও দুর্ধর্ষ গোলাপ মনের গহীনে তোলে ঝংকার৷ তাদের সাধ-আহ্লাদ-বিবমিষা পেরিয়ে যায় সেই গান৷ গানের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুকাল আর কোনও প্রযত্ন মানে না এখন৷


১৪.So kiss me and smiles for me... 


তোমার কন্ঠস্বর কেঁপে যায় ফোনে, আচম্বিতে৷ আড়াআড়ি উঠে গ্যাছে দেয়াল অথচ স্বচ্ছ ফড়িঙেরা বিনবিন ওড়ে না কতোদিন এই আবোলতাবোলে৷ তীব্র হয়ে ওঠে দিন৷ অসহ্য গমন আরো নিরীহ হয়ে যায় মায়াবিরাত্রির টলোমলো অন্ধকারে৷
বুড়ো-র‍্যাঁবো স্টিয়ারিঙ আঁকড়ে ধরে আছে এতোদিন৷ আঁকড়ে বসে আছে হৃদযন্ত্র নির্বিকার দাড়িওলা মন্দিরের সেবাইত৷ ঘাটে থমকে আছে মথুরবাবুর সাজানো-বজরা৷ কুলুকুলু বয়ে যায় জল গঙ্গার আদিমক্যানেলে৷ একটি-দুটি কাগজের নৌকো ভেসে যায় দিকচক্রবালে৷ সবুজটিলার চেনা অশনিসংকেতে৷ এই ঘরের থেকে৷
সন্তর্পণে পা ফ্যালো...দূরে বৃষ্টি...যশোর রোড...৷ স্বগতবিষাদ এলো খামে ভরে নিরন্ন এই গ্রামদেশে৷ মুগ্দ চাতকের মতো আলপথে ধুলোপায়ে হেঁটেছিলে গান৷ পাতার মর্মর থেকে আকন্দ-ঝোপের ব্যস্তসমস্ত সব অপরাধ ম্লান হয়ে গ্যালো আত্মার অনির্ণেয় যোজনার অন্তহীন নিষেধে৷ সেই চৈত্রে৷ অথচ তোমার কন্ঠস্বর কেঁপে যায় ফোনে, আচম্বিতে৷ প্রত্যেকবার৷
সেগুলি গোপন-খাতায় লিপির ভাষায় আঁকা কিছুটা গুহাচিত্র আর বাকি সব হায়ারোগ্লিফিক্স৷ যেন আড়াআড়ি উঠে যাওয়া দেয়াল টপকে নগ্ণপায়ে শীতার্ত-স্পায়ের ভেতর৷ সাদাকালো অন্ধকার৷ আর সেলুনের রক্তাক্ত মেঝে থেকে উপত্যকার পাইনজঙ্গল থেকে আরো একবার অচেনা-নটীর দিকে চলে যাওয়া ধূসর-ফিটন খুলে দ্যাখে মায়াবিবোতল৷ গানেগানে রাত বাড়ে৷ টলোমলো সেই রাত৷ 
কোনো কাজ করা বারণ, ক্ষমা কোরো৷ যদি পারো সেই ভালো থাকার কথাও তুমি ছাড়া আর কাউকে বলবো না৷ পুরনো পোশাকের মতো ফিরে চলে যাক দিন৷ ফিরে চলে যাক এই মাতাল সমীরণ৷ খেজুর আর তালগাছে ঘেরা এই অন্ধকার, চাঁদ, আলো৷ পায়ের তলায় মাড়িয়ে যাচ্ছি পড়ে থাকা পলাশ, কৃষ্ণচূড়া৷ দমকা হাওয়ায় উড়ে যায় আঁচল৷ উড়ে যায় খোলামকুচির মতো দিন৷ অথচ নদীরাও কী ভীষণ নিভু নিভু৷ কিচ্ছু দ্যাখা যায় না৷ এলোমেলো পাণ্ডুলিপি আর গীতবিতান৷ চলো, ফিরে যাই, রাত অনেক৷ জোনাকিরা মশারি, বইয়ের তাক আর পিয়ানোর ওপর কী ভয়ানক আকুতিপরায়ণ৷ সমস্ত অলসতা ঘুমিয়ে পড়ক এখুনি৷
ইদানিং একটা দীর্ঘ চিঠি উদ্ধৃত করবার ইচ্ছে হয় কৃষ্ণেন্দুর৷


১৫. রাতজাগা বেলফুল, বুড়ো আবদুল, কুঠিবাড়ি আর প্রেতিনীর গান


রাত্রি ঘনালো যখন ভিজে ঘাস থেকে অবদমন আর অতৃপ্ত ইচ্ছেগুলো গড়িয়ে গেল চিরকালীন ফাঁকা যাত্রীবিহীন রেলস্টেশনে৷নিঝঝুম খালি ওয়াগনে কয়জন বন্ধুস্বজন শুধু আগুন জালিয়ে রেখেছিলে৷ধোঁয়া উড়ছে৷উড়ে যাচ্ছে তরুণ কবিতা-উচ্চারণ৷উড়ে যাচ্ছে কবিতার খাতা৷নীলাভ ডেস্কটপের স্ক্রিন জুড়ে কালো কালো অক্ষরমালা গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত৷গড়িয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতা দেড়শো বছর ধরে এই অক্লান্ত নির্জনতায়৷এই উপত্যকায় তখন শুধুই বৃষ্টিপতনের শব্দ৷কীভাবে করবে সেই পাঠগ্রহণ! কীভাবে বাঁচবে বলো আলো!
এ সেই লেখা যা তুমি লিখতে চাওনি চিঠির আকারে ! যেন বুড়ো আবদুল মাঝি বা কচ্ছপের ডিম... যেন রুদ্রপলাশ ড্রসেডা কুর্চি...কলমির রঙ...যেভাবে গঞ্জ থেকে হাট থেকে নগরীর তলপেট থেকে লিখিত বাংলাকবিতা , সেইসব যা তুমি লিখতে চাওনি--রাসায়নিকে বিষাক্ত টমেটো বা ফুলকপির মতোই মহাজাগতিক আভা নিয়ে এতোদিনে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবার বাসনায় সেইসব এই লেখার মধ্যে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে ! তুমি আর আবদুল চাষাদের পানীয় নিয়ে পদ্মার তীরে৷বেলা গড়িয়ে যায়৷গড়িয়ে যায় রোদ৷দূরে আকাশে দু’একটা শঙ্খচিল,বোটের ভেতর বাসমতীর সুঘ্রাণ আর সর্ষে-ইলিশের ঝাঁঝালো গন্ধ...৷কখনো বড়ো বড়ো জলভরা-মেঘ এসে ঢেকে দেয় রোদ৷আঙ্গুলের দশটি নখ ছিঁড়ে দিতে চায় অভিজাত পর্দা,অভিজাত ঝাড়লন্ঠন৷এই ব্যাপ্ত দুপুর জুড়ে ঝরে পড়ছে নৈঃশব্দ্য৷আর প্রিয় নারীটির নারীলোকটির হৃদয় ঠেঁট বা নাভির তলদেশের ক্ষত ভুলে একতারা বাজিয়ে গান গাইছে তোমার ভাসমান হৃদয়...যে গান তুমি লিখতে চাওনি--৷
বুড়ো আবদুল ঘুমোলে অল্প হাঁ হয়ে থাকে মুখ৷ দু’একটা মাছি মুখের ওপর ভনভন,আবদুল মাছিদের চোখের দিকে তাকায় না৷ তন্দ্রার ভেতর সে তলিয়ে যায় ধীরে ৷ আর তুমি অসম্ভব ছায়ায় ম্যাকবেথের পুরনো পৃষ্ঠাগুলো আঁকড়ে বসে থাকো আশ্চর্য প্রৌঢ় তরুণ ! শিলাইদহের ওই গা-ছমছমে পুকুরপাড়৷ভেজা কাপড়ে সলসলে নরম শীতল আলিঙ্গণ,নদীর মতো হালকা সারল্যে তোমার সমস্ত প্রতিভা গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিচ্ছে...৷ খুলে পড়ছে তোমার বাহারি শিফন, ছিঁড়ে যাচ্ছে অলঙ্কৃত মেরজাইয়ের উষ্ণ হলকা ৷ বাংলাকবিতা এই অসম্ভব বেতের প্রহার থেকে চারদিকের পরিত্রাণ থেকে নিঃসাড়ে গড়িয়ে যাবে দেড়শো বছর৷ আর তুমি দগ্ধ শিরায় উপশিরায় রক্তাক্ত শিলাইদহে আঁকড়ে ধরবে পুরনো ম্যাকবেথ বেঠোফেন বাখ অথবা গগন-লালনের গান ৷
তবু কিছু আলো আর ফড়িঙের ওড়াউড়ি৷নিভে যাওয়া মন জুড়ে অনাম্নী ফুলেদের তীব্র আকর্ষণ করাল বিদ্যুতের মতো প্রেতভাষায় ক্রমশ নির্ভার করে তোলে চতুর্দিক৷কাবার্ডে রাখা বেনারসীর জরি ছিঁড়ে ফালাফালা৷আর এই এতো রাতে ফিটনে চড়ে চারণ বেরিয়েছো পথে৷তোমার জামার লেসে ছড়িয়ে পড়ছে রাতজাগা বেলফুলের বাসি পাঁপড়ি৷ছড়িয়ে পড়ছে আতর৷ছড়িয়ে যাচ্ছে বাহ্মসময়৷ছড়িয়ে যাচ্ছে কুঠিবাড়ি৷ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রেতিনীর গান৷ছড়িয়ে যাচ্ছে মহাজাগতিক আলোর বিচ্ছুরণ শিলাইদহ থেকে শিলংপাহাড়ে...
অসম্ভবের দিনলিপি জুড়ে রোগাক্রান্ত নারীমন যে উপেক্ষার হাসি দিয়ে ভরে রেখেছিলো মধ্যাহ্ণ আকাশ,সামনে তার উপায়হীন শিকল৷তুমি তার নিভে-আসা আগুনের সন্ধান পেয়ে ছুটে চলেছো নির্বিকার৷গাছেরা দৌড়চ্ছে উর্ধমুখ আর সেই অসম্ভব দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত কোপাই খোয়াই দামোদর রূপনারায়ণ থেকে টেমসের দিকে৷চাষার কাদামাখা পা অথবা বোকাহৃদয়ের অনির্বাণ অমোঘ উত্তরীয় নিজের স্রোতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক-অতিমানবদের দিয়ে সেইসব গল্প লিখিয়ে নিচ্ছিলো তোমার কলমে...৷ অথচ তুমি ম্যাজিক জানোনা৷ জানোনা তাজমহল৷ জানোনা ফুলের প্রতিবাদ৷চিরশূন্যে কোথাও উড়ে গেলে সেই জীবন ও তার রূপক আকাশে বদলে যেতে থাকে রঙ৷বদলে যেতে থাকে কবিতার সংকেত৷বদলে যেতে থাকে পাখির গর্জন৷চিরায়ত শোকের আধার ৷ চূর্ণ-বিচূর্ণ শিল্পের জন্য শেষাবধি অনেক নদীর ঢেউ হয়ে আক্রোশের জ্যোৎস্না হয়ে পিয়ানোর কল্লোলিত রিড হয়ে ছুঁয়ে থাকে চোখের পাতায়৷আর তুমি ঘুম ভেঙে জানিলে এ জগৎ স্বপ্ন নয়...


১৬. নোনাঢেউ


মাথার ওপর ক্রমশ রোগা হয়ে গেছে আকাশ৷ দুইধার দিয়ে উঠে গেছে এবরো-খেবড়ো সব বাড়ি৷পুরনো দেয়ালে ঝরে-পড়া পলেস্তরা আর রঙচটা স্বপ্ণসমূহ৷ আমরা ন্যারেশন পছন্দ করি তাই সেই লোলগর্ভে পেতে দিই মাথা, এই রাতে পুরনো রাস্তায় নবীন দুইজন আমিষের খোঁজে নাকাল হলে রাতপাহারা দেওয়া মুহূর্তগুলি পুনরায় মাইক হাতে বসিয়ে দেয় তোমায়৷একটার পর একটা নাম ডেকে চলো তুমি৷ ষণ্ডামার্কা নাম থেকে নিরীহ নামগুলি আসে যায় আসে যায়৷ লেখা পড়ে, মুহূর্তে ফিরেও যায়...৷ যদিও কেউ ডাকেনা তোমার নাম, নিজের লেখা তোমাকে কেউ পড়তে বলে না৷তুমি এক জাদুমাইক হাতে ডেকে চলো একটার পর একটা নাম৷ শুনতে থাকো অন্যের লেখা, অন্যের আলো, অন্যের অন্ধকার, আর ফুরিয়ে আসে রাত৷
ঝিলপাড় বরাবর সারি সারি লাল নীল হলুদ সবুজ৷ স্কেচবুকে আঁকিবুকি৷ গান৷ গাছের গুঁড়িতে এলানো গিটার, রিনরিন শব্দে বাজে বুকপকেটের ফোনযন্ত্র, সমস্ত শরীর জবজবে ঘামে আরো বেশি দিকসচেতন করে তুললে গালের পাশে জমে ওঠে পড়ন্তবেলার রোদ্দুর৷ মাটিতে ছড়ানো পলাশ, থ্যাঁতলানো শিমুল... উল্টোদিকে মাটির গয়নায় সাজানো উদ্ধত গ্রীবা আর উন্মত্ত হৃদয়৷
সেইদিন, রাত্রি যখন ঘনালো নিবিড়, ছাদে, অন্ধকারে নির্বিকার তাকিয়েছিলে দূরে৷কাঁধ ছুঁইয়ে চৈত্রের উদাসী নিঃশ্বাস আর শেষরাতের হিম তবুও একলা করে তোলে তোমাকে৷ একলা তুমি৷ মনে মনে ফিরে যাও অচেনা শহরে, মুঠোয় বন্দি সেই অলীক মাইক্রোফোন ঝিলপাড়ে বাতাসে অল্প অল্প নড়তে থাকে হাওয়ানিশানের ধাতব ব্লেড়..৷ স্নায়ুর গভীরে পিছলে যায় আলো৷ নদীরা ঘুমোয় আর ভোরবেলার কুয়াশারা মশারির মতো আগলে রাখে তোমাকে, ক্রমশ তুমি বুড়িয়ে যেতে থাকো৷
এই উপত্যকায় তখন শুধুই বৃষ্টিপতনের শব্দ৷ কীভাবে করবে সেই পাঠগ্রহণ ! কীভাবে বাঁচবে বলো আলো ! তোমাকে কতোদিন বলা হয়নি এ কথাগুলি৷ বলা হয়নি শীতকাল আর শিরীষ-অর্জুনের কথা--! অথচ নদী ও পাখিদের দল প্রাচীন ফটোগ্রাফের মতো এই বন্দরশহরে আজো অপেক্ষমান৷


এতো কোলাহল চারিদিকে৷ শনিপুজোর উদ্দাম ঢাক, দড়ি দিয়ে বুকে ঝোলানো ঝুড়িতে ''বাদাম বাদাম--’’, এঁড়ের দালালের সাথে হাঘরে পথিকের নির্লজ্জ দরদাম, আসরের নিচু টুলে গড়িয়ে পড়া মাতাল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ঝকঝকে মঞ্চ, ট্যাবলোতে বুলাদি এবং মঞ্চে মাননীয় মশাই, কফিহাউসে চায়ের দোকানে ব্যতিক্রম আর আরো-ব্যতিক্রমের মৃদু হৈ চৈ, ফেসবুকে বইমেলা আসিতেছে, আসিতেছে কতো কতো নতুন প্রচ্ছদ, লাইক দিতে দিতে আর কমেন্ট লিখতে লিখতে যখন ক্লান্ত তুমি, এতশত শব্দের মাঝখান থেকে তখনি ফিরে এলো তোমার নিজের লেখা, তোমার ফেলে আসা শহরের কথা, বাইশে শ্রাবণ নামে নতুন আরেকটি সিনেমার কথা, সরকারি চাকরির বয়সের নতুন নিয়মের কথা, কলকাতা থেকে মুম্বইগামী যন্ত্র-শকটের কথা, ডাগরচোখ শমিতের একঝলক হাসির কথা, যাকে পাকিস্তানি বোলার শোয়েব আখতার বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়...
ডায়মণ্ডহারবারের বৃষ্টিভেজা নোনা রাস্তায় তুমি হাঁটছো, মগজে কখনো সুুমন কখনো সুুনীল কখনো সন্দীপন৷সঙ্গে হস্টেল থেকে বেরনো মেয়েটি, প্রাপ্ত সম্পর্কের বোঝা টেনে টেনে ক্লান্তপ্রায়৷ তুমি সিগারেট থেকে তখনও ঝরিয়ে ফেলছো তামাকের কুচি৷ একদিন ভেবে রেখেছো যাবে বিনয় মজুমদারের বাড়ি অথবা হস্টেলের মেয়েটিকে নিয়েই উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে বাদামপাহাড়ে৷


দু-ধারে চষা জমির আশ্চর্য কোমলতা৷ আলের পর আল সাবধানে হেঁটে যাওয়ার সময় কৃষ্ণেন্দু লক্ষ করেছিলো ‘হরর্-হট্-হট্’ কাদা-মাখা মোষের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে নরম কাদায় হাঁটু পর্যন্ত দেবে যাওয়া কৃষকের হলকর্ষণ৷ সেদিন ভারি হয়ে এসেছিলো মেঘলা দিগন্ত৷ কা-কা চিলচিৎকারে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গিয়েছিলো অতগুলো কাক৷ নদীর সীমান্তে নির্মীয়মান সুকলবাড়ির অফিসঘরে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি, ক্লাশ ফোর পাস, পার্টিক্যাডার স্কুল সেক্রেটারি দেশলাইকাঠি দিয়ে দাঁতের ফাঁকে আটকে যাওয়া সুপারি খোঁচাতে খোঁচাতে তাকে চোখ রাঙিয়েছিলো৷ অর্ধেক দেয়াল গাঁথা ক্লাশঘর দেখিয়ে দাবি করেছিলো ছাদের খরচ৷
অথচ তখনও তিনশো তেত্রিশ কিলোমিটার দূরে তার বন্ধুরা হলুদ বোতলের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পুরনো তর্কে আরও একটা দশক পার করে দ্যায় লুকনো ব্যর্থতায়৷ কফির টেবিল থেকে উদ্বায়ী যুবকেরা ভেসে উড়ে যেতে চায় কোনও দূর দিকচক্রবালে৷ আর ভূতগ্রস্ত কৃষ্ণেন্দু দূরবর্তী কোনও ধূসর গ্রহের বুকে দাঁড়িয়ে থাকে একা৷
ফ্ল্যাশব্যাকে ঔপন্যাসিক চশমা খুলে এইমাত্র টেবিলে রাখছেন৷ তাঁর ভাসা-ভাসা আয়ত চোখদুটোর ওপার থেকে উপচে গড়িয়ে নামে নোনাঢেউ৷ ভাঙা চোয়ালের দাড়িগুলো কুঁকড়ে ওঠে ঠাণ্ডায়৷ একটানা সিটি দিতে দিতে পেটভর্তি বাষ্প নিয়ে গুমরোতে থাকে একলা প্রেসার কুকার৷


১৭. ইতি কৃষ্ণেন্দু


...এখানে নিজের মতো আছি আমি৷ বনবিভাগের সারসার সরলবর্গীয় অরণ্যের মধ্যে দিয়ে দূরে ছুটে গেছে রেলপথ৷ যতোদূর চোখ যায় ছড়ানো সবুজ জমি ও বিক্ষিপ্ত জঙ্গলের মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ এক একটা গ্রাম৷ কুড়িটা-পঁচিশটা বাড়ি নিয়ে৷ ছোটো ছোটো তালবন, পুকুর আর ঘন বাঁশবনের মধ্যে কোনও মতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামগুলি৷ একমাত্র দূরের স্টেশনেই দুটো পাকাঘর৷ তা-ও ব্রিটিশ পিরিয়ডের ৷ লাল রঙা৷ একটা স্টেশন মাস্টারের, অন্যটা স্টোর কাম টিকিট কাউণ্টার৷ নামফলকে লেখা--- ‘দিস ইজ দ্য লাস্ট স্টেশন অব ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন’৷ অনুমানে বুঝি এই সীমান্ত রেলওয়ে স্টেশনটির পত্তন ইংরেজদের হাতেই৷ ইস্পাতের সরীসৃপের মতো রেলপথ চলে গেছে জঙ্গল পেরিয়ে সোজা ওপারে, বাংলাদেশে৷
সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে এইখানে৷ স্টেশনের পাশেই একটা স্কুলবাড়ি৷ তার পাশেই ধুলো-ওড়া লম্বা ন্যাড়া মাঠ৷ এই মাঠেই বসে হাট৷ চাল, গম, সবজি, গামছা, লুঙ্গি, সস্তার শাড়ি থেকে খুকুমণি আলতা, চিরুণি, পাউডার, ক্রিম সবই পাওয়া যায় হাটে৷ গবাদি পশুও কেনা-বেচা হয় এখানে৷ নদীর ওপারের বাংলাদেশের অনেকেই হাটে আসে দোকান দিতে অথবা জিনিস কিনতে৷ একটা হাট-কমিটি আছে৷ সেখানে গ্রামের মুরুবিব-মাতববরদের ভিড়৷ তারা মোটা টাকা আদায় করে বাংলাদেশি দোকানদারদের কাছ থেকে৷ এখানে ইন্ডিয়ান কারেন্সি ও বাংলাদেশি টাকা দুই-ই দেদারে চলে৷ আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করি ওদের, ওপার বাংলাদেশের মানুষদের৷ কেমন যেন সদাসন্ত্রস্ত ওরা৷ শুনেছি যে-কোনও সময়েই বিডিআর বা বিএসএফের হাতে ধরা পড়বার ভয়ে এভাবে গুটিয়ে থাকে ওরা৷
তোমার কথা, কলেজের কথা, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঝিলপার ধরে আমাদের হেঁটে চলা মনে পড়ে খুব৷ মেকানিকালের হাওয়াকলের তলায় উজ্জ্বল দুপুরগুলোয় কোঁচড়ভর্তি কৃষ্ণচূড়া নিয়ে তোমার বসে থাকা, কোণের লবিতে বসে গুনগুন, হঠাৎ গেয়ে ওঠা তোমার রবিঠাকুর, আমার হঠকারী আবেগে হঠাৎ রাগিয়ে দেওয়া তোমার কান্নাভেজা মুখ, চোখ আর ঠোঁট সমস্তই মনে পড়ে আমার৷ কলেজ ইলেকশনের আগে ছোট্ট মিছিল নিয়ে তোমাদের নিঃশব্দে ক্যাণ্টিনে ঢোকা, দলীয় র‍্যাগিংয়ে আক্রান্ত তোমাদের হস্টেলের মেয়েটি--- চুপচাপ ওড়নায় ফাঁস বেঁধে ঝুলে পড়া সিলিং--- এ সবই সীমান্তের আরও ঘন অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে আক্রান্ত করে যায় আমাকে৷ রেলপথের ধার দিয়ে সীমান্তের দিকে প্রতিদিনই টহল দিয়ে যায় একের পর এক মিলিটারি লরি৷
আমার সব কথাই তো ইদানিং তোমার অসংলগ্ণ মনে হয়৷ হয়তো-বা দুর্বোধ্যও৷ ইস্ তোমার এই অভিযোগ থেকে যদি মুক্তি পেতাম কখনও! এখনও মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে শেষট্রেনে দলবেঁধে সমুদ্রবন্দরে ছুটে যেতে চায় মন৷ এক বিস্তীর্ণ রেডিয়াস জুড়ে নড়ে ওঠা মিছিলের গমগমে বৃন্দগান সোহাগ করতে শিখিয়েছিলো আমাদের৷ পার্কের মাটি ফোঁপরা করে দিয়েছে যে ইঁদুরের দল, আগন্তুকেরা তাদের চারিদিকে ভিড় করে খাবার ছুঁড়ে ছুঁড়ে দ্যায়৷ চিড়িয়াখানায় শিম্পাঞ্জীকে পোট্যাটো চিপস, পাউরুটি, কলা অথবা বিসুকট ছুঁড়ে দেওয়ার মতো৷ আর আমরা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্ব লাফিয়ে লাফিয়ে ক্যাচ প্র্যাকটিস করি শুধু৷...


১৮. সাইকো--- পার্ট ওয়ান, পার্ট টু, পার্ট থ্রি


যারা বছরের পর বছর গভীর ঘুমের মধ্যে থেকে আর্তনাদ করে ওঠে, খাঁচায় বন্দি পাখিদের জন্য আশ্চর্য তাদের কোনও মমতা ঝরে পড়ে না৷ ক্যাম্পফায়ার সাজিয়ে প্রচণ্ড শীতে টলমল যে-যুবকের দল নেচে ওঠে গেয়ে ওঠে ধ্বংসের গান কৃষ্ণেন্দু দূর থেকে অপলক চেয়ে থাকে তাদের দিকে৷ নেশায় আচ্ছন্ন কবির জন্য একটি পংক্তি রচনা করে তাকে কাঁদিয়ে তুলেছিলো ও৷ কোনো নির্দিষ্ট কাজলকালো চোখের মায়ায় বিমোহিত না হয়েও ও পড়তে চেয়েছিলো কবিতার প্রথম পাঠ৷ অথচ চাঁদ দেখে ওর কেমন ঘোর লেগে যায়৷ কেমন অবসন্ন হয়ে যায় ও৷ ঝিমঝিম করে মাথা৷ বৃত্ত ঘুরে ঘুরে চন্দ্রছটা ছায়া ফ্যালে মাটির উপর৷ মাথার ওপর ছড়িয়ে থাকা উপগ্রহজালে বন্দি হয় আকাশের মেঘ৷ পায়ের পাতার তলে সিরসির কিলবিল করে ওঠে ট্রামের লাইন৷
কৃষ্ণেন্দুর বন্ধু যেদিন ঔপন্যাসিকের বাড়ি থেকে রাত্রে ফিরে এলো না, তার কিছুদিন পর পূজাবার্ষিকী বেস্টসেলারে ফুলপেজ ইলাস্ট্রেশনে সেজে প্রকাশিত হলো ঔপন্যাসিকের নতুন উপন্যাস৷ ‘তাহলে তো তোমরা মিথ্যা হয়ে যাও’--- ঔপন্যাসিকের এই আশঙ্কা আর পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত উপন্যাস কোথায় গিয়ে যেন একই সুরে কথা বলে৷ তোমাদের জীবনের যাবতীয় ক্ষত, যাপনের আলো ও অন্ধকার এক আশ্চর্য দক্ষতায় ঔপন্যাসিকের লেখায় প্রকাশিত৷ অনেক না-বলা, অনুচ্চারিত ব্যক্তিগত আর ব্যক্তিগত থাকে না তখন আর!
ভোরবেলার ভিক্টোরিয়ায় হঠাৎ একদিন বন্ধুর হাত ধরে পৌঁছে যায় কৃষ্ণেন্দু৷ ময়দান গাঢ় কুয়াশায় ঢেকে আছে৷ ইতঃস্তত ছড়িয়ে আছে পর্ণমোচী ঝরাপাতারা৷ সবুজ ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির৷ দূরের রেডরোড দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুটো গাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে৷ এই ভোরবেলায় নরম সোনালি আলোয় ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় ধীর লয়ে ঘুরে চলেছে অ্যাঞ্জেল অব ভিক্ট্রি, সেই ফ্লুট নিয়ে ঘুরে চলা পরী, কৃষ্টি সুবিচার আর মহানুভবতার বার্তা নিয়ে৷ ক্যানভাসে জমে যাওয়া রঙের মতো স্থির পড়ে আছে মেমোরিয়ালের পেছনের বাঁধানো পুকুর৷ স্বাস্থ্যসন্ধানী স্বাস্থ্যবান মর্নিং ওয়াকাররা কেউ কেউ চেনে বাঁধা সারমেয় নিয়ে ওই সকালবেলাতেই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছেন৷ পুকুরের পাড়ের বেঞ্চে এই সকালও তখন আবেগ-সঘন৷ বাসিমুখ তোলে কেউ সঙ্গিনীর ঠোঁটের উপর৷ গা গুলিয়ে ওঠে কৃষ্ণেন্দুর৷ অসহ্য বমি পায়৷ আস্থার নরম প্রলেপ মাখিয়ে ‘কি হয়েছে’ দৃষ্টি নিয়ে অলক্ষ্যে তাকিয়ে থাকেন ঔপন্যাসিক৷ 
এখন মাঝরাতে বৃষ্টিপতনের শব্দ হয় মাথার গভীরে৷ ভোঁ-ভোঁ করে ওঠে কান৷ এই অসহ্য চরাচর জুড়ে খিলখিল শব্দে হেসে ওঠে স্বপ্নের মিথ্যেরা৷ বুকের ভেতরে এক পুরনো অসহ্য ব্যথা প্রচণ্ড যন্ত্রণায় টনটন করে ওঠে৷ দুইচোখের মাঝখানে জমে ওঠে রক্ত৷ আগ্রার রাস্তায় তখন রুটমার্চ, এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উড়ে যায় গোলাপায়রার দল৷
দূর কুয়াশার ভেতর পড়ে থাকে পাখির ছিন্ন-রোম, বাসি পালক৷ নরম ঘাসের বুকে শুয়ে থেকে আবহমান ক্লান্তি আর মৃত্যুর যৌথ রেখাচিত্রে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে না-লেখা উপন্যাসের বিবর্ণ পাণ্ডুলিপি৷ মাঠে-ঘাটে একা একা ফিরে মরেন আজকের উপন্যাস-লেখক৷ নগরীর বিস্তীর্ণ বাস্তবে একে একে ভেসে ওঠে চরিত্রেরা৷ তাদের মুদ্রাদোষ, লোভ, কামনা আর ভয়৷ তাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা আর দাম্পত্যের গোলোকধাঁধা৷ এক অলীক ছায়াপথ আর মায়াবি সভ্যতার নীতিনিষ্ঠ নিয়মপ্রণালী৷ শরীরে অপ্রকট শরীর আর অমলিন যৌনইচ্ছের বেদনাবিধুর অ্যালবাম৷ সবই ভিড় করে অন্তর্বাস-ছেঁড়া এক দ্রুতগামী মত্ততায়৷ বন্ধুর বিছানায় প্রেমিকার গোপন অন্ধকার৷ এক দীর্ঘতম স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন যেমন অন্তর্গত, সে রকমই৷ কৃষ্ণেন্দু আবারও অনুভব করে, ভয়-বাসনা-পাপবোধ থেকে কেউ মুক্ত নয়৷
প্রিয়তম বন্ধুর জন্য মনখারাপ করে কৃষ্ণেন্দুর৷ কষ্ট হয়৷ কষ্ট হয় ঔপন্যাসিকের জন্য৷ লিপস্টিকে রাঙানো লালঠোঁট বন্ধুর প্রেমিকার জন্য তার কষ্ট হয়৷ কষ্ট হয় মায়ের জন্যও৷ মায়ের বিবর্ণ কুঞ্চিত স্তনের ওপর হামলে পড়েছে একদল চতুষ্পদ৷ হাঁপিয়ে উঠেছে মা৷ জিভ বেরিয়ে পড়েছে৷ ক্রমশ সরু আর লম্বা হয়ে গিয়েছে মুখাবয়ব৷ চেরা ঠোঁট থেকে ঝিলিক দিচ্ছে শ্বদন্ত৷ মুখময় লালাস্রাব গড়িয়ে পড়ছে৷ মেঘ সরে গেলে, চাঁদের পূর্ণ অবয়ব স্পষ্ট হলে, আকাশের দিকে মুখ তুলে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে জান্তব আর্তনাদ করে ওঠে মা৷ সমস্ত চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে যায় সেই অপার্থিব হাহাকার৷ 

(এরপর আগামী সংখ্যায় ) 

'মত্তনীল অন্ধকারে', আগের পর্বগুলি পড়ুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন