রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

তুষার পণ্ডিত ।। হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রতিরোধের গাণ্ডীব

মাসিক কবিতাপত্র সাপ্তাহিক অনলাইন ।। সংখ্যা ৫।। ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ 




তুষার পণ্ডিত ।। হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রতিরোধের গাণ্ডীব


'ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে ' - 

এইসব অনিন্দ্যসুন্দর ধ্বনির মায়াবী আলোয় সেদিন কেঁপে কেঁপে উঠেছে যৌবনের দিনরাতগুলি। তাঁর কবিতার শক্তি এমনি আবেগময়, সুপ্ত যৌনকাতর। আনন্দ আর বিষাদের যুগলবন্দিতে এমন চোরাটান আগে টের পাইনি কখনো। না, চন্দনের বনে নয়, তাঁর সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি ভুবনডাঙার মাঠে। তাঁর 'একা এবং কয়েকজন' বাড়িতে। এই তিনিই তো নবীন কিশোরের হাতে স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছেন ভুবনডাঙার খোলা মাঠ, তাঁর যা কিছু সম্বল। সুতরাং সেই মাঠে প্রবেশের কোনো সংকোচ ছিল না। ২০০৭ সালের নয় জুন ওই সন্ধ্যায় কাটোয়া শহরে বসবে বঙ্গ সংস্কৃতির উৎসবের আসর। ভাষা শহিদ স্মারক সমিতির সভাপতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া আর কার অধিকার এই উৎসবের ফিতে কাটার! ঘরে - বাইরে যখন মরতে বসেছে আ-মরি বাংলা ভাষা, তখন তিনি বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক - - যিনি হাতে তুলে নিয়েছেন প্রতিরোধের গাণ্ডীব। তাই তো বাংলা কবিতার যুবরাজকে বরণের জন্য প্রস্তুত চৈতন্যভূমির নাগরিকজন।

বেলা দেড়টায় জুন মাসের আকাশে তাপের খরস্রোত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে কাটোয়া অভিমুখী আমরা চারজন। তিনি সামনের সিটে আর পিছনে আমার সঙ্গে দুই সফরসঙ্গী - কবি অসীম বিশ্বাস এবং সাংবাদিক রূপক মজুমদার। বোলপুর থেকে কাটোয়া এই দুই ঘণ্টার যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা কোনোকালেই ভুলব না। দেশজোড়া খ্যাতিমান একজন মানুষ কোন উচ্চতায় পৌঁছলে আমার মত অতি তুচ্ছ প্রাণির আবদার মেটাতে পারেন এককথায় - তা আমার অজানা। তাও তো তিনি সামনের সিটে বসে। আর প্রশ্নকর্তা পিছনে। তখন কৃষি বনাম শিল্পের দ্বৈরথে বাংলার বুধমণ্ডলী প্রায় আড়াআড়ি বিভক্ত। শঙ্খ ঘোষ থেকে জয় গোস্বামী, অভীক সরকার থেকে হর্ষ দত্ত - কে আসেননি সেই কথোপকথনে! আমার নানা প্রশ্নের বিপ্রতীপে তিনি যথেষ্ট খোলামেলা অথচ সংযত। এসব কথাবার্তা নিঃশব্দে রূপকের ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছে, কিন্তু তিনি উদাসীন। ভাষাকর্মীদের বারংবার দাবি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে মাতৃভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে নীরব। এ সম্পর্কে তাঁর মত, 'সরকার বোধহয় অবাঙালি ভোট হারানোর ভয় পাচ্ছে।' আবার নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে শঙ্খবাবুর সিদ্ধান্তকে ভুল বলতেও তাঁর গলা কাঁপেনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক কবিতায় প্রসঙ্গক্রমে এসেছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। 'তোমার করুণ ওষ্ঠে কতদিন চুম্বনের রেখা পড়েনি।' এ লেখার জন্য তাঁকে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। তবে ইংরেজি অনুবাদ পড়ে ইন্দিরা গান্ধী মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'নটি, ভেরি নটি।' সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ হলে তাঁকে নির্ঘাত জেলে পোরা হত।

কাটোয়ার সংস্কৃতিচক্র প্রাঙ্গণে তিনি উদ্বোধন করলেন ভাষা উদ্যানের। প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষা পিছু হটে যাওয়ায় তিনি যে কতটা বিচলিত, সেটা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর বক্তৃতার প্রতিটি ভাঁজে। মাতৃভাষা থেকে সরে যাওয়ার অর্থ যে জাতিসত্ত্বার অপমৃত্যু, জোরের সঙ্গে বলেছিলেন। সবার অনুরোধে নিজের গলায় পাঠ করলেন, 'চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।' তাঁর সঙ্গে ছিলেন সুবোধ সরকার, পঙ্কজ সাহা, চিত্রা লাহিড়ি, অংশুমান কর, স্বপ্নকমল সরকার। প্রবীণ লোকশিল্পীদের সংবর্ধনার সময় তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশের মুহূর্তে নাগরিক ভাঁড়ামি মুখ লুকিয়েছে লজ্জায়।

আসলে ছোট-বড় সব মানুষের জন্যই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বুকের দরজা ছিল খোলা। একটা ছোট ঘটনার উল্লেখে এই চির যুবকের সহজতা বোঝা যায়। কাটোয়ার কলম পত্রিকার পুজোসংখ্যার জন্য একটা কবিতা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তারপর কোনো কারণে কবিতাটা আনা হয় নি। শেষমেশ তাঁকে ফোনে কবিতাটা বলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। আমার অনুরোধকে তিনি স্পর্ধা ভেবে উড়িয়ে দেননি। তিনি ফোনে মফস্বলের এক অখ্যাত অক্ষরকর্মীকে কবিতা বলে যাচ্ছেন পরম ধৈর্যের সঙ্গে -- এ দৃশ্য অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।

এমন মানুষকে না ভালবেসে দূরে রাখা যায়?

1 টি মন্তব্য: