শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

কথোপকথনঃ শংকর চক্রবর্তী

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৪।। ২৯ আগষ্ট, ২০২০



কথোপকথনঃ শংকর চক্রবর্তী



জন্ম: ২৪ সেপ্ঢেম্বর ১৯৪৬, ঢাকা
প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ: এক আকাশে, ১৯৭৫
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা: ২০
শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ফেলে আসা আধকাপ চা, ২০১৭
প্রাপ্ত পুরস্কার / সম্মান : ত্রিবৃত্ত পুরস্কার, অবনি সাহিত্য পুরস্কার (টাংগাইল, বাংলাদেশ) রূপসী বাংলা পুরস্কার ইত্যাদি৷ অতি সম্প্রতি কবিতা আশ্রম পুরস্কার৷ 
রাজীব সিংহ-র লিখিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শংকর চক্রবর্তী।


প্রশ্ণ: গত শতাব্দীর ৫-এর দশকের শেষ থেকে বলা ভালো ৬-এর দশক জুড়ে সারা বিশ্বে পুরোনো মূল্যবোধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, আধিপত্যবাদ, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবসমাজ৷ এই সময়ে এসে আপনার কবিতার লেখার শুরু৷ এই ঝড়ো সময় আপনাকে, আপনার কবিতাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?


ছয়ের দশকের প্রথমদিকে, আমি তখন সদ্য কলেজে--- দু-দু’টো যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করি তখন৷ যদিও ওই সময়েই, হয়তো একটু আগে-পরে, নানা আন্দোলনে শামিল হতে অন্তত একবার মিছিলে পা মেলাননি এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা খুবই নগণ্য৷ সে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই হোক বা যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন৷ সরাসরি সেইসব কবিতায় ঢুকে না পড়লেও কবিতা তখন ভিতরে ভিতরে ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করেছে৷


প্রশ্ণ:একদিকে ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ, অন্যদিকে ভাঙনমুখী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবির--- এক দিকের স্বপ্ণভঙ্গের হতাশা--- এই পরস্পর বিরোধিতা সেইসময় আমাদের দেশেও আছড়ে পড়েছিল৷ আপনার নিজের কবিতায়, আপনাদের সময়ের অন্যদের কবিতায় এই ঝড়ো দিনগুলির কোনো ক্ষত কি আদৌ লক্ষ করা যায়?


ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ যতটা আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল, তখনকার অন্য ঘটনাগুলি ততটা প্রভাব ফেলেনি কারণ কোনো কিছুর সেভাবে গভীরে ঢুকে বিশ্লেষণ করতে শিখিনি তখন৷ তবে ছোটোবেলায়, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলাম তা আমার মধ্যে খুবই প্রভাব ফেলেছিল৷ প্রথম প্রথম মানুষে মানুষে বিভেদের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারার যাবতীয় কষ্ট নীরবে কবিতায় ঢেলেছি একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে৷ এখানে বলে রাখা ভালো, এই বিভেদ কিন্তু পরবর্তী সময়েও আমার পেছন ছাড়েনি৷ প্রায় ত্রিশ বছর চাকরি সূত্রে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকাকালীন নিজেও এই বিভেদের শিকার হয়েছি বহুবার৷ তবে তখন মানুষকে বুঝিয়ে, নানাভাবে, নানা মাধ্যমে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেবার ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছিলাম৷ তো সেই সময় থেকেই মানুষ বা প্রকৃতি আমার কবিতার বিষয় হয়ে উঠতে শুরু করল৷ 


প্রশ্ণ: তখন আদর্শ হিসেবে কাকে মেনে নিচ্ছেন? আপনার প্রিয় কবি কে?


একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি৷ সত্তরের শেষ দিকে যখন সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জাতি-বিদ্বেষে উত্তাল হয়ে উঠল, যখন শিলং-এ দিনের পর দিন কার্ফুর মধ্যে দিন কাটাতাম, তখনই ওখানকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষক, বাঙালি-অসমিয়া-খাসিদের বিভিন্ন সাংসৃকতিক সংস্থা ও অন্যান্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রতিনিধি নিয়ে ‘ফরিয়াদ’ নামে একটি সাম্প্রদায়িক বিরোধী ফোরাম তৈরি করলাম৷ সেই সংস্থার তরফ থেকে একটি প্রবন্ধ ও কবিতার সংকলন তৈরির কাজে একবার কলকাতা এসেছিলাম৷ কলকাতায় এসে একদিন আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়ে এক প্রখ্যাত সাহিত্যিকের কাছে সম্প্রীতির বাণী-ছোঁয়া একটি গদ্য চাইতেই তিনি মশকরা করে আমায় বলেছিলেন, ‘আপনাদের খুব মারছে না? মেরে কেটে লাশ ফেলে দিচ্ছে শুনলাম’৷ এই ভাষা তাঁর মুখ থেকে শুনে আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম সেদিন৷ ওঁর ঘর ছেড়ে তৎক্ষাণাৎ বেরিয়ে আসি৷ আর কখনো তাঁর মুখোমুখি হইনি৷ অথচ শিলং থাকাকালীন সেইসময় সুনীলদা ও শঙ্খদা উদ্বিগ্ণ হয়ে চিঠি লিখতেন প্রায়ই৷ তো আদর্শ হিসেবে বাছতে গিয়ে একজন কবি বা লেখকের জীবনযাত্রা, তাঁর সততা ও সুচিন্তিত ভাবনাই সর্বাগ্রে আমায় প্রভাবিত করে৷ তাই এখনও শঙ্খ ঘোষ,নিঃসন্দেহে৷


প্রশ্ণ: কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ কি আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? কবিতার শরীর অর্থাৎ ফর্ম আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? 


এই প্রশ্ণের দু’টি উত্তর হয়৷ প্রথম প্রশ্ণের উত্তরে জানাই-- ছাত্রাবস্থা থেকে আই-পি-টি-এ, গণনাট্য বা বাম রাজনীতির প্রতি পক্ষপাত ছিল৷ নির্দিষ্ট কোনো দলীয় সংগঠনের প্রতি নয়৷ তখন বিশ্বের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকরাই বাম-চিন্তাধারার প্রতি আস্থা রাখতেন৷ এখন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলির ভোটকেন্দ্রিক দিশাহীন অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হয়৷
দ্বিতীয় প্রশ্ণের উত্তরে বলি, কবিতার শরীর বা আঙ্গিকেরও গুরুত্ব কম নয়৷ তবে তা কখনো আরোপিত হলে মুশকিল৷ এত বছর লেখালেখির পর এইসব নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালোই লাগে, তবে,সবার আগে সেটা ভালো কবিতা হয়ে উঠল কি না সেটাই বিবেচ্য৷


প্রশ্ণ: আপনার কবিতায় চিরায়ত রোমান্টিকতার বদলে অত্যন্ত উদাসীন মেধাবী এক সত্তা লক্ষ করা যায়৷ যা অত্যন্ত অনুভূতিসম্পন্ন ও সারাক্ষণ ক্রিয়াশীল৷ দেশি-বিদেশি নানা তত্ত্ব, পুরাণ ও সমাজচিন্তা আপনার কবিতার উপাদান৷ প্রচলিত জনপ্রিয় ভঙ্গির বিপ্রতীপে আপনার সামগ্রিক উচ্চারণ কেন?


কী বলব বুঝতে পারছি না৷ সত্তরের আগেই রোমান্টিক আবহে আমার লেখা শুরু৷ ‘টুকুন’ সিরিজের কবিতাগুলিই তার প্রকৃত উদাহরণ৷ তবে কলকাতা থেকে শেকড় উপড়ে মেঘালয়ে নির্বাসিত হওয়ার পর, প্রকৃতি ও বিভিন্ন জাতি-উপজাতিদের জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি, তাদের প্রেম ও প্রেমহীনতার বিষয়ই আমার কবিতায় ঢুকে গেল অগোচরে৷ আসলে আমার ব্যক্তিজীবনের নানা অভিজ্ঞতাই কবিতার বিভিন্ন স্তরের দিকে এগিয়ে নিয়েছে৷ এই সুযোগে অভিজ্ঞতার কথা একটু জানিয়ে রাখি৷ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় অফিসের কাজে ত্রিপুরার তেলিয়ামুড়ায় সাময়িকভাবে তৈরি সামরিক বাহিনীর এক বিশাল ক্যান্টনমেন্টে আমাকে আর সঙ্গে অফিস-গাড়ির ড্রাইভারকে একমাত্র অসামরিক মানুষ হিসেবে প্রায় একমাস কাটাতে হয়েছিল৷ সে এক বিরল অভিজ্ঞতা৷ রাতের অন্ধকারে প্রায় পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান যখন অতর্কিতে আক্রমণ করে উড়ে যেত, তখন ওই যুদ্ধ-সন্ত্রস্ত পরিবেশে আমি এক ঢাল-তরোয়ালহীন ভ্যাবলা অন্ধকার তাঁবুতে একা বসে কীভাবে কাটিয়েছি--- সেসবই ছিল আমার পরবর্তী সময়ের মূলধন৷ তো অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই নানা তত্ত্ব ও সমাজচিন্তা আমাকে উসকে দিত৷


প্রশ্ণ: কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলন আপনাকে কখনো আকৃষ্ট করেছিল? অনুজ কবি হিসেবে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?


এই ধরনের আন্দোলন একেক সময় শিরোনামে এসে পড়ে তা স্তিমিত হতে দেখি৷ তবে গোড়ায় হাংরি আন্দোলনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা-বই খুঁজে সংগ্রহ করে পড়তাম নিয়মিত৷ বলতে দ্বিধা নেই, উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম তখন৷ পরে আমাকে তেমনভাবে টানেনি৷ সত্তরের মাঝামাঝি চাকরি সূত্রে সামান্য সময় পাটনা থাকাকালীন সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে নিয়মিত এ নিয়ে তর্ক করেছি৷ সমীরদা একদিন মলয় রায়চৌধুরীকেও নিয়ে আসেন৷ মলয়দার একটা ইন্টারভিউ ছেপেছিলাম সেই ’৭৫ সালে আমার কাগজের একটি সংখ্যায়৷ আর মাসিক কৃত্তিবাস বেরোবার সময় শিলং থেকে প্রায়ই ছুটি নিয়ে অক্রুর দত্ত লেনের অফিসে গিয়ে নানা কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতাম৷ আমার বন্ধু শ্যামলকান্তি দাশ, দেবাশিস বসু কৃত্তিবাস-এ কাজ করত তখন৷ সন্ধ্যের দিকে আড্ডা হত নিয়মিত৷ শিলং-এ আমাকে লেখা সুনীলদা ও শক্তিদার অনেক চিঠিতেই কৃত্তিবাস-এর প্রসঙ্গ থাকত৷ নানা পরিকল্পনার কথাও৷


প্রশ্ণ: লিট্ল ম্যাগাজিন, বিগ ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান--- প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সম্পর্কে আপনার মত কী?


দেখ, সত্তরের একেবারে প্রথম দিকে শিলং থেকে আমার সম্পাদনায় শতাব্দী বেরোতে শুরু করে৷ একটি লিট্ল ম্যাগাজিনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট-বৈষম্য-অপমান সবই সহ্য করার মতন ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে তখন৷ পরে আশির দশকের মাঝামাঝি যখন শিলং-এর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকা উমিয়াম সম্পাদনা শুরু করি, তখনও একই অভিজ্ঞতায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছি৷ আসলে, আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়ে হইচই করিনি কখনো৷ কারণ দু’জায়গায় লেখার গুণগত মানের পার্থক্য বুঝিনি৷ আমি সত্তরের দশকে যেমন অসংখ্য লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছি, তেমনি দেশ পত্রিকাতেও নিয়মিত৷ আমরা যে এখন কবি সম্মেলন পত্রিকাটি মাসে মাসে বের করি, সেটাও নাকি প্রতিষ্ঠান! অনেকেই বলেন, আবার হাসিও পায়৷ দু-চারজনের সম্মিলিত চেষ্টায়, পকেটের পয়সা ঢেলে ঘরের খেয়ে সাজানো প্রতিষ্ঠান! এই প্রতিষ্ঠান অবশ্য লেখককে আর্থিক সম্মানমূল্য দিতেও অপারগ৷


প্রশ্ণ: আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের প্রেক্ষিতটি কি?


অকালপ্রয়াত আমার কবিবন্ধু সোমনাথ মুখোপাধ্যায় আমার সঙ্গে সুকলে পড়ত৷ শিলং থেকে প্রায়ই ছুটি নিয়ে চলে আসতাম কলকাতায়৷ এসে আড্ডার টানে অক্রুর দত্ত লেনের কৃত্তিবাস মাসিক পত্রিকার অফিসে ছুটে যেতাম৷ সোমনাথের অফিস ছিল ‘হিন্দ’ সিনেমার পাশে৷ প্রায়ই ওর অফিস থেকে বেরিয়ে একসঙ্গে ‘কৃত্তিবাস’-এ ঢুকতাম৷ সেখানেই একদিন সোমনাথ আমাদের দু-জনের কবিতা নিয়ে একটি বই বের করার প্রস্তাব দেয়৷ সেটা ছিল ১৯৭৫৷ আমি রাজি হই৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটির নাম রাখলেন এক আকাশে, আমায় এলোমেলো পান্ডুলিপি থেকে কবিতা নির্বাচিত করে দিয়েছিলেন সুনীলদা৷ তারপর সব কিছু সোমনাথের হাতে জমা দিয়ে শিলং ফিরে যাই৷ কিছুদিন পর, বন্ধুদের চিঠিতে বই-একাশের খবর পাই৷ তখনও দেখিনি, ইতিমধ্যে প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় বইটির আলোচনাও করেছেন দেশ-এ--- তাও শিলং-এ বসেই পড়েছি৷ তারও অনেক পরে কলকাতায় গিয়ে বইটির কয়েকটি কপি সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম সোমনাথের কাছ থেকে৷ এই সেদিন বইপত্র গোছাতে গিয়ে মলাট-ছেঁড়া একটি কপি উদ্ধার করতে পারি৷ 


প্রশ্ণ: ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার--- আপনি স্বীকার করেন?


অস্বীকার করার উপায় নেই৷ তবে ভিন্ন প্রেক্ষিতে, এই সব এড়িয়েও বহু উল্লেখযোগ্য কীর্তির উদাহরণ আছে৷


প্রশ্ণ: সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সরকারি পুরস্কার নিয়ে একই বিতর্ক আছে৷ এই নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগও সর্বজনবিদিত৷ এ বিষয়ে আপনার মত কী?


এটা চিরকালীন সমস্যা৷ খুব কম প্রাপ্য পুরস্কারই বিতর্কের বাইরে থাকতে পেরেছে৷ তবে এও ঠিক কোনো পক্ষকেই সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়৷ তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত যেকোনো পুরস্কারই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা-মুক্ত থাকা প্রয়োজন৷ অবশ্য যদি সেখানে প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তিরা বিচারকমণ্ডলীতে না থাকেন৷


প্রশ্ণ: বাংলা কবিতার কলকাতা-কেন্দ্রিকতার অভিযোগ নিয়ে আপনার অভিমত কী?


এই অভিযোগ আমারও ছিল যখন ত্রিশ বছর কলকাতার বাইরে, উত্তর পূর্বাঞ্চলে ছিলাম৷ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেসব কবিরা থাকেন, তাঁদের এই অভিমান খুব একটা অমূলক নয়৷ তবে সত্তরের দশকে কিন্তু বাইরে থেকেই কলকাতাকে ঘিরে ধরেছিল বাংলা কবিতা৷ শিলচর-শিলং-জামশেদপুর-মেদিনীপুর-রানাঘাট- কৃষ্ণনগর-শ্রীরামপুর--- বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতায় স্পর্ধা দেখিয়েছে তখন তরুণ কবিরা৷ এই প্রসঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একবার আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্যামল, কমল ও আমার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন৷ তবে আসাম ও ত্রিপুরার কবিদের এই সংগত অভিমান দূর করার জন্য কবি সম্মেলন পত্রিকার তরফ থেকে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷


প্রশ্ণ: অনেকেই দাবি করেন গত শতাব্দীর সাতের দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায় মৌলিক চিন্তার অভাব৷ আপনি কী বলেন?


এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে সত্তরের দশকে বাংলা কবিতায় এক নতুন প্রাণের সংযোজন হয়৷ এবং এরপর থেকে ওই প্রচলিত তৈরি পথেই বাংলা কবিতা এগোয় কয়েক দশক৷ তবে এই মুহূর্তে, সামান্য হলেও বাংলা কবিতায় বিদ্যুৎচমকের মতো নতুন কাব্যভাষায় লেখার চেষ্টা লক্ষ করছি--- যা
নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক৷ তবে তার উত্তরণ কোনো সঠিক পথে এগোয় কি না সেটাই দেখার বিষয়৷


প্রশ্ণ: এতটা পথ পেরিয়ে অনুজ কবিদের প্রতি কোনো বিশেষ পরামর্শ?


অনুজ কবিদের পরামর্শ দেওয়ার মতো স্পর্ধা আমার নেই৷ তবে ইদানীং আমাদের দপ্তরে ভিড়-করে-আসা কবি-যশঃপ্রার্থীদের প্রায়ই নিয়ম করে অগ্রজ কবিদের কবিতা পড়তে বলি৷ কবিতা পড়ার কোনো বিকল্প নেই৷ এভাবে একজন নবীন কবির বিশ্বস্ত জ্ঞানও তৈরি হয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস৷ দুঃখের সঙ্গে জানাই, আলোচনায় বুঝতে পারি, অনেকেরই কবিতা-পাঠের অভিজ্ঞতা কম৷


প্রশ্ণ: কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা না গদ্য আজকের তরুণতমদের কবিতায় কীসের প্রভাব স্পষ্ট বলে আপনি মনে করেন? 


কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবনানন্দের গদ্যের প্রভাবই লক্ষ করি, যা আমার বেশ ভালোই লাগে৷


প্রশ্ণ: পরবর্তী-প্রজন্মের কবিদের কাছে কী আশা করেন? 


ওদের হাতে বাংলা কবিতা আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক--- এই আশা করি৷ 

('মাসিক কবিতাপত্র', বইমেলা ২০১৮ সংখ্যা থেকে 'সাপ্তাহিক অনলাইন মাসিক কবিতাপত্র'-এ সাক্ষাতকারটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।) 

আরও পড়ুন কথোপকথনঃ গৌতম চৌধুরী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন